You dont have javascript enabled! Please enable it! 1977.09.09 | মনের ছায়া, মতের ছবি | সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ - সংগ্রামের নোটবুক

মনের ছায়া, মতের ছবি | সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭

আন্তরিকতা দিয়েই সম্ভবতঃ পরাভূত করেছিল সঙ্কোচকে। পরাভূত’ – করে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে একজন তরুণ পাঠক, ঐ যে আমি আমার পিতার কথা লিখেছিলাম গত বছরের ঈদ সংখ্যায়, তার সবটাই কি সত্য ? যখন শুনলো, না, তাতে মিথ্যা নেই, বিবরণ সত্যই, তখন হাসল মিষ্টি করে। জানি না সে-হাসির অর্থ কি, জানি না সে বিশ্বাস করলে কি করলো না। কিন্তু আমার পিতা করতেন না, তিনি একেবারেই বিশ্বাস করতেন না। পত্র-পত্রিকার লেখালেখিকে। কবিতা বলো, গল্প-উপন্যাস বলো সমস্ত কিছু, আকাশকুসম, ফিকশন এসব, কল্পনার বাতাস দিয়ে ঠাসা। এমনকি যাকে বলে আর্টিকেল, যার মধ্যে তথ্যের ভোজবাজি দেখানো হয়, স্ট্যাটিস বিসের নানাবিধ কারসাজি পাবে তুমি যেখানে-সেখানেও সত্য নেই, যা আছে সে হল সত্য-গোগনের উদ্দেশ্যপূর্ণ তৎপরতা। টোকা দিয়ে দেখ, ফাঁকা সমস্ত কিছু। বড় জোর সাজিয়ে তোলা, গুছিয়ে-রাখা পুতুল নানাবিধ। পুতুলখেলা।
তবে সেই গল্পটা মিথ্যা ছিল না, পুতুলখেলাও ছিল না বোধ করি, যে-গল্প আমি একদা লিখেছিলাম, কল্পনা দিয়েই, কল্পনা করেই। তাতে খেলা-খেলা ভাব ছিল ঠিকই, খেলতে খেলতেই লেখা যেন। একজোড়া স্যাণ্ডেল নিয়ে গল্প। আই, এ, পরীক্ষার পরের প্রশস্ত অবকাশে ছাপানো পত্রিকা বের করেছিলাম আমরা কয়েক বন্ধুতে মিলে। আগে হাতে-লেখা পত্রিকা ছিল একটা, দু’টো বাঁশের সাহায্যে মাঠে টানানো হতো বলে নাম দেওয়া হয়েছিল, বাঁশ-পত্রিকা। আমাদের পরীক্ষা-পরবর্তী অবকাশে পত্রি কাটি বাঁশ ছেড়ে হাতে উঠে এল, হাতের লেখা ছেড়ে ছাপার অক্ষরে সজ্জিত হল সে। তার মধ্যেই গল্প ছাপা হয়েছিল আমার, একজোড়া স্যাণ্ডেলের গল্প। নিম্নমধ্যবিত্ত, আপিস-করা ভদ্রলোক রবিবার সকালে স্যান্ডেল নিয়ে গেছেন মোড়ের মুচির কাছে। খবরের কাগজে জড়িয়ে। চেনাজানা মুচি, টেনেটুনে দেখে হাসল, হেসে বলল, এ আর কি সারাবেন হুজুর, ফেলে দিন, একজোড়া নতুন কিনে নিন। ফেলে দেননি তিনি, আবার জড়িয়ে নিয়েছেন কাগজে। কিন্তু দেখেন কাঁপছে তাঁর শরীর। দেখেন উউজ্জ্বল সকালের সমস্ত আলো, চারপাশের গরীয়ান ব্যস্ততার সবটা কোলাহল একেবারে মিথ্যা হয়ে গেছে তাঁর জন্য। শুধু, একটা হাসি জলজল করছে সেই অন্ধকারে, মুচির হাসি-তাচ্ছিল্যের। সব ধনি মিলে, কেন্দ্রীভূত হয়ে, একটা শব্দ বাজছে শুধু কানে। কোন দাম নেই তোমার। কোন দাম নেই। আমীর হোসেন, তুমি মুল্যহীন। পরিত্যাজ্য।—এই অনুভবটিকেই বিস্তৃত করে, আরো কিছু গার্হস্থ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে আরো বেশি অবর্জনীয় করে তোলা হয়েছিল গল্পে। পত্রিকার ফেরিওয়ালাও আমরাই। আমরাই গছিয়ে দিচ্ছিলাম বাসায় বাসায় যেয়ে। এক বাসায় বয়স্ক এক ভদ্রলোক বললেন তিনি পেয়েছেন ঐ পত্রিকা পড়েছেনও। তারপর এককপি চেয়ে নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমার গল্পের কাছে এসে বললেন, কে লিখেছে এই গল্প ? তাঁর প্রশ্নের মধ্যে একটা আকস্মিকতা ছিল, ভঙ্গিতে এক ধরনের উগ্রতা, আমি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। মনে পড়ে। কিন্তু তিনি আক্রমণ করলেন না। বরঞ্চ বললেন আমাকে, ঠিক লিখেছ, সত্য গল্প লিখেছ, নিম্নমধ্যবিত্তের ট্র্যাজে ডিকে সামনে টেনে এনেছ তুমি। ঠিকই, ম্যালেরিয়া রোগীর মতই এ জীবন, কাঁপে, শুধু, কাঁপে।
(ঐ উপমাটা গল্পেরই ) ‘ আরো কথা ছিল তাঁর। সাহিত্যের সত্যবিষয়ক। সব কথা মনে নেই। বোধ করি শুনিওনি ঠিক মত। আমার কানে বেজেছে শুধু একটা কথা, – শুধু, একটা ধবনি (যেমন বেজেছিল আমার গল্পের নায়কের কানে)। নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের একটি সাধারণ সত্যকে উন্মােচিত করেছি আমি। তার মানে এ গল্প শুধু আমীর হোসেনের নয়, এ গল্প আমার পিতারও। এবং তখন অন্য কোন অনুভব নয়—উল্লাস নয়, আনন্দ নয়, সন্ত্রাস নয়, অনুশোচনাও নয়,—শুধু সঙ্কোচ জেগেছে মনে। আমার সমস্ত লেখাই – আমার পিতা পড়েন, যদি পড়ে হাতের কাছে একজন আত্ননিয়োজিত সেন্সর তিনি, ছেলের মতিগতি তাঁর নখদর্পণে। এই গল্প পড়ে তাঁর কি মনে হয়েছে যে তাঁকে নিয়েই লিখেছি আমি , এ কি তাঁর জীবনের সার্থকতার মূল্যায়ন—আমার কাছে ? আমার চোখে তাঁকে দেখা? ঐটুকু কি মূল্য তাঁর ? ছেড়া, পরিত্যাজ্য, একদা-বহ-ব্যবহৃত বর্তমানে একেবারে অকেজো একজোড়া স্যান্ডেলের মত ? কোন দাম নেই তাঁর ? আমার কাছেও ? প্রশ্ন নয়, সন্দেহ। আশঙ্কা। এবং সেই সন্দেহ, সেই আশঙ্কা গভীর এক সঙ্কোচের সৃষ্টি করেছিল, আমার মনে পড়ে। অনেকদিন আমি ভাল করে তাকাতেই পারিনি আমার পিতার দিকে। ভাবনা হয়েছে তিনি কি ভাবছেন তাই নিয়ে। আমি কি বলবো তাঁকে, আব্বা, এ গল্পে আপনি নেই। এ আজগুবী কল্পনা, এ হল পুতুল খেলা। কিন্তু তিনি তো আছেন, আমার অজান্তেই, সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে, তিনি এসে গেছেন। আমার পিতার বয়েসী ঐ ভদ্রলোক চিনেছেন যেমন করে নায়ককে, নিজেকে দেখেছেন গল্পে, আমার পিতাও নিশ্চয়ই দেখেছেন তেমনি—নিজেকে। তারপর যখনই আমি কোন গল্প লিখতে চেষ্টা করেছি এই একই সঙ্কোচ জড়িয়ে ধরেছে আমাকে, নিষেধ করেছে। বলেছে, ঠিক হচ্ছে না কাজটা। আমি দেখেছি পরিচিত মানুষেরা এসে পাচ্ছেন গল্পে, আত্মীয় কেউ, স্বজন আমার, কেউ বা বন্ধু। তাদের জীবনের ঘটনা দুর্ঘটনাই যেন সর্বসমক্ষে উন্মােচিত করতে বসেছি আমি। সত্যপ্রদর্শনের নামে অর্পিত বিশ্বাসকে হত্যা করছি, সত্য উন্মােচনের ছদ্মবেশে কাজ করছি হৃদয়হীনের। ঠিক হচ্ছে না, কাজটা। আমার মন বলেছে। আমি লিখতে পারিনি লিখতে-চাওয়া গল্প। এই সঙ্কোচকে কি নাম দেব আমি? বলবো কি এ হচ্ছে অক্ষমের অজুহাত, ব্যর্থতাবোধেরই করণ আচ্ছাদন ? না কি বলবো এটা হল গিয়ে নিরুপায় কাপুরুষের বিবেকবান হওয়া, সত্যকে দেখতে যে ভয় পায় সে বলছে সত্য লুকানো, থাকাই শ্রেয়। এই দুই বিবরণের কোনটাই হয়ত অসত্য নয়। যদি কথাসাহিত্যিক ক্ষমতা থাকত যথার্থ তবে সেই ক্ষমতা, কোন অজুহাতই শুনতো না, লিখিয়ে নিত, জোর করে, যা লেখাবার। হয়ত আমি কাপুরুষই একজন, সাহস নেই, দেখব নিরাবরণ সত্যকে ; তার হৃদয়বানর, সঙ্কোচের পর্দা খাড়া করছি সত্যের সামনে, আলোককে করছি অন্ধকারাচ্ছন্ন।
