You dont have javascript enabled! Please enable it!

মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ

বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো নওগাঁতেও স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার পুরোমাত্রায় এসেছিলো। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় শাখাসমূহ তাদের নিজ নিজ কেন্দ্রীয় সংগঠনের নির্দেশ অনুযায়ী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সংগ্রাম ছিলো সত্যিকার অর্থেই জনতার সংগ্রাম। অন্যান্য এলাকার মতো নওগাঁবাসীদের অবদানও এতে কোনো অংশে কম ছিলো না। ২৬শে মার্চের আগেই নওগাঁর বুকেও স্বাধীনতার প্রতীক বাংলাদেশের পতাকা নওগাঁবাসীরা উড়িয়েছিলো।

একাত্তরের ২৫শে মার্চের নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ ঘটনাবলীর খবর টুকরো টুকরো খবর দু’একদিনের ভিতর বিভিন্ন সূত্রে নওগাঁতে এসে পৌছেছিল। অনেকের মত আমারও কোনো সন্দেহ ছিলো না যে ঐ ঘটনা আমাদেরকে এক রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে ঠেলে দিয়েছে।

ঢাকা শত্রু কবলিত হওয়ায় ঢাকার সংবাদপত্রগুলো আর আমাদের ছিলো না। ওগুলো দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর প্রচারপত্রে পরিণত হয়েছিলো। স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে প্রচারণা চালাবার জন্য আমাদেরও পত্রপত্রিকার প্রয়োজন রয়েছে মনে করেই বিভিন্ন প্রতিকুল পরিবেশেও রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমা শহরের হোটেল পট্টির পাশে কাজীপাড়ার ছোট একটি হস্তচালিত প্রেস থেকে ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ ক্ষুদ্রাকৃতি এক পাতার দৈনিক “জয় বাংলা” বের করি। বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতার কণ্ঠে ধ্বনিত “জয় বাংলা” কথাটি আমাদের জাতীয় শ্লোগানে পরিণত হয়েছিলো বলে পত্রিকার নামটিও জয় বাংলা রাখি। মুক্তিযুদ্ধের একটি মুখপত্রের জন্য এর চেয়ে যোগ্য নাম আমার আসেনি।

মুক্তি সংগ্রামের স্বপক্ষে এবং সুনিয়ন্ত্রিত করার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে “জয় বাংলা” লিখা হত। নানা রকম পরিস্থিতিতে জনগণেরকি করণীয় সে সম্পর্কেও মতামত ব্যক্ত করা হত। নিজেদের দোষ ত্রুটি এবং সকল প্রকার অনাচারের প্রতিও জোরালোভাবে পাঠক পাঠিকাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ কার্যবলীর রিপোর্ট সংগ্রহ ও প্রকাশের মাধ্যমে তাদের উৎসাহিত করা হয়েছে। এটা আমার একক প্রচেষ্টা ছিলো। লেখা, রিপোর্ট সংগ্রহ, প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় বিতরণের ব্যবস্থাও আমিই করতাম। সম্পাদকীয় মন্তব্য ও বিভিন্ন রিপোর্ট আমি সাধারণতঃ রাতে এবং খুব ভোরে লিখতাম। তারপর প্রায় সারাদিন ধরে প্রেসে হাত কম্পোজ শেষে প্রুফ দেখে ছাপা হবার পর বিকেলে পত্রিকার বান্ডিল নিয়ে প্রেস থেকে বের হতাম। মুসলিম লীগের সাবেক এমপিএ জনাব কাজী শহ মাহমুদের মালিকানাধীন প্রেসের জন্য যাতে কোন বিপদ না আসে সে কারনে কাজী সাহেবের অনুরোধে পত্রিকায় প্রেসের নাম ছাপা হত না। প্রেসের ম্যানেজার ও কম্পোজিটর যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে কাজ করতো।

২৬শে মার্চ থেকেই আমরা নিজেদেরকে স্বাধীন হিসেবে গণ্য করেছিলাম। তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কোনো সরকার গঠিত না হলেও এক গোপন সরকারের অস্তিত্ব স্বীকার করে সংগ্রাম পরিষদগুলোকে স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রতিনিধি গণ্য করার জন্য “জয় বাংলা” র প্রথম সংখ্যাতেই মত প্রকাশ করা হয়।

যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত অপর কোনো দৈনিক পত্রিকার অস্তিত্বের কথা আমাদের জানা ছিলো না(পরে প্রমাণিত হয়েছে ঐ সময়ে সত্যি সত্যি আর কোনো দৈনিক পত্রিকা ছিলো না। তাই “জয় বাংলা” পত্রিকাতেই স্বাধীন বাংলাদেশের মুখপত্র হিসেবে হিসেবে কয়টি কথা ছাপা হতো।

“জয় বাংলা” প্রথম থেকেই কিছু নীতিমালা অনুসরণ করে চলেছে। কোনো প্রকার স্বার্থান্বেষী মহলের হুমকি এমনকি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতি হুমকিও তোয়াক্কা না করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে নানা প্রকার গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করা এবং সকল প্রকার অনাচারের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

৫ই এপ্রিল রাতে আমি রাইফেল বাহিনীর গোলা বারুদের জীপে চড়ে বগুড়া যাই। বগুড়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও মুক্তাঞ্চল সফর শেষে ৭ই এপ্রিল সন্ধ্যায় নওগাঁ ফিরে আসি। এ কারণে ৬ ও ৭ই এপ্রিল দুদিন “জয় বাংলা” প্রকাশিত হয়নি। ৮ই এপ্রিল বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার এবং বীরত্বপূর্ণ কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে ৮ম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। এ সফরকালে আমি বগুড়ার তৎকালীন ডিসি এবং এসডিও সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ তাদেরকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বগুড়ায় আইন শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানাই।

এ বিশেষ সংখ্যায় হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বগুড়া শহর রক্ষা এবং মুক্তিবাহিনী কতৃক আড়িয়ার বাজারে অবস্থিত পাক সেনাবাহিনীর গোলা বারুদের ডিপো দখলের বিস্তারিত বিবরণ ছাপা হয়। এছাড়া মুক্তাঞ্চলের টেলিফোন এক্সচেঞ্জগলোর কর্মীদের সহায়তায় যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করি এবং বেসামরিক কতৃপক্ষকে শান্তি শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব প্রদানের কথাও লেখা হয়।

“জয় বাংলা” র ১১তম এবং শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১। এ সংখ্যায় যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহের জন্য ‘জবাসস(জয় বাংলা সংবাদ সংস্থা) গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন সূত্রে যেসব খবর পাচ্ছিলাম সেগুলো সেগুলো একটি সংগঠনের মাধ্যমে প্রচার করার উদ্দেশ্যেই এটি আমি গ্রহণ করি। আমাদের নিজস্ব কোনো সংবাদ সংস্থা ছিলো না এবং কেউ সে রকম কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় সীমিত সামর্থ নিয়েই ‘জবাসস’ গঠন করি। মুক্তাঞ্চলের কিছু টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে খবরাখবর সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়। এ কাজে জনাব সেলিম মন্ডল, পাঁচবিবি এক্সচেঞ্জের শ্রী উপেন্দ্রনাথ ঘোষ ও আরও অনেকে বগুড়া সার্কিট হাউজিস্থ মুক্তিযোদ্ধা কন্ট্রো রুমের রিটায়ার্ড সুবেদার দবিরউদ্দিন(ওস্তাদজী) ও হাবিলদার এমদাদুল হক ওরফে তোতাও এ ব্যপারে সহায়তা করেন। এছাড়া রাইফেলস বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডার মেজর নাজমুল হকও এ বিষয়ে সহযোগিতা করেন।

