You dont have javascript enabled! Please enable it!

1976.04.23 | বাংলাদেশের টাকার মান এবং প্রকৃত আয় | সাপ্তাহিক বিচিত্রা 

ব্রাজিল, পেরু ও চিলির মত অনুন্নত দেশ মুদ্রাস্ফীতির হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে এক হাতিয়ারের ব্যবহার করছে৷ যতখানি মুদ্রাস্ফীতি জনিত মূল্য বাড়ে ততখানি আয় বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবসাই হচ্ছে এ হাতিয়ার। শুধু অনুন্নত দেশই নয়, ব্রিটেনের মত উন্নত দেশেও এ ব্যবস্থা চালু আছে৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মুহূর্ত থেকে জন্ম হয়েছে মূল্য বৃদ্ধি। অথচ আয়কে কোনভাবে বাড়ানো তো হয়নি, বরং তা প্রকৃত পক্ষে অনেকটা কমে গেছে।

গত সরকারের জাতীয় বেতন কমিশন অবশ্য উল্লেখিত ব্যবস্থা গ্রহণের শ্লোগান দিয়েছিলেন। তারা ১৯৭২ সালের জীবন যাত্রার খরচ সূচীর উপর নির্ভর করে বেতন নির্ধারণ করেছিলেন; অথচ যখন তা কার্যকরী হয়, তখন ১৯৭২ সালের তুলনায় ওই সূচী প্রায় একশত শতাংশ বেড়ে যায়। ফলে উক্ত শ্লোগান শুধু বাকপটুতা ছাড়া আর কিছুই বলে প্রমাণ হয়নি। ১৯৭০ সালে মধ্যবিত্তের আয় ছিল পাঁচশত টাকা, ১৯৭২ – এ তার আয় প্রকৃত পক্ষে মূল্য বৃদ্ধির ফলে হয় তিনশত টাকা। ১৯৭৩ সালে মূল্য আরও বাড়ে। ফলে যদিও তার বেতন হিসাবে পাঁচশ টাকাই ছিল, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে কমে গিয়ে দাড়ায় দুইশ পঁচিশ টাকায়৷ এভাবে আয় ধারাবাহিক ভাবে কমে ১৯৭৫ সালে হয় মাত্র দেড়শ’ টাকা। স্বাধীনতার আগে একজন পিয়ন বা তারও নিচের কর্মচারীর বেতন ছিল যেখানে দেড়শ টাকা, সেখানে এখন একজন অফিসারের প্রকৃত বেতন হয়েছে দেড়শ টাকা।

স্বাধীনতার আগে যাদের বেতন ছিল দেড়শ টাকা, তাদের বর্তমানের বেতন কত তা হিসেব করতে যাওয়া অসম্ভব। এবং তখনই বোঝা যায়, স্বাধীনতা উত্তর গত পাঁচ বছর অর্থনীতির কি ভয়ংকর রূপ গেছে।

এখানে আমরা একটি হিসাবের মাধ্যমে দেখাতে চেষ্টা করব, বিভিন্ন বেতন ভোগী শ্রেণীর বেতন ১৯৬৯-৭০ সালে কত ছিল এবং ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত কত হয়েছে।  সমস্ত হিসাবই জীবন যাত্রার খরচের হিসাবে করা হয়েছে।

               প্রকৃত হিসাবে বিবিন্ন শ্রেণীর বেতন (টাকায়)

১৯৬৯-৭০  ১৯৭২ ১৯৭৩ ১৯৭৪ ১৯৭৫ ১৯৭৬
জুন জুন জুন জুন জুন
৫০ ৩৩ ২৩ ১৫ ১১ ১৫
১৫০ ৯৯ ৬৮ ৪৬ ৩৪ ৪৫
২৫০ ১৬৫ ১১৩ ৭৭ ৫৭ ৭৫
৪০০ ২৬৪ ১৮০ ১২৪ ৯২ ১২০
৯০০ ৫৯৪ ৪০৫ ২৭৯ ২০৭ ২৭০

