You dont have javascript enabled! Please enable it!

ষাটের দশকে উঠতি বাঙালি মধ্যবিত্তের ভূমিকা | মীজানুর রহমান শেলী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭

ষাটের দশকের আনুষ্ঠানিক শুরুতে আমাদের যাদের বয়স বিশ এর কোঠায় পৌঁছায়নি তাদের পক্ষে সম্ভবতঃ সেকালের স্থির চিত্র আঁকা দুরূ। আমাদের পক্ষে সে সময় ছিল ঈগলের চোখ এর মতো উজ্জ্বল, ক্ষুধার্ত এবং নির্ভীক অথচ একই সঙ্গে অনেক আত্মলীন প্রহরেই কাকচক্ষু পানির সায়রের মতো নির্জন, নিবিড় এবং শান্তিময়।সকল কালের আত্মময় তরুনদের মতন সেকালে আমরাও জীবনকে অনুভব থেকে এবং অনুভবকে জীবন থেকে আলাদা করে দেখতে পারিনি।
অথচ আমাদের জানান না দিয়েই জীবন তার অমোঘ কাঠামো নিয়ে, পরিবেশের বাস্তব তবুও পরিবর্তনশীল বর্হি বাটি নিয়ে ক্রীয়াশীল ছিল সর্বব্যাপী কম্পিউটারের মত,নির্বিকার এবং প্রায় যন্ত্রায়ত।এখন আরেক দশকের প্রায় শেষাশেষি দেখি সেই পূর্ব রচিত আয়তক্ষেত্রের আওতায় আমারা ব্যাক্তি ও গোষ্ঠীরা, অবিকল বিন্দুর নড়াচড়া করেছি-মায়বী গন্ডী পার হতে পারিনি। এক দশকের সঞ্চিত শক্তি নিয়ে আরেক দশকের সূচনায় সামাজিক ও রাজনৈতিক বিস্ফোরণে আত্মপ্রকাশ করেছে।সৃষ্টি করেছে নতুন মানচিএ এবং অপূর্ব পরিচয় সমাজের যেখানে মানুষের মুখের রেখা বদলায় নি, বদলে গেছে মনের ধরণ-ধারণ।
এখন মনে হয় ষাটের দশকে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের মধ্যেই পরবর্তীকালের ঐ শাসনিক পরিবর্তনের সকল বীজ উপ্ত ছিল। ইতিহাস বলে, ষাটের দশকের বাংলা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের পূর্ব বাংলা থেকে অবশ্যম্ভাবীভাবেই ভিন্নতর রূপ নিয়েছিল ঐ ব্যয় প্রায় সর্বসম্মত ভাবে সত্য যে বৃটিশ ভারতের বঙ্গ প্রদেশে ৭টি উপনিবেশিক শাসন হিন্দু সম্প্রদায়ের অমলে ছিল উবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল মূলতঃ এবং প্রধানতঃ হিন্দু-শাসিত। এই শ্রেণীর অর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলকাতা । ফলতঃ এই শ্রেণী উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে যে সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক গণজাগরণ বা রেনেসাঁসের সৃষ্টি করেছিল এবং ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সনের মধ্যবর্তী কালে বৃটিশ ভাতের বড়লাট কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যে প্রায়-জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করেছিল তা বঙ্গীয় মুসলমানদের বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশের মধ্যে কোন সাড়া জাগাতে পারেনি।
ঐ সময়ে বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের কাঠামো ছিল ত্রিধাবিভক্তি উপরে ছিল এটা স্বল্পজন-বিশিষ্ট হাল্কা ও ভংগুর অভিজাত শ্রেণীর প্রলেপ, মাঝখানে ছিল একটা তখনও ছোট অথচ কুমায় সম্প্রসারণশীল ইংরেজী শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং সবচেয়ে নীচে ছিল বিপুলসংখ্যক দরিদ্র ও নিরক্ষর চাষীর সমন্বয়ে গঠিত এক নিরেট স্তর।
প্রথম দুই শ্রেণীর সমন্বয় গঠিত বাঙ্গালী মুসলমান নেতৃত্ব এিশ এবং এবং চলিশ-বিশেষতঃ চলিলশের দশকে একাত্ম আগ্রহে সব ভারতীয় মুসলিম স্বতন্ত্রবাদী আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিল। তারা এ আন্দোলনে বিশাল মুসলিম চাষী সমাজকেও কালক্রমে শরীক করতে পেরেছিল। তাঁরা চেয়েছিল হয় প্রস্তাবিত পাকিস্তানে যোগ দিয়ে অথবা পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান-এর আওতার বাইরে এক সার্বভৌর বিরাট বাংলায় থেকে তাঁদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে। স্বাভাবিক ভাবেই, পশ্চিম বাংলার হিন্দু-প্রধান সমাজ তাঁদের এই আখাংকার সঙ্গে, একাত্ববোধ করতে পারেনি। ফলে পশ্চিম বাংলা হিন্দু প্রধান ভারত ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার বিষয়ে দ্বিধা করেনি। পরিনতিতে পূর্ব বাংলা, ১৯৪৭ সনে… ভারতে বৃটিশ শাসনের অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভৌগলিক ভাবে বিচ্ছিন্ন অংশ হিসাবে নতুন রূপ নেয়।
দুই
১৯৪৭ সলে ভারত বিভাগের পরবর্তী কালে পূর্ব বাংলার ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দলের নেতৃত্বের কাতার থেকে বেশ কয়েকজন প্রধান বঙ্গীয় মুসলিম নেতাকে বাদ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জনাব আবুল কাশেম, মো. ফজলুল হক (দুইজনই বৃটিশ ভারতে নিখিল বাংলার প্রধাণ মন্ত্রী ছিলেন) এবং প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় কৃষক নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ।
