পাকিস্তানের অভ্যুদয় ও বিরোধী রাজনীতির সুত্রপাত | আতাউর রহমান খান | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭
আমরা পাকিস্তান চেয়েছিলাম, মুসলমানদের একটা আলাদা বাসভূমি হিসেবে স্বীকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের থেকে সংখ্যালমু মুসলমানরা স্বতন্ত্র বাসভূমি চাওয়া হয়েছিল কেননা একই ভৌগলিক কাঠামোয় মুসলমানরা নিরাপদ বোধ করেনি। হিন্দুদের উস্কানিতে বৃটিশরা মুসলমানদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। এসমস্ত কারণে মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্যই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পরই সন্দেহের সুত্রপাত হয় বাংলাদেশের মুসলমান এবং পশ্চিমের মুসলমানদের মধ্যে একটা আদর্শ গত পার্থক্য ছিল। ওরা মনে করত আমরা ধর্মান্তরিত মুসলমান তাই সাস্কৃতিক ভাবে উন্নত নই। ওরা বলত ‘আমরা চাড়াল থেকে মুসলমান হয়েছি। উপরন্তু এমনভাবে দেশ বিভাগ হয়েছিল, যার ফলে অবস্থাটা অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে। দুই প্রান্তে দুই দেশকে সংযত করা হয়েছিল যেখানে মাঝখানে রয়েছে ‘ বন্ধুনয়’ এমন একটি দেশ। এভাবে একদেশ বলার নজির পৃথিবীর আর কোথাও ছিলনা।
১৯৪০ সালে যে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয় সেখানে স্বায়ত্বশাসিত দুটি রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ ছিল। ১৯৪৬ সালে কায়দা করে স্টেটস-এর বদলে স্টেট করা হয়। কিন্তু তাই বলে ১৯৪৬ সালের ‘আইনসভা সদস্যদের কনভেনশনের এই সংশোধনী ১৯৪০ সালের সর্বভারতীয় মুসলীমলীগের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি। বলা হয়েছিল পাকিস্তানের কাঠামোতেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ৭টি স্বায়ত্বশ্যসিত রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। হিন্দুরা যেভাবে মুসলমানদের ঠকাত সেভাবে এক প্রান্তের লোক অন্যপ্রান্তের লোকদের ঠকানো শুরু করে। ক্ষমতার সবটুকু কেত্বীভূত করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছায় যে, একজন ক্ষুদে ব্যবসায়ীকেও লাইসেন্স পেতে হলে ঢাকা থেকে করাচী যেতে হত। এ অবস্থায় আমাদের ন্যায্য দাবী-দাওয়া পূরণ করা হয়নি। এই অবস্থায় সেদিনের শাসকবর্গ গণপরিষদকে আইনসভায় পরিণত করে আরামের সঙ্গে ক্ষমতায় বসে যান। যে কারণে নির্ধারিত সময়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়নি। পূর্ব-পাকিস্তান বুঝতে পেরেছিল ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের মধ্যে তাদের স্থান নেই। অথচ শাসনতন্ত্র হচ্ছে একটি দেশের কাঠামো। এটা না দেয়ার কারণেই তারা শাসন করতে পেরেছিল। আমি যখন চীফ মিনিষ্টার তখন একজন বিদেশী আমাকে বলেছিলেন—‘টু রান এ কানন্ট্রী উইদাউট এ কনসটিটিউশন ইজ এ ফ্রড’ ।। পাকিস্তানের শুরুতেই ক্ষমতাধররা আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিকভাবে আমাদের শোষণ করা শুরু করে। শতকরা ৮২ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা · ব্যয় করা হত পশ্চিম-পাকিস্তানে এবং শতকরা ১৮ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করা হত পূর্ব-পাকিস্তানে। এ প্রশ্ন উঠলেই বলত “তোমারা রেভিনিউ দেওনা। আসলে বাস্তব অবস্থাটা ছিল ভিন্ন। আমরা আয়কর বা অন্যান্য কর হিসেবে যা জমা দিতাম তার সব কিছুই জমা হতে পশ্চিম-পাকিস্তানের ক্রেডিটে! মশতাক আহমদ গুরমানী বলতেন‘ইয় পে স্মল এমাউন্ট এন্ড উই পে লাজ এমাউন্ট। বাস্তবে আমরাই দিতাম। কিন্তু আমাদের