You dont have javascript enabled! Please enable it! 1977.09.09 | চৌষট্টির ছাত্র আন্দোলন | রাশেদ খান মেনন | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ - সংগ্রামের নোটবুক

চৌষট্টির ছাত্র আন্দোলন | রাশেদ খান মেনন | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭

বাংলাদেশের আন্দোলনে কথা লিখতে গেলে ষাটের দশকের বছৱগুলিকে আলাদা আলাদা করে ভাগ করা মুস্কিল। কারণ বাষাট্টিতে যে আন্দোলনের সূত্রপাত ষাটের সারা দশক জুড়েই তা ব্যপ্তি লাভ করে। এর মাঝে জোয়ার-ভাটা আছে। আছে তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ সময় যখন-সাৱা দেশের মানুষ এক হয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য। আবার আছে অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ অবস্থা-যে সময়টা অনেকের কাছেই মনে হয় যে হয়ত বা সব কিছুর ইতি হয়ে গেল। কিন্তু সমস্ত দশক ফৱে সারা সমাজ জীবন জুড়ে টালমাটাল চলছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, জীবনে নতুন উপাদানের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। তবুও আন্দোলনের এই উত্থান-পতন, ঘটনার গতিস্রোতের জোয়ার-ভাঁটা, বাঁক-মোড় এক একটি বছরকে কি বিনষ্ট করে রেখেছে। উনিশ শ’ চৌষট্টি, ষাটের দশকের এমনি বৈশিষ্ট্যময় বছর। এই সারা বছরটিই ছিল ঘটনায় পরিপূর্ণ এবং এই ঘটনাগুলি এমনভাবে বিকাশ লাভ করেছে যে সমাপ্ত জীবনের ভিতর সপ্ত কতকগুলি গল্পপূর্ণ প্রশ্ন এর মধ্য দিয়ে সামনে এসে যায়! এই প্রশ্নগুলিকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে যে নানা ধরনের দৃষ্টিভোংগী এ সময় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে, তাই পরবর্তী ঘটনাবলীর গতিধারা, সামাজিক শক্তিসমূহের অবস্থান অনেকাংশে নিদিষ্ট করে দেয়। এক কথায় বলা চলে যে বাষট্টি সাল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নতুন যাত্রা শরির কাল, আর চৌষটি পথ বাছাইয়ের। চৌষট্টির ঘটনাবলীগলিকে একটু খতিয়ে দেখলেই বৈশিষ্ট্যময় দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন দিয়ে শবন করা যেতে পারে। বস্তুতঃ এটাই চৌষটির প্রথম উলেলখযোগ্য ঘটনা। আর এই ঘটনা সামাজজীবনে এমন তোলপাড় সৃষ্টি করে যার মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতিস্বত্তার নিজস্ব স্বকীয়তার প্রশ্ন ভীর ও তীক্ষভাবে সামনে চলে আসে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে যে প্রশ্নগুলো উঠে আসে সে গুলো সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার সঙ্গে এই আন্দোলনের সম্পর্কে প্রশ্ন! – এ কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে আন্দোলনের বিকাশ যে সামাজিক শক্তি সর্বাপেক্ষা সক্রিয় ছিল তারা হলেন সে সময়কার ছাত্র-যুব সমাজ, মূলতঃ ছাত্র সমাজ। পাকিস্তান উত্তর যুগে নতুন প্রেক্ষাপটে এদের জীবনে প্রবেশ । তৎকালীন পাকিস্তানের সমাজজীবনের অনড়তা, অবক্ষয়, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির স্বৈরতান্ত্রিক কেন্দ্রীভূত শাসনেৱ পোষণ ও অত্যাচার এদের তাড়িত করেছিল বাষট্টিতে বাঁধ ভাঙাতে। তখনও কোন নিদিষ্ট ভাবনা সেখানে প্রবল ছিল না। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের কিছু পুরানো কর্মী ও তাদের পিছনে তৎকালীন গোপন কমিউনিষ্ট পার্টি এ সকল আন্দোলনের পুরোভাগে থাকলেও কোন নির্দিষ্ট যারা অনুসরণ করে নয়, বরঞ্চ এই শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ হিসেবে আন্দোলনের আত্ম প্রকাশ। কিন্তু আন্দোলনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নিদিষ্ট চিন্তাভাবনা সময় সামনে, আসতে থাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও তার বিরুদ্ধে আন্দোলন এ ধরনের ঘটনা একটি, যা সেই চিন্তাভাবনা গুলিকে মুখোমুখি এনে দাড় করায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ভাৱ বিরুদ্ধে প্রতিৱোধ : ভারত ও পাকিস্তানের জন্মের পূর্ব থেকেই সাম্প্রদায়িকতা এদেশের রাজনীতির অন্যতম মূল বিষয়বস্তু ছিল। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার নিজের স্বার্থে এই সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়। আর উপ মহাদেশের রাজনীতিতে তার সহযোগী শক্তি সমূহ জনগণের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করে তাদের কায়েমী স্বার্থের স্বপক্ষে ব্যবহারের জন্য তাকে সযত্নে লালন করে ও প্রসার ঘটায়। ভারত ও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠিরও তাদের ক্ষমতাকে নিরুপদ্রব ও নিরংকুশ করার জন্য এই হাতিয়ারটি সযত। ব্যবহার করেছে-যখনই প্রয়োজন হয়েছে। বাষট্টিতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র আন্দোলনে মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা সুরগুলি