কি হয়েছিল ৭ জুন?
৭ জুন কী হবে তা নিয়ে দু’পক্ষেরই সংশয় ছিল। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ৭ জুন [মঙ্গলবার] “সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কি হয় আজ? আবদুল মােনায়েম খান যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসলাে দোকান-পাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলেছে।”১১৯
আসলে শান্তিপূর্ণভাবে কিছুই চলেনি। ৭ জুন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। ৮ তারিখের পত্রিকা পাওয়া যায় নি। ৯ জুন দৈনিক সংবাদে সরকারি একটি প্রেস নােট ছাপা হয়েছে, সেটি বিশ্লেষণ করলে রক্ষণশীল একটি হিসাব পাওয়া যাবে-
১. সকাল থেকে পথচারী ও যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা হয়। ই পি আরটিসি বাসগুলিতে ঢিল ছোড়া হয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছােকড়া ও গুণ্ডাদের লেলাইয়া দেওয়া হয়। ‘অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়।”
২. হাইকোর্টের সামনে তিনটি গাড়ি পােড়ানো হয়।
৩. কার্জন হল, বাহাদুর শাহ পার্ক ও কাওরান বাজারের কাছে পুলিশ ‘গুণ্ডাদের বাধা দেয় ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
৪. চট্টগ্রাম মেল তেজগা রেল স্টেশনের আউটার সিগন্যালে লাইনচ্যুত করা হয়। জনতা ট্রেনযাত্রীদের ঘিরে ফেলে তুমুল ইটপাটকেল ছুঁড়তে” থাকে। পুলিশ শৃঙ্খলা রক্ষা করতে গেলে জনতা তাদের ঘিরে ফেলে তখন ‘আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে, ফলে ৪ ব্যক্তি নিহত হয়। অনেক পুলিশও আহত হয়।
৫. সকাল ১০টায় তেজগার ল্যান্ড রেকর্ড ও সার্ভে ডিরেকটরের অফিস আক্রান্ত হয়। তারপর জনতা সেটেলমেন্ট প্রেসের মেশিনগুলি ক্ষতি করে।
৬. সকাল সাড়ে ছয়টায় নারায়ণগঞ্জে গলাচিপা রেলওয়ে ক্রসিং-এর নিকট ঢাকাগামী ট্রেন আটক করে। নারায়ণগঞ্জগামী ৩৪নং ডাউন ট্রেন আটকে “উহার বিপুল ক্ষতিসাধন ও ড্রাইভারকে প্রহার করে।”
৭. নারায়ণগঞ্জ থানা আক্রমণ করে জনতা। ৪৫ জন পুলিশ আহত হয়। ‘আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুঁড়তে ৬ জন নিহত ও ১৩ ব্যক্তি আহত হয়।
৮. পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি এমএ জাহেরের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয় ও তার ‘বাড়ি লুণ্ঠিত হয়।”
৯. টঙ্গিতে মালবাহী ট্রেন আটক করা হয়।
১০. নারায়ণগঞ্জ ও চাষাড়ার মধ্যে রেলওয়ে সিগনাল লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়।
১১. টঙ্গিতে শ্রমিকরা মিছিল করে।
১২. কাওরান বাজারে একজন সার্জেন্টকে প্রহার করা হয়। তার স্কুটারেরও ক্ষতি করা হয়।
১৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা পিকেটিং করে ও “আংশিক ধর্মঘট” হয়।
১৪. দুপুরে আদমজী, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ডেমরা এলাকার শ্রমিকগণ ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করিয়া শােভাযাত্রা সহকারে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হইতে থাকে। ঢাকা নগরীর দুই মাইল দূরে ইপিআর বাহিনীর একটি দল শােভাযাত্রার গতি রােধ করে।
১৫. গেণ্ডারিয়ার কাছে ট্রেন আটক করা হয়।
১৬. চট্টগ্রামগামী ও ঢাকা অভিমুখী ট্রেন অপরাহ্নে তেজগাঁ স্টেশনে আটক করে।
