You dont have javascript enabled! Please enable it!

একাত্তর উত্তর বাংলাদেশ | জাফরুল্লাহ চৌধুরী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭

মার্চ, ১৯৭১-লন্ডন। পূর্ব বাংলার জনতার বিক্ষোভের ঢেউয়ের খবরে সুদূর লণ্ডনে বসে প্রবাসী বাঙালীরা ভাবছে এ বিক্ষোভ—কোন পর্যায়ে যাবে? আপোষ কি হবে ? অতীত চিন্তা করলে দেখা যায় নেতৃত্ব বার বার আপোষ করে এদেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, এবারও কি তাই হবে ? একদিকে নেতৃবৃন্দের পাকিস্তানী সরকারের সঙ্গে মিটিং অন্যকে জনতার রুদ্ররোষ। প্রতি মুহূর্তে নতুন খবর। বাঙালীর আন্দোলনের প্রচণ্ডতার সময় খবর। ২৫শে মার্চ রাতে দেশের নিরীহ জনতার উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংস আক্রমণের খবর ছড়িয়ে পড়ল ২৫শে মার্চ রাতে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে। ব্যথার মাঝখানে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত-আপোষকামী নেতৃবৃন্দের জুয়াখেলা ব্যর্থ হয়েছে—মুক্তি আন্দোলন গড়ে উঠবে—দেশ স্বাধীন হবে। সংকটময় মুহূর্তে , সংগঠনের খাতিরে, নিরপেক্ষভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রবাসী বাঙালীরা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর উপর চাপপ্রয়োগ করে। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবাসী সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে । লন্ডন প্রবাসী বাঙালীদের শতকরা নব্বই ভাগ হচ্ছেন শ্রমিক। যুদ্ধের জন্য প্রচুর অস্ত্র দরকার, তাই সংগঠন সিদ্ধান্ত নেয় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার প্রবাসী বাঙালী সপ্তাহে এক পাউণ্ড করে সংগঠনকে জমা দেবেন। কিন্তু, মুজিবনগর থেকে আবু সাঈদ চৌধুরীর নিকট নির্দেশ আসতে থাকে অর্থ জমা করতে এবং বিভিন্ন স্থান পেকে মন্ত্রিযোদ্ধাদের চিঠি আসতে থাকে অস্ত্রের ব্যবহার আবেদন নিয়ে। দু’ভাবে দেশ থেকে প্রবাসী বাঙালীদের কাছে নির্দেশ এবং আবেদন আসতে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই প্রবাসী বাঙালীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু আমি জানতাম দেশের মানুষ সহনশীলতার চরম পর্যায়ে গেছে। স্তব্ধ হয় না, সীমানা ভেংগে দেয় বানের মত। ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬২ ও ১৯৬৯ তারই প্রমাণ রেখেছে দেশের ইতিহাসের পাতায়। বরাবরই এদেশের মানুষ সঠিক পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে গেছেন, আর নেতৃত্ব সে ইতিহাসকে ভুলণ্ঠিত করেছে। কিন্তু ১৯৭১-এর বিক্ষোভের ধারা যে পথে এগিয়ে চলছিল তাতে সবকিছুর মধ্যে একটা সামঞ্জস্য ধরা পড়ছিল যেন বারবার। তাই যে স্টীমরোলার চলেছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালীর উপর—সে স্টীমরোলার উপেক্ষা করে এদেশের মানুষ চলেছিলেন নির্দিষ্ট পথে। ইতিহাসের এ পর্যায়ে বসে থাকাকে ঘটনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর্যায়ে মনে হল। তাই আমি ও ডাক্তার মোবিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য লন্ডন ত্যাগ করলাম।
মে, ১৯৭১-কলকাতা