তাই হবে। তা হোক। নিম্নমধ্যবিত্তের নির্মম ট্রাজেডিসমূহকে উন্মােচিত করলে ব্যক্তিগত লাভ হয়ত বা হোত, কিন্তু সমষ্টিগত লাভের কোন সম্ভাবনা ছিল ভাবলে উচ্চ আত্মবিশ্বাসের পরিচয় দেওয়া হবে। বাংলা কথাসাহিত্যে অভাব আর যে কিছুরই হোক নিম্নমধ্যবিত্তের কণ্ঠাগত প্রাণের ক্ষীণ স্পন্দনচিএের অভাব মোটেই হয়নি। কিন্তু তাতে সামাজিক অগ্রগতির সহায়তা হয়েছে এমন কথা বলবো কোন ভরসায় ? সত্য শুধু, করুণ দারিদ্র্যই নয়, সত্য তো দারিদ্র-মন্ডির ব্যগ্ৰ-ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষাও ; সত্য শুধু, কানাগলিই নয়, সত্য কানাগলির বাসিন্দাদের উদার আকালপ্রীতিও। কিন্তু সেই মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, ‘সেই আকালপ্রীতির বাস্তবতা সাহিত্যে আসেনি। আনা হয়নি। সেটা ভিন্ন কথা। আমার কথা মোহ। যাকে সঙ্কোচ বলছি তার সম্পর্কে প্রধান সত্য হচ্ছে এক ধরনের মোহ। আমার আত্মীয়কে, স্বজনকে, পিতাকে আমি সমস্ত পৃথিবীর করুণাদৃষ্টির সামনে এনে দাঁড় করাবো, অধোবদন ; এ কাজ আমার সাধ্যে নেই। আমি মোহে পড়েছি। ভালোবাসায় নয়, মোহে। আমি পথিবীকে দেখি এক দৃষ্টিতে, এবং আমার আত্মীয়কে, স্বজনকে, পিতাকে আরেক দৃষ্টিতে। এক দৃষ্টি নিরাসক্ত, আরেক দৃষ্টি মোহাচ্ছন্ন। পরস্পরবিরুদ্ধে তারা।
জীবনের সত্য থেকে পলায়নভিন্ন নিম্নমধ্যবিত্তের উপায় নেই। সত্য তার শতপক্ষ। এই পলায়নের ব্যগ্রতায়, তৎপরতায় অবাস্তব চলচ্চিত্র, ভীষণ জনপ্রিয় হয়, আধ্যাত্মিকতার বহুবিধ উর্শনাভ সতত উৎপাদিত হতে থাকে। এর তাড়নায় লোকে স্বপ্ন দেখে, প্রেমে পড়ে, কবিতা লেখে। নেশা, নানাবিধ নেশা করে লোকে। এবং কেউ কাউকে নেশাখোর বলে না, পাছে প্রত্যেকের নেশাগ্রস্ততাটা বিকটভাবে বেরিয়ে আসে। মোহ এখানেও আছে। নেশার প্রতি মোহ। কিন্তু মোহ আছে প্রধানতঃ নিজের সম্পর্কে এবং নিজেকে জড়িয়ে যারা নিজের আত্মীয়-স্বজন, আপনজন, মোহ তাদের সম্পর্কেও। মোহ আমার পিতারও ছিল। আমার পিতা গড়েছেন, হিংস্র পরিবেশের বিরুদ্ধেতার বিরুদ্ধে। আপনজন ছিল না কেউ, পিতা-মাতা তাঁর উভয়ে ইহলোক ত্যাগ করেছেন তাঁর অল্প বয়সে, একমাত্র ভাই ছেড়ে চলে গেলেন এর কিছু পরে ; তবু, তিনি লড়েছেন, একাই, অকুতোভয়ে। সেই সংগ্রামশীলতার স্তরে স্তরে জগৎ সম্পর্কে তার মোহনতি ঘটেছে–ক্রমান্বয়ে। তীব্র থেকে তীব্রতর গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে অবিশ্বাস। বিশ্ব-সংসার, জগৎ-চরাচর যে দুবৃওদেরই নন্দনকানন সেই বোধ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে। দৃষ্টির রঞ্জনরশ্মি মানুষের আপাত-শুভেচ্ছায় অস্থি-মাংস ভেদ করে ভেতরে চলে গেছে। স্বার্থপরতার গোপন অভিসন্ধিকে লুক্কায়িত দেখেছেন অভ্যন্তরে। একে বলা যায় সিনিমিজম। সিনিমিজমে সৌখিনতা থাকে, থাকতে পারে। আমার এক বন্ধু, হিল, বাল্যব, কৈশোরে সে বলতো, সিনিক কবিতা লিখবে। সেটা ফ্যাশন ছিল সে-সময়ে। প্যান্টের ঘেরের উঠতি পড়তির মত, ব্লাউজের হাতার দিগবিদিকের মত। আমার পিতার সিনিমিজম। সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত, আত্মরক্ষায় প্রয়োজনে অবলম্বিত। জীবন শিখিয়েছে তাঁকে অবিশ্বাসী হতে। আত্মরক্ষায় আবশ্যকতা বলেছে, অপরকে-হেয় করার উচ্চমন্যতাকে অবলম্বন কর। নিম্নমধ্যবিত্ত যে পরচর্চা করে সে তো সাধে নয়, তার সমস্যা আছে সময়-কাটানোয় এবং তারো চেয়ে বড় কড়া কথা, অপরিহার্য আবশ্যকতা অপরকে সামান্য প্রমাণ করে নিজের অসামান্যতাকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলাল। গরজ বড় বালাই। কিন্তু এই যে সিনিসিজম, এই যে সমস্ত পৃথিবীকে প্রতারক হিসাবে দেখা, মানুষকে দেখা জন্তু-জানোয়ার, কুকুর-গেরিলা, সৃগাল-বানর, কাক ঘুঘু হিসাবে এর মধ্যেও সৃজনসক্ষম কোন দার্শনিকতা নেই। এ নিতান্ত পীড়িত-জনের অত্যন্ত বেশি বিদ্বেষ-প্রসুত মনোভঙ্গি। ব্যক্তিগত, সমষ্টি নয়। বরঞ্চ বলা যায় ব্যক্তির পক্ষে এ এক দুর্ভেদ্য দেওয়াল, সমাজের বিরুদ্ধে। এর পুজি সামান্য এবং যেটকু আছে তাও সম্পূর্ণ অসামাজিক। তাই এ যে বিধ্বস্ত করবে সমাজব্যবস্থা, অথবা উদ্ভাবিত করবে কোন দার্শনিক-কাঠামো এমন সম্ভাবনা আদপেই নেই। থাকলে দেশে আরো অনেক বড় কিছু ঘটত। এই অবিশ্বাসে কোন বৈজ্ঞানিক প্রতিশ্রুতি দেখি না, এতে আছে সন্দেহ, কিন্তু নেই সংশয়।
তাই বলে কি মানুষের মহত্তেৰ, ভক্তিতে, শ্রদ্ধায়, সম্মানে, সততায় এ বিশ্বাস করতেন না আমার পিতা ? অবশ্যই করতেন। যে সমস্ত মহৎ গুণাবলী থাকলে মানুষ মানুষ হয় সেগুলো আছে বৈকি। কোথায় আছে, কোন ঠিকানায় ? আবার কোথায়, আছে তাঁর পরিবারমধ্যে আছে তার ছেলে-মেয়েতে, আছে অত্যন্ত আপজনে, আছে তাঁর নিজের মধ্যে। আপনি ভালো তো জগৎ ভালো~-এ তাঁর জীবনদর্শন নয়। আপনি অবশ্যি ভালো, এবং জগৎ অতিঅবশ্যি খারাপ। তুমি ভালো বলে জগৎ ভালো হবে । কক্ষণো নয়, জগৎ তো পশু একটা, বিকট দেহ, হীন স্বভাব। কিন্তু তবু তুমি ভালো, কেননা তুমি আমার পরিবারের। তুমি আমার আপনজন। অবিশ্বাসের পাশাপাশি আছে এই বিশ্বাস। মোহহীনতার সঙ্গে সঙ্গে, অত্যন্ত কাছাকাছি এই মোহ। দুই প্রবাহের দ্বৈতশাসন একই মনে। এর ফলে আমরা, উত্তরাধিকারীরা মোটেই সামাজিক হতে পারিনি কখনো, সহজভাবে খোলামেলা মিশতে পারিনি অপরের সঙ্গে। সাড়াশীর দুই পায়ের মত বিশ্বাস ও অবিশ্বাস আটকে রেখেছে, রেখেছে জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। অথবা বলা যায়, গ্যাস্ট্রিকের রোগীর পরিপাকক্রিয়ার অভ্যন্তরস্থিত খাদ্যের মত পৃথিবীকে, জগতের অভিজ্ঞতাকে, মানুষকে লানি দিয়ে বরণ করেছি। আমার পিতা তো একা নন। সকল পরিবারেই তিনি ছিলেন, তিনি আছেন। তাঁর শিক্ষা বিশিষ্ট নয়, সাধারণ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের, নিজ সম্পর্কে অত্যুচ্চ ধারণার এবং অপর সকলের সম্পর্কে অত্যন্ত হীন ধারণার অসমান দুই পায়ে ভর করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছি আমরা। সমাজের মধ্যে বিচিত্র এক অসামাজিকতার সৃষ্টি