You dont have javascript enabled! Please enable it! 1977.09.09 | যে প্রেক্ষাপটে ভাষা আন্দোলন | আবদুল মতিন | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ - সংগ্রামের নোটবুক

যে প্রেক্ষাপটে ভাষা আন্দোলন | আবদুল মতিন | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭

আমাদের সমাজ বিকাশল্যতে করতে করতে ইংরেজ দখলের পর উপনিবেশিক ও আধা-সামন্তবাদী পর্যায়ে উপনীত হয়। এই সমাজেই ক্রমে ক্রমে আমাদের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বূর্জোয়া, মধ্যবিত্ত এবং সর্বহারা শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। আমাদের সমাজে এটা নিঃসন্দেহে একটা বিরাট সামাজিক পরিবর্তন, যাতে বিপ্লবও বলা চলে।
বাংলাদেশে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা জমিদায় শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। আমাদের সমাজের হাজার হাজার বছরের, কালমাস্কের্র কথায় “এশীয় ধরনের সামন্তবাদী” উৎপাদন ব্যবস্থায় যে উৎপাদন সম্পর্ক ছিল তার অবসান ঘটে এইভাবে। এ এক অসাধারণ যুগান্তকারী পরিবর্তন । এর আগে জমির উপর কোনো প্রত্যক্ষ মালিকানা ছিল না। কৃষকরা জমির মালিক না হলেও জমির উপর তাদের পূর্ণ দখল স্বত্ত ছিল। ফলে জমি থেকে উচ্ছেদ করার অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল না। জমি কেনাবেচায়ও অড়থনৈতিক ভিত্তি ছিল না। সুতরাং সহজে ভূমিহীন, স্বত্বহীন কৃষকও ছিল না। কৃষকদের কাছ থেকে ভূমিরাজস্ব আদায়কারীরা ছিল শাসক তথা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ,কখনোই জমির মালিক না। জমির প্রত্যক্ষ মালিক ছিল রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র ছিল সামপ্ত নৃপতিদের শোষণ ও অস্তিত্বের হাতিয়ার । ইউরোপীয় সামন্ত ব্যবস্থায় সমস্ত ভূ-স্বামীরা পর্যায়ভিত্তিতে ছিল জমির মালিক, আর আমাদের “এশীয় ধরনের সমস্ত ব্যবস্থায় জমিয় মালিক ছিল সামন্তদের পরিবর্তে সামন্তদের রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের সাংগঠনিক অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল স্বনির্ভর গ্রাম্য ব্যবস্থা।
ইংরেজদের দখলের ফলে আমাদের দেশের সামন্তদের রাষ্ট্রযন্ত্র পরিণত হল বিদেশী ধনিক-বণিকদের রাষ্ট্রযন্ত্রে। ১৮৫৭-৫৮ সালে দেশের সিপাহী জনতা ইংরেজদের বিতাড়িত করতে চাইলেও নেতত্বের লক্ষ্য ছিল তাদের তথা সামন্তদের রাষ্ট্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠিা। সামন্তদের এ প্রয়াসেরই বাস্তব রূপ হল ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা। উপনিবেশে যাদের উপনিবেশ, রাষ্ট্র হয় তাদের। নয়া উপনিবেশেও রাষ্ট্র অপ্রত্যক্ষভাবে কোনো একটি সাম্রাজ্যবাদের, আর আধা-উপনিবেশে রাষ্ট্র হয় সামন্ত ও মৃৎসুন্দিদের। সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ও অবস্থানে সমাজের চরিত্র হয়ে দাঁড়ায় আধা-সামন্ততান্ত্রিক, তাই সমান্তরা আর একক প্রচেষ্টা ও নেতৃত্বে তাদের অংশীদারত্ব আছে এমন কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সমাজের চরিত্র অসামন্ত হলে মৃৎসুদ্দি বূর্জোয়ারাও সামন্ত শোষক ও সাম্রাজ্যবাদের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে ও তা বজায় রাখতে পারে না। আর সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসনের অর্থ সমাজের চরিত্র সামন্ত থেকে আধাসামন্ততান্ত্রিক হয়ে যাওয়া।
সুতারাং ইংরেজ শাসনের প্রবর্তনে সামন্তবাদী সমাজ আধাসামন্তবাদী সমাজে পরিবর্তিত হতে হতে ক্রমে উপনিবেশিকতার অবসানে আমাদের সমাজ পুরোমাত্রায় আধাসামন্তবাদী হয়ে উঠেছে। আধাসামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এমন কতকগুলি শ্রেণীর উদ্ভব হয় যাদের অস্তিত্ব সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থায় থাকে না। আধা-সমান্তবাদী সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেনীগুলি এই রকমঃ
সামন্ত, মৃৎসুদ্দি, ধনিক, মাঝারী ধনিক,ক্ষুদে ধনিক, আধাসর্বহারা ও সর্বহারা। উপনিবেশিক আমলে তথা বৃটিশ শাসনামলে আমাদের সমাজ উপরোক্ত শ্রেণীগুলিতে বিভক্ত হয়ে যায়। লক্ষ্যণীয় যে উপরোক্ত শ্রেণীগুলির মধ্যে কোনো এক বা একাধিক শ্রেণীই উপনিবেশিক শাসনামলে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে না। সাম্রাজ্যবাদের তথা বিদেশী ধনিকদের শাসন তাদের দাসানুদাস মৃৎসুন্দীদালাল, প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ত, অনুগত আমলা ওতাদের দালাল মুষ্ঠিমেয় বুদ্ধিজীবী ছাড়া আর কেউ চায় না। সুতরাং এই অবস্থায় আভ্যন্তরীণভাবে সমস্তভূস্বামীদের সঙ্গে ব্যাপক কৃষকদের স্বন্দ তীব্র আকার ধারন করে। আর তীব্র আকার ধারন করে কৃষকদের সহ ব্যাপক জনগণের সঙ্গে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ । এই দুটো দ্বন্দ সমাজের মধ্যে তীব্র গতিবেগের সঞ্চার করে।
