আঘাত আঘাত আরাে জোরে আঘাত করাে
— সুনীল সরকার
আমাদের মুক্তিবাহিনীর তীব্র পাল্টা আক্রমণে জঙ্গীশাহীর ভাড়াটিয়া দস্যুরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বাঙলাদেশের সর্বত্র স্থল ও নৌ-যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ, ব্যাঙ্ক-পপাস্ট অফিস অৰ্দ্ধরুদ্ধ এবং লুটেরা দস্যুদের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। বােমা গ্রেনেড আর মাইন বিস্ফোরণে জাহাজগুলি একের পর এক জলের তলে গিয়ে ঠেকছে, সেতু, কালভার্ট, সেনা-শিবির উড়ে যাচ্ছে, রেলগাড়ির ইঞ্জিন বগী উল্টে পড়ছে, কোম্পানির পর কোম্পানি হানাদার বাহিনীর ফৌজেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। সামরিক কর্তৃপক্ষের এন্তার কড়া ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রী-প্রাক্তনমন্ত্রী, গভর্ণর পর্যন্ত কুপােকাত হয়ে পড়েছেন-ফলে বর্বরশাহীর গদীলােভী কুকুরদের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে চেঙ্গিস খাঁর বংশধর বেসামাল ইয়াহিয়া বাংলাদেশ প্রশ্নে আপস করার জন্য যখন পিণ্ডি-তেহরান করে অবশেষে উন্মাদের মত চৌ-নিকশনের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন-তখন হানাদারদের লুটেরা দস্যুর উপর আঘাত, আঘাত, আরাে জোরে আঘাত করাে। বাংলাদেশ সরকার দেশবাসীর মানসিকতাকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে সুস্পষ্ট ঘােষণা করেছেন, ‘পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাঙলাদেশের পক্ষে কোন রাজনৈতিক সমাধানই গ্রহণযােগ্য হবে না।’ কিন্তু স্বাধীনতা শিশুর হাতের মােয়া নয়, এবং কেউ এসে তা দিয়েও যাবে না, কঠিন আত্মত্যাগ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই রক্তের রাঙা নদীতে ফুটে উঠবে স্বাধীনতার রক্তপদ্ম। দুর্বল স্থানে আঘাত করাে শত্রুবাহিনীর শক্তি যেখানে সংহত, ঘাঁটি যেখানে শক্ত, সেখানে নয়, ছােট ছােট সেনা ছাউনি এবং রাজাকারদের উপর একই সময়ে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ চালাও প্রস্তুতি নেবার আগেই অতর্কিতে হামলা চালিয়ে হানাদারদের খতম করতে হবে। সব সময় শত্রুর দুর্বলতম স্থানে এবং দুবর্লতম মুহূর্তে আঘাত করতে হবে।
জঙ্গীশাহীর দুর্বলতম মুহূর্তে সমুপস্থিত-শত্রুর উপর আঘাত করার এটাই উপযুক্ত সময়। উচ্ছিষ্টভােজীদের নিচিহ্ন করাে ইয়াহিয়ার যে-সব পা-চাটা কুকুর এবং উচ্ছিষ্টভােজী ও সদা লােভী পশু বাঙলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য পায়তারা দিচ্ছে, সেইসব মীরজাফর এবং সমাজের রক্তচোষা পরগাছাদের নিশ্চিহ্ন করে দাও। বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের রায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে প্রকৃত গণপ্রতিনিধিদের গ্রাস করার জন্য যারা ইয়াহিয়ার সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে দাঁতে শান দিচ্ছে, প্রচণ্ড আঘাত হেনে তাদের হিংস্র পাশব বিষ দাঁত উপড়ে ফেলে দাও। বাঙালী জাতির এইসব দুষ্টব্রণকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মধ্যেই নিহিত সুস্থ ও আদর্শ বাঙলার ভবিষ্যৎ। বিমান ও সামুদ্রিক বন্দরের উপর আঘাত হাননা দখলদার বাহিনীর খাদ্য ও অস্ত্রসহ যাবতীয় সরবরাহের মূল পথ বাঙলাদেশের দখলীকৃত অঞ্চলের বিমান সামুদ্রিক বন্দরগুলির উপর আঘাত হাননা। শত্রুকে দুর্বল করার মূল মন্ত্রই হােল তাদের সরবরাহ ও যােগাযােগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দেওয়া। বাঙলাদেশ থেকে হাত গুটাও মােগল-পাঠান, ইংরেজ-পতুর্গীজ, মগ-মঙ্গোল-যেই রূপসী বাঙলার উপর বর্বরের মত ঝাপিয়ে পড়েছে, তাকেই হনুমানের দশা নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। তথাপি ইয়াহিয়ার সঙ্গে দোস্তি করে যারা বাঙলাদেশের প্রতি হাত বাড়াচ্ছে, তাদেরকে আমরা হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি-যদি ভালাে চাও, তবে বাঙলাদেশ থেকে হাত গুটাও। নচেৎ আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা তার এমন জবাব দেবে যে, ইহ জীবনে তা ভুলতে পারবে না।
মুক্তিযােদ্ধারা অচিরেই বিমান হামলা শুরু করবে। বাঙলাদেশের অধিকৃত অঞ্চল সমূহ হানাদার মুক্ত করার জন্য অচিরেই মুক্তিযােদ্ধারা বিমান হামলা শুরু করবে। আশা করা যাচ্ছে আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে আমাদের বিমানবাহিনী দখলদারদের নিয়ন্ত্রিত সামরিক ঘাঁটির উপর প্রচণ্ড আঘাত হানতে শুরু করবে। আমাদের বিমানবাহিনী মােটামুটি শক্তিশালী। এবং একে আরাে শক্তিশালী করার জন্যও জোর প্রচেষ্টা চলছে। স্বাধীনতা আমাদের চাই-ই জনযুদ্ধের হাত আরও তীব্রতর করতে হবে, আঘাতকে করতে হবে কঠিনতর কারণ, স্বাধীনতা আমাদের চাই-ই। এ যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ-জাতি হিসাবে বাঙালী তার আপন সত্তা নিয়ে টিকে থাকবে; না পৃথিবীর মাটি থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। জয় করে নাও জয়ের মালা পূবের আকাশে স্বাধীনতার রক্তসূর্য উদয়ের পূর্বাভাস ফুটে উঠেছে। এ মুহূর্তে শান্তি নেই—জোরে, আরও জোরে সুমুখ পানে এগিয়ে চলাে। মুক্তিসেনাদের শঙ্কাহীন অভিযানের পায়ে পায়ে জড়িয়ে আছে দানব নিধন ও সারা বাঙলার মরণ-জয়ের প্রার্থনা। এবার শুধু শত্রুর উপর চরম আঘাত হেনে জয় করে নাও জয়ের মালা।
সাপ্তাহিক বাংলা ১: ৪
১১ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