কলকাতা এসে ঢাকা—ক এবং ঢাকা—ব গাড়ির সংখ্যা দেখে প্রতিভাত হল নেতৃত্ব কাদের হাতে এবং এর রূপ কি ? প্রথম ঘা খেলাম সেখানেই। এরা ব্যক্তিগত ব্যাপারে অনেক বেশি ব্যস্ত। আশ্চর্যজনকভাবে অনুমতি পেলাম এবং জানতে পারলাম প্রধানমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন। মন আনন্দে উতলা হয়ে উঠল ; আমাদের স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে আলাপ করবেন, এ যেন পরম সৌভাগ্য। দেখা হল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। বললেন, “যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধ চলবে। হয়ত আমি থাকব না তবে বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই। বেনবেল্লা বেনখেদ্দার মত হয়ত আমিও দেশের মঞ্চ থেকে অপসারিত হয়ে যাব, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।” নিয়তির কি অদ্ভুত পরিহাস ! তবে অপসারণ কি বেনবেল্লা বা বেনখেদ্দার মত হয়েছিল ? মন তখন উদগ্রীব-কখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব , মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করব, অংশগ্রহণ করব। রওনা দিলাম বনগাঁর উদ্দেশ্যে। কাছাকাছি এসে পথিমধ্যে দেখা হল ক্যাপ্টেন হাফিজের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের আবহাওয়া এসে গা ছুয়ে গেল- গেলাম স্কুলের মাঠে। যশোর সীমান্ত হতে পশ্চাদাপসরণ করে তারা আস্তানা গেড়েছেন এখানে। যুদ্ধ করতে হলে কৌশলের দরকার। পিছিয়ে এসে নিজেদের সংগঠিত করার মধ্যে কাপুরুষতার কিছু নেই, আছে যুদ্ধজয়ের পথ। আমার ধারণা বাস্তবভিত্তিক বলে প্রমাণ পেলাম যখন
দেখতে পেলাম সৈনিক-যুবক-শিক্ষক-ছাত্র সবাই ট্রেনিং নিচ্ছে। নেতাদের নেতৃত্ব প্রাথমিক না হওয়াতে সংগঠিত যুবকরা আত্নত্যাগের আপন মহিমায় উজ্জ্বল। নেতাদের বিবৃতি এবং বক্তৃতা স্হূল এবং মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। ক্যাপ্টেন হাফিজের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম মাও-সে-তুং এর গেরিলা তও্ব সে পড়েনি তবে অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝতে পেরেছে যখন শত্রু আক্রমণ করে তখন পিছিয়ে যেতে হবে যখন শত্রু অসতর্ক থাকবে তাকে আঘাত করতে হবে, যখন শত্রু পালাবে তখন ধ্বংস করতে হবে। ভারত সরকারের কাছে দেশের পূর্ব সীমান্তে যাওয়ার অনুমতির জন্য। আবেদন করলাম। এক সপ্তাহ চেষ্টা করবার পরও ভারত সরকারের অনুমতি না পেয়ে পূর্ব সীমান্তের দিকে রওনা দিলাম। পোঁছেই বুঝতে পারলাম চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে সিলেট পর্যন্ত প্রকল্পিত করে তুলছে মুক্তিযোদ্ধারা। এক অদ্ভুত উন্মাদনা সবার মধ্যে। শুধুমাত্র ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে, এবং সে খরচ ছাড়া অন্য সব কিছুর খরচ যেমন—চাল-ডাল ইত্যাদি তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে সংগ্রহ করে আনছে। দেখেছি ডাক্তারকে কম্যাণ্ড করতে, সাংবাদিককে বন্দুক হাতে, ইঞ্জিনিয়ার-শিক্ষক কৃষক-শ্রমিক তথা সর্বস্তরের বাঙালীকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। এই ঐক্যফ্রন্ট মুক্তিযুদ্ধের