You dont have javascript enabled! Please enable it!

রক্তে রক্তে লাল হয়ে ওঠে পূর্ব কোণ

(পূর্ব রণাঙ্গণ থেকে জাহাঙ্গীর আলম প্রেরিত) পূর্ব রণাঙ্গণে কুমিল্লা জেলার সালধানদীর তীর। উপরে নীল আকাশ। নীচে বঙ্গশার্দুলদের অস্থায়ী আস্তানা । মাত্র একটি রাত কাটাবে ওরা। পশু হত্যার জন্যে মানবতার শত্রুকে নিপাত করার জন্যে। হঠাৎ পাশের গ্রাম থেকে জমাটবাধা চিৎকার শােনা গেল। রাজাকার হানা দিয়েছে সে গ্রামে। লুটে পুটে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামের ধনসম্পদ, সােনা-দানা। প্রাণপণে বাধা দিচ্ছে গ্রামের জনগণ। কিন্তু সে বাধার সাধ মানছে না। প্রবল চিত্মার আর রাইফেলের গুলির আওয়াজে অগ্নি শপথে দীপ্ত বঙ্গশার্দুলের দল রুখে চলে সেই গ্রামেরই দিকে। হাতে ওদের হালকা মেশিনগনি, রাইফেল। এগিয়ে চলে ওরা দ্রুত থেকে দ্রুততর। গ্রামের পূর্বাপ্রান্তে তখন জোট বেঁধে বসে আছে রাজাকার দল। মুক্তিযােদ্ধারাও ততক্ষণে পৌছে গেছে গ্রামের পূর্ব প্রান্তে। অকস্মাৎ কড়কড় করে উঠলাে মুক্তি যােদ্ধাদের হালকা মেশিনগান। প্রচন্ড আক্রমণ আর অব্যর্থ গুলির সম্মুখে রক্ষা পেলােনা রাজাকারদের কেউ। এমন কি এগিয়ে এলােনা কেউ ওদের রক্ষা করতে। মুক্তি যােদ্ধারা চলে গেলাে রাজাকারদের অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে। গ্রামের অসংখ্য নরনারী দেখতে এলাে তাদের। কিন্তু না, তাদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে কেউ ফেললােনা দুফোটা অশ্রু। বরং  তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এতােদিন যারা শুভক্ষণের প্রতীক্ষায় ছিলাে, মারমুখাে হয়ে এগিয়ে গেল তারা। পদাঘাত করতে থাকলাে মৃত্যুশর্যায় শায়িত রাজাকারদের উপর।  রাত তখন ন’টা। গাড়ী আসার সময় হয়ে গেছে। দূর থেকেই গাড়ীর আলাে দেখা যায়। সালধানদী রেলওয়ে ষ্টেশনটির অদূরেই রেল লাইনের দুপাশের নীচু জায়গায় ‘পজিশন নিয়ে বসেছিলাে মুক্তিযােদ্ধারা। গাড়ীটা পাশকেটে যেতেই গর্জে উঠলাে ওদের মেশিনগান। মশারীর ছিদ্রের মতাে ছিটেটুটে গেল প্রতিটি বগী। কিন্তু তখনাে শােনা যাচ্ছিলাে আহত পাক সেনাদের আর্তনাদ। 

রাত তিনটে বেজে গেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের মনে দারুণ চঞ্চলতা। একটা সংকীর্ণ খাল ধরে নৌকোয় করে এগুচ্ছিল ওরা। বুকের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। শত্রু নিধনের অভিযানে বেরিয়েছে ২৪ জন মুক্তি সেনা। দুপাশের ধানক্ষেতে প্রায় হাঁটু জল। খানিকটা দূরে শত্রু ছাউনী। নৌকো থেকে নেমে পড়লাে মুক্তি যােদ্ধারা। নুয়ে ধান গাছের আড়ালে থেকে ছাউনীর চারিদিক ঘিরে ফেলে এরা। আক্রমণ শুরু হলাে মুক্তি সেনাদের। অত্যাচারীর দম্ভকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে গর্জন করছে মুক্তিবাহিনীর রাইফেল, হালকা মেসিনগান। হতভম্ব পাকসেনারাও চালালাে পাল্টা আক্রমণ। চললাে এদের এলােপাথারী গুলী চুঁড়াছুঁড়ি। কিন্তু জানে না কোন দিক থেকে আক্রমণ চালিয়েছে মুক্তি যােদ্ধারা। | মাঝে মাঝে গুলি ছােড়া বন্ধ করে প্রয়ােজন মতাে স্থান পরিবর্তন করেছে মুক্তি সেনারা। তাদের এমনি অবস্থান পরিবর্তনে আরও বিপর্যস্ত, দিশেহারা হয়ে পড়ে পাক সেনারা। বেসামাল হয়ে দু’একজন পাকসেনা অস্ত্র ফেলে দিয়ে পালাবার চেষ্টা করলাে। কিন্তু না, পারলাে না। মুক্তি যােদ্ধাদের অব্যর্থ গুলি লক্ষ্য ভেদ করছে। বেশ কয়জন খানসেনা গুলি খেয়ে পড়ে গেছে ইতিমধ্যেই। আর্তনাদ করছে আঘাতের যন্ত্রনায় । প্রায় তিনঘণ্টা চললাে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণ। এবারে পাকসেনাদের গুলি ছােড়া বন্ধ হয়েছে। গুলি শেষ হয়ে গেছে ওদের। যুদ্ধের সাধ মিটে গেছে চিরতরে। এসেছিলাে এরা বাংলাকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু এবারে পেলাে তার দাঁতভাঙ্গা জবাব। পরদিন সূর্য উঁকি দিতে না দিতেই বলদা বাজারে পত পত করে উড়তে থাকলাে স্বাধীন বাংলার পতাকা।

সাপ্তাহিক বাংলা : ৪ ৪

১১ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!