১৭. সন্ধ্যার পর জনতা কালেকটরেট ও স্টেট ব্যাংক আক্রমণ করে। পুলিশ গুলিবর্ষণ করে।
১৮. সকাল ১১টায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।১২০
পরদিন আরাে একজন মারা যান। ৭ জুন সম্পর্কে পরবর্তীকালেও বিস্তারিত কেউ লেখেন নি। ৮ জুন ইত্তেফাক, সংবাদ বন্ধ থাকে। সংবাদ ৯ তারিখে নাটকীয়ভাবে শিরােনাম দেয়—‘আমাদের নীরব প্রতিবাদ’—“যে মর্মান্তিক বেদনাকে ভাষা দেওয়া যায় না, সেখানে নীরবতাই একমাত্র ভাষা। তাই গতকল্য সংবাদ প্রকাশিত হইতে পারে নাই। আমাদের এই নীরব প্রতিবাদ একক হইলেও আমাদের পাঠকরাও শরীক হইলেন, ইহা আমরা ধরিয়া লইতেছি।”
৮ জুন ন্যাপ এক প্রচারপত্র বিলি করে। এখানে ৭ জুন সম্পর্কে লেখা হয়েছিল—
“পাকিস্তানের জীবনেতিহাসে এমন হরতাল আর দেখা যায় নাই। পিকেটিংয়ের প্রয়ােজন হয় নাই, স্বেচ্ছাসেবকদের কথা কেউ চিন্তাও করে নাই—তবুও ৭ই জুন ভােরবেলা দেখা গেল লক্ষ জনতা নিজেরাই স্বেচ্ছাসেবক, চোখেমুখে দৃপ্ত শপথ, আত্মশক্তিতে গভীর আস্থা কোনও কটি, কোন চন্ডনীতিই তাহাদিগকে লইতে পারিবে না…।”১২১
৭ জুন পুলিশের গুলিতে শহিদ হন ১১ জন। দু’জনের কথা সবাই বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। একজন মনু মিয়া। বেঙ্গল বেভারেজের শ্রমিক। বেঙ্গল বেভারেজ ছিল তেজগাঁ শিল্প এলাকায়। মনু মিয়ার বাড়ি ছিল সিলেট। অন্যজন আজাদ এনামেল অ্যান্ড অ্যালমুনিয়ামের শ্রমিক আবুল হােসেন। বাড়ি ননায়াখালি। তেজগাঁ স্টেশনের কাছে ইপিআরের সামনে বুক পেতে দাঁড়ান। তারা তখুনি গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের কাছে। বিক্ষোভের সময় পুলিশের গুলিতে মারা যান ৬ জন। গ্রেফতারের সংখ্যা ছিল ১৫০০-এর বেশি। শ্রমিক এলাকাগুলিতে সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ৭ জুন জেলে ভােরবেলায় উঠলেন। খবর পেলেন হরতাল চলছে। এবং “এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে।” সারাদিন টেনশনে কেটেছে তার। লিখেছেন-
“হরতাল যে সাফল্যজনকভাবে পালন করা হয়েছে সে কথা সকলেই বলছে। এমন হরতাল নাকি কোনােদিন হয় নাই, এমনকি ২৯শে সেপ্টেম্বরও না। তবে আমার মনে হয় ২৯শে সেপ্টেম্বরের মতােই হয়েছে হরতাল।
গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শুধু পাইপই টানছি—যে একটি তামাক বাইরে আমি ছয় দিনে খাইতাম, সেই টিন এখন চারদিনে খেয়ে ফেলি। কি হবে? কি হতেছে? দেশকে এরা কোথায় নিয়ে যাবে, নানা ভাবনায় মনটা আমার অস্থির হয়ে রয়েছে।…”১২২
আরাে বিস্তারিত জানলেন ৮ জুন। সকালে উঠে জানলেন ৭ জুন থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ৩০০ জনকে জেলে আনা হয়েছে।
“এর মধ্যে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু, “৬ বৎসর বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সের লােকও আছে। কিছু কিছু ছেলে মা মা করে কাঁদছে। এরা দুধের বাচ্চা, খেতেও পারেনা নিজে। কেস টেবিলের সামনে এনে রাখা হয়েছে। সমস্ত দিন এদের কিছুই খাবার দেয় নাই। অনেকগুলি যুবক আহত অবস্থায় এনেছে। কারও পায়ে জখম, কারও কপাল কেটে গিয়াছে, কারও হাত ভাঙা এদের চিকিৎসা করা বা ঔষধ দেওয়ার কোনাে দরকার মনে করে নাই কর্তৃপক্ষ। গ্রেফতার করে রাখা হয়েছিল অন্যখানে। সেখান থেকে সন্ধ্যার পর জেলে এনে জমা দেওয়া শুরু করে। দিনভরই লােক আনছিল, অনেক। কিছু সংখ্যক স্কুলের