উপাদান। সকল শ্রেণীর সমন্বয় ও সঠিক বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ। এ সময় দীর্ঘস্থায়ী হলে, যুদ্ধ দুই বছর চললে, নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছিলাম নেতৃত্বের হাত বদল হয়ে এবং প্রতিষ্ঠা হবে বাংলাদেশের বুকে অর্থনৈতিক আমল পরিবর্তনে জনগণের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। বেলুনিয়া-সালদা-চিলমারী-কামালপুরে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, যারা এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাদের মানসিকতা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং বাস্তবভিত্তিক। দিনের পর দিন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেসঙ্গে প্রয়োজন বাড়ছে অস্ত্রের—অস্ত্র চাই। বুঝতে পারছিলাম কেন প্রবাসীদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের জন্য আবেদন ? কিন্তু একইসঙ্গে মনে পড়ছিল মুজিবনগর থেকে প্রবাসী বাঙালী সংগঠনের প্রতি নির্দেশ–‘অর্থ জমা রাখ’। নেতারা ভাবতেই পারছিলেন না যে একমাত্র প্রতিবেশী দেশ নয়, অন্য দেশগুলো থেকেও অস্ত্র যোগাড় সম্ভব। নেতৃত্বের এই দেউলিয়াত্ব তখন ছিল হতাশাব্যঞ্জক। নেতারা স্বাধীন নয়, দিল্লীর নিদের্শ ছাড়া একটি সিদ্ধান্ত নিতেও অপারগ। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে একের পর এক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিজয়ের খবর শুনেছি। জয়ের খবরের উন্মাদন ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে। জুলাই, ১৯৭১-ঢাকা কম্যান্ডারের নির্দেশ এল, বাংলাদেশের অভ্যন্তরের কিছু খবর সংগ্রহ করতে হবে এবং সচক্ষে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আসতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা সংগে নিয়ে ত্রিপুরা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। অভ্যন্তরে গ্রামের কৃষক হল আমাদের পথপ্রদর্শক। পথে পথে গ্রামের জনসাধারণের সাহায্য। এবং সহযোগিতা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করছিল দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বাত্মকভাবে আবেগাপ্লুত। লংমার্চের ইতিহাসের সবক’টি উপাদান না থাকলেও তার অনুসরণ ছিল পথিমধ্যের প্রমাণগুলিতে। না হলে, এ সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া ঢাকায় পৌঁছান আমাদের সম্ভব ছিল না। নির্দেশ ছিল ঢাকার কতকগুলি অঞ্চলে আমাদের যাওয়া চলবে না। এর মধ্যে আমার বাড়িও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা না করারও নির্দেশ ছিল। কিন্তু ঢাকায় যে নির্দিষ্ট স্থানে, যাদের থাকবার কথা ছিল তাদের না পাওয়ায় কার্ফু শরু হয়ে যাওয়ায় উপায় না দেখে বাড়িতেই যেতে হল মুক্তিযোদ্ধাসহ। রাত তখন ন’টা বাজে। আলবদরের হেডকোয়ার্টার পার হতে হল। বাড়িতে এসে দরজা নাড়তেই টপ করে আলোটা নিবে গেল। অনেকক্ষণ পর দরজা খুলতে ছোট ভাই-বোন ভূত দেখার মত চমকে উঠল। এতদিন পরে আমাকে দেখেও মা নির্জীবের মত শুধু ঠোঁট দুটি নেড়ে বললেন-“কবে এসেছ”? আমি উত্তর দিলাম “আজকে।” মা-বললেন, “আজ ত’ ঢাকায় এসেছে, বিলেত ছেড়েছো কবে ?” বুঝতে পারলাম বিদেশী আবহাওয়ার চাকচিক্য মুছে গেছে এতদিনে। সতর্ক হলাম। মা বললেন একইভাবে,-“যারা মারা গেছে এক হিসাবে তাঁরা ভাগ্যবান। তাঁদের আর অত্যাচার সইতে হবে না। মত্যুর অপর পার থেকে ভবিষ্যতে তাঁরা শান্তিতে দেখতে পাবে দেশের লোকের মুখে হাসি ফুটেছে। হাসিমুখে বাঙালী—নিন্দ্রা যাচ্ছে। যারা দেশত্যাগ করেছে তাঁদের কষ্ট হচ্ছে প্রচুর কিন্তু ভীতিতে নেই। তারা জানে যুদ্ধে জয় হবেই, এবং জয়ের বেশে তাঁরা দেশে ফিরতে পারবে। আর আমরা যারা দেশের ভিতরে আছি, প্রতিনিয়ত ভাবছি আজকের রাত্রিটা কাটবে কিনা!”—আশ্চর্য হলাম আমার সামান্য পড়াশুনা জানা চিরকালের সংসারে আবদ্ধা মা কি সুন্দরভাবে শহীদ বাঙালী, দেশত্যাগী এবং দেশের অভ্যন্তরে পরাধীনতায় আবদ্ধ বাঙালীর বিশ্লেষণ করলেন। জাতিগত নিপীড়ন কত সচেতন করে তুলেছে সমগ্র বাঙালী জাতিটাকে। নির্দেশ ছিল মেডিক্যাল কলেজ কিংবা শহীদ মিনারে যাওয়া চলবে না। কিন্তু বাঙালী আবেগতা রাখতে পারলাম না। শহীদ মিনারের এত কাছাকাছি আছি অথচ শহীদ মিনারকে দেখতে পাবনা—এটা যেন কেমন খচ খচ করছিল। পায়ে পায়ে হেটে চললাম শহীদ মিনারের দিকে। ঠিক করে রেখেছিলাম থামব না হাঁটতে হাঁটতেই দেখে যাব। শহীদ মিনারের কাছে যেয়ে দেখলাম শহীদ মিনারের গায়ে লেখা আছে “মসজিদ”। আনমনা ভাবটা কাটল পিঠের উপর প্রচণ্ড এক থাপড়ে ।–“কেয়া দেখতে এতনা গাওর সে’’। চমকে উত্তর দিলাম, “কুছ নেহি, মসজিদ দেখ রেহা।” পাকবাহিনী। জিজ্ঞেস করল-“গাশ নেখলাও”। মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাড় করা মুসলিম লীগের নেতার জাল স্বাক্ষর করা পাশ দেখালাম মিলিটারিটিকে। প্রচণ্ড জোরে এক ধাক্কা দিল, মুখে বলল, “ইধার সে ভাগো”। শহীদ মিনারের নিচে একজন বাঙালী হিসাবে এতবড় অপমানের প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছা হচ্ছিল। ধরে ফেলতে চেয়েছিলাম মিলিটারিটিকে। কিন্তু দুরে সহমুক্তিযোদ্ধাটি হাত ইশারায় চলে আসতে বলল। কম্যান্ডারের নির্দেশ উপেক্ষা করছি, তাই সংযত হলাম। দেশত্যাগ করলাম নির্দিষ্ট কাজ শেষে। একটি অভিজ্ঞতা হল, জাতীয় বিপ্লব সম্ভবপর। সেক্ষেত্রও প্রস্তুত। কিছু জাতীয় বুর্জোয়া এ আন্দোলনে অংশগ্রহণও করেছিল। এর প্রমাণস্বরুপ এক বুর্জোয়া জানিয়েছিলেন, তার নিজের ন্যাপথা ভর্তি জাহাজ কবে চাঁদপুরে থাকবে, এবং তা যদি আমরা উড়িয়ে দিতে পারি তাহলে সে জাহাজের আগুন সমগ্র চাঁদপুরকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে। সে বুর্জোয়ার খবরটি সম্পূর্ণভাবে সত্যি ছিল। সমগ্র জাতির আচরণে মার্কস-লেনিন-মাওয়ের তত্তের সত্যতা আরেকবার প্রকাশ হল। আমাদের দেশের যুবকরা সারা দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগে বলীয়ান হয়ে উঠছিলেন ক্রমান্বয়ে, তাদের পথ হয়ত ভিন্ন ছিল কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল এক, সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা। সামন্তবাদী শোষণ ব্যবহার পরিবর্তন হয়ে আসবে নতুন এক দেশ, যেখানে থাকবে না অতীতের শোষণ ব্যবস্থার অভিশাপ। তাই গ্রামের সেই মালকোচা দেওয়া লুঙ্গি পড়া ছেলে মার্কসীয় তও্ব