ব্রিটিশ ভারতে প্রবল ও তীব্র মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলন কালেও এঁরা বাঙ্গালী মুসলমানের রাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের প্রশ্নে অটল ছিলেন বলেই এদেরকে ভারত বিভাগ পরবর্তীকালে ক্ষমতার চৌহদ্দি থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। অল্পকালের মধ্যেই এঁরা বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের ভিন্ন মত পোষণকারী নেতৃত্বের পয়োভাগে এসে দাঁড়ান। কালক্রমে এই ভিন্নমতের কাতারের নেতাদের সঙ্গে উদীয়মান এবং সম্প্রসারণশীল পূর্ব বাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের এক পরস্পর-নির্ভর সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং ক্রমেই বলিষ্ঠতর হয়। পাকিস্তানের অবাঙ্গালী শাসকবর্গের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী রাজনৈতিক ব্যর্থতা এবং সীমাবদ্ধতা ঐ পরস্পর-নির্ভর সম্পর্ককে আরও দ্রুত জোরদার করে যার ফলে ভিন্নমত পোষণকারী বাঙ্গালী নেতৃত্বে ষাটের দশকে উদ্দেশ্যও কর্মপ্রচেষ্টায় সমগ্র পূর্ব বঙ্গীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমর্থক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭০-৭১ সনে এই আত্মীয়তা ও একাত্মবোধ আরো সম্প্রসারিত হয়ে সমগ্র পূর্ববাংলার জনগণ ও গণমানুষের সঙ্গে অবিভাজ্য ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে।
॥ তিন ॥
ষাটের দশক অন্তত সূচনায় এবং মধ্যপথে ছিল তৎকালীন অবিচ্ছিন্ন পাকিস্তান রাষ্ট্রের গৌরবময় যৌবনের কাল। যা আরো ছিল পাকিস্তানের তুলনামূলকভাবে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক নেতার শাসনের যুগ: সেনাপতি আইয়ুব খাঁনের বিতর্কিত অথচ অনস্বীকার্য শাসন আমল। সে সময় আরো ছিল বাংলাদেশের মুসলমান শাসিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্প্রসারণ, পরিদর্শনও আত্ম পরিচয়ের এক বিচিত্র ক্রান্তিকাল।
আইয়ুব এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন যা তার মতে এক আধুনিকায়নের নজির ও যন্ত্র হিসাবে কাজ করতে পাৱবে। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক তদারকমূলক ব্যবস্থা চালু করতে যা তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের আঞ্চলিক ও গোষ্ঠিগত রাজনৈতিক শক্তি এবং প্রবণতাগুলোকে রোধ করে সামাজিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক উন্নতির স্বপক্ষে প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমগ্র জনগণের মধ্যে নিখিল রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের সৃষ্টি করবে। জাতিগঠন নয় বরং রাষ্ট্রগঠনই ছিল তার প্রধান ও সর্বব্যাপী প্রচেষ্টা। আইয়ুবের প্রয়াসের সাফল্যের পথে প্রধান এবং অনতিক্রম্য বাধা হিসাবে দাঁড়িয়েছিল বাঙ্গালী স্বায়ত্বশাসন ও স্বাতন্ত্রের স্বপক্ষে বলিষ্ঠ এবং প্রধান সামাজিক শক্তি হিসাবে ক্রিয়াশীল মুসলমান বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী। কৌতুহলের বিষয় এই যে, এই শ্রেণীর পরিবর্ধন ও সম্প্রসারণ ঘটেছিল পাকিস্তান সৃষ্টি পরবর্তী আড়াই দশকেই। পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ এডওয়ার্ড শীলস এর মতে “নানা বিপর্যয় ও পরীক্ষার মুখে আফ্রিকা ও এশিয়ার নয়া রাষ্ট্রগুলোর সম্ভবনা, জন্ম ও জীবন প্রধানত বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর কর্মপ্রচেষ্টারই ফল।” পূর্ববাংলা-বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বুদ্ধিজীবিদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল এই এলাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে।
এখানে “মধ্যবিত্ত শ্রেণী” কথাটি প্রায়-পূর্ণাঙ্গ সমাজতাত্বিক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে বলা চলে।’অতিধনী’ এবং ‘অতি দরিদ্র’ এই দুই শ্রেণীর অর্থনৈতিক মধ্যস্তরে স্থিত যে জনসমষ্টি তা এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭০-এর পূর্বে তৎকালীন পাকিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে মাসিক ২০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা উপার্জনকারী ব্যক্তিবর্গকে এই শ্রেণীর আওতাভুক্ত বলে মনে করা অযৌক্তিক নয়। এই মাপকাঠিতে বিচার করলে বেতনভূক্ত সকল রাজকর্মচারী এবং সীমিত ও স্থির আয়ের সকল পেশাদারকে এই শ্রেণীতে ফেলা চলে। এদের মধ্যে যেমন নিম্নবেতনভুক্ত কেরানীকে ধরা যায় তেমনি ধরা যায় উচ্চতর পর্যায়ের রাজপুরুষকে; প্রাথমিক শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, রিপোর্টার থেকে নিয়ে পত্রিকস সম্পাদক, মধ্যপর্যায়ের বানিজ্যিক কর্মচারী, অপেক্ষাকৃত উচ্চবিত্ত কৃষিজীবি, ক্ষুদ্র এবং মধ্য পর্যায়ের ব্যবসায়ী ও বণিক—সকলেই এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী সদস্য। মধ্যবিত্ত শ্রেণী এমন একটি শ্রেণী যা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সমার্থক। এই শ্রেণীর সদস্যদের এক প্রধান আশা,কামনা ও প্রচেষ্টা হচ্ছে উত্তরপুরুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা এবং সমাজে প্রতিষ্ঠাবান মানুষ হিসাবে সন্নিবিষ্ট করা। এই শ্রেণীর আয়েকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে এর অন্তর্ভুক্ত সকলে নিজেদেরকে ‘মধ্যবিত্ত’ বলেই মনে করেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মূল্যবোধ ও বিচিত্র এবং দ্বন্দ, কণ্টকিত—মধ্যবিত্ত একদিকে যেমন স্পর্শকাতর ও আত্মাভিমানী—অন্য দিকে তেমনি ক্রুর সুযোগসন্ধানী, প্রধানতঃ ভীড় ও নিরাপত্তালোভী অথচ সময়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা ও শক্তির বিরুদ্ধে দারুন বিদ্রোহ সোচ্চার।
