বেগমগঞ্জের জনসভায় শেখ মুজিব :
ছয়-দফা ১৮ বছরের অবিচারেরই স্বাভাবিক পরিণতি
(ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি)
বেগমগঞ্জ (নোয়াখালী)
২৭ শে ফেব্রুয়ারি—অদ্য বেগমগঞ্জ দীঘিরপাড়ে এক বিরাট জনসমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে অবিলম্বে আওয়ামী লীগের ৬-দফা মানিয়া লইয়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার চিরন্তন ভুল বােঝাবুঝির অবসান মিটাইবার। আহ্বান জানান। সহস্র সহস্র শ্রোতার তুমুল করতালির মধ্যে তিনি ঘােষণা করেন। যে, ৬-দফা দাবী উত্থাপনের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগের কেহ ব্যক্তিগত কোন আকাংক্ষা চরিতার্থ করিতে চায় না এবং সরকার যদি এই ৬-দফা মানিয়া নেন, তবে ‘আমি আদালতে হলপ করিয়া লিখিত চুক্তি সম্পাদন করিয়া আজীবন রাজনীতি হইতে অবসরগ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছি। যুদ্ধোত্তরকালে-বিশেষ করিয়া আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে আওয়ামী লীগ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট ৬-দফা দাবী উত্থাপনের পর নােয়াখালী জেলার এই সভা সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া প্রতীয়মান হয়। জনসভায় জনসমাগম এবং বক্তাদের বক্তৃতার পর্যায়ে পর্যায়ে সহস্র কণ্ঠের পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি সনদ ৬-দফা মানিতে হইবে’ ধ্বনির মধ্যদিয়া জনসাধারণ তাহাদের আশা ও আকাংক্ষার বায় অভিব্যক্তি ঘটাইয়াছে। দূর-দূরান্ত হইতে দ্বিপ্রহরের দিকেই জনতা মিছিল করিয়া সভাস্থলে আগমন করে এবং নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শােনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে।
শেখ মুজিবর রহমান বক্তৃতা মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতা শহীদ সােহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’, ‘৬-দফা দাবী মানতে হবে’, ইত্যাদি ধ্বনিতে আকাশবাতাস মুখরিত করিয়া তােলে। বক্তৃতার প্রারম্ভে শেখ সাহেব আবেগপ্রবণ কণ্ঠে নােয়াখালীর মাটি ও মানুষের সঙ্গে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সুমধুর সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, নােয়াখালীর প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর অবিস্মরণীয় স্মৃতি জড়িত। শহীদের অমর স্মৃতির প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাইয়া তিনি আওয়ামী লীগের ৬-দফার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন।
শেখ মুজিব বলেন যে, বিগত ১৮ বৎসর প্রায় সব কয়টি কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে অবিচার করিয়াছে, তাহারই অত্যন্ত স্বাভাবিক পরিণতি এই ৬-দফা দাবী। তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে
সতর্ক করিয়া দিয়া বলেন যে, যে গতিতে আজও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবিচারকে অব্যাহত রাখা হইয়াছে, এখনি যদি তা বন্ধ না করা হয় তবে ৬-দফার চাইতেও ভয়াবহ পরিণতির জন্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহলকে তৈরী থাকিতে হইবে। কারণ দর্শাইয়া তিনি বলেন যে, আজ যাহারা ৬-দফা দাবী উত্থাপন করিয়াছেন তাঁহারা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে পাকিস্তান সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রতভাবে জড়িত ছিলেন। তাই পাকিস্তানের জন্য তাঁদের মায়া আছে। পাকিস্তানকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী করিয়া গড়িয়া তােলাই তাঁহাদের রাজনৈতিক জীবনের উদ্দেশ্য। কিন্তু পাকিস্তান সংগ্রামের এইসব বীর সেনানীর প্রায় সবাইর জীবন শেষ হইয়া আসিয়াছে। তাহাদের মৃত্যুর পর যাহারা আসিতেছে তাহারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার ভুল বােঝাবুঝিকে এবং পূর্ব পাকিস্তানের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যকার ভুল বােঝাবােঝিকে এবং পূর্ব পাকিস্তানের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের অবিচারকেই প্রত্যক্ষ করিয়াছে। তাহারা এই ভুল বােঝাবুঝি আর অবিচার অবসানের দাবী জানাইয়া যে প্রস্তাব করিবে তাহা ভয়াবহ পরিণতিশীল হইতে বাধ্য। ভাবীকালের এই ভয়াবহ পরিণতির কথা ভাবিয়াই আজ দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হইবে এবং সুদূরস্পর্শী দৃষ্টি লইয়াও ৬-দফাকে বিচার করিয়া দেখিতে হইবে।
