You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানের অভ্যুদয় ও যুব আন্দোলন | মোহাম্মদ তোয়াহা | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭

১৯৪০ সালে লাহের প্রস্তাব পাশ হয়। এই প্রস্তাব উপমহাদেশের সলিম সমাজে নাড়া দিয়েছিল। সে সময় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের ফলশ্রতিতে পাকিস্তানের দাবী উত্থাপিত হলে মুসলমান যুবকদের মধ্যে নতুন জাগরন সুচিত হয়। আমরা একটা আলাদা আবাসভূমি পাব এই ধারণা দানা বেড়ে ওঠে। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে মুসলমান যুবকরা পাকিস্তানের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এ সময় জিন্নাহ আহবান জানিয়েছিলেন এক বছরের জন্য পড়াশোনা ত্যাগ করে পাকিস্তন আন্দোলনে শরীক হতে। আর আমরা তিনবছর পড়াশোনা ত্যাগ করে আন্দলনে শরীক হই। গোড়ার দিকে আকাংখিত পাকিস্তানের পর কি হবে সে সম্পর্কে ‘সুপষ্ট ধারনা গড়ে ওঠেনি। বরং ‘মুসলমানরা নিজ আবাসভূমি পাবে’ এই স্লোলোগানের ভিত্তিতে আন্দোলন হয়েছিল। পাকিস্তানের ধারনা ছিল অসপষ্ট। এই পটভূমিতে, ১৯৪১ সালে হিটলায় যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে তখন জাতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। এই ঘটনা নতুন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধের আহবান জানায় সি পি আই (ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি) এবং তা সমগ্র উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তার করে। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ব্যাপক মুসলিম যুবকদের সঙ্গে সি পি আইর সংযোগ ঘটে। এই সংস্পর্শে আসার ফলে মুসলমান যুবক বিশেষ করে বাংলার, যুবকদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক চেতনা সচিত হয়। (এখানে মনে রাখা প্রয়োজন পাকিস্তান আন্দোলনে বাংলা অগ্রনী ভূমিকা পালন করে যার পরিণতি ১৯৪৬ এ সমগ্র বাংলায় মুসলিম লীগের বিজয়) এই সময়ে মুসলমান যুবকরা পাকিস্তান দাবীকে যুক্তির ভিত্তিতে দাড় করাবার চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে তৎকালীন সি পি আই এর ভূমিকা ছিল। মুসলিম লীগ এ দাবীকে যুক্তির ভিত্তিতে দাঁড় করাতে পারেনি। ১৯৪২ সালে ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী, পি,সি, যোশী প্রমুখ Pakistan and National Unity শীর্ষক প্রস্তাব কমিউনিষ্ট পার্টিতে উত্থাপন করেন। এই প্রস্তাবে এরা পাকিস্তানের দাবীকে যুক্তি সঙ্গত বলে ব্যাখন, করেন। কংগ্রেসের এই দাবী মেনে নেয়া উচিত বলেও তারা অভিমত ব্যক্ত করেন এবং বলেন যে এর ভিত্তিতেই বৃটিশদের বিরুদ্ধ হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। মুসলমান যুবকেরা এই বক্তব্য লফে নেয় । এবং ব্যাপক সংখ্যক মুসলমান যুবক কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোগ দেয়। এর ফলে পরিবর্তন সাধিত হয় মুসলীম লীগ নেতৃত্বে। এ সময়ে ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় মুসলীম লীগের জেনারেল সেক্রেটারী হিসেবে নির্বাচিত হন অাবুজ হাশিম। তার সঙ্গে সি পি আই নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে ভবানী সেনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। পাকিস্তান বীর প্রতি কমিউনিষ্ট পার্টির সমর্থনের ফলে সি পি আই মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। মুসলমান যুবকদের সঙ্গে সি পি আই এর সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে যেখানেই আবদুল হালিম বা মুসলিম লীগ নেতা