You dont have javascript enabled! Please enable it! যুব আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ঃ পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ | বদরুদ্দীন উমর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ঈদসংখ্যা ১৯৮৩ - সংগ্রামের নোটবুক

যুব আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ঃ পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ

বদরুদ্দীন উমর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ঈদসংখ্যা ১৯৮৩ 

১। যুবলীগ গঠনের প্রাথমিক উদ্যোগ

১৯৫১ সালের প্রথম দিকে মাহমুদ নূরুল হুদা নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে করাচী যান। বুলবুল চৌধুরী করাচী থেকে বিদেশ যাওয়ার পর অসুস্থ অবস্থায় নূরুল হুদা কিছুদিন করাচীতে থাকেন।
এই সময় একদিন পূর্ব বাংলার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার আবদুর রউফকে অনুরোধ করেন যাতে তিনি বিমান বন্দরে নূরুল হুদাকে ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দর থেকে নিয়ে আসেন। নুরুল হুদা (সম্পর্কে হাবিবুল্লাহ বাহারের মামা) অসুস্থতার পর দুর্বল শারীরিক অবস্থায় ঢাকা আসছিলেন বলেই হাবিবুল্লাহ বাহার এই অনুরোধ করেছিলেন। তিনি নিজে ভয় ও সাবধানতাবশতঃ এ কাজ করতে নিরুৎসাহী ছিলেন কারণ শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দীর প্রাক্তন প্রাইভেট সেক্রেটারী হিসেবে নূরুল হুদা তখন সরকারের কাছে ছিলেন সন্দেহের পাত্র।* আবদুর রউফ যথাসময়ে তেজগাঁ বিমান বন্দর থেকে নূরুল হুদাকে নিয়ে র‍্যাংকীন স্ট্রীটে প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেনের বাসায় পৌঁছে দেন।
আনোয়ার হোসেনের বাসায় আলোচনা প্রসঙ্গে নূরুল হুদা আব্দুর রউফকে বলেন যে, পূর্ব বাংলায় যুবকদের জন্য একটা নতুন সংগঠন করা দরকার। এ ব্যাপারে করাচীতে মিস ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গেও তাঁর আলাপ হয়েছে বলে নূরুল হুদা উল্লেখ করেন। ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে তখন লিয়াকত আলীর গন্ডগোল চলছিলো। কাজেই তিনি চাইছিলেন এই ধরনের একটা সংগঠনের মাধ্যমে বিরোধী রাজনীতি কিছুটা অগ্রসর হোক।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামে একটি সংগঠন গঠিত হয়েছিলো। নূরুল হুদার প্রস্তাবিত এই সংগঠনের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক ছিল না কারণ তাঁরা মনে করতেন যে, সেই পুরাতন সংগঠনের সঙ্গে কোন যোগ রাখতে গেলে নতুন সংগঠন ঠিকমতো গঠন করা সম্ভব হবে না।
আনোয়ার হোসেন এবং নূরুল হুদা একটি যুব সংগঠনের উদ্দেশ্যে কিছু প্রাথমিক তোড়জোড় শুরু করেন। এই উদ্যোগের সঙ্গে তাঁরা আবদুর রউফকেও সম্পর্কিত রাখেন। আব্দুর রউফ তখন ছিলেন ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির সেক্রেটারী। এজন্য প্রত্যক্ষ ভাবে এই উদ্যোগের সঙ্গে থাকা সম্ভব না হওয়ায় তিনি পরোক্ষ ভাবে থাকেন। তাঁকে সাংগঠনিক কমিটিতেও রাখা হয় তবে আবদুর রউফ নামে নয়, আবু সাঈদ, (আবু সাঈদ মহম্মদ আবদুর রউফ এই পুরো নামের অপরিচিত প্রথমাংশ) নামে।
এই প্রাথমিক উদ্যোগ শুরু হওয়ার সময় একদিন কমিউনিস্ট পার্টির অনিল মুখার্জী আবদুর রউফের কাছে এসে বলেন যে, তাঁরা যুবলীগ গঠনের যে কাজ শুরু করেছেন তাতে তাঁদের সমর্থন আছে। তাঁরাও এ ব্যাপারে সাহায্য করতে প্রস্তুত বলে অনিল মুখার্জী তাঁকে জানান। আবদুর রউফকে একথা বলার কারণ তিনি সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির টেক (গোপন) কাজ করতেন এবং সেই হিসেবে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনিল মুখার্জী এ প্রসঙ্গে আবদুর রউফকে আরও বলেন যে, ১৯৪৭ সালে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনের যে চেষ্টা করা হয়েছিলো সেটা সফল হয়নি কিন্তু তার প্রয়োজনীয়তা এখনো আছে। শুধু তাই নয়, তৎকালীন অবস্থায় তার সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি। কাজেই সেটা গঠনের ব্যবস্থা করলে তাঁরা সক্রিয়ভাবে সহায়তা করবেন। তবে আবদুর রউফ পার্টির টেক কাজ করতেন সে কারণে অনিল মুখার্জী তাঁকে প্রস্তুতি কমিটিতে না থাকার পরামর্শ দেন। এরপর কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে মুহম্মদ তোয়াহাও আবদুর রউফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং যুবলীগ গঠনের ব্যাপারে আলোচনা করেন।
ইতিমধ্যে আনোয়ার হোসেন (যাঁর সঙ্গে তখনো পর্যন্ত নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং মুসলিম লীগের কিছু সম্পর্ক ছিলো) সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করে ব্যবসা বাণিজ্য করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তিনি আবদুর রউফকে জানান যে, যে নতুন যুব সংগঠনটি গঠনের মূল সাংগঠনিক দায়িত্ব তখনো পর্যন্ত তাঁর ওপরই ছিলো সেই সংগঠনটিকে

* তৎকালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের প্রতি মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতনমূলক নীতি কি ধরনের ছিলো এবং তার ফলে এমন কি মন্ত্রী মহোদয়দেরর মনেও ভয়ভীতি কি পরিমাণ ছিলো বিশেষভাবে তারই একটি উদাহরণ হিসেবে এই ঘটনাটি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা হলো।–ব,উ।

তিনি ভালো লোকদের হাতে তুলে দিতে চান। ভালো লোক বলতে ঠিক কি বোঝাতে চান সেটা স্পষ্টভাবে না বললেও তিনি যে তার দ্বারা কমিউনিস্টদেরকেই বোঝাতে চেয়েছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। কারণ আবদুর রউফের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্কের বিষয় তিনি মোটামুটিভাবে জানতেন।
খালেক নামে মুসলিম লীগের গুন্ডা প্রকৃতির একজন কর্মী আনোয়ার হোসেনকে যুবলীগের ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের জন্য বলেছিলো এবং তিনি সে ভূমিকা পালন না করে অবসর নিলে তাদের হাতেই সংগঠনটি তুলে দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলো। কিন্তু আনোয়ার হোসেন তাতে সম্মত না হয়ে সংগঠনটি যাতে কমিউনিস্টদের হাতে চলে যায় তারই পক্ষপাতী ছিলেন। তৎকালীন সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি ছিলেন নূরুল হুদা। তাঁর প্রতিও আনোয়ার হোসেনের কোন আস্থা ছিলো না। কমিটি সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আবদুর রউফরা তোয়াহাকে সম্পাদক করার চিন্তা করেন। কিন্তু তোয়াহা তাঁকে জানান যে, তিনি নিজে সম্পাদক হতে চান না। তার পরিবর্তে তিনি অলি আহাদকে সম্পাদক করার প্রস্তাব করেন। কমিউনিস্ট পার্টিরও এই প্রস্তাবে সম্মতি আছে বলে তিনি জানান। কাজেই শেষ পর্যন্ত অলি আহাদকেই সম্পাদক করার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু সম্পাদকের ব্যাপারে কোন অসুবিধা না হলেও সভাপতি নিয়ে বেশ জটিলতার সৃষ্টি হলো। তখনো পর্যন্ত সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি ছিলেন নূরুল হুদা। তাঁর সম্পর্কে অনেকের ভালো ধারণা ধারণা না থাকলেও আবদুর রউফরা তাঁকে সভাপতি করতে অসম্মত ছিলেন না। কিন্তু অন্য অনেকের তাতে আপত্তি ছিলো। আনোয়ার হোসেনেরও তাতে তেমন সম্মতি ছিলো না। তাছাড়া তখনকার একমাত্র বিরোধী দলীয় দৈনিক পত্রিকা ‘পাকিস্তান অবজারভার’- এর সম্পাদক আবদুস সালাম ও সেই পত্রিকার কর্মরত সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী (যদিও তিনি নূরুল হুদার আত্মীয়) একথা জানান যে নূরুল হুদাকে সভাপতি করা হলে যুব লীগের কোন সংবাদই তাঁরা তাঁদের পত্রিকায় প্রকাশ করবেন না।
সেই অবস্থায় নূরুল হুদাকে সভাপতি করার চিন্তা বাদ দেয়া ব্যতীত উপায় থাকলো না। কাজেই সাংগঠনিক কমিটির নাম বদল করে অভ্যর্থনা কমিটি করার এবং নূরুল হুদাকে তার চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।
এই সময় সিলেটের তসদ্দুক আহমদের (তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত) মাধ্যমে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ও সিলেটের সাপ্তাহিক ‘নওবেলাল’-এর সম্পাদক মাহমুদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এবং তাঁর সঙ্গে এই যোগাযোগের মাধ্যমে তাকেই যুব লীগের সভাপতি করার ব্যাপারে সকলে একমত হন।
৬ মার্চ, ১৯৫১ তারিখে ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলী হলে সন্ধ্যার দিকে যুব সম্মেলনের ব্যাপারে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন বদিউর রহমান। সভায় যুবলীগের উদ্দেশ্য ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেন মুহম্মদ তোয়াহা। এরপর ১৪ মার্চ পুনরায় যুব-সম্মেলনের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় ফজলুল হক হলের ৬০ নম্বর কামরায়। তাতে উপস্থিত থাকেন হাবিবুর রহমান শেলী, সৈয়দ মুহম্মদ আলী; বদিউর রহমান; মকসুদ আহমদ, রোকেয়া এবং অন্য এক মহিলা।
যুবলীগ সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটি গঠনের জন্য ঢাকার বার লাইব্রেরী হলে একটি সভা আহ্বান করা হয়। খবর পৌঁছায় যে সালেক প্রভৃতি মুসলীম লীগের গুন্ডারা ঐ সভা ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা করছে। এই খবর পাওয়ার পর যুব-লীগের সংগঠকরাও তাদের গুন্ডামি প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
আব্দুর রউফ সে সময় ছিলেন ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির সেক্রেটারী। তাঁর এই অবস্থানের সুযোগ নিয়ে সম্মেলনের উদ্যোক্তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, আহ্বায়ক কমিটি গঠনের সভা শুরু হওয়ার আগে থেকে সভাস্থলে মিউনিসিপ্যালিটির কয়েকশো মেথর ধাঙড়কে সেদিন বার লাইব্রেরীর আশপাশে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে।
সেই অনুযায়ী সভার দিন মেথররা বার লাইব্রেরীর সামনে কেউ কেউ লাঠি হাতে এবং কেউ কেউ খালি হাতে ঘোরাফেরা করে পাহারা দিতে থাকলেন। সালেক তার কিছু লোকজন নিয়ে বার লাইব্রেরীর কাছে এসে পরিস্থিতি দেখার পর স্থান ত্যাগ করলো এবং তার ফলে শেষ পর্যন্ত আর কোন গণ্ডগোল না হয়ে সভার কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলো।
যুবলীগ গঠনের উদ্দেশ্যে যুব সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হয় ১৯৫১ সালের ২৭ মার্চ। সম্মেলনের সময় ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি থাকায় বার লাইব্রেরী হলে সম্মেলনের স্থান নির্দিষ্ট হয়। কিন্তু ২৬ মার্চ সরকারী কর্তৃপক্ষ যুব সম্মেলনের কর্মকর্তাদের জানান যে, ১৪৪ ধারা বার লাইব্রেরীর মধ্যে বলবৎ থাকবে কাজেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে তাঁরা সেখানে কোন সম্মেলন করতে পারবেন না এই নতুন পরিস্থিতিতে সম্মেলনের কর্মকর্তারা সম্মেলন স্থান নির্ধারণ করেন বুড়িগঙ্গার অপর।

২। যুব সম্মেলন

সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা দুপুর আড়াইটায় থাকলেও সম্মেলনের উদ্যোক্তারা জিঞ্জিরা বাজার পৌঁছান সন্ধ্যা ছয়টার পর। এই বিলম্বের ফলে প্রায় দুইশত প্রতিনিধি তিনঘন্টা জিঞ্জিরা বাজারে ঘোরাফেরা করেন। অবশেষে সম্মেলন শুরু হয় মাগরেবের নামাজের পর সন্ধ্যা সাতটায়। ১ প্রতিনিধিরা ছাড়াও সম্মেলনের জায়গায় কয়েক হাজার শ্রোতা সমবেত হন।
সম্মেলনের শুরুতে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল এবং জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে একটা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তারপর কোরান তেলাওয়াতের* পর ঢাকার ইংরেজী দৈনিক ‘পাকিস্তান অবজারভার’ -এর সম্পাদক আবদুস সালাম সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
এই উপলক্ষ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে দেশের যুবকদের মনে এক দারুণ নৈরাশ্যের সঞ্চার হয়েছে কারণ আজাদী লাভের পূর্বে তারা যে সোনার স্বপ্ন দেখেছিলো সেটা বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। এই মনোভাব যে দেশের পক্ষে ক্ষতির কারণ হতে পারে একথা উল্লেখ করে আবদুস সালাম সম্মেলনের সাফল্য কামনা করেন।
অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যান নূরুল হুদা তাঁর অভিভাষণে সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেন যে, সরকারের ফ্যাসিস্ট নীতির ফলে দেশে ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, এমনকি কথা বলার স্বাধীনতা পর্যন্ত লোপ পেতে বসেছে। তিনি আরো বলেন, ‘সরকার আজকাল সমালোচনা সহ্য করিতে পারেন না। তাঁহারা প্রতিক্রিয়াশীলতার নীতি গ্রহণ করে দেশের অগ্রগতি

*[ সে সময় পরিস্থিতি এমন ছিলো যে গণতন্ত্রের যতই কথা বলা হোক কোন সভা সম্মেলন কোরান তেলাওয়াত ব্যতীত শুরু করলে শুধু সরকারই নয়। জনগণের মধ্যেও তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দিতো। ব,উ,]
বন্ধ করিয়া দিবার বন্দোবস্ত করিয়াছেন। দেশের যুব সমাজ এই সবের বিরুদ্ধেই আওয়াজ তুলিয়েছেন এবং তাহা প্রতিরোধের জন্য বদ্ধপরিকর হইয়াছেন। নূরুল হুদা সরকারের বৈদেশিক নীতির সমালোচনা করেন এবং যুব সমাজের সামনে যে বিরাট কর্মসূচী অপেক্ষা করছে তার উল্লেখ করে বলেন যে, ‘আমাদের প্রথম কাজ হইল সকল প্রকার যুদ্ধ প্ররোচনার মূলোচ্ছেদ করিয়া শান্তি স্থাপন করা এবং দ্বিতীয়তঃ সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটানো।’
এরপর নির্বাচিত সভাপতি মাহমুদ আলী তাঁর আসন গ্রহণ করে সভাপতির অভিভাষণে বলেন, আজ এক দেশের পরিস্থিতির সহিত অন্য দেশের তথ্য সমগ্র দুনিয়ার পরিস্থিতি এমনই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে বিচ্ছিন্নভাবে কোন এক দেশের পরিস্থিতির পরিমাপ করা আর সম্ভবপর নয়।
সদ্য বৃটিশ শাসনমুক্ত আমাদের এই দেশ বিদেশী শাসনমুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বরাজনীতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর অন্য দেশের উত্থান-পতনে আমরাও আনন্দিত হই— বিভিন্ন দুটি দেশে দেশে যুদ্ধ বাঁধলে আমাদের দেশেও তার ছোঁয়াচ লাগে। ‘ওরা মারামারি কাটাকাটি করছে আমাদের তাতে কি’ একথা বলে আজ আর আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। কারণ ওদের মারামারি কাটাকাটি আমাদের গায়েও আঘাত হানে। ঠিক তেমনি করে তাদের বেলায়ও একই অবস্থা।
জাতীয় সমস্যা সম্পর্কে সভাপতির ভাষণে মাহমুদ আলী বলেন, আমি ইতিপূর্বে বলেছি আন্তর্জাতিক সমস্যার সহিত আমাদের জাতীয় সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে। তাই জাতীয় সমস্যাকেও আমরা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েই বিচার করবো। বিদেশী শাসন মুক্তির পর জাতির সামনে যে সমস্যা সবচেয়ে বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো দেশের অগণিত জনসাধারণের ভাত কাপড়ের সমস্যা, শিক্ষার ও স্বাস্থ্যরক্ষার সমস্যা? এক কথায় স্বাধীন মানুষের মতো বেঁচে থাকার সমস্যা যে স্বাধীনতায় এই প্রাথমিক সমস্যাগুলির কোন সমাধান নেই সে স্বাধীনতা কাহারো কাম্য হতে পারে না— সে স্বাধীনতা, আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি— পাকিস্তান আন্দোলনের মূল কথা ছিল না পাকিস্তান আন্দোলনে যে সব মহাপ্রাণ যুবক-যুবতী ও অসংখ্য স্বাধীনতাকামী মানুষ জীবনাহুতি দিয়েছেন এ তাদের কাম্য ছিল না। সর্বোপরি জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সে পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই– ‘যে পাকিস্তানে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় মর্মপীড়া অনুভব করে, সে পাকিস্তান আমার প্রয়োজন নেই—‘ কায়েদে আজমের এই অমরবাণী আজও আমাদের প্রেরনা যোগায়।