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর এই দুটো স্বল্প দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে উঠে। এটা কেবলমাত্র হয় সর্বহারা শ্রেণীর, না হয় ধনিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সম্ভব । ধনিকদের রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসে সামন্তদেরও স্থান হয়।এই কারণে কংগ্রেস সমন্ত উচ্ছেদে কৃষক আন্দোলনে বিরোধী ছিল । প্রথম মহাযুদ্ধ ও অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পর সর্বহারা আদর্শের ভিত্তিতে এই উপমহাদেশে কমিউনিষ্ট পার্টি গঠিত হলেও, এই পার্টির নেতত্বের শ্রেণী দুর্বলতার কারনে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে এই পার্টির বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তির কারনে, অর্থ্যাৎ শ্রমিক-কৃষকদের শ্রেণী সংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে পরিণত না করার কারনে এবং বিভিন্ন জাতি স্বত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে প্রাধান্য না দেওয়ার কারণে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে হিন্দু, মৃৎসুন্দি প্রধান ধনিকদের রাজনৈতিক দল কংগ্রেস, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের পুরোভাগে আসন করে নিতে সক্ষম হয়।
এই সব কারনে এবং অন্যদিকে, ব্যাপক মুসলমান জনতা কৃষক হওয়া এবং ইংরেজ সৃষ্ট জমিদার জোতদার, হিন্দু হওয়ার কারনে, কৃষকদের শ্রেণী সংগ্রাম তীব্রতা লাভের কারনে মুসলমান মৃৎসুন্দী সামন্তরা প্রত্যক্ষভাবে শাসক ইংরেজদের এবং পরোক্ষভাবে হিন্দু, মৃৎসুন্দি সামন্ত প্রধান কংগ্রেসের সহায়তা ও সমর্থনে ধর্মের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করতে এবং মুসলিম জনতার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মুসলমানদের জন্য তাদের সংখ্যাধিক্য অঞ্চল সমন্বয়ে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারদাবী তুলতে সক্ষম হয়।
এই ভাবেই ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসনান্তে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারত ও পাকিস্তান হিসেবে সামন্ত মৃৎসুদ্দিদের দুইটি ভিন্ন রাষ্ট্র। ইংরেজ আমলের উপনিবেশিক ও আধাসামন্ততান্ত্রিক উপমহাদেশের নতুন শ্রেণীগুলি ইংরেজ শাসনের অবসানে আধা-উপনিবেশিক ভারত ও পাকিস্তানে বিকাশের ভিত্তি ও সুযোগ লাভ করে।
এই সামাজিক, অর্থনৈতিক ওরাজনৈতিক পটভূমিকাতেই কেবল ১৯৪৭ সালের পরবর্তী ঘটনাবলী সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পূর্ববাংলার মুসলমান জনগণের মধ্যে এক বিরাট উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং রাজনৈতিক আবেগ ও চেতনার সঞ্চার করে। স্বল্প বিকশিত হলেও তৎকালীন মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে, ব্যাপক কৃষকরা ছিলেন তাদের এই সংগ্রামের সাথী ও সহযোগী।
পাকিস্তানের পূর্ব অঞ্চলের জনগণ প্রথম থেকেই তাদের ভিন্ন অবস্থান ও স্বাধীন সত্বা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। ব্যাপক দখলী সত্ব সম্পন্ন কৃষকরা চাচ্ছেন তাদের সঙ্গের মালিকানা। মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক অংশ তাদেরই সন্তান সন্ততি। পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যদি মনিঅর্ডার ফর্ম, পোস্টকার্ড ইত্যাদিতে কেবল উর্দু লেখা হয়, যদি উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করা হয় তাহলে জমিদারী উচ্ছেদ ও তাদের জমির দখলী সত্বকে মালিকানা সত্বতে পরিনত করবে তারই বা নিশ্চয়তা কি? তাই ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও রাষ্ট্রপ্রধান জিন্নাহ সাহেবের একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষনার এত তীব্র প্রতিবাদ এবং সে প্রতিবাদেৱ প্রতি কৃষকসহ ব্যাপক জনগণের বিরোধিতার পরিবর্তে সমর্থন।