গেছেন সেখানেই সি পি আই সহযোগিতা করেছেন। আমি ১৯৪৪ সালে দেড়মাস আল হাশিমের সঙ্গে সাংগঠনিক সফর করেছি। এ সফরে যেখানেই গেছি সেখানেই আমাদের মিটিং সংগঠিত করতে সি পি আই সাহায্য করেছে। একই বছর বঙ্গীয় মুসলীম লীগ একটি খসড়া ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। এই খসড়ায় জমিদারী উচ্ছেদ, ভূমি সংস্কার, এবং অন্যান্য প্রগতিশীল কর্মসূচী বাস্তবায়নের প্রস্তাৰ করা হয়। এর ফলে মুসলীম লীগ নেতৃত্বে পরিবর্তন সূচিত হয়। বামপন্থীরা আবুল হাশিমের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। এ কারণে ১৯৪৫ সালে বঙ্গীয় মুসলীম লীগে সভায় গণ্ডগোল হয়, যার ফলে এই খসড়া–ঘোষণাপত্র শেষ পর্যন্ত অনুমোদিত হয়নি। এই মিটিংয়ে মওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে ডানপন্থীয়া খসড়া

ঘোষণাপত্রের বিরোধিতা করে। একে Draft Manifesto নাম দেওয়ায় ফজলুর রহমান এতে কমিউনিস্ট গম্ব আবিষ্কার করেন। অবিশ্যি এজন্যে তাকে নাকাল হতে হয়েছিল।
পরবর্তী পর্যায়ে মুসলীম লীগের, ঢাকা অফিস থেকে আমরা কয়েকজন এই ঘোষণাপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেই। এ সময় আমাদের সহ কর্মীদের অন্যতম ছিলেন শামসুল হক, শামসুদ্দীন আহমেদ, তাজউদ্দিন আহমদ, শওকাত আলী, কামরুদ্দীন আহমদ প্রমুখ। আমরা ঢাকায় মুসলিম লীগের সর্বক্ষনিক কর্মী ছিলাম। এই ঘোষণাপত্র নিয়েই আশা জনগণের কাছে যাই।
১৯৪৪ সাল থেকেই মুসলীম লীগে ডান-বাম বিরোধ দানা বেধে ওঠে। এই বিরোধের সুযোগে কমিউনিষ্ট বিরোধী মতবাদ সৃষ্টির চেষ্টা চলে মুসলীম লীগে। এর আগে উঠে কংগ্রেসে।
১৯৪১ এ নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পর যখন সি পি আই ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধের আহবান দেয়, সেসময় কংগ্রেস উল্টো ভূমিকা গ্রহণ করে। কংগ্রেস ১৯৪২ এর ‘কুইট ইন্ডিয়া’ দাবীর ভিত্তিতে স্বাধীনতার দাবী ছাড়তে চায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথন আন্দোলন মুখর। কমিউনিস্ট পার্টি ‘জনযুদ্ধের খাতিরে’ বৃটিশের যুদ্ধে প্রচেষ্টাকে সমর্ধন করে বসে।
বৃটিশ সরকার ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করে। সুতরাং কংগ্রেসের ভেতর থেকে কমিউনিষ্ট বহিস্কার আন্দোলন শুরু হয়। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার আগে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করতেন। কংগ্রেসের এই ভূমিকার ফলে মুসলীম লীগ থেকেও কমিউনিষ্ট বহিস্কার শুরু হয়।
আমরা তখন সকলেই আবুল হাশিমের নেতৃত্বে সংগঠিত হই। সাংগঠনিক কাজ সুস্থভাবে চালানোর জন্য আবুল হাশিম বিভিন্ন জেলা থেকে একদল কর্মী বাছাই করেন। তিনি এদের সঙ্গে পরামর্শ করেই কাজ করতেন।
আবদুল হাশিমের নেতৃত্বে এই জেনারেশন পাকিস্তানের দাবীকে জনপ্রিয় ও কৃষক শ্রমিকের কাছে গ্রহণ যোগ্য করে তোলে। এ সময় চাপে পড়ে জিনাহও দু’একটি ভালো কথা বলেছিলেন। ১৯৪৪ সালে এক বিদেশী সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জিনাহ বলেছিলেন “যে পাকিস্তানে মানুষ না খেয়ে মরবে সে পাকিস্তান আমি চাই না।” যুবকরা জিম্লাহর এই কথাকে-ব্যাংগকভাবে প্রচার করে।
এই যুবকদের কাজের ধরণ ছিল কমিউনিষ্ট পার্টির মতোই। এক সময় আমরা কমিউন জীবন যাপন করেছি । তখন কমিউনিষ্ট পার্টির সার্বক্ষনিক কর্মীরা পেতেন মাসে ত্রিশ টাকা। আর আমরা, মাসে ৪০ টাকা হিসেবে পেয়ে ‘মিশনারী’ উদ্যম নিয়ে সাৱা দেশে কাজ করেছি।