হচ্ছে, হয়ে আছে, চিরস্থায়ী হয়ে থাকতে চাইছে। অনু-পরমাণুতে মৌলিক থাকি, যৌগিক হই না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এই দ্বৈত তৎপরতা—এটাও এক ধরনের খেলা। কিন্তু আনন্দহীন সে, কৌতুকবিহীন। নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনে আনন্দহীনতার চাইতে বড় সত্য আর কি আছে ? কি হতে পারে ? মনের গলি বসবাসের। গলির চেয়ে কিছু কম নোংরা নয়। সেখানে নিষেধ আছে, বর্জন আছে, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস, অনেক কিছু আছে, আনন্দই শুধু নেই। সে জীবনে নাটক মানেই উৎকট অতিনাটক।। এমনকি নাটক যে দেখবো, মঞ্চের নাটক, তেমন- সুযোগও কত কম ছিল। আমাদের ছেলেবেলায়, যখন আমাদের নৈতিক ও দৈহিক রক্ষণাবেক্ষণের সম্সতটা দায়িত্ব অর্পিত ছিল পিতা-মাতার স্কন্ধে। মফস্বল শহরে সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য নাট্যাভিনয়ের আয়োজন ছিল কলেজে। সেই কলেজেই নাটকে, মনে আছে, নায়ক কী জানি কী ওষুধ খেয়েছে, খেয়ে তার এমন খিদে পেয়েছে যে, কিছুতেই আর তৃপ্তি হয় না। যা পায় তাই খায়। আরেকজন, প্রতিনায়ক সে। থেকে থেকে আসে, জড়িয়ে কথা বলে। সব কথা ভালো বোঝা যায় না, শুধু এইটুকু বোঝা যায় যে সে ‘সোমরস’ পান করেছে।
পরে আমরা কয়েকজন মিলে নিজেরা নিজেরা ঐ নাটকের অভিনয় করেছিলাম। নাটকের অন্য সবকিছু যেমন-তেমন খুব ঘটা করে ব্যবস্থা’ করা হয়েছিল ঐ খাওয়ার, যা পাচ্ছে তাই একজন, আরেকজন জাদু জড়িয়ে জড়িয়ে বলছে কোনমতে যে সে ‘সোমরস’ পান করেছে। বয়স্কদের কে একা যাচ্ছিলেন ঐ পথ দিয়ে সোমরসের আওয়াজ শুনে ধমকে দিলেন খুব কষে। সোমরস যে মদ তা আমাদের ধারণাতেই ছিল না। আমরা অল্পবয়সী অনুভব দিয়ে টেনে বার করে এনেছিলাম। আজ ভাবলে তাই মনে হয়। সত্য বোধ করি আপনা থেকেই এসে ধরা দিয়েছে। যেমন দিয়েছিল একজোড়া স্যাণ্ডেলের সেই গল্পে। তাই তো খাওয়া কোথায় পাওয়া যায় কি যায় না, যাবে কি যাবে না সে নিয়ে উদ্বেগে ও আহ্লাদে জীবন কাটে। তারপর খেতে বসে পাক কতটা খারাপ হয়েছে বা হয়নি তার আলোচনা, অতীতে কবে কোথায় ভালো খাওয়া পাওয়া গিয়েছিল তার সুখস্মৃতির রোমন্থন চলে। যেখানে রান্না হয় খাবারের সে-জায়গাটা অবজ্ঞা পায়। যারা পাক করে তারাও, সে হোক বাড়ির মেয়ে কি ভাড়া-করা পাচক। সাধাসাধি, কাড়াকাড়ি, ধাক্কাধাক্কি, কারো ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা, কারো গোগ্রাসে সাবাড় করায় লিপ্ত থাকা—সমস্ত কিছু মিলিয়ে পরিবেশটা হয়ে ওঠে সামন্তবাদী। পশুর সঙ্গে। তফাৎ থাকে না—আবার থাকেও। বেশি অপ্রয়োজনে খায় না। প্রয়োজনের বেশি খায় না, এবং তারা খাদ্যবিষয়ে সমালোচনাদিতে নিমগ্ন হয় বলেও জানা যায় না। সোমরসের কথা বলছিলাম। রস তো আছে। আছে তো ব্যস্ত রসানুর সন্ধান। নানাবিধ রস, আদি রস প্রধানতঃ। শুধু, আধ্যাত্মিক রস খোঁজেন এমন লোকও কম নয়। আমার পিতার বন্ধু, একজন, তাঁর পিতার রেখে যাওয়া ব্যবসায় লাটে তুলে দিয়েছেন আধ্যাত্মিক রসের সাধনায়। তাঁকে দেখলে আমার মনে হত, ইচ্ছার বিরুদ্ধেও প্রায়ই মনে হত, ভেতরে ভেতরে যেন হা করেই আছেন, যদি দু’য়েক ফোঁটা পড়ে রস জীবনবৃক্ষ থেকে। কিন্তু এটা একটু, চরম ব্যাপার। রসের ব্যাপারী রসের কাংগাল পথে-ঘাটে যেখানে চাইবো, পাবো দেখতে। কোন দুর্ভিক্ষ নেই কোথাও। . খাদ্যানুসন্ধানের মহাব্যস্ততা জানিয়ে দেয় এই কথা যে, জীবনের চাইতেও বড় হয়ে উঠেছে জীবন যাপনের উপকরণ। জীবন অত্যন্ত দীন, অত্যন্ত হীন। এই সামান্য জীবনকে নিয়ে আমি কি করব ? কেমন করে একে অর্থ পূর্ণ করে তুলবো? সবাই বলে, মানুষ হও। কিন্তু কাকে বলে মানুষ হওয়া ? ” আমার পিতার সঙ্গে আমার এমন বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল না যে, জিজ্ঞাসা করতে পারতাম ঐ প্রশ্ন। সম্পর্কটা ছিল সামন্তবাদী, অনেকটা প্রভু-ভৃত্যেরই, যদিও স্নেহ-ভালোবাসার কারণে তার রূঢ়তাটুকু আত্নপ্রকাশ করতে পারেনি সরাসরি। কিন্তু তবু অনুচ্চারিত প্রশ্নটা তত ছিল ঠিকই, মানুষ হওয়া কাকে বলে ? জবাব কি হতো তাও অজানা ছিল না। কেন? মানুষ হওয়া মানে আবার কি ? মানুষ হওয়া ? সচ্চরিত্র হওয়া, গুরুজনকে মান্য করা, ভক্তিশ্রদ্ধা করা, সৎপথে চলা, সাংসারিক দায়িত্বসমূহ যথোপযুক্ত রপে পালন করা, ধর্মকর্ম, রোজা-নামাজ ঠিকমত করে যাওয়া ! . এক কথায় যদি বলতে হয়, যদি প্রকাশ করতে হয় কোন সাধারণ নামে তবে বলা যায়, ধারণাটা ছিল সামন্তবাদী। সাংস্কৃতিক সান্তবাদের অবিসংবাদিত রাজত্ব ছিল মানুষের মনে। আমার পিতার যুগ, বাবু-মৌলভীর যুগ, অধিকাংশ ছিলো বাবু বাকি যাঁরা তাঁরা মৌলভী। ঐভাবে লেখা হত নাম তাঁদের। টাকা নয়, রক্তের রঙ্গ দেখে, রুপ দেখে, ধারাবাহিকতা অবলোকন করে মানুষের মর্যাদা নির্ণয়ের প্রথা ছিল সর্বজনস্বীকৃত। কে কোন বংশের, কে তরফ শ্রেণী, কেইবা প্রথম বিবাহের—এ সকল প্রশ্নের আলোচনা সম্পাদিত হতো প্রকৃত আবেগের সঙ্গে।
কিন্তু সাংস্কৃতিক সামন্তবাদ তো অমর, অজেয় কিছু নয়। তারও তো বিকাশ ও বিলয় আছে। সাংস্কৃতিক সামন্তবাদও ভাংছিল বৈকি। টাকা এসে যাচ্ছিল রক্তের জায়গায়, চাকুরি বড় হয়ে উঠেছিল বংশের তুলনায়। যে-পরিবার বিশুদ্ধ খান্দান অথচ আজ যার অর্থনৈতিক রবদবা জবজবা নেই সেখানে মেয়ে বিয়ে দিতে অথবা ছেলেকে বিয়ে করাতেও ভীষণ সঙ্কোচ করবেন অবস্থাপন্ন পিতা। অবস্থাপন্ন ঘরই বরঞ্চ খুজবেন, বংশসম্পন্ন ঘর। না -খুজে। বাল্যকালে বিয়ে করে বউ রেখে এসেছে গ্রামে, শহরে এসে পড়েছে যে সেটা গ্রাম্য শ্বশুরের টাকাতেই, এখন বড় চাকুরি পেয়েছে, আরো বড় হবে চাকুরিতে ভবিষ্যৎ জীবন—এখন দোজবর পাত্রে কন্যা-সমর্পণে অসস্মতি দেখা যায় না ভালো বংশের মানুষেরও। অত্যন্ত পরহেজগার পিতা, স্বভাবে বলি, আচরণে বলি, বলি পোশাক একেবারে নিখুত অধ্যাত্মবাদী, “তাঁর ছেলে, এমনকি মেয়েও, বিদেশে যেয়ে নানাবিধ ‘কদাচারে লিপ্ত হয়ে যদি শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেন বিদেশী পাত্রী অথবা পাত্রকে তবে সেই ছেলেকে অথবা মেয়েকে মেনে কি নিচ্ছেন না পিতা এবং মাতা ? তুলনায় যে ছেলেটি, অথবা মেয়েটি, দেশে আছে, করতে পারেনি তেমন কিছু,, সম্ভাবনা নেই করবে ভবিষ্যতে, ছাপোষা যে, নিতান্ত সাধারণ, আনে কোনমতে আর খায় কিন্তু যার স্বভাব-চরিত্র নিখুত, সচ্চরিত্র নিঃসন্দেহে, ভক্তিতেশ্রদ্ধায়, রোজায়-নামাজে আদর্শস্থানীয়, তুলনায় তার স্থানটি কোথায় ? ভাংছে, পুরাতন মানদণ্ড ভাংছে। যে টাকা দেয় তার পাপও ক্ষমাহ। দুধাল গরু যেটা তার লাথিটিও মিষ্টি। টাকার শাসন এসে গেছে। সামন্তবাদ ভাংছে। বিদেশ থেকে টাকা যে পাঠায় সে-ই শ্রেষ্ঠ, সেখানে সে যা ইচ্ছে করে, আমরা শুনছি না, আমরা শুনবো না। পৌরষ কোথায়, মানুষের ? নিঃসন্দেহে অর্থোপার্জনে। যে পারেনি করতে উপার্জন, সে অনুজ্জল, যতই পরহেজগার হোক তাকে নিয়ে বড়াই করা চলে না। যে পারে দিতে টাকা, অথবা মনে হয় পারবে দিতে তার খানা-পিনা, পোষাক-আষাক, আচার-ব্যবহার, ময়মুরব্বির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি যত খারাপই হোক না কেন পুষিয়ে যেতে পারে টাকার ওজনটা। জেয়াদা হলে।
