You dont have javascript enabled! Please enable it! পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনা-ক্ষেত্রে কয়েকটি বাস্তব সমস্যা | বদরুদ্দীন উমর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮ - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনা – ক্ষেত্রে কয়েকটি বাস্তব সমস্যা

বদরুদ্দীন উমর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮ 

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে আমাকে যে সব বাস্তব সমস্যা ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছো সে বিষয়ে আপনারা জানতে চেয়েছেন। নীচে আমি এ সম্পর্কিত বহুবিধ সমস্যার মধ্যে কয়েকটি সংক্ষিপ্তকারে উল্লেখ করছি।

ভাষা আন্দোলনের মত এক ব্যাপক গণ আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে প্রথমে আমি যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি সেটা হচ্ছে এই আন্দোলন সংক্রান্ত বইপত্রের অভাব। ১৯৫২ সালে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা রূপে পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী কর্তৃক স্বীকৃত হয় এবং সেই হিসেবে ভাষা আন্দোলন একটি পরিণতি লাভ করে।
কিন্তু তারপর বহু বৎসর গত হলেও এই আন্দোলনের কোন উল্লেখযোগ্য ইতিহাস রচিত হয়নি।

১৯৫২ সালের জুন মাসে তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তাতে ইতিহাস পদবাচ্য বিশেষ কিছুই ছিল না। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ঘটনার উল্লেখ সেখানে ছিল এবং তাতে সমগ্র ভাষা আন্দোলনকে তমদ্দুন মজলিসে আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টার ফলে তার ঐতিহাসিক মূল্য খর্ব হয়েছিল। বিভিন্ন ঘটনাকে এই উদ্দেশ্য বর্ণনা করার ফলে ঘটনাবলীর বর্ণনার মধ্যেও বিকৃতি এবং অতিশয়োক্তির অভাব ছিল না। এই বিকৃতি এবং অতিশয়োক্তি গুলোর অপরাপর তথ্যের আলোকে চিহ্নিত করা আমার পক্ষে কঠিন হয়নি।

এরপর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। তথ্যের পরিবর্তে আবেগের প্রাধান্য এতে অনেক বেশী থাকায় ইতিহাস রচনার দিক দিয়ে এই সংকলনটি বিশেষ কোন কাজে আসেনি। তবে ২৩২ পৃষ্ঠার এই সংকলনটির একেবারে শেষের দিকে ‘যেন ভুলে না যাই’ নামে খন্দকার গোলাম মুস্তাফার এবং ‘একুশের ইতিহাস ‘ নামে কবির উদ্দিন আহমেদের রচনা দুটিতে (মোট ২৩ পৃষ্ঠা) কিছু সুপরিচিত ঘটনা মোটামুটি সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়।

ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত বই পত্রের অভাবজনিত এই অবস্থার জন্য আমাকে প্রথম থেকেই মৌলিক তথ্য সংগ্রহের দিকে নজর দিতে হয়। এবং সে কাজ করতে গিয়ে প্রথম যে প্রশ্নটি সামনে আসে সেটি হলোঃ কি ধরণের তথ্য আমি সংগ্রহ করবো।

কি ধরণের তথ্য প্রয়োজনীয় এবং সেই হিসেবে সংগ্রহের যোগ্য সেটা নির্ভরনকরে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে সাধারণতঃ কিছু সংখ্যক ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীর আন্দোলন হিসেবে ব্যাখ্যা ও চিত্রিত করার যে বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গী বহু বৎসর ধরে প্রচলিত ছিলো তাকে আমি প্রাথমিক কিছু তথ্য পর্যালোচনার পরই একেবারে বর্জন করি। আমি খুব স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাই যে, পূর্ব বাঙলার ভাষা এবং সেই আন্দোলনে এদেশের কৃষক – শ্রমিক ও সাধারণ মেহনতি জনগণের ভূমিকাই এখানে প্রধান। ছাত্র বুদ্ধিজীবীরা এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা জোরালো প্রাথমিক ভূমিকা পালন করেছিলো একথা সত্য। কিন্তু সারা দেশের জনগণের জাতিগত নিপিড়ন বিরোধী সংগ্রামের পটভূমিতেই তাদের এই ভূমিকা অর্থবহ। ঠিক এ কারণেই আমি আমার বইটির নামকরণ ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ‘ বা ঐ জাতীয় কিছু না কিছু করে তার নাম রাখি ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি “।

এই ভাবে দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নটি মীমাংসার পর আমি তথ্য সংগ্রহে নিযুক্ত হই। এ ক্ষেত্রে আমি তথ্যের উৎসকে মোটামুটি তিনভাগে বিভক্ত করিঃ (ক) পত্রপত্রিকা (খ) বিভিন্ন আন্দোলন সম্পর্কিত পুস্তক পুস্তিকা, পার্টি দলিল পত্র, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাগত সংগঠন সমূহের আন্দোলনের দলিল পত্র, খন্ড খন্ড নানা আন্দোলনের সময় প্রচারিত ইসবতাহার, পাকিস্তানের সংবিধান সভা ও পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের বিতর্ক সমূহ এবং (গ) ভাষা আন্দোলন সহ অপরাপর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার।

তথ্য সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত হয়ে প্রথমেই যে বিষয়টি লক্ষ্য করি সেটা হলো, পূর্ব বাঙলার পাঠাগারগুলোর দৈন্যদশা। যে কোন উন্নত দেশে এই ধরণের একটি কাজে হাত দিলে বিভিন্ন পাঠাগারে প্রাপ্ত দলিল পত্রের ওপরই প্রধানতঃ নির্ভর করতে হয়। এখানকার পাঠাগারগুলি থেকে আমি এক্ষেত্রে সাহায্য খুব কমই পেয়েছি। ঢাকার বাংলা একাডেমী পাঠাগার এবং সিলেটের মুসলিম সাহিত্য সংসদ পাঠাগারে অযত্ন সহকারে রক্ষিত সামান্য কয়েকটি পত্রিকা (যা অচিরেই ইঁদুর, আরশোলা এবং উইপোকার দ্বারা নিশ্চিহ্ন হবে অথবা ইতিমধ্যে হয়েছে) আমার কাজে এসেছে।

এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগার এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদ পাঠাগারে প্রাপ্ত পরিষদ বিতর্কের কিছু দলিলও আমি ব্যবহার করেছি। এ ছাড়া আমার বইটিতে ব্যবহৃত বাকী যাবতীয় তথ্য কয়েক বৎসর ধরে অনুসন্ধান করে বিভিন্ন ব্যক্তির থেকো আমাকে সংগ্রহ করতে হয়েছে। এই ভাবে দলিল সংগ্রহ করতে গিয়ে যাদের দ্বারা আমি সব থেকে উপকৃত হয়েছি তাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৪৭ সাল থেকেই বহু দলিল সংগ্রহ করে যত্ন সহকারে নিজের কাছে রেখেছিলেন। এ ছাড়া নিয়মিত ডায়েরী রাখাও তার অভ্যাস ছিল। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত প্রতিদিনের ডায়েরিতে তার ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত উল্লেখ ছিলো, এই সব তিনি আমাকে দিতে কোন রূপ কার্পণ্য বা ইতস্ততঃ করেননি। এদিক দিয়ে শহীদুল্লাহ্ কায়সার, অলি আহাদ, মাহমুদ আলী, আব্দুর রশীদ খান এবং কমরুদ্দিন আহমেদের নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া একটি একটি করে দলিল পত্র সংগ্রহ করেছি যাদের কাছে থেকে তাদের কাছে অতিশয় কৃতজ্ঞ থাকলেও এখানে তাদের সকলের নাম উল্লেখ সম্ভব নয়।

দৈনিক পত্রিকাগুলির জন্য আমি ‘পাকিস্তান অবজারভার ‘, ‘মর্নিং নিউজ’ এবং ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সাহায্য পেয়েছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আজাদ পত্রিকার ফাইলও এ ক্ষেত্রে কাজে এসেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীতে এ দিক দিয়ে কোন সাহায্যই পাওয়া যায় নি। কারণ সেখানে কোন পুরাতন সংবাদ পত্রের অস্তিত্ব ছিলো না। ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকা থেকে কোন সাহায্য পাইনি। পত্রিকাটি তৎকালীন সত্ত্বাধিকারী ও সম্পাদক মানিক মিঞা আমাকে জানিয়েছিলেন যে, কোন পুরাতন ফাইল তাদের অফিসে ছিল না। ১৯৫২ সালের পুরো ফাইলটি সৌভাগ্যবশতঃ আমি নিজে সিলেটের ‘মুসলিম সাহিত্য সংসদ’ লাইব্রেরীতে গিয়ে খুঁজে পাই এবং এক বন্ধুর মাধ্যমে তার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করি। ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকার ফাইলের জন্য মোহন মিয়া এবং মোতাহার হোসেন সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারি পত্রিকাটির ফাইল নষ্ট হয়ে গেছে।

