You dont have javascript enabled! Please enable it!

আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন বংগীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের এক অংশের নেতা ও কর্মিদের এক কনভেনশনে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। সভাপতি ছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ খান; সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক (টাঙ্গাইল); যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান (জেলে অন্তরীণ), খন্দকার মোশ্ আহমেদ; এ কে রফিকুল হোসেন এবং কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খান। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবমুর্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। এ দলের রয়েছে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, যুব ও মহিলা ফ্রন্ট। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল। জন্মলগ্নেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের উপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহন করে। পাকিস্তান আমলে গোড়ার দিকে দলের প্রধান দাবির মধ্যে ছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, একজনের এক ভোট, গণতন্ত্র, একটি সংবিধান প্রনয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যকার বৈষম্য বিলোপ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যূত করার জন্য অন্যান্য দলের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠনে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

এ নির্বাচনে ২৩৭ টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট পায় ২২৩ টি আসন (আওয়ামী লীগ ১৪৩) ও মুসলিম লীগ পায় ৯ টি। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ আতাউর রহমানের নেতৃত্বে প্রদেশে প্রায় দুই বছর ১৯৫৬-১৯৫৮) ক্ষমতাসীন ছিল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস (১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর) কোয়ালিশন সরকারের প্রধান অংশীদার ছিল। নানা চাপ ও অসুবিধা সত্ত্বেও এই সরকার গুলো বাঙালিদের ন্যায্য দাবীদাওয়া পূরণের প্রয়াস পেয়েছিল। এগুলোর মধ্যে জাতীয় পরিষদে যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তনে (১৪ অক্টোবর ১৯৫৬) সোহরাওয়ার্দীর সাফল্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

১৯৫৭ সালে পররাষ্ট্র বিষয়ে বিরাজমান মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে দলে ভাঙনের ফলে আওয়ামী লীগ কঠিন সংকটে পড়ে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী বেশ কিছুকাল ধরে রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করছিলেন। সোহরাওয়ার্দী পশ্চিমের বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোরাল সম্পর্ক রক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন আর মওলানা ভাসানী ছিলেন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির সমর্থক। আওয়ামী লীগের কাগমারি সম্মেলনে (৭-৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭) দলে বিভক্তির বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এই ভাঙনের ফলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়।
জেনারেল আইয়ুবের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকালে (১৯৫৮-১৯৬৯) আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে অগ্রসৈনিকের ভুমিকা পালন করে এবং শেখ মুজিবুর রহমান দলের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলনে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচী উপস্থাপন করেন। এই কর্মসুচির অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রাপ্ত বয়স্কের সার্বজনীন ভোটাধিকারের সুযোগ সহ কেন্দ্রে সংসদীয় ফেডারেল পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা; ফেডারেল ইউনিট গুলোর হাতে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা ব্যতীত সকল ক্ষমতা অর্পণ; পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক মুদ্রা প্রচলন; কর ও শুল্ক সংগ্রহের জন্য ইউনিটগুলোকে ক্ষমতা প্রদান। আইয়ুব সরকার এ কর্মসূচীর প্রতিক্রিয়া হিসেবে শেখ মুজিবুর সহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (১৯৬৮) দায়ের করে। ফলে ১৯৬৯ সালে গণ আন্দোলন শুরু হয় এবং আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে।

গন-আন্দোলন ও আইয়ুব পতনের পটভূমিতে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আইন সভায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০ আসন লাভের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসন পেয়ে আওয়ামী লিগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। দলটি জাতীয় পরিষদের মোট ৭ মহিলা আসনের এবং প্রাদেশিক পরিষদের মোট ১০ মহিলা আসনের সবগুলোতেই বিজয়ী হয়।

আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে মোট ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন লাভের সুবাদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেয়ার পরিবর্তে ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেয়। আওয়ামী লীগ ও দলের নেতা শেখ মুজিব ২ মার্চ (১৯৭১) থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে এক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে জনগণ তাতে সর্বাত্মক অংশগ্রহন করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে নিরস্ত্র বাঙালি জনগণের উপর পাকিস্তানি সৈন্যদের আকস্মিক আক্রমনের ফলে কার্যত পাকিস্তানের অখন্ডতা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে বিচারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ইতিমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত একটি প্রবাসী সরকার (মুজিবনগর সরকার) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে এবং ৯ মাসের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের পর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ দুই মেয়াদকালে মাত্র সাড়ে আট বছরের জন্য ক্ষমতাসীন ছিল। প্রথম মেয়াদে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬-২০০১ সালে। প্রথমবার আওয়ামী লীগকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি পুনর্গঠনের কথিন সমসযা মোকাবেলা করতে হয়। সারাদেশে লোকের বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছিল।
শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীগ লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যগুলোর মধ্যে উল্লেখ্য, স্বাধীন বাংলাদেশে স্নগবিধান প্রণয়ন (১৯৭২), মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠানো এবং বিশ্বের ১৪০ টি দেশের স্বীকৃতি লাভ। নতুন সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান ছিল আওয়ামী লীগের অপর একটি সাফল্য। নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ আসন লাভের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতার মধ্যে ছিল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় অব্যবস্থা, অবাধ দুর্নীতি দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জনয একটি বেপরোয়া পদক্ষেপ হিসেবে দেশে জরুরী অবস্থা জারি (১৯৭৪) এবং স্নগবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে একটিমাত্র জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) ভিত্তিক রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। বাকশাল পদ্ধতি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল। এ ব্যবস্থার সংগে যুক্ত হয়েছিল সরকারি পত্রিকা ছাড়া অন্যান্য পত্রিকা নিষিদ্ধকরণ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা সীমিতকরণের মত কঠিন আইন।
এই নেতিবাচক ঘটনাবলির সুযোগে কিছু সামরিক অফিসার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব ও তার সঙ্গে বসবাসরত পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের চার শীর্ষ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ,ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানের হত্যার ফলে আওয়ামী লীগের উপর আরেকটি বিপর্যয় নেমে আসে। অধিকন্তু ,সামরিক সরকার কর্তৃক ঘোষিত রাজনৈতিক দল প্রবিধানের আওতায় দলটি (১৯৭৬) হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দলে একটি ভাঙন দেখা দেয়।

বিশ শতকের আশির দশকের শুরুতে অবশ্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুণরায় সংগঠিত হতে থাকে। এ দল ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ৩৯ টি, ১৯৮৬ সালে ৭৬ টি এবং ১৯৯১ সালে ৮৮ আসন পায়। ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে অন্যান্য দলের সহযোগী আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ও অবিরাম আন্দোলনের সূচনা করে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে আওয়মী লীগ প্রথমে সংসদ বর্জন করে, তারপর সংসদ থেকে পদত্যাগ করে এবং ক্রমাগত হরতাল আহবান করে। এসব প্রয়াসের ফলে বিএনপি সরকার শেষ পর্যন্ত আওয়ামি লিগের প্রধান দাবী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন আনয়ন করে।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচণে আওয়ামী লীগ ১৪৬ টি আসন লাভ করে এবং ২৩ জুন ১৯৯৬ তারিখে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ ২০০১ সাল পর্যন্ত সরকার পরিচালনা করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দলের নেতৃত্বাধীন চার দলিয় জোটের নিকট ‘পরাজিত’ হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লীগ সরকার যেসব সাফল্য অর্জন করে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি (১৯৯৬) স্বাক্ষর, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি (১৯৯৭) সম্পাদন এবং ইউনিয়ন পরিষদ ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মহিলাদের সরাসরি অংশগ্রহনের ব্যবস্থাসহ নারীর ক্ষমতায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ।

[১২৯]                        হারুন-অর-রশীদ

রেফারেন্স: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (প্রথম খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!