যে ভৌগোলিক এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে সেখানে সত্যিকার অর্থে প্রাক—১৯৪৭ যুগে বিস্তৃত ভিত্তির মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল না। পাকিস্তান আমলের চব্বিশ বছরেই এ দেশে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। কৌতূহলের বিষয় এই যে, আইয়ুবের শাসনের দশকেই বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্প্রসারণ ও শক্তিবর্ধন ঘটে। আইয়ুবের শাত্ৰীশাসিত এবং মূলত অরাজনৈতিক ব্যবস্থার ছত্রছায়াই পাকিস্তান-অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশে গড়ে উঠে বিপুল রাজনৈতিক শক্তির আধার মধ্যবিত্ত শ্রেণী। মার্কসের এক বহু উদ্ধৃত বিশ্লেষণের ভাষায় বলা চলে যে সাধারণভাবে পাকিস্তান এবং বিশেষ ভাবে, আইয়ুবের শাসন ব্যবস্থা নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। পাকিস্তানের শাসককুল অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নিজেদের ধংসের বীজ বুনে, সামরিক শাসন আমলে সেই বীজ থেকে উদ্ভুত গাছ-পালাকে যেন লালন পালন করে বাড়িয়ে তুলেছিল অথচ পারেনি এমন এক রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পত্তন করতে যা এই বিপুল ও প্রথর সম্ভাবনাগুলোকে ঐ রাষ্ট্রের চৌহদ্দীর মধ্যেই সুষ্ঠু ও গঠনমূলক বিকাশের সুযোগ দিতে পারে।
সামরিক নেতৃত্ব এবং বেসামরিক আমলাগোষ্ঠির মধ্যেই আইয়ুব তার “স্বাভাবিক মিত্র” খুঁজে পেয়েছিলেন। এদের উপর ভর করেই তিনি সরকারকে স্ব-নিয়ন্ত্রণাধীন করেন এবং এমন সব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে প্রয়াস পান যা তার ব্যবস্থাকে বলিষ্ঠ ও স্থায়ী করবে। এই সব কাঠামোর মধ্যে প্রথম ছিল আইয়ুবের “মৌলিক গণতন্ত্র” ব্যবস্থা—মৌলিক গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নির্বাচিত স্থানীয় সরকার পরিষদ। কিন্তু এই সব পরিষদে নির্বাচিত ব্যক্তিদেরকে নিয়েই আবার গড়ে তোলা হয় এমন একটি গণ-বিচ্ছিন্ন নির্বাচকমণ্ডলী যা শক্তিমান রাষ্ট্রপতিকে তো বটেই, এমন কি আইনসভার সদস্যদেরও “নির্বাচন করার একচেটিয়া অধিকার পায়।
আইয়ুবের দ্বিতীয় মৌলিক প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল ১৯৬২ সনে জারীকৃত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র যার মূলমন্ত্র ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। এই শাসনতন্ত্রের আওতায় সৃষ্টি করা হয় বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রপতির পদ, এবং মূলত এমন এক এককেন্দ্রিক সরকারী কাঠামো যার তুলনায় প্রাদেশিক সরকারগুলো কেন্দ্রের ইচ্ছা-দাসে পরিণত হয়। আইয়ুব সৃষ্ট তৃতীয় প্রতিষ্ঠান ছিল রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা যা তিনি তাঁর প্রাথমিক সিদ্ধান্তের রদবদল করে অনুন্নত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে বাধ্য হন। প্রথম অবস্থায় ১৯৬২ সনের পাকিস্তানী শাসনতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার স্বীকৃতি ছিল না—আইয়ুব এক রাজনৈতিক দলবিহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার নিজের রাজনৈতিক মিত্রদের চাপ, অবস্থার পরিবর্তন, সবকিছু তাঁকে শুধু নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা প্রবর্তন করতেই বাধ্য করল না, তাঁকে পুনরুজ্জীবিত মুসলিম লীগের প্রধান ও ১৯৬৫ সনের নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতেও বাধ্য করল।
‘মৌলিক গণতন্ত্র’, ১৯৬২ সনের আইয়ুব আরোপিত শাসনতন্ত্র, সীমিত স্বাধীনতার রাজনৈতিক দল—এই তিন প্রতিষ্ঠানের সবগুলোই উঠতি বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। এদের কোনটির মাধ্যমেই এই শ্রেণী পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় তার পক্ষে সম্মানজনক ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা দেখতে পায়নি। আইয়ুব শাসনের প্রধান দুই স্তম্ভে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের উচ্চতর পর্যায়ে বাঙ্গালী প্রতিনিধিত্ব ছিল না। প্রাক-আইয়ুব যুগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অন্ততঃ আধা-আধি ভাগ বাংলাদেশী রাজনৈতিকদের হাতে ছিল কিন্তু আইয়ুবের আমলা-শাসিত ব্যবস্থায় এই স্তরের লোকের প্রবেশ নিষেধ থাকায় বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে নীতি-নির্ধারণে ও সিদ্ধান্ত নির্ণয়ে অংশ গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল।
‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের শহর কেন্দ্রিক ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ প্রকারান্তরে ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়ে পড়ে। নাগরিক, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, ছাত্র সমাজ, শহরে বেতনভুক্ত কর্মচারীবৃন্দ, এমনকি গ্রামের শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত চাষী—সকলেই নিজেদেরকে বঞ্চিত ও প্রতারিত মনে কলে—“মৌলিক গণতন্ত্র রাষ্ট্রীয় নেতা ও আইন সভার সদস্য নির্বাচন তাঁদের প্রত্যক্ষ অধিকারকে লুট করে নিয়েছে, একথা ভেবে তারা ঐ ব্যবস্থাকে তথা সমগ্র আইয়ুবী শাসন কাঠামোকে মনে মনে অস্বীকার করতে শুরু করেন।
