৬ দফা ব্যাখ্যা করেন বঙ্গবন্ধু
১৯৬৬ [১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি বিরােধী দলের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু করাচী যান, সেখানে ছয়-দফা দাবি তিনি বিশ্লেষণ করেন। সেটি গৃহীত না হওয়ায় ফেব্রুয়ারি ১১ তারিখ ঢাকা ফিরে তিনি ঘােষণা করেন বিরােধীদের কোন প্রস্তাবের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক নেই। এরপর সাংবাদিকদের কাছে আবারও তিনি ৬ দফা ব্যাখ্যা করেন]।
যুদ্ধোত্তর দেশের পরিস্থিতি পর্যালােচনা করিয়া শেখ মুজিব জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটির বিবেচনার জন্য দেশের দুই প্রদেশের মধ্যে অটুট ঐক্য, সুদৃঢ় সংহতি ও বৃহত্তর সমঝােতা সৃষ্টির জন্য মুখ্যত যে ছয়-দফা প্রস্তাব করেন সেই সম্পর্কে তিনি সাংবাদিকদের বিস্তারিত বিবরণদান করেন। লাহাের সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে তিনি যেসব সুপারিশ পেশ করেন সেই প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, পাক-ভারতের মধ্যকার বিগত ১৭ দিনের যুদ্ধে যে অভিজ্ঞতা হইয়াছে তাহাতে প্রশাসনিক দিক দিয়া জনসাধারণের বৃহত্তর কল্যান সাধনের কথা বিবেচনা করিয়া দেশের প্রশাসনিক কাঠামাে সম্পর্কে নূতনভাবে চিন্তা করার প্রয়ােজন দেখা দিয়াছে। তিনি বলেন, বিগত অস্বাভাবিক ধরনের জরুরী দিনগুলিতে কেবল পূর্ব পাকিস্তানিদের ঐক্যবােধই দেশের দুই প্রদেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখিতে সমর্থ হইয়াছে, ঘটনাক্রমে নহে।
শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বলেন যে, জাতীয় সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে তিনি যেসব সুপারিশ করিয়াছেন তাহা পাকিস্তানের দুইটি অঞ্চলকে একত্র ও একই রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে বিশ্বমানচিত্রে কায়েম রাখার জন্যই করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, এই উদ্দেশ্য নিয়াই তিনি লাহাের সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানে তিনি একটি শাসনতান্ত্রিক ফেডারেশন গঠনের সুপারিশ করিয়াছেন। সুপারিশকৃত এই শাসনতন্ত্রে বিশ্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার কায়েমের এবং আইন পরিষদসমূহের সার্বভৌমত্বের বিধান থাকিতে হইবে।
ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারাধীন যেসব বিষয় থাকিবে বলিয়া শেখ মুজিব যে সুপারিশ করিয়াছেন তাহা এই যে, ফেডারেল সরকার দেশরক্ষা এবং পররাষ্ট্র বিষয়ের দায়িত্ব পালন করিবেন। এই দুইটি বিষয় ছাড়া আর বাকি যেসব বিষয় থাকিবে তার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকিবে ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত স্টেটসমূহের হাতে।
দেশের মুদ্রাব্যবস্থা সম্পর্কে শেখ মুজিব সাবজেক্ট কমিটিতে অবাধে বিনিময়যােগ্য দুইটি পৃথক ধরনের মুদ্রার অথবা শর্তসাপেক্ষের একটি মুদ্রা ব্যবস্থা কায়েম রাখার সুপারিশ করিয়াছেন।
তিনি সুপারিশ করিয়াছেন যে, ফেডারেশনের জন্য যদি একটি মুদ্রা ব্যবস্থা কায়েম রাখিতে হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করিতে হইবে এবং সেইক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান হইতে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন
পাচার বন্ধ করার জন্য কার্যকারী শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে। এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সম্পূর্ন পৃথক আর্থিক ও অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তন করিবে হইবে।
কর ধার্য করা সম্পর্কে শেখ মুজিব যে সুপারিশ করিয়াছেন তাহা হইতেছে। যে, সর্বপ্রকারের কর ও শুল্ক ধার্যের একচেটিয়া অধিকার ফেডারেশনের স্টেটসমূহের হাতেই থাকিবে। ফেডারেল সরকারের কোনরুপ কর ধার্যের অধিকার থাকিবে না। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যয় নির্বাহের জন্য স্টেটসমূহের করের একটি অংশ ফেডারেল সরকার পাইবেন। স্টেটসমূহের সকল প্রকার করের একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ দ্বারাই ফেডারেল সরকারের তহবিল গঠিত হইবে।
বৈদিশিক বাণিজ্য সম্বন্ধে শেখ মুজিব ৫-দফা সুপারিশ করিয়াছেন। প্রথমত, ফেডারেশনের প্রতিটি স্টেটের পৃথকভাবে বিদেশী বাণিজ্যের হিসাব রাখিতে হইবে। দ্বিতীয়ত, বিদেশী বাণিজ্যের দ্বারা আগত বিদেশী মুদ্রা স্টেটগুলির অধিকারে থাকিবে। তৃতীয়ত, ফেডারেল সরকারের বিদেশী মুদ্রার চাহিদা সমান হারে বা সম্মত কোন একটা হারে স্টেটসমূহ মিটাইবে। চতুর্থত, প্রয়ােজনীয় স্বদেশে প্রস্তুত সকল দ্রব্যই বিনা শুল্কে বা টেরিফের রিফের বিধি-বিধানমুক্ত অবস্থায় স্টেটসমূহের মধ্যে যাতায়াত করিবে। শেষত, শাসনতান্ত্রিক বিধান করিয়া স্টেটসমূহকে বিদেশে বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণের এবং সংশ্লিষ্ট স্টেটের স্বার্থে বিদেশে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করার অধিকার দিতে হইবে।
শেখ মুজিব শাসনতন্ত্র মতে স্টেটসমূহকে আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্রের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্যারামিলিটারি’ বা আঞ্চলিক বাহিনী সংরক্ষণের অধিকারদানেরও সুপারিশ করেন।
শেখ মুজিব সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, লাহাের সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের প্রভাবশালী একটি মহল পূর্ব পাকিস্তানের দাবি-দাওয়া আলােচনা। তাে দূরের কথা, শুনিতে পর্যন্ত প্রস্তুত না থাকায় তিনি তার প্রতিনিধিদলসহ সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিতে বাধ্য হইয়াছেন।
তিনি বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের নায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল রহিয়াছে বলিয়াই তাহার বিশ্বাস।
ইত্তেফাক, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