তথ্য সংক্রান্ত এই আলোচনা প্রসঙ্গে পাঠকদের কাছে আমি একটি আবেদন রাখতে চাই। সেটা হচ্ছে এইঃ ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ‘আমাদের ভাষার লড়াই’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। সেটি প্রকাশ করা হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এর পক্ষে থেকে। এছাড়া ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনঃ কি ও কেন?’ নামে অপর একটি পুস্তিকা ঐ সময়ই প্রকাশিত হয় খুব সম্ভবতঃ বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে। এই দুটি পুস্তিকা আমি এ পর্যন্ত কোথাও সংগ্রহ করতে পারি নি। ভাষা আন্দোলনের তথ্য ভিত্তিক ইতিহাস রচনায় আগ্রহী কোন ব্যক্তির কাছে যদি এই দুটি পুস্তিকার কোন কপি থেকে থাকে তাহলে সে দুটি আমাকে ব্যবহারের জন্য আমার প্রকাশক মওলা ব্রাদারসের (বাংলা বাজার, ঢাকা) মাধ্যমে অথবা অপর কারো মাধ্যমে অল্প কয়েক দিনের জন্য ধার দিলে আমি তার কাছে অপরিসীম কৃতজ্ঞ থাকবো।

দলিল পত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে যাদের সাথে যোগাযোগ করি তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই একটা কথা বলেন। যে সমস্ত দলিলপত্র তারা সংগ্রহ করেছিলেন ইতিপূর্বে কোন না কোন সময় পুলিশী হামলার ফলে নষ্ট হয়ে যায়। কোন ক্ষেত্রে তা পুলিশের হস্তগত হয় এবং কোন সময় পুলিশের ভয়ে তা নষ্ট করে ফেলা হয়। এই অসুবিধার জন্য তথ্য সম্বলিত দলিল পত্রাদি সংগ্রহের জন্য অনেক বেশী ঘোরাঘুরি করতে হয়। ঐ সময় আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষকতা কাজে নিযুক্ত থাকায় সময়ও অনেক বেশী লাগে।

ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ সম্পর্কে আমি আমার বইটার প্রথম খন্ডের প্রথম সংস্করণের (দ্বিতীয় সংস্করণ এই বৎসর মার্চ মাসে প্রকাশিত হবে) ভূমিকায় বলেছি, ‘মৌখিক আলাপ ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক সতর্কতা আমাকে অবলম্বন করতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অতিশয়োক্তি, নিজের ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা, অন্যের ভূমিকাকে ছোট করার চেষ্টা এবং সর্বোপরি অনিচ্ছাকৃত ভাবে বা দূর্বল স্মৃতির জন্য অনেক ভুল ঘটনা বিবৃতিকে নানাভাবে যাচাই করে গ্রহণ ও প্রয়োজনে বাতিল করতে হয়েছে। “

এ কথা লেখার সময় আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু লেখার প্রয়োজন বোধ করিনি৷ কিন্তু বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আমার ব্যবহৃত তথ্য সমূহ সম্পর্কে কোন কেন ব্যক্তির কিছু উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা এবং কোন কোন ব্যক্তির সঠিক সমালোচনার প্রেক্ষিতে এখন এ সম্পর্কে কিছু বলার আমি প্রয়োজন বোধ করছি৷

প্রথমেই আমি জনাব আতাউর রহমান খানের সাথে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করবো৷ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলা সফরে আসেন। ২৪ শে মার্চ সন্ধার দিকে তিনি রাষ্ট্রভাষা কার্যপরিষদের একটি প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাৎ দান করেন (প্রথম খন্ড, পৃঃ ১১২-১৬) আতাউর রহমান খান সাহেবের সাথে আমার সাক্ষাৎকারের সময় তিনি বিস্তৃত ভাবে জিন্নাহর সাথে কার্যপরিষদের এই সাক্ষাৎকারের বিবরণ দিতে শুরু করলেন। তিনি কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর আমি যখন বুঝতে পারলাম যে, তিনি নিজেও সাক্ষাৎকারের সময় উপস্থিত ছিলেন এইভাবে বর্ণনাটি দিয়ে যাচ্ছেন তখন আমি খুব বিস্মিত হলাম। তবে বিষ্ময় দমন করে আমি তার কথা শুনতে লাগলাম। তিনি এক পর্যায়ে আমাকে বললেন, জিন্নাহ কিভাবে তার কাঁধে হাত দিয়ে তার সাথে কথা বলছিলেন। আমি আরও বিষ্মিত হলাম। অবশেষে তিনি বর্ণনাটি শেষ করলেন এবং আমি তাকে বললাম, “কিন্তু আপনি তো সেই সাক্ষাৎকারের সময় ছিলেন না।”

আমার এই কথায় আতাউর রহমান খান সাহেব আঁতকে ওঠার মতো একটা অভিব্যক্তি করলেন এবং তারপর যথাসাধ্য জোর দিয়ে বললেন যে, তিনি নিশ্চয়ই উপস্থিত ছিলেন এবং তা না হলে তিনি সাক্ষাতকারের বর্ণনা কিভাবে দিতে পারতেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তিনি যে বর্ণনাটি দিয়েছিলেন সেটা মোটামুটি সঠিক ছিলো। সেজন্য আমি আজ কিছুক্ষণের জন্য ভাবলাম যে, হয়তো বা হতেও পারে, হয়তো তিনি উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু অনেকক্ষণ চিন্তা করেই আমি আবার তাকে বললাম, “আপনি ভুল করছেন, আপনি উপস্থিত ছিলেন না।” আতাউর রহমান সাহেব এবারও আমার কথার জোর প্রতিবাদ করলেন। আমি তখন তাকে বললাম, “যারা সাক্ষাৎকারের সময় উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে যার যার সাথে সাক্ষাৎ করা সম্ভব, আমি প্রায় প্রত্যেকের সাথেই সাক্ষাৎ করেছি কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই আপনার নাম উল্লেখ করেন নি। তা ছাড়া যে নামগুলি তারা উল্লেখ করেছে পৃথক পৃথকভাবে সেগুলি একই, তার মধ্যে আমি কোন তারতম্য পাইনি। ” তিনি কিন্তু আমার যুক্তি গ্রাহ্যই করলেন না। বারবার জিন্নাহর সাথে কার্যপরিষদের সাক্ষাৎকারের সময় তিনি নিজের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করতে লাগলেন।

আমার সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী উপরোক্ত সাক্ষাৎকারের সময় যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হলেনঃ শামছুল হক, কমরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহম্মদ, মুহম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমেদ, আলী আজাদ, নইমুদ্দীন আহমদ, শামসুল আলম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং লিলি খান (প্রথম সংস্করণে লিলি খানের নামটি উল্লেখ করতে আমি ভুলে গিয়েছিলাম)। এদের মধ্যে শামসুল হক, আজিজ আহমদ এবং নঈমুদ্দীন আহমদের মৃত্যু ঘটায় তাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ সম্ভব ছিলো না। বাকী কয়জনের মধ্যে শামসুল আলম এবং লিলি খান ব্যতীত আমি প্রত্যেকের সাথেই এ ব্যাপারে সাক্ষাৎ করেছি৷ তারা কেউই আতাউর রহমান সাহেবের উপস্থিতি উল্লেখ করেন নি। এই কথা শোনার পর আতাউর রহমান সাহেব বললেন, “ঠিকই তো, কমরুদ্দীন সাহেব উপস্থিত ছিলেন, তুমি তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো।” আমি বললাম, “তা করবো কিন্তু আপনিও তো তাকে এখনই এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তাকে টেলিফোন করুন না, এ সময়ে তিনি খুব সম্ভবতঃ নিজের বাসাতেই থাকবেন।” আমার কথায় সম্মত হয়ে তিনি কমরুদ্দীন সাহেবকে ফোন করলেন। সৌভাগ্যবশতঃ টেলিফোনে কমরুদ্দীন সাহেবকে পাওয়া গেল।

আতাউর রহমান সাহেব তাকে উপরোক্ত সাক্ষাৎকারের সময় তার নিজের উপস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। ফোনের ওপারে কমরুদ্দীন সাহেব তাকে জানালেন যে তিনি, আতাউর রহমান সাহেব, ঐ সাক্ষাৎকারের সময় উপস্থিত ছিলেন না। কমরুদ্দীন সাহেবের কথা শুনে আতাউর রহমান সাহেব রীতিমতো বিব্রত বোধ করলেন। আমি তাকে বললাম, “আপনার সাথে জিন্নাহ সাহেবের সাক্ষাৎ ঠিকই হয়েছিলো তবে অন্যত্র অন্য কোন প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে। জিন্নাহ ঢাকাতে এসে সমাজের অনেক স্তরের লোকের সাথেই সাক্ষাৎ করেছিলেন। কাজেই আপনি তাদের কোন একটি গ্রুপে ছিলেন, কিন্তু কার্যপরিষদের সাক্ষাৎকারের সময় আপনি উপস্থিত ছিলেন না। “

কমরুদ্দীন সাহেবের জবাবের পর আতাউর রহমান সাহেব আর পূর্বের মতো জোর দিয়ে তার উপস্থিতির কথা বলতে পারলেন না, তবে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “উপস্থিত যদি না থাকবো, তাহলে আমি সেই সাক্ষাৎকারের এত বিস্তৃত বিবরণ দিতে পারলাম কি ভাবে?” আমি বললাম, “খুব সোজা। কারণ জিন্নাহ সাহেবের সাথে অল্প বয়স্ক ব্যক্তি এবং যুবকদের সেই উত্তেজনাপূর্ন সাক্ষাৎকারের বিবরণ তখন লোকের মুখে মুখে অনেক ছড়িয়ে ছিলো। আপনিও নিশ্চয় সেই বিবরণ অনেকের মুখেই শুনেছেন। এবং শুনতে শুনতে শেষ পর্যন্ত গল্পটি এত পরিচিত হয়ে উঠেছে যে’ ভুলবশতঃ আপনি নিজের উপস্থিতিও সেখানে ধরে নিয়েছেন। জিন্নাহ সাহেবের সাথে অন্যত্র আপনার সত্যিকার একটি সাক্ষাৎকার আপনার এই ভুল সৃষ্টির ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে কাজ করেছে। স্মৃতির ক্ষেত্রে এমনটি ঘটা মোটেই অসম্ভব বা অস্বাভাবিক বিচিত্র কিছু নয়। ‘ আমার এ কথা শুনে আতাউর রহমান সাহেব আরও দূর্বল হলেন। আমি ভাবলাম এ ক্ষেত্রে ভ্রান্তির নিরসন হলো। পরে আমি আবার কমরুদ্দীন সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। এবং তিনি আমার মতকেই দৃঢ়ভাবে সমর্থন করলেন।