১৯৬২ পরবর্তী রাজনৈতিক দল ব্যবস্থাও বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সমাজকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি নির্ধারণে যথাযথ ভূমিকা পালন করার সুযোগ দিতে ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রপতি আইয়ুব মুসলিম লীগের এমন সব গোষ্ঠির মধ্যে তার মিত্র ও সহায়কদের খুঁজে নেন যাদেরকে ১৯৫৪ সনের প্রাদেশিক নির্বাচনে বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত ও জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। উপরন্তু ঐ সরকার-সমর্থিত ও সরকার সমর্থক দল-মূলত ছিল সরকারেরই সৃষ্টিত গণ প্রচেষ্টার পরিণতি নয়। ফলে বাংলাদেশ মধ্যবিত্ত প্রধানত আওয়ামীলীগ এবং কতকাংশে দুই ভাগে বিভক্ত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ছত্রচ্ছায়ায় সমাবিষ্ট হয়। এই সব দলই মৌলিকভাবে আইয়ৰ সরকার ও ব্যবস্থার বিরোধী ছিল। ১৯৬৫ সনে অপ্রত্যক্ষ নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি বাছাইয়ের সময় বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত শ্রেণী শেষবারের মত পাকিস্তানী ব্যবস্থায় নিজেদের ভূমিকা প্রবল করার প্রয়াস পায়। এ নির্বাচনে আইয়ুবের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে মিস ফাতেমা জিম্মাহ আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের সমর্থন পান। কিন্তু যেমন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, তেমনি পরবর্তী সময়ের আইনপরিষদ সদস্যদের নির্বাচনেও মৌলিক গণতন্ত্রের – পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা আইয়ুবের গলায়ই জয়মাল্য পরায়। বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের সমর্থনপুষ্ট সম্মিলিত বিরোধী দলের ভাগ্যে জোটে ব্যর্থতা।
আইয়ুবী ব্যবহার মৌলিক কাঠামোই এমন ছিল যে তাতে নিখিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণে বা উচ্চ প্রশাসনিক ক্রিয়াকাণ্ডে বাংলাদেশী মধ্যবিত্তের সক্রিয় ভূমিকা পালনের সুযোগ আসেনি। কিন্তু ঐ শাসন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতি ও কর্মপ্রয়াসের ফলে সারা পাকিস্থানে, বিশেষত বাংলাদেশে নতুন নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব ও পরিবর্ধন ঘটে। আইয়ুব দশকের প্রবল অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক ক্রিয়াকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশী মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলিষ্ঠতর ও বিশালতর হয়ে ওঠে। শিক্ষার সুযোগের প্রসারের ফলে বাংলাদেশে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬১ সনে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) যেখানে কলেজ ডিগ্রীধারী ও বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৮,০৬১ এবং ৭,১৪৬ সেখানে ঐ বছরই কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ে ছাত্র সংখ্যা ছিল ৫২,000 এবং বিশ্ববিদ্যালয় (বি, এ, এবং উচ্চতর ডিগ্রী) পর্যায়ে ছাত্রসংখ্যা ছিল ৩৫,০০০ (দ্রষ্টব্য : পাকিস্তান সেনসাস, ১৯৬১ প্রখম খণ্ড)। একদিকে বাংলাদেশে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা ক্রমেই এবং বিপুলভাবে বেড়ে চলছিল, অন্যদিকে তাঁদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল অতি সীমিত, কারণ পাকিস্তানের কাঠামোতে প্রশাসনিক, প্রতিরক্ষামূলক (রাওয়ালপিণ্ডি, ইসলামাবাদ) এবং বাণিজ্যিক ও অনৈতিক (করাচী) ক্রিয়াকাণ্ডের স্নায়ুকেন্দ্র ছিল তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে-বাংলাদেশ থেকে এক হাজার মাইল দূরে। এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই এই ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীজাত শিক্ষিত বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীরা সংঘবদ্ধ, বিপ্লবীর কাতারে এসে দাড়ালো। তরুণ সমাজ বিশেষত ছাত্র সম্প্রদায়ই ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ মধ্যবর্তী সময়ে তৎকালীন সরকার বিরোধী ও পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনপন্থী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
।। চার।।
আইয়ুব শাসনের চোখে প্রাক-সত্তরের পাকিস্তানের মানুষ ছিল যেন ‘চির শিশু। খবরদারি-মূলক এই ব্যবস্থা-প্ৰসূত নীতি ও কর্মসূচী উঠতি ও সম্প্রসারনশীল বাংলাদেশী মধ্যবিত্তের পক্ষে ছিল তাঁদের শ্রেণী স্বার্থের পরিপন্থী, সুতরাং অগ্ৰহনীয়। তাঁদের সংখ্যার অনু পাতে পাকিস্তানের শাসন-প্রশাসন প্রতিষ্ঠানে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব ছিল নিতান্তই অসন্তোষজনক। আইয়ুব রচিত ও নিয়ন্ত্রিত সকল প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাই ছিল তাঁদের চোখে অপ্রতুল ও অক্ষম। ঐগুলোর কোনটি তাঁদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম ছিল না। ক্রমশ তাই তাঁদের চোখে আইয়ুবের মাষ্টার-সুলভ শাসনাধীন পাকিস্তান হয়ে দাঁড়াল এক ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা। পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ক্রমেই ষাটের দশকের উঠতি বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের মনোভাব কঠোর হয়ে দাঁড়ায়। আইয়ুবের শাসনের দশকেই বাংলাদেশে স্বাতন্ত্রবাদী রাজনীতি ও ক্রিয়াকাণ্ড প্রধান ও বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