পড়েনি, জানত না ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বােডীয়ার ইতিহাস, জানত না চীনের বিপ্লবী ধারা—কিন্তু গড়ে তুলছিল এদেশকে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে স্থায়ী স্বাধীনতার জন্য অবচেতনে গড়ে উঠছিল চীনের লংমার্চের মত ইতিহাস। মানুষের কাফেলা চলছিল নিরাপদ স্থানে, যেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যেতে চাচ্ছিল, স্বাধীনতার পথে। কিন্তু, সত্যিকারের স্বাধীনতার পথ বন্ধ হল আবারও। যে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে পরিবর্তন আসত সমাজের, পরিবর্তন আসত অর্থনৈতিক অবস্থায়, পরিবর্তন আসত মানসিকতার, দেখা গেল জাতীয় মুক্তির যুদ্ধ ও জাতীয় নিপীড়নের সংগ্রাম যেন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও সম্প্র সারণবাদ বিরোধী সংগ্রামে পরিনত না হয়ে তা নিশ্চিত করার জন্য ভারতও তার মিত্রশক্তি সাহায্যের হাত বিস্তার করল ব্যাপক অর্থে তাদেরই স্বার্থে। কারণ আমাদের দেশে পরিবর্তন সে দেশেরও জনতার কাছে দৃষ্টান্ত হবে, তাই তাদের শঙ্কিত হবার যথেষ্ট কারণ ছিল।
সেপ্টেম্বর, ১৯৭১-কলকাতা। আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম, সে খবর নেতৃবৃন্দ পেয়ে ডেকে পাঠালেন আমাকে কলকাতায়। আমি যেন একটা সাংঘাতিক কিছু করে ফেলেছি। তাদের কেউ কেউ বললেন—আমি নাকি সাংঘাতিক কাজ করেছি। অবাক হলাম। বললাম, আমার মত প্রত্যেকদিন ত হাজার মুক্তিযোদ্ধই যাচ্ছে, দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করছে। আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে আরেকজন বললেন তাহলে সত্যিই দেশের ভেতরে যুদ্ধ হচ্ছে ? নেতাদের সঙ্গে মুক্তিযযাদ্ধাদের যে কত দূরত্ব তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম। রেডিওতে তারাই খবর দিচ্ছে, যুদ্ধের কথা বলছে দেশে-বিদেশে, অথচ তাঁদেরই যুদ্ধের প্রতি কতবড় অবিশ্বাস। এই দুরত্ব এবং অবিশ্বাসই হয়ত তাদের ঠেলে দিয়েছিল “সেপ্টেম্বরের চুক্তিতে”। জানতে পারলাম সেপ্টেম্বরেই বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গেছে। যুদ্ধ এ বছরই শেষ হবে ডিসেম্বর মাসে,। সত্যিকার স্বাধীনতার উদ্দেশ্য কোনদিনই আর সফল হবে না। ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধের মাঝে আরও প্রাণ দিতে হবে যুদ্ধ দেখানোর জন্য দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের একটি মানবশিশুরও জন্ম নিতে হয় সময় নেয় তার চেয়েও কম সময়ে আমাদের দেশের স্বাধীনতা আসছে। ভৌগোলিক স্বাধীনতা আসবে হয়ত কিন্তু উপযুক্ত সময়ের আগে একটি দেশের জন্ম কখনও সাধারণ মানুষের মুক্তি আনতে পারবে না। সেপ্টেম্বরের চুক্তির আপত্তি করেছিল কেউ কেউ। যার জন্য আজও প্রশ্ন থেকে যায় অনেক! কর্ণেল ওসমানী তাদের একজন। ১৬ই ডিসেম্বর কর্ণেল ওসমানীর বিমানের উপর অতর্কিত আক্রমণ হয়। এর পূর্বেই সব পাকিস্তানী বিমান ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। এটা কি সত্যিই কোন দুর্ঘটনা ছিল না সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, সেপ্টেম্বরের চুক্তি-না-মানতে চাওয়ার ?