দেশের অন্যান্য সীমান্তের মত নওগাঁ সীমান্তও তখন উন্মুক্ত ছিলো। কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকারও দু’এক কপি সীমান্ত পথে আমাদের হাতে আসতে শুরু করেছিলো। “জয় বাংলা” র ১১তম সংখ্যায় ‘জবাসস’ সংগৃহিত এবং এসব পত্র পত্রিকা থেকে উদ্বৃত হয়ে কিছু সংবাদ ছাপানো হয়। অমৃতবাজার পত্রিকার ৯ই এপ্রিল তারিখের সংবাদে জানতে পারি যে, ২৫শে মার্চের রাতে ঢাকার ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’, ও ‘দ্য পিপল’ এর কার্যালয়গুলো ধ্বংস করা হয়েছে এবং বেশ কিছু সাংবাদিক ও কর্মচারীদের হত্যা করা হয়েছে। আরও জানি ‘দি পাকিস্তান অবজারভার’, ‘দি মর্নিং নিউজ’, ‘দৈনিক পাকিস্তান’, আজাদ’ ও ‘পূর্বদেশ’ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছাপা হচ্ছে। “জয় বাংলা”য় এ খবর উদ্বৃত করে মন্তব্য করা হয়- “পশ্চিমা বর্বরেরা বিশ্বকে ধোঁকা দিবার জন্য উক্ত বিখ্যাত পত্রিকাগুলোর নাম বা Goodwill ব্যবহার করিতেছে।” এই সংখ্যায় জনপ্রিয় সংবাদপত্রগুলোর অফিস ধ্বংস ও সাংবাদিক হত্যার নিন্দা করা হয়।

হানাদারদের আক্রমণের ভয়ে নওগাঁ শহর তখন প্রায় ফাঁকা। কাজীপাড়ায় যে প্রেস থেকে ‘জয় বাংলা’ ছাপা হচ্ছিল তার কর্মচারীদের অনেক বলে-কয়েও নওগাঁ থাকতে রাজী করানো যাচ্ছিলো না। সকলের মনেই ভীতি ছিলো, -এই বুঝি হানাদার এসে পড়লো। অন্যান্য প্রেসও বন্ধ। এ পরিস্থিতিতে ‘জয় বাংলা’ আর ছাপানো সম্ভব হয় নি।

১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের ভিতরে কিংবা বাইরে থেকে ‘স্বাধীন বাংলা’র আর কোনো দৈনিক পত্রিকা ছাপা হয়নি। দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের নাম দিয়ে বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় একাধিক সাপ্তাহিক/পাক্ষিক ইত্যাদি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু একটি দৈনিকও বের হয়নি।

নিজস্ব সীমিত পুঁজির উপর নির্ভর ‘জয় বাংলা’ প্রকাশের কাজে হাত দিয়েছিলাম। কারো কাছ থেকে কোনো আর্থিক সাহায্য নেবার প্রয়োজন হয়নি। প্রেস কতৃপক্ষও কোন লাভ নিতেন না। শুধু কাগজ ও মুদ্রণের খরচ নিতেন। ‘জয় বাংলা’র প্রথম সংখ্যার মূল্য ১০ পয়সা ধার্য হয়েছিলো। এক ঘন্টায় ২০০ কপি বিক্রিও হয়েছিলো। কিন্তু এ সামান্য দাম আদায়ে ঝামেলার কারণে প্রথম সংখ্যার অবশিষ্ট কপি ও দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে শেষ সংখ্যার সকল কপিই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছিলো।

‘জয় বাংলা’র প্রথম সংখ্যাটি ছাপা হয়েছিলো ১০০০ কপি। পরবর্তী সংখ্যাগুলোর কোনোটা ১৫০০ কোনটা ৩০০০ কপিও ছাপা হয়েছিলো। সর্বমোট কপি সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩০,০০০। খুলনা নিউজপ্রিন্টের হাফ ডিমাই সাইজের কাগজে জয় বাংলা ছাপানো হত। প্রথম কয়েক সংখ্য এক পাতার একপাশে এবং অবশিষ্টগুলো পাতার উভয় পাশে ছাপা হতো। ঐ পরিস্থিতিতে ছোট হাতে চালানো প্রেস থেকে এর চেয়ে বড় আকারে পত্রিকা বের করা কোনভাবেই সম্ভব ছিলো না।