মার্কসবাদী পাকিস্তানী ভাষ্যকার হামযা আলভীর ভাষায়ঃ বাংলাদেশের স্বাতন্ত্রবাদী আন্দোলনের মূল ও প্রধান বাহন ছিল “বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সেইসব পরগাছা-ধর্মী গোষ্ঠীনিচয় যাদেরকে আইয়ুব ইচ্ছা করেই পোষন ও লালন করেছিলেন” (হামযা আলভী “বাংলাদেশ : পটভূমি ও ভবিষ্যত” জার্নাল অব কমনওয়েল্থ পলিটিক্যাল স্টাডিজ, জুন ১৯৭৩ ইং)
১৯৬৫ এর অপ্রত্যক্ষ ‘প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে’ ব্যর্থতার পর, বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুঝতে পারেন যে আইয়ুব- ব্যবস্থা মধ্যে প্রবেশ করে সে ব্যবস্থাকে সংশোধন করার কোন উপায়ই বাস্তবে নেই। তাই এ সময় থেকে তারা বলিষ্ঠ কণ্ঠে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের স্লোগান তুলে শাসনব্যবস্থা বিরোধী আন্দোলন গড়ার প্রয়াস পান।
১৯৬৫ সনের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধ বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সামরিক অসহায়তা এত প্রকট করে দেয় যে সারা অঞ্চলে পাকিস্তানের সঙ্গে এক থাকার উপযোগিতা সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে। বাংলাদেশীদের কাছে কাশ্মীরের প্রশ্নে সৃষ্টি ঐ যুদ্ধ যেন ছিল দুরাগত বজ্রপাতের আওয়াজ। , রনাঙ্গণ সীমিত ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্থান এবং ভারতের আন্তজাতিক সীমান্তের আশে পাশে। সেকালের দুরদর্শী ভারতীয় নেতৃত্ব পূর্বখণ্ডে, ভারত-পূর্ব বাংলা সীমান্তে কোন রন-প্রচেষ্টাই চালাননি। এসব কিছুর ফলে বাংলাদেশে কেবল আইয়ুব ব্যবস্থারই নয়—সারা পাকিস্তানী, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ন্যায্যতা ও উপযোগিতা সম্পর্কে দারুন সন্দেহ জাগে। শিক্ষিত বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ঘটে মোহভঙ্গ এবং তার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই কায়েমী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার মানসিক প্রস্তুতি নেন।
এই পটভূমিতেই শেখ মুজিব ও তাঁর সহকর্মীরা ছয় দফা কর্মসূচী পেশ করেন। পূর্ব বাংলার জন্য রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, এবং অর্থনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো চিত্রনকারী এ কর্মসূচী বাংলাদেশের নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুক্তিসনদ হিসাবে তাঁদের কাছে তাৎক্ষনিক স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ঐ শ্রেণীর তৎপর এবং কর্মনিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের প্রচেষ্টায় দু তিন বছরের মধ্যে ছয় দফা গণমনেও বিপুল সাড়া জাগায় এবং নিখিল বাংলাদেশ ব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বক্তৃতা, বিবৃতি, ভ্রুকুটি, ভীতি প্রদর্শন ও পুলিশি অবদমনের নানা বিচিত্র পন্থার আইয়ুব সরকার বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের এই বিপুল জাগরনকে ব্যর্থ করে দিতে চায়। ১৯৬৮ সনের প্রথম দিকে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা”র মাধ্যমে পাক সরকার বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতা, বেসামরিক ও সামরিক কর্মচারীদের অনেক ক’জনকে ভারতের সঙ্গে যোগসাজস করে পূর্ববাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টার অপরাধে শাস্তি দিতে চেষ্টা করে। বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের নিরিখে “আগরতলা মামলা” বাংলাদেশের স্বায়ত্বশাসনের দাবীকে নিষ্পেষিত ও বিচূর্ণ করার চেষ্টা হিসাবেই প্রতিভাত হয়। পরিনামে তাই এই মামলা বাঙ্গালী স্বাতন্ত্রের আন্দোলনকে বলিষ্ঠ করে তোলে এবং বাঙ্গালী স্বার্থের মুখপাত্র ও প্রধান এবং একমাত্র নিশানবরদার হিসাবে শেখ মুজিবের ভূমিকাকে সংহত করতেই সাহায্য করে।
।। পাঁচ ॥
১৯৬৮ এর শেষে এবং ১৯৬১ এর প্রথম ভাগে তৎকালীন পাকিস্থানের উভয় খণ্ডে আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক ও তীব্র গণআন্দোলন শুরু হয়। বাংলাদেশে এই আন্দোলন কেবল আইয়ুব বিরোধীই ছিল না—ছিল পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সুস্পষ্ট প্রতিরোধও। আন্দোলনের প্রবল চাপে আইয়ুব শেখ মুজিবসহ সকল বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকে মুক্ত করতে বাধ্য হন। রাজনৈতিক নেতৃবন্দের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সংকটের আপোষমূলক সমাধানে ব্যর্থ হয়ে ১৯৬৯ এর ২৫শে মার্চ আইয়ুব ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খান দেশে দ্বিতীয়বারের মত সামরিক আইন জারী করে ক্ষমতার রাশ হাতে নেন।
১৯৭০-৭১ এ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠী নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের প্রয়াস পান। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধভাবে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীনে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করে। ঐ দল সারা পাকিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও পাক সামরিক সরকার তাঁদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ বাংলাদেশে সশস্ত্র হামলা। এই অন্যায় সামরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশীরা যে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন-সেই মুক্তি সংগ্রামের পরিনতিতেই নয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তি ঘটে। কিন্তু সে কাহিনী তো সকলেরই জানা—সে কাহিনী তো সত্তরের দশকের কথা। তবু সত্তরের দশক যার মানসপত্র সেই ষাটের কাল এই বিপুল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের জনক এবং নিয়ামক হিসাবে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে গেছে।