পাকিস্তান লাভের সাড়ে তিন বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আজ আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছি আমরা শুধু যেই তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই থেকে যাইনি, বরং তিমিরে আমাদের আরো ঘনীভূত হয়েছে। বৃটিশ শাসনমুক্ত আমরা হয়েছি সত্য কিন্তু বৃটিশের উত্তরাধিকার সূত্রে যাঁরা আমাদের উপর চেপে রয়েছেন তাঁরা বৃটিশ শাসনের ঐতিহ্যকে বজায় রেখেছেন তার নির্মমতার— অমানুষিক চরম পর্যায়ে। তাই আমরা দেখতে পাই জাতীয় সমস্যার কোন সমাধান না করেও জনসাধারণের তরফ হতে সমাধানের দাবি উঠলেই সেটা দমন করার জন্য তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠেন— দমন নীতির কঠোরতম অস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসেন জনসাধারণের দিকে। এই দেশের মানুষের কল্যাণ সাধন করা যেন তাঁদের দায়িত্বের মধ্যে নয়। তাঁরা যেন আল্লার তরফ থেকে এসেছেন মাটির মানুষের উপর নির্মম শাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য এতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করে এ কার সাধ্য? শুধু তাই নয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিদেশী শোষণের যাঁতাকল আজও আমাদের সমাজ জীবনে ভূতের মত চেপে আছে।
দেশের যা কিছু সারবস্তু তার শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত নিংড়ে গ্রহণ করবার ব্যবস্থা করছে তারা এবং তাদের দেশীয় উত্তরাধিকারীগণ দালাল সেজে সাহায্যকারীর নীরব ভূমিকার মহড়া দিয়ে চলেছে। অথচ যারা এ সব কথা সাধারণ্যে প্রকাশ করতে এগিয়ে যায়, যারা সত্য কথা বলার সৎসাহস রাখে আজ তারাই আখ্যা লাভ করছে— ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, ‘কম্যুনিস্ট’ ‘ইসলামবিরোধী’ ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী; আরও কত কি!
যুদ্ধোত্তর যুগে আমাদের মত আরও বহুদেশ বিদেশী শাসনমুক্ত হয়েছে। তারা অনেকেই নিজেদের মোহমুক্ত করে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেছে এবং সেই সমাধান কার্যকরী করে দেশের মানুষকে (অস্পষ্ট) প্রতিষ্ঠিত করতে এগিয়ে গেছে। অতএব যদিও রাষ্ট্রের দোহাই সময়ের স্বল্পতার দোহাই দিয়ে যে অজুহাত দেখান হয় মূলতঃ তার কোন ভিত্তি নেই। কারণ অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে দিচ্ছে বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করলে আমাদেরও পেছনে পড়ে থাকার কোন কারণ নেই।
আমরা দেখতে পেয়েছি তথাকথিত জাতীয় সরকার জনসাধারণকে সুখ সমৃদ্ধির কল্প-কাহিনীর প্রসাদ দিয়ে প্রতারিত করে গদী কায়েম রাখার সব ব্যবস্থাই করেছেন। আমার মনে হয় জনসাধারণ আজ সাধারণভাবে এ প্রতারণা ধরতে পেরেছে এবং পেরে মুক্তির সন্ধানে পাগল হয়ে উঠেছে। এই পাগল করা উতলা আবহাওয়ায় তারা নিজেদের লক্ষ্য পথ হারিয়ে ফেলতে পারে— তাদের বিভ্রান্তি ঘটতে পারে— তারা সংযোগহীন অবস্থায় দমননীতির কঠোর নিষ্পেষণে চিরতরে মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়তে পারে।
তাই এদিক থেকে শিক্ষিত সমাজচেতন যুব সমাজের দায়িত্ব রয়েছে অপরিসীম। এই সংকটকালে তাদের উদভ্রান্ত জনতার পাশে এসে দাঁড়াতে হবে— তাদের দিতে হবে পথের সন্ধান— তাদের বাঁচাতে হবে অত্যাচারী মানুষখেকো শোষকের কবল থেকে। আমি বিশ্বাস করি আজকের এই ঐতিহাসিক যুব সম্মেলন সেই বাঁচার পথের সন্ধানই দেবে।
এরপর ভাষণ শেষ করার পূর্বে মাহমুদ আলী বলেন, ধীরে হলেও আমাদের নিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে। আজ দেশের কৃষক মজুর, মধ্যবিত্ত চাকুরিয়া, ব্যবসায়ী ছাত্র শিক্ষক; যুবক; নারী পুরুষ নির্বিশেষে কারোরই জীবনযাত্রার এতটুকু নিশ্চয়তা নেই। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চলেছে যুদ্ধের মহড়া— যুদ্ধের আবহাওয়ায় সৃষ্টি করে চলেছে দেশী বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদের রাজত্ব চিরস্থায়ী করার হীন প্রচেষ্টা।
তাই আজ যুব সমাজের কর্তব্য জনসাধারণের সহযোগিতায় যুদ্ধবাজদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়া। সর্বপ্রকার যুদ্ধ প্ররোচনার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা। সমাজতান্ত্রিক সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার বিনাশ সাধন করে জাতীয় উন্নতির পরিপোষক স্বাস্থ্যকর রাজনৈতিক আবহাওয়ার সৃষ্টি করা। বিদেশী ও বড় বড় দেশী ধনিকদের শোষণের পর্দা উন্মোচন করে দেশের অগণিত মধ্যবিত্ত—কৃষক মজুরের দলকে মোহমুক্ত করে সংগঠিত করা। এবং সুনিশ্চিত পদক্ষেপে সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সহায়তা করা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই ভিত্তিতে আমরা এগিয়ে গেলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের সুনিশ্চিত সাফল্য অবধারিত। আমরা পাকিস্তানকে এক সুখী সমৃদ্ধ প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্রে পরিণত করতে সমর্থ হবো। সাফল্য আমাদের কিন্তু সাফল্যের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয় এও আমাদের জানা আছে। আজকের জীবনের নিবিড় অমাকে উদয় সূর্যের রক্তিমাভায় রঞ্জিত করতে হলে প্রয়োহন বহু লালিমার।
সভাপতির অভিভাষণের পর নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ একটি খসড়া মেনিফেস্টো সম্মেলনে পেশ করেন। ম্যানিফেস্টোর উপর আলোচনা পরবর্তী অধিবেশনের জন্য স্থগিত রাখার পর খোন্দকার গোলাম মোস্তফা যে প্রস্তাবাবলী সম্মেলনে পেশ করেন তার সংবাদপত্র রিপোর্ট নিচে উদ্বৃত্ত করা হলোঃ
প্রথম প্রস্তাবে পাকিস্তানের ভিত্তিকে শক্তিশালী করিবার কাজে সম্মেলনে আত্মনিয়োগের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা হয়। একই সঙ্গে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ধৃত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচারে চরম শাস্তিদানের দাবি জানানো হয়।
দ্বিতীয় প্রস্তাবের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গণভোটে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের দাবি জানানো হয়। এই ব্যাপারে আমেরিকার কদর্য ভূমিকায় নিন্দা করা হয়। সম্মেলনে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের জন্য মরক্কোর যোদ্ধাদের অভিনন্দন জানায় এবং ফরাসী সরকারের অত্যাচারের নিন্দা করা হয়। সম্মেলনে মিসর লেবানন, মালয়; ইন্দোচীন ও কোরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের নির্লজ্জ ভূমিকার নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়।
পূর্বে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান সরকার বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম ও অফিসের ভাষারূপে গ্রহণ করার প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন হওয়ায় সম্মেলনে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। সম্মেলন প্রতিটি প্রাদেশিক ভাষাকে সেই প্রদেশের শিক্ষার মাধ্যম এবং প্রদেশের ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতির জন্য সার্বজনীন সর্বোচ্চ সুবিধা দেওয়ার মত পোষণ করে। সম্মেলনে মোহাজের যুবকদের পুনর্বসতির প্রতি সরকারের ঔদাসীন্য, বাটা স্যু ফ্যাক্টরী, ডানলাপ ফ্যাক্টরী ইত্যাদির শ্রমিকদের স্থানচ্যুতকরণের নিন্দা করা হয় ও অবিলম্বে তাহাদের উপযুক্ত ব্যবস্থার দাবি করা হয়। সম্মেলন সাংবিধানিক মূলনীতি কমিটির সুপারিশকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করিবার দাবি জানায় এবং পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গত নবেম্বর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনে গৃহীত নীতির উপর ভিত্তি করিয়া গঠনের দৃঢ় মত পোষণ করে। সম্মেলন আগামী বৎসরের প্রথম ভাগেই পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদকে বাতিল করিয়া পূর্ণবয়স্কদের ভোটাধিকার ভিত্তিতে যুক্ত নির্বাচনের দাবি জানায়।
সম্মেলনে অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত মনে করে এবং প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রস্তাবিত ১লা এপ্রিল হইতে ধর্মঘট আরম্ভ করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানায় এবং সরকারকে তাঁদের দাবি মানিয়া লইবার জন্য দাবি জানায়। অন্য একটি প্রস্তাবে সম্মেলন ঢাকা শহরে ৪৪ ধারা জারী এবং ‘পাকিস্তান অবজারভার’ ও ‘দৈনিক ইনসাফের’ উপর সরকারী প্রিসেন্সরশীপ আদেশের নিন্দা এবং তাহা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানায়। সম্মেলন পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ফেনীর সাপ্তাহিক সংগ্রাম পত্রিকার উপর ৩০০০ টাকা জামানত তলব আদেশের নিন্দা করে এবং উক্ত আদেশ প্রত্যাহার করিয়া পত্রিকাটিকে বিনা বাধায় প্রকাশ হইতে দেয়ার অনুরোধ জানায়।
শেষ প্রস্তাবে, সম্মেলন প্রদেশের দ্বিতীয় শিল্প চা শিল্পের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করিতে এবং কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ইউরোপীয় মিঃ ব্রাবান্টের প্রদত্ত রিপোর্টে পশ্চিম পাকিস্তানে চা
বাগানের পরীক্ষা চালাইবার জন্য পাকিস্তনের এই অংশের পরিত্যক্ত দেশী চা বাগানগুলিকে বন্ধ করিয়া দেওয়ার সুপারিশের সমালোচনা করে। সম্মেলনের মতে অহা দেশীয় চা শিল্পীদের স্বার্থের পরিপন্থী এবং ইউরোপীয় চা শিল্পীদের স্বার্থের প্রতি সুবিধা জনক। এই হেতু সম্মেলন এই রিপোর্ট বাতিলের দাবি জানায়।
খোন্দকার গোলাম মোস্তফা উপরোক্ত প্রস্তাবাবলী সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে পাঠ করার পর ফেনীর খায়েজ আহমদ এগুলির উপর আলোচনা করেন। তারপর প্রস্তাবগুলি সর্বসম্মতিক্রমে সম্মেলনে গৃহীত হয়। শুরু থেকে এ পর্যন্ত পুলিশ রিপোর্টাররা সম্মেলনে উপস্থিত থাকে এবং প্রস্তাবগুলি গৃহীত হওয়ার পর রাত্রি দশটার সময় প্রথম অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে।
জিঞ্জিরা বাজারে পুলিশ বাহিনী উপস্থিত হওয়ার ফলে সেখানে সম্মেলনের পরবর্তী অধিবেশন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব না হওয়ায় উদ্যোক্তারা বুড়িগঙ্গায় নৌকোর উপর দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু করেন রাত্রি ১১ টায়। এই অধিবেশনে মাইক ব্যবহৃত হয়। সম্মেলনে আগত ২৫০ জন প্রতিনিধিই দ্বিতীয় অধিবেশনে উপস্থিত থাকেন। তাঁদের মধ্যে হালিমা খাতুন সহ চার পাঁচজন মহিলা প্রতিনিধিও ছিলেন।
সামান্য রদবদলের পর প্রথম অধিবেশনে পেশকৃত খসড়া ঘোষণাপত্র বা ম্যানিফেস্টোটি* গৃহীত হয়। এই গৃহীত ঘোষণা পত্রটিতে বলা হয়ঃ
পাকিস্তান কায়েম হওয়ার প্রায় সুদীর্ঘ পাঁচ বছর পরেও আমরা গভীর লজ্জার সহিত লক্ষ্য করিতেছি যে, আমাদের দেশ এখনও বৃটিশ কমনওয়েলথ- এর শিকলে বাঁধা। এখনও পাকিস্তানের ধন সম্পদ, যেমন– পাট, চা প্রভৃতি ব্যবসার উপর সেই বৃটিশ পুঁজির কর্তৃত্ব অব্যাহত। আজও মুষ্টিমেয় বিদেশী ও দেশী ধিনিক আমাদের ধন-সম্পদ লুন্ঠন করিয়া সুখ-বিলাসে কাল কাটাইতেছেন।
আমরা পাকিস্তানের যুব সমাজ গভীর উদ্বেগএর সহিত লক্ষ্য করিতেছি যে, আজও আমাদের শিল্পের বিন্দুমাত্র উন্নতি হয় নাই। আমাদের দেশের বাজার বিদেশীর মালপত্রে ছাইয়া গিয়াছে; এবং মুষ্টিমেয় ধনিকের সহায়তায় বিদেশী ধনিকগবই আমাদের দেশের বাজারের উপর কর্তৃত্ব এবং একাধিপত্য বিস্তার করিয়া রহিয়াছে।
এই সাধারণ বক্তব্যের পর সমাজের প্রতিটি স্তরের যুবক যুবতীর বিভিন্ন সমস্যার উপর ঘোষণাটিতে নির্দিষ্ট বক্তব্য প্রদান করা হয়। কৃষক যুবক সম্পর্কে তাতে বলা হয়ঃ
আমাদের দেশের অর্থনীতি এখনও রহিয়াছে সেই অনগ্রসর ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক পর্যায়ে। আমাদের দেশের যুব সমাজের শতকরা ৮০ ভাগই গ্রামের কৃষক। দেশের যুব শক্তির এই প্রধান অংশ আজও সামন্তবাদী জমিদারী প্রথার নিষ্পেষণে পিস্ট।

*[ এই খসড়া ঘোষণাপত্রটি মার্চ ১৯৫১- এর প্রথম সপ্তাহে যুব-সম্মেলনের প্রচার দফতর কর্তৃক ৩৬ নং র‍্যাংকিন স্ট্রীট ঢাকা (আনোয়ার হোসেনের বাসা) থেকে প্রকাশিত হয়। তখন এই খসড়া ঘোষণাপত্রটির নাম ছিল পাকিস্তানের যুব সম্মেলনের ঘোষণা।—ব,উ।]

**[ পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের ঘোষণাপত্র উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী নামে ঘোষণাপত্রটি ক্যাপিটাল প্রিন্টিং প্রেস, ৫০ বেগম বাজার রোড; ঢাকা থেকে মুদ্রিত এবং প্রচার দপ্তর কর্তৃক ৪৩/১ নম্বর যোগীনগর লেন (মহম্মদ তোয়াহার বাসা) ওয়ারী ঢাকা থেকে প্রকাশির হয়। ব,উ]