‘জয় বাংলা’র প্রথম সংখ্যাটি আমি নিজে আমার স্কুল জীবনের সহপাঠী জাহিদ হোসেনকে সাথে নিয়ে নওগাঁ শহরে বিলি করেছিলাম ৩০শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে। এ পত্রিকা প্রকাশকালে নওগাঁর তৎকালীন এমএনএ জনাব বায়তুল্লাহ(পরবর্তীকালে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার), নওগাঁ, রাজশাহী, ও বগুড়া মুক্তাঞ্চলের তৎকালীন কমান্ডার রাইফেল(ইপিআর) বাহিনীর মেজর নাজমুল হক, বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের আরও অনেকেই উৎসাহ দিয়েছেন এবং সহযোগীতা করেছেন। মেজর হকের অনুমতিক্রমে তার বাহিনীর যানবাহনে নওগাঁর বাইরে ‘জয় বাংলা’র বান্ডিল পাঠানো সম্ভব হয়েছে।

এপ্রিলের মাঝামাঝি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মুক্তাঞ্চল একে একে আমাদের হাতছাড়া হতে থাকে। পাবনা, রাজশাহী, বগুড়া ও অন্যান্য শহরগুলোতে হানাদার বাহিনী ধীরে ধীরে তাদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। আমাদের অসংগঠিত, বিশৃংখল, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণবিহীন এবং উপযুক্ত অস্ত্রবিহীন বাহিনী প্রথম পাল্টা আক্রমণেই পশ্চাদপসরণ করতে এবং নিরুপায় হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও আপৎকালীন জরুরী ব্যবস্থার কোনো পরিকল্পনা না থাকায় কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বও সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। বলা চলে সাময়িকভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং এর ফলে হানাদারদের হামলার মুখে সারাদেশ জুড়ে শুরু হয় মাঠ-ঘাট, বন-বাদার, নদী-নালা, টিলা-পাহাড় পেরিয়ে পরিকল্পনাহীনভাবে সকলের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছোটাছুটি। সীমান্ত নিকটবর্তী শহর নওগাঁতেও এর কোনো ব্যতিক্রম হয় নি।

১৪ এপ্রিল সকালে রাইফেল বাহিনীর গোলাবারুদসহ রাজশাহীগামী দুটি জীপের কনভয়ে রাজশাহী যাত্রা করি। অধিকাংশ রাস্তাই কাঁচা। দুপুরের আগেই নদীর তীরে কালিকাপুরে পৌঁছি। নদীর ওপারে মান্দা। নৌকায় জীপ পারাপারের ব্যবস্থা ছিলো। সেখানেই রাজশাহী এলাকা থেকে জীপযোগে ফিরে আসা নওগাঁর সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি রাজশাহী শহর হাতছাড়া হবার খবর দেন এবং কনভয়ে কয়েকজন সৈন্যকে একটি জীপ নিয়ে ঐ এলাকায় অবস্থানরত ক্যাপ্টেন গিয়াসের সঙ্গে যোগ দেবার নির্দেশ দিয়ে অপরটিকে তার সঙ্গে নওগাঁ ফিরতে বলেন। রাজশাহী যাওয়া সম্ভব না বলে আমাকেও তার জীপে তুলে নেন। দুপুর ২টার দিকে আমরা নওগাঁর বলিহার হাউজে ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ফিরে আসি। জীপে বসে মেজর হককে আমি নওগাঁ ঘাঁটি রক্ষার্থে সম্ভাব্য হামলার রাস্তাসমূহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তার অধীনস্থ সৈন্য এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় প্রতিরক্ষা ব্যূহের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করি। তিনি নিরাসক্তভাবে আমার বক্তব্য শোনেন। রাজশাহী হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তিনি অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং শিগগিরই নওগাঁ আক্রমণের আশংকা করেছিলেন। হাতিয়ারের জন্যও তিনি চিন্তিত ছিলেন। যে কয়েকটা মেশিনগান তার বাহিনীর হাতে ছিলো সেগুলোর ফায়ারিং পিনের অভাব দেখা দিয়েছিলো। হানাদারদের ধারণা তার ছিলো কেননা তিনি মূলতঃ আর্টিলারী কোরের সদস্য ছিলেন কিন্তু রাইফেল বাহিনীর সঙ্গে ডেপুটেশনে যুক্ত ছিলেন। সম্ভবত এসব কারণে আমার মতো যুদ্ধে অনভিজ্ঞ ব্যক্তির প্রস্তাবে তার কোনো ভাবান্তর হয়নি। এরপরে সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সকলের মনেই নানারকম আশংকা। প্রায় ফাঁকা নওগাঁ শহরে বিকেলের মধ্যেই আরো ফাঁকা হয়ে যায়।