আসলে জিন্নাহর সাথে কার্যপরিষদের ঐ সাক্ষাৎকারের সময় আতাউর রহমান সাহেবের উপস্থিতির কোন প্রশ্ন ছিল না। কারণ সেই সাক্ষাৎকার শুধুমাত্র তৎকালীন রাষ্ট্রভাষা কার্যপরিষদের সদস্যদের সাথেই হয়েছিল এবং তিনি সেই কার্যপরিষদের সদস্য ছিলেন না।

আমি ভেবেছিলাম, আমার সাথে সেদিনের সাক্ষাৎকারের পর আতাউর রহমান খান সাহেব নিজের ভুল যথাযথ ভাবেই উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু আমার বইয়ের প্রথম খন্ড প্রকাশিত হওয়ার পর একদিন তিনি আমাকে পুনরায় তার উপস্থিতির কথা বললেন এবং বইয়ের ঐ জায়গায় তার নাম উল্লেখ না করার জন্য অভিযোগ করলেন। আমি আমার পূর্ব মতটাই আবার তাকে জানালাম, কিন্তু এ নিয়ে কোন আলোচনা নিরর্থক মনে করে সে চেষ্টা থেকে বিরত থাকলাম। আতাউর রহমান সাহেব কিন্তু তারপর বিভিন্ন মহলে এবং নানা লোকের কাছে এই বলে অভিযোগ করেছেন এবং এখনো করছেন যে, আমার বইটিতে আসি সত্যের অপলাপ করেছি অর্থাৎ কৃতি ব্যক্তিকে তার যোগ্য কৃতিত্ব প্রদানে ইচ্ছাকৃত ভাবে বিরত থেকে অসাধুতার পরিচয় দিয়েছি। সমসাময়িক কালের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ এক অপরিহার্য বিড়ম্বনা।

শেখ মুজিবর রহমান সাহেবের সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গে দুই – একটি বিষয়ের উল্লেখ এখানে করব। তিনি সাক্ষাৎকারের সময় এমন ভাবে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে নিজের ভূমিকার কথা বর্ণনা করেছিলেন যেন তিনি সেই আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন এবং তার নির্দেশেই সমস্ত কিছু পরিচালিত হচ্ছিলো। আসল ব্যাপার কিন্তু তখন একটু অন্য রকম ছিলো। শরখ সাহেব কলকাতায় একজন নামকরা ছাত্রনেতা ছিলেন কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা ঢাকার ছাত্র সমাজের সাথে তার কোন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো না। এই ধরণের যোগাযোগ স্থাপন করতে স্বাভাবিকভাবেই তার কিন্তু সময় লেগেছিল। তবে সেটা ঘটেছিল ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের অনেক পরে। প্রথম পর্যায়ের ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকার ছাত্ররাতার নাম জানতো এবং তিনি নেতৃস্থানীয় কর্মীদের একজন ছিলেন। কিন্তু সে সময় তার অাঙ্গুলি হেলনে সব কিছু ঘটেছিল তবে তিনি ঐ ভাবে ঘটনার বর্ণনা দিতে থাকার সময় এক পর্যায়ে আমি বললাম, কিন্তু আপনার ভূমিকা যদি সে সময়ে এতো গুরুত্বপূর্ণ হবে তাহলে জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্র ভাষা কার্যপরিষদের সদস্যদের সাক্ষাৎকারের সময় আপনি সেখানে ছিলেন না কেন?” জবাবে তিনি হাস্যধ্বনি করে বললেন, “আমার থাকার তো কোন প্রয়োজন ছিল না। আমি তাজউদ্দীনকে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলাম।” কথাটি আমার কাছে খুবই বেখাপ্পা শোনালো।
প্রথমত, শেখ সাহেব নিজে তখন রাষ্ট্র ভাষা কার্য পরিষদের সদস্য ছিলেন না; দ্বিতীয়ত, জিন্নাহর সাথে কার্য পরিষদের সাক্ষাৎকার এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিলো যে, সেজন্য নিজে উপস্থিত না থেকে অন্যকে প্রতিনিধি রূপে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া নিঃসন্দেহে একটা বিষ্ময়কর ব্যাপার; তৃতীয়ত, সে সময় শেখ সাহেব ও তাজউদ্দীন সাহেবের সম্পর্ক এমন ছিলো না যে, শেখ সাহেব তাজউদ্দীন সাহেবকে এই ধরণের কোন নির্দেশ দিতে পারতেন। বস্তুতপক্ষে ঢাকার ছাত্র রাজনীতিতে তখন তাজউদ্দীন যথেষ্ট পরিচিত ও সক্রিয় এবং সেই হিসেবে রাষ্ট্র ভাষা কার্য পরিষদের সদস্য। শেখ সাহেবের সাথে সাক্ষাৎকারের পর আমি আবার তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে যখন তাকে শেখ সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি, তখন তিনি যথেষ্ট উত্তেজিত ভাবে কয়েকটি মন্তব্য করেন। সেই সব মন্তব্যের সারমর্ম ছিলো এই যে, শেখ সাহেবের ঐ বক্তব্য মোটেই সার্বিক নয়।

শেখ মুজিবর রহমান সাহেবকে আমি তার ভূমিকার গুরুত্ব সম্পর্কে আর একটি প্রশ্ন করিঃ “জিন্নাহ ঢাকায় ছাত্র নেতাদের, প্রধানতঃ মুসলিম ছাত্র লীগের নেতাদের পারস্পরিক ঝগড়া ও দলাদলির মীমাংসার জন্য তাদের কয়েকজনের সাথে ২০ শে, ২২ শে, ২৩ শে, ২৪ শে মার্চ সাক্ষাৎ করেন (প্রথম খন্ড, পৃ ১১৬ – ১২২) তার মধ্যে আপনি ছিলেন না কেন?” এর জবাবেও তিনি ঐ একই জবাব দেন, “আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সেখানে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলাম। ” শেখ সাহেবের এই জবাবও বেখাপ্পা ছিলো। কারণ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেই সাক্ষাৎকারে উপস্থিতদের মধ্যে একজন ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভাইস প্রেসিডেন্টের পদাধিকার বলে। তাছাড়া তৎকালে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথেও শেখ সাহেবের এমন কোন সম্পর্ক ছিলো না যাতে তিনি তাকে ঐ ধরনের কোন ‘নির্দেশ’ দিতে পারতেন।

এই সব উপস্থিতির বিষয়টি সম্পর্কে সম্ভাব্য ভ্রান্তি দূর করার জন্য তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে উপরোক্ত সাক্ষাৎকারের পর এ নিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথে পুনরায় আলাপ করার কোন প্রয়োজন আমি বোধ করিনি।

১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চের একটি ঘটনাকে আমি নিম্নলিখিত ভাবে উল্লেখ করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সভায় নির্ধারিত সময়ের কিছু পূর্বেই বেলা দেড়টার সময় শেখ মুজিবর রহমান কালো শেরওয়ানী এবং জিন্না টুপী পরিহিত হয়ে একটি হাতল বিহীন চেয়ারে সভাপতির আসন অধিকার করে বসেন। সেই সভায় তার সভাপতিত্ব করার কথা ছিল না কারণ ঢাকার তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে তার ভূমিকা ছিল নিতান্ত নগণ্য। কিন্তু এ সত্ত্বেও তিনি নিজেই সেই সভায় সভাপতিত্ব করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সভাপতির চেয়ার দখল করেন। সভার প্রথম দিকেই সকালে ফজলুল হক হলের গৃহীত নিম্ন লিখিত সংশোধনী প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়…. উপরোক্ত প্রস্তাব গুলো গৃহীত হওয়ার পর অলী আহাদের মাধ্যমে সেটি প্রধান মন্ত্রী নাজিমউদ্দীনের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ প্রস্তাব গ্রহনের পর শেখ মুজিবর রহমান অন্য কাউকে বক্তৃতার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বক্তৃতা শুরু করেন। সেই এলোপাথারি বক্তৃতার সারমর্ম কিছুই ছিলো না। অল্পক্ষণ এই ভাবে বক্তৃতার পর তিনি অন্য কাউকে বক্তৃতার সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ ‘চলো চলো অ্যাসেম্বলি চলো’ বলে স্লোগান দিয়ে সকলকে মিছিল সহকারে পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার জন্য আহবান জানান। সেদিন কার পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী মিছিলের কোন কথা ছিল না। কিন্তু এই হঠাৎ উদ্ভুত পরিস্থিতির পর মিছিলকে বন্ধ করা কারো পক্ষে সম্ভব হলো না। কাজেই ছাত্ররা সরকার বিরোধী এবং বাংলা ভাষার সমর্থনে নানা প্রকার ধ্বনি দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হলো। “