সরকার নামেমাত্র জমিদারী প্রথাত উচ্ছেদ করিয়াছে। কার্য্যত জমিদারী হস্তান্তর হইয়াছে মাত্র; চাষী জমির স্বত্ব পায় নাই। দেশের প্রাণ এই যুব সমাজ আজও শিক্ষা হইতে বঞ্চিত জমি হইতে বঞ্চিত। নিজেদের জীবনকে সুখী ও সুন্দর করিতা গড়িয়া তোলার কোন পথই তাহাদের সম্মুখে নাই। এক মুঠা পেটের ভাতের জলন্য সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি চাকুরীর আশায় এদিক ওদিক ছুটাছুটি, পরের বাড়ির গোলামী, এবং অকালে মৃত্যু ইহাই আজও পাকিস্তানের যুব শক্তির ভাগ্য। আমাদের অবস্থার উন্নত করিবার কোন চেষ্টাই বর্তমান সরকারের নাই। অর্থনৈতিক শোষণে শিক্ষার অভাবে দেশের প্রাণ এই গ্রাম্য যুবশক্তি দিন দিন হীনবল হইয়া পড়িতেছে। আমরা আশায় বুক বাঁধিয়া পাকিস্তানের জন্য লড়িয়াছিলাম– জমি পাইব শিক্ষা পাইব কিন্তু বর্তমান মুসলীম লীগ সরকারের কল্যাণে আমাদের কৃষক যুব শক্তির সেই আশায় ছাই পড়িয়াছে।
শ্রমিক যুবক সম্পর্কে ঘোষণাতে বলা হয়ঃ
আমরা যুব সমাজের যে অংশ রেলে কাজ করিয়া, চট্টগ্রাম ডকে গতর খাটিগা সূতাকল চালাইয়া সিকসা চালাইয়া বা অনুরূপ কঠোর পরিশ্রম করিয়া দিন-মজুর হিসাবে জীবিকা অর্জন করি- আমরা সেই যুব সমাজ আশা করিয়াছিলাম যে পাকিস্তানে আমরা জীবন ধারনের উপযোগী মজুরী পাইব, পাইব চাকুরীর স্থায়িত্ব এবং শিক্ষা। কিন্তু বাস্তব জীবনে আমাদের আসল মজুরি কমিতেছে, খাটুনি বাড়িতেছে। শিক্ষার ব্যবস্থা নাই। বেকারী ও ছাঁটাই এর বিভীষিকা আমাদের সম্মুখে। অথচ আমাদিগকে শোষণ করিয়াই মুষ্টিমেয় ধনিক টাকার পাহাড় জমাইতেছে।
মধ্যবিত্ত যুবক সম্পর্কে ঘোষণাতে বলা হয়ঃ
আমরা মধ্যবিত্ত যুব সমাজ স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম— পাকিস্তানে আমরা চাকুরী পাইব। ব্যবসা বাণিজ্য বিকাশের সুযোগ পাইব গৃহ পাইব, পাইব উন্নত সংস্কৃতি ও উন্নততর জীবন ধারণের মান। কিন্তু বাস্তবতার নিষ্ঠুর কষাঘাতে সে স্বপ্ন আমাদের ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। অভাবের তাড়নায় আমরা জর্জরিত। শহরের বাসস্থানের অভাব আমাদের এক বিরাট সমস্যা। তদুপরি আজ আমরা ১৫ লক্ষের বেশী বেকার এক মুঠো ভাতের জন্য এখানে ওখানে ধর্ণা দিতেছি, আত্নহত্যা পর্যন্ত করিতেছি।
মোজাহের যুবকদের সম্পর্কে বলা হতঃ
আমরা মোজাহের যুবকেরা, পাকিস্তানের জন্য আমাদের সর্বস্ব হারাইয়াছি। কিন্তু আজ পাকিস্তানে আমাদের কোন ভবিষ্যৎ নাই। সরকার আমাদিগকে কেবল মৌখিক সহানুভূতি এবং খবরের কাগজের মারফৎ সাহায্য করিতেছেন। কিন্তু আমাদের পুনর্বসতি ও পুনর্জীবনযাত্রার কোন উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থাই তাহারা করেন নাই। বাস্তুহারা হইতা পাকিস্তানে আসিয়া আমাদিগকে বেকার হইয়া, গৃহহারা হইয়া অন্নহারা হইতে হইতেছে; এমনকি আত্নহত্যা পর্যন্তও করিতে হইতেছে।
এরপর সর্বশেষ নারী-যুবসমাজ সম্পর্কে ঘোষণাটিতে বলা হয়ঃ
আমরা নারী যুব-সমাজ আশা করিয়াছিলাম যে পাকিস্তানের সরকার আইন করিয়া আমাদিগকে সামাজিক অত্যাচার হইতে মুক্তি দিবেন, শিক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা করিবেন এবং দিবেন জীবনের প্রতিক্ষেত্রে পুরুষের সহিত সমান মর্যাদা ও অধিকার। কিন্তু আজও আমরা নিগৃহীতা এবং শিক্ষা ও সভ্যতার সামান্যতম অংশ হইতেও বঞ্চিতা। আমরা গভীর লজ্জার সহিত লক্ষ্য করিতেছি যে পাকিস্তান হওয়ার আট বছর অতীর হইতে চলিল দেশের সমগ্র যুব সমাজের অর্ধেক এই নারী যুব শক্তির শতকরা একজনও লিখিতে পড়িতে পারে না। তদুপরি সিলেট মেয়ে কলেজ ও কামরুন্নেছা মেয়ে কলেজ ইডেন স্কুল বরিশালের এক মাত্র ছাত্রী নিবাস জগন্নাথ কলেজে মেয়েদের অধ্যয়নের ব্যবস্থা তুলিয়া দিয়া নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে সরকার এক বিরাট অভিযান চালাইতেছে। অথচ আলবেনিয়ার* ন্যায় ক্ষুদ্র মুসলিম রাষ্ট্রে ১৯৪৫ সনে অবৈতনিক বাধ্যতামূলম প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন হওয়ায় ১৯৪৬ সালের শেষে একমাত্র পেশার জেলায় শতকরা ৭৫ জনের নিরক্ষরতা দূর হইয়া যায়। স্কুটারী জেলায় ১৯৪৬ এর মাঝামাঝি ২৩ হাজার মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়িতে আসে। এইরূপে বিভিন্ন স্বাধীন দেশে আমাদের বোনেরা যখন শিক্ষাদীক্ষাত উন্নত হইয়া দেশের ও সমাজের উন্নতির কাযে আত্ননিয়োগ করিতেছে, তখন আমাদের পাকিস্তানের নারী সমাজের ভাগ্যে জুটিতেছে অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও সামাজিক দাসত্ব। অর্থনৈতিক সংকটের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে ঘোষণাটিতে শুধু দ্রব্যমূল্যের কথা এইভাবে বলা হয়ঃ
পূর্ববঙ্গের তথা পাকিস্তানের অর্থনীতির মেরুদন্ড হইতেছে কৃষি। পাকিস্তানের শতকরা ৯২ জন অধিবাসীই কৃষক। যে পাট তাহারা গড়ে ৩৫ টাকা দরে বিক্রয় করিত তাহা আজ ১২ টাকায়, যে সূপারী গড়ে ৭৫ টাকা দরে বিক্রয় করিত তাহা আজ ১০ টাকা দরে বিক্রয় করিতে বাধ্য হইতেছে।তদুপরি সুপারীর উপর প্রতি মনে ১০% টাকা শুল্ক ধার্য হওয়ায় সুপারী বিক্রয়ই হয় না। এভাবে পাকিস্তানের অধিবাসীসেএ নগদ আয়ের পথ ভীষণভাবে সঙ্কুচিত হইতেছে। অন্যদিকে দৈনন্দিন ব্যবহারেএ দ্রব্যাদি তাহাদিগকে অগ্নিমূল্যস ক্রয় করিতে হইতেছে। বিগত কয় বছরের দ্রব্যমূল্যমানের সূচক সংখ্যা (index number) হইতে এই তথ্য সহজেই জানা যায়।

১৯৩৯ সনে দ্রব্যের গড়পড়তা মূল্য ছিল ১০০
১৯৪৮ ,, ,, ,, ,, ,, ৩৭৪
১৯৪৯ ,, ,, ,, ,, ,, ২১৪
(পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রদত্ত অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা হইতে)
আজ একদিকে পাট সুপারী তামাকের দাম দ্রুত কমিয়া কৃষকের আয় ভয়ানকচাবে হ্রাস পাওয়ায় ও অপরদিকে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পাকিস্তানের অধিবাসী গণ আজ তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ঘোষণাতে বলা হয়ঃ
আমরা পাকিস্তানের যুব সমাজ আশা করিয়াছিলাম যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইলে সরকার সমস্ত দেশে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার প্রচলন করিয়া বৃটিশ আমলের কুশিক্ষা ও অজ্ঞতা দূর করিবেন। কিন্তু তার পরিবর্তে আজও দেশে শিক্ষিতের হার শতকরা ১১ জন। প্রাইমারী স্কুল বাড়ির পরিবর্তে সরকার শতকরা ৪০ হইতে ৫০ ভাগ স্কুল- একমাত্র চট্টগ্রাম জেলায় ৮৪৪টি, নাটোরে ৪০০টি— উঠাইয়া দিয়া শিক্ষা ব্যবস্থার সংকোচ করিতেছেন। সরকার আজ শিক্ষা খাতে ৫.৬ ভাগ ব্যয় বরাদ্দ করুয়া যুদ্ধ খাতে দেশের সম্পদের শতকরা ৭২ ভাগ ব্যয় করিতেছেন।
তদুপরি সরকার পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের মাতৃভাষার দাবীকে উপেক্ষা করিয়া আমাদের সাংস্কৃতিক অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করিতেছেন। বিশেষতঃ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাভে পাকিস্তানের শতকরা ৬২ জনের মাতৃভাষা বাংলা ভাষার দাবীকে উপেক্ষা করিয়া উর্দু চাপাইতেছে এবং আরবী হরফে বাংলা

* [ আলবেনিয়া ১৯৪৫ সালে কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীনে পরিচালিত একটি রাষ্ট্র, যদিও বিপ্লবের পূর্বে তার জনসংখ্যার অধিকাংশ ছিলো মুসলমান পরিবারভুক্ত। ব,উ]
লিখার উদ্ভট পরিকল্পনাকে কার্যে পরিণত করার জন্য অজস্র অর্থের অপচয় করিতেছেন। আমরা বিশ্বাস করি যে উর্দু ও বাংলা একত্রে রাষ্ট্রভাষা হইলে পাকিস্তান দূর্বল হইবে না। এবং আমরা আরও বিশ্বাস করি যে আরবী হরফে বাংলা লিখার ব্যবস্থাকে আমাদের উপর চাপাইয়া দিলে আমরা দেশের যুবক সমাজ চিরদিনের জন্য অজ্ঞতা ও অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবিয়া যাইব, আমাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ রুদ্ধ হইবে।
সরকারী দমনীতির সমালোচনা প্রসঙ্গে যুবলীগের এই ঘোষণাপত্রে বলা হয়ঃ
আমরা যুব সমাজ আশা করিয়াছিলাম পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু আজ যখনই আমরা নিজেদের কোন দাবি বা সমাজের উন্নতির জন্য কোন আন্দোলন বা সংগঠবে সমবেত হই তখনই সরকার আমাদের ওপর দমননীতি প্রয়োগ করেন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান পুলিশের ধর্মঘট, লাহোর বাটা শ্রমিকের ধর্মঘট, করাচী ডাল মিয়া সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর শ্রমিক ধর্মঘট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নতম বেতনভোগী কর্মচারীদের সমর্থনে ছাত্র ধর্মঘট, মেডিকেল ছাত্রদের ধর্মঘট প্রভৃতি ন্যায্য গণতান্ত্রিক আন্দোলন আন্দোলনের উপর সরকারী দমননীতির তীব্র কষাঘাত আমরা পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তানের যুবসমাজ আজও ভুলি নাই, মেডিকেল ছাত্রদের ও ডাক্তারদের দাবীর প্রতি সরকারের অনমনীয় মনোভাব আমরা লক্ষ্য করয়াছি। ‘ভুখা’ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বরখাস্তের ব্যাপারেও গভীর ক্ষোভের সহিত আমরা লক্ষ্য করিয়াছি।
সরকারের দমননীতির কোপে পড়িয়া আজ পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রবাদী শত শত যুবক-যুবতী কারগারে আবদ্ধ। সরকারী দমননীতির দরুণ স্বাধীনভাবে সভাসমিতি করার বা সংগঠন গড়ার অধিকার আমাদের নাই। নিষ্ঠুর সরকারী দমননীতির ফলে আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা আজ বিপর্যস্ত। তাই আজ আমাদের পাকিস্তানের যুব সমাজের জীবন সামাজিক,অর্থনৈতিক আধ্যাত্নিক ও দৈহিক এই চতুর্ব্বিধ সংকট নামিয়া আসিতেছে। আমাদের সমাজের অর্থনীতিতে বিদেশী পুঁজির প্রাধান্য আজও অব্যাহত। আমাদ্রর গ্রাম্য অর্থনীতিতে জমিদারী প্রথার নাগপাশ আজও অক্ষত৷ আমাদের দেশের শিল্প নাই, গণতান্ত্রিক অধিকার নাই। বেকারীর দুঃসহ জ্বালায় আমরা জর্জরিত ও আমাদের দেহমন স্বাস্থ্যা আজ হীনবল। বর্তমান সরকারের নীতিই আমাদের দেশের যুব শক্তির এই মহা-সংকটের কারণ।
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সম্পর্কে ঘোষণায় বলা হয়ঃ
আমিরা পূর্ব বঙ্গ তথা পাকিস্তানের যুব সমাজ নিজেদের দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকার করিতে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় প্রাণ দিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমরা দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করিতেছ যে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে আমরা কখনও কামনের খোরাক হইব না। আমরা জানি যুদ্ধের আনুসঙ্গিক ফল, সেই ৫০ সনের মন্বন্তর হইতেও ভয়াবহ যে মন্বন্তরে আমরা আমাদের ৩৫ লক্ষ মা-ভাই-বোনকে হারাইয়াছি। আমরা জানি যুদ্ধের অর্থ আমাদের স্কুল কলেজে আবার মিলিটারীর আস্তানা। আমরা জানি যুদ্ধের অর্থ সেই ৫০ সনের মতো আমাদের শত শত নারীর ইজ্জত হানি, আমরা জানি এবার যুদ্ধ আরম্ভ হইলে গুলি ও বোমার আঘাতে আমাদের স্কুল কলেহ মাদ্রাসা মসজিদ মন্দির ধ্বংস হইবে। যুদ্ধের এই বিপদ সম্পর্কে আমরা যুব সমাজে সচেতন হইয়াছি। আমরা পাকিস্তানের যুব সমাজ চাই স্বাধীনতা, শান্তি সুখী ও উন্নত জীবন।
প্রতিক্রিয়াশীল উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সরকার ও শাসনকাল কর্তৃক ইসলামকে ব্যবহার করা প্রসঙ্গে ঘোষণাটিতে বলা হয়ঃ
জাতীয় জীবনের এই সমুদয় পুঞ্জীভূত সমস্যা ও সংকট সম্বন্ধে কোন প্রকার প্রশ্ন তুলিলেই সরকার আত্নরক্ষার একাধিক প্রকারের বর্ম পরিধান করিয়া থাকেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল শিশু রাষ্ট্রের দোহাই। কিন্তু সেই দোহাই এর স্বরূপ আজ জনসাধারণের কাছে উদঘাটিত হইয়াছে। তাই আজ ‘শিশু রাষ্ট্রের’ কথা আমরা শুনিতে পাই না। আজ আবার নতুন ধরনের বুলি তাঁহারা আওড়াইতেছেন। আমরা দেশের কোন সমস্যার কথা তুলিতে গেলেই আমাদিগকে আখ্যা দেওয়া হয়—‘ রাষ্ট্রের শত্রু বা রাষ্ট্রদ্রোহী’। কোন প্রকার সমস্যার সমাধান হইতে বিলম্ব ঘটিতেছে কেন, এইরূপ প্রশ্ন করলেই তার জবাব স্বরূপ সরকার হইতে বলা হয় ‘ইসলামী শরিয়তের বিধান মতে ইহা করিতে হইবে সে কারণে দেরী হইতেছে।’….. পাকিস্তানের গঠনতন্ত্রের ব্যাপারে একাধিক সরজারী মুখপাত্র হইতে আমরা অনুরূপ জওয়াবই পাইয়াছি৷ তদুপরি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বিশ্বাসঘাতক নাজিমুদ্দীন কায়েদ আজমের দোহাই দিয়া আত্নরক্ষার চেষ্টা করিতে ছাড়েন নাই।
ইসলামের নামে আজ তিন বৎসর যাবত আমাদের নেতারা জনসাধারণকে অনেক ভাঁওতা দিয়া চলিয়াছেন। কিন্তু তাহদের রাজনৈতিক কাজকর্ম, তাহাদের ‘প্রোগ্রামে’ তাহাদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ যতটুকু তাহা দিনদিনই আমাদের দেশবাসীর নিকট পরিষ্কার হইয়া পড়িতেছে। ইসলামের প্রতি জনসাধারণের ভালবাসা আছে তাহা আমাদের নেতারা জানেন, তাই তাহারা ব্যক্তিগত ও দলগত স্বার্থসিদ্ধির জন্যই পরস্পর ইসলামের বুলি আওড়াইতেছেন, অর্থাৎ ‘ইসলাম রাষ্ট্রদ্রোহী রাষ্ট্রের শত্রু’ প্রভৃতি বুলি সরকার যে কোন আন্দোলনের মুখে আত্নরক্ষার ধর্মরূপে এবং গণদাবীকে চাপা দেওগার যন্ত্ররূপে ব্যবহার করিয়া থাকেন। আমরা পাকিস্তানের‍ যুব সমাজ স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করিতে চাই যে আমাদের রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তান অর্জিত হইয়াছে, আত্নসর্বস্ব নেতাদের বাগাড়ম্বর দ্বারা নয়। পাকিস্তানের যে রঙ্গিন স্বপ্ন আমরা দেখিয়াছিলাম নেতাদের কার্যকলাপ তাহাকে ধূলিসাৎ করিয়া দিয়াছে। সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করিবার দায়িত্ব আমাদের যুব সমাজকেই লইতে হইবে।
এই সব বক্তব্যের পর ঘোষণাপত্রটিতে ‘আমাদের ঘোষণা ও দাবী’ শীর্ষক অংশে বলা হয়ঃ
১। আমরা যুদ্ধ চাই না। দুনিয়ার যুব সমাজ আজ যুদ্ধের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করিতেছে। তাহাদের সঙ্গে কন্ঠ মিলাইয়া আমরাও ঘোষণা করিতেছি যে আমরা সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করিব। সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধের কামানের খোরাক হইব না। আমরা দাবী করিতেছি যে আমাদের সরকার যুদ্ধবন্দীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াক।
এ কথাও আমরা ঘোষণা করুতে চাই— এটম অস্ত্র হহইতেছে আক্রমণের অস্ত্র, মানুষকে ব্যাপকভাবে নিশিহ্ন করার অস্ত্র। তাই আমরা দাবী করিতেছি এটম অস্ত্রকে বিনাশর্তে অবৈধ ঘোষণা করা হউক এবং এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকরী করার জন্য তারপর কঠোর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হোক।
যে সরকার প্রথম কোন দেশের বিরুদ্ধে এটম অস্ত্র ব্যবহার করিবে সেই সরকার মানব্জাতির শত্রুতা করিবে, আমরা তাহাকে যুদ্ধ অপরাধে অপরাধী মনে করিব।
আজ আমরা ইহাও লক্ষ্য করিতেছি যে দুনিয়ার গুটি কয়েক রাষ্ট্র এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি মানুষকে দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে এবং ঔপনিবেশিক দেশগুলির আজাদীর আন্দোলনে ভীত সাম্রাজ্যবাদী দস্যুরা
মারমুখো হইয়া ঐসব দেশে রক্তের স্রোত বহাইয়া দিতেছে। আমরা এই সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে দৃঢ় আওয়াজ তুলিতে চাই এবং আজাদী সংগ্রামে নিযুক্ত আমাদের কোটি কোটি ভাই বোনদের অভিনন্দন, অকুণ্ঠ সমর্থন জানাই।
২। আমরা চাই পাকিস্তান বৃটিশ কমনওয়েলথ ত্যাগ করতে এবং পাকিস্তানে স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কায়েম হউক। যাহাতে প্রত্যেকটি ভাষা-ভাষী প্রদেশেল পূর্ণ আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকার ভোগ করিতে, প্রত্যেকটি উপহাতি পাইবে কৃষ্টির স্বাধীনতা ও স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকটি নাগরিক ভোগ করিবে সমান নাগরিক অধিকার এবং আরবী হরফহীন বাংলা হইবে রাষ্ট্রভাষা।
৩। আমরা চাই বেকারীর অবসান এবং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক যুবক যুবতীর চাকরী ও সৎভাবে জীবিকার্জনের নিশ্চয়তা বেকারদের জন্য সরকারী ভাতা।
৪। আমরা চাই প্রাপ্ত বয়স্কদের সার্বজনীন ভোটাধিকার ও যুক্ত নির্বাচন।
৫। আমরা চাই দেশের নিরক্ষরতা দূরীকরণ শিক্ষার উন্নতি যুদ্ধখাতে ব্যয় কমাইতা শিক্ষার জন্য বর্ধিত হারে ব্যয় বরাদ্দ, বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, প্রয়োজন অনুসারে মেয়েদের জন্য শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা ও প্রাপ্তবয়স্ক অশিক্ষিত যুব সমাজের জন্য শক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা স্কুল-কলেজের উন্নতি ছাত্রছাত্রীদের আবাসস্থল বৃদ্ধি ও ছাত্র বেতন হ্রাস।
৬। আমরা চাই যুব সমাজের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্য শহরে ও গ্রামে সরকার কর্তৃক প্রচুর পরিমাণে পাঠাগার ক্লাব ও খেলাধুলার ব্যবস্থা এবং বর্তমানে যে সমস্ত পাঠাগার ও ক্লাব আছে সেই গুলিতে সরকারাই সাহায্য, মেয়েদের জন্য বিশেষ পাঠাগার ও ক্লাবের ব্যবস্থা।
৭। আমরা চাই জনসাধারণের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সরকার কর্তৃক প্রভূত পরিমাণে ব্যয় বরাদ্দ— শহরে ও গ্রামে প্রচুর চিকিৎসালয় ও ব্যায়ামাগার স্থাপন।
৮। আমরা চাই বিনা খেসারতে জমিদারী, জায়গীরদারী প্রথার উচ্ছেদ ও কৃষকের হাতে জমি।
৯। আমরা চাই শ্রমিকের জীবন ধারণের উপযোগী মজুরী দৈনিক ৮ ঘন্টা হিসাবে সাপ্তাহিক ৪৪ ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণ। শ্রমিক যুবকদের জন্য খেলাধুলা, পাঠাগার ও ক্লাবের ব্যবস্থা।
১০। আমরা ফাউ সমস্ত বিদেশী মূলধন বাজেয়াপ্তকরণ, বড় বড় শিল্পগুলির জাতীয়করণ।
১১। আমরা চাই যুব সমাজের জন্য সামরিক শিক্ষাব্যবস্থা ও অস্ত্র বহন করিবার অধিকার।
১২। আমরা চাই সমস্ত দাসত্বমূলক আইনের প্রত্যাহার বিনা বিচারে আটক রাখার কানুন নাকচ, সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি সমাজের প্রত্যেকটি শ্রেণীর— শ্রমিকের কৃষক মধ্যবিত্তের ছাত্রদের মেয়েদের চাকুরেদের নিজ নিজ সংগঠন গড়ার সভা সমিতি করার ও মত প্রকাশের পূর্ণ ও অবাধ অধিকার। প্রত্যেকটি দলের নিজ মতানুযায়ী কাজ ও মত প্রকাশ করিবার বৈধ অধিকার।
১৩। আমরা চাই দেশের প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্ম পালন করার পূর্ণ অধিকার, সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের ধর্ম ও অন্যান্য অধিকার এওক্ষার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা।
১৪। আমরা চাই সকল প্রকার প্রাদেসগিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার অবসান।
‘আমাদের ঘোষণা ও দাবী’ শীর্ষক এই কর্মসূচীর পর যুব লীগের ঘোষণা পত্রটিতে সাধারণভাবে যুবকদের প্রতু নিম্নোক্ত আহবান জানানো হয়ঃ