জনগণের সমর্থন সত্বেও ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব তাদের শ্রেণী চরিত্রের কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে আপোষ করে। এই কারণেই এই নেতৃত্বের পরবর্তিতে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের নেতত্বে ভাষা আন্দোলন বিশেষ পর্যায়ে পৌছলেই কেবল ১৯৪৮ সালের আন্দোলনের নেতৃত্ব নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে আন্দোলনে যোগ দেয়। কিন্তু ২০শে ফেব্রুয়ারী (১৯৫২) জারিকৃত ৪৪৪ ধারা ভঙ্গ করার বিরোধিতা করে, ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রতিবাদে পরদিন হরতাল আহ্বানের প্রচারপত্র । সর্ব দলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক সই করতে অস্বীকৃতি জানালে বিশ্ব বিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ২২শে ফেব্রুয়ারী হরতাল আহ্বানের মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে। এরপর থেকে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কোনো ভূমিকা ছিল না এবং ২১শে গুলি চালনার জন্য বিশ্ব ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতি সরাসরি বিরোধী ভূমিকাই পালন করে ২১শে ফেব্রুয়ারী এবং তৎপরবর্তি কয়েকদিনের যুগান্তকারী সংগ্রাম থেকে ১৯৪৮ সালের নেতৃত্ব কেবল বিচ্ছিন্নই ছিল না, রাজনৈতিকভাবে বিরোধীও ছিল।
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বই ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে গঠিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিনত হয়। এদের মধ্যে এবং প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র কেবল ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী আন্দোলনেই নয়, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন পরবর্তি পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের সঙ্গে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোষ ইত্যাদিতে পূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পরও শাসক শ্রেণী হিসেবে তাদের একই ভূমিকা দেখতে পাই। এইখানে একটা বিষয় পরিস্কার করা দরকার। ১৯৪৮ সালে ব্যাপক প্রগতিশীল ছাত্র ও প্রতিষ্ঠানগুলি অংশ গ্রহণ করলেও নেতৃত্ব ছিল মুজিবর রহমান ও তার অনুসারীদের। এরা ১৯৪৮ সালে মুসলিম ছাত্রলীগ, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং ১৯৫৪ সালে যক্ত ফ্রন্ট গঠন করে। এই নেতত্বই ১৯৫৬ সালে কেন্দ্র ও পূর্ব বাংলায় সরকার গঠন করে ১৯৭১, ১৬ই ডিসেম্বর নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করে।
এই নেতৃত্ব তাদের শ্রেণী চরিত্রের (সামন্ত মৃৎসুদ্দি) কারণে ১৯৪৮ সাল থেকেই প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আপোষকামীর ভূমিকা পালন করে এসেছে। ১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী প্রশ্নে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আপোষ করার জন্য পরবর্তিতে ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে এদের বিরোধী ও প্রতি বিপ্লবী ভূমিকা ছিল। এরা ২১শে ফেব্রয়ারী হরতালের অর্থাৎ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে হরতালের বিরোধী ছিল। এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ২১শে ফেব্রুয়রী দেশব্যাপী হরতাল পালন ছিল বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহান। আওয়ামীলীগের উপরোক্ত নেতৃত্ব ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫১ সালে শেষ পর্যন্ত নিস্ক্রিয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন বিশেষ পর্যায়ে উন্নীত হলেই কেবল ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে আওয়ামীলীগের উপরোন্ত নেতত্ব তাদের দোসর পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে তার নেতত্ব কুক্ষিগত করে।
১৯৫০ সালের প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই সংগ্রাম পরিষদে আওয়ামীলীগের ছাত্র ফ্রন্ট ছাত্রলীগ এবং কমিউনিষ্ট পার্টির ছাত্রফ্রন্ট ছাত্র ফেডারেশন ভুক্ত থাকলেও এই উভয় অংশের তাতে কোনো সক্রিয় বা নেতত্ব ভূমিকা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের নেতত্ব ছিল উপরোক্ত ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠন বহির্ভূত সাধারণ ছাত্রদের। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাংলার বিরোধীতা করলে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা শহরের ছাত্রদের হরতাল আহ্বান করে। সেই হরতাল উপলক্ষে মিছিল ও প্রতিবাদ সভায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী হরতাল পালন ও পরিষদ ভবণ ঘেরাওর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা ও ব্যাপকতা দেখে আওয়ামীলীগ কমিনিষ্ট পার্টির সহায়তায় ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে নেতত্ব কুক্ষিগত করে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদকে অন্তর্ভুক্ত ও অধীনস্থ করা হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারী হরতাল পালন উপলক্ষে ২০শে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক চলা কালে ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা জানা যায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ব্যাপক সংখ্যাধিক্য অংশ ২১শে ফেব্রুয়ারীতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ অমান্য করে ২১শে ফেব্রুয়ারী পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সভায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ তাদের পূর্ব দিনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার আহবান জানায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ও সাধারণ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ভাবেই সূচনা হয় মহান ২১শে ফেব্রুয়ারী ও ভাষা আন্দোলনের।
২১শে ফেব্রুয়ারী বিকালে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল ও বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে গুলি চলার এবং তাতে বরকত, সালামদের শহীদ হওয়ার পর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ আহ্বায়ক ও অন্যান্য নেতারা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম। পরিষদকে এই হত্যার জন্য দায়ী করেন এবং এই হত্যার প্রতিবাদে পরদিন হরতাল ও প্রতিবাদ মিছিল আহ্বানের বিরোধীতা করেন। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ২২শে ফেব্রুয়ারী হরতাল আহ্বানের লিফলেট দস্তখত করতে বিরত থাকে। তারা মনে করেছিলেন আন্দোলন এখানেই শেষ। বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ২২শে ফেব্রুয়ারী শহীদের গায়েবী জানাজা এবং সেই উদ্দেশ্যে হরতাল ও মিছিলের আহ্বান জানায়।
বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের এই আহ্বানে ২২শে ফেব্রুয়ারীর ঐতিহাসিক হরতাল ও মিছিল পালিত হয়। ২২শে ফেব্রয়ারী পালিত হলে ২১শে ফেব্রুয়ারী ব্যর্থ হয়ে যেত। এই দিন গুলি চালিয়েও মিছিল ও হরতাল রোধ করা যেত না। ২৩শে ফেব্রুয়ারী ২২শের প্রতিবাদে হরতাল ও মিছিল আহ্বান করল বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ। তারপরই শুরু হয়ে গেল দেশব্যাপী হরতাল ও মিছিল। এই হল ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলন। এই সমগ্র আন্দোলনে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কোনো ভূমিকা ছিল না। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ তার মহান ভূমিকা পালন করল ২৫শে ফেব্রুয়ারী এক বৈঠকে মিলিত হয়ে ২৬শে ফেব্রুয়ারী থেকে হরতাল প্রত্যাহার করে।
সামন্ত মৃৎসুদ্দি দল ও ব্যক্তি প্রধান সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ তার শ্রেণী চরিত্র উদ্ঘাটনে ত্রুটি করে নাই। এরাই ১৯৫৪ সালে গঠন করে ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্ট। জনগণ শতকরা ৯৮টি আসনে তাদের জয়যুক্ত করলেও ৯২ ক আমল থেকে ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের আগমণ পর্যন্ত তারা আর একবার তাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছিল।
১৯৭১ সালে জনগণের সমর্থনে ভারত ও রুশের সহায়তায় এরা বাংলাদেশ, গঠন করে আর একবার তাদের সামন্ত মৃৎসুদ্দি চরিত্র প্রকাশ করল। এ হল শ্রেণী বৈশিষ্ট্যর অমোঘ নিয়ম নির্দিষ্ট শ্রেণী হিসেবে সেই শ্রেণীর গণ্ডী অতিক্রম করা এদের সাধ্য তথা চরিত্রের অতীত।
এই শ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশ নিহত আছে প্রথমে বৃটিশ আমলে উপনিবেশিক ও আধা-সামন্তবাদী আমাদের সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় এবং ১৯৪৭ সালের পরবর্তিতে আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্তন্ত্রিক সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থায়। বাংলাদেশের উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠার পূর্ব উপরোক্ত সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থা কেবল বলবৎই নেই, তা আরো গভীর ও ব্যাপক হয়েছে। এই শ্রেণী বারবার তাদের শ্রেণী চরিত্র বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উদ্ঘাটন করতে করতেই একদিন ইতিহাসের মঞ্চ থেকে বিদায় নেবে। প্রথম শ্রেণীর নেতৃত্বে প্রগতিশীল শ্রেণীগুলির কর্তব্য হল এই প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীগুলিকে তাড়াতাড়ি ইতিহাসের মঞ্চ তথা আমাদের আধা-উপনিবেশিক আধা-সামন্তবাদী সমাজ থেকে সচেতনভাবে বিদায় করে নতুন একটা নয়া গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