১৬ শে মার্চ ঘটনার উল্লেখে প্রথমে আমি তাজউদ্দীনের ডায়েরীতে পাই (প্রথম খন্ড, ডায়েরীর ফটোকপি দ্রষ্টব্য)। তারপর আমি তোয়াহা সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করি এবং ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ তার থেকেই সংগ্রহ করি। তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে আমি এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি তোয়াহা সাহেবের বিবরণ যে সঠিক সে কথা বলেন। সেই অনুযায়ী ঘটনাটি আমি বইয়ে লিপিবদ্ধ করি।

বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর পর (শেরওয়ানী টুপি পরিহিত শেখ সাহেবের সভাপতির চেয়ার দখল করা ইত্যাদি বিবরণ নিয়ে) আওয়ামী লীগ মহলের লোকদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই আমার সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। সঠিক কিনা জানি না, তবে লোক মুখে শুনেছি এই নিয়ে শেখ সাহেব ও তাজউদ্দীন সাহেবের মধ্যে কিছুটা তিক্ততার সৃষ্টি হয়।

একদিন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের বাসায় তার সাথে দেখা করতে গিয়ে তাজউদ্দীন সাহেবকে দেখি। তিনি আমাকে বলেন যে, ঘটনাটিকে ঐ ভাবে বর্ণনা করে আমি ঠিক করি নি এবং তিনি ঐ ধরণের কোন তথ্য আমাকে দেন নি৷ তার ডায়েরীতেও ঐ ধরণের কোন কথা নেই। জবাবে আমি তাকে বলি যে, ডায়েরীতে অত বিশদ বিবরণ নেই এবং ঐ কথারও কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু সাক্ষাৎকারের সময় তিনি ঐ বিষয়ে তোয়াহা সাহেবের বর্ণনাকে সঠিকই বলেছিলেন। তিনি বলেন যে, আমি সঠিকভাবে তার বক্তব্য লিপিবদ্ধ করিনি। তার এ কথার পর আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে বলি যে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে আমি তোয়াহা সাহেবের দেওয়া তথ্যকে সঠিক বলে মনে করি তাই ঘটনাটিকে আমি ঐ একই ভাবে দ্বিতীয় সংস্করণেও বর্ণনা করবো তবে তার নাম এ ক্ষেত্রে তথ্যের উৎস হিসেবে আর উল্লেখ করবো না।

আসলে উল্লেখিত সময়ে মহম্মদ তোয়াহা ছিলেন ফজলুল হক মুসলিম হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং তৎকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সমাজের একজন সুপরিচিত ও প্রভাবশালী নেতা। তাছাড়া, ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ফজলুল হক হলই ছিলো সব কিছু কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র। এজন্য ঐ দিন ফজলুল হক হলের সকালের সভায়, দুপুরের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে যে ছাত্র সভা আহবানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তাতে ফজলুল হক হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট (সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়ন বলে কিছু ছিলো না।) হিসেবে তোয়াহা সাহেব ও অন্যান্যরা উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই শেখ সাহেব কিছু ছাত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন এবং সভাপতির আসন গ্রহণ করে সভার কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই আরম্ভ করে দেন।

এখন সংবাদপত্রের রিপোর্টিং সংক্রান্ত একটি সমস্যা প্রসঙ্গে একটি ছোট্ট ঘটনা উল্লেখ করবো। বাংলা একাডেমীতে একদিন আবু জাফর শামসুদ্দিন সাহেব আমাকে বললেন যে, তার সম্পর্কে আমার বইয়ে আমি ভুল তথ্য দিয়েছি। উল্লেখ করেছি যে তিনি এবং অধ্যাপক আবুল কাশেম উভয়ে তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে ৫ ই ডিসেম্বর ১৯৪৭ তারিখে ভাষার প্রশ্ন আলোচনার জন্য মৌলানা আকরাম খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। অথচ তিনি আবু জাফর শামসুদ্দীন কোন দিনও তমদ্দুন মজলিসের সদস্য ছিলেন না এবং অন্য কোন সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সাথেও তার কোনদিন কোন সম্পর্ক ছিলো না। শামসুদ্দীন সাহেবের রাজনৈতিক মতামতের সাথে আমি পরিচিত ছিলাম না তবে আমি তাকে বললাম ঐ ভাবে ঘটনাটি উল্লেখ করার পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ ছিলো। তৎক্ষনাৎ বইটি এনে দেখা গেলো যে, আমার তঁথ্যের উৎস ৬ ই ডিসেম্বর, ১৯৪৭, এর মর্নিং নিউজ পত্রিকা অনুসরণ করেই আমি লিখেছিলাম, ‘ঐ দিনই তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে আবুল কাসেম এবং আবু জাফর শামসুদ্দীন মৌলানা আকরাম খানের সাথে ভাষার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেন। ” (প্রথম খন্ড, পৃঃ ১৯) শামসুদ্দীন সাহেব বললেন, মর্নিং নিউজের রিপোর্ট ভ্রান্ত। আমি তার কথা তৎক্ষনাৎ মেনে নিয়ে তাকে জানালাম যে, দ্বিতীয় সংস্করণে এই ভুল শুদ্ধ করা হবে। তবে ভুলটি সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং ভ্রান্ত সংবাদপত্র রিপোর্ট থেকে অদ্ভুৎ।

আমি ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে খুব অসুস্থ হয়ে ঢাকার পি, জি হাসপাতালে যাই৷ সে সময়ে কবি জসিম উদ্দীনও হাসপাতালে ছিলেন। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে তিনি আমাকে দেখতে আসেন। অল্প কিছু কথাবার্তার পর তিনি আমাকে বলেন, “তোমার ভাষা আন্দোলনের ওপর বইটিতে তুমি সৈয়দ আলী আহসান সম্পর্কে যা লিখেছো তা মোটেই সঠিক নয়৷ তুমি লিখেছো যে, সে নাকি ফজলুর রহমান সাহেবকে উর্দু অক্ষর প্রবর্তন করা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিলো৷ অথচ ব্যাপার একেবারে উল্টো৷ সে কখনোই ফজলুর রহমানকে আরবী অক্ষর প্রবর্তন থেকে বিরত রাখতে চায়নি৷ তোমার ওর সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই৷ “

আমি জসিম উদ্দীন সাহেবকে বললাম, সৈয়দ আলী আহসান ফজলুর রহমানকে আরবী অক্ষর প্রবর্তন থেকে বিরত করার চেষ্টা করেন, ঠিক এ ধরণের কথা আমি তো বলিনি৷ তিনি বলেন, “তুমি যা বলেছো, তার অর্থ তাই।” এর পর তিনি বললেন যে, আমাকে লিখিতভাবে তিনি এ বিষয়ে নিজের মতামত জানাবেন।

আমি আলোচ্য বিষয়ে আমার বইয়ে যা লিখেছিলাম তা হলো এইঃ “১৯৪৮ সালে ফজলুর রহমান সৈয়দ আলী আহসান এবং অন্যান্য কয়েক জনের সাথে মাওলানা সাহেবের বাসায় আরবী হরফ প্রবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করেন। আলী আহসান তাকে বলেন যে পরিকল্পনাটির সম্ভাব্যতা পরীক্ষার জন্য ডক্টর শহীদুল্লাহ্ই সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ব্যক্তি। কাজেই তাকে সেই দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। ” (প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৫৮)

উপরের বিবরণ থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, সৈয়দ আলী আহসান ফজলুর রহমানকে আরবী হরফ প্রবর্তন থেকে বিরত করার চেষ্টা করেন সে কথা আমি বলিনি।

যাই হোক, এর পর কবি জসিম উদ্দীন ২।৭ ৭২ তারিখে আমাকে এ সম্পর্কে একটি পত্র দেন। সেই পত্রে আরবী হরফ প্রবর্তনের বিষয়ে ফজলুর রহমান, ফজলে করিম ফজলী এবং সৈয়দ আলী আহসানের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি যা বলেন সেই অংশটি আমি নীচে উল্লেখ করছিঃ