।। ছয় ।।
ষাটের দশকের বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্লীন বৈশিষ্ট্যগুলোই তাকে পুরোন রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙ্গেচুরে নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো গড়ার প্রেরণা দেয়। প্রথমতঃ এই শ্রেণীর তুলনামূলক বিস্তৃতিঃ ষাটের দশকে বাংলাদেশী মধ্যবিত্তের কাতার ছিল আগের যে কোন দশকের তুলনায় দীর্ঘ ; দ্বিতীয়তঃ এই শ্রেণীর ধর্মীয় গঠনঃ এই শ্রেণী প্রধানত ও মূলত বাংলাদেশী মুসলমানে সমন্বয়েই গঠিত ছিল ;তৃতীয়তঃ এই শ্রেণীর বলিষ্ঠ বিপ্লবী-প্রবনতার অগ্ৰমুখ ছিল তুলনামূলক ভাবে ভরন মুসলমান মধ্যবিত্ত যাঁদের কাছে বৃটিশ ভারতে হিন্দু, প্রাধান্য ও উচ্চবর্ণের হিন্দু, আধিপত্য দূরশ্রুত ভয়াল সঙ্গীতের বিলীয়মান সংকেতের চেয়ে বাস্তব ছিল না কখনও।
আড়াই দশকের বিবর্তনমান বাংলাদেশ-কাহিনীর অদরদিত ঝলিষ্ঠ নায়ক আসলে এক যুথবদ্ধ চরিত্র-সমষ্টি ; পূর্ববঙ্গীয় মধ্যবিত্ত। শ্রেণী। এই নায়ক সাহসী এবং দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। বাস্তব অবস্থা ও পরিপ্রেক্ষিত যদি তার পছন্দসই না হয় তাহলে সে তাকে আপন ইচছা মাফিক বদলে নেয়। এই শ্রেণীর পূর্ব পথিক-প্রাক ১৯৪৭ যুগের ক্ষুদ্র মুসলমান বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধর্মীয় স্বাতন্ত্রের উদারভিত্তি করে উচ্চবর্ণ হিন্দু, আধিপত্যের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু ভারত-বিভাগ-উত্তর কালে বিরাটতর বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পক্ষে ধর্মীয় প্রশ্নাবলী, ধর্মীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অপ্রাসংগিক হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতরে উচ্চবর্ণের হিন্দুর কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না—তাঁদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাংলাদেশ ছেড়ে সীমান্তের ওপারে ভারতে চলে গেছেন। ঐ অবস্থায় তারা আর প্রত্যক্ষ বাস্তব ভীতির আকড় হিসাবে দৃশ্যমান ছিলেন না, এমনকি সম্ভাব্য স্বার্থ বিনষ্টকারী প্রতিযোগীও না। যে সত্তর আশি লক্ষ হিন্দু, পাকিস্তান-অধীন বাংলাদেশে বসবাস করে আসছিলেন তাঁরা এই শ্রেণীর নিরিখে ছিলেন বড়জোর পাকিস্তান রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। যে রাষ্ট্রে বাঙ্গালী মুসলমান নিজেরাই ছিলেন মূলত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশী মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চোখে প্রধান প্রতিযোগী ও স্বার্থপ্রতিদ্বন্দী ছিল সেই সব বিত্তশালী ও ক্ষমতাবান অবাঙ্গালী উর্দুভাষাভাষী, অথবা পাঞ্জাবী মানুষ যারা পাকিস্তান রাষ্ট্রে ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক প্রতিগতির নিয়ামক ও নিয়ন্ত্রক ছিলেন ; এ অবস্থায় প্রধানত নিম্নবর্ণ বাংলাদেশী হিন্দুরা বাংলাদেশী মুসলিম শাসিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চোখে ছিলেন বড়জোর এক অধীনস্থ মিত্র যার এমনকি নিষ্ক্রিয় নীরবতাও প্রতিপত্তিশালী অবাঙ্গালী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রামকে সহায়তা ও সাহায্য দিতে পারে। এভাবেই ষাটের দশকে পূর্ববাংলার রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক নীতি ও ঐক্যের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ও প্রাসঙ্গিকতা পশ্চাৎপটে সরে যায়। ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক একাত্মতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা “আধুনিক অঞ্চল ভিত্তিক বা ভৌগলিক জাতীয়তাবাদ,” “সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি”—ইত্যকার ব্যবহারই ষাটের দশকের বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপকদের কাছে কালপোযোগী এবং সে জন্যই গ্রহণীয় বলে মনে হয়েছিল। এই জন্যই সম্ভবতঃ ঐ আমলে, যখন বাংলাদেশের অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা ১৭ শতাংশের বেশী ছিল না—তখনও বাংলাদেশী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সক্ষমতার বিষয়গুলো নিয়ে এমন এক রাজনৈতিকভাবে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন যা উৎপীড়িত, অভাবগ্রস্থ অশিক্ষিত সাধারণ চাষী মজদর জনগণের পক্ষে যতই দূরস্থিত বা অবান্তর হোক না কেন, পাকিস্তানী রাষ্ট্র কাঠামো ও শাসনব্যবস্থার ভিত্তি মূল নাড়িয়ে চরমার করে দিয়েছিল। মূলত উঠতি মুসলমান বাংলাদেশী মধ্যবিত্তের নতুন পাওয়া বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সঙ্গীত প্রিয়তা, বাংলাদেশী পাকিস্তানীদের ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যকার বিপুল তফাৎ সোচ্চার ও বাস্তবে অস্বীকার্য, করে তুলতে সাহায্য করেছিল।