শাসকগোষ্ঠি বঝতে ভুলে করেনি। তাই দমননীতি যখন সম্ভব হলোনা, তখন কৌশলে যাতে তাকে বিভ্রান্ত করা যায় তার পর তার গ্রহণ করে। ধর্ম, তাহজিব, মন্দনের সপক্ষে প্রচারত নৈমত্তিক ব্যাপার। যে ঘটনা তাদের সামনে সুৰর্ণ সুযোগ এনে দেয় তা হলে কাশ্মীরের হরতালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ওপারের দাঙ্গাকারীদের তৎপরতার সঙ্গে সঙ্গে এপারের দাঙ্গাকারীরাও তৎপর হয়ে ওঠে। সরকারী প্রশাসনযন্ত্রও নির্বিকারে দাঙ্গাকারীদের পক্ষ গ্রহণ করে জনগণের মঝে বিভেদ সৃষ্টি করতে এগিয়ে আসে। এর আগেও এদেশে দাঙ্গা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধও আছে। কিন্তু চৌষটির এই দাঙ্গা সৃষ্টির ব্যাপারে পাকিস্তানের বৃহৎ পুজিপতি, মোনেমী প্রশাসনযন্ত্রের হাত ছিল, তেমনি এর প্রতিরোধে সমস্ত শক্তি একাট্টা হয়ে রুখে দাঁড়ায়। কেবল ছাত্র, রাজনৈতিক, সমাজকমীরাই নয়, উচ্চ পদস্থ বাঙালী কর্মচারীরাও সরকারী কর্তাব্যক্তিদের স্বরাচক্ষ, উপেক্ষা করে “কনস্টেবুল্যারী” গঠন করেন এবং সক্রিয়ভাবে দাঙ্গাকে রুখে দাড়াতে এগিয়ে আসেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে বিভিনস্তরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আহান সম্বলিত সমস্ত জাতীয় সৈনিকের প্রথম পাতায় শিরোনাম “পূর্ব পাকিস্তান রাখিয়া দাঁড়াও” বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বা বিকাশের আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ আন্দোলন বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন বিকাশের পক্ষে ও বিপক্ষের শক্তিকেও মোটামুটি নিদিষ্ট করে দেয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী আন্দোলন যেমন একদিকে বাঙ্গালী জাতীয় চেতনায় বিকাশ ঘটায়, তেমনি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী গঠনের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা সম্পর্কিত প্রশ্নটি এ সময় সামনে চলে আসে। অবশ্য ছাত্র-আন্দোলনের মধ্যে, বিশেষ করে তার বামপন্থী অংশের মধ্যে এই প্রশ্নটি সীমাবদ্ধ ছিল। তবুও পরবর্তীতে এর সাথে সম্পর্কিত হয়ে যে বিতর্কের সূচনা হয় তার প্রভাব ছিল সূদর প্রসারী। আগেই বলা হয়েছে যে ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে এদেশের দাঙ্গাকারী শক্তি তাদের তৎপরতা শুরু করে। ছাত্র সমাজের মধ্যেও তাই। বাষট্টির আন্দোলনে সমস্ত ছাত্ররা একসঙ্গে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করলেও, আয়ুবের নতুন বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা ছাত্রদের মাঝে প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী অংশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলে। তৎকালীন এন এস এফ নামে পরিচিত ছাত্র সংগঠন এ ব্যাপারে নেতত্ব নেয় এবং ক্রমশঃ ক্ষমতাহীনদের পেটোয়া সংগঠনে পরিণত হয় এরাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে এই দাঙ্গা। তৎপরতায় ছাত্র সমাজকে সংশ্লিষ্ট করার জন্যে উঠে পড়ে লাগে। গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের নেতত্বকারী সংস্থা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন স্বাভাবিক ভাবেই তার বিপরীতে দাড়িয়ে এর প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। কিন্তু এই প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রশ্ন সামনে এসে দাড়ায়-এই প্রতিরোধের ধরণ কি হবে? কারণ ইতিমধ্যেই ছাত্র ইউনিয়নের কমীমহলে যে বিষয়টি নিয়ে বির্তক চলছিল তা হলঃ সাম্রাজ্যবাদকে বিরোধিতা করা ছাড়া সাম্প্রদায়িকতাকে সঠিকভাবে বিরোধিতা করা যায় কিনা ? মার্কিন সপ্তম নৌ-বহরের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এই বিতর্কের সূত্রপাত। এর কিছুদিন পবেই ভিয়েতনামকে কেন্দ্র করে মার্কিন সপ্তম নৌবহর এশিয়ার এই অঞ্চলের জলসীমায় তার হুমকিমূলক তৎপরতা শুরু করে। সেই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে উপস্থিত হয়ে কলকাতা বন্দরে ভিড়লে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জড়ে তার প্রতিক্রিয়া হয়। এর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীরা। সোচ্চার হয়ে ওঠে। এই সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি হিসাবে মার্কিন “সারকারামা” র আগমণ উপলক্ষে মার্কিন তথ্য কেন্দ্র কর্তক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদের নেতাদের কাছে প্রেরিত দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে এই লেখক একটি প্রতিবাদ লিপি প্রেরণ করে।” ঐ প্রতিবাদলিপিতে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে উপস্থিতির প্রতিবাদ করা হয় এবং দেশবাসীর প্রতি তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানানো হয়। একে কেন্দ্র করে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের (পরবর্তীতে যায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রপ হিসাবে পরিচিত হয়) তরফ থেকে এই বক্তব্য উথাপণ করা হয় যে সপ্তম নৌবহরের কলকাতা বন্দরে উপস্থিতির প্রতিবাদ করা ঠিক নয় এই কারণে যে, সেই প্রতিবাদ ভারতবিরোধিতায় পরিণত হবে এবং যা সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করবে। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতার প্রসার পেতে পারে এই কারণে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধতা করা যাবে না। দ্বিতীয়তঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করলে যেহেতু ছাত্রলীগের সঙ্গে ঐক্য বিনষ্ট হতে পারে, সুতরাং সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্ন সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করা সঠিক নয়। সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্নে এই আপোষমুখীনতা, ভারতের প্রশ্নে মোহ ও অভ্যন্তরীণভাবে ঐক্যের নামে তোষননীতি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংগ্রামের ধরণ ও তার কর্মসূচী কি হবে এই নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে আন্দোলনের জঙ্গীত্ব (বিশেষ করে ভায়োলেন্স) নিয়েও এ মহল থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এই বিতর্ক মুখোমুখি এসে দাড়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধিতার ইস্যুতে। ঐ একই যুক্তি অনুসরণ করে বামপন্থী আন্দোলনের উল্লিখিত অংশ যুক্তি হাজির করে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরোধিতা। করার জন্য শান্তি মিছিল ইত্যাদি করা প্রয়োজন, কিন্তু কোনক্রমেই ভারতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে নিন্দা করা চলবে না। কারণ ভাতে এখানে সম্প্রদায়িকতাকে উস্কানী দেয়া হবে। ছাত্র ইউনিয়নে সংশ্লিষ্ট এ সকল ব্যক্তিদের এই বক্তব্য কেবল তাদের বক্তব্য ছিলনা। মূলতঃ তা ছিল তৎকালীন কমিউনিষ্ট পাটির বক্তব্য যে কমিউনিষ্ট পার্টি ইতিমধ্যে সোভিয়েত সংশোধনবাদের পক্ষালম্বন করতে গিয়ে তাদের রং বদলাতে শর করেছে এবং শেষে সরাসরি সেই পক্ষে গিয়ে দাড়ায়। এই সময় থেকেই তাই বলা যেতে পারে যে এ দেশে বামপন্থী আন্দোলনে বিপ্লবী পথ ও সংশোধনবাদী পথের পোলারাইজেশন শুরু হয় (১) সার্বজনীন ভোটাধিকার আন্দোলন : চৌষট্টির প্রথমদিকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবীতে ১৯শে মার্চের হরতাল। অবশ্য এই হরতাল সফল হতে পারেনি। সেটা অবশ্য বড় কথা নয়। কিন্তু এরই দেখা যায় আয়ুবের বেসামরিক শাসনব্যবহার খুটি হিসাবে গঠিত কনভেনশন মুসলিম লীগকে জন্মগণের আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরাসরি ও সক্রিয়ভাবে হরতাল ভাঙ্গতে মাঠে নামতে। চৌষট্টির এই প্যাটার্ণই পরবর্তীকালে মোনেমী দমননীতির অন্যতম কায়দা হয়ে দাড়ায়।
কনভোকেশন আন্দোলন: দমননীতির এই কায়দা ছাত্র আন্দোলনকে ধংস করার জন্য ব্যবহার করা শুরু হয় এই সময় থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য গভর্ণর মোনেম খান এর পূর্বে তার একান্ত অনগত ডঃ এম, ও, গণীকে উপচার্য করে নিয়ে আসে। উপাচার্য হয়েই ডঃ এম, ও, গণী সরকারী পেটোয়া বাহিনী এন, এস, এফ-কে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনগলোর বিরদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য মদত দিতে শুরু করে। আয়ুব-মোনেম শাসন ব্যবহার সপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের প্রতিবাদের বহিপ্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে। তারা আয়ব খানের দমননীতির প্রতীক মোনেম খাঁর হাত থেকে ডিগ্রি নিতে অস্বীকার করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বায়ত্ব শাসনের দাবীও সামনে চলে আসে। ছাত্রদের এই দাবীর বিরদ্ধে জোর করে পুলিশ ও ছাত্র নামধারী গণ্ডদের প্রহরায় কনভোকেশন করার চেষ্টা করেল মাসের পর মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। তাই কনভোকেশন আন্দোলন নামে পরিচিত। কনভোকেশন অনুষ্ঠান ব্যর্থ হয়ে যায়। এর পরিনতিতে বিভিন্ন হলে চলে পুলিশী ও ছাত্র নামধারী এক শ্রেণীর গুণ্ডার আক্রমণ। ডিগ্রি প্রত্যাহার, বহিস্কার, গ্রেপ্তার, হুলিয়াজারী এসব মিলিয়ে এক তাণ্ডব নৃত্য চলে সারা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে। এই আন্দোলনে আশু কোন ফল লাভ না হলেও, এই প্রক্রিয়া ছাত্র আন্দোলনকে অনেকখানি বহির্মুখী করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্য ও আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ছাত্র আন্দোলনের চাপ আরও তীব্র হয়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে আয়ুব মোনামী এই তাণ্ডব নৃত্য সামাজিক অন্যান্য