You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966 | বিগত যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার আলােকে ৬-দফার সারবত্তা যাচাই করুন, বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি শেখ মুজিবের আহ্বান | দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ - সংগ্রামের নোটবুক

বিগত যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার আলােকে ৬-দফার সারবত্তা যাচাই করুন

বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি শেখ মুজিবের আহ্বান

 

বিগত যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার আলােকে ৬-দফার সারবত্তা যাচাই করুন ১৯৬৬ বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি শেখ মুজিবের আহ্বান :
শক্তিশালী কেন্দ্রের প্রবক্তাদের প্রতি একটি সুস্পষ্ট জিজ্ঞাসা
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
গতকল্য (বৃহস্পতিবার) আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করেন যে, রাজনীতিতে মধ্যপন্থায় আর বিশ্বাস করা চলে না। তাই দেশের বৃহত্তর কল্যাণের কথা চিন্তা করিয়াই তিনি জাতির সামনে ৬-দফা সুপারিশ তুলিয়া ধরিয়াছেন। এই ৬-দফা কোন রাজনৈতিক দরকষাকষি নয়, কোন রাজনৈতিক চালবাজিও নয়—এই ৬-দফার সহিত পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ অধিবাসীর জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত। আমি বিশ্বাস করি যে, এই ৬দফার বাস্তবায়নের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা-তথা পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি সুসংবদ্ধ করার শ্রেষ্ঠতম গ্যারান্টি নিহিত।
শেখ মুজিবর রহমান সাংবাদিকদের বলেন যে, তাঁহার ৬-দফা সুপারিশ পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী শতকরা ৫৬ ভাগ অধিবাসী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদের মধ্যকার সংঘাতেরই প্রশ্ন। বস্তুতঃ পশ্চিম পাকিস্তানের। জনসাধারণের সঙ্গে এই ৬-দফার কোন বিরােধ নাই। তিনি বলেন যে, জাতির বৃহত্তর কল্যাণের কথা চিন্তা করিয়াই দেশবাসীর সামনে তিনি তাঁহার ৬-দফা পেশ। করিয়াছেন। দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থেই ৬-দফার প্রতি সকল মহলের সমর্থনই তাহার কাম্য।
“১৯৪০ সালে লাহাের প্রস্তাব আজ গ্রহণযােগ্য নয়’ বলিয়া যাঁহারা যুক্তি দেখাইতেছেন তাহাদের উদ্দেশে শেখ মুজিব বলেন যে, ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবই পাকিস্তানের ভিত্তি। এই প্রস্তাবভিত্তিক ‘ভাবী পাকিস্তানের উপরই পাকভারতের জনসাধারণকে মতামত দানের জন্য সেদিন আহ্বান জানানাে হইয়াছিল। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পাক-ভারতের মুসলমানেরা এই লাহাের প্রস্তাব ভিত্তিক পাকিস্তানের পক্ষে ভােট দিয়া দেশ বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান কায়েম করিয়াছিল।
এই পর্যায় এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ১৯৪৬ সনে দিল্লীতে মুসলিম লীগের উদ্যোগে যে লেজিসলেটরস কনভেনশন হয় তার পূর্বেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সে নির্বাচনে জনসাধারণ লাহাের প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তানের পক্ষেই রায়দান করে। মুসলিম লীগ কাউন্সিলে গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং জনসাধারণ কর্তৃক অনুমােদিত ও স্বীকৃত সত্যকে বানচাল করিয়া দেওয়ার কোন এখতিয়ার দিল্লীর লেজিসলেটরস কনভেনশনের ছিল না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, সাম্প্রতিক লাহাের সম্মেলনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যেভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছে, সেভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করার পূর্ণ গঠনতান্ত্রিক এখতিয়ার প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের আছে। তিনি