বাংলাদেশের গণজীবনে ষাটের দশকের উন্নয়নের যুগেও বিস্তৃত দারিদ্র্যে এবং তুলনামূলক অর্থনৈতিক অগ্রসরতা ছিল বাস্তব এবং সহজ নিরীক্ষ সত্য! এই ধুমায়িত গণহতার ও তার ফলে সৃষ্ট। গণ-অসন্তোষের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কৃত্রিম। পাকিস্তানী সংস্কৃতির বিরদ্ধে বলিষ্ঠ বিদ্রোহ ঘোষণা করা ও বাঙ্গালী ধর্মীয় সংস্কৃতির পক্ষে কাভার বাধা স্বতন্ত্র বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষের পক্ষে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। সেকালের পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি সমাজিক প্রকৌশলীর যথার্থ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। সংকটকালে তার স্থীরতা ও ধী-শক্তি হারিয়ে নির্মম কসাইয়ের ভূমিকায় নামেন। তাদের এই অমোঘ অক্ষমতা এবং আন্তর্জাতিক শক্তিনিচয়ের ক্রিয়াশীলতা উভয়েই বাংলাদেশী মধ্যবিত্তের পাকিস্তানবিরোধী সংগ্রামকে জোরদার করে। ষাটের দশকে জীবনের শিক্ষা বাংলাদেশের উঠতি ও ক্রমসম্প্রসারণশীল বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত সমাজকে স্পষ্টত উপলদ্ধি করতে শেখায় প্রায় সামন্ততান্ত্রিক, সামরিক ও অসামরিক পশ্চিম পাকিস্তানী আমলা শাসিত, অবাঙ্গালী পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানী রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর ভিতরে বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত ও সর্বহারা শক্তির মুক্তির কোন পথই আর খোলা নেই।
।। সাত ।।
আমরা যারা ঐ কালের ষাটের দশকের কিশোর-কিশোরী, তরুণতরুণী—তার একাধারে যেমন ইতিহাসের মঞ্চে অবশ্য প্রয়োজনীয় পাশ্ব-চরিত্রে অভিনয় করেছি ; তেমনি বিপর্যয়, বিদ্রোহ, সশস্ত্র সংঘাতের অনন্যপূর্বা কালের ‘গ্রাম উজাড়ের সাক্ষী হয়ে এখনও প্রায় তরণ অস্তিত্বে জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংবদ্ধ হয়ে আছি।
আমরা ছাত্র-ছাত্রী হিসাবে নব্য অধ্যাপক, অধ্যাপিকা হিসাবে, উঠতি আমলা এবং ব্যবসায়ী হিসাবে অথবা সমৃদ্ধির সীমান্তের আশেপাশে সঞ্চারণশীল বনিক বা ঠিকাদারের গৃহবধু হিসাবে জীবনের বারোয়ারী উঠানে ষাটের দশকের বিচিত্র অস্থিরমতিত্বকে দুর্বোধ্য আল্পনা আঁকতে দেখেছি। কখনও বা রং ও তুলি নিয়ে সেই সব চিত্রে আমাদের কেউ কেউ নিজ নিজ সৃজনশীলতা বা বিধ্বংসী প্রতিভার সামান্য স্বাক্ষরও রেখেছি।
একথা তো সত্যি যে, পাকিস্তান আমলের প্রথম ও গরম ভীতির সামরিক শাসনের বিরদ্ধে যারা দুর্বিনীত আন্দোলনে মাথা উচু করে দাঁড়ায় তাঁরা আমাদেরই কালের তরুণ—আমরাই। ১৯৫৮ সনে আইয়ুবের সামরিক শাসন আরোপিত হয়—আর ষাট সনের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা, আমাদের কালের তরণ মানুষেরা বুলেট, বেয়নেট কারাগারের ভয়ে—অপরীক্ষিত সামরিক শাসনের সন্ত্রাসে ভীত না থেকে স্বতঃস্ফূর্ত, সোচ্চার প্রতিবাদ সভা, মিছিল, ধর্মঘটে ঢাকা তথা সারা বাংলাদেশকে অত্যাচারী, একনায়ক আরোপিত নির্জীবতার মোহময়ী শৃংখল ভেঙ্গে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে।
১৯৬২ সনে বাঙ্গালী নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির দাবীতে ঐ ষাটের দশকের তরুণেরাই আবার সামরিক শাসকদের নির্ভীক বিরুদ্ধচারণ করে সফল হয়ে ওঠে। একই সনে আমাদের সহযোগী সতীর্থরা আইয়ুবের গণবিরোধী শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে বিপলে আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে ঐ রিপোর্টও প্রত্যাহত হয়।
আরেকটি বিশেষ আন্দোলনের কথা আমাকে বলতেই হবে। বাংলাদেশের ষাটের দশকের ইতিহাসে ঐ আন্দোলন সম্ভবত পাদটীকায় স্থান পাবে। কিন্তু আমরা যারা ষাটের দশকের প্রথম ছিলাম নব্য তরুণ-তরুণী তাঁদের জন্য ঐ বিচিত্র অপ্রশংসাই আন্দোলন ছিল বাস্তব এবং নৈতিকভাবে বিপুল গুরত্বপূর্ণ। সেটি ছিল ১৯৬২ সনের বি, এ, অনার্স পরীক্ষা পেছানোর সফল আন্দোলন। পরীক্ষা বয়কট বা পরীক্ষা পেছানোর মত অযৌক্তিক ও অবাঞ্ছিত ঘটনা সভ্য, শিক্ষিত সমাজে অপাংক্তেয়। অথচ ষাটের দশকে আমাদের নিজেদেরে বি, এ, অনার্স পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণের বিষয়ে, এই সাধারণ ধিক্কত প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছিল স্বীয় যৌক্তিকতায় ভাস্বর। আমি ব্যক্তিগতভাবে সে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। ঐ পরীক্ষার তারিখ পেছানোর বিষয়ে আমাদের সহযোগীরা যথা : অংকের মসাববির চৌধুরী, পদার্থ বিদ্যা বিভাগের চৌধুরী শফী সামী (বর্তমান প্যারিসে বাংলাদেশের প্রথম সচিব) এদের মত অধ্যয়ন-অনুরাগী, সত্যিকারভাবে নিষ্ঠাবান ভাল ছাত্ররাও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলো মাত্র একটা কারণে তা হচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের ‘মোনাফেকি’র বিশ্বে প্রতিরোধ।
