৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে ‘ছয় দফা’ পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়
৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে ‘ছয় দফা’ পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদে লেখা ছিল—‘আমাদের বাঁচার দাবি : ৬ দফা কর্মসূচি। শেখ মুজিবুর রহমান।’ তিনি এই দাবিগুলিকে মনে করতেন ভালােভাবে বেঁচে থাকার দাবি হিসেবে। বা বাঙালি যদি বেঁচে থাকতে চায় তাঁকে ৬ দফা আদায় করেই বেঁচে থাকতে হবে। পরবর্তীকালে ৬ দফা পরিচিত হয়ে ওঠে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি বলতে আমরা সাধারণত ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১-এর মার্চ পর্যন্ত ঘটনাবলিকে মনে করি। হ্যা, তার যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু, ১৯৬৬ পর্যন্ত। ছিল সলতে পাকাবার সময়। বৈষম্য, দমন পীড়নের বিষয়ে মানুষ সচেতন হতে থাকে। বাংলা ভাষার জয়, মুসলিম লীগের পতন হলেও পাকিস্তান প্রত্যয় থেকে মানুষ বেরুতে পারেনি। তখনও মানস জগতে এই ধারা প্রবল ছিল যে, মুসলমানদের রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে। ভাইয়ে ভাইয়েও ঝগড়া ফ্যাসাদ হয়। সব মিটিয়ে ইসলামের স্বার্থে থাকা উচিত। সরকারি ও সরকার সমর্থক দলগুলির প্রচারের এটিই ছিল গাইড লাইন। ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৬, ১৯৬২-এতােসব আন্দোলনের পরও ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এ অঞ্চলের মানুষও পাকিস্তানি জোশে আচ্ছন্ন হয়েছিল। এ কথা আজ অস্বীকার করতে পারেন অনেকে। কিন্তু তাতে সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না। তাশখন্দ চুক্তির। পরই নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আড়ালে আবডালে কথা শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ প্রথম মানস জগতের এই প্রভাব হ্রাসে আগ্রহী হয়। বঙ্গবন্ধু কৌশল হিসেবে এই তাসখন্দ চুক্তিকেই বেছে নেন। এই চুক্তির ফলে আইয়ুবের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়, সরকারের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কথা পরে অনুধাবন করে ভূট্টোও সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।
বঙ্গবন্ধু আমাদের মানসজগতের খোজ খবর জানতেন। এটিই ছিল তাঁর দূরদর্শিতা। তাই কাউকে না জানিয়েই লাহােরে ৬ দফা ঘােষণা করেন। এই ধাক্কা এত প্রবল ছিল যে, বিরােধী দল এই দফা নিয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ১৯৪৯ সাল থেকে শেখ মুজিব সরকারের শক্র হলেও সরকার তখনও ৬ দফার গুরুত্ব বােঝেনি।
বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতাগুলি দেখুন। প্রথমে নমনীয়ভাবে, তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিষয় এনে বাঙালিকে এটা বােঝাতে সমর্থ হলেন যে, পাকিস্তান গত প্রায় দু’ দশক তাদের বঞ্চনাই করে এসেছে। আওয়ামী লীগের প্রবীণরা এটি মানতে পারেন নি একারণে যে, ৬ দফা এনে মুজিব তার অবস্থানকে এতই সুদৃঢ় করে তুলেছেন যে বাকিদের আর সেই অবস্থান নেই। বিশেষ করে মুজিবের জ্যেষ্ঠ ও সমসাময়িকদের পক্ষে এটি মেনে নেয়া কষ্টকর ছিল। এবং পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদও তারা মেনে নিতে পারছিলেন না। আওয়ামী লীগ বিভক্ত করার চেষ্টাও তাদের বৃথা গেছে।
