You dont have javascript enabled! Please enable it!

ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতি | মাহবুব উল্লাহ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭

সমকালীন সময়ের ইতিহাস বিধৃত করা এক বিরাট সমস্যা। রজনী পাম. দত্ত তাঁর প্রবলেমস, তার কনটেমপরারী হিস্ট্রি ( Problems of Contemporary History) গ্রন্থে এ সমস্যা সমপর্কে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। সুতরাং আমাদের পক্ষে ষাটের দশকের রাজনীতি নিয়ে আলোচনার অবতারণা করা, সত্যি এক দুঃসাহসিক ঝুকির ব্যাপার। কারণ বাংলাদেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল এই সময় কালে আমি নিজেও খানিকটা সচেতনভাবে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলাম। সুতরাং এই আলোচনা আর্দশিক দৃষ্টিভঙ্গী নিরপেক্ষ হতে পারে না। ॥ দুই ॥ • ‘৬২-এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সামরিক শাসনের ধাক্কা সামলে ছাত্র ইউনিয়ন তখনো সুসংগঠিত হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু সর্বত্রই সাংগঠনিক কাঠামো ছিল। সংগঠনের এই ন্যূনতম রূপটি বজায় থাকার পেছনে কমিউনিস্ট পার্টির গোপন তৎপরতা সহায়তা করেছে। এই প্রয়াস শুধুমাত্র সংগঠনের কাঠামোটিকে কোনক্রমে টিকিয়ে রাখার মধ্যেই সীমিত ছিল। সামরিক শাসনের বেড়াজাল সত্ত্বেও ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কিছু, রাজনৈতিক তৎপরতা চালাত। ছাই ইউনিয়নকে পরিচালনা করার ব্যাপারে মাঝে মাঝে পার্টি নেতৃত্ব ও ছাত্র নেতাদের মধ্যে বিরোধ বাধত। এই সংক্রান্ত কিছু কিছু কাহিনী তৎকালীন ছাত্র নেতাদের কাছে থেকে আমরা শুনতে পেয়েছি। আন্দোলনের প্রশ্নে পার্টি নেতত্বের সব সময়েই একটা জড়তা ও সহবিরতা লক্ষ্য করা যেত। সামরিক শাসনামলের প্রতিশ্রতিবান ছাত্রনেতা আনোয়ার জহিদ বলেছেন, সামরিক আইন লংঘিত হবে এই আশংকায় পার্টি নেতারা হল সংসদ নির্বাচনেও অংশ গ্রহণের মত দিতেন না। এতদসত্ত্বেও পার্টির নির্দেশকে উপেক্ষা করে ছাত্র-ইউনিয়নের সমর্থকেরা নির্বাচন করেছেন। ‘৬০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে পাটির সিদ্ধান্ত ছিল শহীদদের মাজার থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত মৌনমিছিল করা। আনোয়ার জাহিদ বলেছেন, সেই মিছিলে তিনি যখন একটি রাজনৈতিক শ্লোগান তুললেন তখন গোটা মিছিলটাই শ্লোগানে শ্লোগানে সরব একটি রাজনৈতিক বিক্ষোভ মিছিলে পরিণত হলো। শসিকগোষ্ঠীর সমস্ত নিষেধের বেড়াজাল খড়কুটোর মত ভেসে গেল। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে ২১শে ফেব্রুয়ারী-কে কেন্দ্র করে নূতন এক ট্রাডিশন গড়ে উঠেছে। আর তা হ’ল অগণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞার ফলে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর আর কোন পথ থাকে না তখনি ২১শে ফেব্রুয়ারী হয় বরফ ভাঙার উপলক্ষ্য। গণবিরোধী কিংবা গনমুখী সকল শক্তিই এই দিবসটিকে নিজ নিজ রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের কাজে ব্যবহার করে। এখানে বলে রাখা দরকার পার্টি নেতত্ব অবশ্য পরবর্তীকালে আনোয়ার জাহিদের এই বীরত্বপর্ণ সাহসিকতাকে অভিনন্দিত করেছিলেন এবং নিজেদের ভূল মূল্যায়নের সমালোচনা করেছিলেন। উপরোক্ত আলোচনা থেকে একটা জিনিস পরিস্কার হয়ে উঠেছে যে ‘৬২-এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের প্রক্রিয়া সামরিক শাসনের চরম বিভীষিকাময় দিনগুলিতেই শুরু হয়েছিল। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতার ছিল উপলক্ষ্য মাত্র। সোহরাওয়ার্দী মার্কিন ঘেষা প্রবণতা সত্বেও ছাত্র-ইউনিয়নের নেতারা মনে করতেন তার গ্রেফতারের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠবে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবী, রাজবন্দীদের মুক্তির দাবী ও গণতন্ত্রের দাবী। প্রাসাদের ষড়যন্ত্র রাজপথে ছাত্র জনতার বিক্ষোভে ভেঙে গড়ে গড়াে হয়ে যাবে। সত্যিই তাই হয়েছিল। কেবলমাত্র শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির দাবীই আন্দোলনের মুল শ্লোগান হয়ে থাকলো না। এই শ্লোগানকে ছাপিয়ে যেসব শ্লোগান বল হয়ে উঠলো, সেসব হলো সামরিক আইন প্রত্যাহার, রাজবন্দীর মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবী। এই আন্দেলনের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনের কালো দিনগুলিতে তৎকালীন পাকিস্তানের বামপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তির উপর যে নির্মম নির্যাতন হয়েছিল তার কাহিনী প্রকাশ পেল। একে একে প্রকাশ পেল লাহোর দূর্গের নির্জন প্রকোষ্ঠে তৎকালীন পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হাসান নাসিরের হত্যা কাহিনী, বেলুচিস্তানের সামরিক বাহিনীর নির্মম নিপীড়নের লোমহর্ষক কাহিনি, মোমেনশাহরি কৃষকনেতা কাজী আবদুল বারী কি করে সামরিক আইনের বেত্রদণ্ডের ফলে শ্রবন শক্তি হারিয়েছিলেন ও কৃষকনেতা নগেন সরকারের দীর্ঘ কারা জীবনের কাহিনী। এছাড়াও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শত শত বীর যোদ্ধাদের অসংখ্য আত্মত্যাগ ও নিপীড়ণ নির্যাতন ভোগের কাহিনী জনসমক্ষে প্রকাশ পায়। নীরবে নিভৃতে গণতন্ত্রের সাচ্চা সৈনিকের দেশ, জাতি ও জাগনের মন্তির কামনায় যে অত্যাচার সয়েছিলেন সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেইসব বীর গথি লোক লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ‘৬২-এর ফেব্রুয়ারী আন্দোলনের পর ুল-কলেজ কিছু দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলে আন্দোলনে একটা স্তিমিতভাৰ নেমে আসে। ছাত্র- নেতার বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ এই দুই সংগঠনের নেতত্ব যারা গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবীতে ছিলেন আপোষহীন তারা বঝে উঠতে পারলেন না কি করে গণতন্ত্রের এ আন্দোলনকে এগিয়ে নেবেন ? শাসকগোষ্ঠী সেই সুযোগ করে দিলেন। ‘৬১ সাল থেকেই আইয়ুবের শিক্ষা কমিশনের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনারেল আইয়ুব খানের প্রাক্তন শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ শরীফ ছিলেন এই কমিশনের চেয়ারম্যান। শিক্ষা কমিশনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল—“শিক্ষা হল একটি পণ্য। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যেমন বাজারদরে পণ্য বিকিকিনি হয় শিক্ষার ব্যজারেও শিক্ষা নামক পণ্যকে ক্রয় করতে হবে। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের এই পুজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী সাধারণ ছাত্র সমাজের বোধগম্য না হলেও রিপোর্ট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কতকগুলি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ছাত্র সমাজকে বিক্ষবন্ধ করে তোলে। এসব পদক্ষেপগলির মধ্যে ছিল তিন বছরের ডিগ্রী পাসকোর্স চাল, এইস, এস, সি ক্লাসে ইংরেজী পাঠ্যপুস্তকের অতিরিক্ত বোঝা, প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি। যেহেতু সমস্যাগুলো ছিল মূলতঃ কলেজ ছাত্রদের সেহেতু কলেজ পর্যায়েই শিক্ষার ক্ষেত্র এইসব সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠে । ছাত্ররা একে তোগলকি শিক্ষা বলে আখ্যায়িত করে। ঢাকা কলেজ থেকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ডিগ্রীর ছাত্ররাই প্রথমে আন্দোলন শুরু করেন। ঢাকা কলেজে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন জনৈক এম, আই, চৌধুরী। তিনি ডিগ্রীর ছাত্র ছিলেন এবং ‘মনের বীনায়’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এর পাশাপাশি এইচ, এস, সির ছাত্ররাও সভা ও বিবৃতি প্রদান করতে পার করেন। জুলাই মাস থেকে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে নিয়ে ছাত্র অসন্তোষের সচনা হয়। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর অভাবে আন্দোলনের সূচনা লগ্নে ও উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্রদের তেমন কোনো সমন্বয় ছিল না। আন্দোলনের ঢেউ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা এসে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। স্নাতক ছাত্ররা লাগাতার ধর্মঘট পর করলেন। উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্ররা ইংরেজীর ক্লাস বর্জন করলেন। এই সময়ে ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কাজী ফারুক আহমেদ। কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর তেমন কোন যোগাযোগ ছিল না। তিনি ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন—এক পর্যায়ে তিনিও কলেজ ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এবং এই আন্দোলনকে একটা সংগঠিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। ১০ই আগস্ট (১৯৬২) বিকেল বেলায় ঢাকা কলেজ কেন্টিনে এক ছাত্ৰ-সভা অনুষ্ঠিত হল। এই সভায় ডিগ্রীও এইচ, এস, সির ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে যোগদান করে। তিনি ছাত্রদের বিশ্লেষন করে বুঝিয়ে বললেন শিক্ষার আন্দোলন ও গণতন্ত্রের আন্দোলন একত্রে গাঁথ্য। সুতরাং এই আন্দোলনে গণতন্ত্রের দাবী ও শিক্ষার দাৰীকে সন্নিবেশিত করতে হবে। ছাত্ররা তাঁর আহৰানে অনুকূল সাড়া দিল । ১০ই আগস্টের সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হল ১৫ই আগস্ট দেশব্যাপী সাধারণ ছাত্র ধর্মঘট পালিত হবে। বন্ধুতঃ এই সভাৱ পের শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠণগলের তেমন কোন যোগাযোগ ছিল না। কেন্দ্রীয় ছাত্র নেতারা তখন মনে করতেন শিক্ষা সংক্রান্ত দাবী দাওয়ার প্রশ্নে বিরাট ও ব্যাপক আন্দোলন হওয়ার সম্ভবনা কম। আমি পূর্বেই বলেছি এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ঢাকা কলেজ থেকে। তখন এই কলেজের কয়েকজন ছাত্র এই আন্দোলনের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। এদের মধ্যে জনাৰ নুরুল ইসলাম (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি), জনাৰ সলতান মাহমদ খান, জনাব আবদুর রশীদ, জনাব আহসান আলী ও জন্য শাহ, সালাউদ্দীনের নাম উলেখযোগ্য এরা প্রথমদিকে যখন আন্দোলনের প্রনটি নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন কেন্দ্রীয় নেতারা অনেকটা অনীহার সঙ্গে আন্দোলনের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে সম্মত হলেন। ১৫ই আগস্ট দেশব্যাপী সফল ছাত্র ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে শিক্ষা আন্দোলন, ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন পরবর্তী বৃহৎ কর্মসুচী ছিল ১০ই সেপ্টেম্বর সেক্রেটারিয়েটের সামনে অবস্থান ধর্মঘট। ১৫ই আগস্ট থেকে ১০ই সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় বেশ কয়েকটি ছাত্রসভা ও সেখান থেকে বেশ কয়েকটি বিক্ষোভ মিছিল ও বের হয়। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়এর হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এসব বিক্ষোভ মিছিলে অংশ গ্রহণ করছেন। ১৪৪ ধারা জারী করার ফলে ১০ই সেপ্টেম্বর অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসুচী প্রত্যাহার করা হয়। ১৪৪ ধারা জারি করতে গিয়ে সরকারী প্রেসনোটে হুমকি দেয়া হল ‘যদি কেউ এই “শ ভঙ্গ করে সেক্রেটারিয়েট ভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘটের চেষ্টা করে তাহলে তার পরিণতি অত্যন্ত মারাত্মক হবে।” অবদান ধর্মঘটের কর্মসূচী প্রত্যাহার করা হলেও ১৭ই সেপ্টেম্বর সারা পূর্ব-পাকিস্তানে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। হরতালের কর্মসূচীর মধ্যে ছিল সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় ছাত্র-জনসভা ও সভাশেষে বিক্ষোভ মিছিল। ১০ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ই সেপ্টেম্বর রাজধানীতে ছোট ছোট স্কোয়াড মিটিং, পথসভা ও খণ্ড মিছিলের আয়োজন করে হরতালের পক্ষে জনমত সৃষ্টির করা হল। এ ছাড়া বিভিন্ন কর্মচারী সমিতি, ব্যবসায়ী সমিতি, রিকশা ইউনিয়ন ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। সর্বত্র হরতালের সমর্থনে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল। ১৭ই সেপ্টেম্বর কাকডাকা ভোর হতে ঢাকা নগরীর মিছিলের নগরীতে পরিণত হল। দোকান-পাট, অফিস-আদালত, যানবাহন সব বন্ধ, রাস্তায় রাস্তায় শুধু মানুষ আর মানুষের মিছিল। সকাল ৯টায় ঢাকা কলেজ থেকে আমরা একদল ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় গিয়ে হাজির হলাম। আমতলায় এতলোকের সমাবেশ হলো যে সভার নিয়ম-শৃংখলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। রাজপথের বিক্ষোভ মিছিলে মেহনতী মানুষের সংখ্যাই ছিল শতকরা ৯৫ জন। এমন কি বড়গঙ্গার ওপার থেকে নৌকার মাঝিরা বৈঠা হাতে মিছিল নিয়ে আসে। জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সভা বাতিল করা হল। মিছিল শুরু হল। মিছিলের সঙ্গে কার্জন হলের সামনে আসতেই দেখলাম মোনেম-এর মন্ত্রীসভার সদস্য হাসান আসকারীর মার্সিডিজটি চাকা উল্টে পরে আছে ও আগুনে দাউ দাউ করে জলছে। এর পাশেই আরেকটি পুলিশের জিপও আগনে জলছিল। মিছিল আৰদুল গনি রোডের মোড়ে আসতেই পুলিশ গুলি চালালো। কে একজন পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। আহত ব্যক্তিকে ছাত্ররা ধরাধরি করে কার্জন হলের চত্বরে নিয়ে এলো। কিছুক্ষণ বিরতির পর আহত ব্যক্তির রক্তমাখ্য শার্ট নিয়ে শহর হলো জঙ্গী মিছিল। একই দিনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হলেন ওয়ালীউল্লাহ ও বাবুল। ১৭ই সেপ্টেম্বরের অপর বৈশিষ্ট্য একজন সচেতন রাজনৈতিক কর্মীও পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তিনি ছিলেন ন্যাপ কমী আবদুস সামাদ। সাধারণ কোনগিরির কাজ করতেন তিনি। গুলীবিদ্ধ হয়ে তার হাতে প্রচণ্ড জখম হয়। দীর্ঘদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা সত্ত্বেও তাঁর হাতটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি। এই পংগু হাত নিয়ে তিনি আজও বেঁচে আছেন। ঢাকায় বিক্ষোভ ও হরতালকে কেন্দ্র করে রাজধানীর আইন-শৃংখলা পুন প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর উপর অর্পণ করা হল। তৎকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন জনাব গোলাম ফারুক। ১৮ই সেপ্টেম্বর সকাল ৮ টায় সলিমুল্লাহ হলের শহীদ পার্কে শহীদদের জন্য গায়েবানা জানাযা ও মোনাজাত করা হল। উল্লেখ্য যে, এই জানাজায় বালুচ নেতা খায়ের বকস, মারী ও গাউস বকস বেজেঞ্জো শরীক হন। নামাজের পর দুজন দুজন করে পাঁচ হাতের ব্যবধানে লাইন করে এক বিরাট শোক-মিছিল বের হয়। পুলিশ কিংবা ই, পি, আর এই শোক-মিছিলে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেনি। শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন করাচীর কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন। ১৭ই সেপ্টেম্বরের গণ-অভ্যুত্থানকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সেই ব্যাপার নিয়ে তিনি নিজস্ব উদ্যোগে গর্ভনর গোলাম ফারুকের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ঠিক সেই মূহুর্তে আইয়ুব খাঁও পাকিস্তানে ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট দ্যগলের সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য প্যারিস গিয়েছিলেন। আইয়ুব খাঁন পূর্ব পাকিস্তানের এই পরিস্হিতি নিয়ে তার মারফত ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ছিলেন। শোনা যায়, গভর্নর ফারক গুলি চালাতে রাজী না হলেও আইয়ুব খানের নির্দেশে পুলিশ ও ই, পি, আর, জনতার বিক্ষোভ মিছিলের উপর গুলী চালায়, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ‘৬২-এর গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র ইউনিয়ন অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিতে ছাত্র ইউনিয়ন ছিল কমিউনিষ্ট পন্থী সংগঠন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব নিজেও ছিলেন একজন দক্ষিণপন্থী নেতা। তিনি গভর্নর গোলাম ফারুককে বোঝালেন সহিষ্ণুতার সঙ্গে ছাত্রদের দাবী দাওয়াগুলো বিবেচনা করা না হলে আন্দোলন আরও হিংসাত্মক রপ ধারণ করতে পারে এবং এতে করে কমিউনিস্টরাই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করবে। সুতরাং ছাত্রদেরকে একটা আশ্বাস দিয়ে আন্দোলন থামানোর ব্যবস্থা করা দরকার। এদিকে সোহরাওয়ার্দী সাহেব’ ছাত্রলীগ নেতাদের বোঝাতে সমর্থ হলেন যে আর বাড়াবাড়ি করলে তাতে ছাত্র ইউনিয়নই লাভবান হবে অর্থাৎ কমিউনিস্টরাই লাভবান হবে। সুতরাং একটা সমঝোতায় আসা উচিত। সোহরাওয়াদী সাহেবের পরামর্শে সরকার সায় দিলেন। অভ্যুথানের তৃতীয় দিনের মধ্যে সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস দেয়া হল শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন স্থগিত রাখা হবে। ‘৫২ ভাষা আন্দোলনের পর তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে বৃহত্তর গণ-অভ্যুত্থান এভাবেই আপোষের পথে স্তিমিত হয়ে আসলো। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ‘৬২-এর আন্দোলন কে কেন্দ্র করে ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুর রহিম আজাদ, যুগ্মসম্পাদক হায়দর আকবর খান রণো ও প্রচার সম্পাদক রাশেদ খান মেনন প্রমুখ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। এদের মধ্যে প্রথমোক্ত তিনজন ছিলেন অনলবর্ষণ কঙ্কা- বক্তৃতায় কাজী জাফরের জুড়ি তখন কাৱ আমলে ছিল না। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে তাঁর বাগ্মী তাই তৎকালে বহু ছাত্রছাত্রীকে ছাত্র ইউনিয়নে আকৃষ্ট করেছিলো। তিনি যখন আইয়বের নির্যাতন নিপীড়নের কাহিনী বলতেন তখন। অনেককে চোখের জলও ফেলতে দেখেছি। এতই মর্মস্পর্শী ছিল তাঁর বক্তৃতা। আজ-কাল যারা তার বক্তৃতা শোনেন তাঁরা ভাবতেই পারবেন না ৬২তে কাজী জাফর এত ভালো বক্তা ছিলেন। আসলে ইতিহাসের কয়েকটি যুগে একেক জন ব্যক্তি বিশেষ এমন একটি ভূমিকা পালন করেন যার মাধ্যমে ইতিহাস একটা নূতন দিকে মোড় নেয়। ‘৬২তে কাজী জাফর ছিলেন সেই মানুষ। এই প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন বর্তমানে ডেমোক্রাটিক লীগ নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও মরহম শেখ ফযলুল হক মনি-এরা দুজনেই ছিলেন ভাল বক্তা। এদের বক্তৃতায় গণতন্ত্র ও সাধারণ রাজনৈতিক অধিকারের দাবীই প্রাধান্য পেত। অপরদিকে কাজী জাফরদের বক্তৃতায় অর্থনৈতিক সংকট, গণতন্ত্রের সমস্যা ও বামপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তির উপর আইয়ুবী স্বৈরাচারের নির্যাতন নিপীড়নের কাহিনী প্রাধান্য পেত। ‘৬২-এর আন্দোলনে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনও অংশগ্রহন করে। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করতেন জনাব আবুল হাসনাত (বর্তমানে ব্যারিষ্টার)। ছাত্র-শক্তির একটি অংশও এ আন্দোলনকে সমর্থন করে। খুব সম্ভবত মিয়া মোহাম্মদ নুরুজ্জামান (জনাব ওয়াহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়ার আত্মীয়) এদের প্রতিনিধিত্ব করতেন। ‘৬২-এর আন্দোলনে শেখ মুজিবের তেমন কোন প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না। শেখ মুজিব তখন একটি অবাঙালী বীমা কোম্পানীতে চাকুরী করতেন। জিন্নাহ, এভিন্যুতে এর পর পানি সদর দপ্তর ছিল। ছাত্রদের বড় বড় মিছিলগুলো যখন জিন্নাহ, এভনু্যর ঐ পথ অতিক্রম করত শেখ মুজিব তখন বাতায়ন পথে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের বাহবা দিতেন। অতীতে এদেশের শাসকগোষ্ঠী যখনই কোনো আন্দোলন হত তখনই এর পেছনে কমিউনিস্টদের কারসাজি আবিষ্কার করত। কিন্তু ‘৬২-এর ঘটনাপুঞ্জী আমার যতদূর মনে আছে, এর পেছনে কমিউনিস্টদের অদৃশ্য হস্ত আবিষ্কার করা হবে এক হাস্যকর ব্যাপার। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে এতবড় একটি গণ-অভ্যুথান হতে পারে তা আল্ডার গ্রাউণ্ড কমিউনিস্টর মোটেও আঁচ করতে পারেননি। আন্দোলন যখন তুঙ্গে পেছিল তখন হয়তো কমিউনিস্ট মহল এই আন্দোলনের প্রতি কিছুটা উৎসাহ দেখিয়ে থাকতে পারেন। সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টির নেতত্ব সংশোধনবাদীদের করায়ত্ব ছিল। এরা দক্ষিণপন্থী আওয়ামী লীগকে নাখোশ করে কোন পদক্ষেপ ফেলতে চাইতেন না। এর প্রমাণ মেলে সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন ‘৬২-এর গণ-অভ্যুত্থানকে আপোষের চোরাগলিতে ঠেলে দিলেন, এরা তখন আন্দোলনকে ধরে রাখার জন্য তেমন কিছু করলেন না। প্রশ্ন উঠতে পারে আন্দোলনকে ধরে রাখার মত তাদের সংগঠনও ছিল না। অনেক নেতাই ছিলেন তখন জেলে। কিন্তু তাঁরা কি অজুহাতে সোহরাওয়ার্দীর আপোষের ভাওতাকে উন্মােচিত করলেন না তা মোটেও বোধগম্য নয় ? আসলে এই আন্দোলন ছাত্রদের মধ্যে স্বতস্ফূর্তভাবেই শুরু হয়েছিল। ছাত্ররা তাদের দৈনন্দিন শিক্ষা সমস্যা থেকেই আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন এবং এ থেকেই আন্দোলনের জন্ম। সুতরাং এতে ছিল না কোন কমিউনিস্টদের কারসাজি কিংবা জীয় নেতারা কেউ একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাননি। বরং তাঁদের কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বাধা দিতে চেয়েছেন। সুতরাং পূর্ব-বাংলার ছাত্র ইউনিয়ন সম্পর্কে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সে বিষোদগারটি করতেন তা আদপেই সত্য নয় অর্থাৎ ছাত্ররা কখনোই রাজনীতিকদের দাবাখেলার ঘুটি ছিলেন না।
।তিন ৷
১৬৩-এর হল-সংসদ ও ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন ১৩টি আসনের মধ্যে ৮০টি আসন দখল করল। অবশ্য কোন কোন হল ইউনিয়ন নির্বাচনে এপসু ছাত্রলীগের সঙ্গে কোয়ালিশন গঠন করেছিল। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দলীয় প্রচারণার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলো তখন গণতান্ত্রিক নীতিমালা মেনে চলতো। হলসংসদ নির্বাচনে প্লাটফর্ম প্রচারের আয়োজন করা হত। বিভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা সদীর্ঘ প্লাটফর্ম বস্তৃতা দিতেন। এসব বক্ততা এক নাগাড়ে পাঁচ ছয় ঘন্টা চলতো-জাতীয় আন্তর্জাতিক বিষয়াদি থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি কিছুই বাদ যেত না। দলীয় নেতারা বাংলাতেই বক্তৃতা দিতেন। হল শাখার নেতা ও নির্বাচন প্রার্থীর ইংরেজীতে বক্তৃতা দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। যে সংগঠনের প্রার্থীরা ইংরেজীতে ভাল বক্তৃতা দিতে পারতেন তারা উচ্চতর মেধার অধিকারী বলে পরিচিত হতেন। পরিচয় পত্রও ছাপানো হত ইংরেজীতে। পরিচয়পত্রের প্রথম অধ্যায়ে সংগঠনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর উপর একটি নাতিদীর্ঘ বক্তব্য সন্নিবেশিত হত। আমি তখনকার সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে পরমত সহিষ্ণুতার কথা বলেছি। কিন্তু এটা ছিল পূর্ব-বাংলার ছাত্র আন্দোলনে খুবই ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার। এর আগের বছরও সলিমুল্লাহ হলে এন, এস, এফ, ছাত্র ইউনিয়নের উপর চড়াও হওয়ার জন্যে জার্মানীর রাইখ স্টাগ ঘটনার মত একটি অজহাত সৃষ্টি করেছিল। সলিমুল্লাহ হল অডিটোরিয়ামে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একটি প্রতিকৃতি ঝোলানো থাকতো। কে বা কারা এর কাঁচের আচ্ছাদনটি ভেঙে দেয়। এন-এস-এফ এই ঘটনার জন্য ছাত্র ইউনিয়নকে দায়ী করে। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে ছাত্রইউনিয়ন ও এন-এস-এফের মধ্যে মারামারি বেধে যায় ছাত্র ইউনিয়নের বক্তব্য ছিল এটা এন-এস-এফ-এর একটি সাজানো ব্যাপার। যহোক পরবর্তীতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এন-এস-এফ পন্থীরা মাতম ধ্বনির মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতিকৃতি যথাস্থানে স্থাপন করে। এই ঘটনা থেকে এন-এস-এফ-এর খুদে ফ্যাসিস্ট চরিত্র ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠে।১৯৬৩ সালের পর থেকে পূর্ববাংলার রাজনীতিতে মেরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ার অংশ ছিল ছাত্র ইউনিয়নের দ্বিধাবিভক্তি, ‘৬২-এর ছাত্রঐক্যে ফাটল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে ভাঙন, আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচী ও ৬ দফাকে কেন্দ্র করে অওয়ামী লীগে ভাঙন প্রভৃতি। প্রকাশ্য রাজনীতিতে এ ভাঙনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট আন্দোলনেও শুরু হয়েছিল ধারাবাহিক ভাঙনের প্রক্রিয়া। বস্তুতঃ ‘৬৩ থেকে ‘৭১-এর রাজনীতি হ’ল এই বহুধা বিস্তত মেরুকরণ প্রক্রিয়া ও তা থেকে উদ্ভব নূতন রাজনৈতিক শক্তির রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় ভূমিকা। ৬০’ থেকে আন্তজাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে প্রকাশ্য বিতর্কের সূচনা হয়। সেই সময় থেকে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও সেই বিতর্কের হাওয়া বইতে শুরু করে। সস্কোতে অনুষ্ঠিত ৮১ পার্টির আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের পার্টির কমরেড নেপাল নাগ প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। দেশে ফিরে তিনি নিজ পার্টির কাছে যা রিপোর্ট করেন তা হল ‘সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনের পর ১৭ দিনের বিরতি ঘোষণা করা হল। কেন এই বিরতির প্রয়োজন হল আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। ১৭ দিন পর একটা যৌথ ইশতেহার সম্মেলনে আগত ডেলিগেটদের পড়ে শোনানো হল। এই যৌথ ইশতেহার ৮১ পাটির দলিল হিসেবে পরিগনিত হয়। ৮১ পাটির দলিলটি ছিল মূলতঃ আন্তজাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিবদমান দলগুলোর মধ্যে একটি আপোষ ফরমুলা। এতে মস্কো ও পিকিং উভয়েরই মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছিল। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁদের অধিকাংশেরই আনুগত্য ছিল রুশপাটির প্রতি। ৮১ পার্টির দলিলে প্রতিফলিত রুশ দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি তাঁরা তাঁদের সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে সেই লাইন প্রয়োগের পক্ষে ওকালতি করেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে কেবলমাত্র দুজন সদস্য ছিলেন যাঁরা চীনা পার্টির লাইনের প্রতি আহা জ্ঞাপন করেন এবং পার্টি তাঁদের মতামত প্রচারের উদ্দেশ্য ‘আন্তজাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুই নীতি নামে একটি দলিল প্রচার করেন। এই দলিলটি ‘খালেদ বশীরের’ দলিল হিসেবে পরিচিত। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, পার্টিতে যে মতাদর্শগত সংগ্রাম শুরু হল তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল আন্তজাতিক প্রেক্ষাপট জাতীয় প্রেক্ষাপট নয়। স্বদেশ ও নিজ জনগণের বিপ্লবের ক্ষেত্রে সঠিক লাইন কি অতীতের ভুলভ্রাতি কোথায় এবং সাম্ভাবনা থাকা সত্বেও এদেশের বিপ্লবী আন্দোলনের বিকাশ কেন ব্যহত হচ্ছে এই আলোচনা বিতর্কের সূত্রপাতের ক্ষেত্রে সহান পায়নি। অথচ সংশোধনবাদ ও বিপ্লবের মাঝখানে সবচেয়ে বড় সীমারেখা হল জাতীয় পরিস্হিতিতে কার অবস্থান কোথায় ? কে চীনা পার্টিকে সমর্থন করে কে রুশপার্টিকে সমর্থন করে সেটাই বিপ্লবী কিংবা সংশোধনবাদী তা নিরূপনের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। পাটির অভ্যন্তরে যখন এই ধরনের একটা বিতর্কের সূত্রপাত হয়। তখন অনেকটা পার্টি নেতত্বের অজান্তে ছাত্র ইউনিয়নে পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিংবা পার্টিমনাদের মধ্যে একটা দায়ত্বের সুত্রপাত হয়। এই স্নায়ুযুদ্ধের মূল কারণ হল পার্টি নেতত্বের আহা কে অর্জন করতে পারবেন । এতে একদিকে প্রতিনিধিত্ব করতেন মোহাম্মদ ফরহাদ (বর্তমানে সি, পি, বির সাধারণ সম্পাদক) অপরদিকে ছিলেন কাজী জাফর আহম্মদ। এদের প্রথমজন ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কোষাধক্ষ্য এবং দ্বিতীয় জন ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। মোহাম্মদ ফরহাদ তখন আত্মগোপনে থাকতেন আর কাজী জাফর ‘৬২এর আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ছাত্রমহলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছেছেন। ফরহাদকে পার্টি নেতত্ব ছাত্র ইউনিয়নে পার্টি সংগঠনের দায়িত্ব প্রদান করলেন! এটা কাজী জাফর আহমদের মনপুত হল না। তখনকার দিনে পার্টির আশীর্বাদ না থাকলে, কারুর পক্ষেই গণফ্রন্টে তিনি যতই জনপ্রিয় হোন না কেন তাঁর পক্ষে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব বজায় রাখা সদর পরাহত ছিল। সুতরাং কাজী জাফর পার্টি নেতত্বের উপর আস্থা হারালেন এবং মোহাম্মদ ফরহাদের সঙ্গেও তার বিরোধ তীব্র হয়ে উঠল । জনাব ফরহাদ পার্টি নেতৃত্বের সেই অংশেরই আস্থা অর্জন করেছিলেন যাঁরা ছিলেন রশপন্থী। অপরদিকে জনাব কাজী জাফর খালেদ, বশীরদের কাছে থেকেও সরাসরি কোন সমর্থন পেলেন না। বিধে থাকা সত্ত্বেও খালেদ-বশীররা তখনও ছিলেন পার্টি শৃংখলার মধ্যে। একারণে ছাত্রইউনিয়নের বিরোধে তাঁদের নাক গলানোর কোন অধিকার ছিল না এবং তাঁরা এ ব্যাপারে নাক গলাতে চাননি। জনাব কাজী জাফর ও জনাব ফরহাদের মধ্যেকার এই বিরোধে কতখানি রাজ-নীতি ছিল এবং কতখানি ব্যক্তিগত স্বভাবের অভাব ছিল তা বিতর্ক সাপেক্ষ। ইতিহাস তা নির্ধারণ করবে। ‘৬২ সালের ছাত্রইউনিয়নের প্রাদেশিক সম্মেলনে জনাব কাজী জাফর আহম্মদ যে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট পেশ করেন তাতে রাজনৈতিক বিরোধ আবষ্কার করা দুঃসাধ্য। কিন্তু কাজী জাফর আহম্মদ জনাব মোহাম্মদ ফরহাদের সঙ্গে তাঁর কোন ব্যক্তিগত বিরোধ আছে একথা কস্মিনকালেও স্বীকার করেননি। তিনি সবসময় বিরোধটাকে রাজনৈতিক বিরোধ বলেই প্রচার করতেন। অপর দিকে ছাত্র ইউনিয়নে জনাব মোহাম্মদ ফরহাদের অনুসারীরা এই বিরোধকে নিছক ব্যক্তিগত বলেই উড়িয়ে দিত। তারা কাজী জাফরকে একজন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাসী হিসেবে চিত্রিত করার প্রয়াস পেত। কাজী জাফর অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গেই নিজেকে সংশোধনবাদ বিরোধী। ক্রুসেডের অগ্রসেনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। তাঁর বাগ্মীতা তাঁকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠায় বিরাটভাবে সহায়তা করেছে। তদরি ছিল- জনাব রাশেদ খান মেনন, জনাব হায়দার আকবর খান। রননা, জনাব আবদুল মান্নান ভূইয়া প্রমুখের বলিষ্ঠ সমর্থন। ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জনাব আবদুল মতিন আলোচ্য সময়কালে কারারুদ্ধ ছিলেন । কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের সংশোধনবাদী লাইনের প্রতি তিনিও প্রচণ্ডভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন।

‘৬৫ সালের সম্মেলনের পূর্ব মূহুর্তে যখন ইউনিয়নের বিরোধ চরমে গেছে সেইসময় চিকিৎসার জন্য তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরিত হন। এই সময় তিনি ছাত্রকর্মীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন এবং সংশোধনবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জনাব আবদুল মতিনের এই অবস্থানও ছাত্র ইউনিয়নে কাজী জাফরের হাতকে শক্তিশালী করে প্রায় একই সময়ে কাজী জাফরও জেল থেকে ১ মাসের প্যারলে মুক্তি পান। ঐ সময়ে তিনি নিজ সমর্থকদের সংগঠিত করার কাজে সদ্ব্যবহার করেন। এমনি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ‘৬৫ সালের প্রথম দিকে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ছাত্র ইউনিয়নের প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইতিপূর্বে কনভোকেশন আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্র ইউনিয়নের বিশিষ্ট নেতারা অনেকেই ছিলেন কারাগারে। এদের মধ্যে উল্লেখ্য হলেন, ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি, জনাব এ, কে, বদরুল হক, সাধারণ সম্পাদক জনাব হায়দার আকবর খান রনো, ডাকসুর সহ-সভাপতি জনাব রাশেদ খান মেনন, জনাব আলী হায়দার, জনাব বদিউজ্জামান বড় লস্কর প্রমুখ। এই সম্মেলনে ছাত্র ইউনিয়ন, দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। সম্মেলনে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব নুরুর রহমানের রিপোর্টকে কেন্দ্র করে বিরোধের সূত্রপাত হয়। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন নিছক ও প্রচার ও প্রতিবাদমূলক। রিপোর্টের এই বক্তব্য নিয়ে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ছাত্র ইউনিয়নে যারা সংশোধনবাদেয় বিরোধিতা করতেন তাঁদের মতে এই বক্তব্যের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ বিৱোধী আন্দোলনকে খাটো করার চেষ্টা করা হয়েছে। ইতিপূর্বে ছাত্ৰইউনিয়ন নেতৃত্বে সংশোধনবাদী অংশ বঙ্গোপসাগরে মার্কিন রণতরীয় পাঁয়তারাকে নিন্দা করতেও কুণ্ঠাবোধ করেছিলেন। তাঁরা মনে করতেন এ ধরনে নিন্দাবাদ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ফাটলের সৃষ্টি করবে। অপরদিকে যারা সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন তাঁদের দৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন ছিল এক ও অবিভাজ্য। এখানে উল্লেখ্য যে সম্মেলনে ছাত্র ইউনিয়ন, দ্বিধাবিভয় হয় সেই সম্মেলনের প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছিলেন অধ্যাপক আবুল ফজল। এই সম্মেলনে আমি ও জনাব মতিয়ুর রহমান (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অনাপ্ত মুখপত্র ‘একতা’র সম্পাদক) সেমিনারে উপ-কমিটির যুগ্ম-আহায়ক ছিলাম। সেমিনারে কান্না আলোচনা করবেন এ নিয়েও কিছুটা দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। (সেমিনারে অংশ গ্রহন করেন অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, কবি সীমশীন, জনাব আহমেদ রহমান (ভীমরুল), জনাব আলী আকছাদ ও জনাৰ আনোয়ার জাহিদ।) জনাব আলী আকছাদ ছিলেন জনাৰ মতিয়ুর রহমানের পদুন্দসই ব্যক্তি, আমি ব্যক্তিগতভাবে জনাব আনোয়ার জাহিদকে আমন্ত্রণ জানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করি। এতে জনাব সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও মতিয়ুর রহমানরা খানিকটা ইতস্ততা প্রকাশ করে সম্মতি দিলেন। জনাব আনোয়ার জাহিদ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের উপর বক্তব্য রাখেন। আনোয়ার জাহিদ তখন ‘জনতা’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তখনকার দিনে ‘জনতা’ ছিল সংশোধনবাদ বিরোধী আদর্শগত সংগ্রামে এক শাণিত হাতিয়ার। এ কারণে ‘জনতা’ সম্পাদক আনোয়ার জাহিদ মতিয়ুর রহমানদের অনুরাগের ব্যক্তি ছিলেন না। সম্মেলনের পর থেকেই কাউন্সিলার লিস্টের প্রশ্নে ও সম্মেলন কক্ষে প্রবেশের অধিকার নিয়ে ছোটখাট হাতাহাতি, বাধে ও হাতাহাতি চড়ান্ত সংঘর্ষে পরিণত হয় নির্বাচনী অধিবেশনে। জনাব রাশেদ খান মেনন ও কাজী জাফরের সমর্থকেরা সম্মেলন মঞ্চ দখল করে তাঁদের পছন্দ সই প্যানেল পাশ করান। অপরদিকে বেগম মতিয়া চৌধুরী ও সাইফুদ্দিন আহম্মদ মানিকের সমর্থকরা সম্মেলনের শেষদিন রাতের বেলায় তৎকালীন ইকবাল হলের ছাদে তাঁদের প্যানেল পাশ করেন। পরদিন বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় এক বা একাধিক প্যানেলের খবর বের হয়। জনতা’ পয়িকা হেডলাইন দিল’ ‘দ্বিধাবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নে এখন সবাই ঐক্য চায়। কিন্তু সে ঐক্য আর কখনো হয়নি। মেনন ও মতিয়াগ্রুপ নামে ছাত্র ইউনিয়নের দুটি পৃথক সংগঠন পৃথকভাবে কাজ করতে থাকে। পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহে এই দুই সংগঠনের পার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। ১৯৬৫-এর সেপ্টেম্বর যধে ছাই ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) মাতভূমির রক্ষার আওয়াজ তোলে ও আগ্রাসনের বিরদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহান জানায়। অপরদিকে মতিয়া গ্রপ মখরক্ষার জন্য দেশরক্ষার কথা বললেও তা মূলত শান্তিপণ উপায়ে জাতিসংঘের হস্থক্ষেপের মাধ্যমে পাক-ভারত বিরোধ নিষ্পত্তির কথা বলেন। পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) পাকিস্তানের প্রতি গণচীন, আলবেনিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সমর্থনকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানান। মেনন গ্রপ কাশ্মীয়ের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের প্রতিও সঢ় সমর্থন জ্ঞাপন করেন। অপরদিকে মতিয়া গ্রুপ এই প্রশ্নে ‘ধরি মাছ না দুই পানি’ এই ভূমিকা গ্রহন করে। কাশ্মীর প্রশ্নে সংশোধনবাদীদের ভূমিকা বরাবরই ভারত ঘেযা ছিল। তাদের দৃষ্টিতে ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সুতরাং কাশ্মীর ভাৱতের অঙ্গীভূত হলে তা হবে কাশ্মীরবাসীদের জন্য মঙ্গলজনক। অপরদিকে পাকিস্তান ছিল তাদের দৃষ্টিতে পশ্চাদগামী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। সুতরাং কাশ্মীরের পাকিস্থানে যোগদানের প্রশ্নই উঠতে পারে না। অথচ মার্কসবাদের এই মৌলিক শিক্ষাকে তারা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন পাকিস্তান ও ভারত উভয়েই বুর্জোয়া সামন্ত রাষ্ট্র। সুতরাং এ দুই-এর মধ্যে দলগত কোন পার্থক্য নেই। পাক-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর পরই অনুষ্ঠিত হয় তাসখন্দ সম্মেলন। কাশ্মীয়ের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও কে আক্রমণকারী ও কে অক্লান্ত এই প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে আইয়ুৰশাস্ত্রীর মধ্যে সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাসখন্দ শান্তি চুক্তি। ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপ ও হাভানা সম্মেলন থেকে সদ্য প্রত্যাগত মওলানা ভাসানীও তাসখন্দ চুক্তিকে সমর্থন করলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে জামাতে ইসলাম সহ কতিপয় উগ্র ধর্মাথ শক্তি ভাসখন্দ চন্তি বিরোধিতা করার নামে চরম দক্ষিণ পন্থি ও মার্কিন ঘেষা অভ্যুত্থান ঘটাতে চেয়েছিল। এ কারণে তাসখন্দ প্রশ্নে মওলানা ভাসানী সহ মস্কোপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোয় ভূমিকা একটি বিন্দুতে এসে মিলে গিয়েছিল। যদিও এ প্রশ্নে বামপন্থী মহলে আজও দ্বিমত আছে সেদিনকার সেই ভূমিকা সঠিক ছিল কি না? উল্লেখ্য যে, তৎকালীন আবদুল হক ও মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে পূর্ব-পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার আশায় তাসখন্দ ঘোষণাকে সমর্থন করেছিল। যুদ্ধের অব্যহিত পরে মওলানা ভাসানী ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে তাঁর সমর্থক অংশ জাতিসংঘ বর্জন করে আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার নিপীড়িত জাতি সমূহের জন্য ভিন্ন জাতিসংঘ গড়ে তোলার দাবী জানায়। তাঁদের বক্তব্য ছিলো : মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রভাবিত জাতিসংঘ কাশ্মীরসহ দুনিয়ার কোনো দেশেরই মক্তি সংগ্রামের স্বপক্ষে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদের আস্তানা জাতিসংঘ ত্যাগ করা উচিত। সুকর্ন-এর ইন্দোনেশিয়াও জাতিসংঘ বর্জন করেছিল। চীনা পত্রপত্রিকায় সে খবর ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। চীন তখন জাতিসংঘের সদস্য ছিল না এবং চীন জাতিসংঘের সদস্য হতে চায় এমন কোনো আভাসও তখন চানা পত্র-পত্রিকায় পাওয়া যেত না। আমাদের দেশের বামপন্থীরা গণচীনের সেই দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে সেন্টিমেন্টাল এটাচমেন্ট প্রকাশ করেছিলেন। আমার মনে হয় চীনের পররাষ্ট্রনীতি তখন অতি বামদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। উইলফ্রেড বার্চেড ও চৌ-এন লাই-এর বক্তব্য থেকে এ অভিমতের স্বপক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) জাতিসংঘ বর্জনের বিপক্ষে বক্তব্য রাখে এবং জাতিসংঘের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করে। পাক-ভারত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যেসব আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে উত্তপ্ত বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল যুদ্ধের দিনগুলো দয়ে সয়ে যেতে যেতে সেগুলো স্তিমিত হয়ে আসে। জাতিসংঘ সংক্রান্ত বিতর্কও এভাবে স্তিমিত হয়ে পড়ে। জাতীয় রাজনীতিতে জাতীয় ইস্যুগুলো আবার প্রাধান্যে আসতে থাকে। জাতীয় রাজনীতিতে এই মোড় পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বড় কারণ হল শেখ মুজিবের ৬ দফা কর্মসূচী। পাচ ।। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারী মাসে শেখ মুজিব লাহোরে বিরোধী দলগুলোর সম্মেলন বর্জন করে এসে ঢাকা বিমানবন্দরে ‘বাঙালীর মুক্তিসনদ ৬ দফা পেশ করেন। ৬ দফা পেশ করার পর পরই এই সম্পর্কে নানা রূপ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি তখনো বিভক্ত হয়নি। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মওলানা ভাসানী ৬ দফা ডিসমিস করে দিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন (মেননগ্রুপ) এই কর্মসুচী জাতির মুক্তি সনদ নয় বলে ঘোষণা করল। অপরদিকে মতিয়া গ্রুপ একে অসম্পূর্ণ কর্মসূচী বলে সমালোচনা কর। মূলতঃ ৬ দফাকে স্বায়ত্বশাসনের কর্মসূচী হিসেবে সমর্থন করল। ন্যাপের অভ্যন্তরে মস্কোপন্থীরা প্রথমদিকে এই প্রশ্নে ঐক্যমত পোষণ করলেও অল্পকিছুদিনের মধ্যে এই প্রশ্নে মওলানা ও অন্যান্যদের সমালোচনা শুরু করলেন। চট্টগ্রামে লালদীঘির ময়দানে এক জনসভায় ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষিত হবার অব্যবহিত পরে হাজী দানেশ থেকে মতিয়া চৌধুরী পর্যন্ত সবাই ৬দফা সম্পর্কে এক ধরনের বক্তব্য হাজির করেন। সভায় ৬ দফা গুচ্ছীয় গোলযোগ সৃষ্টি করতে গিয়ে বিফল মনোৱধ হয়ে ফিরে যান। মওলানা ভাসানী ৬ দফার সত্যিকার বিকল্প হিসেবে তাঁর এক দফা সমাজতন্ত্রের কথা সহ প্রচার করতে থাকলেন। তিনি বললেন সমাজতন্ত্র হলে পূর্ব-পশ্চিম, ধনী-গরীব সকল প্রকার বৈষম্যেরই অবসান হবে। আসলে ৬ দফাতে তেমন নূতন কোন বক্তব্য ছিল না। ‘৫৭ সাল থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যে ফরমুলার ভিত্তিতে পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতি সমহের জন্য স্বায়ত্ব শাসনের দাবী করে আসছিল ৬ দফা তারই দফাওয়ায় বিস্তারিত ব্যাখ্যা মাত্র। বরং ৬ দফা তার তুলনায় আংশিক কর্মসুচীমাত্র। কারণ তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতি সমূহের জন্য স্বায়ত্বশাসন দাবী করা হয়নি। ন্যাপ স্বায়ত্বশাসন দাবী করত তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও অন্যান্য প্রগতিশীল সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মসূচীর পাশাপাশি। ৬ দফাতে জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক কর্মসূচীও ছিল না। সুতরাং বামপন্থিরা একে পশ্চিমা পুজিপতির পরিবর্তে বাঙ্গালী পুজিপতির রাজ কায়েমের প্রয়াস হিসাবেই দেখলেন। রাজনীতিতে সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য শেখ মুজিব ছিলেন দক্ষিণপন্থী, কমিউনিস্ট বিরোধী ও মার্কিন ঘেষা। সুতরাং তাঁর যে কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপকে বামপন্থীরা সন্দেহের চোখে দেখবেন এটাই তো স্বাভাবিক। স্বায়ত্বশাসনের প্রশ্নে ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাপের জন্ম হয়েছিল। এককালের মওলানার চোখের মনি ‘মজিবর’ সেদিন মওলানার পাশে সাড়াননি। বরং সেদিন তিনি সোহরাওয়ার্দীর পাশেই ছিলেন। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী তখন বলতেন ৯৮ ভাগ স্বায়ত্বশাসন হয়ে গেছে, সুতরাং স্বায়ত্বশাসনের শৈলাগান একটি রাজনৈতিক স্ট্যান্ট। ‘৬৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে আমি নিজে যখন স্বায়ত্বশাসনের লোগান সম্মলিত প্ল্যাকার্ড বহন করছিলাম আওয়ামী লীগ পস্থী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কিছু ফর্ম ওটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনের সময় ‘কপ’-এর ৯ দফা কর্মসূচীতে ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা যখন স্বায়ত্বশাসনের দাবী অন্তর্ভুক্ত করতে চাপ দিয়েছিল তখন শেখ মুজিব বলেছিলেন, ওটা পরে হবে। আগে দেশে ডেমোক্রাসি আসুক। ডেমোক্লাসি এলেই সব প্রশ্নের সমাধান হবে। মাত্র ১ বছরের প্নে’ ব্যবধান স্বর্গে ও মর্ত্যে এমন কি ঘটনা ঘটে গেলে যে শেখ মুজিব স্বায়ত্ব ও শাসন ত্যাগ ‘জাতীয় মুক্তির সবচেয়ে বলিষ্ঠ প্রবন্ধ বুনে গেলেন। একাৰুনীয় নেই বামপন্থীরা তাকে সমর্থন দিতে নারাজ ছিল। অপরদিকে জাতীয় এই রাজনীতির আন্তর্জাতিক দিকটিতেও পরিবর্তন এসেছিল। এককালের মার্কিনের মিত্র আইয়ুব খান তখন মার্কিনের বিরাগভাজন। পাকিস্তানের বড় বুর্জোয়াদের স্বার্থে আইয়ুব সরকার আমেরিকার পাক-ভারত কনফেডারেশনের প্রস্তাব নাকচ করে দিচ্ছিলেন। মার্কিনচাপের নিকট বশ্যতা স্বীকার না করার অপরাধে আইয়ুব খাঁ আমেরিকার কাছে থেকে নানারূপ শাস্তির সম্মুখীন হচ্ছিলেন। এদিকে আসলো শেখ মুজিবের মাধ্যমে ৬ দফার হুমকি, অন্যদিকে, তাসখন্দ সম্মেলনের বিরদ্ধে দক্ষিণ পন্থীদের লাহোর সম্মেলন। বামপন্থীরা দেখলেন সাম্রাজ্যবাদীরা শেখ মুজিবের নেতত্বে পূর্ব-বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে মার্কিন ও ভারতের একটি তাঁবেদার রাষ্ট্র কায়েম করাতে চায়। এ কারণেই তাঁরা শেখ মুজিবের সঙ্গে কোনরুপ সহযোগীতা করতে রাজী ছিলেন না। তবে মার্কিনীরা পূর্ব-বাংলাকে পুরোপরি বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বোধ করি তারা এটাকে চাপের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন! অপরদিকে মস্কোপন্থীরা আলাদা রাজনৈতিক সংগঠন ওয়ালীন্যাপ দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। মস্কোপন্থীরা বলতে শুরু করলেন ৬ দফাতে সাম্রাজ্যবাদের অভিঘদ্ধি থাকলেও একে সমর্থন দিয়ে একে একটি গনআন্দোলনে পরিণত করতে হবে। গণ আন্দোলন গড়ে উঠলেই সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত নস্যাত হয়ে যাবে ও প্রকৃত মুক্তি সংগ্রাম গড়ে উঠবে। অথচ সেই সময় রুশ পত্রিকা ‘ইজভেস্তিয়ায় এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদী যোগসাজসের কথা এক নিৰলে স্বীকার করা হয়েছিল। ওয়ালী ন্যাপের পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা জনাৰ মাহমুদল হক ওসমানীও এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন। দুই দফার প্রশ্নে বামপন্থীদের সবচেয়ে বড় ভুল হলো তারা বিরুপ কোন পরিপূর্ণ কর্মসূচী হাজির করতে ব্যর্থ হন। কর্মসূচী যে তারা চিন্তা করেননি এমন নয়। ন্যাপ ভার জাতীয় কমিটিতে ১৪ দফা বলে এক কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই কর্মসূচীর সপক্ষে কোন ব্যাপক প্রচার ও আন্দোলন তাঁরা গড়ে তোলেননি। কারণ তারা ভয় করতেন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি তাদের আন্দোলনের ফলে যদি আইয়ুৰ সরকারের পতন হয় তাহলে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় এমন কোনো শক্তি ক্ষমতাসীন হবেন যারা পাক-চীন বন্ধের নীতি অনুসরন করবেন না সাম্রাজ্যবাদে তাঁবেদারী নীতি গ্রহন করবেন। আসলে সেই সময় থেকে থেকে বামপন্থীরা নিজেদের উপর খুব কমই আচ্ছা পোষন করতেন। সে রোগ তাদের আজও আছে। সে কারণে জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো উদ্যোগে হবে না, থাকে না কোন পরিস্কার ভূমিকা। বামপন্থী নেতত্বের রাজনৈতিক ক্লীব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, ছাত্র ইউনিয়নের তরণ কর্মীদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও চিন্তাধারার প্রভাবে এইসব কর্মীরা বিপ্লব ও জাতীয় মুক্তির এক উগ্র কামনা নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নে সমবেত হয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে যে নেতৃত্ব সংগ্রাম করে বেড়িয়ে এসেছেন তাঁরা হয়তো একটি সঠিক পথ বাতলাবেন। কিন্তু ক্রমাগত রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থতা তাদেরকে হতাশ করে তোলে। ১৯৬৫ সনে এক সন্ধ্যার কথা, সলিমুল্লাহ হলের একটি রুমে (৫২ নং রুম) আমরা কজন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী সমবেত হয়েছি। এদের মধ্যে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল মান্নান ভূইয়া, জনাব সামসুজ্জোহা মানিক (পরে কৃষকনেতা ও বর্তমানে ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক) ও তৎকালীন সলিমুললাহ, মুসলিম হল। সংসদের সহ সভাপতি জনাব মুহাম্মদ ইব্রাহীম (বর্তমানে ডঃ ইব্রাহীম এ পদার্থ বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক)। আমি জনাব মান্নান ভূইয়াকে গান করলাম দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ অচিরেই পূর্ববাংলার স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু করবে। তখন আমরা কি করব ? মান্নান ভূইয়া বললেন, ওরকম সময় আসলে কি করব তা ভাবা যাবে। জনাব আহমেদ কামাল আমাকে সমর্থন করে বলেন, ছাত্র লীগের ছেলেরা এখন থেকে বিচ্ছিনতার কথা ভাবছে। ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগের উপর এদের প্রভাব বাড়ছে। সুতরাং আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা আন্দোলনে যাবেই! আমি বললাম, সময় থাকতেই আমাদেরকে ভাবতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কিছুই করা যাবে না। আমি চাইনা আওয়ামী লীগ নেতত্বে দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে ধনিক বণিকদের রাজত্ব কায়েম হোক। সেটা হবে আমাদের জন্য চরম দুঃসময়। শামসুজ্জোহা মানিক তাঁর স্বাভাবিক ধীর হির কণ্ঠে বললেন, দেশে একটা সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র চলছে, আমরা। সেই ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে পারি না। আমি বললাম, পূর্ব-বাংলার জাতীয় প্রশ্ন যেভাবে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে তাতে করে পাকিস্তান থেকে পূর্ববাংলা বিচ্ছিন্ন হওয়াটা একরকম অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং এই আন্দোলনে আমাদেরকে অবশ্যই নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে। আমাদের নেতৃত্বে পূর্ব-বাংলা স্বাধীন হলেও পূর্ব-বাংলা হবে এক নতুন পূর্ববাংলা সুতরাং সেই লাইনে গোটা বামপন্থী নেতৃত্বকে একযোগে কাজ করতে হবে। সেদিনকার মত আলোচনা এখানেই শেষ হল। ৬দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেই শেখ মুজিব সারা বাংলাদেশ চষে বেড়াতে লাগলেন। ৬ দফা কর্মসূচী দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। শেখ মুজিব যেখানেই জনসভা করেন সেখানেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং একটা মামলা দায়ের করার পর তাঁকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। আইয়ুৰ খান বললেন, শেখ মুজিব ভাষার অস্ত্র প্রয়োগ করতে চান, আমরা অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করে তাঁকে স্তব্ধ করে দেব। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর এইসব কার্যকলাপ শেখ মুজিবকে আরও জনপ্রিয় করে তুললো। শাসকগোষ্ঠী স্বায়ত্বশাসনের মত ন্যায্য দাবীকেও উপেক্ষা করে চললো। এদিকে বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির উপর নানারপ হামলা বুদ্ধিজীবী মহলকেও চরমভাবে বিদ্ধ করে তুললো। শাসকগোষ্ঠীর এইসব কার্যকলাপ জনগণের বিক্ষোভের আগুনে ইন্ধন জোগালো। কেবলমাত্র। শেখ মুজিব তাঁর ৬দফা প্রচারের এক পর্যায়ে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার হলেন। এদিকে ‘৬৬ সালের ৭ই জন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৬দফার দাবীতে হরতাল পালিত হল। শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে আওয়ামী লীগ তেমন জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু এই জনেয় হরতালে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে শ্রমিকরাও আংশিকভাবে জড়িয়ে পড়লো। আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা অনেকেই গ্রেফতার হলেন। এইভাবে অস্বীকার করবার উপায় নেই যে বামপন্থীদের সমালোচনা সত্ত্বেও ৬দফা উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। এমন সময় পাকিস্তানের রাজনীতিতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও কনভেনশন হললীম লীগের সেক্রেটারী জেনারেল জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো আইয়ব মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করলেন। তাসখন্দ চুক্তির পর থেকে আইয়বের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। ভদপরি ৬৬ লনের জানুয়ারীতে জাতীয় পরিষদের ঢাকা অধিবেশনে এসে তিনি মুজিবের সঙ্গে ৬ দফার প্রশ্নে প্রকাশ্য বিতর্কের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু অদৃশ্য হস্তের আঙ্গুলি হেলনে সেই বিতর্ক আদৌ অনুষ্ঠিত হলো না। ভুট্টোর এইসব রাজনৈতিক উদ্যোগ আইয়ুবের নিকট ভাঁকে অপ্রিয় করে ভুললো। জাতীয় পরিষদের জানুয়ারী অধিবেশনে সময় ভুট্টোর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল বুড়িগঙ্গায় এক নৌবিহারে। তিনি তখনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসলীম লীগের প্রাক্তন এম, এন, এ, জনাব এম, এ, লস্কর একটি লঞ্চে নৌবিহারের আয়োজন করেছিলেন। এতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ডঃ আবু মাহমুদ। এতে আরও ছিলেন লেবার পার্টির নেতা জনাব ফয়জুর রহমান। তিনি তখন অভান্তরীন নৌচলাচল সংস্থায় চাকুরী করতেন। চাকুরী করলেও ধীরে ধীরে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছিলেন। ডঃ আবু মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যেই এই নৌবিহারের আয়োজন করা হয়। ডঃ আবু মাহমুদ সেইকালে একজন বামপন্থী চিন্তাবিদ হিসেবে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তপক্ষের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করতে গিয়ে তিনি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর জনাব মোনায়েম খান ও তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর জনাব ওসমান গনির (বর্তমানে ডেমোটিক লীগ নেতা) বিরাগভাজন হন ও এম, এস, এফের পাণ্ডাদের দ্বারা নৃশংসভাবে হত হন। ডঃ আবু মাহমুদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশের উদ্দেশ্যেই এই সাক্ষাতকারের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে আমি কি করে সেই আসরে ঠাই পেলাম। জনাব ভুট্টো দু-একজন তরুণ বামপন্থী ছাত্র কর্মীর সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। কারণ সেই সময় থেকে কনভেনশন লীগের বাইরে তিনি আলাদা সংগঠন গড়ে তোলার কথা ভাবছিলেন। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বামপন্থী তরণ কর্মীদের মনোভাব তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন আরেকজন ছাত্র তার নাম আজিজ আহমেদ। তিনি এখন কানাডায় পড়াশুনা করছেন। সেই সংবাদেই আমাদের যাওয়া। জনাব ভুট্টোর সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক প্রসঙ্গে আলাপ হলো। আমরা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম পাকি স্তান ও ভারতের মধ্যে কাশ্মীর সমস্যার কিভাবে নিষ্পত্তি হতে পারে? Kashmir problem can only be solved within the framework of a united socialțst India,” আমার ভাবতে অবান্ত লাগে পাকিস্তানের মত একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি করে এ উক্তি করেছিলেন। বোধ করি একটা সূদর প্রসারী ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গীই ছিল তাঁর এই উক্তির ভিত্তি। সেই সময় ঘানা ও ইন্দোনেশিয়াতে সামরিক অত্যুথানে মাধ্যমে নরমা ও সুকর্ণ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। আমরা প্রশ্ন করলাম, কি করে সুকর্ণর মত জনপ্রিয় নেতাকে সামরিক বাহিনী ক্ষমতাচ্যুত কয়লে। তিনি সুকর্ণ-এর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতকারের কাহিনী বর্ণনা করলেন। তিনি বললেন, সি, আই, -এর চক্রান্তের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। দুনিয়ার সব দেশেই জাতীয় বুর্জোয়া নেতাদের ভাগ্যেই এমন ঘঠনা। ঘটে থাকে। তিনি আরও বললেন, “When Mao-se-tung comes, he stays ; when Ho-chi-minh comes, he stays ; but when Soekerno comes ; he goes, when Nkrumah comes, he goes,” আমার মনে হয় এসব উক্তির মাধ্যমে ভূট্টো আমাদের চমৎকৃত করতে চেয়েছিলেন। আমাদের পক্ষে ভুট্টোর সমর্থনে দাঁড়ানোর প্রশ্ন ছিল না, কারণ আন্দরী তখন থেকেই বুঝেছিলাম, পূর্ববাংলার পথ পশ্চিম-পাকিস্তানের পথ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। ভূট্টো বাংলাদেশের বামপন্থীদের সমর্থন না পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানের উদীয়মান তরল বামপন্থীদের বিরাট সমর্থন পেয়েছিলেন এই অংশের নেতৃত্বে ছিলেন জনাব মেরাজ মোহাম্মদ খান ও জনাৰ রশীদ হাসান খান। এদের প্রথমজন ছিলেন শ্রমিক নেতা ও অপরজন ছাত্র নেতা। ভুট্টোর পাটির জঙ্গী শাখাটি এরই গঠন করেছিলেন। এদের দুজনের সঙ্গেই ৬৭ সালের দিকে ঢাকায় আমার বিস্তারিত আলাপ হয়েছিল। এরা উভয়েই ছিলেন মার্কসবাদী আমি তাদেরকে প্রশ্ন করেছিলাম আপনারা কি করে ভুট্টোর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেন ? ন্যাপনেতা), জনাব আহমেদ কামাল (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁরা জবাব দিলেন, ভুট্টো শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে থাকবেন না। কিন্তু বর্তমানে আমরা তাঁকে নিয়ে জনগণের কাছে পৌছাতে পারি ও জনগণকে ব্ল্যাডিকালাইজ করতে পারি। পররাষ্ট্র মন্ত্রী থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর পাকিস্তানে ভুট্টোর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে গিয়েছিল। করাচীয় রেলস্টেশনে লাহোর থেকে করাচী পৌছার পর ভুট্টো এক বিপুল গণ-সম্বর্ধনা লাভ করেছিলেন। সেখানে তাঁর অমাখা রুমাল নিলামে দশ হাজার টাকা বিক্রী হয়ে ছিল। ভূট্টো তখনো কোন পার্টিতে যোগ দেননি যা কোন পার্টি গঠন করেননি। কথা উঠেছিল তিনি ভাসানীন্যাপে যোগদান করবেন ও পাকিস্তান ন্যাপের সেক্রেটারী জেনারেলের পদ অলংকৃত করবেন। গদী ছেড়ে ঢাকা শহরে আসার পর ভাসানী ন্যাপের প্রাদেশিক শাখার কিছু নেতা ঢাকা বিমানবন্দরে ভুট্টোকে মাল্যভূষিত করেন। এদের মধ্যে আনোয়ার জাহিদ, ও কামরুন্নাহার লাইলী উল্লেখ্য। এ নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন মহলে প্রবল সমালোচনার রব উঠে। এটাকে কেউ কেউ এইসব নেতাদের আইয়ুবের প্রতি মোহ বলে বর্ণনা করে। কিন্তু আসলে তা সেই ধরনের ব্যাপার ছিল না। কারণ ভূট্টো তো আইয়ুৰ কেবিনেট ছেড়েই এসেছিলেন। মার্কসবাদী পণ্ডিতরা এটাকে দক্ষিণ পন্থী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। শেষপর্যন্ত ভূট্টো নিজেই পি, পি, পি, গঠন করেন। তিনি হলেন এর চেয়ারম্যান। তবে সে আমলে ভাসানী ন্যাপের সঙ্গে পি, পি, পি,-র একটা সৌহার্দ্যমুলক সম্পর্ক ছিল। ভূট্টো ভাসানীকে শ্রদ্ধা করতেন। এদিকে ৬ দফার প্রেক্ষিতে আমাদের কি করনীয় তা নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন মহলে বেশ একটা বাগবিতণ্ডার সৃষ্টি হল। এদিকে গণচীনেও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা হল। চেয়ারম্যান মাও হেড কোয়ার্টারে তোপ দাগার অবস্থান জানালেন। আমরাও মনে করলাম রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়ায় জন্য হেড কোয়ার্টারে তোপ দাগার প্রয়োজনীয়তা আছে অর্থাৎ প্রয়োজনবোধে নেতৃত্বকে অস্বীকার করতে হবে। এমনি এক সময়ে আফ্রো-এশিয়ান রাইটার্স ব্যুরোর এক প্রতিনিধি দল ঢাকা আসেন। এদের মধ্যে ছিলেন ব্যুরোর সেক্রেটারী জেনারেল আর, ডি, সেনানায়ক, সুদানের কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারী জনাব আহম্মদ মোহাম্মদ খায়ের, মোজাম্বিক মুক্তিফ্রন্ট নেতা দাক্রুজ ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য। ছায়া হোটেল শাহবাগে উঠেছিলেন। আমি নিজের তরফ থেকেই একটা তাড়া বোধ করলাম চীনের পার্টিকে আমাদের জাতীয় পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ ঘটনা জানানোর। হয়তো তাঁরা পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক অবগত নন। প্রায় দুই ঘন্টা ধরে দোভাষীর মাধ্যমে চীনা পার্টির নেতার সঙ্গে আলোচনা চললো। তিনি কেবল শুনলেন-কোন মন্তব্য করলেন না। কিন্তু খুব ধৈর্য সহকারে এসেছিলেন। আমি বোঝাতে চাইলাম ৬ দফার আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব-বাংলায় একদিন স্বাধীনতার আও য়াজ উঠবে। এটাকে কেউ রোধ করতে পারবে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা বিচ্ছিন্ন হলে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকবে না। একারণেই বামপন্থীদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ অপরিহার্য। তাঁরাও মুখভঙ্গী দেখে আসল প্রতিক্রিয়া কি কিছুই বোঝা গেল না। তবে এইটুকু বুঝতে পারলাম স্বদেশে ফিরে গিয়ে তিনি পার্টিকে এ ব্যাপারে রিপোর্ট করবেন। এসব কথার ফাঁকে ফাঁকে শ্রীলঙ্কায় আর, ডি, সেনানায়ক বলতে চাইলেন তোমাদের কর্তব্য হবে শ্রমিক, কৃষক ও জাতীয় বাজেয়াকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ঐক্যজোট করা। তাঁর দৃষ্টিতে আইয়ুবই ছিল জাতীয় বুর্জোয়া প্রতিনিধি। আমায় কথাটা পছন্দ হল না। বরং দাক্রুজের কথা অনেকটা পছন্দ হলো। তিনি বললেন, শাসকগোষ্ঠী সম্পর্কে কোন মোহ পোষণ করো না, সংগ্রামে নামো। সংগ্রামই তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। পরিশেষে বলতে গেলে বিভ্রান্ত হয়েই ফিরলাম। দাক্রুজ আরেকটি কথা বলেছিলেন। সেটা হল মোজাম্বিকের মত “সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কি পরিবর্তন এসেছিল। তিনি বলেছিলেন, ১৮ বছর বয়সে আমি স্বদেশের মুক্তি সংগ্রামে নামি আমি ছিলাম যূব রোগা ও যক্ষারোগে আক্তান্ত। কিন্তু সংগ্রাম এ প্রক্রিয়া আমাকে সুস্থ করে তুলেছে। আমি এখন সম্পূর্ণ নীরোগ। এমনিতর রাজনৈতিক বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে আসলো ‘৬৭ সালে। ছাত্র ইউনিয়ন সম্মেলন। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ছাত্র ইউনিয়নে মেরুকরণ শুরু হলো। ছাত্র ইউনিয়নে জাফর-মেননের সমর্থক অংশ প্রথমে অচিন্ত্য সেন ও পরে হায়দার আনোয়ার খান জনোকে সাধারণ সম্পাদকের পদের জন্যে সমর্থন জানাতে থাকলেন। অপরদিকে আমি সমর্থন পেলাম ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যেকার নূতন শক্তির ও অন্যদিকে প্রবীণ নেতৃত্বের তরফ থেকে জনাব আবদুল হক ও অন্যান্যের। মেননদের সমর্থকরা আবদুল হকের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা প্রচার শুরু করলেন। আমরা সেটাকে খুব ঢাকার চেষ্টা করলাম না। কারণ তাদের সঙ্গেও ছিল আমাদের চিন্তার জগতের পার্থক্য। আবদুল হক পাকিস্তানের। সংহতিকে বিশ্বাস করতেন। আমরা বিশ্বাস করতাম পূর্ব-বাংলার স্বাধীনতায় জনগণতান্ত্রিক পূর্ব-বাংলায়। তৎকালে হক ও তোয়াহা এক গ্রপভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যেও ছিল চিন্তার পার্থক্য। তোয়াহা বলতেন, তিনি অনেক আগে থেকেই পৃথক পূর্ববাংলায় কথা ভাবতেন এবং ১৯৫০ সালে এদেশের একটি পত্রিকায় পূর্ববাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা লিখেছিলাম। এদিকে ‘৬৭ সনের বসন্তকালে নকশালবাড়ীর কৃষক অভ্যুত্থান হয়েছে। রাশেদ খান ‘৬৬ সালের ২১শে জুলাই বন্দী মুক্তি আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন। জেল থেকে তিনি জানালেন, নকশালবাড়ী অভ্যুত্থান সম্পর্কে তার রিজারভেশন আছে। এসব উক্তি ছাত্র ইউনিয়নের জঙ্গী অংশ থেকে তাঁদের কিছুটা বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। ফল স্বরূপ আমাদের প্রতি তাদের সমর্থন গেল বেড়ে। এমনকি আবদুল হক নিজেও আমার সঙ্গে এক আলোচনায় বললেন, দেশহিতৈষী পড়নি? ওখানে লিখেছে নকশালবাড়ীর অভ্যুত্থান হল পশ্চিম বাংলায় যুক্তফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত ফরার জন্য সি, আই, এ ও কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্ত। প্রথম দিকে এটাই ছিল নকশালবাড়ী অভ্যুত্থান সম্পর্কে আব্দুল হকদের মনোভাব। পরে যখন ‘পিকিং রিভিউ’ একে স্বাগত জানালো তখন তারাও এর বড় সমর্থক হয়ে গেলেন। একেই বলে মার্কসবাদে নকলনবীশি। মার্কসবাদ সৃজনশীলভাবে উপলদ্ধি করতে না পারলে এমনি হাস্যকর পরিস্থিতির উম্ভব হয়। ছাত্র ইউনিয়নে জাফর-মেননদের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক বিরোধ এমনিভাবে তীব্র হতে থাকে। তদুপরি সাংগঠনিক কারণেও বিরোধ দানা বেধে উঠে। সাংগঠনিক বিরোধের কারণ ছিল সংগঠনে ব্যক্তিগত আধিপত্য ও ব্যক্তিপূজাবাদ। এই ধরনের বুর্জোয়া প্রবণতার বিরুদ্ধেও সংগ্রাম তীব্র হয়ে উঠে। এছাড়া জাফরপন্থীদের তরফ থেকে চীনের সর্বহারার মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সম্পর্কেও আপত্তিকর মন্তব্য হতে থাকে। একারণেও তারা জঙ্গীকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন। এমনি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বিরোধী পক্ষের চক্রান্তের জালকে ছিন্ন করে আমার সমর্থকরা আমাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করতে সমর্থ হন। বহুদিনের সুপ্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরোধে এটাই ছিল কর্মীদের সকল বিদ্রোহ। এ সময় শাসকগোষ্ঠীর জুলুম অত্যাচাৱও চরমে পেীছে সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা হরণ, ১৪৪ ধারা, লাঠি-গুলি, জেল-জুলুম নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সরকার বিরোধী ছাত্রদের উপ সরকারী ভাড়াটে ছাত্রসংগঠন এন, এস, এফ-এর অত্যাচার উৎস। সে না এম, এস, এফ নামধারী কতিপয় পাণ্ডা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসগুলো সকল প্রকার অসামাজিক কার্যকালাপের আখড়ায় পরিণত করে। এমনি এক পটভূমিতে আমাদের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের মুখে বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য এক উগ্র আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হল। অপরদিকে ছাত্রলীগ কর্মীদের একাংশ ভাবছে শুরু করলেন সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া আর কোন পভ্যস্তয় নেই। সপষ্টতঃই বুঝতে পারলাম যে সমাজে স্বাভাবিকভাবে বিক্ষোভ প্রকাশের পথ রুদ্ধ হয়, ন্যায় বিচার লুপ্ত হয় সেরকম সমাজেই বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রেরনা স্বতঃর্ফূতভাৰে সৃষ্টি হতে থাকে। ছাত্র লীগের এই অংশটির গুরু ছিলেন জনাৰ সিরাজুল আলম খান। ‘৬২-৬৩ তে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বিদায় নেবার পর জনাব খান বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র ছিলেন না। কিন্তু তিনি ইকবাল হলেই অবস্থান করতেন মাঝে মধ্যে মেডিকেল হোস্টেলে থাকতেন। লাল রং এর এটি ৫০ সি, সি, হোন্ডা নিয়ে সারা শহরময় ঘুরে বেড়াতেন এবং কর্মীদের সংগে সংযোগ রক্ষা করতেন। ৬৬ সনে ৭ই জনের হরতালের পর আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের প্রথম কাতায়ের নেতৃত্বে কারারুদ্ধ হয়ে গদলদ বস্তুত সিরাজুল আলম খানই সংগঠনের চেইন রক্ষা করে কর্মীদের মনোবল বজায় রাখতে সহায়তা করেন। ‘৬৮ সনে ইকবাল হলে তাঁর রুমে গিয়ে দেখেছি তিনি ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে মাসলেলিন ও মাওসেতুঙের বই বিলি করতেন ও পড়তে বলতেন । মাঝে মাঝে এইসব কর্মীদের নিয়ে স্টাডি ক্লাসেও আয়োজন করতেন। আওয়ামী লীগের দিনে তাঁর এই ফর্ম তৎপরতার ফলে বিশেষ কোন পদে অধিষ্ঠিত না থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগে তার গুরুত্ত্ব খুব বেড়ে যায়। একবার তিনি আমাকে জানালেন (৮৪ সাল) তার প্রচেষ্টার ফলেই আওয়ামী লীগে পর রাষ্ট্রনীতি ক্ষেত্রে, জোটনিরপেক্ষতা ও সিয়াটো, সেল্টো ত্যাগে কর্মসূচি গৃহীত হয়। তবে সেই সময় তিনি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্যারালেল কোন সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন কিনা তা আমার জানা নেই। তখনকার দিনে আন্দোলনে প্রশ্নে ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপ ও ছাত্রলীগ একযোগে কাজ করতো। কিন্তু ৬ দফা আন্দোলনের পর থেকে এই ঐক্য অটুট রাখা এ কঠিন সংগ্রামের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্রলীগ যে কোন ইস্যুতেই ৬ দফা সমর্থন করাকে ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে দাবী করতো। অপর দিকে আমরা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকে প্রধান শর্ত হিসেবে হাজির করতাম, এতে করে ঐক্য অর্জন দুরূহ হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু রাজনীতিতে আপোষের কোন ঠাই নেই। অপরদিকে মতিয়া গ্রুপ ৬ দফাকে সমর্থন করতে বলে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। তাঁদের এই সুবিধাবাদী অবস্থানের ফলে ছাত্র-ঐক্য অর্জন কর একটা কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ২১শে ফেব্রয়ায়ী ও ১৭ই সেপ্টেম্বরের মত দিবনগুলো পালন করার ব্যাপারে এক নাজূফ পরিস্থিতির উম্ভব হত। আমরা বলতাম ছাত্রলীগের উচিত নয় তাদের দলীয় কর্মসূচী আমাদের উপয় চাপিয়ে দেয়া কিন্তু তাঁরা বলতো ৬ দফা যেহেতু বাঙালী জাতির কর্মূসচী সুতরাং এই প্রশ্নের কোন উত্তর থাকতে পারে না। বিশেষ ফয়ে মতিয়া গ্রুপের সমর্থনে বলীয়ান হয়ে তারা আমাদের উপর তাদের কর্মসূচী চাপিয়ে গিতে চাইতো কিন্তু আমরা আমাদের বিঘোষিত-নীতি থেকে একচুলও নড়িনি বলে ওরা আমাদের বক্তব্যের যৌক্তিকতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। কেননা ঐক্য তাদেরও দরকার। তাদের বহুকর্মী কর্মকর্তা নেতা আইয়ুবের কারাগারে। একগেয়ে মনোভাব নিয়ে কোনো ফায়দা হবে না এটা তারা বুঝতে পেরেছিলেন। সবকিছুর উর্ধে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা সমন্ধে উপলব্ধি আর্দশগত মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও তৎকালে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিল। বিভিন্ন সময়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ক্ষেত্রে ৬ দফার স্লোগানটই নয় ৬ দফায় মধ্যকার কর্মসূচিগুলিকে গ্রহন করে আমরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কর্মসূচিগুলি প্রণয়ন করতাম।আটষট্টি সালের অক্টোবরে এন, এস, এফের সাপ্তা সাইফুর রহমান নিহত হয়। সাইফুর রহমানদের অত্যাচার অবিচার চরমে গেলে তার স্বাভাবিক পরিনতি হিসেবে এই ঘটনাটি ঘটল। ঘটনাটি ঘটে সলিমুল্লাহ হলে রাত ৮-৯টার দিয়ে। এরকম কোন ঘটনা ঘটৰে তা কস্মিনকালেও ভাবতে পারিনি। আমি সে সময় মহসীন হলে জনাব আবদুল কাসেম ফজলুল হকের রুমে। জনাব হক সে সময় বাংলা বিভাগে গবেষণা করেন। এন, এস, এফের পান্ডা সব মুসলীম হলস জড় হয়েছিল নিঃখরচায় রোষ্ট খাবার উদ্দেশ্যে। এর কিছুদিন আগে অর্থনীতি বিভাগে কৃতি রেজওয়ানুল ইসলাম (বর্তমানে ডঃ রেজওয়ানুল ইসলাম) ও খালেদকে এন, এস, এ এৱ জনৈক পাণ্ডা অহেতুক মারধোর করেছিল । এরা উভয়ই ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে বেশ কিছুদিন হয়ে উত্ত্বেজনা চলছিল। আমি জনাব হকের রুম থেকে মুসলীম হলে ফিরে আসার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স ক্লাবের সামনে জনৈক ছাত্রর কাছে শুনতে পেলাম মুসলীম হলে লঙ্কাকান্ড ঘটে গেছে। সেখানে এখন কুরুক্ষেত্রের লড়াই চলছে। সুতরাং মুসলীম হলে যাওয়াটা নিরাপদ বোধ করলাম না। রাতে মহসীন হলে সৈয়দ রুহুল আমিনের রুমে থাকলাম। রূহল আমীন ছিলেন আমাদের মহসীন হল শাখার সভাপতি। সাইদুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা ঢাঝায় উইচ হান্টিং শুরু হয়। তাই ইউনিয়নের কর্মীরা যে সেদিকে পারলেন পালিয়ে বাঁচলেন। ঘটনার দুদিন পর আমি মুসলিম হলে আসলাম আমার জিনিষপত্র নেয়ার জন্য। হলের দারোয়ান হাশমত দেখেই বললো, স্যার কেন এসেছেন ? শিগগির পালান। আপনাকে পেলেই ও মেরে ফেলবে। সৌভাগ্যবশত ওরা কেউ হলে ছিল না। আমি ধীরে সুস্থে গোসল সেরে আমার ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পরদিন গেলাম মাদারিপুর সেখানে সম্মেলন হল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হল ! মুসলীম লীগের লোকেরা সম্মেলন প্যান্ডেল আক্রমন চালাবার পায়তারা করছিল। কিন্তু শ্রমিক নেতা বাদশা মিয়ার নেতৃত্বে বিড়ি শ্রমিকরা আমাদের সহায়তা করায় তাদের সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। এর পরদিন আসলাম ফরিদপুর ছাত্র ইউনিয়ন সম্মেলনে। ঐ সম্মেলনে কৃষক নেতা আব্দুল হক, আবদুল মতিন ও আলাউদ্দিন আহম্মদ নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আবদুল হক সাহেব দুপুরের পরেই বিদায় নিলেন। আলাউদ্দিন আহমদ ও আবদুল মতিন যাবেন রাতের গাড়ীতে। এদিকে বৈকালিক অধিবেশনে আমি রাজনৈতিক বক্তব্য রাখছিলাম এমন সময় বাইরে থেকে খবর এল একদফা সরকারি পান্ডা আমাকে কিডন্যাপ করার পাঁয়তারা করছে। আমাদের কর্মীরা খবরটা পাওয়ামাত্র আমাকে বক্তব্যটা সংক্ষিপ্ত করতে স্লীপ দিলেন। তা শেষ হয় পর তারা আমাকে জনাব জাহিদ হোসেনের বাড়ীতে নিরাপদ রেখে এলেন। জাহিদ হোসেন তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও আমাদের সমর্থক। রাতের বেলা জনাব আলাউদ্দীন আহম্মদ ও জনাব আবদুল মতিন ফিরে আসার সময় আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাহিদ হোসেনের বাড়ীর কাউকে জাগানো যায়নি বলে তাঁরা চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু জনাব নাজমুল হক নান্নুকে রেখে গেলেন যাতে তিনি আমাকে সঙ্গে করে পাবনার শাহাপুরে জনাব আলাউদ্দীন আহম্মদের বাড়ি নিয়ে যান। পরদিন ঢাকা থেকে জনাৰ আহম্মেদ কামাল ফরিদপুর গিয়ে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমি ভাবছিলাম ঢাকাতেই ফিরে যাব। আহমেদ কামাল ঢাকাতে ফিরে যেতে বারণ করলেন কারন এন, এস, এফ এর পাণ্ডাদের কবলে পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু। সুতরাং সিদ্ধান্ত হল সেদিন রাতেই পাকশী হয়ে পাহাপুর চলে যাব। নিরাপত্তার খাতিরে ফরিদপুর স্টেশন বেয়ে না উঠে ফরিদপুরের আগের স্টেশন অম্বিকাপুর থেকে গাড়ীতে উঠলাম। শুরু হল আমার আত্মগোপনের জীবন। শাহাপুরে দিন কয়েক থেকে কয়েকটি কৃষক বৈঠকে অংশগ্রহণ করলাম। কৃষকদের নিয়ে কি ভাষায় আলোচনা করতে হয় তা আমার মোটেই জানা ছিল না। শাহাপুরে কিছুদিন থাকার পর কৃষকদের সঙ্গে কথা বলার ভাষাটা কিছুটা আয়ত্ব করতে সক্ষম হলাম। আমাকে কৃষকদের নিকট পরিচিত করানো হল তাদের একজন ছাত্রবন্ধু হিসেবে। সেই সময় শাহাপুর অঞ্চলে ধলতা প্রথার বিরুদ্ধে প্রচার আন্দোলন চলছিল। জনাব আলাউদ্দীন আহম্মদ ও অন্যান্য কৃষক নেতারা ধলতা প্রথার মাধ্যমে শোষণের রূপ বর্ণনা করে বক্তব্য রাখতেন। এইসব বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে তারা আর একটা কথাও বলতেন তা হল পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলাকে আলাদা করার কথা। এই ফেরারী জীবনের এক পর্যায়ে ৬৯ সালের জানুয়ারী মাসে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছে। পত্রিকায় এই সংবাদ দেখামাত্রই অনুভব