খাতে দেখানো হতো না। যেমন, আদমজীদের পূর্ব-পাকিস্তানে আয়, দেখানো হতো পশ্চিম-পাকিস্তানের। হেড অফিসে। এই সমস্যা নিয়ে আমাদের সঙ্গে ওদের থব লাগত। ধীরে ধীরে তাই তিক্ত সম্পর্কে গড়ে ওঠে। আমি তাই বলতাম—তোমাদের সঙ্গে থাকব না। একদিন একথা বলাতে সোহরাওয়ার্দী ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন—একথা কেন বলেন ? অধিকারের জন্য সংগ্রাম করুন। আমি বলেছিলাম, সংগ্রাম করতে করতে শেষ হয়ে যাব, কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। আমি যখন মূখ্যমন্ত্রী তখন পূর্ববাংলার জন্য বেশী অর্থ আদায়ের চেষ্টা করেছিলাম। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত আমরা একুশ কোটী টাকা পেয়েছিম অথচ নুরুল আমীন সাহেব মাত্র ১২ কোটী টাকা রিচ করতে পেরেছিলেন। এটা আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাড়ায়। এজন্যেই আয়ুব বলতো-‘ইয়, হ্যাভ নো পাওয়ার অফ এবসরপশান। আমি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে দুই বছরে একশ কোটি টাকা ডেকে বললাম, যেভাবেই হোক মার্চ মাসের আগে এ টাকা খরচ করতে হবে। হয় খরচ করবেন, নয় চুরি করবেন। কয়েকদিন পর তিনি এসে বললেন আরো এক কোটি টাকা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে চীফ সেক্টে টারীকে ডেকে বললাম—এক কোটী টাকার জন্য কেন্দ্রের কাছে খবর পাঠান। তিনি বললেন—এসব আমাদের পর্যায়ে হবেনা। আপনাদের পর্যায়ে করতে হৰে স্যার। সঙ্গে সঙ্গে আমার নামে টেলিগ্রাম পাঠাতে বললাম। পরদিন সেক্রেটারী এসে হাসতে হাসতে বললেন, টাকা অন মোদিত হয়ে গেছে। এ সময়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে বলেছিলাম-আমাদের আলাদা হওয়া ছাড়া উপায় নেই। ওদের বোধোদয় হবেনা। বললাম, আমাদের যেকোন পরিকল্পনার পচাত্তর কপি পাঠাতে হয় আর তা ঘোরে পঞ্চাশ হাতে। অনুমোদনের জন্য সময় লাগে তিন চার বছর। বিশটা পরিকল্পনার মধ্যে প্রথম দুটোয় ভুল থাকলে ফেরত পাঠিয়ে দেয় বলে নতুন করে করে দাও। তাই সোহরাওয়ার্দীকে বলেছিলাম এ অবস্থার অবসানের জন্য একদল পরিকল্পনাবিদ আসক পূর্ব-পাকিস্তানে-আমাদের খরচেই তারা থাকবেন কিন্তু পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে যাবেন। সোহরাওয়ার্দী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন তাকে বলেছিলাম, আমাকে টাকা খরচ করতে হবে, না হলে কাইয়ুম খানের মত করব। কাইয়ুম খান সীমান্ত প্রদেশের মখমন্ত্রী হিসেবে নিজ খরচ করতেন—প্রশন ভুললে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিতেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে আমি ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক থেকে ১২ কোটী টাকা কর্জ নেই। অথচ আমার তিন মাসের জন্য অনুমোদিত ব্যয় ছিল মাত্র ২৫ লাখ। এতে সোহরাওয়ার্দী, সাহেব খুব রেগে যান। তখন জাহিদ হোসেন ষ্টেট ব্যাংকের গভর্নর। একদিন আমাকে সোহরাওয়ার্দীর রুমে চার্জ করে বললেন—দিস ইস থেফট অফ পাবলিক মানি। কথা শুনে আমি রেগে যাওয়ায় সোহরাওয়ার্দী সাহেব বললেন ‘ডোন্ট বি উইকেড। ও চুরি অর্থে একথা বলেনি’। আমি পাল্টা বলেছিলাম-আমার মানুষ মরবে অথচ আমি সাহায্য করতে পারব না, এটা হয় না। দরকার হলে পুলিশ দিয়ে নাশনাল ব্যাংকের ভোল্ট ভেঙ্গে আমি সব টাকা নিয়ে নেব।’এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আমার উপস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী সাহেব কেবিনেট মিটিং করে বলে দিলেন, উৎপাদন খাতে আমি পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে ১৫ লাখ টাকা এবং অনুৎ– পাদনীল খাতে পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে ১০ লাখ টাকা খরচ করতে পারব। এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে করাচীতে অসন্তোষ দেখা দিল। সবাই বলতে শুরু করল আমরা আলাদা হয়ে যাব। বলতে শুরু করল বাঙালী সোহরোওয়ার্দী তামাম পয়সা লে যায়গা।”- শাহ ওয়াজেদ আলী বলেই ফেললেন- কেয়া আপলোগ আলীগ হো যায়গা ? এতো গেল প্রশাসনিক বিয়োধিতার কথা। রাজনৈতিকভাবে এনেছে। (ল,ন্দখোয় স্বীকার করতো না যে মুসলীমলীগ পাকিস্তান এনেছে। বলতো বৃটিশের শয়তানী এবং হিন্দুদের বোকামীয় জন্য পাকিস্তান হয়েছে।) আমরা বলতাম, যখন পাঞ্জাবে ইউনিয়নিষ্ট সরকার: জয়লাভ করেছে তথন বাঙলায় জয়লাভ করেছে মুসলীমলীগ পাকিস্তান প্রশ্নে। এত বড় সমর্থন ভারতবর্ষের আর কোথাও লাভ করেনি। সেই পাকিস্তান লাভ করার পর পূর্ব বাঙলায় যখন মুসলীম লীগের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙ্গে গেল তখন মওলানা আকরাম খানকে সংগঠন গড়ার দায়িত্ব দেয়া হলো। মওলানার কাছে যখন সাংগঠনিক বিষয়ে আলাপ করতে গেলাম, বললাম আমরা সদস্য হতে চাই, তখন তিনি বললেন-ভেড়া ছাগল দিয়ে আর অর্গনাইজেশন করব না। মুসলীম লীগ আর অর্গানাইজেশন নেই—এটা এখন পার্টি। পার্টি মানে বোঝ ?—সরকারের বান্দী। সরকার যা করে আমরাও তাই করব। তিনি আরো বললেন ঢাকা শহরে সদস্য সংগ্রহ করার জন্য ১৪০০ রসিদ বই দিয়েছি। ওতেই কাজ হবে। আমি বললাম—এতে কি হবে ? আরো বই দরকার। তিনি বললেন—রসিদ বই ছাপার কাগজ নেই। আমরা রসিদ বই ছাপার কাগজ, অর্থ সব দিতে চাইলাম, কিন্তু তিনি। রাজী হলেন না। বাধ্য হয়ে আমিও আনেয়ারা খাতুন চৌধুরী খালিকুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি তখন মুসলীম লীগের প্রেসিডেন্ট। তিনিও একই কথা বললেন। বললেন—মওলানা আকরাম খান কে ভার দিয়েছি। দেখা যাক মওলানা কি করেন? তাছাড়া আমি তো নামমাত্র প্রেসিডেন্ট, জিন্নাহর কথাই আইন। আমরা জিম্মাহর সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। বললেন-ওতে লাভ হবে না। তখন আর কি করব ? বাধ্য হয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসি। ” তখন আমরা সমানাধিকাৱে দাবীতে লাহোর প্রস্তাবের উল্লেখ করতাম। পাট, চা, চামড়া রফতানী করতাম আমরা। আর সে পয়সা দিয়ে বিলাসদ্রব্য আমদানী করতো ওরা। আমাদের এইসব দাবীকে এগিয়ে নেয় ভাষা আন্দোলন। আট চল্লিশে ভাষা আন্দোলন শুরু হলেও বায়ান্ন সালে তা তীব্রতর হয়ে ওঠে। আটচল্লিশে জিন্নাহ যখন কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ” ভাষণ দিতে গিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বললেন তখন প্রথম উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাল নঈমুদ্দীন। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে। অন্য যাদের নামে একথা চালানো। হয় তাদের কেউ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না-থাকার কথাও নয়। ভাষা আন্দোলনের পর পরই আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবীও জোরদার হয়ে ওঠে। ৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও সে সময়েই আওয়ামী লীগ শক্তি সঞ্চয় করে। সে আওয়ামী লীগ আজকের আওয়ামীলীগ নয়। কিন্তু কি করব? জনগণ এসবের অনেক কিছুই জানেন না। কেননা বার্ণাড শ’ বলেছেন : Politicians suffer from tyraphy of public ignorance.
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.09.09-2.pdf” title=”1977.09.09″]