পৃষ্ঠা: ১১৭
বলেন যে, লাহাের সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে আওয়ামী লীগ দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দল বলিয়া আখ্যায়িত করিতে পারেন কেবল তাঁহারাই—আওয়ামী লীগের গঠনতান্ত্রিক সম্পর্কে যাঁহাদের সুস্পষ্ট ধারণা নাই। কেবলমাত্র স্বকপােলকল্পিত ব্যাখ্যার দ্বারা ৬-দফার বিরুদ্ধাচারণ না করিয়া এই ৬-দফার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের জনমত কি, গণভােটের মাধ্যমে তাহা যাচাই করিয়া দেখিবার জন্য তিনি বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, দেশবাসী আপামর জনসাধারণ ৬-দফার পক্ষে আছে এবং বিগত যুদ্ধের স্মৃতি যারা সুষ্ঠুভাবে স্মরণ রাখিয়াছেন, তাহাদের এই ৬-দফার বিরুদ্ধাচরণ করার কোন উপায়ই নাই।
কাউন্সিল লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা আজ লাহাের প্রস্তাবের বিরুদ্ধাচরণ করিতেছেন শেখ মুজিব তাঁহাদিগকে স্মরণ করাইয়া দেন যে, ১৯৫৪ সালে যে একুশ দফার ভিত্তিতে মুসলিম লীগকে খতম করা হইয়াছিল, লাহাের প্রস্তাবভিত্তিক প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী সেই একুশ দফার অন্যতম প্রধান দাবী ছিল।
একটু চেষ্টা করিলেই ৬-দফার বিরুদ্ধাচারীরা নিশ্চয়ই স্মরণ করিতে পারিবেন। যে, ১৯৫৪ সালের সে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে দেশবাসী জনসাধারণ লাহাের প্রস্ত। বিভিত্তিক প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী সম্বলিত একুশ দফার সমর্থকগণকেই শতকরা ৯৭টি আসনে জয়যুক্ত করিয়াছিল। আর উহার বিরুদ্ধাচারণ করিতে গিয়া তদানীন্তন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দলকে ভরাডুবি বরণ করিতে হইয়াছিল।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন—তথা লাহাের প্রস্তাবের ইস্যুটিকে যদি কেহ বা কোন দল পুনরায় গণআদালতে উত্থাপন করিয়া আর একবার জনমত যাচাই করিয়া দেখিতে রাজী থাকেন, আমরা সানন্দে তাহাদের সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছি।
তিনি বলেন যে, মুসলিম লীগের নামে এতকাল কায়েমী স্বার্থবাদী মহল যে গণবিরােধী ও পূর্ব পাকিস্তান বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করিয়া আসিয়াছে আজ তাহা খতম হইয়াছে। তাই আজ তাঁহাদের কেহ কেহ নূতন উদ্যমে ইসলামের দোহাই দিয়া সমগােত্রীয়দের সহিত একীভূত হইয়া নূতন এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়াছেন।
পূর্ব পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী জনাব আবদুল হাই ৬-দফা সম্পর্কে মন্তব্য শেখ মুজিবের দেশপ্রেমের প্রতি যে কটাক্ষ করিয়াছেন, শেখ মুজিব তাহার জবাব দিতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, মৌলিক গণতন্ত্রের দেশে মন্ত্রীকে কেবল সৌজন্যের খাতিরেই মন্ত্রী বলা হয়। আসলে জনাব হাই কেবল নামেই মন্ত্রী—কারণ তিনি যেমন দেশবাসীর কারও প্রতিনিধি নন, তেম্নি তাঁর পলিসি। নির্ধারণেরও কোন ক্ষমতা নাই।
শেখ মুজিব দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল শান্তিকামী মানুষকে বিগত যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলােকে পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডত্ব রক্ষার প্রশ্নটি পুনরায় গভীরভাবে অসাম্প্রদায়িক নীতিতেই বিশ্বাসী; কিন্তু তাই বলিয়া আমার দেশে

পৃষ্ঠা: ১১৮
ভারতীয় সেনাবাহিনী বিজয়ীর বেশে আসিয়া প্রবেশ করিবে, দেশের লক্ষ-কোটি মানুষের মত প্রাণ থাকিতে আমিও তা বরদাশত করিতে পারি না। পাকিস্তানের শক্তি তার এলাকা বিশেষে নিহিত নয়, দেশের শক্তির আসল উৎস দেশের কন্দরে করে। একটা বিষয় পরিষ্কারভাবে বুঝা দরকার যে, কেন্দ্রের উপর ‘বিষয়ের হিমালয়’ চাপাইয়া দিলেই কেন্দ্র শক্তিশালী হয় না, অঙ্গসমূহের শক্তিই আসলে কেন্দ্রের শক্তি। কেন্দ্রকে যারা শক্তিশালী করিতে বা রাখিতে চান, তাঁদেরকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আজ সকল ক্ষমতার অধিকারী একটি মহাশক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার দেশে কায়েম থাকা সত্ত্বেও বিগত যুদ্ধের সময় অসীম শক্তিধর সে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানীদের চরম বিপদের দিনে তাহাদের কী সাহায্য করিতে পারিয়াছিল? খােদা না খাস্তা, সীমান্ত পার হইতে পূর্ব পাকিস্তানের উপর যদি সর্বাত্মক কোন হামলা হইত, তাহা হইলে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার কিভাবে উহার ‘এলাজ করিতেন, বিগত যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার আলােকে শক্তিশালী কেন্দ্রের বিশ্বাসীদের নিকট ইহাই আমার জিজ্ঞাসা।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