You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের আলেখ্য শত্রুকে চরম আঘাত হানতে মুক্তিবাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত

(নিজস্ব নিবন্ধকার) সম্প্রতি বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর শিক্ষানবীশ অফিসারদের প্রথম দলটির শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। এই শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এম, এ, জি, উসমানি। তিনি অফিসারদের গার্ড অব অনারও পরিদর্শন করেন। এই অনুষ্ঠানে তার সাথে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান, এবং তথ্য। ও বেতার দফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিষদ সদস্য জনাব এ, মান্নান। | এই অনুষ্ঠানে ভাষণ দান কালে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এম. এ. জি. উসমানি মুক্তি বাহিনীর আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগনকে সব রকম অত্যাচার ঔপনিবেশিক শাসন শােষণ থেকে মুক্তি দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের কৃষ্টি, ভাষা ঐতিহ্য ও আচার ব্যবহারের কোন মিল নেই। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বলেন, পাকিস্তান আমাদের কাছে মৃত। বাস্তব এবং কল্পনায় পাকিস্তানের কোন অস্তিত্ব নেই। অতএব পূর্ণ স্বাধীনতা না হওয়া পর্যন্ত আমরা প্রতিজ্ঞা পালনে ব্যর্থ তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের বহু পার্থক্য থাকায় পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার কোন সমাধান আমরা মেনে নিতে পারি না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছমাস পূর্তি উপলক্ষে বিবৃতি প্রদান করে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক দৃঢ়কণ্ঠে যে কথা ঘােষণা করেন তার মধ্যে উপরিউক্ত মন্তব্যেরই প্রতিধ্বনি শােনা যায় ।

সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও সােভিয়েট প্রধানমন্ত্রী মিঃ কসিগিনের মধ্যে সম্পাদিত ভারত-রুশ চুক্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত যুক্ত বিবৃতিটিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে রাজনৈতিক সমাধানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসবাংলাদেশ সম্পর্কেও বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক মহল থেকে এ ধরনের প্রস্তাব এসেছে। এ সম্পর্কে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীশরণ সিং এর উক্তি সম্পর্কেও অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। রুশ ভারত চুক্তিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে রাজনৈতিক সমাধানের যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ এবং স্বাধীনতা সম্পর্কে কোন কোন মহল সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কোন কোন স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক মহল ছ দফা ভিত্তিতে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা মেনে নিয়ে বাংলাদেশ প্রশ্নের রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব দেন।  রুশ ভারত চুক্তি বাংলাদেশের জনগণ এবং বাংলাদেশ সরকার সানন্দ চিত্তে গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ সরকার এই চুক্তিটি অত্যন্ত যত্নের সাথে পরীক্ষা করে এক বিবৃতি প্রদান করেন। বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ সরকার এই চুক্তিটি পরীক্ষা করেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি শরণার্থীর জন্যে চুক্তিটিতে যে উদ্বেগ ও সমবেদনা প্রকাশ করা হয়েছে তার জন্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রদত্ত বিবৃতিটিতে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। | চুক্তিটিতে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আইনানুগ ও গণতান্ত্রিক অধিকারের ভিত্তিতেই কেবল রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব হতে পারে।  বাংলাদেশ সরকার চুক্তিটিকে এই মন্তব্যের জন্যেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। রাজনৈতিক সমাধান। সম্পর্কে সকলের মনে যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে তা নিরসনের জন্যে বাংলাদেশ সরকার তার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া কোন সমাধানই তাদের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে না।

সুতরাং পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে কোন রাজনৈতিক সমাধান মেনে নেয়ারও কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান কি এখন সম্ভব হতে পারে। বিশ্বের কয়েকটি শক্তি এশিয়ার এ অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য অবশ্য সব রকম চেষ্টা। করছে।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাগ্রত এশিয়ার এবং বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশের মুক্তিপাগল মনােভাবকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী চক্র বিশেষ ভাল নজরে দেখে নি। তারা ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতাকে তাই অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা চালায় এবং সফল হয়। তাদের চক্রান্তে ভারত উপমহাদেশে মারাত্মক ক্যান্সারের মত সৃষ্টি হল-পাকিস্তান। গণতান্ত্রিক ভারতকে শুধু পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরাই ভয় করে না-সমাজতান্ত্রিক চীন ও ভারতকে এশিয়াতে তার এক নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাব্যস্ত করছে। চীনও তাই ভারতকে জব্দ করার সুযােগ খুঁজছিল। তার পরিণতি হিসাবে ১৯৬২ সালে চীন ভারত সংঘর্ষ প্রভৃতি ঘটনা আজ আর কারও অজানা নেই। চীন মনে করে যে ভারতকে ঠাণ্ডা করতে হলে পাকিস্তানের টিকে থাকা অত্যন্ত প্রয়ােজন। চীনের উদ্দেশ্য হচ্ছে যে কোনভাবে ভারতকে অপদস্থ করা।  ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত সংঘর্ষের সময় চীন পাকিস্তানকে সমর্থন জানিয়েছে এবং ভারতকে হুমকি দিয়েছে এবারও তার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। চীন এবার পাকিস্তানকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করছে। মুক্তিবাহিনীর বীরযােদ্ধারা রােজই পাকিস্তানী সৈন্যদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে চীনা অস্ত্রশস্ত্র ও গােলা বারুদ উদ্ধার করছেন। বাংলাদেশের জনগণকে খতম করার জন্যে চীনা সামরিক উপদেষ্টাগণও পাকিস্তানী জল্লাদদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলে জানা গেছে।  সুতরাং চীন কিংবা পশ্চিমা শক্তিবর্গ বিশেষ করে আমেরিকা কিছুতেই চায় না পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাক। তারা মনে করে ভারতকে তাদের আজ্ঞাবহ করে রাখতে হলে পাকিস্তানকে রাখতে হবে। তাই তারা উঠে পড়ে লেগেছে পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চালিয়ে দেবার জন্যে। 