তবুও শেষ চেষ্টা করলাম যুদ্ধের পরে যেন স্কুল-কলেজ এক বছর বন্ধ থাকে। উৎপাদনের মালিকানা পরিবর্তন করে শ্রমিকরা যাবে উৎপাদন ক্ষেত্রে, ভূমির সংস্কার করে কৃষকেরা যাবে কৃষি উৎপাদনে। ছাত্র-সৈনিকরা ব্যস্ত হবে দেশ গড়ার কাজে। ১৬ বছরের যে ছেলে নিজ হাতে নিজের দেশের সেতু ভেংগেছে সেই সেতু সেই ছেলে গড়বে দেশগড়ার জন্য। কিন্তু নেতাদের মধ্যে রয়েছে উপনিবেশিক শিক্ষা। চমকে উঠল তারা এ ধরনের প্রস্তাবে। ছেলে-মেয়েদের, এক বছর শিক্ষা নষ্ট হয়েছে আর দেরি করা যাবে না, তাহলে তারা সব উচ্ছন্নে যাবে। এমন মুখের চিন্তাধারা পরবর্তীকালে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাটাকে কোথায় নামিয়েছিল তার আর উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। অনেকপরে বুঝেছিলাম এসব নেতাদের সাথে কথা বলা আর কালক্ষয় করা সমান। এক বছরের পড়াশনা নষ্ট হওয়ায় স্কুল-কলেজ খুলে তার পরিণতি গোটা জাতির কাছে এক বিভীষিকার পর্যায়ে গেল। নিজেদের বোকামিতে ছেলেদের গড়ে তুলল হাইজ্যাকার করে। পাকিস্তান আমলে যাদের বলা হত দুষ্কৃতকারী, স্বাধীনতা আন্দোলনে যাদের বলা হত দুষ্কৃতকারী, স্বাধীনতার পরেও তারা থাকল দুষ্কৃতকারী হয়ে। জানি না ভবিষ্যতেও তারা একইভাবে দুষ্কৃতকারী হিসাবে গণ্য হবেন কি না ?
তারপর ? সুযোগ এসেছিল ১৯৭২-এ। স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা নিয়ে। যে দৃপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তথা মুক্তিকামী জনতা জ্বেলেছিলেন মশাল; তাদেরকে সঠিক পথে সংগঠিত করবার সুযোগ এল প্রচণ্ড। প্রতি আন্দোলনে, বিক্ষোভে, বিদ্রোহে থাকে আবেগ। শ্রেণী বিভক্ত মানুষের নিজ নিজ শ্রেণী থেকে সে আবেগ পরিচালিত হয়। কিন্তু ব্যাপকতর অর্থে তার চরিত্র থাকে এক। যে দেশের সঠিক নেতৃত্ব সে আবেগকে জাতীয় স্বার্থে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছে, সেদেশই উন্নতির দিকে যেতে পেরেছে। আর তা হলে স্বাভাবিকভাবেই যে স্বপ্ন নিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছে, তাঁর সঙ্গের সাথীকে চোখের সম্মুখে রক্তাক্ত দেহে শহীদ হতে দেখেছে, নিজে পঙ্গু হয়ে পড়ে থেকেছে, হয়ত উপার্জনক্ষম হিসাবে সংসারের এক জন হয়েও দেশকে মুক্ত করতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনহীন, অনাহারে হারে যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুকে টেনে নিয়েছে, সে মুক্তিযোদ্ধা যখন তার স্বপ্নকে চোখের সম্মুখে বাস্তবে হতেই শুধু দেখবেন না তা নয়, বাস একদিন তার সঙ্গের সাথীর মৃত্যুর কারণ হয়েছে অথবা যার এক বিশ্বাসঘাতকতার দোষে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে তাদেরকে দেখতে পাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্হায়, রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের নাট-বল্টুর মত, তখন মুক্তিযোদ্ধা তথা মুক্তিকামী জনতার বিক্ষোভ বাস্তবসম্মতভাবে স্বাভাবিক