আমরা জানি সে, দেশের যুব সমাজের তথা সমস্ত সমাজের উন্নতির জন্য মূল প্রয়োজন— রাজনৈতিক, সামাজিক অর্থনৈতিক ও সরকারী ব্যবস্তগার আমূল পরিবর্তন সাধন ও মৌলিক পুনর্গঠন। সেই মহান উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উপরোক্ত কর্মসূচীর ভিত্তিতে দলমত- ধর্ম – নির্বিশেষে পাকিস্তানের সমস্ত যুব সমাজ যুবলীগে যোগদান করিয়া পাকিস্তানের সর্বত্র শক্তিশালী যুব আন্দোলন গড়িয়া তুলুন।
আমরা জানি সে আমাদের পথ সহজ নয়। বহু বাধা কায়েমী স্বার্থের রক্তচক্ষু ও অত্যাচার আমাদের এই জয়যাত্রার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করিবে কিন্তু দেশের যুব সমাজ অসাধারণ শক্তির অধিকারী। মহান আদর্শ অনুপ্রাণিত ও ঐক্যবদ্ধ যুবশক্তি অসাধ্য সাধন করিতে পারে। তার জন্য চাই যুব সমাজের ঐক্য ও প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা।
দুনিয়ার দেশে দেশে আজ যুব শক্তির অতুলনীত অভ্যুত্থান ঘটিয়াছে। দেহে অমিত শক্তি ও মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা লইয়া তাহারা আজ আগাইয়া চলিয়াছে স্বাধীনিতা শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। আসুন আমরা পাকিস্তানের যুব সমাজ দল-মত-নির্বিশেষে তাহাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া অগ্রসর হই। আমাদের জীবনের সর্ববিধ উন্নতি ও পাকিস্তানের স্বাধীন, সুখী ও সমৃদ্ধশালী করার জন্য আমরা চাই স্বাধীনতা শান্তি ও গণতন্ত্র। আমরা চাই দুনিয়া
ব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান।
২৭ মার্চ ১৯৫১ তারিখে যুব সম্মেলনে সভাপতির ভাষণ প্রস্তাবাবলী ও ঘোষণা থেকে যে অংশগুলি উপরে উদ্ধৃত করা হলো সে গুলির গুরুত্ব শুধুমাত্র যুব সম্মেলনের দলিল হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়। এই দলিলগুলিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিকসহ জীবনের বিভিন্ন দিকের যে চিত্র পাওয়া যায় সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য।
মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হওয়ার পর যুব লীগের খসড়া ঘোষণাপত্রটি সম্মেলনের প্রতিনিধিদের দ্বারা সামান্য রদবদল হয়ে গৃহীত হওয়ার পর ‘পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ’ নামে একটি যুব সংগঠন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এই উদ্দেশ্যে গঠিত হয় ১২৫ সদস্য বিশিষ্ট ‘পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ সংগঠনী কাউন্সিল’। ১৪ প্রথম দিনের দ্বিতীয় অধিবেশন শেষ হয় রাত্রি আড়াইটায়। ১৫
২৮ শে মার্চ বিকেল ৪-৩০ মিনিটে ৪৭ নম্বর ঠাটারী বাজারে যুব লীগের কাউন্সিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন মহম্মদ আলী। ৩০ জন সদস্যের ১৬ এই বৈঠকে নিম্লিখিত ব্যক্তিদেরকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের একটি কার্যকরী কমিটি১৭ গঠিত হয়ঃ
সভাপতি—মাহমুদ আলী (প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক আসাম প্রাদেশিল মুসলিম লীগ) সহ-সভাপতি— খায়েজ আহমদ (সম্পাদক সংগ্রাম) ইয়ার মহম্মদ, শামসুজ্জোহা, আবদুল মজিদ; দৌলতুন্নেছা সাধারণ সম্পাদক— অলি আহাদা, যুগ্ম সম্পাদক— আবদুল মতিন রুহুল আমীন কোষাধ্যক্ষ— টি এ চৌধুরী সদস্য— নূরুল হুদা মোহাম্মদ তোয়াহা মতিউর রহমান, আবদুল হালিম আবদুস সামাদ মকসুদ আহমদ খোন্দকার গোলাম মোস্তফা কবির আহমদ, আবদুল ওদুদ এ গফুর চৌধুরী প্রাণেশ সমাদ্দার।
এই কাউন্সিল অধিবেশনে একটি পৃথক প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানের যুব সমাজকে একটি যুব প্রতিষ্ঠানে সংগঠিত হওয়ার জন্য আহবান জানানো হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের যুবকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় নুরুল হুদার উপর।
২৮শে মার্চ তারিখে সন্ধ্যার সময় তেজগাঁওএ সম্মেলন উপলক্ষ্যে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। মশাল জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের স্থানটি আলোকিত করা হয় এবং পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে আগত শিল্পীরা গান বাজনা আবৃত্তি ও কমিক পরিবেশন করেন। এইভাবে দুই দিনব্যাপী পূর্ব পাকিস্তান খুব সম্মেলন সমাপ্ত হয়। এই সম্মেলনের উপর ‘নবীন আশার আলো’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে সাপ্তাহিক নওবেলাল বলেনঃ
সম্প্রতি পাকিস্তান যুব সম্মেলনের অনুষ্ঠানের ফলে ‘পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ’ জন্মলাভ করিয়াছে। এই নতুন প্রতিষ্ঠানটির জন্মলাভ আমাদের জাতীয় জীবনে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করিবে তাহাতে সন্দেহ নাই। দেশের যুব সমাজের উপরই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে— কিন্তু সেই যুব সমাজের কর্ম প্রচেষ্টা সুসংবদ্ধ ও সুপরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি ‘পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ’ দেশের যুব সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করিয়া জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করিতে সমর্থ করিয়া তুলিবে। আমরা জানি, তাহাদের জয়যাত্রা ব্যর্থ করিয়া দিবার প্রয়াস পাইবে কায়েমী স্বার্থবাদ। কিন্তু যৌবনের দৃঢ় শপথ তাকে সম্মুখের পানে আগাইয়া লইয়া যাইবেই।

৩। যুবলীগের প্রাথমিক সাংগঠনিক তৎপরতা

১৯৫১ সালের ২৭শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই যুবলীগের সাংগঠনিক কাজ শুরু হয়। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে যেসব প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেন এবং কিছু কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্যে দিয়েই সাংগঠনিক তৎপরতার সূত্রপাত করেন। এইসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে ২৩শে এপ্রিল পূর্ব বাংলার বিভিন্ন এলাকায় গঠিত শাখাসমূহে এবং ঢাকায় যুবলীগের উদ্যোগে কবি ইকবাল এর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয় এরপর ১৩ই মে ঐ একইভাবে সারা প্রদেশে যুবলীগ রবীন্দ্র জন্ম-জয়ন্তী পালন করে।
যুব লীগের সাংগঠনিক কাজকে অধিকতর সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য এবং বিভিন্ন এলাকায় কাজের সমন্বয় সাধনের জন্য ২৭ ও ২৮শে মে, ১৯৫১ তারিখে যে ঢাকা জেলার নরসিংদীতে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ সংগঠনী কাউন্সিলের একটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ বলেন, “দেশের সাংস্কৃতিক জীবনকে সংক্ষিপ্ত করা— বর্তমান মন্ত্রিসভার কবল হইতে জনগণের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে পূর্ণভাবে মুক্ত করাই আমাদের বর্তমান জরুরী কাজ।”
দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপর এই অধিবেশনে কতকগুলি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এগুলির মধ্যে একটিতে যুব লীগের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিত রাজনৈতিক প্রচারণার জবাবে বলা হয় যে, ‘পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের স্বরূপ সম্পর্কে বিভিন্ন দিক হতে উত্থিত প্রশ্নের উত্তরে সংগঠনী কাউন্সিলের এই সভা পুনরুক্তি করিতেছে যে, পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতি বিধানের উদ্দেশ্যে কর্মরত যুবকগণের একটি গণতান্ত্রিক সাধারণ প্রতিষ্ঠান। অতএব ইহাকে একটি রাজনৈতিক দল বলিয়া সন্দেহ করার কোন হেতু নাই।”
ধর্মঘটী প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি প্রদেশের শিক্ষা বিভাগের মনোভাব মনোভাব ও নীতির তীব্র নিন্দা করে এবং অবিলম্বে প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবী মেনে নেয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সেই সঙ্গে প্রস্তাবে পাট ব্যবসায়ীদের ওপর অতিরিক্ত আয়কর ধার্য করে তার থেকে প্রাপ্ত অর্থ দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের উন্নতির জন্য ব্যবহার করার দাবীও জানানো হয়।
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করার দাবী জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ যে কর্মপন্থা গ্রহণ করেন তার প্রশংসা করে এবং প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে জেলা বোর্ড, লোকাল বোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এবং সরকারী অফিসসমূহে অবিলম্বে বাংলাকে কার্যকরী ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করার দাবী জানিয়ে অপর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এই সময়ে সরকার সংবাদপত্রের উপর যে সব নিষেধাজ্ঞা জারী ও নির্যাতন করেন তার নিন্দা করে অধিবেশনে গৃহীত একটি প্রস্তাবে বলা হয় যে, জনসাধারণের প্রতিবাদকে অবজ্ঞা করে পাঞ্জাবের ‘নওয়াই ওকত’ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ এবং পাকিস্তান অবজার্ভার (অস্পষ্ট) সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ ও ‘সংগ্রাম’ পত্রিকার উপর নানারূপ আঘাত দ্বারা সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করিতেছেন।
২২শে জুলাই, ১৯৫১, তারিখে ঢাকায় যুব লীগের কার্যকরী সংসদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে একটি সাংগঠনিক প্রস্তাবে বিভিন্ন শাখা যুব লীগের নির্বাচনের তারিখ এইভাবে নির্ধারণ করা হয় (১) প্রাথমিক শাখা ১৫ই অক্টোবর (২) থানা ও শহর শাখা ৩০শে অক্টোবর (৩) মহকুমা শাখা ১৫ই নবেম্বর (৪) জেলা শাখা ৩০শে নবেম্বর এবং কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ৩০শে ডিসেম্বর, ১৯৫১।
এরপর ঢাকায় কার্যকরী সংসদের অপর একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৬শে অক্টোবর, ১৯৫১। ইতিপূর্বে ১লা অক্টোবর একটি সরকারী প্রেস নোটে প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ ৫ বছরের অনুর্ধ্ব বয়স্ক বালক-বালিকাদের শিক্ষার জন্য আরবী, উর্দু ও বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা সম্বন্ধে যে ঘোষণা দেয়া হয় তার প্রতিবাদ করে প্রাথমিক পর্যায়ে কেবলমাত্র মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষাদানের দাবী জানিয়ে এই বৈঠকে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
অপর একটি প্রস্তাবে লবণের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির *ভয়াবহতার উল্লেখ করে বলা হয় যে তা সরকারের দেউলিয়া শিল্পনীতির অবশ্যম্ভাবী ফল। প্রস্তাবে সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য লবণ আমদানীর উপর সকল প্রকার বিধি-নিষেধ রহিত, পূর্ববঙ্গ লবণ ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের প্রস্তাব অনুযায়ী অতিসত্বর পূর্ববঙ্গ লবন তৈরির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা এবং লবণের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের উপর পাঁচ বছর কোন কর ধার্য না করার কথা বলা হয়। খুলনার দুর্ভিক্ষাবস্থার উপরও একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
নবেম্বর মাসে যুব লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ব্যাপকভাবে পূর্ব বাংলার অনেকগুলি জেলা সফর করেন এবং তাঁদের উপস্থিতিতে কতকগুলি জেলায় যুব লীগের সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। এই প্রাথমিক সাংগঠনিক কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর ৩০শে ও ৩১শে ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় যুব লীগের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন।