এদিকে পাকিস্তানের জঙ্গী চক্রও প্রভুদের প্ররােচনায় মেতে উঠে রণ হুঙ্কার ছাড়ছে। তারা কাশ্মীর ও বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ, বেসামরিক সরকার গঠনের প্রচেষ্টা বাংলাদেশে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ প্রভৃতি শেষ রক্ষা করার মত চেষ্টা করেও পাকিস্তানের জঙ্গী চক্র শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তারা শেষ রক্ষার চেষ্টায় সব শেষ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স এখনও বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে চীৎকার করে যাচ্ছেন। তারা চেষ্টা করছে বাংলাদেশ সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা বলে রূপ দিতে। কিন্তু এসব দিক দিয়ে ভারত সফল হতে পারে নি এবং পারবে না জেনে এখন যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছেন। তারাও জানে বিশ্বও জানে পাকিস্তানের জঙ্গী চক্রও জানে আমরাও জানি পাকিস্তান মৃত। আমরা নেপথ্য জগতে বিশ্বাস করি না-আমরা অশরীরী পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের হুঙ্কার গর্জনে ভয় পাই না। বরঞ্চ আমরাই এখন বলতে পারি বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি থেকে শত্রুকে সমূলে উচ্ছেদ করার জন্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। সপ্রতি বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান জানিয়েছেন যে মুক্তিবাহিনীর বিমান বহরও তৈরী রয়েছে। অনতিবিলম্বে তারা শত্রুদের উপর আঘাত হানবেন। মুক্তিবাহিনীর সাফল্যে পাকস্তানী জঙ্গী চক্র নাজেহাল হয়ে পড়েছে। তাদের পক্ষে মৃত্যুর হার রােজই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানে জনগণের মধ্যে প্রতিদিন-ই অসন্তোষ প্রকট হয়ে উঠছে। দিশেহারা ইয়াহিয়া তাই পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় তার প্রভুদের হুকুম তামিল করার চেষ্টায় তার স্বৈরাচারী আইউবের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করছে। ইয়াহিয়া মনে করে বাংলাদেশ প্রশ্নে কোন সমাধান মেনে নিলে পাকিস্তানের জনণগও বিশ্ব জনমত তাকে রেহাই দেবে না। তাই সে পুরােনাে চাল চেলেছে-ভারতের সাথে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে।  সে বুঝেছে কোন চক্রান্তই পাকিস্তানকে টপকিয়ে চলতে পারবে না এবং বাংলাদেশের জনগণও পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে কোন রাজনৈতিক সমাধান মেনে নেবে না।

পৃথিবীর মানুষ এবং ভারত সরকারও জানেন বাংলাদেশের জনগণ বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ঐ জাতীয় সমাধানে সাড়া দেবেন না। শত্রুকে চরম আঘাত হানতে মুক্তিবাহিনী এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। মুক্তিবাহিনীর বীরযােদ্ধারা বাংলাদেশ থেকে হানাদারদের সমূলে উচ্ছেদ করার জন্যে দিন গুনছেন। আমরা আবার বিশ্বের শক্তি বর্গের কাছে অনুরােধ করছি তারা যদি আমাদের কোন সাহায্য না করেন, অন্ততঃপক্ষে তারা যেন নিরপেক্ষ থাকেন। মুক্তিবাহিনী কারও সাহায্য ছাড়াই বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত করতে সম্পূর্ণ সক্ষম। বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রীর মত আমরাও বলতে চাই বাংলাদেশ থেকে শত্রু উচ্ছেদ করার জন্য আমাদের সাহায্য না করে অন্ততঃপক্ষে আমাদের ধ্বংস হওয়ার সুযােগ দেয়া হােক।

সাপ্তাহিক বাংলা । ১: ৪

১১ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!