“আমি তখন সরকারের তথ্য বিভাগের গীতিপ্রচারের সংগঠক হিসেবে কাজ করি। এক সময় আমাদের ভূতপূর্ব ছাত্র আজিজুল হক আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, দেখুন আপনার বন্ধু প্রেস কনফারেন্স ডাকিয়া কি কান্ড করিতেছেন। তিনি বাংলার পরিবর্তে উর্দু বর্ণমালা প্রবর্তন করাইবেন। প্রেস কনফারেন্সে এই কথা ঘোষণা করিলেন।
শুনিয়া আমি তো আকাশ হইকে পড়িলাম। বাঙ্গালী জাতির এমন সর্বনাশ তিনি কি করিয়া করিতে যাইবেন?
আমি ফজলুর রহমান সাহেবকে যাইয়া বলিলাম, ” বর্ণমালা প্রবর্তনের ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করিতে চাই।” তিনি আমাকে বলিলেন, আজ রাত ৮ টার পরে আপনি মওলা মিঞার বাসায় আসিবেন। মওলা মিঞা তখন থাকিতেন ফুলবাড়িয়া রোডের একটি বাসায়। সেইখানে যাইয়া দেখিতে পাইলাম শিক্ষা সম্পাদক মিঃ ফজলে করিম ও সৈয়দ আলী আহসান সেইখানে আগেই আসিয়া বসিয়াছেন। মন্ত্রী সাহেব পূর্বেই তাহাদিগকে ডাকিয়া থাকিবেন।”
কুশল প্রশ্নের পর আমি বলিলাম, “বাংলার পরিবর্তে উর্দু বর্ণমালা প্রবর্তন করিতে যাইয়া আপনি বাঙালী জীবন সংগ্রামে পশ্চিমাদের সঙ্গে হারিয়া যাইবার সুযোগ করিয়া দিতেছেন।” তিনি বললেন, “বাঙালী জাতির প্রতি আপনার বড়ই হীন ধারণা। বাঙালীরা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই উর্দু বর্ণমালা শিখিয়া পশ্চিমা ছাত্রদিগকে ডিংগাইয়া যাইবে। “
পাশে বসিয়া সৈয়দ আলী আহসান আর ফজলে করিম সাহেব মন্ত্রী সাহেবকে সমর্থন জানাইতেছিলেন।
আমি বলিলাম, “আপনার এই কথা আমি বিশ্বাস করি না। তা ছাড়া এখনই আমাদের দেশে প্রেস নাই, বই পুস্তক ছাপাইবার কাগজপত্র নাই। আমাদের অতীত কালের যে সব সাহিত্যিক তাহাদের অমর অবদান রাখিয়া গিয়াছেন, তাহা উর্দু অক্ষরে রূপান্তরিত করা সরকারের সাধ্য নাই। উর্দু অক্ষর প্রবর্তন করিলে আমাদের ছাত্ররা সেই সব সাহিত্য উপভোগ হইতে বঞ্চিত হইবে।
মন্ত্রী সাহেব বলিলেন, ” সরকার ইচ্ছা করিলে কি না করিতে পারেন। কামাল পাশা অল্প দিনের মধ্যে তুরস্কের বর্ণমালা পরিবর্তন করিলেন।
আমি বলিলাম, কামাল পাশার মতো বড়ো প্রতিভা আমাদের দেশে নাই। “
তিনি বলিলেন, “অপেক্ষা করুন, আমিই এ কাজ করিব। দেখেন বাংলা ভাষায় কোন লাইন টাইপ মেশিন নাই, টাইপ রাইটার নাই। উর্দু ভাষায় আছে৷ উর্দু বর্ণ প্রবর্তন করিলে আমরা এই সব মেশিনের সাহায্য পাইবো। “
আমি উত্তর করিলাম, “পশ্চিমবঙ্গে তারও পূর্বে লাইনো মেশিন ও টাইপ রাইটার আছে। ” ফজলে করিম বলিলেন, “আপনি ভারতের দিকে অত তাকাইতেছেন কেন?”
একে তো ফজলুর রহমান খুব নামকরা তার্কিক, তার উপর ফজলে করিম ও আলী আহসান তাহার সমর্থনে এই কথা সেই কথা বলিতেছিলেন। ইহা তর্কের সময় বড়ই অসুবিধাজনক। আমি আলী আহসানকে ধমক দিয়া বলিলাম, “আমি কথা বলিতে আসিয়াছি আমার বন্ধু ফজলুর রহমানের সঙ্গে। তোমাদের সঙ্গে নয়। ” শুনিয়া আলী আহসান চুপ করিয়া গেল। ফজলে করিম তবু থামিলেন না। আমাকে জিজ্ঞেস করিলেন, “আপনি মুসলিম সভ্যতায় বিশ্বাস করেন?”
আমি বললাম, মুসলিম সভ্যতা বলিয়া কিছু আছে কিনা জানি না কিন্তু পারশ্য সভ্যতা আছে, আরব সভ্যতা আছে, এমন কি বাঙালী সভ্যতাও আছে। ” আমার কথা শুনিয়া ফজলে করিম আর আলী আহসান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসিলেন।
ফজলুর রহমান সাহেবকে আমি বলিলাম, “আপনি উর্দু বর্ণমালার প্রবর্তন করিতে যাইয়া বাঙালী সন্তানদিগের একটা চক্ষু কানা করিয়া দিতেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ হইতে আধুনিক কাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে যে অপূর্ব সাহিত্য তৈরী হইতেছে, আমাদের ছেলে মেয়েরা তাহা হইতে বঞ্চিত হইবে। “
তিনি বলিলেন, “আমিও তাহাই চাই৷ পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য কলায় আকৃষ্ট হইয়া তাহারা আর নিজের দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হইতে পারিবেনা।”
এইরূপ কথায় বার্তায় অনেক রাত হইয়া গেল। সব কথা এখন ভাল করিয়া মনে করিতে পারিতেছি না। বিদায়ের সময় আমি ফজলুর রহমান সাহেবকে বলিলাম, “আজ হইতে বর্ণমালার ব্যাপারে আমি আপনার বিপক্ষে কাজ করিব।” ফজলুর রহমান বলিলেন, “আপনাকে একাই তাহা করিতে হইবে। কেহ আপনাকে সমর্থন করিবে না। “
ইহার কিছুদিন পরে সৈয়দ আলী আহসান যদিও বাংলায় এম, এ নিয়া করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার প্রধান নিযুক্ত হইলেন। ‘

পত্রটি কবি জসিম উদ্দীন নিজ হাতে আমাকে প্রদান করেন। এটি পড়ার পর আমি তাকে বলি যে, বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময় তার অভিমত আমি উপযুক্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবো।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইটি লেখার সময় আমি এমন কিছু রাজনৈতিক ব্যাক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছি যারা নিজেদের ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করার কোন চেষ্টা করেননি, এবং সাক্ষাৎকারের সময় যথাসাধ্য নির্ভুল তথ্য প্রদানের চেষ্টা করেছেন। এই ধরণের ব্যক্তিদের মধ্যে লালা শরদিন্দু দে, নগেন সরকার, অক্ষয় ভট্টাচার্য, কামরুদ্দীন আহমদ, শহীদুল্লাহ্ কায়সার প্রভৃতির নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।

যাদের থেকে বস্তুতপক্ষে কোন সাহায্যই এই ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে পাইনি তারা একদিকে ভাষা আন্দোলনের সাথে কিছুটা সম্পর্কিত এবং অপর দিকে নিজেরা লেখকও৷ তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে, এমনাি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের উৎসাহের অভাব দেখে অনেক সময় আমি রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি।
সাতচল্লিশের শেষ থেকে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের ক্রম বিকাশে আমার যে বিষয়টি চোখে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে সেটি হলো, এই আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিলেন ছাত্রসমাজ এবং তাদের সমর্থন জুগিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ও প্রাক্তন ছাত্ররূপে তৎকালীন পরিচিত এবং পরবর্তী কালের নেতারূপে। জাতীয় জীবনের বেশ কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আর এই একই সঙ্গে সবিশেষ লক্ষ্যণীয় যে, ছাত্রদের এই আন্দোলন যে পর্যায়ে ছাত্র জনতার সম্মিলিত সংগ্রামে রূপান্তর লাভ করেছে, সে পর্যায়ে নেতৃত্বদানের প্রাথমিক সব সংকট বাঁধা ও বিপত্তির পুরোভাগে ছাত্ররা থাকলেও পরবর্তী কালের নেতৃত্বের দাবীতে অনোকে সোচ্চার হয়েছেন এবং সংগ্রামের পশ্চাতে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে নিজেরাই প্রশস্তিগীত গেয়েছেন। ভাষা আন্দোলনকে বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অঙ্গন থেকে রাজপথে এবং তাদের জনপদ থেকে জনপদে, মাঠ, ঘাট, প্রান্তরে প্রসারিত করেছে এদেশের সংগ্রামী ছাত্র সমাজ। এই আন্দোলনের উপ্ত বীজ পরবর্তী পর্যায়ে সরদার ফজলুল করিমের ভাষায়, ‘১৯৫২ সালের ভাষার দাবীতে যে রক্তাক্ত সংগ্রাম শুরু হয়, ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সে সংগ্রাম পরিণতি লাভ করে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন তাই ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে এবং জাতীয় মুক্তির ক্ষেত্রে একটি অনন্য তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলন।’ (দর্শন কোষ, পৃঃ ৬৭)

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শিক্ষা সম্মেলনে যখন বলা হলো, উর্দু হবে পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা এবং তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষার্ধে গণপরিষদের প্রথম সভায় বাংলাকে উর্দু ও ইংরেজীর সঙ্গে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের ধীরেন দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবের বিরোধিতা করে যখন মন্তব্য করেন যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীর এই মনোভাব যে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্র ভাষা রূপে গ্রহন করা যেতে পারে’ – তখনও ছাত্র সমাজ শিক্ষা সম্মেলনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১৯৪৭ সালের ৬ ই ডিসেম্বর প্রতিবাদ সভায় মিলিত হন এবং গণপরিষদে বাংলা ভাষার দাবী অগ্রাহ্য হওয়ায় ক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজ ‘৪৮ এর ২৬ শে ফেব্রুয়ারী ধর্মঘট, প্রতিবাদ সভা ও মিছিলে তাদের বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। ২৬ শে ফেব্রুয়ারীর এই সভায় গৃহীত প্রস্তাবাবলীর মধ্যে প্রথম বারের মতো বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতি দানের দাবী জানানো হয়৷ এই সভার প্রস্তাবানুসারে ১১ ই মার্চ যে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়, তাতেও সক্রিয় ভূমিকা নেন ছাত্র সমাজ। ছাত্র সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাই পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন, কারারুদ্ধ হন। ১৪ ই মার্চ মুসলিম লীগের পরিষদ দলের ‘বর্ধমান হাউস’ এ (বর্তমান বাংলা একাডেমী ভবন) সভা চলাকালে ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ১৫ ই মার্চ পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক সভার প্রথম সভা অনুষ্ঠানের পরিপ্রেক্ষিতে ভাষার দাবীতে এই দিন যে ধর্মঘট আহুত হয়, তারও পুরোভাগে ছিলেন ছাত্রসমাজ। পিকেটিং, কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠি চার্জের ফলে ছাত্ররা আহত হন। জিন্নাহ সাহেব ১৯ শে মার্চ ঢাকায় এসে ২১ শে মার্চের সভায় ভাষা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বিষেদগার ও পরে ২৪ শে মার্চ বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে সুস্পষ্ট মত প্রকাশ করলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানেই ছাত্রেরা ‘না, না’ বলে এর প্রতিবাদ জানায়।