প্রথম থেকেই যদি সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে ‘স্থিত ব্যক্তিরা আমাদের বলে দিতেন যে পরীক্ষা পেছানো অনৈতিক, অবাস্তব অথবা অসম্ভব তাহলে নিশ্চয়ই আন্দোলন দান বেধে উঠত না। কিন্তু যেমন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, তেমনি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রনালয় এ বিষয়ে আমাদের নিয়ে পিংপিং বলের মত কয়েক সপ্তাহ ধরে খেলা করলেন। সুনিশ্চিতভাবে, এই শঠতা ও কপটতার ফলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ বছরের বি, এ, অনার্স পরীক্ষার্থী বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে কর্তৃপক্ষের বিরদ্ধে বিপুল অসন্তোষ ও বিষ্ণা জাগে যা পরিণতিতে তাঁদের এক ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে রূপ দেয়। ফলে সম্মিলিত ছাত্র প্রতিরোধের মুখে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে পরীক্ষায় পূর্বনির্ধারিত প্রথম দিনেই-পরীক্ষা দু’মাস পরে অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। আমরা পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলনে সফল হয়ে একটা সত্য অমোঘভাবে উপলব্ধি করেছিলাম যে মিথ্যা-চারণ এবং অসৎ ভাষণ আমাদের ছাত্রজীবনের কালে রাষ্ট্রীয় এবং শিক্ষাগত কাঠামোর উচ্চতম পর্যায়ের অবিভাজ্য বৈশিষ্ট্য এবং ঐ কারণেই কাঠামো মূলত এবং অনস্বীকার্য ভাবেই ঘনে ধরা এবং পচনশীল। ১৯৬৪ সনের বনভোকেশন বিপর্যয়-পরবর্তীকালের নিষ্পেষণ ও অত্যাচার-বিরোধী ছাত্র প্রতিরোধ, সকলই ঐ ব্যাপক মোনাফেকি, শঠতা ও কপটতার বিরদ্ধে এক নিরন্তর বিদ্রোহের রপ নিয়েছিল। মধ্যবিত্ত শিক্ষিতের বোধহয় ঐ এক অবিচেছদ্য চারিত্রিক দুর্বলতা —নানা কপটতা ও শঠতার সমাহারী জীবনে অভ্যস্ত হয়েও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, শিক্ষাঙ্গনে অথবা যুগান্তরী রাজনীতিতে বিপুল মোনাফেকি সে সহ্য করতে পারে না। অন্তত ষাটের দশকে অামরা দেখেছি যে বাংলাদেশের উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেদের শ্রেণীর সদস্যদের অন্তর্লীন মোনাফেকিকে ক্ষমা করেছে কিন্তু রাষ্ট্র বা সমাজ কাঠামোতে দ্বিচারিনি চরিত্র বা ক্রিয়াকর্মকে সহ্য করেনি ; বিপুল আক্রোশে, দুঃসহ ঘৃণায় তার বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলনে, প্রতিরোধে ফেটে পড়েছে। এই জানাই সম্ভবত ষাট দশকের শো, -১৯৬৮-৬৯ দুই সনেই বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ—বিশেষত তার তরুণ অংশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের কপট ভঙ্গীমার বিরদ্ধে এক প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মধ্যবিত্তের মানস এমনি বিচিত্র ও পরস্পর বিরোধী যে সে নিজে নিয়মিত বারনারীগামী হতে পারে অথচ গৃহবধু গোপনে বারাঙ্গনার ভূমিকা পালন করলে ঐ মধ্যবিত্তই তাকে ঘৃণা করে, পুলিশের হাতে তুলে দেয়। অথবা এমন কি লাঞ্ছনা দেয় ও নির্যাতন করে। আমরা ছাত্র, অধ্যাপক ও নব্য আমলা হিসাবে ষাটের দশকের প্রথম মধ্য ও শেষ ভাগে বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সমাজের মোনাফেকি-বিরোধী বিস্ফোরণ দেখেছি, কোন সময় তাতে অংশ নিয়েছি, কখনও অভিনয় করেছি নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকার ! কখনও ভেবেছিঃ শুধুমাত্র বিশ্বস্ততার প্রশ্নে বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত এমন ঝুকি নেয় কেন? উঠতি বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত শ্রেণী কেন ষাটের দশকে কপটতার বিরদ্ধে এমন এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সূচনা করল ? এ কথা তো গ্রহণযোগ্য নয় যে শুধু বৃহত্তর চারণক্ষেত্রের তাগিদে, শুধুমাত্র উচ্চতর পদের লোভেই বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত হাতের এক পাখী ছেড়ে ঝোঁপের দু পাখী ধরতে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। বস্তুত ষাটের দশকে বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত শ্রেণী অথনৈতিক ও সামাজিকভাবে যে সমৃদ্ধ ও অন্যান্য নির্ভর জীবন মান লাভ করেছিল তা আবার কবে সম্ভব হবে তা ভবিষ্যতই বলতে পারে।
এত কিছুর প্রলোভন ছেড়েও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিরাট কপটতার বিরদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল। ষাটের দশকে বাংলাদেশী মুসলমান, প্রধান মধ্যবিত্ত শ্রেণী বুঝতে পেরেছিল যে অর্থনৈতিক সমদ্ধি সত্ত্বেও তারা এমন এক শঠ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর শিকার- যেখানে তারা আসলে উঠানের মানুষ হিসাবেই পরিগণিত–অন্দরমহলের নয় । এই মোনাফেকি শাসিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরদ্ধে নব্য বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত সমাজ ষাটের দশকের প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন যার চূড়ান্ন্ত পরিণতিতে এলো ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। সেই বিল ৰূলে সালে আমাদের অনেক কাছের মানুষ চিরন্তন দুরত্বে সরে গেল। আমার সহকারী, সতীর্থ, সহকর্মীদের অনেকেই সেই সংগ্রামে বিলীন। ষাটের দশকের গর্ভজাত ৭১-এর সংগ্রামকে দূর থেকে দেখে চীনা লেখক উ, চি, র ঘোষণাই প্রাসঙ্গিক মনে হয় : “এখন রনাঙ্গণ যেন দণ্ডায়মান লাশের দেশ, যারা মৃত্যুবরণে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ তাঁরা বেচে থাকবে ; যাৱা জীবন্ত অবস্থায় পালিয়ে যাবার আশা রাখে তারা মৱৰে।” (No the field of battle is a land of standing corpsea ; those determined to die will live those who hope to escape with their lives will die” Wu ch’i cited by Jack Higgins, in “The Engle has handed”. London Books, 1976)

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.09.09-5.pdf” title=”1977.09.09″]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!