শক্তিকেও দ্রত ঐ একনায়কত্বমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পোলারাইজড হতে সাহায্য করে। এই সম্মিলিত প্রয়াসের ফলেই চৌষট্টির শেষের দিকে জন্ম নেয় সম্মিলিত বিরোধী দল ও তার নেতৃত্বে আন্দোলন। সম্মিলিত বিরোধী দল ও তার কর্মসূচী : চৌষটির ঘটনাবহলতায় সম্মিলিত বিরোধীদল (কপ)-এর আবির্ভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেপ্টেম্বরের শেষে সারা দেশব্যাপী ব্যাপক হরতাল ও সম্মিলিত বিরোধীদলকে কেন্দ্র করে জনজোয়ার নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু সম্মিলিত বিরোধী দলের কর্মসূচীতে এর অন্যতম অঙ্গদল জামাতে ইসলামীর চাপে ‘মুসলিম ফ্যামিলী ল” অর্ডিন্যান্স বাতিলের দাবী গ্রহণ নিঃসন্দেহে একটি পশ্চাদপসারণ। এই পশ্চাদ পসারণকে প্রতিরোধ করতে পারত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রগতিশীল সংগঠিত শক্তি। কিন্তু এর পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ঐক্যের নামে তোষণ নীতির যে প্রবণতার বহিপ্রকাশ চৌষট্টির প্রথমভাগেরই এদের মাঝে লক্ষ্য করা গেছে সেই তোষণ নীতিই এরপ একটি প্রতিক্রিয়াশীল দাবীকে মেনে নেয়ার কারণ। চৌষট্টির এই ঘটনা আরেকবার দেখিয়ে দেয় যে সামাজিক শক্তি হিসাবে প্রতিক্রিয়া কতখানি প্রভাববান, প্রগতির শক্তি কতখানি অসংগঠিত ও দুর্বল। এ সকল ঘটনাবলী থেকে বেরিয়ে আসা অভিজ্ঞতা, শিক্ষা থেকে সে সময়েই নতুন চিন্তা ভাবনা, ধ্যান ধারণার বিস্তার লাভ করতে থাকে। পয়ষট্টি-ছেষট্টিতে এসব চিন্তা, ধ্যান ধারণাই সমাজের বিপ্লবী শক্তিসমূহকে নতুনভাবে সংগঠিত হতে সাহায্য করে। চৌষট্টির আন্দোলন মুখর দিনগুলির ঘটনাগলির তাই বাষট্টির আন্দোলনের ক্রমধারা হিসাবে এলেও, যে বিশিষ্ট দিক সমূহ এর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে তা নিয়ে পরবর্তী ঘটনার উত্তরণকে আমরা সহজে বুঝতে পারি। সেই দিক দিয়ে চৌষট্টির ঘটনাবলীকে আরও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সেই ইতিহাসচেতা বা সমাজচেতার কাজ বর্তমান নিবন্ধে সম্ভব নয়। হাতের কাছে তখনকার কোন কাগজ বা তথ্যমুলক দলিলও উপস্থিত নেই। খুজে দেখবার অবকাশও হয়নি। স্মৃতির উপর নির্ভর করতে হয়েছে মূলতঃ। তবু এটা স্পষ্ট করে বলা যায় যে চৌষট্টি সাল এদেশের ইতিহাসের ভবিষ্যতকে নির্দিষ্ট করেছে অনেকভাবে। চৌষট্টিকে তাই খুঁটিয়ে দেখা প্রয়োজন। ১। এখানে যে পোলারাইজেশনের উল্লেখ করা হয়েছে, তারই পরিণতি ১৯৬৫ সালের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে ভাঙ্গন। এই সমেলনে কার্যকরি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নার রহমান যে রিপোর্ট পেশ করেন এবং পরবর্তীকালে ১৯৬৬ সালের জরী সমেলনে মেনন গ্রপ ছাত্র ইউনিয়নের সহসম্পাদক শফিকুর রহমান। যে রিপোর্ট পেশ করেন তা থেকে উদ্দতিই এই পার্থক্য নিরূপণে। সহায়ক হবে। জনাব নুরুর রহমানের দীর্ঘ ত্রেত্রিশ পৃষ্টা রিপোর্টে অনেক কথা বলা হয়েছে। তাই এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সার্বজনীন ভোটাদিকারের আন্দোলন এবং সমাবর্তন উৎসব সংক্রান্ত অংশটুকু উঞ্চত করা হলো : “সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-এই অবস্থায় ১৯৬৪ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের অধিবেশন আহবান করা হয়। ঢাকাতে ৪ঠা হইতে ৭ই—এই চার দিন ব্যাপী অধিবেশনে ঢাকা ছাড়াও রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশোর, শ্রীহট্ট, ময়মনসিংহ, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালি জিলা থেকে সদস্যবর্গ এসেছিলেন। এই সভায় সংগঠনকে বিস্তত ও শক্তিশালী করার উপরে বেশী জোর দিলেও এবং শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সংকট এবং সাংগঠনিক কাজ কর্মের উপর অনেক আলোচনা হলেও, তদানিন্তন জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সেই বিষয়ে আমাদের সংগঠনের দায়িত্বের প্রশ্নই প্রধান হয়ে উঠে। তখন খুলনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে গেছে, দেশের হিন্দু নাগরিকদের মধ্যে চরম ভয়ভীতি ও অনিশ্চয়তার মনোভাব বিরাজ করছে এবং সংখ্যালঘুদের কেহ কেহ দেশ ত্যাগও করেছন। এই পরিস্থিতি আমাদের ছাত্রদের তথা দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। অথচ আমরা স্পষ্টই বুঝতে পেরে ছিলাম যে কনভেশনী নেতারা এবং পদস্থ সরকারী ব্যক্তিরা অনেকেই একটা সাম্প্রদায়িক গোলযোগের উস্কানি দিচ্ছেন এবং খুলনার দাঙ্গা অন্যান্য স্থানেও ছড়াতে পারে। তাই কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদের প্রথম প্রস্তাবই হয় খলনার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নিন্দা করে এবং দোষী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দাবী করে। ঐ প্রস্তাবে আরো বলা