এ দিকে সাংগঠনিক দিক দিয়েও ছাত্র সমাজ অগ্রনী ভূমিকার অধিকারী৷ ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক সাহিত্য সভায় তমদ্দুন মজলিস সর্ব প্রথম রাষ্ট্র ভাষার জন্য সংগ্রাম পরিষদ গঠন করলেও ১৯৪৮ সালের ২ রা মার্চ ফজলুল হক হলে তদানীন্তন মুসলিম ছাত্রলীগ, বিভিন্ন ছাত্রবাস ও তমদ্দুন মজলিসের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই সর্ব দলীয় পরিষদ গণ – আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিস, সলিমুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ইত্যাদি ছাত্রাবাস ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, এদের প্রত্যেকটি থেকে ২ জন করে প্রতিনিধি এর সদস্য হিসেবে মনোনীত হন৷ এখানেও দেখা যাবে যে, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদে ছাত্ররাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দিনের যে আলোচনা মহম্মদ আলী ও খাজা নসরুল্লাহর মাধ্যমে ১৫ ই মার্চ সাড়ে এগারোটার সময় অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ছাত্র সংখ্যার প্রামাণ্য সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তবে বদরুদ্দীন উমর তার ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ বইয়ে আবুল কাসেম, কমরুদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা (হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছেন), নইমুদ্দিন আহমদ, নজরুল ইসলাম, আজিজ আহমেদ, আবদুর রহমান চৌধুরী (এ উপস্থিতির কথা আবুল কাসেম ও আবদুর রহমান চৌধুরী ছাড়া আর কেউ স্মরণ করতে পারেন না) প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন৷ তুমুল বিতর্ক ও উত্তেজনার মধ্যে পরিষদ প্রতিনিধিবর্গের সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দিনের আলোচনা অনুষ্ঠিত হলেও পরিষদের অনমনীয়তার ফলশ্রুতি হিসেবে আট দফা চুক্তি সাক্ষরিত হয়। বদরুদ্দীন উমরের বইতে এ সম্পর্কিত নিম্নোক্ত বিবরণ রয়েছে। এর শেষ দফাটি খাজা নাজিমুদ্দিনের নিজ হাতে লেখা বলে অমৃত বাজার পত্রিকায় ১৬ ই মার্চে ৩৪৮ সংবাদ প্রকাশিত হয়। চুক্তিগুলি নিম্নরূপঃ

১। ২৯ শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮ হইতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে, তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তি দান করা হইবে।

২। পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন।

৩। ১৯৪৮ এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভার বেসরকারী আলোচনার জন্য যেদিন নির্ধারিত হইয়াছে, সেইদিন। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং তাহারে পাকিস্তান গণ পরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের একটি বিশেষ প্রস্তাব উথ্বাপন করা হইবে।

৪। এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উথ্বাপন করা হইবে যে প্রদেশের সরকারী ভাষা হিসেবে ইংরেজী উঠিয়া যাইবার পরই বাংলা তাহার স্থলে সরকারী ভাষা রূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাংলা। তবে সাধারণ ভাবে স্কুল কলেজগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দান করা হইবে।

৫। আন্দোলনে যাহারা অংশগ্রহণ করিয়াছেন, তাহাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হইবে না।

৬। সংবাদপত্রের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে।

৭। ২৯ শে ফেব্রুয়ারী হইতে পূর্ব বাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জরী করা হইয়াছে, সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে।

৮। সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।

চুক্তি পত্রটি সাক্ষরিত হওয়ার পূর্বে আবুল কাসেম, কমরুদ্দীন আহমদ প্রভৃতি জেলখানায় উপস্থিত হয়ে ভাষা আন্দোলনের বন্দীদের চুক্তিপত্রটি দেখাস। শামসুল হক, মুজিবর রহমান, অলি আহাদ,শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রভৃতি চুক্তির শর্তগুলি দেখার পর তার প্রতি তাদের সমর্থন ও অনুমোদন জ্ঞাপন করেন। এর পর সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা আবার ‘বর্ধমান হাউসে’ ফিরে আসেন এবং সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কমরুদ্দীন আহমদ চুক্তিপত্রটিতে সাক্ষর দেন। (দ্রষ্টব্য পৃঃ ৮১-৮২)

এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণীর উল্লেখ এ কারণেই যে ছাত্র সমাজ নিশ্চুপ বসে ছিলেন না। তারা দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়ে মিছিল সহকারে পরিষদ ভবনের সামনে এসে হাজির হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। তাদের বিক্ষোভ চলা কালে পরিষদের অন্যতম সদস্য আবুল কাসেম এসে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার কথা জানালে উত্তেজনা হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ছাত্র সমাজ নাজিমুদ্দিনের সাথে চুক্তি সম্পাদনের জন্যই বিশেষ ভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আবুল কাসেম লাঞ্ছিত হন। মোহাম্মদ তোয়াহার হস্তক্ষেপে ও বক্তব্যে উত্তেজনা কিছু প্রশমিত হলেও বিক্ষোভকারীরানখাজা নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে চুক্তি সম্পর্কে বক্তব্য শুনতে চান। নাজিমুদ্দিন তাদের সামনে উপস্থিত হননি ; ফলে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে এবং ঘটনাস্থলেই সংগ্রাম কমিটির নেতারা পরদিন ধর্মঘট জানাতে বাধ্য হন।

ছাত্ররা ১৬ ই মার্চ সভায় মিলিত হয়, পরিষদ ভবনের সামনে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠি চার্জে শওকত আলী সহ অনেক ছাত্র আহত হন। সংগ্রাম পরিষদ পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে পর দিন ১৭ ই মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ধর্মঘট ও সভার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে মিছিল বের করা হবে না। এ অনুসারে ১৭ ই মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ধর্মঘট ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এরপরই ভাষা আন্দোলনের আর এক অধ্যায় শুরু হয় জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আগমনকে কেন্দ্র করে। ১৯ শে মার্চ ঢাকায় এসে ২১ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে তিনি ভাষা সমস্যা ও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করেন, তাতে উর্দু ভাষার সপক্ষে তার ওকালতি এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে উর্দুই হবে, এ কথাই নির্লজ্জ ভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। তার বক্তব্যে ছাত্র সম্প্রদায়ের সংগ্রামী ভূমিকা আপ্যায়িত হয় ‘রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের স্বার্থে প্রশাসনকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে ছাত্র সম্প্রদায়কে ব্যবহার ‘ বলে। রেস – কোর্সের সভায় প্রকাশ্যে বিরোধিতার সম্মুখীন না হলেও ২৪ শে মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সম্মানে আয়োজিত বিশেষ সমাবর্তন উৎসব ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে’ ঘোষণায় তাকে ছাত্রদের ‘না, না’ ধ্বনির প্রতিবাদ শুনতে হয়। এদের মধ্যে আবদুল মতিন, ও এ কে এম আহসানের নাম উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ দিন বিকেলের সাক্ষাৎকারে উত্তেজনা বৃদ্ধি ও একটি স্মারক-লিপি পেশ ছাড়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। ছাত্র নেতাদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকার মূলগতভাবে ছাত্রলীগের ঐক্য প্রচেষ্টার মধ্যে নিহিত ছিল। ভাষার প্রশ্নে সেখানে কোন সমাধানের সম্ভাবনাও ছিল না স্বভাবতই।

পরবর্তী সময়ে ১৯৪৮ এর ৬ ই এপ্রিল প্রাদেশিক পরিষদে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন (ক) পূর্ব বাংলা প্রদেশে ইংরেজীর স্থলে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহন এবং (খ) পূর্ব বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে স্কলারের মাতৃভাষা এ মর্মে এক প্রস্তাব পেশ করেন। পরিষদে আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তাতে (ক) ধারায় এবং তারপর যত শীঘ্র সম্ভব অসুবিধাগুলি দূর করা যায়, তত শীঘ্র তাহা কার্যকর করা হবে’ সংযোজিত হয়। পরিষদে অবশ্য এই প্রস্তাব নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ ঘটেছিল।

রাষ্ট্র ভাষা কর্ম পরিষদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির পরিবর্তে পরিষদ যে প্রস্তাব গ্রহন করে, তা সুস্পষ্টতঃই স্বতন্ত্র এবং সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দিনের বিশ্বাসঘাতকতা।