সামাজিক কোনো শ্রেণীর চরিত্র ও ভূমিকা যে সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে তার উম্ভব তার দ্বারাই নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে বাহ্যিক কারণ সহায়ক, নির্ধারক আভ্যন্তরীণ কারণ।
১৯৪৭ সালের পর থেকে আমাদের সমাজের চরিত্র আধা-উপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক। বৃটিশ শাসনামলে তা ছিল উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক। ১৯৭১ এর পরও সমাজের চরিত্র আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক। অনেকে সমাজের বর্তমান চরিত্র নয়া-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক বলতে চান। এবং তারা আরে বলেন, আমাদের সামাজের চরিত্র ১৯৪৭ সাল থেকেই উপনিবেশিক আধা সামন্ততান্ত্রিক।
এখানে লক্ষ্যনীয় যে বৃটিশের আগমনের আগে আমাদের সমাজে। চরিত্র ছিল সামন্ততান্ত্রিক “(এশীয় ধরনের)”। তখন শাসক ছিল সামন্তর এবং রাষ্ট্রও ছিল তাদেরই। বৃটিশের শাসনামলে রাষ্ট্র ছিল প্রথমে বৃটিশ বনিক ও পরে বৃটিশ ধনীকদের। আর তখন সমাজের চরিত্র উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ ও কংগ্রেসের সঙ্গে আপোষেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসক হল মৃৎসুদ্দি ধনিক ও সামন্তরা। তখন সমাজের চরিত্র দাড়াল আধা-উপনিবেশিক ও আধাসামন্ততান্ত্রিক। ১৯৭১ এর পর বাংলা দেশ হল ভিন্ন রাষ্ট্র, যার শাসক শ্রেণী বাঙালী মৃৎসুদ্দি ও সামন্তরা এবং সমাজের চরিত্র থাকল। আগের মতই আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক।
বর্তমান নিবন্ধে আমরা কেবল ১৯৫২ পর্যন্ত আমাদের সমাজ ও তার শ্রেণীগুলির উদ্ভব ও বিকাশের পর্যালোচনা করব। আমরা আগের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় দেখেছি যে বৃটিশের শাসনামলেই আমাদের সামজের চরিত্র কেবলমাত্র সামন্তবাদী থেকে উপনিবেশিকও আধা-সামন্তবাদী হয়ে গিয়েছিল এবং শ্রেণীগলিও হয়েছিল সেই অনুযায়ী—সামন্ত, মৃৎসুদ্দি ধনিক, মাঝারি ধনিক, ছোট ধনিক, আধা-সর্বহারা ও সর্বহারা। এর ফলে আমাদের সমাজে সৃষ্টি হয়েছিল প্রচণ্ড এক গতিবেগ যা আমাদের হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে কোনোকালেই ছিল না। এই শ্রেণীগুলির (প্রথম দুইটির প্রতিক্রিয়াশীল অংশবাদে) সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের তীব্র দ্বন্দ ছিল। এই দ্বন্দকে নিরসন করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব ছিল সর্বহারা শ্রেণীর পার্টির। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের দেশে সর্বহারা শ্রেণীর পাটির উদ্ভব হয়েছিল। শ্রেণী তথা তত্ব দুর্বলতার কারনে সর্বহারা শ্রেণীর পার্টি সে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। আর সেই কারনে জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন চলেগেল মৃৎসুদ্দি ধনিকদের নেতৃত্বে। তারা দেশকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতায় এবং সামন্তদের সহায়তায় হয়ে বসল ভারত ও পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী। সমান্তরা ফিরে পেল তাদের হারানো স্বর্গ। তার আগের মতো এককভাবে নয়, ছোট তফর হিসাবে মৃৎসুদ্দি ধনিকদের নেতৃত্বে। তাই প্রয়োজন ছিল ভূমি বিপ্লবের। মাও সেতুং ১৯৩৩ সালে এডগার স্নােকে বলেছিলেন যে ভূমি বিপ্লব ছাড়া ভারত পরিপূর্ণ স্বাধীন হতে পারবে না।
সুতরাং আধা-সামন্তবাদের তথা আধা-সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার তাৎপর্য আমাদের অবশ্যই উপলদ্ধি করতে হবে। এই রকম সমাজ ব্যবস্থায় প্রধান উৎপাদন ব্যবস্থা হয় সামন্তবাদী তথা আধা-সমান্তবাদ উৎপাদন ব্যবস্থা। যদি আধা-সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা প্রধান না হয় তাহলে সমাজের একমাত্র অবশিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থা (ধনবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা) হবে প্রধান উৎপাদন ব্যবস্থা। যখন ধনবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা কোনো সমাজে প্রধান বা নির্ধারক হয় তখন সে সমাজ লাভ করে নতুন ও গুণগতভাবে ভিন্ন চরিত্র ও গতিবেগ, এবং তখন বুঝতে হবে যে বূর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে। আর এ বিপ্লব সম্পন্ন করেছে কারা ? সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতায় মৃৎসুদ্দি ও সামন্তরা। আর কমিউনিস্টরা বিগত ৩০ বছর যাবৎ যারা সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের বিরদ্ধে সংগ্রাম করছিল বূর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করছিল তাদেরই কি না করছিল বিরোধিতা ?
