অধ্যাপক সারওয়ার মুর্শেদ
প্রথমে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের পর্যবেক্ষক এবং পরে এই আন্দোলনের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে, সেই সংগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা ভিত্তিক খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়ণকারি গ্রুপের সদস্য হিসেবে ২৫শে মার্চের বেশ আগেই উপলব্ধি করেছিলাম রক্তপাত হবেই, পাকিস্তানের কাঠামোতে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব হলেও তা কাগজে নক্সা হয়েই থাকবে।এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ অনিবার্য। বঙ্গবন্ধুর “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” ঘোষিত হল,তখন পাকিস্তানিদের বাংলাদেশে গণহত্যার পরিকল্পনা সমাপ্ত হয়েছিল। জাহাজ বোঝাই সমরসম্ভার এবং সাদা পোষাকে বিমানযোগে পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত সৈন্য আমদানি,ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমুহে মেশিনগান এবং কামানের নগ্ন উপস্থিতি। মুজিব-ইয়াহিয়ার আলোচনা সম্পর্কে সন্দেহ বাঙালিদের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক অভিযান আসন্ন;এ ধারণাকে আমার মনে দৃঢ়মূল করেছিল।
এসময়ে আমার মনকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসাসস্কুল করেছিল:বাঙালি জাতি উদ্বেলিত প্রত্যয় এবং প্রচন্ড আবেগে ঐক্যবদ্ধ এবং অগ্নিগর্ভ, একটি সশস্ত্র সংগ্রাম এবং প্রতিরোধের জন্য,সংগঠন এবং আয়োজনের দিক থেকে তৈরি কি? মার্চের মাঝামাঝি সময়ে এই প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব দেয়া সহজ ছিল না। চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য তথা কৌশলগত কারণে সাময়িকভাবে ছ’দফার দাবীকে কিছু নমনীয় করা যুক্তিযুক্ত নয়? কিন্তু একই সংগে এও বুঝেছিলাম যে আন্দোলনের রাশ টেনে ধরার কঠিন ঝুঁকি নেয়া হলেও সেই মুহূর্তে ইতিহাস তার গতি মন্থর করবে। স্বাধীন বাঙালি সত্তার শত্রুরা বাঙালিদের সময় দেবে, এমন চিন্তার কোন নিশ্চিত ভিত্তিও নেই।
সুতরাং গঠনতান্ত্রিক আলাপ আলোচনার আড়ালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে যে একটি মৃত্যুযজ্ঞের আয়োজন করেছিলো,এ বিষয়ে বিশ্বজনমতকে অবহিত করার প্রচেষ্টা আমার কাছে প্রাধান্য পেল। ফরাসী দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশ্রুত অর্থনীতিবিদ জন কেথে গলব্রেথ,সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এবং টাইমস ও নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকসহ আরো অনেকের কাছে এ বিষয়ে আমি তারবার্তা পাঠাই। এবিষয়ে আরো উল্লেখ্য যে কিসিঞ্জার-নিক্সনের পাকিস্তান সমর্থনের নীতি এবং বাংলার মাটিতে পরাশক্তি সমূহের অস্ত্রের উপস্থিতি এবং পাকিস্তানি শাসকদের বাংলার নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে তা’ ব্যবহারের ক্রুর সম্ভাবনা কিভাবে বাংলার মানুষকে বিপন্ন জনগণের বিরুদ্ধে তা’ জানাবার জন্য পূর্বপরিচয়ের সুত্র ধরে প্রফেসর হেনরী কিসিঞ্জারকে আমি ১৬ মার্চ একখানা চিঠি লিখি। চিঠির অনুলিপি নিচে সন্নিবেশিত হলোঃ
“I am writing to you at a moment of grave peril to my people. Yahya has moved in guns and tanks apparently to reinforce his and mr. Bhutto’s constitutional arguments. There has already been a good deal of wanton killing and move is promised by the situation.The holocaust that seems all but inevitable will destroy many bengali lives and much else. it is clear to us that this country can not survive the application of force and that the resulting chaos and instability in wide area was in the subcontinent will benefit neither our friends nor our enemies.
We want the world to know that a military solution to our constitutional problem is not only liable to be barren and disastrous; but it is unnecessary. A political settlement is possible; provided the bengali demand for changing the colonial pattern of the relationship between the two wing was accepted by writing a constitution for the country, which would give them complete control over their economic resources. But of course; Mr. Bhutto; backed by army and the economic interests responsible for the deprivation of the bengalis for the post twenty three years; continued to oppose this.