করলাম আমার অবিলম্বে ঢাকার পথে রওনা হওয়া উচিত। অন্যথায় সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। বিশেষ করে আমাদের সংগঠনের কর্মীদের পক্ষে ছাত্রলীগ ও মতিয়া গ্রুপের সঙ্গে পালা দিয়ে এগনো কঠিন হবে। এই প্রয়োজনীয়তা আমি আরও বেশী অনুভব করলাম যখন দেখলাম, সবর্দলীয় সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচীতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের পক্ষে স্বাক্ষর করেছেন সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব নুরুল হাসান ও প্রচার সম্পাদক জনাব নুর মোহাম্মদ খান। পরিস্কার বোঝা গেল সংগঠনের সভাপতি জনাব জামাল হায়দর সহ বিশিষ্ঠ নেতৃবর্গ সক্রিয়ভাবে কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। আমি ৭ই জানুয়ারী ঢাকায় চলে এলাম ও গোপনে কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম। এমনিভাবে ২০শে জানুয়ারী পর্যন্ত আত্মগোপন অবস্থায় কাটিয়ে দিলাম। এদিকে সংগঠনের মধ্যে যেসব কৰ্মীরা আমার সমর্থক ছিলেন তারা নুরুল আমীন ও অন্যান্য (‘ডার্ক’ (ডেমোক্রাটিক এ্যাকশন কমিটি) নেতত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলে একটি ইশতেহারে খসড়া তৈরী করেছেন। খসড়াটি আমি অনুমোদন করার পর ওটা ছাপিয়ে বিলি করার ব্যবস্থা করা হল। সম্ভবতঃ ২০শে জানুয়ারীর দিকে ঐ ইশতেহারটি বিলি করা হয়। এখানে উল্লেখ যে, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসূচীর পাশাপাশি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত ‘ডার্ক’ ৮দফার একটি কর্মসূচী হাজির করেছিল। ওয়ালী ন্যাপ ও আওয়ামীলীগও ‘ডার্ক’ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘ডার্ক’ এর ৮ দফা কর্মসূচীতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসন কিংবা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দাবী সমূহ অন্তর্ভুক্ত হয়নি: আওয়ামীলীগ তার এতদিনকার রাজনৈতিক অবস্থানকে পরিহার করে এই জোটের মধ্যে শামিল হয়, এর আগে আওয়ামীলীগ ৬ দফাকে বাদ দিয়ে কোন ঐক্য জোটে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করতো। আওয়ামীলীগ ‘ডার্ক’ এ অংশগ্রহণ করলেও ছাত্রলীগ ‘ডার্ক’ জোটকে পছন্দ করতো না। এটাই ছিল তখনকার রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। ছাত্র সংগঠনগুলো একেবারেই রাজনৈতিক দলের লেজুড় পরিণত হয়নি। অনেক সময় ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় ভিন্নতর অবস্থান গ্রহণ করছে। কিন্তু মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন ও মস্কোপন্থী ন্যাপ ‘ড্যাক’ এর প্রতি জোর সমর্থন দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে ভাসানী-ন্যাপ ইতিপূর্বেই সিদ্বান্ত নিয়েছিল ‘৭০ সালে আনুষ্ঠিতব্য আইয়ুবেরর মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না! আন্দোলন শুরু হয়ে যাওয়ার পর মস্কোপন্থী ন্যাপ ব্যতিরেকে আওয়ামীলীগ সহ ড্যাক ভুক্ত দলগুলিও নির্বাচন বর্জনের সিন্ধান্ত নেয়। মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনকে ড্যাক-এর সঙ্গে একাকার করে দিতে চাইতো। তাঁরা বলতো ড্যাক-এর ৮ দফা ও ছাত্র ১১ দফার মধ্যে কোন বিরোধ নেই। ১১ দফায় ৮ দফাও আছে। কিন্তু সাধারণ ছাত্র সমাজ ঠিকই বুঝতে পেরেছিল ১১ দফা ও ৮ দফাতে মোলিক তফাত কোথায় ? ১১ জন সংস্কারবাদী কর্মসূচী হওয়া সত্ত্বেও এতে ছিল ছাত্র শ্রমিক কৃষকদের অর্থনৈতিক দাবী দাওয়া। ছিল স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির দাবী। প্রগতিশীল বামপন্থীরা যে সব ইস্যুর কথা এতদিন বলতেন ১১ দফাতে তার স্বীকৃতি মিলল। এদিকে ড্যাক বিরোধী ইশতেহার বিলি নিয়ে ছাত্রলীগ ও মস্কোপন্থী ছাত্রনেতারা উম্মা প্রকাশ করলেন। এমনকি জামাল হায়দরও আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের এক কর্মীসভায় বললেন, যদি আমাদের কর্মীরা কেউ এ কাজ করে থাকে তাহলে তার খুব নিন্দনীয় কাজ করেছে। এরা কেউ বুঝতেন না ঐক্য ও সংগ্রামের প্রক্রিয়া। তদুপরি এই ইশতেহারে ১১ দফায় জোটকে নিন্দা করা হয়নি। নিন্দা করা হয়েছে একটি দক্ষিণপন্থী জোটকে। তাছাড়া একটি বৃহত্তর আন্দোলনে সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের মত প্রকাশ ও প্রচারের স্বাধীনতা না থাকলে তাকি সত্যিকারের গণ আন্দোলন হতে পারে ? ২০শে জানুয়ারীর বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামান শহীদ হলেন। শহীদ আসাদ হলেন এদেশের গণ-আন্দোলনে প্রথম সচেতন কর্মী যিনি শাহাদত বরণ করেছেন। যেদিন শহীদ হলেন সেদিন বিকেল ৩টায় নগরীতে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মৌন মিছিল বের হল। সমস্ত নগরী শ্ৰদ্ধাবনতচিত্তে মৌনতার ভাষায় সেই মৌন মিছিলের সঙ্গে একত্মতা প্রকাশ করেছিল। আসাদের আত্মহুতি ১১ দফার আন্দোলনকে দিল এক সবাত্মক সর্বব্যপক রুপ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৪শে জানুয়ারী দেশ ব্যাপী হরতাল ও বিক্ষোভের ডাক দিল। ২৩শে জানুয়ারী পর্যন্ত আমি ছিলাম আত্মগোপনে। ২৪শে জানুয়ারী গণ-অভ্যুথান সফল হল। শাসকগোষ্ঠী ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লক্ষ জনতা রুদ্র রোষ ফেটে পড়লো। বেলা ১২টার দিয়ে পাঁচ লক্ষ লোক ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে পল্টন ময়দানে এসে জমায়েত হয়েছে। ওরা সঙ্গে করে বয়ে এনেছিল দুজন শহীদের লাশ। শহীদ মতিয়র ও শহীদ রুস্তম। মতিয়র রহমান শহীদ হয়েছিলেন সেক্রেটারীয়েটের সামনে পুলিশের গুলীতে। লাশ দুটির মুখে প্রশান্ত পবিত্রতার ছাপ। আমিও আত্মগোপন অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে জনতার সমুদ্রে যোগ দিলাম! সাইফুদ্দীন আহমেদ মানিকও ঐ একই দিন আত্মগোপন অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। আমি যখন প্রকাশ্যে এসেছি তখন দেখতে পেলাম ১১ দফার অন্যান্য নেতৃবৃন্দও একটি বেঞ্চের উপর দাড়িয়ে রুদ্র রোষে ফেটে পড়া জনতাকে নানা কথা বলে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। মাঠের অপর প্রান্তে মোনেমের লাটভবন দেখা যাচ্ছে। সামরিক বাহিনীর লোকেরা লাটভবনের দেওয়ালে হালকা কামান ও মেশিনগানের নল তাক করে আছে। বিক্ষুদ্ধ জনতা নেতৃবৃন্দের কাছে হুকুম চাইছে লাটভবন ধুলিস্যাৎ করে দেয়ার। তখন বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত দিলেও লাভবনের প্রতিটি ইট জনতা খুলে ফেলতো। কিন্তু নেতৃবৃন্দ ভাবলেন এমন ধরনের ইঙ্গিত দিলে রক্তাক্ত ও বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে যাবে। জনতা পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণার দাবী জানাতে থাকে। ছাত্রলীগ ও মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা কিছুতেই তা করবেন না। আমি বললাম, পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করতে আমাদের আপত্তি কোথায়? ছাত্রনেতারা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধার দোহাই দিয়ে ও জনতাকে দরুদ পড়ার আহবান জানিয়ে কিছুটা শান্ত করতে সক্ষম হলেন। শহীদদের জন্য জানাযা পড়া হল। মৌলবী সাহেব মোনাযাত করলেন “ইয়া আলাহ জালেমশাহী ধংস করে দে, ইয়া আল্লাহ, তুই অত্যাচারীর মুখ কালা করে দে।” প্রতিবার যখন মৌলবী সাহেব “ইয়া আল্লাহ” বলছিলেন। জনগণ সমম্বরে “ইয়া আল্লাহ” বলছিলেন! জানাযা শেষে পল্টনেরর বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রে লাশ নিয়ে মিছিল করে ইকবাল হলের দিকে অগ্রসর হল। ইকবাল হলের মাঠে সমবেত ছাত্র জনতাকে উদ্দেশ্য কয়ে প্রত্যেকেই কিছু বলায় চেষ্টা করলেন। মাঝখান দিয়ে সিরাজুল আলম খান হট করে মঞ্চ দখল করে লম্বা চওড়া বক্তৃতা শুরু করলেন। সিরাজুল আলম খানের অযাচিত হস্তক্ষেপ অনেকেরই পছন্দ হল না তবুও প্রবীণ ছাত্রনেতা হিসেবে সম্মানের খাতিরে কেউ তেমন কোন প্রতিবাদ করলেন না। শহীদ মতিয়ুরের পিতাও সেই সময় সন্তানের লাশ গ্রহণ করার জন্য এসে উপস্থিত জনতার প্রতি একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি বললেন, শহীদ মতিয়ুরকে হারিয়ে আমার কোন দুঃখ নেই, মতিয়ুর দেশ দশের জন্য আত্মাহুতি দিয়েছে। কিন্তু এক মতিয়ুরকে হারিয়ে আমি লক্ষ মতিয়ুরকে পেয়েছি। জুলম শাহীর পতন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু মজার ব্যাপার এতসব আনুষ্ঠানিকতার পরও আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করায় ব্যাপারে ছাত্রলীগ, মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন ও আমাদেয় একাংশ দোদুল্যমানতা প্রদর্শন করছিলেন। সকলের বিরোধিতার মুখে আমিও যে কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিনা। অথচ কর্মসূচী ঘোষণা না করার অর্থ আম্মেলনের মত্যে। সবাই জনতাকে বোঝাতে চাইলেন নেতৃবৃন্দ বসে আলাপ করে সিদ্ধান্ত দেবেন। অথচ পরিস্থিতি এমনি যে উপস্থিত ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত দেয়া যায়। জনাব বদরউদীন উমর এক আলোচনা সভায় এই ঘটনাকে পেটি বূর্জোয়া ছাত্র নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, ছাত্রদের পক্ষে এর বেশী করা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন-এর জঙ্গী কর্মীয় আওয়াজ তুললেন, “আগামী দিনের কর্মসূচী ঘোষণা কর ঘোষণা কর। জনগণও তাদের সাথে আওয়াজ তুললো, অবশেষে ছাত্র নেতারা বাধ্য হয়ে ২৫শে জানুয়ারী হরতাল ঘোষণা করলেন, শাসকগোষ্ঠী জারী করলো কারফিউ। কারফিউ চললো কয়েকদিন মাঝে মাঝে সংক্ষিপ্ত বিরতি।… ৩রা ও ৯ই ফেব্রুয়ারী পল্টনে জনসভা অনুষ্ঠিত হল। লক্ষ লক্ষ লোক জনসভায় সমবেত হল। সারা দেশবাসী ছাত্রনেতারা কি বলেন, কি নির্দেশ দেন তাৱ প্রতি উৎকর্ণ হয়ে থাকতেন। ১ই ফেব্রুয়ারী সমাবেশে কৃষক শ্রমিক ও মেহনতী জনতার প্রতি তাদের শ্রেণী দাবী দাওয়া আদায়ের আহবান জানানো হলো। শুরু হল কারখানা কারখানায় ঘেরাও। এই ঘেৱাও আন্দোলনের জনক ছিলেন মওলানা ভাসানী। ৬৮ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে বিভিন্ন জেলা ও মহকুমায় ডি, সি ও এস, ভি, ও দের বাংলো ঘেরাও করে মওলানা জনগণকে ঘেরাও আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। ছাত্রসমাজ যখন এতকিছু করছেন জাতীয় নেতারা তখন ড্রয়িংরুমের নিরাপদ কক্ষে আশ্রয় নিয়েছেন। ড্যাক নেতাদেরও কোন কর্মসূচী দেখা গেল না। ইতিমধ্যে তাঁর পল্টনে একটি জনসভার আয়োজন করলেন। কিন্তু জনতার রুদ্ররোষে তাদের সভা পণ্ড হয়ে গেল। ড্যাক এয় উদ্যোগে মূল শান্তি ছিল জামাতে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্র সংঘ। তাদের তখন শ্লোগান ছিল পাকিস্তানের উৎস কি? লা ইলাহা ইল্লালাহ, ‘তোমার নেতা আমার নেতা বিশ্ব নবী মোস্তফা’, ‘মস্কো না মক্কা মক্কা মক্কা’, পিকিং না মক্কা মক্কা। অপরদিকে জনতার শ্লোগান হল, ‘কেউ খাবে কেউ খাবেনা, তা হবে না তা হবেনা জয় জয় হৰে জয় সর্বহারার হবে জয় পাকিস্তান না বাংলা, বাংলা বাংলা ইত্যাদি, মওলানা ভাসানীরও তখন কোন কথা শোনা যাচ্ছেনা। ন্যাপ নএতৃবৃন্দ তাঁকে অনেক খোঁজাখুজি করেও তাঁর হদিশ পাচ্ছে না। অবশেষে তাঁকে দেখা গেল শাহজাদপুরের এক জনসমাবেশে বক্তৃতা করতে। তাঁকে ঢাকা নিয়ে আসা হল। ১৬ই ফেব্রুয়ারী পল্টনে ন্যাপের জনসভা হল। সেই সভায় মওলানা ভাসানী ও মিয়া আলিফ ইফতেখার প্ৰমুখ ন্যাপনেতারা বক্তৃতা করলেন। এমন সময় খবর আসলো পুলিশ একটি মিছিলের উপর গুলি করেছে। মওলানা বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করলেন এবং বজ্রকন্ঠে ঘোষনা করলেন ‘শেখ মুজিবকে মুক্তি না দিলে আমরা ফরাসী বিপ্লবের মত জেল ভেঙে মুজিবকে ছিনিয়ে আনবো।’ তাঁর এই বক্তৃতায় সাৱা ঢাকায় আগুন জ্বলে উঠল। আগুন জ্বললো আগরতলা ষড়ষন্ত মামলায় প্রধান বিচারপতি জাস্টিস হামুদুর রহমানের বাসভবনে, মন্ত্ৰী সবুরের বাসভবনে, মন্ত্রী ভবানী শংকর বিশ্বাসের বাসভবনে ও নওয়াব খাজা হাসান আসকারীর বাসভবনে। আবার কারফিউ জারি হল। ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ শামসুজ্জোহা, ছ, পি, আয়ের বেয়োনেট চার্জে নিহত হলেন। রাত ১১টায় রেডিও পাকিস্তানের সংবাদ বুলেটিনে এই খবর প্রচারিত হলে নগরীর হাজার হাজার লোক কারফিউ ভেঙে মিছিলে চলে আসলেন। কারফিউ ভাঙার মিছিলে বেশীর ভাগ অংশ নিয়েছিলেন বস্তির সর্বহারা মানুষ। রাতের অন্ধকারের সামরিক বাহিনীর গুলীতে কত লোক শহীদ হয়েছেন : জানা নেই। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে শ্রমিকরা ঘেরাও ধর্মঘট শুরু করলে শ্রমিকশ্রেণী তাদের বেতন ও সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রে বিরাট বিজয় অর্জন করলেন। ছাত্রদের হস্তক্ষেপে এসব ঘেরাও ধর্মঘটের নিষ্পত্তি হত। ১৬ই ফেব্রুয়ারীর পর বেসামরিক প্রশাসনিক যন্ত্র নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। রাস্তা থেকে পুলিশ প্রত্যহার করা হয়। ফলে পুলিশ ও বিচারের দায়িত্ব ছাত্রদেয় উপর বর্তায়। শত শত লোক বিভিন্ন অভিযোগ ‘ নিয়ে ইকবাল হলে আসতে থাকে। ছাত্ররা যে রায় দিত জনগন তাই মেনে নিতেন। ইতিমধ্যে আইয়ুবের দূত হয়ে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান একটি গোল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় নেতাদের সাথে সাক্ষাত করতে থাকলেন। তিনি ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গেও সাক্ষাত করলেন। এক পর্যায়ে মুজিবও প্রায় রাজী হয়ে গেলেন প্যারলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে। ছাত্ররা এই প্রস্তাব শোনামাত্র নানা প্রকার ধিক্কার দিল ফলে শেখ মুজিব শক্ত হলেন। পরিশেষে সরকার বাধ্য হলেন মুক্তি দিতে। শেখ মুজিৰ ২২শে ফেব্রয়ারী মুক্তি পেলেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আগরতলা মামলার অন্যান্য আসামীরায়াও মুক্তি পেলেন। আগৱতলা মামলায় (শেখ মুজিৰ ব্যতিরেকে) আসামীদেরকে জনতা পল্টন ময়দানে সংবর্ধনা দিলেন। ছাৱলীগের নেতারা সংগ্রাম পরিষদের কোন আলোচনা ব্যতিরেকে মাইকযোগে প্রচার করে দিলেন ২৪শে ফেব্রুয়ারী তাকে রেসকোর্সে গন-সম্বর্ধনা দেয়া হবে। ছাত্রলীগের এই ধরনের ঐক্য বিরোধী কার্যকলাপে সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে উষ্মার ভাব সষ্টি হল। এ নিয়ে ইকবাল হলের ছাত্রসংসদ অফিসে ২৩শে ফেব্রুয়ারী রাতভর মিটিং হল। সকাল ১০টা পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত হল না। আমরআ প্রস্তাব করলাম সফল রাজবন্দীকেই একযোগে সম্মানা দিতে হবে। কারন রাজৰন্দী হিসেবে সকলেই আমাদের নিকট সমান। এখন কি জনাব ভুট্টোও সেই সম্বর্ধনা সভায় থাকৰেন। তিনি তখন ঢাকায় ছিলেন। মুক্ত রাজবন্দীদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন যাঁরা দশ বছরেরও বেশী কাল আইয়ুবের কারাগারে বন্দী ছিলেন। দেশবাসীয় জন্য তাদের ত্যাগ তিতীক্ষা কম নয়। কিন্তু মস্কোপন্থিদের নমনীয় ভূমিকার ফলে শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবকে আলাদা সংবর্ধনা দেয়ার প্রস্তাবই গৃহীত হয়। দুপুর ২টার দিকে ছাত্র নেতৃবৃন্দ একটি জীপ সহযোগে নিয়ে আসতে তার বাসভবনে গেলেন। সেই প্রথম আমার শেখ মুজিবের সঙ্গে পরিচয়। শেখ মুজিব বললেন ‘হুজুর কি বলেন (মওলানা).? তিনি ঠিক থাকলে এবার বাঙালী সৰ দাৰী দাওয়া আদায় হবে। আমি বললাম, আপনাকেও তো ঠিক থাকতে হবে। যথাসময়ে রেসকোর্সে জনসভা শুরু হল। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের পক্ষ থেকে আমি বক্তব্য রাখলাম। আমি আমাযর বক্তব্যে শেখ মুজিকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, জনগণের বহু দাবীদাওয়া এখনো পুরন হয়নি। জনগণের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য শাসকগোষ্ঠী গোল টেবিল বৈঠকের টোপ ফেলেছে। এবার যদি শেখ মুজিৰ ১১ গফার প্রথম আপোষ করেন জনগণ তাহলে তাঁকে ক্ষমা করবেন না। আমার বক্তৃতায় একটি বিস্তারিত বিবরণ ২৫শে ফেব্রয়ারী আজাদ পত্রিকায় বেরিয়ে ছিল,আমি যখন বক্তৃতা শেষ করে বসে পড়লাম শেখ মুজিব আমার পিঠে হাত চাপড়ালেন। বললেন, “খুব তো বক্তৃতা দেয়া শিখেছিস কিন্তু আমাকে বেকায়দায় ফেলছিস।” এমন সময় ছয়-সংগ্রাম পরিষদে স্বঘোষিত আহবায়ক জনাব তোফায়েল আহমেদ মাইকের সামনে উঠে দাড়ালেন এবং বললেন “আমি জনাৰ শেখ মুজিবুর রহমানকে জনতার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করছি।” জনতাকে তিনি হাত তুলে এ প্রস্তাৰের প্রতি সমর্থন জানাতে বললেন। জনতা এই প্রস্তাবকে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের প্রস্তাব মনে করে হাত তুলে সমর্থন জানাল। শেখ মুজিবের শাসনামলে জনাৰ তোফায়েল আহমদের ভাগ্যোন্নতির জন্য একটা বড় কাৱন। এতে তিনি শেখ মুজিবের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠছিলেন, অথচ তখনকার সময়েয় ছাত্রলীগের মুল জন নেতা জনাব আবদূর রউফ ও জনাব খালেম মোহম্মদ আলী আন্দোলন সংগঠিত করার প্রশ্নে বিরাট অবদান থাকা সত্বেও তাঁদের সেই অবদানের স্বীকৃতি পাননি। জনাব তোফায়েল আহমেদকে সংগ্রাম পরিষদের স্বােঘোষিত আহবায়ক বলেছি একারনে যে সত্যিকার অর্থে সংগ্রাম পরিষদে কোন নির্ধারিত বা মনোনীত আহবায়ক ছিল না। ডাকসু’র সহ-সভাপতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐক্যলব্ধ অতীতরীতি অনুসারে সংগ্রাম পরিষদে সভাগুলোতে সভাপতিত্ব করতেন। এতেই তিনি জনগণের নিকট সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক প্রতিভাত হয়েছেন। পত্রিকাগুলো এব্যাপারে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেননি। শেখ মুজিব রেসকোর্সের সম্বর্ধনা সভায় ভাষণদান প্রসঙ্গে বললেন ছাত্র সমাজ তাদের ১১ দফায় তার ৬ দফা অন্তর্ভু করায় তিনি কৃতজ্ঞ। তিনি আরও বললেন, গোল টেবিল বৈঠকে আমি যাব। সেখানে আমি ৬ দফা ও ১১ দফা দাবী পেশ করবো। আমি কোন আপোষ করবো না। আমি কি আইয়ুব খাঁকে ডরাই যে আমি আপোষ করবো ? মওলানা ভাসানী ও জনাৰ জুলফিকার আলী ভুট্টা সেদিন ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। মওলানা ভাসানী জনাব সাইদূর রহমানের বাসভবনে উঠেছেনে। সন্ধ্যার পর সেখানে আইয়ুবের দূত খাজা শাহাবুদ্দীন এলেন মওলানাকে গোল টেবিলে বসতে রাজি করাতে। এর কিছুক্ষণ পূর্বে জনাব ভুট্টোও এসেছেন মওলানা সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করতে গোল টেবিল বৈঠকের ব্যাপারে তাঁরা কি করবেন ? উভয় নেতা একমত হলেন তারা গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দেবেন না। খাজা শাহাবুদ্দীনকে মওলানা কিছু ফারসী বয়াত আউড়ে বিদায় দিলেন। বয়াতটির কথা আমার মনে নেই। ভাসানী ও ভুট্টো ব্যতিরেকে সব নেতাই গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দিলেন। কিন্তু বৈঠকে মৌলিক কোন প্রশ্নে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হল না। ছাত্রদের ১১ দফার কথাও শাসকগোষ্ঠী গ্রাহ্য করলেন না। মওলানা আগেই ঠিক করেছিলেন যেহেতু বৈঠকের কোন কর্মসূচী নেই সুতরাং আলোচনা নিরর্থক। গোল টেবিল বৈঠকে কেবলমাত্র একটি প্রশ্নে ঐক্যমত হল। তা হল সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পার্লামেন্টারী ধরনের সরকার গঠন। ইতি পূর্বে ২১শে ফেব্রয়ারীর ভাষণে আইয়ুব খাঁন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে বহাল না থাকতে সংকল্প ঘোষণা করলেন। এদিকে শেখ মুজিব গোল টেবিল বৈঠক শেষে আইয়ুৰ খানের সাথে এক নৈশ ভোজে মিলিত হলেন। এই নৈশভোজ ৬ ঘণ্টা অব্যাহত ছিল। এই ৬ ঘণ্টায় তাঁরা কি আলোচনা ছিলেন তা প্রকাশ হয়নি। তবে জনশ্রুতি উঠেছিল শেখ মুজিব সেই আলোচনায় আইয়ুৰ খানকে দেশের শ্রেসিডেন্ট পদে বহাল রাখতে রাজী ছিলেন আর তিনি হবেন প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানে মার্কিন ঘেষা পুর্জিপতি হায়ুন গোষ্ঠী এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিলেন। যখন গোল টেবিল বৈঠক চলছে মাওলানা ভাসানী তখন গেলেন পশ্চিম পাকিস্তান সফরে। এ সময়ে মওলানা লাহোর থেকে করাচী পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে বক্তৃতা করেন। জনাৰ মোহাম্মদ তোয়াহাও তার সঙ্গে গেলেন। সফরের মাঝখানে তিনি ফিরে আসলেন, বিভিন্ন জায়গায় মওলানা জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন, । পাঞ্জাবের শাহীওয়ালে জামাতে ইসলামীরা মওলানার উপর দৈহিক হামলা চালালো, এর প্রতিবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হল। মওলানা তখন ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলতে শুরু করেছেন। আর পশ্চিম পাকিস্তান সফরের শুরু থেকেই জামাতীরা বিভিন্ন সভায় গোলযোগ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। এই প্রতিবাদে সারা পশ্চিম পাকিস্তানের শ্লোগান উঠে “এফ মওদুদী লাখ ইহুদী।” এদিকে ছাত্র সংগ্রাম পৱিষদ বি, ড়ি চেয়ারম্যান মেম্বরদের পদত্যাগেয় আহবান জানায়। ফলে আন্দোলন গ্রাম বাংলাতেও ছড়িয়ে পড়ে। অত্যাচারী ও দুর্নীতিপরায়ন বি, ডি মেম্বারদের বিরুদ্ধে গণ-অভিযান শুরু হয়। গ্রামাঞ্চলে টাউট ও দুর্নীতি পরায়ণদের বিরুদ্ধে দূত শ্রেণী জাগৱণ শুরু হয়, ঘটনা লক্ষ্য করে ততকালীন দেশরক্ষা মন্ত্রী শেখ এ, আয়, খান মন্তব্য করেন, ‘তৃতীয় শক্তি আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, এ হল কমিউনিষ্ট।’ এ থেকেই শাসক গোষ্ঠীর শ্রেণীভীতি স্পষ্ট হয়ে উঠে। মওলানা ভাসানী ঢাকা ফিরে এলেন। হাজার হাজার ছাত্রজনতা লাল পতাকা হাতে শ্লোগান দিয়ে মওলানাকে স্বাগত জানাল। মওলানাকে একটা ট্রাঙ্কের উপরে বসিয়ে মিছিলের পুরোভাগে রাখা হল। মওলানার পাশ ঘিরে দাড়িয়েছিলেন জনাব মোহাম্মম্ব তোয়াহা, জনাব কাজী জাফর আহমেদ, জনাব রাশেদ খান মেনন, জনাব জামাল হায়দার, জনাব মাহফুজ উল্লাহ ও আমি নিজে। মিছিলে শ্লোগান উঠতে বললা নির্বাচন নির্বাচন বর্জন, বর্জন।” কর্মীদের মধ্যে নকশাল বাড়ী আন্দোলনের প্রভাবে এমনিতেই একটি নির্বাচন বিরোধী মনোভাব সংকামিত হয়েছিল। এ সঙ্গে মওলানা বিমান বন্দরের ভাষণ অগ্নিতে ঘৃতাহুতি স্মরুপ হল, মওলানা বিমান থেকে অবতরণ করেই বললেন এবার যদি নির্বাচন হয় তাহলে প্রথমে অনুরোধ কোরবো নির্বাচন বর্জন করতে, অনুনয় বিনয় কোরবো, তাতেও যদি কর্ণপাত না করে তাহলে পোলিং বুথ জ্বালিয়ে দেবো, জ্বালিয়ে দেবো।” তোয়াহা সাহেব নির্বাচন বর্জন শ্লোগান বলতেই ট্রাঙ্কের উপর দাঁড়িয়ে আমার কানের কাছে মুখ রেখে মন্তব্য করলেন, জানিনা কি হবে ? তোমরা যা ইচ্ছা তা কর। আমরাও দেখলাম শ্লোগানটা অত্যন্ত নেতিবাচক হয়ে যাচ্ছে। আমি ও জনাৰ রাশেদ খান মেনন কর্মীদের আহবান করে বললাম এই শ্লোগান নয়, শ্লোগান দাও নির্বাচন না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম”, ভোটের আগে ভাত চাই, নইলে এৰার রক্ষা নাই। মিছিল শহীদ মিনার পর্যন্ত গিয়ে শেষ হল। সেখানেও মওলানা ঐ একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। এদিকে শেখ মুজিব গোল টেবিল বৈঠক থেকে ফিরে এসে ঢাকা বিমানবন্দরে মন্তব্য করলেন, অধ্যাপক গোলাম আযম, মাহমদ আলী নুরুল আমীন প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাঁরা ছাত্রদের ১১ দফা সমর্থন করেননি। মওলানা ভাসানী সম্পর্কে আস্ফালন ফল তিনি মন্তব্য করলেন, “মাওলানা সাহেবের রাজনীতি থেকে অবসরগ্রহণ করা উচিত।” মুজিবের এই উক্তি অনেককেই বেদনা দিয়েছিল। এই উক্তির পর ছাত্রলীগ কর্মীরা মাহমুদ আলীর বাড়ীতে চড়াও হল। সম্বর্ধনা শেষে মওলানা ভাসানী সাইদুল হাসানের বাসায় উঠলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মহবুব মার্শাল’ল হলে তোমরা কি করবা ?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরকম কিছু হবে নাকি? মওলানা মৌন থাকলেন, কথা ছিল পরদিন তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেবেন। কিন্তু তা না করে রাতের বেলা সন্তােষ চলে গেলেন। মওলানা এমনিভাবেই তার রাজনৈতিক পদক্ষেপকে রহস্যাবৃত করে রাখতেন। এখন প্রশ্ন মাওলানা কি সামরিক আইন জারী হবার খবর জানতেন? খুব সম্ভবতঃ পশ্চিম পাকিস্তান সফর কালেই তিনি তা জানতে পেরেছিলেন। হয়তো এ ব্যাপার নিয়ে সামরিক বাহিনীয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার আলাপও হয়ে থাকতে পারে ! সে ইতিহাস রহস্যাবৃত । এখন প্রশ্ন কি উদ্দেশ্যে মওলানা পোলিং বুথ জ্বালিয়ে দএবার কথা বলেছিলেন ? কোন কারন বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে মওলানার এসব উক্তি বেখাপ্পা মনে হয়েছিল। তবে মনে হয় দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকরা নির্বাচন অনুষ্ঠান ও পরবর্তীকালে আইয়ুবকে গদীতে বহাল রাখার জন্য যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন তাকে নস্যাৎ জন্যই মওলানা নির্বাচন বানচালের কথা বলেছিলেন। ২৫শে মার্চ রাত ৮টায় বেতার ভাষণের মাধ্যমে আইয়ুব খান সামরিক আইন ঘোষণা করলেন ও জেনারেল ইয়াহিয়ার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন। আইয়ুব খান তাঁর ভাষণে বললেন “I cannot preside over the destruction of my country”. আইয়ুব খান বিদায় নিলেন বটে, কিন্তু পাকিস্তানের ধ্বংস রোধ করা গেল না। মাত্র দুবছরের মধ্যেই জন্ম হল নতুন রাষ্ট্র-বাংলাদেশের।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.09.09-9.pdf” title=”1977.09.09″]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!