এবং এ বিক্ষোভ যে কোনভাবেই প্রকাশ করে মানসিকতাও স্বাভাবিক। স্বাধীনতার পথে দেশ দ্বিতীয়বার লুঠিত হল সাহায্যকারী দেশ কর্তৃক প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃবৃন্দ জনগণের রক্তদানকে অস্বীকার করল। নেতৃবন্দ ভাল ভাল কথা, রাজনৈতিক বুলি ও সিদ্ধান্ত নিতে থাকলেন একের পর এক। জাতীয়করণ করা হল কলকারখানা, কিন্তু দায়িত্ব দেওয়া হল এগুলোকে তাদেরই চালানোর যারা পুর্বের হয় মালিক ছিল না হয় শোষকশ্রেণীর অতৃভক্ত ছিল। ফলতঃ মিলমালিক কিংবা আমলারা কখনও উৎসাহ বোধ করেনি, জাতীয়করণের সফল জনসাধারণকে ভোগ করতে দেয়নি। তারা চেয়েছিল এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হে দেশের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ার দায়িত্ব দেওয়া হল সেসব আমলাদের যারা এতে বাসা নয় বরং এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। এ ব্যাপারে আমাদের দেশের প্রগতি বাদী বলে দাবিদাররা হয় অজ্ঞ ছিলেন না হলে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তাই ত প্রতিক্রিয়ায় জনগণের মধ্যে সমাজতন্ত্র বিরুপ ধারণার সৃষ্টি হল। সেদিনের সমাজতন্ত্রের নামে ভাওতাবাজি দেশকে কতদূর পিছিয়েছে ইতিহাসই তার প্রমাণ দিবে। ( নেতৃবৃন্দ প্রাথমিক অবস্থাতেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন জনগণের উপর আস্থা না রেখে, জনগণের উৎপাদনমুখী চরিত্রের উন্নতি না করে, চারদেওয়ালের মধ্যে বসে থেকে দুর্ভিক্ষে বিভীষিকা সৃষ্টি করে নত জান হয়ে ভিক্ষা চাইল সাহায্যের। সুযোগ করে দিল পুজিপতিদের ও তাদের প্রতিভূ, বিশ্বব্যাঙ্কের অবাধ প্রবেশের নেতাদের চরম বিশ্বাস ঘাততার প্রত্যুত্তরে জনতা—সিপাইয়ের বিদ্রোহ পূর্বের নেতৃত্বের অবসান করে দেশকে আবার নতুনভাবে ঢেলে সাজাবার সুযোগ করে দিল। আবারও কি পূর্বের ভুলের পুনরাবৃত্তি দেখবে এদেশের মানুষ? আবারও কি শহীদ মিনার শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ঘটনার শহীদ মিনার হয়ে থাকবে? সাধারন মানুষের মুক্তির শহীদ মিনার কি হবে না?
এরা বলছে উৎপাদন বাড়ছে, হয়ত ঠিকই কিন্তু তার সুষম বণ্টন বই। জোতদারদের শোষণে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের দৌরাত্ম বাড়ছে। জাতীয় বুর্জোয়াদের চরিত্র আবার গণবিমুখ হয়ে উঠছে। বিদেশে রফতানী বেড়েছে ঠিকই কিন্তু ঋণের পরিমাণ হয়েছে। জনগণের আয়ের পরিমাণ কমেছে। এসব সমস্যার সামগ্রিক বিশ্লেষণ করতে পারলে সাধারণ মানুষের সার্বিক মুক্তি সহায়ক হতে পারেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়া। তাহলে ২৭শে মার্চ, ১৯৭১ রাতে চট্টগ্রাম ও তাঁর নিজেরই ঘোষণা সত্যিকার অর্থে রূপ নিতে পারে! ১৯৭১ রাতে চট্টগ্রাম থেকে তার নিজেরই ঘোষনা সত্যিকার অর্থে রুপ নিতে পারে।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.09.09-10.pdf” title=”1977.09.09″]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!