The situation therefore has the element of a sophoclean tragedy; with this difference that its denouement would affect the fate of real human beings who number seventy five millions. What looms large in one’s mind at the moment of the bristling array of weapons to be seen in Bangladesh today and what they augur. These weapon ; American; Russian and Chinese in origin are to be used against an unarmed people. Bengalis are united as never before their history in their resolve to replace the old system of relationship in the country. Paradoxically, this make the threat of massive use of force by Islamabad more real; for it has no other way to imposing its will on the Bengalis ; although every dictate of sanity is against it.
I should like to appeal all men of goodwill; and you are a man of goodwill in high office in America; to do all they can to help avert this cruel possibility involving fellow human beings.
I am writing this letter to you as a teacher and as one who had the great good fortune and honour of knowing you and feel sure that you could sympathies human aspect of our crisis. You would earn our eternal gratitude if you would exert your influence and help prevent the threatened mass slaughter of men, women and children in East Pakistan. “
-(The weekly Web; 25 March 1973)
(অনুবাদ)
আমার আমার লোকেদের ভীষণ বিপদের সময় তোমাকে লিখতে বসেছি। ইয়াহিয়া স্পষ্টতই তার এবং ভুট্টোর সাংবিধানিক মতাদর্শ টিকিয়ে রাখার জন্য অস্ত্র এবং ট্যাংকের আশ্রয় নিতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে নির্বিচার হত্যা শুরু হয়ে গেছে এবং অবস্থাদৃশ্যে তা চলমান থাকবে। ভয়াবহ গণহত্যা দেখে মনে হচ্ছে এতে অনিবার্যভাবে আরো অনেক কিছুর ধ্বংসের সাথে প্রচুর বাঙালি মারা পড়বে। এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট যে এই দেশ জবরদস্তী সহ্য করতে পারবে না এবং এই জবরদস্তীর পার্শপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এই উপমহাদেশ যে বিশৃঙ্খলা এবং ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে তা আমাদের বন্ধু বা শত্রু কারো জন্য লাভজনক হবে না।
আমরা বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই যে আমাদের সাংবিধানিক সমস্যার মিলিটারি সমাধান শুধু নিষ্ফল এবং সর্বনাশা নয় বরং এটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। একটা রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব হতো, যদি বাঙালিদের দাবী মেনে নিয়ে বর্তমানে চলমান ঔপেনিবেশিক কাঠামো পরিবর্তন করে দেশের দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের রীতি সাংবিধানিকভাবে বদলে অর্থনৈতিক বিষয়সমূহে উভয়পক্ষকে নিজ নিজ প্রদেশে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হতো। কিন্তু বিগত ২৩ বছর যাবৎ বাঙালিদের বঞ্চনার জন্য দায়ী অর্থনৈতিক বিষয়াদি। আর্মি সমর্থনপুষ্ট জনাব ভুট্টো তাই ক্রমাগত এর বিরোধিতা করে যাচ্ছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে যে কোন দুঃখজনক ঘটনা ঘটার সমূহ উপাদান রয়েছে। এরকম চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ভাগ্য এতে আক্রান্ত হবে যাদের সংখ্যা সাড়ে সাত লক্ষ। এমন যুদ্ধ সরঞ্জাম দেখে মাথায় একটা ব্যাপারই গুটি পাকাতে থাকে যে এগুলো কিসের ভবিষ্যৎ বাণী করছে? অ্যামেরিকা, রাশিয়া এবং চায়নাতে তৈরি এই সব অস্ত্রসমুহ নিরস্ত্র মানুষের উপর ব্যবহার হবে। ইতিহাসের আগের যে কোন সময়ের থেকে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ এবং দুই দেশের মধ্যকার সনাতন কাঠামো পরিবর্তনে বদ্ধপরিকর। অপরপক্ষে এটা ইসলামাবাদ কর্তৃক ব্যাপক বল প্রয়োগের সম্ভাবনাকে আরো বাস্তবসম্মত করে তুলছে, বাঙালীদের উপর তাদের নেতৃত্ব খাটানোর এছাড়া আর কোনই পথ নেই; যদিও সকল সদবিবেচনা এর বিপক্ষে যাবে।