হয়। যে, “সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল চক্র দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করিবার জন্য সাম্প্রদায়িক গোলযোগের প্রয়াস পাইতেছে। দেশ হইতে সাম্প্রদায়িক চক্রকে চিরতরে বিনষ্ট করিবার জন্য এই সভা ছাত্রসমাজ ও গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি আহবান জানাইতেছে। বস্তুতঃ এই প্রস্তাব গ্রহণের কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের সংগঠন এক চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হল। খুলনার পরে ব্যাপক দাঙ্গা-শুরু হল কলিকাতায়! কলিকাতার প্রতিক্রিয়ায় নারায়নগঞ্জ ও ঢাকায় এবং অন্যান্য কোন কোন জিলাতেও ব্যাপক দাঙ্গার অবহার সৃষ্টি হল। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা উহার অসাম্প্রদায়িক এবং যথার্থ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পতাকাতলে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়ালেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে সরকারের পৃষ্টপোষিত মুখচেতনা প্রতিক্রিয়াশীল মহল কলকাতার দাঙ্গার প্রতিবাদে সভা ও মিছিল করার প্রচেষ্টা নিল। দেশে যখন চরম সম্প্রদায়িক উত্তেজনা তখন এরকম সভা ও মিছিলের অর্থই যে দাঙ্গা বাঁধান, তাহা স্পষ্ট। তা ছাড়া এর উদ্যোক্তাদের জঘন্য প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র আমাদের নিকট জানা ছিল। এদিকে অন্যান্য গণতান্ত্রিক ছাত্রদের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি দেখা দিল—কলকাতার দাঙ্গার প্রতিবাদে শুধ, একটা সভা ও শান্তিপূর্ণ মিছিলে আপত্তি কি? এই অবস্থায় আমাদের কোন কোন কর্মী মনে করলেন যে প্রতিক্রিয়াশীলদের আহবানে সভা, মিছিল প্রভৃতি হবেই। তাই আমাদেরও এগলিতে যোগ দিয়ে এগুলো যাহাতে শান্তিপূর্ণ থাকে সেজন্য চেষ্টা করা উচিত ; এ না করলে একদিকে আমরা ছাত্র সাধারণ হতে বিচ্ছিন্ন হব, অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীলরা দাঙ্গা বাঁধাবার সুযোগ পাবে। কেহ কেহ এমনও ভাবলেন যে মিছিল বের করা হবে না, প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র মহলটির সাথে এই রকম একটি শর্ত করে তাদের সাথে একযোগে ধর্মঘট ও সভার আহান দেওয়া উচিত। যা হোক আমরা শেষ পর্যন্ত হির করলাম যে, ঐ পরিস্থিতিতে চিহ্নিত প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক ছাত্র মহলটার সাথে কোন রকম শর্ত করে একত্রে অগ্রসর হওয়া আমাদের অনচিত হবে। আমাদের নাম ভাঙ্গিয়ে বড় জমায়েতের সুযোগ পেলে তখন চরম উত্তেজনার মতে তারা শর্ত ভঙ্গ করলে তা রোধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। তা ছাড়া যে মূহুর্তে আমাদের নিজেদের দেশে দাঙ্গা প্রতিরোধ করা আমাদের প্রধান কাজ তখন অন্য দেশের দকর্মের সমালোচনা আমাদের মল কাজে সাহায্য না করে বরং তাকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। তখন আমাদের প্রতিবেশী কলকাতার দাঙ্গা রুখতে কিছুমাত্রও সহায়ক হত না। কলকাতা তথা ভারতের মানুষকে দাঙ্গা প্রতিরোধে দাঁড় করানোর একমাত্র পথ ছিল এখানে প্রত্যক্ষভাবে দাঙ্গা প্রতিরোধের কাজে আত্মনিয়োগ করা। আমরা ঠিক করলাম, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা তার ঐতিহ্য আর প্রভাব নিয়ে ৫ বিরদ্ধে দাঁড়াবে। জীবন দিয়ে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় হতে মিছিল বাধা দেবে। ছাত্র ইউনিয়ন এইরুপ দৃঢ় মনোভাব গ্রহণ করায় ক্রিয়াশীল দলটি অন্যান্য ছাত্র সংগঠনকে এবং সাধারণ ছাত্রদের হাত করতে পারে নাই। সভায় বিশেষ ছাত্র জমায়েত হল না এবং দল বের করা সম্ভব হয়ে উঠল না। আমাদের সংগঠনের এই সঠিক নেতৃত্বদান শুধু ঢাকাতে সাধারণ ছাত্র সমাজকে দাঙ্গার বিরুদ্ধে সক্রিয় করেছে কিংবা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের কর্মীদের, কাজে অনজ্ঞা ও উৎসাহ জাগিয়েছে। তাই নয়, এর ফলে দেশের ব্যাপক গণতান্ত্রিক মহলে আমাদের প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজ আমাদের প্রতিষ্ঠান একটি অসাম্প্রদায়িক যথার্থ গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসাবে ছাত্র সমাজের মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ নয়, ইহা দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের নিকটও অতি প্রিয়ই। ১৯৬৪ এর জানুয়ারীর বিভৎস সাম্প্রদায়িক গোলযোগের সময় আমাদের প্রতিষ্ঠান যে গৌরবময় ভূমিকা গ্রহণ করে এবং খলনা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, পাবনা, ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট প্রভৃতি দেশের সর্বত্র আমাদের কর্মীরা দাঙ্গা প্রতিরোধ কাজে এবং দাঙ্গায় আহত ও বিস্তদের সাহায্যের কাজে যেভাবে আত্মনিয়োগ করে তাতে ছাত্র সমাজের ও সমগ্র দেশবাসীর নিকট আত্মাদের