এরপরেও রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলার দাবী নস্যাৎ করার অশুভ তৎপরতা অব্যাহত থাকে। তদানীন্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী ফজলুর রহমান আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করেন এবং এর সমর্থনের ষড়যন্ত্র জাল বিস্তার করেন তাবেদারদের নিয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছাত্রীদের তরফ থেকে পাকিস্তানের শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড ও বর্ণমালা বিবেচনার বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে পেশকৃত স্মারকলিপিতে বাংলা হরফ সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী সংসদ (১০ ই ডিসেম্বর) , কলা ভবন প্রাঙ্গণের ছাত্র সমাজ ইকবাল হলের ছাত্রবৃন্দ (১১ ই ডিসেম্বর), জগন্নাথ কলেজ, ইডেন কলেজ এমনকি প্রদেশের অন্যান্য স্থানেও বহু সভা সমিতি আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের তীব্র প্রতিবাদ করে৷ এ পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলা সরকার ১৪ ই ডিসেম্বর যে প্রেসনোট জারী করেন তাতে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সভার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিথ্যা গুজব সৃষ্টি করা হচ্ছে এ কথা বলে ঘোষণা করা হয় যে, বাংলা ভাষা বর্তমান চালু হরফে লিখিত হবে কি আরবি হরফে লিখিত হবে প্রদেশবাসীর স্বাধীন মতামত দ্বারা সেটা নির্ধারিত হবে। অথচ তারপরের দিন শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের যে সভা হয়, তার শেষ দিনে (১৬ ই ডিসেম্বর) ‘অত্যন্ত সুক্ষভাবে বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রচলনের ষড়যন্ত্র হিসাবে বলা হয় যে যদি কোন ছাত্র তার মাতৃভাষার হরফে লিখিত পুস্তকাদি পাঠে আপত্তি করেন, তাহলে তার সেই আপত্তি বিশেষ ভাবে বিবেচনা করতে হবে৷

পূর্ব বাংলায় আরবী হরফের মাধ্যমে বাংলা ভাষা প্রচলনের উদ্যোগ হিসেবে ১৯৫০ সালের ১৮ ই এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের উদ্যোগে ২০ টি কেন্দ্রে আরবী হরফে বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু হয়। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য আরবী হরফে বাংলা বই ছাপিয়ে বিতরণ করা হয়।

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ এর প্রতিবাদ করেন৷ ইতিমধ্যে আবার আরবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী উত্থাপিত হয়।

বিগত ঊনিশ’ শ সাতচল্লিশ থেকো পঞ্চাশ অবধি এভাবেই কেন্দ্রীয় সরকার ধীরে চল এবং সুক্ষ্ণভাবে বাংলা ভাষার আদল পাল্টে দিয়ে তাদের ষড়যন্ত্র জাল ক্রম প্রসারিত করে চলে। ইতিমধ্যে জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যু, খাজা নাজিমউদ্দিনের গভর্নর জেনারেল পদন্নোতি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী রূপে লিয়াকত আলী খানের অভ্যুদয় ও ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে আততায়ীর হাতে তার রহস্যজনক হত্যাকান্ড এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী রূপে খাজা নাজিমউদ্দিন এবং এর পাশাপাশি পূর্ব বাংলাও আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানের জন্ম, যুবলীগের অভ্যুদয়, মুসলিম লীগ দলে দুই উপদলের সৃষ্টি প্রভৃতি ঘটনায় ভাষা সমস্যাটি কিছুটা কম প্রাধান্য লাভ করে৷ বিশেষ করে সাংবিধানিক প্রশ্নটি যখন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছিল মূলনীতি কমিটির রিপোর্টে তখন সারা পূর্ব বাংলা বিক্ষুব্ধ। প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন, কেন্দ্র ও প্রদেশের সম্পর্ক, স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি জটিল সমস্যার সমাধান হলে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের একটা সুরাহা হবে বলে রাজনৈতিক মহল আশাবাদী। কিন্তু ১৯৫২ সালের জানুয়ারী মাসের শেষান্তে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী রূপে এসে খাজা নাজিমউদ্দিন সদম্ভে ঘোষণা করলেনঃ একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

পূর্ব বাংলায় তখন কেন্দ্র বিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তির নতুন অভ্যুত্থানের উষালগ্ন। ছাত্র সমাজও নীরব বা নিশ্চুপ নয়। ৩১ শে জানুয়ারী ঢাকা বার লাইব্রেরী হলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবীতে প্রদেশের সর্বত্র সভা সমিতি শুরু হয়ে গেল। সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে একুশে ফেব্রুয়ারী সারা দেশব্যাপী ধর্মঘটের আহবান জানান। এই একই দিনে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন তখন নূরুল আমিন। স্বীয় দলে তার প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ থাকলেও তার একজন উগ্র সমর্থক মোহন মিয়া দলের মধ্যে থেকেই তার বিরোধিতা করছেন। পরিষদে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ছাড়াও নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কয়েকজন সদস্য রয়েছেন। নূরুল আমিন সাহেব ও তার পেছনের শক্তি কেন্দ্রীয় সরকারের অবাঙালী আমলারা সংগ্রাম পরিষদের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য হিংস্র হয়ে উঠলেন। তাদের প্রথম শিকার হলো, বাংলা ভাষার সমর্থক ‘পাকিস্তান অবজারভার ‘ কে তুচ্ছ অজুহাতে নিষিদ্ধ করা। ঢাকার প্রকাশিত সংবাদ পত্রগুলির মধ্যে আজাদ ও সংবাদ মুসলিম লীগ সমর্থক, মিল্লাত মোহন মিয়ার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কাগজ হলেও মুসলিম লীগ পন্থী, মর্নিং নিউজ যে মুসলিম লীগ অনুসারী, তাই – ই নয়, উপরন্তু উগ্র বাঙালী বিরোধী, ইনসাফও যথেষ্ট মুসলিম লীগ ঘেঁষা তবে সে সময় যথেষ্ট বিরোধী দলীয় সংবাদ প্রকাশ করতো। তদানীন্তন সরকার প্রথমতঃ বিরোধী দলীয় শক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলেন। দ্বিতীয়তঃ ছাত্ররা প্রাথমিক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ হলেও ক্রমশঃই তাদের আন্দোলন প্রশমিত হয়ে যাবে, এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী, তৃতীয়ত, সরকার বিরোধী কোন সংবাদ পত্রই নাই, তখন আন্দোলনকারীরা প্রচারের সমর্থন পাবে কার কাছ থেকে। পরবর্তী ঘটনা পর্যায় অবশ্য প্রত্যেকটি ধারণাকেই ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত করেছে। মূলতঃ ছাত্র শক্তির অপরাজেয় দূর্বার ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের জ্ঞানোদয় ঘটেনি। মর্নিং নিউজ ছাত্র জনতার প্রতি রোষে ভষ্মিভূত হয়েছিল। ‘আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন তো একুশের নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পরিষদ সদস্যপদ ইস্তফা দিলেন, মিল্লাত, ইনসাফ ছাত্র জনতার রোষ – বহ্নির দুর্নিরোধ্য বিকাশ প্রত্যক্ষ করে সুর পাল্লাটালো এবং সংবাদও ভাষা আন্দোলনের সত্যিকারের রূপ বিকাশে প্রতিবন্ধক হতে পারে নি। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য যে, সংবাদ পত্রগুলি মুসলিম লীগ দলভুক্ত হলেও কর্মরত সাংবাদিকরা অধিকাংশই যেমন উগ্র বাঙালী তেমনি রাজনৈতিক চেতনায় বামপন্থী আদর্শে দীক্ষিত ছিলেন।

তদানীন্তন সরকার ঢাকায় সংগ্রাম পরিষদের তৎপরতা লক্ষ্য করে ২০ শে ফেব্রুয়ারী রাত্রি থেকে সারা শহরে একমাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারী করেন। সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা জারী ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে খন্ড খন্ডভাবে ছাত্র ছাত্রী এসে সমবেত হতে শুরু করে৷ বিশ্ববিদ্যালয় ফটকের সামনে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী মোতায়েন। সারা ঢাকা শহর ধর্মঘটের আহবানে সাড়া দিয়ে যান বাহন চলাচল বন্ধ করে দোকান পাটের দরজায় তালা লাগিয়েছে। শুধু মাত্র রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীতে খন্ড খন্ড মিছিল এসে সমবেত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। সকাল ৮ টা থেকে সম্মিলিত ছাত্র ছাত্রীর পদভরে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ।

কিছু পরেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনের ঐতিহাসিক আমতলায় সভার কাজ শুরু হয়। সভার শুরুতে সংগ্রাম পরিষদের কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক বক্তৃতা শুরু করেন। তাদের বক্তব্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার মনোভাব প্রকাশ পায়। যতদূর মনে পড়ে, তারা এই মর্মে যুক্তি দেন যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে সরকারের প্ররোচনার ফাঁদে পড়তে হবে৷ কিন্তু তখন ছাত্র সমাজ স্তুতি ও নেতিবাচক মনোভাবের কাছে নতি স্বীকারে রাজী নয়। ফাল্গুনের আগুনঝরা মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় ফটকে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সদর্প পায়তারা ও সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন জুড়ে সম্মিলিত ছাত্র ছাত্রীর বাঁধভাঙা প্রাণের দূর্বার প্রকাশ ও সবার উপরে ভাষার দাবীতে মুখর ছাত্র সমাজের প্রতিরোধ নেতৃবৃন্দের সব যুক্তিকে নিমিষে ধুলিসাৎ করে দিল৷ মুহূর্ত মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে হবে। পরিষদ ভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে হবে। উদ্বেল জন সমুদ্রের প্রাণ – তরঙ্গকে কে রোধ করবে৷ কৌশল হিসেবে স্থির করা হলো যে, দল বেঁধে সবাই একসঙ্গে রাজপথে না বেরিয়ে দশ জনের (মতভেদে পাঁচ জনের) এক একটি দল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বেরিয়ে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হবে। যতদূর মনে পড়ে, প্রথমে ছাত্রী দের একটি দল বেরুবে আর এতে ছিলেন সুফিয়া ইব্রাহিম, সাফিয়া খাতুন, রওশন আরা ও আরো দুজন। যথারীতি এরা পুলিশের হাতে নাজেহাল হলেন কাঁদুনে গ্যাস প্রয়োগের ফলে। তারপর শুরু হলো মিছিলের সমুদ্র তরঙ্গ। সে সময় একথাই মনে হয়েছিলঃ কে বা আগে প্রাণ করিবেক দান, তারি লাগি কাড়াকাড়ি। মিছিলের পর মিছিল বেরুচ্ছে, পুলিশ বাহিনী কাকে বাঁধা দেবে, কাকে সামলাবে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অনন্য অবতারণা। ট্রাক বোঝাই করে গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের তোলা হচ্ছে।