এ ভালো কি মন্দ সে-বিচার এখানে আসছে না। আসছে যে সে, অনিবার্য যে সে এটাই বড় কথা। এমন লোক তো হামেশাই যায় দেখা যার গায়ের স্মার্টনেসটা ভঙ্গুর কাচের মত, যে-কোন মুহূর্তে পড়ে ভেংগে যেতে পারে, যায়ও অনেক সময়, যেয়ে পিতা-মাতার হাত-দেয় কেটে, সেই লোককে নিয়ে বড়াই করা চলে, চলছে পরিবারে। দেখো, দেখো এবং প্রশংসা করো। আমাদের যা আছে তোমাদের তা নেই। তা ভাংগুক, পুরাতন যাবে, আসবে নতুন, জীবনেরই ধারা এটা কিন্তু পুরাতন যাচ্ছে না চলে, নতুনও আসছে না সম্পূর্ণে-বিজয়ীর বেশে ! তাই . সামন্তবাদী মূল্যবোধ ও বুর্জোয়া ধ্যান-ধারণা সহ-অবস্থান করছে একই। পরিবারে। একই পরিবারে অনেক পরিবার, একই মানুষ অনেক মানুষ চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে। পরস্পরবিরুদ্ধে এরা এই গেজালো, কিন্তু এরা মরণপণ দ্বন্দে লিপ্ত নয়, একে চাইছে না নস্যাৎ করে দেবে অপরকে। বরঞ্চ এরা সমঝোতা করে চলে। আমাদের সংস্কৃতিতে সম্প্রীতির, সমঝোতার অতিউচ্চ জয়ধ্বনিসমূহের মূল্যবোধগত তাৎপর্য হচ্ছে সহ-অবস্থান ; আপাত-শান্ত কিন্তু ভেতরে ভেতরে অসন্তুষ্ট অথচ দ্বন্দ-ভীর, এক একান্নবর্তী পরিবার, বিভিন্ন অংশের মধ্যে যেখানে মিল যেমন আছে গরমিলও এমন কিছু কম নেই। বুর্জোয়া চিন্তাচেতনা সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে পারছে কেননা তার অর্থনৈতিক ভিত্তিটা এখনো সুসংগঠিত হয়নি। সামন্তবাদ উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে হটে যাচ্ছে, আরো যাবে, কিন্তু পুজিবাদ যে খুব তেজীয়ান হয়ে উঠবে তা সম্ভব হয়নি। এখানে পুজি স্বাধীন নয়। সাম্রাজ্যবাদের অধীন। টাকা যা আসার বিদেশ থেকে আসে। সামন্তবাদ ও ধ্যান-ধারণার সহ-অবস্থানের ফলে সংস্কৃতি না-হয়েছে ঘরের, না ঘাটের। জ্যামিতিবহির্ভূত চেহারা তার, কিন্ডত, কদাকার। তাই বলে কি বলা যাবে, আব্বা, যে আপনাদের যুগের সমস্ত কিছুই শেয় ছিল। ঐ যে ছেলেমেয়ে চলে যাচ্ছে, বিদেশে, ফিরে আসছে, এলেও থাকছে না, চাইছে না থাকতে, তার কারণটা কি? কারণটা স্পষ্ট, সে আপনাদের জীবনের দীনতা, তার সাংস্কৃতিক সামান্যত্য, তার নিদারুন আনন্দহীনতা। কি দিয়ে, কোন, আকর্ষণে উপযুক্ত ছেলেমেয়েকে আটক রাখবেন দেশে ? যে চলে গেছে, মোহে পড়েছে বিদেশের, বিয়ে করেছ সেখানে তাকে যে ডাকবেন ঘরে সে-ভাষা কি আপনাদের জানা আছে । আছে কি তাদের সঙ্গে সেই আদান-প্রদান, দেওয়া-নেওয়া, সহজ বন্ধুত্ব – যাতে যথার্থ যোগাযোগ সমভ্ব : অস্বীকার করে লাভ কি, তা নেই। হুকুম দিয়ে, ধমক দিয়ে, অথবা অভিমান করে, কিম্বা কেদে ফেলে ছেলেকে ফেরানো যাবে না, মেয়েকেও না, তাকে পীড়া দেওয়া যাবে হয়তোবা, হয়তো যাবে তাকে বিড়ম্বিত করা। চরমই চরমের জন্ম দেয়, আপনাদের জীবনের অত্যধিক গ্রাম্যতাই যে আপনাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে অত্যধিক আধুনিকতার জন্ম দিয়েছে তাতে কোন ভুল নেই।। * আপনাদের যুগেও কি অন্যায় ছিল না। লোকে ঠকায়নি লোককে, ভাই ভাইকে, একজনের স্ত্রীকে নিয়ে চলে যায়নি আরেকজনের স্বামী ; অসামাজিক জীবনযাপন করেনি অনেক সম্পন্ন মানুষ : বিয়ে করেনি একা_ধিক- এ যুগের ছেলেমেয়ে যদি সিগারেট খায় কেউ আপত্তি করেন আপনারা, কিন্তু আপনাদের আগের যুগের মহিলারাও কি হুকো খাননি, আমরা কি দেখিনি খেতে আপত্তি আসলে ধূমপানে নয়, আপত্তি ঔদ্ধত্য । হুকো চলতে পারে, তাতে ঔদ্ধত্য নেই, দবিনয় নেই, তাতে প্রথা-মেনেচলা আছে, আপত্তি সিগারেটে, কেননা সেটা উদ্ধত, বুর্জোয়া। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আপনার যুগেরই একজন প্রতিনিধি খুব সরাসরি বলেছিলেন। একটা কথা মাসিক পত্রিকায়-লেখা এক চিঠিতে। সরল চিঠি, সাধারণ খুব, এবং সেজন্যই বিশেষভাবে মূল্যবান প্রতিনিধিত্বমূল্যে দুঃখ করে তিনি লিখেছেন যে, “শিক্ষিত সমাজে ইংরেজ অনুকরণে হুক্কা ও তামাক ছাড়িয়া সিগার ও সিগারেটের ধূমোগার করা, আহারের সময় ফরশ স্হলে চেয়ার- টেবিল, হাতের পরিবর্তে কাটা চামচ ব্যবহা চাল, হয়েছে। আপনি ধূমপানে নয়, আপত্তি তো হুক্কা ও তামাক ছাড়িয়া সিগার ও সিগারেট ধরায় । চেয়ার-টেবিল বসার জন্য, লেখার কাজ, পড়ার প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে, যাবে না খাবার সময় ব্যবহার করা। যেমন ইংরেজী ভাষা নেয়া যাবে, ইংরেজদের মত ইংরেজী বলাটাকে চরম উন্নতির সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করা চলবে, কিন্তু সত আকাশ একমুহূর্তে ভেংগে পড়বে যদি কেউ পোষাক পরে ইংরেজ-ধরনের। সে একদিন গেছে। আজও চিঠি কেউ লিখবেন না। আজকের দিনে ইংরেজানুকরণে কোন সঙ্কোচ নেই, তার বিপক্ষে সবলতা নেই। কিন্তু প্রশ্ন থাকছে, মানদণ্ড কোনটা ? কোন মাপে মাপবেন মনুষ্যত্ব ? পুরাতন, নাকি নতুন ? সম্পূর্ণ পুরাতন নাকি সম্পূর্ণ নতুন ? একই বাড়ির একেক মহলে একেক মানদন্ড। সহ-অবস্হানের বিশিষ্ট লক্ষণ ! যাই বলি, আনন্দহীনতার কেন্দ্রীয় সত্যটি ভুলতে পারি না। আপনাদের নিজেদের জীবনে আনন্দ ছিল না, আপনাদের উচিত সন্ধান আপনাদের জানা ছিল না। বায়স্কোপ ছিল। কিন্তু কোন ধরনের ছবি দেখাবো আমরা ? পাছে নিজেরাই দেখাদেখি শুরু করি এই জন্য আপনিই ব্যবস্থা করে দিতেন। আপিসের লোক যেতো সঙ্গে। উদয়ের পথে’, ‘সাত নম্বর বাড়ি’—এসব ছবি সেই সময়েই দেখা, আপনার তত্তাবধানে। কিন্তু বাকি ছবি ? সেসব ছবি হল থেকে সরাবেন কেমন করে, যেসব ছবিতে নানাবিধ অবাস্তবতা ও অশলীলতা (আপনাদের দৃষ্টিতে), প্রধান বিষয়বস্তু ? সরাতে পারেননি, সম্ভব তাই করেছেন, নিষেধ করেছেন ছেলে-মেয়েদের। মেয়ে। কিছুটা শুনেছে, ছেলেরা শোনেনি, পরে একদিন টের পেয়েছেন মেয়েরাও শুনছে না, আর চাইছে না শুনতে। সাহিত্য ও সাহিত্যে তো আহা আপনাদের ছিল না। সেখানে মিথ্যা শুধু কপট মিথ্যাচার। আর এ অভিযোগও তো অস্বীকার করতে পারবো না আমরা, সাহিত্যভক্তেরা, যে সাহিত্যে প্রধানত আছে কবিতা, গদ্যেও কবিতা আছে উপন্যাসে আছে, আছে প্রবন্ধেও, অর্থাৎ বড় করে আছে কল্পনা, আর আছে কৌশল, বড় করে নেই বক্তব্য, নেই তেমন উদ্ভাবনা, নেই এমনকি অত্যন্ত প্রবল কোন আবেগ কেন নেই? তার জবাব খুজতে গেলে নটে গাছটি কেন মড়ালে তার ইতিহাস জিজ্ঞাসা করতে হয়, এবং জিজ্ঞাসার ধাপ ভেংগে ভেংগে নেমে আসতে হয়। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা যে জীবনেই কোন মৌলিকতা নেই আমাদের। পুরাতন উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কের আজ আর এমন কোন ক্ষমতা নেই বড় কিছু, মৌলিক কিছু, বৃহৎ ও প্রবল কিছু; উপহার দেবে আমাদের। অর্থনীতির দীনতাই সাংস্কৃতিক দীনতার সূতিকাগচ্ছ, বিষ সেখানেই আছে, বিষবক্ষ তারই অনিবার্য অবদান। চিন্তায়, চেতনায়, উভাবনায় যদি কোন মৌলিকত্ব না-থাকে তবে তার কারণ অর্থনৈতিক অচলায়তন। অর্থনীতি যদি বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর হয় তবে সংস্কৃতি কেমন করে স্বাধীন হবে ? হয়েছে কি কখনো ? অঙ্গ নৈতিক জীবন যদি প্রাণহীন হয় তবে সংস্কৃতি কি করে প্রাণবন্ত হবে? : আমাদের প্রচারের জোরে? হয়েছে কি তা কখনো ? জীবনের আনন্দহীনতা তাই অর্থনৈতিক ব্যবহার রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তার কথাটাই চিৎকার করে বলছে নিরবে, নিঃশব্দে। উৎপাদন ব্যবহার, বিশেষ করে উৎপাদন সম্পর্কের উপর একটা বড়সর ও প্রয়োজনীয় আঘাত একাত্তরে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে! লড়াই তে। ছিল না শুধু, বহিরাগত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই ছিল সামন্তবাদী মূল্যবোধের প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধেও। শত্রু, বাইরে ছিল না শুধু, ছিল ভেতরেও, ভেতরে-বাইরে যোগসাজশ ঘটেছিল জাতীয় মুক্তির আকাক্ষার বিপক্ষে। বোমা ফাটছে, গুলি ছুটছে, আর তাতে যে শুধু, হানাদার বাহিনীর ক্ষতি হচ্ছে, তাই নয়, আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে আমাদের পুরাতন মূল্যবোধ, রাজনৈতিক দর্শন, তথা সামাজিক সম্পর্ক। পুরাতন সমাজ, ভেংগে নতুন সমাজ গড়ে উঠবে, যেখানে মুক্তি আসবে দেশের শ্রমশক্তির, সম্ভব হবে নতুন আনন্দ সৃষ্টি, যেখানে মানুষ বিচছিন্ন থাকবে না পরষ্পরের, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সেই অতিপুরাতন সাঁড়াশীর বন্ধন ছিন্ন করে আমরা বেরিয়ে আসবো, এসে নতুন সামাজিকতায়, ব্যাপক, বৃহৎ ঐক্যে সমবেত হয়ে জীবনকে করবে পূর্ণতর, সংস্কৃতিকে নিয়ে যাবো সুসংগঠিত ও উচচতর এক স্বরে। সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ; শেষ হয়নি। সেই সময়ে আপনি ছিলেন না, তার আগেই আপনি চলে গেছেন। জীবিত থাকলে চতুর্দিকে মৃত্যু দেখতেন, এবং মৃত্যুর নিষেধ ও হত্যার অগ্রাহ্য করে জীবনের অভ্যুদয়। সংস্কৃতি, সমাজ ও অর্থনীতির পুরাতন স্ববিরোধিতাসমূহ তখন অতিনাটকীয় দুই বিরপক্ষে পরিণত হয়েছে। হয়ে জীবনপণ লড়েছে। জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর লড়াই। আপনি দেখতেন, মানুষ কি করে অভ্যাসান্তগত ধারণাগুলো ফেলে দিচ্ছে। ইচ্ছে করে নয় ? সখ করে নয় বাধ্য হয়ে, ঘটনার ধাক্কায়। দেখতেন, মানুষের মহত্তম উচ্চতা, দেখতে পেতেন নিকষ্টতম নিচুতা। কত উপরে উঠতে পারে মানুষ, আবার নামতে পারে কত নিচুতে। কিন্তু উচ্চতাটা উচুতেই ছিল, আশেপাশে ছিল না সে, তার সঙ্গে রোজ গা এক্কিধাক্কি হতো না ; উচুকে দেখতে হলে ঘাড় উচু করতে হতো। লড়ছে মানুষ; দরে দরে, গোপনে, লুকিয়ে। আত্মত্যাগ করছে। আশ্রয় দিচ্ছে। সাহস দিচ্ছে। আশেপাশে স্তুপ ছিল নিচুতার ভীরুতার। কিলবিল করছিল ঘাথ– পর ও কাপুরুষ লোকেরা। তারা ঘুরছে, হতাশা ছড়াচ্ছে, হানাদারদের অনিঃশেষ ক্ষমতায় অগাধ আস্থা প্রচার ও প্রদর্শন করছে। ন্যায়-অন্যায় বোধটাকে খাটো করে ফেলেছে প্রায় অবিশ্বাস্য রকমে। সহানুভূতি নেই, করুণাও নেই। আছে শুধু, টিকে থাকার “লানি। মানুষ জন্তুর মত হয়ে গিয়েছিল। লোভে যেমন, তেমনি সংগ্রামে। সেদিন সমাজজীবনে নিরাপত্তাবোধের সুপ্রাচীন অভাব সম্পূর্ণরুপে উন্মেচিত হয়েছিল। পরষানুক্রমে মানুষ ভয়ে ভয়ে বাস করেছে এইখানে। সে ভয় যে কত গভীর হতে পারে সেদিন জানা গেল। সন্ত্রস্ত মানুষের মনুষ্যত্ব খসে খসে পড়েছে, গাছের শুকনো পাতার মত। ভয়ে মানুষ পশুর চেয়েও পশ হতে জানে বলে জানিয়ে দিয়েছে সেই ন’মাসে। মানুষের মহত্তের ব্যাপারটা কথার কথা নয়। সে আছে বৈকি। কিন্তু তার সামাজিক ভিত্তিটা কি? ভিত্তিটা যে শক্ত নয়, বরঞ্চ অতিশয় দুর্বল এই মৌলিক কথাটা নতুন করে জানা গেছে একাত্তরে। মহত্তের সামাজিক ছিল। শক্ত সামাজিক ভিত্তি ছিল দুর্বলতার, পরাজয়ের, নিচুতার, স্বার্থপরতার। সবসময়েই ছিল তা, শহর আক্রমণ তাকে আরো সুদৃঢ় করল। . আমার মা বলেছিলেন, তুই চলে যা। দেশ ছেড়ে আমার চলে যাবা: আবশ্যকতাটা আত্মীয়স্বজনের কাছে বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল তখন। চতুর্দিকে সকল বাঙালীই, বাঙালী মাত্রেই, বিপদগ্রস্ত তখনএমনকি দালাল বাঙালীও সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়, বাঙালী তো যতই হোক। ঔপনিবেশিকতা তখন তার সকল ছন্দবেশ ক্রুদ্ধ হস্তে ছিন্ন করেছে। হত্যা করছে নির্বিচারে। এরি মধ্যে শোনা গেছে বিশেষভাবে খোঁজা হবে অনেককে, সেই তালিকায় আমার নামও থাকবার কথা। আমার মা বলেছেন, বাবা, তুই থাকিস, না, চলে যা। আব্বা, আপনি তখন, ছিলেন না। যদি জীবিত থাকতেন সেই কঠিন দুদিনে, পালাতে হতো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, বোধ করি কোথাও নিরাপদ মনে হতো না; কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারতেন না আপনি, তুই চলে যা। আপনার অভিমানে, বাধত। আপনি আমাকে আশ্রয় দেবেন। রক্ষা করবেন আপদ-বিপদ, বালা-মসিবতের হাত থেকে। এই তো হবে ভূমিকা আপনার। তার বদলে যদি বলেন যা পালিয়ে যা তবে আপনার পৌরষের ভীষণ অপমান। আমার মা ভাবতেন শুধু, আমার কথা, আপনি আপনার কথাও ভাবতেন আমার কথা ভাবতে যেয়ে। অভিমান এমনই বস্তু। নিজে আপনি পিতৃহীন হয়েছেন অল্প বয়সে, আমার পিতামহ ছিলেন না, আপনি পিতার ও পিতামহের যক্ষদায়িত্ব পালন করছিলেন যেন, মনে হয়েছে আমার। আপনি বাঁচাবেন আমাকে ঘাতকের হাত থেকে। যদি কেউ হাত তোলে ভেংগে দেবেন তার হাত। আমার খুব মনে আছে ছেলেবেলায় একবার এক ভদ্র মাতাল ক্ষিপ্ত হয়ে তাড়া করেছিল আমাদেরকে, অন্যেরা পালিয়ে গিয়েছিল, আমি পড়ে গিয়েছিলাম মাটিতে। সেই মাতাল লোকটা বোধ করি চড়-চাপর দিয়েছিল দু’য়েকটা। সেটা আমার তত মনে নেই যত মনে আপিস থেকে ফিরে আপনার সেই বেরিয়ে-যাওয়া, যেয়ে সেই লোকের বাড়ি খাঁজে বার করা, করে মহাহট্টগোল বাঁধিয়ে তোলা। পাড়ার ছেলেরা পরে বলেছে, তোকে ঘাটাবো না, তোর বাবা আছেন পেছনে। পেছনেই ছিলেন, থাকতে চাইতেন ছায়ার মত। খুব মনে আছে, আপনার সঙ্গে ট্রামে যেতে নামতে পারিনি ঠিক স্টপেজে, আপনি নেমে গেছেন, আমি ভয় পেয়ে নামতে পারিনি, ঘণ্টা বাজিয়ে ট্রাম দিয়েছে ছেড়ে ; তারপর সেই যে পরের স্টপেজে দেখি আপনি হন হন করে। প্রায় ছুটতে ছুটতে, লোক ঠেলে ধাক্কিয়ে চলে আসছেন আমার দিকে। অনেক পরে, যখন বিয়ে হচ্ছে আমার। সেই দিন, বিয়ের মত হট্টগোল গেছে তো, যেমন যায়, বিয়ের আসরে যখন লোকজন কিছুটা হাল্কা হয়ে এসেছে, দেখি আপনি কোথা থেকে কমলা নিয়ে এসেছেন একটা,! হাতে তুলে দিয়ে বলছেন, নে খা। সেই কমলা আমি কি করে ভুলি! একাত্তরে জীবিত থাকলে আপনি ভাবতেন আমাকে সেই আগের মত হবে, এম ঘিরে রাখবেন, আগলে রাখবেন আপনি। আপনার স্নেহ বর্ম হবে , বর্ম হয়ে আমাকে বাঁচাবে। কিন্তু আপনি নিজেই তো অসুস্থ হয়ে পড়তে সে কথা নিশ্চিথ্ করে বলতে পারি। আপনার ছেলে-মেয়েরা কে কে ছিটকে পড়েছে, কে বেচেছে, কে বাঁচেনি, কে কোথায় ধুকপক করেছে সকল উদ্বেগ একসাথে জড়াে আপনার পুরানো রোগ গ্যাস্ট্রিক অনেক বাড়িয়ে। এক ঠিকানা থেকে আরেক ঠিকানায় সেই উন্মাদ ছোটাছটি সে আপনার সইতে না কিছুতেই। আপনি অসুস্থ হলে আপনার সঙ্গে আমায়। ভূমিকা বদল হতো–স্বভাবতই। অভিভাবকের দায়িত্ব আমাকেই নিতে হয়। আপনার অভিবাকত্বেরও। কিন্তু সেই অবস্থাটাকে তো কিছুতেই আপনি। স্বীকার করে নিতেন না। পারতেন না নিতে। আগেভাগে তো নয়, এমনকি । ঘটনা যখন রঢ় বাস্তবিক হয়ে উঠতো, কোন সুযোগ থাকতো না মুখ ঘুরিয়ে নেবার, তখনও নিতেন না তাকে স্বীকার করে। একাত্তর একদিকে দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা, আরেকদিকে দালাল। একদিকে। অত্যুজ্জ্বল আলো, অন্যদিকে ঘনক অন্ধকার। মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় ছিল। জানা সহজ ছিল না। নিতান্ত ছেলে-ছোকরা তারা, অত্যন্ত অর্বাচীন। কিন্তু তব, এমনি দুর্ভাগ্য আমাদের যে সেই ছেলে-ছোকরারা, যোদচোরা, দুঃসাহসীরাই একমাত্র ভরসার কারণ ছিল সেই দুদিনে। পঞ্চাশ বছরের জন্য গোলাম হয়ে গেলাম আমরা, বলতেন অনেক বয়স্করা ; কিন্তু সে গোলামির সম্ভাবনা মধুর কোন আশার আঙুল তুলে ধরতে না সামনে। হানাদারদের হাতে একেকদিনই একেকশ’ বছরের মত দীর্ঘ মনে হত অনেক দিন-কল্পনার সাধ্য ছিল না পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত দৌড়ায়। কিন্তু মুক্তি যোদ্ধারা তো অপরিচিত হবেই, অদশ্য থাকবেই, আপনার নিজের ছেলে যাবে মুক্তিযুদ্ধে এতে আপনি কোনদিন প্রাণ ধরে বলতে পারতেন। আপনার ছেলে যাবে না, যাবে অন্যের ছেলে। যাবে, লড়বে, প্রয়োজন হলে প্রাণ দেবে। এবং তার সফলটা ভোগ করবে কে? কে আবার, যারা বেচে থাকবে, অটুট থাকবে তারাই তো, তারা ভিন্ন আবার কে? এই ব্যবস্থার মধ্যে কুৎসিত একটা হৃদয়হীনতা আছে, আছে বীভৎস এক সুবিধাবাদিতা।। কিন্তু সে কি চোখে পড়ে আপনার, আমার, আমাদের ? পড়ে না, শুধ, ঐ। বিশেষ ক্ষেত্র বলো ত নয়, কোন ক্ষেত্রই নয়। পড়ে না চোখে। একাত্তর দালাল এসেছিল। কোথা থেকে এলো এত দালাল : কেউ এসেছে ভয়ে হয়তো, কেউ এসেছে লোভে। বাসি মিষ্টির চারপাশে যেমন । কেবলি ভন ভন ভন ভন করে মাছি, তেমনি কত অসংখ্য দালাল দেখেছি। চারপাশে। কাকে বিশ্বাস করবো, কার মধ্যে কোন দালাল লুকিয়ে আছে। খাপটি মেরে কে বলবে ? মাঝে মাঝে বোমা ফোটে, গুলি ছোটে, সশলে। উড়ে যায় প্লেন ; আর অন্যদিকে ফিসফিসিয়ে কথা বলে মানুষ, এই দুই। চরমপন্থা জীবনযাপনের অস্বাভাবিকতাকেই নির্দেশিত করেছে। মাহি। জন্মে কোথায় ? জন্মে স্বার্থের আস্তাকুড়ে। শুভবুদ্ধি, প্রেম, ভালে। সহনশীলতা ইত্যকার অনেক কিছুর কথা অনেক অনেক বলেছি আর্ম। বলতে ভালোবেসেছি, কিন্তু একাত্তর শিখিয়েছে মিথ্যে কথা এসব কি মল সত্য এক ও অভিন্ন—সে হল স্বার্থ। স্বার্থেই এক হয় মানুষ, বাহে, ভিন্ন। শুভবুদ্ধি দেশ শাসন করে না, দেশ শাসন করে স্বার্থ। সে লো” প্রকৃত মুখে নিজের স্বার্থকে যে জিম্বায় রাখে অন্যের শুভবুদ্ধির ৭ নিজের চরকায় নিজেরই তেল দেওয়া আবশ্যক, অন্যকে দিতে দিলে সে যায় চরকাও যায়। বিবেক’ ‘যাত্রা’তে যতই তড়পাক, জীবনে আহত সে। তার বেশি নয়। দালালদের আদর্শ কি ? অন্য কিছু নয়, স্বার্থসিদ্ধি। অন্য অনেক শোনা যাবে, ইনিয়ে কখনো, কখনো বিনিয়ে, আসল সত্য চাপা – চাপাচাপি চলবে, দালাল বলবে, আদর্শবাদী সে, লড়ছে লড়াই বাদের; কিন্তু বাস্তব বিষয় হচ্ছে স্বার্থ, স্বার্থকে লালন করা, করা তার বক্ষ। অন্য সব কিছ, ছদ্মবেশে ছলাকলা শুধ, প্রতারণা প্রকারের। কোন প্রকার ভেজাল নেই এই সত্য যে, রাজনীতিই বলি, কাছে। নৈ আহত পাখি । অন্য কথা সত্য চাপা দেবার লড়াই আদশর্ন করা, বধিতি ? প্রতারণা বিবিধ তই বলি, অথবা ব্যবসায়-বাি জা, কিম্বা চাকরি-বাকরি, সবকিছু, সমস্ত কিছু দালালিরই ভয়। উঠবার ঐ একটাই পথ-—একমাত্র রাস্তা! তোষামোদ, চাটুকারিতা, প্রতারণা। এদেশের মধ্যবিত্ত মধ্যকারই, মধ্যবত। সে শাসক ও শাসিতের জমিদার এ প্রজার, উৎপাদক ও ক্রেতার। আসল কাজটা তার ঘটকালি, চরিত্রে যা দালালি। এ-পক্ষ, ও-পৃক্ষ দ’পক্ষ থেকে নেয়, ওপর