৪। যুবলীগের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন

১৯৫১ সালের ৩০শে ও ৩১শে ডিসেম্বর ঢাকা বার লাইব্রেরী হলে পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি মাহমুদ আলী। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন ঢাকার সাধনা ঔষধালয়ের অধ্যক্ষ ডক্টর যোগেশচন্দ্র ঘোষ এবং প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেন পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালাম। সম্মেলনে ইস্ট পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবারের সভাপতি কামরুদ্দীন আহমদও বক্তৃতা করেন।
এই সম্মেলনে যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ যে রিপোর্ট প্রদান করেন তাতে যে শুধু যুব লীগের প্রতিষ্ঠা পরবর্তী নয় মাসের সাংগঠনিক রিপোর্টই প্রদান করা হয় তাই নয়। তৎকালীন অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও রিপোর্টটিতে অনেক উল্লেখযোগ্য তথ্য উপস্থিত করা হয়। যুব লীগের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে যে প্রচারণা সরকারী এবং বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল মহল থেকে করা হচ্ছিলো সে সম্পর্কে সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ তার রিপোর্টে বলেন,
কোন কোন মহল হইতে বলা হইতেছে যে, ‘যুব লীগ মুসলিম লীগের লেজুড়।’ কেহ কেহ বলেন যে ‘ইহা আওয়ামী লীগের শাখা।’ আবার কেহ কেহ আমাদের প্রতিষ্ঠানের ‘কমিউনিস্টদের প্ল্যাটফর্ম’ বলিয়া অভিহিত করেন। আমাদের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিভিন্ন মহল যখন পরস্পরবিরোধী মত প্রকাশ করিতেছেন তখন ইহা প্রমাণিত হয় যে, কাহারও মতই ঠিক নহে। যুবলীগ কোন বিশিষ্ট রাজনৈতিক দলের ‘শাখা’ বা প্ল্যাটফর্ম নয়। এই প্রসঙ্গে ইহাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে যুবলীগ কোন ছাত্র প্রতিষ্ঠানেরই প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র প্রতিষ্ঠান নয়, সমস্ত ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ছাত্র যুব সমাজকে সংগঠিত করিতে যুবলীগ চেষ্টা করিবে।
আমাদের যুবলীগ কোন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাবাদর্শের দ্বারা চালিত নয়। ঘোষণায় সম্বলিত কর্মসূচী যুব লীগের আদর্শ এবং যে কোন দলের যে কোন শ্রেণী, যে কোন মতের যে কোন ধর্মের যুবক-যুবতী ইহাতে যোগদান করিতে পারেন। যুব লীগ সমস্ত শ্রেণীর, সমস্ত যুব সমাজের গণতান্ত্রিক গণপ্রতিষ্ঠান। যদি কেহ ইহাকে নিজেদের দলগত স্বার্থে ব্যবহার করিতে চাহেন, তবে তিনি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হইবেন এবং আমরা বিশ্বাস করি যে, যুব লীগের প্রত্যেকটি কর্মীও সভ্য যুব লীগের এই বৈশিষ্ট্যের কথা মনে রাখিয়া ইহাকে যুব সমাজের সত্যিকারের গণপ্রতিষ্ঠানরূপে গড়িয়া তুলিবেন। ইহার ভেতর ব্যাপক যুব সমাজকে সংঘবদ্ধ করিতে চেষ্টা করিবেন।
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অলি আহাদ যুব লীগের জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচি সম্মেলনের অনুমোদনের জন্য পেশ করেনঃ
১। ঘোষণার বাণী সর্বত্র প্রচার করা হবে। যুব লীগ সম্পর্কে যেসব সংশয় উঠিবে অনবরত প্রচার দ্বারা তাহা দূর করা এবং এই উদ্দেশ্যে একটি মুখপত্র প্রকাশ করা।
২। যুব সমাজের বিভিন্ন স্তরের দৈনন্দিন সমস্যা নিয়া— তাহাদের বেকারীর সমস্যা, বাসস্থানের সমস্যা, শিক্ষার সমস্যা ও অন্যান্য স্থানীয় সমস্যা নিয়া— তাহাদের ভেতর দৈনন্দিন কাজ চালান ও সেই সমস্যা দূরীকরণের জন্য আন্দোলন করা।
৩। যুব সমাজের প্রগতিমূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা। পাড়ায় ও গ্রামে ক্লাব লাইব্রেরী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং খেলাধুলা প্রচলনের জন্য চেষ্টা করা। যেসব ক্লাব লাইব্রেরী প্রভৃতি আছে সেগুলিকে যথাসাধ্য সাহায্য করা। সরকার যাহাতে ক্লাব লাইব্রেরীর প্রচলন করে ও ক্লাব লাইব্রেরীকে সাহায্য করে তাহার জন্য আন্দোলন করা।
৪। যুব সমাজের ভেতর হইতে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য গণ-শিক্ষার অভিযান চালান, নাইট স্কুল করা ও সরকার হইতে প্রাপ্ত বয়স্কদের শিক্ষার ব্যবস্থা হয় তাহার জন্য আন্দোলন করা।
৫। ব্যক্তি স্বাধীনতা কায়েম ও সমস্ত রাজবন্দীর মুক্তির জন্য সারা প্রদেশে প্রবল গণ-আন্দোলন গড়া।
৬। বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা। বাংলার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়ার জন্য আন্দোলন করা। অবাঙালীদের শিক্ষার মাধ্যম হইবে তাঁহাদের নিজস্ব ভাষা।
৭। সাম্রাজ্যবাদ মধ্যপ্রাচ্য ছাড় ও এশিয়া ছাড় আন্দোলন গড়িয়া তোলা।
৮। সাংগঠনিক দিক দিয়া ব্যাপকভাবে যুব লীগের সভ্য সংগ্রহ ও প্রত্যেক জেলায় শাখা গঠন। প্রতিটি কমিটিকে সমষ্টিগতভাবে কাজ করানোর জন্য কমিটিগুলির নিয়মিত বৈঠক প্রভৃতি করা।
৯। প্রতি কমিটির তরফ হইতে সভ্য ও বন্ধুদের নিকট হইতে নিয়মিত চাঁদা আদায় ও একটি প্রাদেশিক তহবিল গঠন করা।
১০। যুব কর্মীদল গড়িয়া তোলার প্রচেষ্টা করা আলোচনার পর এই কর্মসূচীটি সম্মেলনে গৃহীত হয়।
এই সম্মেলনে যুব লীগের কার্যকরী সংসদের যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা কর্মকর্তা ও সদস্য নির্বাচিত হনঃ-
সভাপতি– মাহমুদ আলী, সহ-সভাপতি– মির্জা গোলাম হাফিজ, খায়েজ আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, ইয়ার মহম্মদ খান, শামসুজ্জোহা।

[বদরুদ্দীন উমরঃ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি। দ্বিতীয় খন্ড। ]

সাধারণ সম্পাদক—অলি আহাদ। যুগ্ম সম্পাদক -মহম্মদ সুলতান ও ইমাদুল্লাহ। কোষাধ্যক্ষ– মাহবুব জামাল জাহেদী। সদস্য– আবদুল হালিম, আবদুল মতিন, এ বি এম মুসা, নূরুল হুদা, আনওয়ারুল হুসেন, এম আবদুল বারী, আবু তাহের, সালেহউদ্দীন, আবদুল ওদূদ, সুফী খান, আলী আশরাফ, এ রহমান সিদ্দিকী, মুতাহের হোসেন, নূরুর রহমান, মফিজুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, আবদুস সামাদ, দেওয়ান মাহবুব আলী, আবদুল কাদের ও প্রানেশ সমাদ্দার। দুইদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এই বার্ষিক সম্মেলনে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় তিনশো কাউন্সিল সদস্য ও প্রতিনিধি যোগদান করেন।

৫। সম্মেলনে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টের বিবরণ

পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ তাঁর রিপোর্টে বলেন, আমরা আজ যখন এখানে সমবেত হইয়াছি, তখন পূর্ব বাংলার অন্যতম শস্যভান্ডার খুলনা জেলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ* বিরাজ করিতেছে। মুসলিম লীগ এমএলএ জনাব সবুর এর বিবৃতি হইতেই জানা যায় যে, এই দুর্ভিক্ষে ইতিমধ্যেই দশ হাজার নর-নারী প্রাণ হারাইয়াছেন এবং প্রতিদিন অনশনে লোকের মৃত্যু ঘটিতেছে। ৫০ সনের মন্বন্তরে সারা বাংলাদেশে মানুষের জীবনে ব্যাপকভাবে যে বিপর্যয় ঘটিয়াছিল আজ খুলনা জেলায় ছোট আকারে তাহারই পুনরাবৃত্তি ঘটিতেছে। না খাইয়া পথের ধারে শিয়াল কুকুরের মতো প্রাণত্যাগ করা,গৃহস্থ বাটির কুলবধুর লজ্জা-শরম ত্যাগ করিয়া এক মুঠ ভাতের জন্য রাস্তায় মুরিয়া বেড়ান, নারীর ইজ্জত হানি প্রভৃতি ৫০ সনের মন্বন্তরের প্রতিটি জঘন্য ঘটনাই আজ খুলনার গরীব মনসাধারণের জীবনে ঘটিতেছে। এই দূর্ভিক্ষের কারণ সম্পর্কে রিপোর্টটিতে বলা হয়,
অন্যায় ভিত্তির উপর রচিত ভূমি ব্যবস্থা, তদুপরি নদ-নদী খাল-বিল সংস্কারের অভাবে উওর দিক হইতে আগত নদীগুলির মিঠা পানির চাপ কমিয়া যাওয়াতে দক্ষিণ হইতে আগত লোনা পানির উপর্যুপরি বন্যা এবং পাক-ভারত বাণিজ্যের ভেতর নানা বাধা-নিষেধ হেতু খুলনার দক্ষিণ অঞ্চলের কাঠ,পাটি, মাদুর, হোগলপাতা প্রভৃতির বাজার নষ্ট হইয়া যাওয়া— এই সমস্ত কারণেই আজ খুলনার নর-নারী দূর্ভিক্ষের কবলে গ্রাস পতিত হুয়াছেন। যে যুব শক্তু সুস্থ সবল মানুষ হিসাবে পাকিস্তানের সর্ববিধ উন্নতির কাজে আত্ননিয়োগ করিতে পারে সেই যুব শক্তির এক অংশই আজ অনাহারে খুলনার পথে-ঘাটে প্রাণ হারাইতেছে। ইহার চেয়ে বড় দূর্ভাগ্য দেশের আর কি হইতে পারে। যে মূল অর্থনৈতিক কারণে খুলনার দূর্ভিক্ষে ঘটিয়াছে, সেই মূল কারণ পূর্ব বাংলার সমস্ত জেলাতেই বিদ্যমান।
সেজন্যই সোনার পূর্ব পাকিস্তানে শস্যের উৎপাদন ঘাটতি এবং সেজন্যই খুলনাতে আজ যে বিপর্যয় দেখা দিয়াছে, সেরূপ বিপর্যয় যে কোন স্থানে দেখা দিতে পারে।* বস্তুতঃ রাজশাহী

*[ বিস্তৃত বিবরণের জন্য পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির দ্বিতীয় খন্ডের প্রথক পরিচ্ছেস দ্রষ্টব্য। ব,উ]