ঢাকার সিটি এস, পি তখন ইদ্রিস। জেলা প্রশাসক কোরেশী আর পুলিশ সুপার মাসুদ মাহমুদ। বিশ্ববিদ্যালয় ফটকে অবশ্য মোতায়েন ছিলেন সিটি এস, পি ইদ্রিস। পুলিশ ছাত্র মিছিলের সমুদ্র তরঙ্গকে প্রতিরোধে নাজেহাল। এর পর তারা কাঁদুনে গ্যাস ছোঁড়া শুরু করলো। রাজপথে মিছিলকারীদের ওপরও কাঁদুনে গ্যাস ছোঁড়া হয়েছিল। পুলিশ বাহিনীর এই অশুভ উদ্যোগে ছাত্র ছাত্রীরা আরো রোষ বহ্নিতে পদীপ্ত হয়ে উঠলো। কিছু ছাত্র মধুর রেস্তোরাঁর পাশে মেডিক্যাল কলেজের প্রাচীর ভেঙে মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গনে প্রবেশ করলো। অনেক ছাত্রকে দেখলাম রুমাল ভিজিয়ে কাঁদুনে গ্যাসের প্রতিক্রিয়া প্রতিহত করতে। পুলিশী জুলুমে ছাত্ররা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ক্রম বর্ধিত সংখ্যায় মিছিল করে এগিয়ে চললো। তাদের উদ্দেশ্য পরিষদ ভবনে ব্যারিকেড সৃষ্টি। ইতিমধ্যে খবর এলো, পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করেছে। উত্তেজনা আরো বাড়তে থাকলো। তারপর এলো গুলিবর্ষণ। ছাত্রদের একটি দলকে পুলিশ অনুসরণ করছিল। তারা যখন মেডিক্যাল কলেজ মোড়ে (বর্তমান শহীদ মিনার প্রাঙ্গন) তখনই পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলী চালাতে শুরু করে। আমরা যারা তখনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বা এলেমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি, তারা এই গুলিবর্ষণের সংবাদে একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ ও আতংকিত, তারাও মেডিক্যাল কলেজের প্রাঙ্নাভিমুখে ছুটে চললাম। নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর সশস্ত্র পুলিশী হামলা ও গুলীবর্ষণের পরপরই মনে হয়েছে, এবার পুলিশ এসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বর্বর হামলা চালাবে। মেডিক্যাল কলেজের প্রধান প্রবেশপথে(এখন যেটা তালাবদ্ধ থাকে) এসে দেখি, একটি স্ট্রেচারে করে একজন নিহত যুবককে নিয়ে আসা হচ্ছে, পরে জানলাম, তিনি শহীদ রফিক। পুলিশের গুলীতে তার মাথার খুলি উড়ে গেছে। এর পরপরই কয়েক জন পরিষদ সদস্য এসে মেডিক্যাল কলেজের অভ্যন্তরে গেলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রাঙ্গন থেকে মাইকে ছাত্র নেতৃবৃন্দের কন্ঠে তখন পুলিশী বর্বরতার বিরুদ্ধে অগ্নিবর্ষী ভাষণ শোনা যাচ্ছে। শুনলাম পুলিশ শুধু নিরীহ ছাত্রদের ওপর গুলী চালায়নি, তাদের হিংস্র হামলা থেকে মেডিক্যাল কলোজ ছাত্রাবাসেও (বর্তমান শহীদ মিনার ও তৎসংলগ্ন এলাকা জুড়ে পরিব্যাপ্ত)অবস্থানরত ছাত্ররা অব্যাহতি পায় নি। মেডিক্যাল কলেজের প্রাঙ্গন থেকে মাইকে ভাষা আন্দোলনকারীরা ধর্মঘটী ছাত্রদের যে নির্দেশ দিচ্ছিল এবং পুলিশী অত্যাচারের বর্ণনা বিবৃত করছিল, পুলিশ সেখানে গিয়ে মাইক কেড়ে নিয়েছে ও ছাত্রদের উপর নৃশংস ভাবে লাঠি চার্জ করেছে। পরিষদ সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ এসে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রাঙ্গন থেকে মাইকে বক্তৃতা দিলেন।

আর এদিকে দাবাগ্নির মতো সারা শহরে ছড়িয়ে পড়লো পুলিশী গুলীবর্ষণ ও ছাত্র হত্যার নৃশংসতার খবর। মুহূর্ত মধ্যে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ বিশ্বিবদ্যালয় ও সংলগ্ন এলাকা থেকে প্রসারিত হয়ে রাজধানীর আনাচে কানাচে আলোড়ন তুলল। মোড়ে মোড়ে বিষ্মিত হতবাক জনতা নির্বাক হয়ে ভাষার দাবীতে ছাত্রদের পবিত্র রক্তদানে মনে মনে একাত্মতা রচনা করলেন ছাত্রদের সাথে। ছাত্র জনতার ঐক্য গ্রথিত হলো পবিত্র পুতঃ শহীদ রক্তের মালা দিয়ে।

পরবর্তী ঘটনাসমূহে ধারাবাহিকতা স্মৃতিতে আভাসিত না হলেও এটুকু মনে আছে যে, অনেক রাতে জগন্নাথ সাহা রোডে ফিরেছিলাম। ফেরার আগে পর্যন্ত মেডিক্যাল কলেজ ও পরে মুসলিম হলে গিয়েছি। পরদিনের কর্মসূচী জানার জন্য। কোন কিছু করণীয় আছে কিনা তাও জ্ঞাতব্য ছিল। শুনলাম, পরদিন সকালে আসতে হবে, অনেক ছাত্র গ্রেফতার হয়েছেন।

এ দিনের এ বিবরণী শেষ করার আগে একটি ঘটনার কথা প্রাসঙ্গিক ভাবে উল্লেখ্য। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন দলে দলে ছাত্র মিছিল বেরুচ্ছে, পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার করছে আর উত্তাল সমুদ্রের মতো ছাত্র সমাবেশ আন্দোলিত হচ্ছে, তখন হাসান হাফিজুর রহমান হঠাৎ বলে উঠেছিলেনঃ দেখে নিলাম, দেশকে দেখলাম, আমার বড় ভাই জহুরুল আলম সপ্রশ্ন হওয়ায় তাকে তিনি যা বলেছিলেন, তার মর্মার্থ হলো এই সংগ্রামী, সচেতন, প্রত্যয় প্রদৃপ্ত ছাত্র সমাজ – এ উত্তরকালে সংগ্রামী বাংলাদেশের প্রতিভাষ। তার এই মন্তব্য ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতো ছিল। উনিশ’ শ একাত্তরের ১৬ ই ডিসেম্বরই তার মূর্ত প্রকাশ।

সর্বশে আর একটি বিষয়ের উল্লেখ এখানে করবো আমার বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত, এমনকি ক্ষীণভাবে সম্পর্কিত ব্যক্তিরাও কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন যে, তাদের ভূমিকাকে আমি হয়তো উল্লেখই করিনি, অথবা উপযুক্ত গুরুত্ব দেইনি৷ এই সম্ভাব্যতা অনুমান করেই আমি প্রথম খন্ডের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় বলেছি, “ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে নেতৃত্ব স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন তাদের প্রত্যেকের ভূমিকা ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কারও গুরুত্ব প্রথম দিকে এবং কারও গুরুত্বপূর্ণ সব পর্যায়েই মোটামুটি উল্লেখযোগ্য হলেও বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে সেখানেও তারতম্য ছিলো, কাজেই ভাষা আন্দোলন ব্যক্তি বিশেষের সামগ্রিক ভূমিকাকে বুঝতে গেলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত পুরো সময়ের ইতিহাস আলোচনা ব্যতীত সেটা সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে আমি শুধু এতটুকুই আর বলতে পারি যে, ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির একটি তথ্যপূর্ণ ইতিহাস রচনাই আমার উদ্দেশ্য। কোন বিশেষ ব্যক্তিকে বড়ো অথবা ছোট করা নয়৷ যারা নিজেদের ভূমিকা যথাযথ ভাবে নির্ণয় করতে উৎসুক তাতের উচিৎ সামগ্রিক আন্দোলনের পটভূমিতে এবং অন্যান্য দের ভূমিকার সাথে সম্পর্কিত ভাবে নিজের নিজের ভূমিকাকে বিচার করা। ভাষা আন্দোলন বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমি নিজে এই পদ্ধতিই অনুসরণ করেছি।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1978.02.24-bichitra.pdf” title=”1978.02.24 bichitra”]