সাম্রাজ্যবাদ কোনদিনই চাইবে না হাতের কঞ্জার ৮ কোটি লোক অধ্যুষিত একটা বাজার হাত ছাড়া হয়ে যাক। কারন একটা দেশের ধনবাদী ব্যবস্থা হওয়ার অর্থ সেই দেশ আর সেই পরিমাণ পণ্য অন্যদেশ (অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের কাছ) থেকে কিনবে না। আর ধনবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের অর্থ কি সামন্তবাদী উৎপাদন ও শোষণ ব্যবস্থায় পরিমাণ অবসান না ?
সুতরাং আমাদের মতো আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্তবাদী সমাজ তথা উৎপাদন এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শাসক মৃৎসুদ্দি ও সমান্তরা এবং তাদের ও সাম্রাজ্যবাদের পোষা দারোয়ান আমলারা যে ধনবাদের বিকাশের পথে সুগম করে দেবে এ রকম মনে করার অর্থ মৃৎসুদ্দি ধনিক, সামন্ত, আমলা ও সাম্রাজ্যবাদের শ্রেণী চরিত্র ভুলে যাওয়া।
আমাদের মধ্যে অজেকে মনে করেন, উঠতি বুর্জোয়ার প্রতিনিধি বর্তমান শাসকরা, চরিত্রগতভাবে জাতীয় ধনিক হয়ে গেছেন। তাহলে কি বুঝতে হবে যে মৃৎসুন্দি ধনিক, আমলা, সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ত স্বার্থদেয় চরিত্র বদলে গেছে, তারা এদেশে স্বাধীনতাবাদী বিকাশে সহায়তা করে, করছে এবং করবে? কোন অর্থনৈতিক নিয়মে এ হতে পারে না।
আমাদের বন্ধুদের মূল্যায়ন অনুযায়ী যদি শাসকরা জাতীয় ধনিকই হয় তাহলে কি তার ধনবাদ উচ্ছেদ করবেন, নাকি ধনবাদ প্রতিষ্ঠ্য করবেন ? নিঃসন্দেহে তার ধনবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন। আমরা দেখেছি সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ত শোষকরা ধনবাদ প্রতিষ্ঠা করতে দেয় না। জাতীয় ধনিয়া ধনবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সাম্রাজ্যবাদই তাদের আসন্ম ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে তাদের অনুগত মৃৎসুদ্দি ধনিকদের ক্ষমতায় বসাবে। তাছাড়া জনগণই বা কেন ধনবাদ প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত এবং উদ্যোগী হবেন ? ধনবাদ তাদের কি দেয় বা দিতে পারে ? ভাই ধনবাদ প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টায় জাতীয় ধনিকরা শ্রমিক কৃষক তথা জনগনেও সহায়তা পাবে না। সুতরাং আমাদের মতো আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্তবাদী দেশে ধনবাদ প্রতিষ্ঠার কোন পথ নেই।
অথচ ধনিক হওয়ার তথা ধনিকদের শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই মুসলমান ধনিকরা অবিভক্ত ভারতে পাকিস্তান, এবং বাঙ্গালী ধনিকরা অবিভক্ত পাকিস্তানে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর জন্য ধনিকরা উভয় ক্ষেত্রে জোট বেধেছিল সামন্ত ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে। জনগণ তাদের সমর্থন করেছিল ভিন্ন উদ্দেশ্যে ও প্রয়োজনে । জনগণের উদ্দেশ্যে ও প্রয়োজন আজও মেটে নি। এই জনগণ হল আধা সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার জনগণ। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মাধ্যমে জনগণ, সমাজতন্ত্র চায় নি, তারা চেয়েছিল সামন্ত পোষণের অবসান, খেটে খাওয়ার সুযোগ সুবিধা, গণতান্ত্রিক অধিকার। কারণ অবিভক্ত ভারত ও পাকিস্তানের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চরিত্র, আধা-সামন্ততান্ত্রিক। বাংলাদেশ হওয়াতে এ চরিত্র এভটুকু পরিবর্তিত হয়নি।
সামাজিক ক্রমবিকাশের ধারায় হাজার হাজার বছরের সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আধাসামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তিত হয়েছপ মাত্র শ’দুই বছর আগে। আমাদের সমাজের বর্তমান শ্রেণীগুলিযর উদ্ভব আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দরুশে। ১৯৪৭ সালে সমাজে নতুন করে কোনো শ্রেণীর আগমন বা উদ্ভব ঘটেনি। সমাজের উপনিবেশিক অবস্থা আধা-উপনিবেশিক অবস্থায় পরিণত হওয়ার কারনে আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা আরো বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে মাত্র।