জেলার আত্রাই এলাকায় লোকচক্ষুর অন্তরালে গত ৭ বছর দূর্ভিক্ষের অবস্থা চলিয়াছে। এ বছর সিলেটের বড়লেখা, গোলাপগঞ্জ, জগন্নাথপুর প্রভৃতি কয়েকটি থানায় বরিশালের কয়েকটি মহাকুমায় ও নোয়াখালীর হাতিয়ার জনগণও বিষম খাদ্য সংকটে পড়িয়াছিলেন। তাই একথাই বলা চলে যে, আমরা পূর্ববঙ্গের যুব সমাজ তথা সমস্ত নর-নারী চির দুর্ভিক্ষের বিভীষিকার ভেতর বাস করিতেছি। যখন সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে তখনই সেখানে সেখানকার দুঃস্থ ভাই-বোনদের সাহায্যে ছুটিয়া যাওয়া যুব লীগ কর্মী ও যুব সমাজের অবশ্যকর্তব্য। তবে চিরদুর্ভিক্ষের এই বিভীষিকা হইতে মুক্ত হওয়ার একমাত্র পথ হইল আমাদের দেশের ভূমি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার। সেই দিকেও আমরা আপনাদের এবং পূর্ব বাংলার যুব সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেছি।
এরপর লবণ সংকটসহ অর্থনৈতিক সংকটের অপরাপর দিক সম্পর্কে অলি আহাদ বলেন, পূর্ব বাংলায় রহিয়াছে হাজার হাজার মাইল সমুদ্র উপকূল। কিন্তু শুধুমাত্র সরকারী অবহেলার জন্যই এখানে লবণ তৈরির শিল্প গড়িয়া ওঠে নাই এবং পূর্ব বাংলার জনগণকে ১০ হয়েছে ১৬ টাকা সের দর দিয়া লবণ কিনিয়া খাইতে হইয়াছে।** এখনও অধিকাংশ স্থানে লবণের এক টাকা। নুন ভাত খাওয়াও আজ আমাদের সামনে কঠিন সমস্যা। নিত্যব্যবহার্য প্রতিটি জিনিসের দাম আজ আগুন হইয়া উঠিয়াছে। সরকারের সমর্থক “মর্নিং নিউজ” কাগজে ২২-১০-৫১ ইং তারিখে খবর বাহির হইয়াছিল “অন্যান্য নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের দামও টাকায় আরও দুই হইতে চার আনা বাড়িয়াছে।
যেসব সিগারেট সাধারণ লোক ব্যবহার করে তাহার দাম আগের মতোই চড়া। খাসী ভেড়ার গোশতের দাম ৩ টাকা সের, মাছ দুই টাকার উপর। অন্যান্য বহু জিনিস কালোবাজারে চলিয়া গিয়াছে। সর্বত্রই জীবনধারণের খরচের নিষ্ঠুর চাপে জনগণ অসহ্য দুঃখে দীর্ঘশ্বাস ফেলিতেছেন। কিন্তু ব্যবসায়ী চোরাচালানী ও চোরাকারবারীরা প্রভূত মুনাফা করিতেছে।” এর উপর কোন মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। করাচীর ব্যবসায়ী মহলও এক প্রস্তাবে বলিয়াছিলেন যে, “পূর্ববঙ্গে নিত্যব্যবহার্য জিনিসের দাম রূপকথার উপাখ্যানের মত অবিশ্বাস্যভাবে বাড়িয়াছে (পাকিস্তান অভজার্ভার ২৬-১০-৫১ ইং)।
যেসব কারনের জন্য আজ এই মূল্য বৃদ্ধি হইতেছে তাহা আজ সুবিদিত। মুষ্টিমেয় বিদেশী ও দেশী মুনাফাখোর পূর্ববঙ্গের ব্যবসা-বাণিজ্যে একাধিপত্য করিতেছে এবং তাহারা মুনাফার জন্য জিনিসপত্রের দাম যথেচ্ছভাবে বৃদ্ধি করিয়া চলিয়াছে অথচ সরকার হইতে ইহার কোন প্রতিবিধান করার চেষ্টা করিতেছেন না।
আমাদের ধারণা যে ১৯৩৯ সনে জীবন ধারণের খরচের মান যদি ১০০ ধারা যায় তাহা হইলে এখন তাহা দাঁড়াইয়াছে পূর্বেকার কয়েক গুণ। জীবন ধারণের খরচা বৃদ্ধির এই পটভূমিকায় দেশের কৃষক সমাজ তাঁহাদের পণ্য অত্যন্ত কম মূল্যে ছাড়িয়ে দিতে বাধ্য হইতেছেন। এবার পাটের মওসুমে যখন সাধারন কৃষকগণ পাট বিক্রি করেন তখন পাটের দর ছিল ১৫ হইতে ২০ টাকা। উত্তরবঙ্গের কৃষকদের অন্যতম প্রধান অর্থকরী শস্য পাট এবার তাঁহারা ৪ টাকা মন দরে ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইয়াছেন। সেখানে আখের দর কৃষকগণ পাইতেছেন মনপ্রতি গড়ে ১ টাকা চৌদ্দ আনা। ইহাতে তাঁদের উৎপাদন খরচই পোষায় না।
কাজেই একদিকে জীবন ধারণের খরচের অসম্ভব রকম বৃদ্ধি ও অন্যদিকে নিজের ফসলের কম দাম এই উভয় সংকটের যাঁতাকলে পড়িয়া সমগ্র কৃষক সমাজ বিষম দুর্গতি ভোগ করিতেছেন এবং কৃষক যুব সমাজ এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হইতেছেন। পূর্ববঙ্গের কৃষক যুব সমাজের অধিকাংশের দৈনিক খাওয়া হইল একবেলা এক তরকারী ভাত। তাও রোজ জোটে না। আর অন্য বেলা শাকসবজি সিদ্ধ।
দৈনিক কায়িক পরিশ্রম করিয়া যেসব যুবক জীবন ধারণ করেন তাঁদের অবস্থা আজ কি? ঢাকা শহরে প্রায় ৭০০০ রিকসা চালক আছেন যাঁদের অধিকাংশই গরীব যুবক। ৮/৯ ঘণ্টা গাড়ি টানিয়া তাঁদের আয় হয় দৈনিক ৪ টাকা ৪ আনার মত। ইহার ভেতর তাঁদের চা নাস্তা খাইতে চলিয়া যায় এক টাকা দেড় টাকা এবং রিকসার ভাড়া বাবদ দিতে হয় ২ টাকা। বাড়িতে তাহারা নিয়া যান দৈনিক এক টাকা দেড় টাকা। এই সামান্য আয়ে পাঁচজনের সংসার চলে না। তাই পূর্ববঙ্গের রাজধানীতে যেখানে লাট সাহেব মন্ত্রী বড় বড় আমলা ও মুষ্টিমেয় ধনী প্রাসাদোপম ইমারতে বিলাসে কাল যাপন করেন সেখানে জনসংখ্যার অধিকাংশ এই বস্তিবাসী গরীব জনগণ সকালে কোন নাস্তা খান না, সস্তা চা-পানি খাইয়া ক্ষুধা মিটান দিনের পর দিন অপুষ্টিকর খাওয়া ও সারাদিন কঠোর পরিশ্রম— ইহার ফল দাঁড়াইয়াছে এই যে একজন সুস্থ সবল রিকসা চালক যুবক তিন মাস রিকসা চালাইয়াই প্রথম আক্রান্ত হন যকৃতের ব্যাধিতে পরে হয় যক্ষ্ণা। আজ নিদারুণ যক্ষ্ণা রোগ বস্তিবাসী মেয়েদের ভেতরও ছড়াইয়া পড়িতেছে। ঢাকা নগরীর বস্তিবাসীদের প্রতি দশ ঘরে একজন যক্ষ্ণা রোগী পাওয়া যায়। শহরের গরীব যুব সমাজ আজ তিলে তিলে ধ্বংসের পথে চলিয়াছেন।
কল-কারখানায় যেসব শ্রমিক কাজ করেন তাঁদের মূল মজুরি ও মাগগী ভাতাও বাড়ে নাই। আজও রেলওয়ে বিভাগের ওয়াচ এন্ড ওয়ার্ডম্যানের বেতন মাত্র ৩৩ টাকা। কাজেই, জীবন ধারণের খরচা বৃদ্ধি পাওয়াতে তাঁদের জীবন ধারণের মানের ক্রমাবনতি ঘটিয়াছে। সরকারী চাকরিতে যেসব গরীব যুবক নিযুক্ত আছেন তাঁদের অবস্থা কি? প্রাদেশিক সরকারের দফতরে নিযুক্ত জমাদারের মাসিক বেতন ৫৬ টাকা ও চাপরাশীদের বেতন ৫১ টাকা। আবার যারা নীলক্ষেত ব্যারাকে থাকেন তাঁদের বেতন হইতে ঘরভাড়া বাবদ কাটিয়া নেয়া হয় ছয় টাকা চৌদ্দ আনা। কাজেই মাসে ৪৫ টাকা আট আনা আয় নিয়া যে এই গরীব চাকুরিগণকে পরিবারসহ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাইতে হয় তা সহজেই অনুমেয়।
মধ্যবিত্ত যুব সমাজের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। মুষ্টিমেয় যুবক যুবতী সরকারী কৃপাদৃষ্টি লাভ করিয়া কিছু কিছু সুবিধা পাইয়াছেন বটে। কিন্তু চাকরিতে নিযুক্ত অধিকাংশ মধ্যবিত্ত যুবক যুবতী অভাবের ভেতর দিয়াই জীবন-যাপন করিতেছেন। প্রাদেশিক তথ্য বিভাগের (Provincial Statistics Board) প্রকাশিত তথ্য হইতেই জানা যায় যে ঢাকা শহরের শতকরা ৭৮টি মধ্যবিত্ত পরিবার আজ নিজের আয়ে সংসার চালাইতে পারেন না।
কাজেই আমরা এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হইয়াছি যে একদিকে স্বল্প আয় অন্যদিকে জিনিসপত্রের চড়া দাম এই উভয় কারণ হেতু পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত শহরের গরীব শ্রমিক ও গ্রামের কৃষক যুব সমাজ যাহারা সমগ্র যুব সমাজের শতকরা ৯৫ জনেরও বেশি তাহাদের জীবন ধারণের মানের ক্রমাবনতি এবং পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব হেতু তাহাদের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটিতেছে। প্রাদেশিক তথ্য বিভাগের মাসিক পুস্তিকা হইতে পূর্ব বাংলার জেলা শহরগুলির জন্ম ও প্রধান প্রধান অসুখে মৃত্যুর মানের যে হিসাব আমরা নিচে দিলাম তাহা হইতেই আজ অবস্থার গুরুত্ব বোঝা যাইবেঃ
সময় সমস্ত শহরে সমস্ত শহরে
জন্ম মৃত্যু
ডিসেম্বর ১৯৫০ ৯৬৪ ১২০৪
জানুয়ারী ১৯৫১ ৬৪৯ ৮৬৫
ফেব্রুয়ারী ১৯৫১ ৭৮৬ ৭৫৯
মার্চ ১৯৫১ ৭৮৫ ৮৯৯
এপ্রিল ১৯৫১ ৫৯৯ ৮৩৭

**[ লবণ সঙ্কটের বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির দ্বিতীয় খন্ড প্রথম পরিচ্ছেদ। -ব,উ.]
সময় সমস্ত শহরে উপরের এইসব তথ্য সম্পূর্ণ নয়। কারণ, শহরের গরীবের ঘরের অনেক জন্ম-মৃত্যুর কোন হদিস থাকে না তাছাড়া গ্রামে যেখানে বিনা চিকিৎসায় প্রতিদিন বহু মৃত্যু ঘটে তাহার কোন তথ্যও পাওয়া যায় না। তবুও উপরের তথ্য হইতে এই নিষ্ঠুর সত্য বাহির হইয়া আসে যে, আজ পূর্ববঙ্গে জন্ম হইতে মৃত্যুর হার অধিক। আজ জাতি তিলে তিলে ক্ষয়প্রাপ্ত হইতেছে।৩
সাধারণভাবে পূর্ব বাংলার জনগণের অর্থনৈতিক দুরবস্থার এই বর্ণনা দেওয়ার পর যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ তাঁর রিপোর্টে বেকারত্ব সম্পর্কে বলেন, পূর্ব বঙ্গের যুব সমাজের আর একটি প্রধান সমস্যা হইল বেকারী। বেকারী যে কি ভয়াবহ রূপ ধারণ করিয়াছে নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি তাহার প্রমাণ। পাকিস্তান অবজার্ভারে কিছুদিন আগে নীচের খবর দুইটি প্রকাশিত হয়েছিল।
(ক) বরিশালে ১০০টি* কনস্টেবল পদের প্রার্থী হইয়াছিল ৮০০০ যুবক।
(খ) চট্টগ্রাম ডকে ৫টি টালি ক্লার্কের পদের জন্য প্রার্থী হইয়াছিলেন ১৫০ জন। স্টালি ক্লার্কের পদের যোগ্যতার মাপকাঠি ছিল ম্যাট্রিক পাস। কিন্তু ঐ ১৫০ জন প্রার্থীর ভিতর কয়েকজন ছিলেন বি,এ, এবং এম, এ পাস যুবক।
কিছুদিন আগে ঢাকায় সরকারী দপ্তরে তিনটি সাধারণ চাকুরীর পদ খালি হয়। ইহার জন্য প্রার্থী হইয়াছিলেন হাজারের উপর যুবক।
ঢাকা শহরের দক্ষিণ মৈশুন্ডী মহল্লার আমাদের কর্মীদের নিকট হইতে জানা যায় যে, তাঁহাদের মহল্লার গরীবদের ভিতর ২৩ জন ম্যাট্রিক পাস যুবকের ভিতরে উপার্জনের পথ পাইয়াছেন মাত্র ৫ জন। বাকি ২৮ জন বেকার ও আধা বেকার। এই সব ঘটনার উপর কোন মন্তব্যের প্রয়োজন নাই অনাহার দরিদ্র ও বেকারির জ্বালায় অস্থির হইয়া, সৎভাবে পরিশ্রম করে জীবন ধারণের কোন উপায় না পাইয়া আজ পূর্ববঙ্গের হাজার হাজার যুবক অসৎ পথে টাকা উপায় করিয়া বাঁচিবার পথ গ্রহণ করিতে বাধ্য হইতেছেন। পূর্ববঙ্গের সীমান্তবর্তী প্রতিটি জেলা হইয়াছে ভারতের সঙ্গে চোরাকারবারের ঘাঁটি। এই চোরাকারবারীরা যুব সমাজের বেকারীর সুযোগ নিয়া হাজার হাজার যুবককে তাহাদের চোরা আমদানী-রপ্তানীর প্রধান বাহক হিসেবে ব্যবহার করিতেছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সংকটের উপর রিপোর্টটিতে বলা হয়,
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে গলদ চলিতেছে তাহাতেও যুব সমাজের সামনে নানাবিধ সমস্যা উপস্থিত হইয়াছে। গত আই, এ পরীক্ষায় পাসের হার অত্যধিক কম হওয়াতে বহু ছেলে-মেয়ের আবার কলেজে পড়া বন্ধ হইয়া গিয়াছে। কারণ গরীব মা বাপের আজ ক্ষমতা নাই যে, একবার ছেলে মেয়ে ফেল করিলে আবার পয়সা খরচ করিয়া পড়াইতে পারেন। এই শোচনীয় অবস্থার জন্য দায়ী কে? প্রথম দায়ী এই অন্যায় সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যাহার চাপে অধিকাংশ মানুষ গরীব হইয়া থাকিতেছে। দ্বিতীয়তঃ অর্থনৈতিক দুরাবস্থার চাপে আজ বহু ছাত্র-ছাত্রীই সব পাঠ্যপুস্তক কিনিতে পারেন না। পরীক্ষার পড়াও তৈয়ার করিতে পারেন না। তৃতীয়তঃ অধিকাংশ স্কুল কলেজেই উপযুক্ত শিক্ষক নাই। যাহারা আছেন তাঁহাদেরও বেতন কম। কাজেই পড়াশোনা ভাল হয় না। চতুর্থতঃ অধিকাংশ পরীক্ষকের মতো ইংরেজী শিক্ষার মাধ্যম ছাত্রদের শিক্ষার অন্যতম অন্তরায়। এইসব কারণেই পরীক্ষার ফেলের হার অত্যধিক বাড়িয়াছে এবং অগণিত যুবক যুবতীর শিক্ষা কুষ্টিগত উন্নতির পথ রুদ্ধ হইয়া যাইতেছে।
অর্থনৈতিক দুরবস্থা হেতু কলেজে পড়া আজকাল বহু ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিতেছে এবং কোন কোন কলেজে ছাত্রের সংখ্যা কমিতেছে।… বিভিন্ন জেলার প্রাথমিক শিক্ষকদের দুর্দশাও চোখে দেখিয়াছি। রংপুর জেলার প্রাথমিক শিক্ষকগণ ৮ মাসের বেতন পান নাই। শুনা যায় যে, কর্তৃপক্ষ নাকি ডাকে চেক মারফত শিক্ষকদের মাহিনার টাকা পাঠাইয়াছিলেন। কিন্তু সেই চেক নাকি পোস্ট অফিসে উঁই পোকা কাটিয়াছে। কাজেই চেক অচল হইয়া গিয়াছে। শিক্ষকগণও অনাহারে দিন কাটাইতেছেন। অল্প মাহিনা ও অনিয়মিত মাহিনের জন্য বহু প্রাথমিক শিক্ষকই অন্যান্য কাজে লিপ্ত হইতে বাধ্য হন এবং ইহার দরুন সমগ্র প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাই ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে।
আবার প্রাপ্ত বয়স্ক নিরক্ষর যুবক-যুবতীদের শিক্ষিত করার কোন ব্যবস্থাই নাই বলিয়া কোটি কোটি যুবক-যুবতী অশিক্ষিত থাকিয়া যাইতেছেন। সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্টটিতে বলা হয়ঃ যুব সমাজ বিভিন্ন স্থানে নিজেদের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক ও দৈহিক চর্চার বা খেলাধুলার ক্লাব ও লাইব্রেরী বা প্রাপ্তবয়স্ক নিরক্ষরদের শিক্ষার জন্য নাইট স্কুল গড়িয়া তুলিতেছেন। অত্যন্ত আশার কথা। কিন্তু এগুলি সরকার হইতে কোন অর্থ সাহায্য পায় না। অর্থের অভাবের দরুন যুব সমাজের সাংস্কৃতিক, মানসিক ও দৈহিক উন্নতির জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় এইসব ক্লাব লাইব্রেরী ও নাইট স্কুলগুলি উন্নতি করিতে পারিতেছে না।
পূর্ব বাংলার শিক্ষিত যুব সমাজ নিজেদের সাংস্কৃতিক অগ্রগতির জন্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়িতেছেন, ইকবাল, রবীন্দ্র, নজরুল দিবস ও অন্যান্য বহু অনুষ্ঠানও করিয়াছেন। গত কয়েক মাসে বহু প্রগতিমূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হইয়াছে। ইহা তরুণ প্রাণের নতুন জাগরণের চিহ্ন এবং এই জাগরণে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক এবং ঢাকার লেখক ও শিল্পী মজলিস, তমদ্দুন মজলিস ও প্রগতিশীল উর্দু লেখকগণ ও আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সফল অবদান রহিয়াছে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যুব সমাজের এই নবজাগরণকে “কমিউনিস্টদের কারসাজি ও যুক্ত বাংলা গঠনের চক্রান্ত” বলিয়া কলঙ্কিত করিতে চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে, পূর্ব বাংলার যুবসমাজ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির এই হীন প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করিয়া দিবে।৬
ভাষা সমস্যা সম্পর্কে অলি আহাদ তাঁর রিপোর্টে বলেন,
মুসলিম লীগ সরকার জনমত পদ্দলিত করিয়াই চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণী হইতে বাধ্যতামূলকভাবে উর্দু ভাষা ও আরবী বর্ণমালা শিক্ষার ব্যবস্থা চালু করিতেছেন।ইহার ফল কি হইবে? দেশের ছেলেমেয়েদের কচি বয়স হইতেই শিখিতে হইবে চারটি ভাষা— বাংলা, উর্দু, আরবী ও ইংরেজী— চিনিতে হইবে