আমি সকল সহৃদয় মানুষের কাছে আপিল করব এবং আপনি আমেরিকার উচ্চ পদস্থ একজন সহৃদয় মানুষ; মানুষের উপর এই নিষ্ঠুর সম্ভাবনা প্রতিহতে সম্ভব সকল ব্যবস্থা করবেন।
আমি এই চিঠিটা আপনাকে একজন শিক্ষক হিসেবে লিখছি যে কিনা আপনার সাথে পরিচিত হয়ে সৌভাগ্য এবং সম্মানের অধিকারী হয়েছে এবং আমি নিশ্চিত যে আমাদের বিপদের মানবিক দিকটি আপনি সহানুভূতির সাথে দেখবেন। যদি আপনি আপনার প্রভাব বিস্তার করে পূর্ব পাকিস্তানের নারী পুরুষ এবং শিশুদের নির্বিচার গণহত্যা প্রতিহত করতে পারেন, তবে এর মধ্যদিয়ে আপনি অর্জন করবেন আমাদের শ্বাশত কৃতজ্ঞতা।
দা উইকলি ওয়েভ
২৫ মার্চ, ১৯৭৩
চীন-আমেরিকা সম্পর্ক পুনঃনির্মাণের সেতু হিসেবে পাকিস্তানকে ব্যবহারের নীতির অন্যতম স্থপতি হেনরী কিসিঞ্জার যে বাংলাদেশের ঘটনাক্রমের উপর কোন শুভ প্রভাব বিস্তার করেননি তা’ আজ বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আমার এই চিঠির একটি sequel (অনুবাদঃ পরবর্তী পর্ব) আছে যার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক। এ চিঠির কয়েক মাস পর কিসিঞ্জার নয়া দিল্লিতে এলে আমি তাকে পশ্চিম বাংলায় আমাদের শরণার্থী শিবির গুলোতে এসে আমারিকার পাকিস্তান নীতির ফলাফলের একটি দিক স্বচক্ষে দেখে যেতে আমন্ত্রণ জানাই। মানবিক বা নৈতিক প্রশ্নে সম্পূর্ণ উদাসীন এই ধুরন্ধর কূটনৈতিক এবার আমার চিঠির জবাব দিলেন এবং সবিনয়ে সময়াভাবহেতু আমার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারলেন না বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন।
২৫শে মার্চের কালো রাত্রের পর যখন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলাম তখন সিদ্ধান্ত নিলাম সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার জন্য নিজের শক্তি অনুযায়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিবো।
বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা ছেড়ে কিছুদিন আত্নগোপন করে থাকার পর যখন দেখলাম আশ্রয়দানকারীর সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে তখন একদিন নরসিংদীর পথে ভারত সীমান্তের দিকে রওয়ানা হই। ৪ঠা এপ্রিল কি ছিল সেই দিনটি? তিতাসের ওপারে এক মেঘাচ্ছন্ন সকালে যখন আমি পরিবারসহ সিংগারবিল যাওয়ার পথ খুঁজছি দ্বৈবক্রমে আমার এক প্রাক্তন ছাত্র আমাকে দুর থেকে দেখতে পেয়ে কবি সানাউল হকের বাংলোয় নিয়ে আশ্রয় দেয়।এবং নদীর ওপারে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার উপর পাকিস্তানি প্লেন থেকে কয়েক দফা গুলি বর্ষিত হয় সেদিন সন্ধ্যায় স্ত্রী এবং চার পুত্র কন্যা সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলার দিকে রওনা হই। সম্ভবতঃ সেই দিনটি ছিল ১৪ এপ্রিল।
ভারতে অবস্থানকালে আমার তৎপরতাকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ
(১) পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যের দায়িত্ব পালন।
(২) অস্থায়ী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে নানা সমাবেশ এবং সেমিনারে বাংলাদেশ আন্দোলনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা;
(৩) বাংলাদেশ শিক্ষা সমিতির প্রথমে আহবায়ক; পরে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে প্রয়োজনমত মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্যে সমিতির স্বতন্ত্র কার্যক্রমে অংশগ্রহণ।
এছাড়াও ঐ সময়ে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদের কোন কোন বক্তৃতা ও নীতিবিষয়ক প্রতিবেদনের খসড়া ইংরেজিতে তৈরি করে দিয়েছি বা প্রয়োজনমত বাংলায় করতেন ডক্টর আনিসুজ্জামান।
বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি এবং তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমার কয়েকটি জায়গায় স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এখানে তা উল্লেখ করবো। আসামের বুদ্ধিজীবীরা “স্বাধীন বাংলাদেশের তাৎপর্য” বিষয়ে শিলং সরকারি কলেজের মিলনায়তনে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন। এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন আসাম সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শ্রী ত্রিপাঠী।
আমি সে উপলক্ষে যা বলেছিলাম তা’ সংক্ষেপে এইঃউপমহাদেশে দুটি দেশ; ভারত এবং বাংলাদেশ; খুব স্বাভাবিক কারনে পরস্পরের বন্ধু হবে। ভারত বিভক্ত হওয়ার পর ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভূগোলের দিক দিয়ে যথেষ্ট নৈকট্য থাকা সত্বেও ভারত এবং পাকিস্তান স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে নি।পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও সমরবাদীর ভারত বিদ্ধেষকে তাদের স্বৈরশাসন এবং অর্থনৈতিক শোষনের স্বার্থে জিইয়ে রেখেছে। স্বাধীনতার পর নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যেকার সম্পর্কের ভিত্তি হবে পরিণত কান্ডজ্ঞান প্রবুদ্ধ স্বার্থচেতনা এবং পারস্পারিক সম্ভ্রন্ত এবং এই প্রক্রিয়ায় ইতিহাসের একটি বড় রকমের বিকৃতি দুর হবে। দু দেশের যৌথ নদনদী। সহজ যাতায়াতের প্রয়োজন অর্থনৈতিক আদানপ্রদান ও সহযোগীতার প্রশ্নাতীত যৌক্তিকতারও তা’ই দাবী করে। বাংলার স্বশস্ত্র সংগ্রামে ভারতের সহায়তা আমাদের বিপুলসংখ্যক শরণার্থীদের ভারতে আশ্রয় দান; একটি বড় গণতান্ত্রিক দেশের অন্য একটি গণতন্ত্রকামী মানবগোষ্ঠীর প্রতি এ মহানুভব সমর্থন। এই নতুন সম্পর্কের শুভসূচনা। শুধু একটি কথা; ভারত আয়তনে,সম্পদে,শক্তিতে একটি বড় দেশ আর বাংলাদেশ সেসব দিক থেকে ক্ষুদ্র। এ অসমতা যেন দু’দেশের স্বাভাবিক বন্ধুতার পথে কোনদিনও অন্তরায় সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়ে দু’দেশকে সজাগ থাকতে হবে।“
বক্তৃতা শেষ হলে মন্ত্রী মহোদয় আসন ছেড়ে এসে আমায় অভিনন্দন জানিয়ে করমর্দন করেন এবং শ্রোতা বৃন্দও আমার বক্তব্য ও তার আন্তরিকতা সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন বলে আমার বিশ্বাস।
কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন এক আজব কান্ড করে বসে। তারা তাদের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো রিপোর্টে দাবী করে যে বাংলাদেশ থেকে আগত এক নরাধম অধ্যাপক ভারতকে সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে হাঙ্গেরী রুপে কল্পনা করে ভারতকে প্রতিবেশী দমনেচ্ছু আগ্রহী শক্তিরুপে চিত্রিত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন প্রভাবশালী যারা আমাকে জানতেন; আশ্রয়দানকারী সরকারের বিরাগ থেকে সে যাত্রা আমায় রক্ষা করেন।
আরেকটি অন্য ধরনের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশের এক দরিদ্র মুসলিম পল্লীতে বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে। এই স্বল্পশিক্ষিত গরীব মুসলমানদের কাছে পাকিস্তান ছিল একটা বিশ্বাস এবং কল্পনার স্বর্গ; তারা সেখানে কোনদিন যেতে পারবেনা; তবুও যে স্থানটি তাদের মনের মধ্যে লুকোনো আশ্বাস এবং নিরাপত্তা। অনেক্ষন বক্তৃতার পরও দেখলকম মানুষ গুলো পাহাড়ের মত নিরব নিরুত্তাপ, তাদের চোখে শীতল ক্রোধের কাঠিন্য। কিন্তু এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল যখন আমি তাদের দিকে সঙ্গীনের মত কয়েকটি প্রশ্ন উদ্যত করলাম এবং জানতে চাইলাম ইসলামে কোন নির্দেশ আছে ধর্মের নামে কোন মুসলমান সৈনিক পিতার সামনে কন্যাকে ধর্ষণ করতে পারে, লুন্ঠন, অগ্নীসংযোগ, নারী এবং শিশু হত্যা করতে পারে? প্রশ্নের পর পাকিস্তানি বর্বরতার কিছু বর্ণনা, তারপর আবার প্রশ্ন করলাম, এরই নাম কি ইসলাম?