প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ইহার প্রভাবও বেড়েছে। এই দাঙ্গার মধ্যে দিয়ে অপর একটি জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়। দাঙ্গায় কোন কোন অবাঙ্গালী চটকল মালিকের হাত আছে এবং অবাঙ্গালী মজর দাঙ্গায় নেতৃত্ব দিয়েছে—এই ধরনের রটনার ফলে বিশেষভাবে ঢাকা প্রভৃতি স্থানে একটা তীব্র অবাঙ্গালী বিদ্বেষের সষ্টি হয় এবং বাঙ্গালী অবাঙ্গালী দাঙ্গা লাগার উপক্রম হয়। এই অবস্থায় আসে ২১শে ফেব্রুয়ারী। আমরা সেবার ২১শে ফেব্রুয়ারীর মূল শ্লোগান করি, দাঙ্গা ও সকল সাম্প্রদায়িকতা নির্মল করা এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সার্বজনীন ও প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার আদায় করা। স্বৈরাচারী শাসকবর্গ ও তাহাদের সমর্থক প্রতিক্রিয়াশীল বড় বড় ধনিক, সামন্ত প্রভূ আর সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের দেশবাসীর মধ্যে ধর্ম ও জাতিগত বিদ্বেষ লাগিয়ে রাখতে চায়, এবং এজন্যে তাঁহারাই দাঙ্গায় উস্কানি দেয় ; যাহারা গণতন্ত্র চায়, যে কোন দাঙ্গা তাহাদের স্বার্থের হানি করে এইগুলি ছিল আমাদের মূল প্রচার। এর ফলে বাঙ্গালী দাঙ্গার মনোভাব কিছুটা প্রশমিত হয়। আমরা অবাঙ্গালী গণতান্ত্রিক মহলে অনেকটা প্রভাব বিস্তার করতে পারি এবং তাদের মধ্যেও ছাত্র ইউনিয়নের সুনাম হয়, একটি যথার্থ মানব-হিতেষী গণতান্ত্রিক সংগঠণ হিসাবে। বন্ধুগণ, আমরা গর্বের সহিত এই দাবী করিতে পারি যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী বিরোধ সম্পর্কে আমরাই প্রথমে। আমাদের স্পপষ্ট বক্তব্য দেশেবাসীর সম্মুখে উপস্থিত করি। পরবর্তী সময়ে সমস্ত গণতান্ত্রিক মহল এবং গণতান্ত্রিক সংবাদপত্রগুলি এই ব্যাপারে অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে। সার্বজনীন ভোটাধিকারের আন্দোলন-কনভেনশনপন্থী পাণ্ডারা। ও সরকারী পদস্থ ব্যক্তিরা তখনই দেশে একটি দাঙ্গার আবহাওয়া সন্টি করেছিল যখন সারা দেশ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবীতে উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। দাঙ্গা আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করলেও দুবার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে রোধ করতে পারলো না। এই সময়, প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবীকে ভিত্তি করেই এই আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠে। পূর্বেই বলেছি, ইহা ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবসে আমাদের অন্যতম মুল শ্লোগান। প্রাদেশিক কেন্দ্রে আমরা ছাত্রলীগ ও ছাত্রক্তির সঙ্গে এই নিয়ে আলাপ করি এবং আমরা এক হয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও আলোচনা করি। এটা একটা আনন্দের সংবাদ যে এই প্রচেষ্টার ফলেই ১৯শে মার্চ দেশব্যাপী ভোটাধিকার দিবস প্রতি পালিত হয়। এই দিন দেশের সর্বত্র যে ব্যাপক হরতাল হয় তাকে সফল আর ব্যাপারেও আমাদের কর্মীদের তথা ছাত্রসমাজের অবদান যথেষ্ট। এই সময়েই পত্রিকাতে খবর বের হয় যে মার্কিন নৌ-বহর ভারত মহাসাগরে বিচরণ করবে। এটা যে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার স্বাধীনতাকামী। মানুষের প্রতি সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন সরকারের একটা হুমকী তাতে কোন সন্দেহ নাই। এই অবস্থায় আমাদের কেন কোন বন্ধ, বলেন এখন সার্বজনীন ভোটাধিকারের ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে বরং মার্কিন নৌ-বহরের ভারত মহাসাগরে প্রবেশের বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলা হোক। কেহ কেহ এমন বলেন যে আমরা কেবল মোনায়েম খাঁ, আইয়ুৰ খাঁর বিরদ্ধে আন্দোলন করছি, দেশের মুল শত্রু, সাম্রাজ্যবাদ তাঁদের সম্বন্ধে কিছু করছি না। অনেকেই তাদের। এই সকল যুক্তির সারবত্তা গ্রহণ করেন না। গণতান্ত্রিক ছাত্রসমাজ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং ইহাও সত্য যে, আমাদের দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি সামরিক বিভাগ প্রভৃতির উপর হইতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব দুর করতে না পারলে আমাদের দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা হবে না। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ আমাদের দেশ প্রত্যক্ষভাবে শাসন। করছে না। আমাদের দেশের আইয়ুব-মোনায়েম তথা স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমেই সাম্রাজ্যবাদীদের প্রভাব বিদ্যমান আছে ও সপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তাই এদেশ হতে সাম্রাজ্যবাদ উচ্ছেদ করতে হলে আইয়ুব-মোনায়েম তথা সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করতে হবে। ভারত মহাসাগরে ৭ম নৌ-বহরের অধিষ্ঠান তথা সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অবশ্যই আমাদের আন্দোলন করতে হবে। ইহা প্রধানত প্রচারমূলক, প্রতিবাদমূলক আন্দোলন। এক্ষেত্রেও আমাদের। প্রধান কাজ হল যাতে আমাদের সরকার সাম্রাজ্যবাদের সাথে সহযোগিতা করে এবং সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধাচারণ করে সেজন্য তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করা। তাই সার্বজনীন ভোটাধিকারের আন্দোলন আর “সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন-এ দুটোর একটাকে আর একটার বদলে গ্রহণ করা যায় না। দুটা কাজই আমাদের করতে হবে। স্বভাবতই যে কাজটা আমাদের সাথে একেবারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাতেই বেশী লোক আগ্রহ দেখাবে এবং সে কাজটার উপরেই আমাদের প্রধান জোর দিতে হবে। সমাবর্তন উৎসব-দাঙ্গাকে সারা দেশময় ছড়ান গেল না এবং দাঙ্গা বাঁধিয়ে, গণআন্দোলনকে থামান গেল না দেখে স্বৈরাচারী প্রতিক্রিয়াশীল চক্ৰ উন্মাদ হয়ে উঠল। এবার তারা প্রত্যক্ষ গণ্ডামীর পথ গ্রহণ করলো এবং তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য হলো ছাত্র সমাজ। এই কাজে তারা শাধ পুলিশবাহিনী এবং গুণ্ডাবাহিনী নিয়োগ করলে তাই নয় একটি প্রতিক্রিয়াশীল তথা কথিত ছাত্রসংগঠনের সভ্যদেরও কাজে লাগালো। সারা দেশময় ভোটাধিকার দাবীর আন্দোলনে ছাত্রসমাজ যখন ব্যস্ত, সেই সময় ঘোষণা করা হল যে, গম্ভীর মোনায়েম খাঁ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের চ্যান্সেলর হিসেবে রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে পৌরোহিত্য করবেন। জনাব মোনায়েম খাঁ দেশের স্বৈরাচারী শাসকদের দালাল হিসেবে ছাত্রসমাজের চরম দপোর। পাত্র তাঁকে গভর্ণরের পদে অধিষ্ঠিত করার ব্যাপারটিকে পূর্ব পাকিস্তানবাসীরা বাঙ্গালীদের প্রতি অপমান হিসাবে গণ্য করে। তিনি সমাবর্তন উৎসবে যোগ দিলে ছাত্ররা সামবর্তন উৎসব বর্জন করবে এই আশঙ্কায় ১৯৬২ সালে সমাবর্তন উৎসব বাতিল করা হয়। অথচ তার দুই বৎসর পরে, দেশের মধ্যে যখন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আরো তীব্র, তখন কতপক্ষ জিদ ধরলো যে, সমাবর্তন উৎসব করতেই হবে। স্বভাবতই এতে ছাত্রদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল এবং স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক মহলেও এমন একটা ভাব দেখা গেল—দেখা যাক ছাত্ররা এবার কি করে ? মোনায়েম খাঁয় পৌরোহিত্যে সমাবর্তন উৎসব ছাত্রদের ও গণতান্ত্রিক শান্তির প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিল। ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর আকাঙ্খা, ছাত্ররা যেন এর উপযুক্ত জবাব দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ছাত্র তাঁদের কর্তব্য পালনে পরান্মুখ হয় নাই। গুণ্ডা ও পুলিশের আক্রমণ এবং জেল-জুলুম সত্বেও রাজশাহীর ছাত্ররা সমাবর্তন উৎসবে বাধা দিল ।

স্বৈরাচারের প্রতিভূ মোনায়েম খাঁ শিক্ষাবিদের ময়ূরপুচ্ছ ধারন করছে যেয়ে শেষে অপমানিত হয়ে ফিরে এলেন। এর কয়েকদিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন উৎসব। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখচেনা প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র মহলটি খুব সক্রিয় হয়ে উঠল। প্রথমে তারা কূটনৈীতির পথ ধরলো, মোনায়েম খাঁ আসছেন চ্যান্সেলর হিসাবে, শাসক হিসাবে নয়। ছাত্রদের মধ্যে একথা বিকালে না। তখন তারা নানা রকম শাসানী দিতে লাগলো এবং সক্রিয় ছাত্রকর্মীদের কাহাকে কাহাকেও একা পেয়ে মারপিট করলো। সমাবর্তন উৎসবের আগের দিন হতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে যেভাবে পুলিশ ক্যাম্প বসানো হল এবং সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন রাখা হল তাতে মনে হলো একটা যুদ্ধ শুরু হচ্ছে। হলেও ভাই-ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশের যুদ্ধ। সামবর্তন উৎসব হলো লণ্ডভণ্ড। দেশে-বিদেশে মোনায়েম খাঁ তথা স্বৈরাচারী শাসনের “জনপ্রিয়তার” ছবি প্রকাশ পেল। দেশবাসী উৎফুল্ল হল, ছাত্র সমাজকে আশীর্বাদ জানাল।” (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, ১৯৬৫ প্রাদেশিক সম্মেলনে পঠিত কার্যকরি সাধারণ সম্পাদকের কার্য বিবরণী, পৃঃ৪-১০) এই ঘটনা সম্পর্কে পরবতী বৎসর (মেমন গ্রপ) ছাত্র ইউনিয়নের জরুরী সম্মেলনে পঠিতে রিপোর্টের বক্তব্য লক্ষ্যণীয়। ছেচল্লিশ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে নুুরুর রহমানের রিপোর্টের তীব্র বিরোধিতা করা হয় “১৯৬৫ সালের সম্মেলনে পঠিত রিপোর্টে বলা হয়েছে,” সার্বজনীন ভোটাধিকারের আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন—এ দুটোর একটাকে আর একটার বদলে গ্রহণ করা যায় না! দুটা কাজই আমাদের করতে হবে। স্বভাবতই যে কাজটা আমাদের সাথে একেবারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাতেই বেশী লোক আগ্রহ দেখাবে এবং সে কাজটার উপর আমাদের প্রধান জোর দিতে হবে।” রিপোর্টের এই অংশের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা দরকার। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন এ দুটো কাজই আমাদের করতে হবে বলার সাথে সাথে লোকের আগ্রহের নামে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে কৌশলে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি যে, এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে জয়যুক্ত করতে হলে সাম্রাজ্যবাদ বিশেষভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকেও জয়যুক্ত করতে হবে। ঘোষনাপত্রে উল্লেখ আছে “পাকিস্তানের বুকে একটি গণতান্ত্রিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম করা কোনভাবেই সম্ভবপর হইবে না যদি না পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের মূল শক্তির আধার বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর চক্রান্তের বেড়াজালকে ছিন্ন করিয়া শবাসী মুক্তি অর্জন করিতে সক্ষম হয়।” সপ্তম নৌবহর বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে এই রিপোর্টে বলা হয় “শুধু ঘোষণাপত্র পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়। এরপর আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই আরেকটা ঘটনার দিকে। ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে আমরা খবর পাই যে, ভারত মহাসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর আগমণ করবে। এই নৌবহর আমাদের দেশসহ গোটা দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার শান্তি ও স্বাধীনতার প্রতি হুমকী স্বরূপ। আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, আমাদের প্রতিপক্ষ বন্ধুদের বিরোধীতার জন্য এ আন্দোলন আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। তাঁদের যুক্তি ছিল : (১) আজ যদি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা হয় তবে অন্যান্য সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে আমাদের ঐক্যফ্রন্ট গড়ে উঠার যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা নষ্ট হয়ে যাবে ; (২) যেহেতু সপ্তম নৌবহর ভারত মহাসাগরে আসার পেছনে ভারত সরকারের সমর্থন রয়েছে, সেহেতু সপ্তম নৌবহর বিরোধী আন্দোলন, ভারত বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত সাম্প্রসায়িক পাঙ্গার সম্ভাবনাও দেখা দিতে পারে। আমরা এই যুক্তির উত্তরে বলি : (১) কে অসন্তুষ্ট হবে তার উপর নির্ভর করে আমরা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম ত্যাগ করতে পারি না। তা ছাড়া আমাদের মত একটা আধা-উপনিবেশিক দেশে বিভিন্ন দলের যে মোর্চ গড়ে উঠবে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতাই তার অন্যতম মূল ভিত্তি। (২) সাম্প্রদায়িকতা সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি। অতএব সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম সাম্প্রদায়িকতার উস্কানী দেবে, এ চিন্তা অবাস্তব। অধিকন্তু, খোদ ভারতের বকেই যখন সপ্তম নৌ-বহর বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে, তখন সাম্প্রদায়িকতার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। যাহোক, শেষ পর্যন্ত দু’দিকের টানাপোড়েনের মধ্যে সপ্তম নাবহরের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ ধ্বনীও উচ্চারিত হল না। এই একটা মাত্র ঘটনা থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায় আমাদের প্রতিপক্ষ বরা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে কিভাবে খাবটা করে দেখেন। এই রিপোর্টে কাশ্মীর সমস্যা প্রসঙ্গে মন্তব্য করা হয়–“আমাদের একথা ভুললে চলবে না যে, সাম্রাজ্যবাদীরা বিশেষভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের বিশ্ব রণ পরিকল্পনা কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে কাশ্মীরকে নিজেদের কুক্ষিগত রাখতে চায় এবং এই উদ্দেশ্যে তারা পাকিস্তান ও ভারতের শাসকগোষ্ঠীকে নিজবার্থে ব্যবহারের জন্য প্রতিনিয়ত চক্রান্ত চালাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তই কাশ্মীর সমস্যার সষ্টি করে এবং সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফলেই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান আজও হচ্ছে ।” পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, জরুরী প্রাদেশিক সম্মেলন, ৬৬, কেন্দ্রীয় সম্পাদক মন্ডলীর কার্যবিবরণী, সহ-সম্পাদক সফিকুর রহমান। কর্তৃতে পেশকৃত)।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.09.09-8.pdf” title=”1977.09.09″]