*[ এখানে পত্রিকায় শতকের ঘরের সংখ্যাটি অস্পষ্ট থাকায় ঠিক পড়া যায় না। যেটুকু পড়া যায় তাতে সংখ্যাটি ১ মনে হলেও, আসলে অনকিছু হওয়া সম্ভব। ব,উ,উ,]
চারটি বর্ণমালা। ইহাতে কচি মন ভারাক্রান্ত হইয়া পড়িবে এবং তাহাদের শিক্ষাও হইবে না। তদুপরি, একথা একটি বৈজ্ঞানিক সত্য যে, যদি জনসাধারণকে নিজের ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা না হয়, তাহা হইলে সেই জাতি কখনও শিক্ষিত হইতে পারে না। কাজেই আমাদের উপর উর্দু ভাষা আরবী হরফ চাপাইবার সরকারী সিদ্ধান্ত পূর্ব বাংলার যুব সমাজের তথা সমস্ত জাতির শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে বিপন্ন করিয়া তুলিতেছে। অথচ উর্দু ও বাংলা মিশ্রিত এক বিকৃত, জারজ ভাষার সৃষ্টি করার চেষ্টা হইতেছে। ঢাকা এবং করাচীতে একজন উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা এবং তাদের মোসাহেবরা জনসাধারণের অজস্র অর্থের অপব্যয় করিয়া এই “শঙ্কর” ভাষার প্রচলনে প্রচন্ড ব্যস্ত।
আজ আমাদের দারিদ্র্য, স্কুল কলেজে শিক্ষকের অভাব, স্কুলে কলেজে অর্থের অভাব, ক্লাব লাইব্রেরীগুলির অর্থের অভাব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির আক্রমণ ও আমাদের ভাষার উপর সরকারের আক্রমণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আনিয়াছে বিষম সংকট এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতির পথে সৃষ্টি করিতেছে বিষম বাধা। সেই সঙ্গে আমেরিকা হইতে আমদানীকৃত যৌন বিষয়ক অশ্লীল সাহিত্য বাজার ছাইয়া ফেলিতেছে। সিনেমায় সিনেমায় দেখান হইতেছে বিকৃত রুচিসম্পন্ন ছবি। এইভাবে যুব সমাজের তরুণ মনকে কলুষিত করিবার জঘন্য প্রচেষ্টা চলিতেছে। সরকারের পুলিশ বিভাগ প্রগতিশীল সাহিত্যের আমদানী ও প্রকাশ বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট কর্মতৎপরতা দেখায় বটে। কিন্তু আমেরিকার যৌন বিষয়ক অশ্লীল বইপত্র আমদানী বন্ধ করার কাজে সরকারের কোন প্রচেষ্টা নাই। সিনেমায় শিক্ষণীয় ছবি দেখানোর জন্য সরকার কোন উদ্যোগও নেন না।
উপরে বর্ণিত অবস্থা হইতে বুঝা যায় যে, ৯ মাস আগে আমাদের প্রথম সম্মেলনের সময়ে আমরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছিলাম, আমাদের সেই অর্থনৈতিক সমস্যা, জীবন ধারণের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সমস্যা, বেকারীর সমস্যা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংকট এবং আমাদের স্বাস্থ্যের সমস্যা যুব সমাজের এই প্রত্যেকটি সমস্যাই মুসলিম লীগ শাসনের অধীনে আরো জটিল হইয়া উঠিতেছে। পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুব লীগ বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ও ঘটনায় কি ভূমিকা পালন করেছে সে বিষয়ে অলি আহাদ তাঁর রিপোর্টে বিস্তারিতভাবে যা বলেন সেটা সাংগঠনিক দিক দিয়ে এবং সেই সঙ্গে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঠিক আগে পূর্ব বাংলার সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক শিক্ষক ধর্মঘটের সময় যুব লীগের ভূমিকা সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়,
আমাদের সম্মেলনের ঠিক পরেই শুরু হয় পূর্ব বাংলার প্রাথমিক শিক্ষকদের সাধারণ ধর্মঘট। প্রাথমিক শিক্ষকদের একটা বিরাট সংখ্যা যুবক এবং তাহাদের দূরবস্থার কথা আপনারা সবাই জানেন। এই রিপোর্টেও তাহা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের মূল সমস্যা হইল অত্যন্ত কম মাহিনা (মাসিক গড়ে বাধ্যতামূলক এলাকায় ৩৮।৪ পাই এবং অন্যান্য এলাকায় যথাক্রমে ২৫ টাকা তের আনা ৪ পাই ও ১৯।।) ও অনিয়মিত মাহিনা। ইহার বিরুদ্ধে মাহিনা বাড়ানো ও নিয়মিত মাহিনা পাওয়ার মূল দাবী নিয়া তাঁহারা ১৯৫১ সনের এপ্রিল হইতে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু করেন। প্রায় ২৫০০০ প্রাথমিক শিক্ষক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করিয়াছেন। পূর্ব বাংলার প্রত্যেকটি জেলায় বিভিন্ন স্থানে এই ধর্মঘট হয়। শিক্ষকদের এত বড় ব্যাপক ধর্মঘট পূর্ববঙ্গে আর হয় নাই। একমাত্র মুসলিম লীগ ছাড়া পূর্ববঙ্গের আর প্রায় সমস্ত দল ও গণপ্রতিষ্ঠান এই ধর্মঘটকে সমর্থন জানান। যুব লীগের প্রাদেশিক কার্যকর কমিটিও এই ধর্মঘটকে সমর্থন করেন এবং ফেনী, সিলেট, জামালপুর প্রভৃতি স্থানে যুব লীগের কর্মিগণ এই ধর্মঘটের সহানুভূতিতে সভা শোভাযাত্রা প্রভৃতির অনুষ্ঠান করেন।
সরকার এই ন্যায়সঙ্গত বৈধ ধর্মঘটের বিরুদ্ধে দমননীতি হুমকি দেখাইতে থাকেন ও রংপুরে ধর্মঘটের নেতাকে গ্রেফতার করেন। কিন্তু ধর্মঘট চলিতে থাকে ও দেড় মাস পরে প্রাথমিক শিক্ষকদের কোন কোন দাবী বিবেচনার ওয়াদা দিয়া সরকার শিক্ষকদের সংগঠনের সঙ্গে আপোষ করেন। কিন্তু সরকার পক্ষ হইতে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছিল, তাহার একটিও পালন করা হয় নাই।
প্রাথমিক শিক্ষকদের ধর্মঘট এর পরেই জুন মাস হইতে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মীদের ধর্মঘট শুরু হয়। তাহাদের ভেতরও একটা বিরাট সংখ্যা হইল যুবক। অত্যন্ত কম মাহিনার জন্য তাঁহাদের জীবনে যে সঙ্কট সৃষ্টি হইয়াছিল তাহার তাগিদে এই চাকরিজীবীগণ বহুদিন হইতেই সরকারের নিকট দরখাস্ত পেশ করিতেছিলেন কিন্তু সরকার সে-সব গ্রাহ্যের ভেতর আনেন না। তখন বাধ্য হইয়াই তাঁহারা নোটিশ দিয়া ধর্মঘট শুরু করেন। সরকার জরুরী আইন জারী করিয়া প্রথমেই এই বৈধ ধর্মঘটকে বেআইনী ঘোষণা করেন এবং সংবাদপত্রের উপর আদেশ দেন যাহাতে ধর্মঘটের কোন খবর কাগজে প্রকাশ করা না হয়। সরকার ধর্মঘটের নেতাদের গ্রেফতার করার জন্য হুলিয়াও জারী করেন। এই প্রচণ্ড দমননীতির সম্মুখীন হইয়াও ধর্মঘটিগণ ধর্মঘট চালাইয়া যাইতে থাকেন। ইতিমধ্যেই কাশ্মীর সমস্যা নিয়া দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহাতে ধর্মঘট চালান যুক্তিসঙ্গত নয় বলিয়া কর্মচারীগণ তাঁহাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করিয়া নেন।*
পাট চাষীদের অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়,
প্রতি বৎসরই যখন সাধারণ কৃষকগণ পাট বিক্রয় করেন তখন নানা চক্রান্ত করিয়া বড় বড় ব্যবসায়ীরা পাটের দর নামাইয়া দেয়। গত জুন-জুলাই মাসেও কাশ্মীর সমস্যা নিয়া যখন পাক-ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে তখন তাহারা সুযোগে পাটের বড় বড় ব্যবসায়ীগণ পাটের দর কমাইয়া দেয়। কেন্দ্রীয় সরকার পাটের নিম্নতম ন্যায্য মূল্য স্থির করিয়া দেন। ইহাতে কৃষক যুবসমাজ তথা সমস্ত কৃষক সমাজের সামনে এক বিষম বিপদ উপস্থিত হয়। এই পরিস্থিতিতে ঢাকার ‘পাট চাষী সমিতি’ চাষীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বহুস্থানে সভা প্রভৃতির দ্বারা যে আন্দোলন শুরু করেন যুব লীগ তাহাতে সমর্থন জানায় এবং সেই সমিতির ভিতর যুব লীগ কর্মীরা রহিয়াছেন।
যুব লীগের কার্যকরী সমিতি এক বিবৃতিতে দাবী করেন যে পাটের নিম্নতম দর ৪০ টাকায় ধার্য করা হোক— এই দাবী নিয়া আমাদের যুবলীগ সহ-সম্পাদক সিরাজগঞ্জে এক বিরাট সভা করেন।
সরকার আজও পূর্ববঙ্গের পাট চাষীদের ন্যায্য দাবী মানিয়া পাটের নিম্নতম দর স্থির করিয়া দেন নাই। এ বিষয়ে সরকারকে বাধ্য করিবার জন্য পূর্ববঙ্গের যুব শক্তিকে বিরাট আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হইবে। পাট আমাদের জাতীয় সম্পদ। এই জাতীয় সম্পদের ওপর মুষ্টিমেয় বিদেশী ও দেশী ধনীর একচেটিয়া একাধিপত্য আমরা সহ্য করিব না।৯
খুলনার দুর্ভিক্ষ এবং লবণ সংকটে যুব লীগের ভূমিকা সম্পর্কে অলি আহাদ বলেন,

*[ জাতীয় স্বার্থ রক্ষা, বৈদেশিক শত্রুর বিরোধিতা ইত্যাদির নামে প্রণীত বৈদেশিক নীতিকে বুর্জোয়ারা কৌশলের সঙ্গে সব সময়ই অভ্যন্তরীণ সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার কাজে ব্যবহার করে থাকে। শিক্ষক ধর্মঘট প্রত্যাহারের ব্যাপারটি এই ধরনেরই একটি উদাহরণ।— ব,উ,]