এই পাকিস্তানই কি আপনার প্রিয় পাকিস্তান? ‘না’ ভঙ্গীতে অনেকগুলা হাত একসঙ্গে উঠে গেল। আমার সে সন্ধ্যার বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগেই পাথর গলেছিল; সেই সরল বিশ্বাসী মুসলমানরা বুঝেছিল; কেন বাঙালিরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল।
স্বাধীনতাযুদ্ধের স্বপক্ষে কার্যক্ষেত্রে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং সরকার সংশ্লিষ্ট তৎপরতার বাইরেও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কাজের সংগে যুক্ত ছিলাম, এই কথা আগেই উল্লেখ করেছি। শুধু একটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ করেছি – সেটা হল সংবাদ মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের সংগে সহযোগিতা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তি যাদেরকে বুদ্ধিজীবি বলেও আখ্যায়িত করা হয়, ভারতে অবস্থানকালে বাংলাদেশ আন্দোলন ভিত্তিক তাদের একটা আলাদা অস্তিত্ব বা তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র রকম সংহতি ছিল বৈকি বাংলাদেশ শিক্ষক সমতি স্বতন্ত্র সংহতির একটা দৃষ্টান্ত।
দিল্লি আন্তর্জাতিক সেমিনারে পাঠ করার জন্য “The nature of Bengali Nationalism” (অনুবাদঃ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি) শিরোনামে আমাকে একটি Paper (অনুবাদঃ প্রবন্ধ) তৈরি করার অনুরোধ জানানো হয়েছিলো, তবে সেই সেমিনারে যোগ দিতে আমি অসমর্থ হই। কিন্তু প্রবন্ধটির জন্য যে কাজ শুরু করেছিলাম তা’ বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি অনুমোদিত গবেষণা প্রকল্পের রুপ নেয়। perspectives of Bengal (অনুবাদঃ বাংলার প্রেক্ষাপট) শিরোনামে রচিত এই গবেষণা প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিয়তাবাদের প্রকৃতি ও উৎস নিরূপণ করা।
মুজিব নগর সরকার একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেছিলেন। একটি Long term (দীর্ঘ মেয়াদী) একটি Mid term (মধ্য মেয়াদী) এবং একটি Short term (স্বল্প মেয়াদী) প্ল্যান তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এই কমিশনকে। আমি এই কমিশনের একজন সদস্য ছিলাম। কোন দীর্ঘ মেয়াদী বা মধ্য মেয়াদী প্ল্যান নিয়ে কমিশন সদস্যদের মধ্যে কোনও গভীর বা ধারাবাহিক আলোচনা বা বিতর্ক হয় নি। তবে কিছু স্বল্প মেয়াদী প্ল্যান নিয়ে মতবিনিময় হয়েছে- যেমন যুদ্ধ শেষে বিধ্বস্ত শিক্ষা ব্যাবস্থা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন বিষয়টি বং এর কোন কোনটি নীতিগতভাবে গৃহীত হয়েছিল। (মনে পড়ে তরুন মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন সমস্যা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি সমীক্ষা আমার তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছিল)। অস্থায়ী সরকার আওয়ামীলিগের পুরো আদর্শগত বর্ণালী ধারক হিসেবে স্বাভাবিকভাবেঈ যুদ্ধ জয়ের শেষে এক কোটি শরণার্থীসহ গৃহে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যকেই প্রাধন্য দিয়েছিল। তার কাছ থেকে কোন দীর্ঘমেয়াদী এমনকি মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরির ভিত্তিগত দিকনির্দেশ পাওয়া সম্ভব ছিল না। কার্যতঃ তা পাওয়াও যায় নি। মৌলিক বিষয়ে, আমার বিশ্বাস কমিশনের সদস্যরাও একমত পোষণ করতেন না। স্বাধীন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক হবে এমন একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত ছিল কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র