মুজিব প্রচারে যে টুকু সময় পেয়েছিলেন ফেব্রুয়ারি থেকে মে প্রায় চার মাস, বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। ৬ দফা মানুষকে বিশেষভাবে তরুণদের আকৃষ্ট করেছে এবং তারা বিশ্বাস করেছে যে ৬ দফাই মুক্তি আনবে। নিজ দল ছাড়া, অন্যান্য ডান বা বাম দল তাঁকে সমর্থন করেনি। মােজাফফর আহমদ শুধু সমর্থন করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধান্বিত ছিল। মওলানা ভাসানী পুরােপুরি ৬ দফা নাকচ করে তাঁকে সিআইএর দলাল বলেছেন। লক্ষণীয় যে, যারা বঙ্গবন্ধু বা ছয় দফার বিরােধিতা করেছিলেন তারা ১৯৭০-১৯৭১ এমনকি তারপরও শেখ মুজিবের বিরােধিতা করেছেন। এটি যেন ছিল এক ধরনের রােগ।
১৯৭১ সালে যেমন পশ্চিম পাকিস্তানিরা মনে করেছিল কিছু মানুষকে হত্যা করলেই বাঙালি দমে যাবে। ১৯৬৬ সালেও সে ধারণা ছিল এবং তা কার্যকর করার ভার ছিল মােনায়েম খানের ওপর। ছয় দফায় যে দমন-পীড়ন চালিয়েছে। তার ফলেই যাবতীয় অশুভের প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৯ সালে শুধু গণঅভ্যুত্থানের পর ৬ দফা কিন্তু আবার ফিরে এল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কিন্তু, বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ওপরেই প্রকাশ্যে ম্যান্ডেট চাইলেন। তাঁর এই রাজনৈতিক কৌশল দেখার মতাে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ৪-৫ জুন আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতে বারবার এ দফা ফিরে আসে-
১. “জাতীয় সংহতির খাতিরে দিতে দিতে যে শেষ হইয়া গিয়াছে, এখন আর দিবার মতাে তাহাদের কিছু নাই। এবার তাহাদের প্রাপ্য আদায়ের পালা। এবার আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার ফিরাইয়া পাইতে চাই—কলােনি হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করিতে দিতে আমরা আর রাজী নহি।” ২. বিরােধী ৬ দফার যত বিরােধিতা করবেন ৬ দফা তত জনপ্রিয় হবে। “এই অপপ্রচারকারীরাই তাহাদিগকে গত ২৩ বৎসর যাবৎ শােষণ করিয়াছে আর ৬ দফা তাহাদের এই শােষণ অবসান ঘটানােরই হাতিয়ার।” ৩. “নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের আপামর মানুষ যদি ৬ দফার পক্ষে ম্যান্ডেন্ট দেয়, তবে কি করিয়া তাহা আদায় করিতে হয়, তাহা আমরা জানি।” ৪. ৬ দফার বিরুদ্ধে যারা অপপ্রচার করছেন তাদের তিনি বিরত থাকতে বলেন।
পৃষ্ঠা: ৮৮
৫. ৮০ মিনিটের বক্তৃতায় ৬ দফার পটভূমি ও দলের কর্মীদের ভূমিকা কী হবে বর্ণনা করে বলেন-“সােনার এই দেশ আজ অন্তহীন হাহাকার ও নিঃশ্বাস দুঃখের ভাগারে পরিণত হইয়াছে। আওয়ামী প্রধান বলেন, এই অবস্থার অবসান ঘটাইয়া দেশের সকল অঞ্চলে মানুষের জন্য স্বায়ত্তশাসন, সুখ সমৃদ্ধির ব্যবস্থা এবং শােষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্যই ছয় দফা দাবী পেশ করা হইয়াছে।” ৬. তিনি বলেন ৬ দফা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের জন্যই নয়, ৬ দফা পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্যও। “১৯৬৬ সালের জুনে ৬ দফা দাবীতে আন্দোলনকারী শ্রমিক জনতার উপর নির্মম গুলীবর্ষণ হইতে শুরু করিয়া এ পর্যন্ত ইতিহাস প্রমাণ করিয়াছে যে, অপপ্রচার বা শক্তি ও নির্যাতন চালাইয়া কোন আন্দোলন দাবাইয়া দেওয়া যায় না। বরং উহা নবশক্তিতে নূতন আগুন ছড়াইয়া
বিস্ফোরিত হয়।”১৫৮
তাই হয়েছিল ১৯৭১ সালে। জনগণ ৬ দফা বাস্তবায়নের ম্যান্ডেট দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। এবং তিনি তা কার্যকর করতে চেয়েছেন। এবং সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ায় ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। ৬ দফা তাই মুক্তির সনদ শুধু নয়, ৬ দফা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার অভিমুখে যাত্রা। এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পটভূমি বিচার করতে হলে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলিকেই বিবেচনা করতে হবে।
সূত্র : ৬ দফা স্বাধীনতার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু – মুনতাসীর মামুন