শেখ মুজিব ঘােষণা করেন যে, ৬-দফা প্রস্তাব উত্থাপনের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ দল হিসাবে কোন রাজনৈতিক উচ্চাশা চরিতার্থ করার প্রয়াসী হয় নাই। এই দাবী উত্থাপন করিয়া আওয়ামী লীগ বাহবাও পাইতে চায় না। কারণ, এ দাবী সস্তা রাজনৈতিক শ্লোগান মাত্র নয়, এ দাবী শুধু পূর্ব পাকিস্তানেরও দাবী নয়। তিনি বলেন যে, ৬-দফা দাবী পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উভয়েরই দাবী। ৬-দফা বাস্তবায়িত হইলে এই ৬-দফার শর্তানুযায়ী সুযােগ-সুবিধা শুধু পূর্ব পাকিস্তানই ভােগ করিবে না, পশ্চিম পাকিস্তানও একই সুযােগ-সুবিধার ভাগী হইবে। তিনি অপরাপর রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের প্রতি এক জিজ্ঞাসা তুলিয়া ধরিয়া বলেন যে, ৬-দফার মাধ্যমে কি এমন জিনিস পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বেশী চাওয়া হইয়াছে যা একেবারেই দেওয়া যায় না। ইসলামের দোহাই দিয়া আজ যাহারা ৬দফার বিরুদ্ধাচারণ করিতেছেন তাহাদেরকে শেখ মুজিব স্মরণ করাইয়া দেন যে, ইসলাম নির্বিচারে সকলের প্রতি ইনসাফ করার বিধান দিয়াছে কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার কি এতদিন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ইনসাফ করিয়াছে? যারা ইসলামের নামে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ইনসাফ করিতে সরকারকে বাধ্য করিতে পারে নাই, তাদের ইসলামের দোহাই দিয়া ইনসাফ লাভের পথ রুখিয়া দাঁড়াইবারও কোন অধিকার নাই।
শেখ মুজিব ৬-দফা দাবী আদায়ের নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামে প্রতি ইউনিয়নে মাত্র তিনজন করিয়া দৃঢ়সঙ্কল্প কর্মী তৈরীর আহ্বান জানান। তিনি ঘােষণা করেন। যে, প্রতিটি ইউনিয়ন যদি সংগ্রামে তিনজন করিয়া কর্মী দেয়, তবে ইনশাল্লাহ তিন
বছরের মধ্যে ৬-দফা দাবী আদায় হইবে। শেখ মুজিব দেশবাসী আপামর জনসাধারণের প্রতি নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের ডাক জানাইয়া বলেন যে, আপনাদের বর্তমান অবস্থা, সমাজের প্রতি স্তরে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ, দেশের বেকার সমস্যা, রাজনৈতিক হালচাল- যেদিকেই তাকান না কেন, সেদিক হইতেই আপনারা সংগ্রামের হাতছানি দেখিতে পাইবেন। তাই, এখনই সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ন, নয় আর কখনাে দাবী আদায়ের সুযােগ আসিবে না।
আওয়ামী লীগ নেতা খােন্দকার মােশতাক আহমদ বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, ৬-দফা দাবী পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির সনদ কি-না, তাহাই আজ সকল মহলের বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত। কার কণ্ঠে বা কোন দলের মারফৎ এ-দাবী উত্থাপিত হইয়াছে, সে সঙ্কীর্ণতার মধ্যে না যাওয়ার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরােধ জানান। তিনি বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ এ দাবীর বিরােধী নয়। কারণ, এ-দাবী আদায় হইলে পূর্ব পাকিস্তান যেমন সুবিধা লাভ করিবেন, পশ্চিম পাকিস্তানও একই সুবিধার অধিকারী হইবে। তিনি শ্রোতাদের স্মরণ করাইয়া দেন যে, ন্যায্য দাবীর সামনে সবসময়ই প্রবল বাধা সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু ঐ সব বাধা যত প্রবলই হােক না কেন, ন্যায্য দাবীর পথে উহা বেশীদিন টিকিয়া থাকে না।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের অবতারণা করিয়া তিনি বলেন যে, বিরুদ্ধবাদীরা যত দৃঢ় বাধার সৃষ্টি করিয়াছে ততাে বেশী শক্তি সঞ্চয় করিয়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কামিয়াবির পথে আগাইয়া গিয়াছে।
জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসাবে তাহার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার প্রকৃত প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচারের ‘পাম্প’ হিসাবে নিজেদের ব্যবহার করিতেছে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরীও সভায় উপস্থিত ছিলেন।
শেখ মুজিবের ঢাকা প্রত্যাবর্তন
চট্টগ্রাম ও নােয়াখালী জেলা সফর শেষ করিয়া শেখ মুজিব গতকল্য (সােমবার) সন্ধ্যায় মােটরযােগে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁহার সঙ্গে খােন্দকার মােশতাক আহমদ এবং জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরীও ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন।
প্রাদেশিক পরিষদে বিরােধী দলের নেতা ও নােয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব আবদুল মালেক সভাপতিত্ব করেন। জেলা লীগের সহ-সভাপতি জনাব আবদুর রশিদ সভার পক্ষ হইতে কতিপয় প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সভা সর্বসম্মতি ক্রমে তাহা অনুমােদন করে। জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব নুরুল হক এম. পি. এ, অতিথিদের ধন্যবাদ জানাইয়া বক্তৃতা করেন।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১ মার্চ ১৯৬৬