এখানে একটা কথা আজকে বলা প্রয়োজন। পাকিস্তান দাবীর সাম্প্রদায়িক ভিত্তি থাকলেও আমরা মুসলিম লীগের ব্যাখ্যা মানতাম না। আমাদের দাবী ছিল সমগ্র বাঙলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে বাঙলা গঠিত হবে। এবং আমাদের ধারণা ছিল এটা হবে স্বাধীন রাষ্ট্র । লাহোর প্রস্তাবে ‘এক পাকিস্তানের’ কোন উল্লেখ ছিলনা। এ নিয়েও বিরোধ বাধে। এ সময় আবদুল হালিম একটি তত্ব দাঁড় করান। তার বক্তব্য অনুযায়ী মুসলমানরা একটি জাতি, এ ব্যাখ্যা ভুল। তার বক্তব্য অনুযায়ী উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠান এবং আফগানিস্তানের পাঠান ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মের কারণে এক হলেও এক দেশের অধিবাসী নয়। তাই ধর্মকে একটি জাতীয়তার ভিত্তি হিসেবে মেনে নেয়া যায় না। আমরা এ বক্তব্যের উপর গণ আরোপ করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রগতিশীল মুসলমানরা ব্যর্থ হয়েছে, কেননা ভয় ছিল এ দাবীর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হলে যদি পাকিস্তান ভেস্তে যায়।
আবুল হাশিম এবং মুসলিম লীগের বামপন্থী সদস্যরা পাকিস্তান দাবীকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। এ সাম্প্রদায়িক বিভক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিলো।
বাংলা ভাষাভাষী জাতিস্বত্বার ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র হবে এটা আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের একাংশ উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। যখন কেবিনেট মিশন ভারতবর্ষ ধরে গেল এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ‘বাংলা বিভাগ’ অবশ্যাম্ভাবা হয়ে হয়ে উঠল, তখন বৃহত্তর বাংলার (Greater Bengal) পক্ষে দাবী তোলেন অবুল হাশিম, শরৎ বসু, মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আকরম খান প্রমুখ। এটা বোস—সোহাওয়ার্দী ফর্মুলা নামে পরিচিত। এরা বাংলা ভাগ হোক এটা চাননি। ১৯৪৬-এর নির্বাচন পর যখন সোহরাওয়ার্দী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলেন তখন একটি ভোটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল বঙ্গীয় আইন সভায় হিন্দু ও মুসলমান সদস্য দেশভাগের প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্নভাবে মত প্রকাশ করবেন। সে সময় মুসলমান সদস্যরা বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন এবং কংগ্রেসের প্রভাবে হিন্দু সদস্যরা বাংলা ভাগের পক্ষে রায় গিয়েছিলেন। এই ফলাফলের মধ্য দিয়ে ১৯০৫ সালের উল্টো ঘটনা ঘটলো।
এই পরিস্থিতিতে বোস-সোহরাওয়ার্দী নতুন ফর্মুলা দিলেন বাংলা ভাগ হবে না। এর সাহায্যে বৃহত্তর বাংলার কথাই বলা হয়েছিল। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল যুবকরা এ দাবী সমর্থন করে। পরবর্তী পর্যায়ে যেদিন দেশ ভাগ হলো সেদিন এক অস্বস্তিতে কলকাতার রাত কাটিয়েছি। সারারাত ঘুমোতে পারিনি।
এই ফর্মুলার অন্যতম উদ্যোতা ছিলেন আবুল হাশিম এবং পশ্চিম বাংলা সি পি আই ফরোয়ার্ডব্লক নেতৃত্তের একাংশ। তবে তাদের নাম সামনে আসেনি। মওলানা ভাসানী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বাংলা আসাম সহ স্বাধীন পূর্ব-পাকিস্তান কল্পনা করেছিলেন।
শেষ পর্যন্ত দেশ ভাগ হলো। দেশ ভাগ হওয়ার পর আমরা যুবকরা নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করি। এ উদ্দেশ্যেই ঢাকায় সাতরওজায় ১৯৪৮ সালে আবুল হাসনাতের বাসায় গঠিত হয় গণতান্ত্রিক যুবলীগ। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম আমি এবং শামসুল হক, ফেনীর আজিজ আহমদ, শামসুদ্দীন, রাজশাহীর আতাউর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সায় প্রমুখ। গঠিত হওয়ার পর পরই সরকারী – আক্রমণের শিকার হয় যুবলীগ। কেননা এটা ছিল কমিউনিষ্ট প্রভাবিত সংগঠন।