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী, সম্প্রদায়ের বিকাশ সূচিত হলেও বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্বে প্রথম বিশ্বের সময়ও সে বিকাশ ত্বরান্বিত হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়, বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলন ও পাকিস্তান অর্জনে পরই কেবল সে বিকাশ বিশেষ গতি লাভ করতে সক্ষম হয়। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এই বিকাশের ধারাবাহিক রুপ ও সফল পরিণতি মাত্র। আময় আগেই দেখেছি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের বিকাশ সর্বাঙ্গীনভাবে সম্পর্কিত ছিল কৃষকদের স্বাধীন কৃষক হওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে, এবং এই দুই বিকাশ ছিল পরস্পর সম্পর্কিত। অতি আশ্চর্যের ব্যাপার সামন্ত বূর্জোয়া এবং শ্রমিকদের বিকাশও একই প্রক্রিয়ার সঙ্গেই ছিল সম্পর্কিত, অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক মাত্র।
এ এই কারণেই ১৯৫২ সালে ভাষা সংগ্রাম এত প্রচণ্ড ব্যাপকতা, গতি এবং সংহতি লাভ করেছিল। ভাষা সংগ্রামের ধাক্কায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে ধস শুরু হয়েছিল, সামন্ত মৃৎসুদ্দি শাসকশ্রেণীর বিচ্ছিন্দতার যে সূচনা হয়েছিল তা আর কখনও থামেনি, কথনও স্তিমিত হয়নি।
আমাদের উপমহাদেশে, ১৯৪৭ সালে যে শ্রেণীগুলি দেখা যায় তাদের উদ্ভব হয় বৃটিশের দখলের ফলে, অর্থাৎ একটা বিদেশী পূঁজির শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে। লক্ষণীয় যে এই উপমহাদেশে সামাজিক বিকাশের ফলশ্রুতিতে এই পূ্জির উদ্ভব হয়নি, এ পূঁজি আরোপিত একটি বিদেশী পূ্জির শাসনের প্রয়োজনে আরোপিত পূঁজি, উন্মেষমুখ বা উন্মেষ-সম্ভৰ দেশীয় পূজিবাদকে দমন রাখার উদ্দেশ্যে বিদেশী একটা পূজিবাদের আরোপ। তবু আমাদের সমাজে এ বিদেশী পূজিবাদে আগমনে আমরা পাই ধনিক (মৃৎসুদ্দি, মাঝারি ও ক্ষদ্র) এবং শ্রমিক শ্রেণী। সান্তবাস ভেঙ্গে আধা-সামন্তবাদ হওয়ায় ব্যাপক বিহীন ও স্বত্বহীন জনসমষ্টির তথা সর্বহারা, আধা-সর্বহারার উম্ভব হয়ে সমাজের চেহারারটাই হয়ে দাঁড়ালো ভিন্ন ধরনের। ঢিলে ঢালা সামন্ত রাষ্ট্রের পরিবর্তে বিদেশী-ধনিকদের সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রের আবির্ভাবে, মুষ্টিমেয় মৃতপ্রায় সমস্ত ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের জায়গায় কুমবর্ধমান বিপুল সংখ্যক আধুনিক ধ্যান-ধারণায় উজ্জীবিত প্রাণবন্ত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের আগমনে, অনড়, অচল গ্রাম সমুদ্রের মধ্যে নতুন নতুন আধুনিক শহরের উদ্ভবে, পদযান, অশ্ব ও গোশকটের স্থানপ দ্রতগতি সম্পন্ন বাষ্পীয় শকট এবং যুগেযুগে লোক মারফত সংবাদ আদান-প্রদাণের স্থানে বিদ্যুতের সহায়তায় বিদ্যুৎবেগে সংবাদ আদান-প্রদান ব্যবহার প্রবর্তনে অচল একটি সমাজ নতুন জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে সেই জগতের অংশ হয়ে উঠল। এ সবই সম্ভব হল সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ও সামন্তবাদীসমাজ আধা-সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ও আধা-সামন্তবাদী সমাজে পরিবর্তিত ও রুপান্তরিত হওয়ার কারণে এ একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন, আমাদের সমাজ বিকাশের হাজার হাজার বছরের মধ্যে প্রধান বিপ্লবী পরিবর্তন।
এই নতুন ব্যবস্থায় নতুন শ্রেণীগুলি বিপ্লবী, আবার পুরানো শ্রেনীগুলির সঙ্গে সম্পর্কিতও তাই পরস্পর সম্পকির্ত ও পরস্পর-নির্ভর আধা-সামন্তব্যবস্থা ও উপনিবেশিক শোষণের অবসান আর বিচ্ছিন্ন ভাবে সম্ভব নয়, শ্রমিক শ্রেণীর ভাবাদর্শের নেতৃত্বে নতুন প্রগতিশীল শ্রেণীগুলির সম্মিলিত সশস্ত্র প্রচেষ্টা ছাড়া সম্ভব নয়। নতুন উৎপাদন ব্যবস্থার নতুন শ্রেণীগুলি কি কি ? সেগুলি হলো : সামন্ত জমিদায় জোতদার শ্রেণী, ধনীক শ্রেণী (মৃৎসুদ্দি, মাঝারি ও ক্ষদ্র), আধা-সবহারা শ্রেণী ও সর্বহারা শ্রেণী। এর মধ্যে সামন্ত জমিদার-জোতদায় শ্রেণী এবং মৎসী ধনীক শ্রেণী ছাড়া আর সবগুলি নতুন শ্রেণী মুল প্রগতিশীল শ্রেণী। এর মধ্যে মাঝারি ধনীক শ্রেণী দোদুল্যমান, এবং অবশিষ্ট শ্রেণীগুলি বিপ্লবী।
