You dont have javascript enabled! Please enable it!

দেশবাসী যাহাতে স্বাধীনতার সত্যিকারের স্বাদ ভােগ করিতে পারে ১৯৬৬
আওয়ামী লীগের ৬-দফা দেশবাসীর ইন্দিত সেই
শক্তিশালী পাকিস্তানেরই সুস্পষ্ট রূপরেখা
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ কর্মী সমাবেশে শেখ মুজিবের বক্তৃতাঃ
দলীয় কর্মসূচীর কি ও কেন’ ব্যাখ্যা

(ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি)
৬ চট্টগ্রাম, ২৬শে ফেব্রুয়ারি, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার নহে, শক্তিশালী পাকিস্তানই ছিল দেশবাসীর বরাবরের কাম্য। স্বার্থান্বেষী মহলের শাঠ্য ও চক্রান্তের মারপ্যাচে জনগণের সেই কামনা বরাবরই স্তিমিত হইয়া পড়িয়াছে। এবার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত মাত্র ১৭ দিনের যুদ্ধে দেশবাসী যে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছে, সেই সাক্ষাৎ-অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই দেশবাসী আজ নূতন করিয়া অনুধাবন করিয়াছে যে, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার নহে কেবলমাত্র শক্তিশালী পাকিস্তানই পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের নিবিড় ঐক্য ও সংহতির একমাত্র রক্ষাকবচ। আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচী প্রকৃত প্রস্তাবে দেশবাসী জনসাধারণের ঈপ্সিত সেই শক্তিশালী পাকিস্তানেরই সুস্পষ্ট রূপরেখা। রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে এই রূপরেখার বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগের ৬-দফার দাবী লইয়া গ্রামে গ্রামে আপনারা ছড়াইয়া পড়ন।”—অদ্য স্থানীয় জে, এম, সেন হলে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বার্ষিক সম্মেলন ও কাউন্সিল সভায় সমাগত সহস্রাধিক আওয়ামী লীগ কর্মীর উদ্দেশ্যে বক্তৃতা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান এই উদাত্ত আহ্বান জানান। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান বলেনঃ অতীতের মত ভবিষ্যতেও গণতন্ত্রকে যাতে কায়েমী। স্বার্থের শিকারে পর্যবসিত হইতে না হয়, দেশবাসীকে যাতে গণতন্ত্র কায়েম থাকা। অবস্থায়ও মহল বিশেষের অনুগ্রহ বা অনুকম্পার উপর নির্ভর করিতে না হয়। গণতন্ত্র মতে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে যাতে ব্যক্তি বা গােষ্ঠী বিশেষ নিজের বা। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য খতম করিতে না পারে, সর্বোপরি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হইলে দেশবাসী যাতে অনন্তকাল ধরিয়া স্বাধীনতার সত্যিকারের স্বাদ জীবনের সর্বস্তরে ভােগ করিতে পারে তার জন্যই আওয়ামী লীগ গত ১৮ বৎসরের শাসন ও শােষণের, নির্যাতন ও বঞ্চনার আলােকে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬দফা প্রণয়ন করিয়াছে।

আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কি?
শেখ মুজিবর রহমান বলেনঃ এ যাবৎ আমরা পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলিয়াছি, কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের এই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীর তাৎপর্য বা অন্তর্নিহিত লক্ষ্য সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের এবং পূর্ব পাকিস্ত নের কোন কোন নেতা কোনদিন আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই। তাই, আজ আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য ৬-দফার মধ্যদিয়া স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিয়াছি যে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্থে আমরা কি বুঝি। দেশবাসীকে কেবল ধোকা দিবার নিমিত্ত আজও যাঁরা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ফাঁকা শ্লোগান তােলেন, তাঁদের বুঝা উচিত যে, ফাঁকা বলির যুগ শেষ হইয়াছে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্থে তারা কি বােঝেন বা বুঝাইতে চাহেন, আওয়ামী লীগের ৬-দফার পাশাপাশি দফাওয়ারীভাবে আজ তাহাদিগকে তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিতে হইবে। যদি তাহারা তাহা না করেন, তাহা হইলে তাঁহাদের কথাকে দেশবাসী রাজনৈতিক কারচুপি এবং পূর্ব পাকিস্তানকে ভাঁওতা দেওয়ার আরেক দফা নূতন প্রয়াস বলিয়া গণ্য করিবে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে, জেলার দূরবর্তী এলাকা হইতে আগত এক সহস্রাধিক সঙ্কল্পদৃঢ় আওয়ামী লীগ কর্মীর সমাবেশে শেখ সাহেব বক্তৃতা করিতেছিলেন।

বৈষম্যের প্রশ্নে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের লইয়া কমিশন গঠনের দাবী
শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, বর্তমান শাসনতন্ত্রে দুই প্রদেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য স্বীকার এবং উহা দূরীকরণের অঙ্গীকার করা হইলেও বাস্ত বক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাস পাইতেছে না। তিনি বলেন যে, বর্তমানে বরং অধিকতর নৈপুণ্যের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই দুই প্রদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাইতেছে। শেখ মুজিব বলেন যে, স্বাভাবিকতার কদর থাকিলে তিনি এ ব্যাপারে তদন্ত কমিশনই দাবী করিতেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন। কমিশনের রিপোের্ট যেভাবে দিবালােকের মুখ দেখিবার মওকা পায় না, এবং এই সেদিনও ঈদের চাঁদ সংক্রান্ত ব্যাপারে গঠিত কমিটির ৭ দিনের মধ্যে রিপাের্ট পেশের ব্যাপারটিও যেভাবে ধামাচাপা পড়িয়াছে তাহাতে তিনি আর তদন্ত কমিশন দাবী করেন না। তৎপরিবর্তে তিনি জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের লইয়া একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করিয়া দুই প্রদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের হিসাব করার জন্য সরকারের নিকট দাবী জানানই বাঞ্ছনীয় মনে করেন।

অন্যান্য দল সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতি
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতি আওয়ামী লীগের নীতি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, যেসব দল ৬-দফায় বর্ণিত দাবী-দাওযার স্বীকৃতি দিবেন, সেইসব দলের সঙ্গে সহযােগিতা করিতে আওয়ামী লীগ সর্বদাই প্রস্তুত। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং অন্যান্য দাবী পূরণের ব্যাপারে অপর কোন রাজনৈতিক দল আমাদের এই ৬-দফা অপেক্ষাও উন্নত কোন প্রস্তাব পেশ করিতে পারিলে আওয়ামী লীগ সানন্দে তাহা বিবেচনা করিতে প্রস্তুত বলিয়া শেখ মুজিব ঘােষণা করেন। তিনি ঘরে ঘরে ৬-দফার বাণী পৌছাইয়া দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।

দৈনিক ইত্তেফাক, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!