উপরে হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের জুন পর্যন্ত আয় ধারাবাহিক ভাবে কমে গেছে, ১৯৭৬ এর মার্চ মাসে উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে৷

প্রকৃত আয় কেন ভয়ংকর ভাবে হ্রাস পেল তা ব্যাখ্যা করলে নতুন কোন তথ্য পাওয়া যাবে না৷ আয় হ্রাসের মূল কারণই হলো মুদ্রাস্ফীতি। উৎপাদনে ব্যর্থতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন, রফতানীর অধঃগতি, মজুদদারী, চোরাচালানী ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে মুদ্রাস্ফীতি জন্ম – এ কথা বহুবার বিশ্লেষিত হয়েছে। এ ছাড়াও মুদ্রা নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতাবান পুরুষের অভাবও একটি কারণ ছিল৷ ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে আরও একটি বিষয়ে আলোচনা করা যায়।  দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানী নাকি গ্রেট ব্রিটেনের এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশের নকল মুদ্রা তৈরী করেছিল। জার্মানী কর্তৃপক্ষ গোপনে সেগুলি ওই সমস্ত দেশে ছেড়ে দিয়ে কৃত্রিম মুদ্রাস্ফীতি ঘটাতে চেষ্টা করেছিল। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল শত্রু দেশের ধ্বংস। অর্থনৈতিক স্থবিরতা। অর্থসংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারার ক্ষমতা এক ধরণের ভয়ানক আণবিক বোমার মত অস্ত্র। আরও জানা যায় কাশ্মীর ইতিহাস থেকে কিছু তথ্য। কাশ্মীরকে নিজেদের পক্ষে আনার জন্য পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশই নাকি পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ সরবরাহ করেছিল সংগ্রামী ও পাল্টা সংগ্রামীদের। এতে মুদ্রাস্ফীতি জন্ম হয়েছিল। এবং তা কিছুটা পরিকল্পিত ছিল বলে অনেকে মনে করেন।

সুতরাং মুদ্রাস্ফীতি ঘটাবার জন্য নকল মুদ্রা তৈরীর ইতিহাস কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটা দেশকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে দিয়ে তার পর গ্রাস করার কৌশলও ঐতিহাসিকদের অজানা নয়।

বাংলাদেশে নকল মুদ্রা তৈরীর প্রচুর প্রমাণ আবিষ্কার হয়েছে গত কয়েক বছরে। একই নম্বরে প্রচুর নোট পাওয়া গেছে ১৯৭২-৭৩ সালে যখন নোট ছাপা হয়েছিল ভারত থেকে। জনাব তাজউদ্দীনের ক্ষমতাকালে এ ধরণের আরও কেলেংকারীর কথা শোনা যায়। এ সমস্ত ঘটনা থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কি উদ্দেশ্যে পঙ্গু করার চেষ্টা হয়েছিল তার প্রচ্ছন্ন ধারণা পাওয়া যায়।

প্রকৃত আয়ের হিসাব মূলতঃ অর্থের মানেরই আর একটি দিক। অর্থের মানের পতনের মূলতঃ দুটি কারণে ঘটেছে। আভ্যন্তরীণ অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি ও তৎজনিত মূল্যবৃদ্ধির ফলে। অন্যটি হল আন্তর্জাতিক ব্যবসা থেকে বাংলাদেশের টাকার মূল্য হ্রাস। এ দুটি মুদ্রাস্ফীতির কারণ এবং প্রতিফল – উভয়ই।

বাংলাদেশের প্রকৃত আয় তৈরী করে এ বিশ্লেষণকে শেষ সম্পর্কিত একটি তালিকা করা যায়।  

  ১৯৬৯-৭০ ১৯৭১-৭৩ ১৯৭৩-৭৪
১। জিডিপি

(কোটি টাকায়

বর্তমান মূল্যে)

২৯২২ ২৫১৩ ২৯৪০
২। জনসংখ্যা

(লক্ষ)

৬৯২ ৭৪০ ৭৬২
মাথা পিছু আয়

(টাকায়)

৪২২ ৩৪০ ৩৮৬

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!