১৯৪৩ সালে আমি কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোগ দেই। আজকের মতো তখন সদস্যপদ দেওয়া হতো না। একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জনের পর পার্টি সদস্যপদের জন্য দরখাস্ত করতে বলতো।
১৯৪৮ সালে যুবলীগ গঠনের এক বছরের মধ্যেই তা আপনা থেকে অবলুপ্ত হয়ে যায়। কেননা অনেক নেতাই তখন জেলে যুবলীগের কমিউনিষ্ট যুবকরা সবসময় চেষ্টা করতো একে পার্টির সঙ্গে মেলাতে। ধীরে ধীরে তা সি পি আই রাজনীতির প্রভাবান্বিত হয়ে পড়ে। সুতরাং অকনিউনিষ্ট করা তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা হয়ে। এদিকে সরকারী আক্রমণ, অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ মতবিরোধ, (অস্পষ্ট), সংঘাত এসবের কায়ণে সংগঠন অবলুপ্ত হয়ে যায়।
এই সময়ে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন ছাত্র-যুবকদের মধ্যে নতুন জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। ১১৪০-৪৬ মধ্যবর্তী সময়ে বড় সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দেয়া হোকনা কেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যে ১৯৪৮ সালে ভাষার দাবীতে সোচ্চার আন্দোলন গড়ে ওঠে সেটা মূলতঃ ছাত্রদের আন্দোলন ছিল।
কাজেই ভাষা, সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতিস্বত্বায় চেতনা সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিয়ে চাপা দেয়া যায়নি। এ পটভূমিতে, ১৯৫০ সালের শেষ দিক থেকে প্রস্তুতি গ্রহণের পর ১৯৫১ সালে গঠিত হয় পূর্ব-পাকিস্তান যুবলীগ। আমার এই যোগীনগরে বাসায়ই অফিস বলে। অপরদিকে তখন আওয়ামী লীগের অফিস ছিল ১১নং নওয়াবপুরে। যুবলীগই এদেশের প্রগতিশীল যুবকদের প্রথম সংগঠন। যুবলীগের গচীর কর্মসূচীর মধ্যে ছিল ভাষার, গণতান্ত্রিক অধিকার সংস্কারের দাবী। স্বল্প সময়ের মধ্যে যুবলীগ শক্তিশালী ও বৃহৎ সামাজিক সংগঠনে পরিণত হয়।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে যুবলীগের একটা বিরাট অবদান ছিল। এ সময়ে যুবলীগ নেতা হিসেবে আমি, অলি আহাদ, এস এ বারী এ, টি, ফজলুল করিম প্রমুখ জেলে যাই। এ সময়ের যুব আন্দোলনের অবদান হলো :
(১) সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম
(২) কমিউনিষ্ট রাজনীতির আলোকে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা যার ফলশ্রুতি গণনাট্য সংঘ
(৩) প্রগতিশীল সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবীতে সর্বএ আন্দোলন গড়ে তোলা।
১৯৫১ সালে গঠিত যুবলীগ ১৯৫৬ পর্যন্ত অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আমি খাজা আহমদ সহ বেশ কিছু যুবলীগ নেতা প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলাম।
পূর্ব-পাকিস্তান যুবলীগ মূলতঃ তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির একটা শাখা সংগঠন ছিলো। খোকা রায় আমাদের সংগে সাংগঠনিক যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তবে অকমিউনিস্টরাও এর সদস্য ছিলেন।
কমিউনিষ্ট পার্টির সংশোধনবাদী বিচ্যুতির সঙ্গে যুবলীগের অবলুপ্তি ত্বরান্বিত হয়। যার পরিণতি নওয়াবপুরে বাড়ী ভাড়া নিয় এমাদুল্লা প্রতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা। যুবলীগ আন্দোলন ঐ পর্যন্তই শেষ।
পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিটি জেলায় যুবলীগের শাখা সংগঠন ছিলো। যুবলীগের প্রথম কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ছিলেন যথাক্রমে মাহমুদ আলী ও অলী আহাদ। পরবর্তী পর্যায়ে, অবলপ্তি পূর্ব পর্যন্ত যারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন তারা হচ্ছেন যথাক্রমে আমি ও এমাদুল্লাহ (ইনি পরে বসন্তু রেগে মারা যান) এবং যশোরের কামরুজ্জামান ও মোহাম্মদ সুলতান।
১৯৫৬ সালে যুবলীগের উদ্যোগে রংপুরে তিনদিন ব্যাপী বিরাট যুব উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এতে তৎকালীন মন্ত্রীসভার তিনজন সদস্য তিনটি অধিবেশনের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধান অতিথি হিসেবে। এবছরই কমিউনিষ্ট পার্টি থেকে ওলি আহাদ বহিস্কৃত হন। যুবলীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে না পেরে বিদ্রোহ করায় তার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
যুব আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তৎকালীন শান্তি আন্দোলন সম্পর্কেও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর সারা বিশ্বে শান্তি আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই আনবিক বোমার একচেটিয়া মালিকানা। এবং আনবিক মারানাস্ত্রের হুমকির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী শান্তি আন্দোলন গড়ে ওঠে। স্টালিন এই আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা। ১৯৫৪ সালে স্টক হোমে যে শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে জুলিও কুরি, পিকাশে, মেরৃদা প্ৰমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য মওলানা যখন টকহোমে যান, তখনই আমরা জেলে যাই।
১৯৪৩ সালে যখন বিশ্ব যুদ্ধ চলছে তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে সময় দুর্ভিক্ষে ৫০ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। অথচ ইডেন গার্ডেনের গুদাম, গাছতলায় চালের বস্তা বোঝাই করে রাখা হয়েছিল। পানি উঠে আট বস্তা পর্যন্ত চাল নষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধের এই বিভীষিকা সবাইকে আতংকগ্রস্ত করে তোলে। বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী সমাজ যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাই যুদ্ধ পরর্বতী সময়ে শান্তি আন্দোলন জোরদার হয়েছিল।
স্টালিন-যুদ্ধের নেতিবাচক দিকটাকে বড়ো করে দেখেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত সবাই মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সোভিয়েতের পক্ষে আর যুুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। ধ্বংসের কারণেই সোভিয়েতের জন্য শাস্তি প্রয়োজন ছিল।যুদ্ধের মুখে গুড়িয়ে গিয়েছিল পূর্ব ইউরোপ। পূনগঠনের কারণে ন্যায় যুূৃদ্ধের নিন্দা করার অবকাশ ছিল না। আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে চিন্তাও আসেনি। আমরা জেলে যাবায় আগ পর্যন্তই এদেশে শান্তি আন্দোলন এগিয়েছে। তারপর আর এগোয়নি। কেননা এটা ছিল কমিউনিস্টলেয় আন্দোলন। এতে সবাই এ আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু নেহেরু যখন বিবৃতি দিলেন ‘if you want to see the world join the peace movement’ তখন এতে ভাটা আসে। তখন থেকে কমিউনিস্ট পন্থী আন্দোলন হিসেবে এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলে।
বিশ্ব শান্তি পরিষদ সম্পর্কে একটি সুন্দর অভিজ্ঞতা আছে। প্রথমদিকে এর স্বপক্ষে সই সংগ্রহের দায়িত্ব ওলি আহাদের উপর দেয়া হলেও তিনি ব্যর্থ হন। তখন আমি ও উর্দু কবি নারায়ণগঞ্জের ডঃ ইউসুফ হাসান গণসই সংগ্রহের জন্য চকবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে যাই। শান্তির কথা শুনে তারা উৎসাহ প্রকাশ করেন। কিন্তু ৫৪ সালের সেই সম্মেলনের (world peace congress) নাম শুনেই মন্তব্য করেন কংগ্রেস কো সাথ কিউু গিয়্যা।
এদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন করতে গিয়ে কাশ্মীর প্রশ্নে আমাদের মধ্যে নতুন প্রশ্ন দেখা দেয়। ১৯৪৭ সালের একসেশন একট অনুযায়ী কাশ্মীরের ডোগরা মহারাজা ভারতে যোগদানের পক্ষে মত দিলে, কাশ্মীরে মুসলমানদেয় স্বার্থ রক্ষার্থে আজাদ কাশ্মীর, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কশ্মমীর আক্রমণ করে। এই ঘটনার উপর প্রকাশিত সি পি আই দলিলে বলা হয়েছিল—“কাশ্মীরের ভারতে যোগদান করা উচিত, ভারতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন অনেক শক্তিশালী। তাই ভারতে যোগদান করলে কাশ্মীরী জনগণের জাতীয় মুক্তি তরান্বিত হবে।
এই দলিল হাতে পাওয়ার পর এই প্রর্যালোচনার জন্য তৎকালীন মধুর কেনটিনে পার্টির ছাত্র গ্রুপের বৈঠক বসে। সেখানে সবাই এয় বিরোধিতা কৱে বলে এ দলিল সমর্থন করা যাবেনা।
১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পার্টির শক্তি সম্পর্কে আমাদের বিরাট ধারণা ছিল। সামরিক শাসন জারীর পর যখন আত্মগোপন করতে হলে, তখন উপলদ্ধি করতে পারলাম সবই অলীক কল্পনা।
এমনই অবস্থা দাড়াল যে আমাদের থাকার জায়গা নেই, আত্মগোপন করার অবস্থা নেই। একই সন্ধ্যায় থাকার জন্য আমি, মুজাফফর ও হক একই বাড়ীতে উপস্থিত হই। পরদিন সরদার ফজলুল করিম ও শহীদুল্লাহ কায়সারকে জানলা দিয়ে দেখতে পেয়ে ডেকে আনি। সে এক সংকটময় অবস্থা। বাড়ীতে থাকার জায়গা নেই। খোকা রায়কে বলা হল থাকার জায়গা দাও। বললেন দিতে পারবো না। কেননা সারা দেশে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় মিলিয়ে পার্টির সদস্য সংখ্যা মাত্র ৫০০।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের চোখ খুলে গেল। ধীরে ধীরে পর হল পার্টির সংশোধনবাদী লাইনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। দেশভাগ হবার পর ভাষা ভিত্তিক আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটি আমাদের কাছে বড়াে হয়ে দেখা দেয়। তাই ভাষা আন্দোলনে আমরা সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করি।
১৯৫০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত-গ্র্যাণ্ড কনভেনশনের দু-তিন দিন আগে আমি ইনসাফে পাকিস্তান জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নামে স্বনামে একটা লেখা লিখি। এ লেখা বেরোনোর পরই কনভেনশনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দেয়। এক মিটিংয়ে আমি ঘরে ঢুকতে আতাউর রহমান বললেন—আমাদের জেলে ঢোকাবে নাকি? তোমায় লেখায় তো আর পাকিস্তান থেকে না। আমি জবাব হিসেবে দিলী জিন্নাহ-হালিম বিতর্কের কথা ও মুসলিম লীগের সাংগঠনিক প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করি। এসময় কুষ্টিয়ার সামসুদ্দীন আহমদ এসে বললেন- ‘he has written the correct thing’
তবু এ নিয়ে ভীষণ বিতর্ক চলে। পরদিন সমস্ত বই-পস্তুক বগল দাবা করে মিটিংয়ে উপস্থিত হই। আমি লিয়াকত আলীর বই থেকে মূল লাহোর প্রভাব পড়ে শোনাই। সবাই মেনে নিলেন। কিন্তু বললেন, এখন একথা বলা ঠিক নয়। আসলে কেউই লাহোর প্রস্তাকের বাস্তবায়ন সংক্রান্ত অংশটুকু পড়ে দেখেননি। সেখানেই সব কথা বলা ছিল।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.09.09-toaha.pdf” title=”1977.09.09 toaha”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!