খুলনায় আজ দুর্ভিক্ষের যে তান্ডব লীলা চলিতেছে তাহার প্রথম সূত্রপাত হয় গত এপ্রিল মাসে। কিন্তু তখনও সরকার ইহাকে আমল দেন নাই এবং জনগণের সামনেও ইহার বীভৎসতা ধরা পড়ে নাই। গত মে মাস হইতে কোন কোন প্রতিষ্ঠান এই দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আগাইয়া আসেন। ঢাকার শিক্ষিত যুবক যুবতীদের অনেক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নানা অনুষ্ঠান করিয়া ‘খুলনা রিলিফের’ জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। যুব লীগও গত মে মাসে খুলনা রিলিফের জন্য অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করেন। সেদিন আমাদের কর্মীগণ ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া ৯৩ টাকা আদায় করেন। সে টাকা আমরা খুলনায় পাঠাইয়াছি কিন্তু, অত্যন্ত লজ্জার সহিত একথা আমরা স্বীকার করিতেছি যে ঐ সামান্য টাকা পাঠানো ছাড়া এতবড় বিপর্যয়ে খুলনার ভাই বোনদের আমরা কোন সাহায্য করিতে পারি নাই। আমাদের এই শোচনীয় ব্যর্থতা আজ দূর করা দরকার।….
পূর্ববঙ্গের লবণ দুর্ভিক্ষের কথা আপনারা সবাই জানেন। বাজার হইতে লবণ উধাও হওয়ার পর সারা পূর্ববঙ্গে এক বিরাট গণবিক্ষোভ সৃষ্টি হয়। বহু সভা, মিছিলের ভিতর দিয়া জনগণ একবাক্যে দাবী করেন, ‘সস্তা দরে লবণ দাও’। ঢাকায় যুব লীগের প্রাদেশিক সমিতি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় লবণ সমস্যার ওপর এক সভা করে। জামালপুর, সিলেট, ফেনী ও বরিশাল যুবলীগের কর্মীগণ সভা সমিতি করিয়া সস্তা দরে লবণ চাই আন্দোলন গড়িয়া তোলেন। এই উপলক্ষে আমরা দেখিয়েছি যে, কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ আজ ফ্যাসিস্ট সুলভ মনোভাব দেখাইতেছেন। লবণের দাবীর আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য যুব লীগের কর্মী জামালপুর কলেজের পাঁচজন ছাত্রের ওপর কলেজের কর্তৃপক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছিল।
ভাষা আন্দোলনে যুব লীগের ভূমিকা সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়,
নিজেদের ভাষাকে রক্ষা করার জন্যও পূর্ব বাংলার যুব সমাজ আগ্রহী হইয়াছেন। উর্দুকে একমাত্র জাতীয় ভাষা করা ও বাংলার ওপর আরবী হরফ চাপানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ একটি এ্যাকশন কমিটি গঠন করিয়াছেন। তাঁহারা সভা সমিতি করিয়া দাবী জানিয়েছেন যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হউক এবং আরবী হরফ চাপান চলিবে না। বহুস্থানে যুব সমাজ ও প্রগতিশীল অন্যান্য দল ও ব্যক্তিগণও এই দাবী নিয়া সভা-সমিতি করিয়াছেন। যুব লীগও এইসব দাবী সম্পূর্ণ সমর্থন করে এবং এই দাবীর আন্দোলনে ঢাকায় ও অন্যান্য স্থানে যুব লীগের কর্মিগণ সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছেন। এখানে ইহা জানাইতে চাই যে, আমাদের এই দাবী অন্য কোন ভাষার বিরুদ্ধে নয়। সমস্ত ভাষাই নিজ নিজ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হোক ইহাই আমরা চাই। আমরা ইহাও চাই যে, পূর্ববঙ্গে যে সব অবাঙ্গালী জনসাধারণ বাস করিতেছেন তাঁহাদের ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা হোক।
আমাদের দেশের জন্য আমাদের মূল দাবী হইল যে আমাদের ভাষাকে পদদলিত করা চলিবে না, আমাদের ভাষার পূর্ণ মর্যাদা আমরা চাই। ইহা আমাদের জাতীয় দাবী এবং এই দাবী আমরা হাসিল করিতে চাই। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে রিপোর্টটিতে বলা হয়ঃ
আজ দেশে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বাড়িয়া উঠিতেছে ও আমাদের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য যে আন্দোলন জাগিয়া উঠিয়াছে সেই সমস্ত আন্দোলনে সাহায্য করা, এ বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে সহযোগিতা করা এবং সংস্কৃতি ও ভাষার সমস্ত আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করা। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ‘লাল জুজুর’ ভয় দেখাইয়া ও বাঙালী অবাঙালী বিরোধ সৃষ্টি করিয়া এইসব আন্দোলনে যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করিতেছে তাঁহার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার সমস্ত যুব সমাজ ধর্ম জাতি নির্বিশেষে সমস্ত যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করুন।আমেরিকা হইতে অশ্লীল যৌন সাহিত্য আমদানী ও সিনেমায় বাজে ছবি দেখাইয়া আজ যুব সমাজের তরুণ মনকে কলুষিত করার যে অপচেষ্টা চালিতেছে তাহার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়ান। যদি আজ আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিপন্ন হইয়া পড়ে তাহা হইলে সমস্ত জাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হইয়া পড়িবে। তাই আজ সংস্কৃতি ও ভাষাকে অবলম্বন করিয়া পূর্ব বাংলার যুব সমাজের ভিতর প্রাণের যে নতুন স্পন্দন আসিয়াছে তাহাকে আগাইয়া নিয়ে যান, আমাদের সংস্কৃতি ও ভাষাকে মহান করিয়া তুলুন। ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য যুব লীগের আন্দোলন প্রসঙ্গে রিপোর্টটিতে যা বলা হয় বলা হয় তার মধ্যে ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলনের পূর্ব মুহূর্তে তৎকালীন সরকারের গণবিরোধী নীতি এবং নির্যাতনের একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়ঃ
গত নয় মাসের কাজের অভিজ্ঞতা হইতে আমরা ইহাও দেখেছি যে যুব সমাজের ন্যায়সঙ্গত বৈধ আন্দোলনগুলির ওপরও সরকার দমন নীতি চালাইতেছেন। মেডিকেল স্কুল ছাত্রদের, প্রাথমিক শিক্ষকদের ও সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মচারীদের ধর্মঘটের সময় ধর্মঘটী যুবকদের ওপর সরকারের দমন নীতির কথা পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। লবণের দাবীতে আন্দোলন করার অপরাধে জামালপুর কলেজের পাঁচজন ছাত্রের স্টাইপেন্ড নাকচ করার কথাও বলা হইয়াছে। এছাড়া গত ৯ মাসে আরও যে সব ঘটনা ঘটিয়াছে তাহাও আপনাদের সামনে পেশ করিতেছে।
গত ১৫ আগস্ট দিবসে সিলেটের জনগণের ওপর পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে বৈধ সভা করার অপরাধে সিলেট জেলা যুব লীগের সহকারী সভাপতি জনাব নুরুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক মোতসির আলী ও আবদুল বারীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ঐ জেলার প্রখ্যাত যুব নেতা জনাব হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পুলিশ হুলিয়া জারী করে। বরিশাল শহরে রিক্সা চালকদের বৈধ আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকারী কর্তৃপক্ষ বরিশাল যুব লীগের সম্পাদক জনাব আলী আশরাফ, রিক্সা ইউনিয়নের সম্পাদক শ্রী সুনীল বসু, মিউনিসিপ্যালিটির একজন যুবক কমিশনার প্রভাতিকে বরিশাল শহর হইতে বহিষ্কার করিয়াছেন। গাইবান্ধার যুব কর্মী জনাব আবু তাহের ও আওয়ামী লীগ সম্পাদক আবদুস সোবহানকে সরকার বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করিয়াছেন। কিশোরগঞ্জ যুব লীগের অফিসে ও যুব লীগ সম্পাদকের বাড়িতেও পুলিশ সম্প্রতি খানা তল্লাশী চালাইয়াছে। কর্তৃপক্ষের দমননীতিতে যে কি জঘন্য রূপ ধারণ করিয়াছে তাহার আরও একটি প্রমাণ দিতেছি। দুই মাস আগে সিলেট সরকারী কলেজের ম্যাগাজিনে জমিদার জোতদার পুঁজিপতিদিগকে সাবধান করিয়া দিল্লী কনভেনশনে কায়েদে আজম যে বাণী প্রচার করিয়াছিলেন তাহা উদ্বৃত্ত করা হইয়াছিল। কিন্তু যেহেতু কায়েদে আজমের বাণীতে ধনী ও চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে বলা হইয়াছিল সেইসেতু কর্তৃপক্ষ ইহা সহ্য করিলেন না। সরকারী কলেজের প্রিন্সিপ্যাল প্রথম সেই ম্যাগাজিনের প্রচলন বন্ধ করিয়া দেন। পরে কায়েদে আজমের সেই বাণীর ওপর সাদা কাগজ লাগাইয়া ম্যাগাজিন প্রচলন করা হয়। বর্তমান শাসক চক্রের দমন নীতির তাণ্ডবে পাকিস্তানে কায়দে আজমের বাণী জনসমক্ষে প্রচার করিবার অধিকারও আমাদের নাই। ইহা আরও প্রমাণ আমরা পাই যখন
দেখিবে, বর্তমান শাসক চক্রের স্বার্থের জন্য খাতুনে মিল্লাত মিস জিন্নার রেডিও বক্তৃতা হইতেও অংশ বিশেষ ছাটিয়া দেওয়া হয়। এই শাসকচক্রের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যই জনাব সোহরাওয়ার্দীর উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হইয়াছিল।এই শাসকচক্রের গদী টিকাইয়া রাখার জন্যই আজ পূর্ববঙ্গে নতুন করিয়া কুখ্যাত জননিরাপত্তা আইন জারী করা হইয়াছে। পূর্ববঙ্গের আওয়ামী লীগ, পূর্ববঙ্গ ব্যক্তি স্বাধীনতা লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি সঠিকভাবেই বলিয়াছেন যে, জনগণের নিরাপত্তার জন্য নয়, ‘বর্তমান শাসক চক্রের গদীর নিরাপত্তার জন্যই’ এই আইন পাশ করা হইয়াছে। তাঁহাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলাইয়া আমরাও বলিতে চাই, যে,বর্তমান শাসকচক্র নিজেদের গদি টিকাইয়া রাখা ও মুষ্টিমেয় ধনীর স্বার্থরক্ষার জন্য গত চার বছর যাবৎ যুব সমাজের ওপর দমননীতি চালাইতেছেন, বহু বিশিষ্ট যুব কর্মীকে তাঁহারা আটক করিয়া রাখিয়াছেন ও আটক করিতেছেন এবং তাঁহাদের স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা টিকাইয়া রাখার জন্যই তাঁহারা এই কুখ্যাত নিরাপত্তা আইন পাশ করিয়াছেন।
সরকার পক্ষ বলিয়া থাকেন যে ‘পাকিস্তান বিরোধী’ শক্তিগুলিকে দমন করার জন্যই তাঁহারা নিরাপত্তা আইন পাশ করিয়াছেন। কিন্তু পাকিস্তান বিরোধী কে? যাঁহারা আজ পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নতির জন্য কাজ করেন, আন্দোলন করেন, সংগঠন গড়েন তাঁহারা পাকিস্তান বিরোধী? না, যাঁহারা কায়েদে আযমের বাণী প্রচলন করিতে দেন না, যাঁহারা প্রাথমিক শিক্ষক, সরকারী চাকুরিয়া, শ্রমিক, রিক্সাচালক, রাজমিস্ত্রী, ছাত্র প্রভৃতি সমস্ত যুব সমাজের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অবনতি ঘটাইয়া দেন, তাঁহারা পাকিস্তান বিরোধী?
‘পাকিস্তান বিরোধী শক্তি দমন করার ভাঁওতার আড়ালে শাসকচক্র আজ যুব সমাজের সমস্ত ন্যায়সঙ্গত বৈধ আন্দোলন দমন করিতেছেন, আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা কাড়িয়া নিতেছেন। পূর্ব বাংলার যুব সমাজ ইহা সহ্য করিতে পারেন না। গত ৯ মাসে ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর সরকারের প্রত্যেকটি আক্রমণের বিরুদ্ধে যুব লীগ প্রতিবাদ জানাইয়াছে। যুব লীগের কর্মীরা আজ ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করিতেছেন এবং যুব লীগের সম্পাদক ও বরিশাল জেলা যুব লীগের সভাপতি যখন গত নবেম্বর মাসে বিভিন্ন জেলায় গিয়াছিলেন, তখন তাঁহারা গাইবান্ধা, রংপুর, বগুড়া, আক্কেলপুর, সিলেট, কুমিল্লা প্রভৃতি স্থানের জনসভায় ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ঢাকা শহরে পাট চাষীদের সহিত ও একটি শ্রমিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় যুব লীগ নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে একটি জনসভার অনুষ্ঠান করিয়াছে। বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠানও আজ নিরাপত্তা আইনের নাকচ ও সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তির দাবী নিযয়া আন্দোলন করিতেছে। ঢাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মিলিত উদ্যোগে একটি ব্যক্তি স্বাধীনতা লীগ গঠিত হইয়াছে। আমরা ইহাতে যোগদান করিয়াছি এবং ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা লীগ’ নিরাপত্তা আইনের নাওকচ ও সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তির মূল দাবী উত্থাপন করিয়াছি। আমরা আপনাদের নিকট ও পূর্ব বাংলা সমস্ত যুব সমাজের নিকট আবেদন করিতেছে যে, পূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা ও সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য প্রবল আন্দোলন গড়িয়া তুলুন।
এরপর রিপোর্টটিতে কাশ্মীর সমস্যা, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর হত্যাকাণ্ড এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের জনগণের ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণ সম্পর্কে কিছুটা বিবরণ দেওয়ার পর জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়।
রিপোর্টটির শেষে সাংগঠনিক কাজের হিসেব দিতে গিয়ে বলা হয়ঃ
পূর্ব বাংলায় গত ৯ মাসের যুব আন্দোলনের মধ্যে দিয়া আমরা দেখিয়াছি যে, বিভিন্ন প্রশ্নে যুব সমাজ নিজেদের অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য বিভিন্ন আন্দোলন করিয়াছে। যুব লীগ সাধ্যমত সেইসব আন্দোলনে সাহায্য করিয়াছে। কিন্তু একটি বিষয়ে আমাদের কাজের গলদ অত্যন্ত স্পষ্ট। তাহা হইল যে, আমরা যুব লীগের কর্মীগণ যুব সমাজের দৈনন্দিন সমস্যা নিয়া, যেমন বেকারীর সমস্যা, গরীব যুবকদের মঞ্জুরী বাড়ানোর প্রশ্ন, ছাত্রদের শিক্ষা বা বাসস্থানের সমস্যা, মেয়েদের শিক্ষার সমস্যা প্রভৃতি বিষয়গুলি নিয়া আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে বিশেষ চেষ্টা করি নাই। যুব সমাজের শরীর চর্চা, খেলাধুলা প্রভৃতির জন্য আন্দোলনও আমরা করি নাই।
যে সমস্ত প্রশ্ন বা সমস্যা সাধারণভাবে সময়ে সময়ে সারা দেশে বা যুব সমাজকে আলোড়িত করিয়া তুলিয়াছে আমরা সেই বিষয় নিয়া আন্দোলন করার ভিতরই আমাদের কর্মপ্রচেষ্টা সীমাবদ্ধ রাখিয়াছিলাম। আমাদের কাজের ধারার এই গলদ আজ দূর করা দরকার। এ কথা আজ আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, যুব সমাজের দৈনন্দিন সমস্যাগুলি নিয়া যদি আমরা আন্দোলন গড়িতে চেষ্টা না করি, যদি যুবক যুবতীদের প্রতিটি সমস্যায় যুবলীগ তাঁহাদের পাশে গিয়া না দাঁড়ায়, যদি তাঁহাদের প্রতিদিনকার আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাপার নিয়া যুব লীগ তাহাদিগকে সংগঠিত করিতে চেষ্টা না করে, যদি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও খেলাধূলা এর চারটি বিষয়েই আমাদের কাজের ধারা প্রবাহিত না হয় তাহা হইলে যুব লীগ কখনই ব্যাপক যুব সমাজের প্রতিনিধিত্বমূলক গণপ্রতিষ্ঠানরূপেই দাঁড়াইবে না।
এ কথাও সত্যি যে, যদিও যুব লীগ আজ জনপ্রিয়তা অর্জন করিতেছে তবুও আমাদের প্রতিষ্ঠান এখনও সমস্ত শ্রেনীর যুব সমাজের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান হয় নাই। আমাদের সংগঠন এখনও সারা পূর্ব বাংলার শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া পড়ে নাই। ঢাকা নগরীতে বিভিন্ন পাড়ায় এখনও আমাদের সংগঠন হয় নাই।
আমাদের সংগঠন নিম্নলিখিত স্থানে গঠিতঃ— বরিশাল জেলা যুব লীগ, বগুড়া শহর যুব লীগ, আক্কেলপুর (স্থানীয়) যুব লীগ, গাইবান্ধা মহকূমা যুব লীগ, কিশোরগঞ্জ মহকুমা যুব লীগ, সিলেট জেলা যুব লীগ, কুমিল্লা জেলা যুব লীগ, ফেনী মহকুমা যুব লীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যুব লীগ, রংপুর জেলা যুব লীগ, জগন্নাথ কলেজ যুব লীগ (ঢাকা), ময়মনসিংহ জেলা যুব লীগ, জামালপুর মহকুমা যুব লীগ।
উপরোক্ত তালিকা হইতে বুঝা যায় যে, মাত্র ৮টি জেলায় আমাদের সংগঠন গড়িয়া উঠিয়াছে। রাজশাহী,দিনাজপুর, পাবনা, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও চট্টগ্রাম জেলায় আমাদের সংগঠন এখনও গড়িয়া ওঠে নাই। যেসব স্থানে সংগঠন আছে, সেগুলিও এখনও মজবুত নয়। সংগঠনের কাজ মাত্র শুরু হইয়াছে। সেই জন্যই আমাদের সভ্য সংখ্যাও খুব কম। সংগঠনের আরও একটি গুরুতর দুর্বলতা যে আমাদের পরিধি এখনও প্রধানতঃ ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। শহরের গরীব, শ্রমিক ও কৃষক যুবকদের ভিতর আমাদের সংগঠন গড়িয়া উঠে নাই। মেয়েদের ভিতরেও আমরা কাজ করিতে পারি নাই।
এইসব সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণগুলি উল্লেখ করতে গিয়ে রিপোর্টে বলা হয়ঃ আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারন কি? পূর্ব বাংলার যুব সমাজ কি যুব লীগের কর্মপন্থায় সাড়া দেয় না? না, তাহা নয়। আমাদের ‘ঘোষণা’ যেখানে পৌঁছিয়াছে সেখানেই যুব সমাজ সাড়া দিয়াছে।
কিন্তু আমরা যুব লীগের কর্মীগণ আজও সেই ‘ঘোষণার’ বাণী ব্যাপকভাবে যুব সমাজের ভিতর প্রচার করি নাই। আমরা আজও সেই কর্মপন্থা নিয়া পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়, গ্রামে গ্রামে যুব সমাজকে সংগঠিত করার জন্য ব্যাপক চেষ্টা করিতে পারিতেছি না। আমাদের এই মূল ত্রুটির জন্যই যুব লীগের সংগঠন এখনও মজবুত হয় নাই।
সংগঠন গড়ার কাজে আমাদের আরও সমস্যা আছে। আমাদের কমিটিগুলি সমষ্টিগতভাবে কাজ করিতেছে না। জেলা ওয়ার্কিং কমিটি হইতে শুরু করিয়া স্থানীয় কমিটি পর্যন্ত কোন কমিটিরই নিয়মিত বৈঠক হয় না। গত ৯ মাসে প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হইয়াছে ৮টি এবং দুঃখের বিষয় ওয়ার্কিং কমিটির সমস্ত সভ্যগণও সমস্ত বৈঠকে উপস্থিত হন নাই। জেলা এবং স্থানীয় কমিটিগুলিতেও এইসব সমস্যা রহিয়াছে। তবে ইহাও সত্য যে, আমাদের ভিতর বহু কর্মীর কাজে প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক আর্থিক সমস্যা প্রভৃতির জন্য যথেষ্ট কাজ করিতে পারিতেছেন না। কাজেই, এইসব সমস্যা সমাধানের পথ বাহির করিয়া আজ আমাদের কর্তব্য হইবে যুব লীগের একজন আত্নত্যাগী কর্মী গঠন করিয়া তোলা। এ কথাও আমরা জানি এবং গৌরবের সঙ্গেই ঘোষণা করিতে পারি যে, যুব লীগের ভিতর পূর্ব বাংলার সমাজের আত্নত্যাগী অগ্রণী অংশের একটি বিরাট সংখ্যার সমাবেশ হইয়াছে। আমাদের এই অধিবেশনই তাহার জীবন্ত প্রমাণ। নানা দুঃখ কষ্ট, প্রতিবন্ধক, দমননীতি অগ্রাহ্য করিয়াই আপনারা যুব সমাজের স্বার্থের জন্য যুব লীগ গঠনে অগ্রসর হইয়াছেন। আপনারা আপনাদের কর্মশক্তি দ্বারা যুব লীগকে মজবুত করিয়া তুলুন এবং যুব সমাজের ভিতর হইতে আরও নতুন নতুন কর্মী সংগ্রহ করিয়া আসুন।
আমাদের কাজের আর একটি সমস্যা হইল অর্থের অভাব। প্রতিষ্ঠানের সভ্য ও সমর্থকদের চাঁদাই আমাদের একমাত্র আয়ের পথ। স্বভাবতঃই তাহার পরিমাণ যথেষ্ট নয়। অর্থের অভাবের জন্য উপযুক্ত প্রচার, বিভিন্ন জেলায় আমাদের যাওয়া-আসা, এমনকি সময় প্রাদেশিক অফিসের দৈনিক কাজ চালানো পর্যন্ত অসম্ভব হইয়া উঠে। আমাদের সভ্য ও সমর্থকদের সংখ্যা আরও বহু পরিমাণে বাড়াইয়া এবং তাঁহাদের নিকট হইতে রীতিমতো চাঁদা আদায় করিয়াই আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারি।১৬*৷

** পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের বার্ষিক সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদের রিপোর্ট ওপরে বিস্তারিতভাবে উদ্বৃত করার কারণ প্রথমতঃ এই দলিলটিতে ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পূর্বকালের সামগ্রিক পরিস্থিতির একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় সাংগঠনিক দিক দিয়ে যুব লীগের ভূমিকাই ছিলো অন্যসব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অথবা ছাত্র সংগঠনের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়তঃ ১৯৫১ সালে যুব লীগের সাধারন সম্পাদক থাকা কালে অলি আহাদ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলেন। সেজন্য তিনি উপরোক্ত যে রিপোর্টটি পেশ করেন তাঁর খসড়া তৈরির ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিলো।— ব, উ।

বদরুদ্দীন উমরের এই প্রবন্ধে লেখকের নির্দেশিত ‘তথ্যনির্দেশ’ মুদ্রণজনিত অসুবিধার জন্য ছাপা সম্ভব হলো না। লেখকের প্রকাশিতব্য পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (তৃতীয় খন্ড) গ্রন্থে এই আগ্রহী পাঠকরা প্রবন্ধের তথ্যনির্দেশ পাবেন।

সম্পাদক

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1983-bichitra.pdf” title=”1983 bichitra”]