থেকে, নিচ থেকে গাছেরাও খায় তলারও কুড়ায়, তবে তলার, কুড়ানোটাই বেশি, গাছের মালের সিংহভাগ প্রভরা নিয়ে নিয়েছে। একত্তরে এদেশের মানুষ সহমর্মিতায়, সখ্যতায়, ঘৃণায়, সর্বোপরি সাহসে ও সংগ্রামশীলতায় তুলনাবিরল মহত্তৰ জল করে তুলে ধরেছে ; আবার একই সঙ্গে দালালির অন্ধকার দিয়ে। মনে হয়েছে প্লান করে দেবে হানাদারির ইতিহাসকেও! আমার পিতা, অনেক পিতা, উপরে উঠতে চাননি। নাকি বলব, পারেননি ? যাই বলি, একই জায়গাতে ছিলেন। একাত্তরে যদি গ্রামে আসতেন তিনি, যেমন অনেক এসেছিলেন তাঁর বয়েসী, তবে কোথাও লাকড়ির জন্য গাছ পাওয়া যায়, কোন ডোবাতে কেমন মাহ আছে, খেত-খামারে যেটকু আছে বগাদারেরা তার কি করছে—এসব বিষয় খোঁজ নিতেন। দেখা হতো একদা বান্ধবদের দু’য়েকজনের সঙ্গে, যাঁদের সঙ্গে পাঠশালায় পড়েছন, মাঠে খেলেছেন, হাটে সওদাপাতি করেছেন। দেখা হলে পারস্পরিক দুরত্বটাই বড় হয়ে উঠতো, নৈকট্যের তুলনায়।সময় চলে গেছে। এবং এসেছে শ্রেণীগত ব্যবধান। চাষীর ছেলে চাষবাসে রয়ে গেছে, আপনি, আব্বা, শহরে _ চলে গেছেন। সেই যে গেছেন, আর ফেরেননি। অনেক ওপরে ওঠেননি ঠিকই, – কিন্তু গ্রামীণ নন মোটেই। লোক-সংস্কৃতিতে আপনার আস্থা নেই, থাকবার কথা নয়। আপনি ব্যবসাদার নন। কিন্তু শহরের ছোট ফ্ল্যাটে, বন্ধ গলিতে, – দম-আটকানো অবুদ্ধতায় হাঁসফাঁস করেছেন যখন তখন নিশ্চয়ই গ্রামের বড় মাঠ, প্রশস্ত আকাশ, উদার বাতাস, বষার নদী—এসব স্মৃতি অত্যন্ত মধুর হয়ে জেগে উঠেছে মনের ভেতর, আকুপাকু করেছেন প্রত্যাগমনের জন্য । । কিন্তু যদি আসতেন একাত্তরে তবে আসতেন বাধ্য হয়েই, এবং যেই মহতে আসততা ষোলই ডিসেম্বর অমনি সমস্ত কিছ, ভুলে গিয়ে অবুঝ , তৎপরতায় অস্থির হয়ে পড়তেন শহরে ফেরার জন্য ব্যাকুল আপনি, ব্যাকুল আপনারা। গ্রাম গ্রামেই থাকতো পড়ে। যেন আগে ছিল আজো আছে। স্মৃতির গ্রাম গ্রামেই থাকতো পড়ে। যেমন আগে ছিল, আজো আছে। স্মৃতির গ্রাম ও জীবনের গ্রাম দই ভিন্ন বস্তু। আপনারা ওপরে ওঠেননি, নিচে নামেননি, অথচ ঐ, যে আপনাদের আটক-দশা মধ্যপথে তাকেও মেনে নেননি সন্তুষ্টচিত্তে ! অসন্তোষ নানাভাবে হরহামেশা প্রকাশ পেয়েছে। ভঙ্গিতে কিছ, ধনিতেই প্রধানতঃ । সী আওয়াজ নানাবিধ। ফাঁকা আওয়াজ। ভেতরে শক্ত বুলেট আছে যন্ত্রণার, তাৰ বিষ আছে বিক্ষোভের, কিন্তু তারা ভেদ করতে পারেনি লক্ষ্য, হয়তো লক্ষ্য যে কি তাই জানা হয়নি, চেনাই হয়নি শত্রকে, যার উদ্দেশ্যে এমন সব ধনিবাহ,ল্য । ” কথা, কথা, কথা—শুধু, চলতে থাকে। এর চেয়ে ভালো কিছু নেই। করবার, এমের মুক্তি ঘটেনি সমাজে কেউ অলস, কেউ কাজ পায় না, কাজের তেজস্ব উদ্ভাবন ও সষম বণ্টন নেই, তাই ধনিতেই প্রধান পরিশ্রম। ফাস বয়েত উদ্ধৃত করে আমার পিতা বলতেন, “সহজে যা পাওয়া যায় এ জগতে তার মল ঝটা। শ্রমের জিনিস মলে বিকায় যদি হয় তৃণকুটা।” $ মোটেই নয়। শ্রমের মূল্যও কথার কথাই। শুন্যপাত্রের প্রচর-ধনির সঙ্গে _ সঙ্গে এক ধরনের বধিও বিকশিত হয়, বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে বলতে যেয়ে এই ধির যথার্থ স্বরপ একদা রবীন্দ্রনাথ নির্দেশ করেছিলেন, “বাঙালীর * মুদ্ধি সহজেই অত্যন্ত সক্ষম। তাহার দ্বারা চল-চেরা যায়, কিন্তু বড়াে • ড়াে গ্রন্থি ছেদন করা যায় না। তাহা সুনিপুণ কিন্তু সচল নহে।” এই ১ ল-চেরা সুনিপুণ বৃদ্ধি তক করে, শুধ, শব্দ করে, ঘোরে, শুধ, চক্ষা= কারে ঘোরে এগোয় না, পেছাবে যে তাও না। শ্রমের মুক্তি নেই বলেই বুদ্ধির মুক্তি ঘটেনি আসলে। সামান্য পজি জোর খবরদারি করছে, সে বিদেশী প’জি, বণিক পজি, দালাল পজি-যেমন অর্থনীতিতে তেমন চিন্তা-চেতনায়। একাত্তরে, আব্বা, আপনার কথা অনেকবার মনে পড়েছে। খুব কবে মনে পড়েছিল একদিন, বাসে বসে। ঢাকা শহরের চলমান বাস–মরার মত চলছে লোকজন। কথা যা দ’-চারটে অবাঙালীরাই বলছে শধ। কিন্তু সে বলাতেও কোন উলাস নেই, আনন্দ নেই, এমনকি প্রাণও নেই। একজনের হাতে দেখি বাংলা সিনেমা সাপ্তাহিক। আরেকজন তাকে বলছে, উe ভাষাতে–কি রে বাংলা পড়িস নাকি আজকাল ? সিনেমা-পত্রিকাওয। বলল, দোষ, কি, সবকিছুই জানা ভালো। হঠাৎ দেখি দরে, অপর নেত বাসের, এক ভদ্রলোক বসে আছেন। আমি তাঁকে চিনি, তারও চিনবার কথা আমাকে। বিষন্নভাবে বসে আছেন। তাঁর বিষন্নতাই আকষণ কবেড়িত। আমাকে, তাঁর দিকে। আমিও বিষয় ছিলাম, সন্ত আরো বেশি। কি মত আমরা অনেক দূরে, পরস্পর থেকে। মাঝখানে অনেকটা জায়গা, অনেব, গুলো লোক, মাঝখানে এক নদী রক্ত। ভদ্রলোক অবাঙালী, আমি বাঙলা সেই সময়ে আপনার কথা খুব মনে পড়ল আমার। ভদ্রলোকের সাদশ আমাদের নিকট প্রতিবেশী ছিলেন, ভাইয়ের মতনই ছিলেন । আপনার ২ চিকিৎসকও ছিলেন। আমরা চলে গেছি যখন ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্যত্র, ভূ-খন গ্যাসট্রিকের বেদনা যখন অত্যন্ত অসহ্য হয়ে উঠতো আপনার চোখে পদতাম, পানি টলটল করছে, তখন আমরা কেউ রাত হোক, বিরাত, হেঃ ছুটতাম ওর কাছে, তিনি আপনার রোখের সমস্ত বিশদ নিখ”, জাতির জানতেন, তুরিৎগতিতে ওষধ দিতেন, হোমিওপ্যাথিক নিয়ে এসে সাপনাকে দিলে আপনি শান্ত হতেন, বেদনা কমতো, অন্ততঃ আমরা মনে করতাম। কমেছে। লাঘব হত অপারগতার ভুরি। অসুখ হলে আপনি পিতা ছিলেন ‘পারতেন না, প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্তান হয়ে পড়তেন। সেই অত্য গত ৩ প্রতিবেশী, আমাদের, ইউপি থেকে এসেছিলেন, ঘর-বাড়ি সমস্ত কিাহ, দহ মোহাজের হয়ে, তিন মেয়ে সঙ্গে কুরে। তাঁরই বড় মেয়ের জামাতা ঐ ভদ্র লোক। ঈশ্বরদিতে থাকতেন বোধ করি নয়তো পার্বতীপুরে। বাসে বসে আছেন বিষন্ন মুখে।. আমরা বসে আছি দুইজন, দইদিকে। তিনি কি মদ; হাসলেন, আমাকে দেখে ? আমি কি মদ, হাসলাম তাঁকে দেখে ? তিনি কি ভাবলেন ধন শত্রপক্ষ ? আমি কি ভাবলাম তিনি শত্র, আমার ? ঢাকাতে কেন এসে কোন বিপদ হয়েছিল কি মফঃস্বলে ? কোথায় আছেন? কেমন অহনা অনেক প্রশ্ন মনে এসেছিল আমার। জিজ্ঞাসা করা হয়নি। গতব) সে। যাওয়ায় আমি নেমে পড়েছি। তিনি চলে গেছেন, বোধ করি মুহম্মদ। হয়ত বাসায় ফিরে আমার কথা বলেছেন তাঁর স্ত্রীকে। চৌধুরী সাহেবের বড় ছেলেকে দেখলাম বাসে। সেই যে খুব লাজক ছিল ! যেমন আপনাকে কাছে পেলে আমিও বলতাম তাঁর কথা। রিজভী সাহেবের জামাইকে মেয়ে। লাম, সেই যে রেলেতে চাকুরি করতো। ঐটুকুই, ওর বেশি জানতাম না আমরা। খুব কম কথা বলতেন রিজভী সাহেবেরা। ভাষার সরাইল। তদুপরি কথাশিলপী ছিলেন না বাসার কেউ। ব্যস্ত থাকতেন কলরব কর্মে। চাকর-বাকর ছিল না। রিজভী সাহেবের রোগীরা ছিলেন, স, যারা সকালে-সন্ধ্যায়, রাত-বিরাতেও। তাছাড়া তিনি নিজেই ত । গেলেন একদিন হঠাৎ, আমার আব্বারও আগে। নাকি ক্যাসার তাঁর। তারপর পরিবারটি চলে গেল, ঐ জামাতার অয়ে। এ-ও” । কোথায় আছে ? ঐ পরিবার ? পিতৃব্যের পরিবারের মত জল আনা করাচীতে গেছে ? ভালো আছে তো আপনি জীবিত থাকতো, পারতেন সব খবর। আপনি সব খবরই রাখতেন, বাড়িতে বসেই সেদিন। থেকে নেমেও অনেকক্ষণ আপনাকে মনে মনে খুজেছি আমি, এ বাসে ভদ্রলোককে স্মরণ করে। তাঁর সঙ্গে আমার শত্রুতা কোথায় ? আথ্য ও তো শত্রু, হয়ে পড়েছিলাম, ঘটনাচক্সে। যেমন হয়েছিল সাম্প্রদায়িক সফ।