ও মিশ্র অর্থনীতির কাঠামোর মধ্যে সে সমাজতন্ত্র আবদ্ধ থাকবে, না ভূমির ব্যাক্তি মালিকানা বাতিল বা পুনর্বন্টনের পথে আরো সুদূরগামী হবে, এ জাতীয় প্রশ্নের মীমাংসা যুদ্ধরত অস্থায়ী সরকার দেন নি। সুতরাং কতগুলো অবিতর্কমূলক স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনাতে কমিশন নিজের কাজকে সীমাবদ্ধ রেখেছে। তার অর্থ এই নয় যে আলাদাভাবে কমিশনের সদস্যরা কোন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার রুপরেখা বিবেচনা করেন নি-কিন্তু তা সহজবোধ্য কারনেই সরকারের দরবার পর্যন্ত পৌঁছে নি।
বিজয়ের পর কবে কিভাবে দেশে ফিরে আসি আমি তার সঠিক তারিখ কিছুতেই মনে করতে পারছিনা – একাত্তরের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে জেনারেল অরোরার সৌজন্যে তাঁর বিমানে করে দেশে ফিরি। প্রায় দু’দিন বিমানবন্দরে অপেক্ষা করেও ঢাকাগামী কোনোও বিমানে জায়গা পেলাম না জানতে পারলাম জেনারেল অরোরা ঢাকায় যাচ্ছেন, তাঁকে অনুরোধ জানান মাত্র তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে নিতে রাজি হন। ভারত-বাংলাদেশ মিত্র বাহিনীর অধিনায়কদের সংগে কয়েক ঘন্টা কাটাবার এবং কথা বলার একটি অমূল্য সুযোগ আমার এভাবে দৈবাৎ মিলে গিয়েছিল। মনে পড়ে সিলেটের ভারতীয় ছাউনীতে অফিসারদের সঙ্গে জেনারেল অরোরা তাদের মেসে এক মধ্যাহ্ন ভোজে যোগ দেন। তাঁর মেহমান হিসেবে আমিও এই ভোজে শরিক হই। এই উপলক্ষে আমার কয়েকজন জেনারেল এবং অন্ততঃ এবং একজন এডমিরালের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁদের কিছু কথা এবং ইঙ্গিত আমাকে বিস্মৃত করেছিল। স্মরণযোগ্য যে স্বাধীনতা লাভের আগের মুহূর্তে ‘আল বদর’ পৈশাচিক নিপুনতা ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক ক’জন বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করেছিল। জাতির হৃদয়ে অনেক শোকের মধ্যে এই শোকটি বড় বেশি রকম আঘাত হেনেছিল।
ভারতীয় অফিসারদের কথাবার্তা আমার মনে হয়েছিল – তাদের ধারণা আগেই এই ব্যাপারটি ঘটেনি এবং এ বাঙালিদের গুজব সৃজন কুশলতার আরেকটি প্রমাণ। আমি মরিয়া হয়ে অফিসারবৃন্দকে বলেছিলাম যে দীর্ঘ নিহতের তালিকায় আমার অত্যান্ত ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয় অন্ততঃ চার জন অধ্যাপক ছিলেন এবং আমি নিশ্চিত করে জানি তারা পাকিস্তান পরিচালিত আল বদরের হাতে নৃশংসভাবে প্রাণ হারিয়েছিল।
বিমান ভ্রমণের সময় জেনারেল অরোরার সাথে আমার নানা বিষয়ে আলাপ হয়। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম; মিত্র বাহিনীর সাথে পাকিস্তানের এত দ্রুত পরাজয়ের কারণ কি? জবাবে তিনি তিনটি প্রধান কারনের উল্লেখ করেছিলেনঃ
1) The command structure of the Pakistanis had collapsed.
2) The Mukti Bahini had worked havoc on their communication lines and sapped their morale in a war of attrtition.
3) The Pakistanis were surrounded by a sea of hostility while the allied forces had the spontaneous support of the people of Bangladesh.
(অনুবাদ)
১। পাকিস্তানের কম্যান্ড কাঠামো ভেঙে পড়েছিল।
২। মুক্তিবাহিনী তাঁদের যোগাযোগ ব্যবস্থা এলোমেলো করে দিয়েছিল এবং এভাবেই ধীরে ধীরে তাঁদের মানসিক অবস্থা দুর্বল করে দিয়েছিল।
৩। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের জনগণের নিকট হতে ক্রমাগত অসহযোগিতা পেয়ে আসলেও মিত্রবাহিনী জনতার কাছ থেকে ক্রমাগত সহায়তা পেয়ে আসছিল।
-খান সারওয়ার মুর্শেদ
৯ নভেম্বর, ১৯৮৪