লক্ষণীয় যে, উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজে যে যে শ্রেণী থাকে, আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজেও সেই সেই শ্রেণীগুলি থাকে। তফাৎ কেবল এই যে, উপনিবেশে একটি বিদেশী ঘনিষ্ট শ্রেণীর প্রত্যক্ষ শাসন থাকে আর আধা-উপনিবেশে বিদেশী ধনীক শ্রেণীর প্রত্যক্ষ শাসনের জায়গায় থাকে দেশীয় মৎস্য ও সামন্তদের শাসন। ‘নয়া-উপনিবেশেও থাকে একটি বিদেশী ধনীক শ্রেণীরই, তবে অপ্রত্যক্ষ শাসন এবং আধা-সমান্ত ব্যবস্থা। নয়া গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সামন্ত ও মৃৎসুদ্দি ধনীক শ্রেণী নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবে উচ্ছেদ হয়ে অবশিষ্ট শ্রেণীগুলি যথা, মাঝারি ধনিকশ্রেণী, ক্ষুদ্র ধনিকশ্রেণী, আধা সর্বহারা শ্রেণী ও সর্বহারা শ্রেণীগুলি থাকে। সামাজতান্ত্রিক ভিত্তি বিলোপ হয়, আধা-সর্বহারা ও সর্বহারা শ্রেণীরও অর্থনৈতিক ভিত্তি বিলোপ হয়। তথন উৎপাদনের সমস্ত উপায় ও উপকরণ হয় সর্বহারা শ্রেণীর একনায়তাধীন রাষ্ট্রের সম্পত্তি এবং সমস্ত জনগণ পরিণত হয় সংঘবদ্ধ শ্রমজীবীত, এবং উৎপাদন ও বণ্টনের বিধি হয়—কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক।
সুতরাং কোন সমাজ ব্যবস্থাই স্থির ও চিরন্তন নয়। আমাদের হাজার হাজার বছরের সামন্তবদী সমাজ বিদেশী পুজির শাসনে উপনিবেশিক ও আধা সামন্তবাদী সমাজে পরিনত হয়ে যে যে শ্রেণীর জন্ম দিল সেই সব শ্রেণীর এবং সেই সব শ্রেণীর ও সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ তার পরিনতিতে জন্ম দিল আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্তবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রের তথা ভারত পাকিস্তানের। আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্তবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রের শ্রেণীগুলির পারস্পরিক ও সেই শ্রেণীগুলির ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যেকার দ্বন্দ জন্ম দিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। কিন্তু পুরানো শ্রেণীগুলি তথা উৎপাদন ব্যবস্থা যথারীতি থেকে গেল। ফলে বাংলাদেশের সমাজও থেকে গেল—আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক। কিন্তু এ সমাজের শ্রেণীগুলি ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যেকার দ্বন্দ তীব্রতর হয়েছে এবং তার গতি আরো তীব্রতর হওয়ার দিকে। এর সচেতন ও অনিবার্য পরিণতিতে বাংলাদেশ হয় নয়া উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিণত হবে। হয় জনগনতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিণত হবে। বর্তমান জাতীয় ও আন্তজাতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও যেকোনো আধা-উপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রতে দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকতে পারে না।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমাদের সমাজের শ্রেণীগুলির উদ্ভব হয় উপনিবেশিক উপমহাদেশে। পাকিস্তান সেই সমাজ বিকাশেরই একটা পরিণতি ; ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সহ পাকিস্তানের সকল আন্দোলন এবং বাংলাদেশের উদ্ভবও সেই সমাজ বিকাশেরই পরিনতি ; ঐ সময়কার শ্রেণীগুলি ঐ সমাজ বিকাশেরই ফলশ্রুতি। ১৯৫২ সালের সময়কার শ্রেণীগুলি হলো আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ও সমাজ ব্যবস্থার শ্রেণী। তারপর ২৫টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্র এবং শ্রেণিগুলি অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। কিন্তু পরিবর্তন, আসন্ন ও অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ইতিহাসের গতি ও দাবীও তাই।।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.09.09-3.pdf” title=”1977.09.09″]