ছাত্রও আছে। জেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে কেহ কেহ খুবই খারাপ ব্যবহারও করেছে। বাধ্য হয়ে জেল কর্তৃপক্ষকে জানালাম, অত্যাচার বন্ধ করুন। তা না হলে ভীষণ গােলমাল হতে পারে। মােবাইল কোর্ট করে সরকার গ্রেপ্তারের পর এদের সাজা দিয়ে দিয়েছে। কাহাকেও তিনমাস, আর কাহাকেও দুই মাস। এক মাসও কিছু সংখ্যক ছেলেদের দিয়েছে। সাধারণ কয়েদি, যাদের মধ্যে অনেকেই মানুষ খুন করে অথবা ডাকাতি করে জেলে এসেছে তারাও দুঃখ করে বলে, এই দুধের বাচ্চাদের গ্রেপ্তার করে এনেছে। এরা রাত ভর কেঁদেছে। ভালাে করে খেতেও পারে নাই।”১২৩
১০ জুন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু রােজনামচায় শুধু লিখেছেন বন্দীদের কথা। এরা গ্রেফতার হয়েছেন। প্রচণ্ড মারপিট করা হয়েছে তাদের। তিনি বিক্ষিপ্ত, এরই মধ্যে খবর পেয়েছেন মা অসুস্থ। স্ত্রী ছেলে-মেয়েরাও দেখা করে গেছেন। আরাে পরে জানালেন ওয়ার্কিং কমিটির সভা হচ্ছে। ১৭-১৯ জুন জুলুম প্রতিরােধ দিবস’ পালিত হবে। ৬ দফার আন্দোলন অব্যাহত থাকবে তাও ঘােষণা করা হয়েছে। ১২ জুন লিখছেন—“ভাবতে লাগলাম কর্মীদের টাকার অভাব হবে। পার্টি ফান্ডে টাকা নাই।… তবে আমার বিশ্বাস আছে, অর্থের জন্য কাজ বন্ধ হয়ে থাকে না। জনসমর্থন যখন আওয়ামী লীগের আছে, জনগণের ত্রাণ আছে। আমি দেখেছি। এক টাকা থেকে হাজার টাকা অফিসে এসে দিয়ে গিয়াছে, যাদের কোনােদিন আমি দেখি নাই। বােধহয় অনেককে দেখবােও না। ভরসা আমার আছে,
জনগণের সমর্থন এবং ভালােবাসা দুইই আছে আমাদের জন্য। তাই আন্দোলন ও পার্টির কাজ চলবে।”
তিনি লিখেছেন, এ ত্যাগ স্বীকার বৃথা যাবে না। “এই দেশের মানুষ তার ন্যায্য অধিকার আদায় করবার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই। কেবল মাত্র সময় সাপেক্ষ।” ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালের বক্তৃতায় এ কথাই আবার বলেছিলেন। তিনি লিখেছেন—“ছয় দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি-পশ্চিমা উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানে শোষকশ্রেণী যে তার পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জনসাধারণকে শােষণ বেশি দিন করতে পারবে না, সে কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ই জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামে গঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়েছে। কোনাে শাসকের চক্ষু রাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসকশ্রেণীর ছয় দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিত। … আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব। না। সংগ্রাম চালিয়ে যাবাে। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ ত্যাগের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।”১২৪
তার এই কথা সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। ১৯৬৬-১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে, আরাে রক্ত দিয়েছে। ১৯৭১ সালে শহিদ হলেন ৩০ লক্ষের ওপরে। ৬ দফা আন্দোলন শুরু হবার পাঁচ বছর পরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
সূত্র : ৬ দফা স্বাধীনতার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু – মুনতাসীর মামুন