কালে, ৬ লকাতায়। একি ক্লাসে পড়ি, পাশাপাশি বসি, একই সাথে ফিরি বাসায়, অথ, বিশেষ বিশেষ গলির মুখে চমকে চমকে উঠি আমরা, মনে পড়ে সহপাঠী এক সম্প্রদায়ের, আমি অন্য গলি পেরলে আবার ভুলে যাই। সেই সময়ে আপিস আপনার ফিরতে দেরি দেখলে আমরা অহির হতাম চিন্তায়। একাত্তরে হয়ত আপনি অস্থির হতেন আমি কোথায় আছি ভেবে। আপনি বলতেন, রাজনীতি। রাজনীতিই আমাদেরকে খেলো। রাজনীতি তো বটেই। কিন্তু কোন রাজনীতি ? কিসের রাজনীতি ? সেই প্রানে। ঝগড়া লেগে যেতো আপনার সঙ্গে। না-ঝগড়া করার মত বন্ধুত্ব ছিল না। আপনার সঙ্গে। আপনি এক যুগের মানুষ, আমি আরেক যুগের। রাজনীতির চেহারাটা, তার অভ্যন্তরের স্বন্দটা আমাদের কাছে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, আপনাদের কাছে তত হয়নি, সম্ভব ছিল না হওয়া। রাজনীতির কারণেই তো রিজভী সাহেব একদা চলে এসেছিলেন এই শহরে ঘরবাড়ি ছেড়ে। ছেলে ছিল না, তিন মেয়ে, সমাজ ছিল না, মেয়েরা ঘরের বার হতো না, মিলবার লোক ছিল না তাদের, চারদিক বাঙালীতে ছাওয়া। রাজনীতির কারণেই তো কোথায় তাঁর পরিবার ছিটকে পড়েছে আজ কে জানে। সেই কারণেই তো আমরা নিজেরাও, কোটি কোটি বাঙালী সেদিন নিজের দেশেই শরণার্থী হয়ে পড়েছিল, আশ্রয় ছিল না, ঠিকানা ছিল না, ছিল শুধু, আতঙ্ক। কিন্তু এ-রাজনীতির নিয়ন্তা আমরা নই, আমরা এর ভুক্তভোগী। কে কোথায় যাবো, কে বাঁচবো, কে মরবো তা স্থির করবার অধিকার আমাদের নিজেদের নেই। জুতোর মর্যাদা জাপানে বেশি বটে, কিন্তু আমাদের দেশেও কম নয়। অধিকাংশ লোকই জুতো পারে না, পায় না জুতো পায়ে দেবার । জুতো তাই আভিজাত্য আছে। কেউ জুতোপেটা খায়, কেউবা জুতোপেটা করে। জুতোর ত’ প্রয়োজন আছে। জুতো লাগে অনেক দূরে যেতে, অনেক পথ ভাংতে। কিন্তু অনেক দূর যাওয়া হয় না আমাদের, অনেক পথ ভাংগা । ঘরে ঘরে ফিরে ফিরে বারে বারে আমি—একই জায়গায়, একই সীমানায়। চল আছে, অগ্রগতি নেই। অথবা যদি এমন হয় যে, সকল মানুষ এক সঙ্গে হয়েছে, এক সঙ্গে হাঁটছে সামনে, ভাংছে পথ, যেমন কিছুটা হয়, একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরীতে, তবে তাতে, আতত্যাগের সেই সাম্য কার পায়ে জুতো আছে, কার পায়ে নেই সে বিচার আর উঠতো না, কেউ কারো পায়ের দিকে তাকাতো না, একটা ঐক্য গড়ে উঠতো। কিন্তু তাতে হয় না। ঐক্য তো আসে না। সেই ঐক্য হলে জুতো আসতো সকলের পায়ে, প্রয়োজনের জুতো, এক ধরনের জুতো, এবং তাতে তখন, একসাথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো সামনে। কিন্তু তাতে হয় না। তাইতেই জুতোর মতো ক্ষয়ে যায় জীবন। জীর্ণ হয়। অকেজো হয়ে ওঠে। পরিত্যক্ত হয়। আমার গল্পের সেই নায়ক যেমনটি হয়েছিলেন। আপনি, আব্বা, পরিত্যক্ত হতে রাজি হননি। সমাজ আপনাকে পরি ত্যাগ করবার আগেই আপনি পরিত্যাগ করেছেন সমাজকে। ভেবেছেন নিশ্চিন্ত হলেন। যে-চাদর গায়ে দিয়ে আপনি ভালোবাসতেন বিছানায় শুয়ে। থাকতে, সেই চাদর কিসের চিহ্ন ? সে যে বিজয়ের পতাকা নয় সে তো জানি, তবে কি সে বিদ্রোহের নিলাম ? নাকি সন্ধির ? অর্থাৎ আত্নসমপণের প্রস্তাব ? অথবা অবজ্ঞার স্মারকচিহ্ন। অবজ্ঞারই। নিশ্চিত জানি সেটা। বিদ্রোহ আপনি একা করবেন এমন শক্তি কোথায় ? অনেকে মিলে বিদ্রোহী হবেন তেমন ঐক্যও সমাজে নেই। যদি আত্মসমর্পণ করতেন তবে যেতেন তোষামোদ, চাটুকারিতা, ঠগ-জয়াচরির পথে, বন্ধুত্ব হতো অন্য তোষামোদকারী, চাকার, ঠগ-জয়াচোরদের সঙ্গে, চক ও লোহার সম্পর্ক। উপরে উঠতেন টাকা-পয়সায়। আসতো সাংসারিক স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু সে পথও তো মাড়বেন না আপনি। তবে আর রইল কি বাকি, এক অবজ্ঞা ভিন্ন। সেই অবজ্ঞারই অপর নাম সিনিসিজম। আরেক নাম পরচর্চা। কিন্তু সমাজকে অবজ্ঞা-উপেক্ষা করবে। এমন ক্ষমতা কে দেবে আপনাকে ? পাবেন কোথায় ? বিনিময়ে সমাজ যদি অবজ্ঞা-উপেক্ষা করে শান্ত হতে তবে সান্ত্বনা ছিল। কিন্তু থামে না তো। সেখানে সমাজ আঘাত করে, আক্রমণ করে, রক্তাক্ত করে দেয়, রীতিমত। রক্তাক্ত হয়েছেন, হচ্ছেন, হচ্ছি আমরা শত-সহস্র মানুষ। প্রতিনিয়ত। পথ কি নেই মুক্তির : নিশ্চয়ই আছে। মানুষের অসম্ভব কি ? সঙ্কট যেমন আছে ঠিক তেমনি আছে উত্তরণের পথ। কিন্তু তার কথা উঠলে তক আসবে, আসবে রাজনীতির কথা, আসতো মতপার্থক্য, ঘটতে বেয়াদপি। যেমন অনেক সময় ঘটেছে। তক চলবে অবিরাম, কিন্তু মিলবে না কিছুই। মতের অমিলটা বেরিয়ে আসবে সামনাসামনি। সে কিছু, লাভ নয় নিশ্চয়ই। আমরা বলি, অনেককাল ধরে নানাভাবে বলেছি যে, মনের যদি মিল হল, তুচ্ছ তবে মতের গরমিল। পরানো কথা, কিন্তু মিথ্যা কথা। মতের গরমিলের চেয়ে বড় গরমিল আর হয় না। মনের মিল থাকে না, ভেংগে যায়, মতের যখন বিরোধ ঘটে! আতমীয়তার চেয়ে, বন্ধুত্বের তুলনায়, রক্তের সম্পর্কের চাইতেও অধিক শক্তিশালী তাই মতবাদের ঐক্য। সে কথা এখন থাক। আমি জানি আপনার স্নেহের মতই অনেক কিছু ব্যাপার আমার ভেতরে আছে। গা ভেজা থাকলে, বৃষ্টিতে ভিজলে, অথবা গোসল করে এলে ছেলেবেলায় যেমন করে আপনি পানি মুছে দিতে ভালোবাসতেন, তেমনি অনেক রকম ধারণাও আমার চিন্তা-চেতনা থেকে মুছে ফেলে দিতে চেয়েছেন আপনি। হয়ত সবটা পারেননি। ঐ একটি ব্যর্থতা আপনার যেখানে অগৌরব নেই। আমি মনে করি।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.09.09-11.pdf” title=”1977.09.09″]