বিকেলে মেজর হকের সঙ্গে আবার দেখা করি। তাকে জিজ্ঞাসা করি আমাদের প্রতিবেশী দেশ থেকে কোনো অস্ত্র সাহায্য পাচ্ছেন কিনা। এখনো তো তেমন কিছু পাচ্ছি না। আমি তখন তাকে সীমান্তের ওপারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ করব কিনা জিজ্ঞাসা করি। তিনি চেষ্টা করে দেখতে বলেন। তার সাথে আলোচনায় এবং হেডকোয়ার্টারের তোড়জোড় দেখে বুঝতে বাকী রইলো না যে কোনো মুহুর্তে তিনি ঘাঁটি ত্যাগ করবেন। সন্ধ্যার পর সংগ্রাম পরিষদের অফিসেও আর কাউকে পাওয়া গেলো না। সব যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ‘মুক্তি’ সিনেমার রাস্তার মাথায় টেলিফোন এক্সচেঞ্জটিতে তখনো একজন অপারেটর ছিলেন। সেখান থেকে রাতে বলিহার হাউজের রাইফেল বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে ফোন করে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। এ পরিস্থিতিতে আমি অপারেটরের সহায়তায় পাঁচবিবি, আত্রাই, জয়পুরহাট ও পত্নীতলা পিসিও বগুড়া সার্কিট হাউজে অবস্থিত বগুড়া কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং রাজশাহীর সর্বশেষ পরিস্থিতির খবর দিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেই। নওগাঁর পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেই। পরদিন ১৫ এপ্রিল সকালে হেডকোয়ার্টার শূণ্য থাকার খবর পাওয়া গেলো। আগের রাতেই রাইফেল বাহিনীর হেডকোয়ার্টার অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। শহরও প্রায় শূন্য। প্রেসও বন্ধ। এ পরিস্থিতিতে আমার শহরে থাকা মানে হানাদারদের হাতে পড়ে খামাখা জান দেয়া বিধায় একটি ব্যাগে কাগজপত্র ও একসেট বাড়তি কাপড় নিয়ে আমার বাসা-কাম-‘জয় বাংলা’র দফতরে তালা ঝুলিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। সীমান্ত এলাকায় তখন সুযোগমত লুটপাটের প্রবণতা দেখা দিয়েছিলো। দু এক জায়গায় সন্দেহজনক লোকদের তথাকথিত ‘চেকপোষ্টে আমার পরিচয় দিয়ে দলসহ ১৫ এপ্রিল রাত প্রায় ১১টার দিকে প্রহরাবিহীন নওগাঁ-পশ্চিম দিনাজপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করি। ভারতে এটাই ছিলো আমার প্রথম প্রবেশ।

ভারতে প্রবেশের কিছুদিন পর কোলকাতা প্রেসক্লাবের সেক্রেটারীসহ কয়েকজন সদস্য আমাকে কোলকাতা থেকে ‘জয় বাংলা’ পুনঃপ্রকাশের পরামর্শ দেন। মুক্ত বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ সম্ভব হলে পুনরায় মুক্ত বাংলাদেশ থেকেই প্রকাশিত হবে তাদেরকে আমার এ সিদ্ধান্তের কথা জানাই।

ভারত থেকে পরবর্তীকালে অন্যান্য বাংলাদেশী সাংবাদিকেরা বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক/পাক্ষিক পত্রিকা বের করেছিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১১ই মে ১৯৭১ তারিখে দলীয় মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক জয় বাংলা’ প্রকাশ করেছিলেন। প্রকাশস্থলের নাম দেয়া হয় ‘মুজিবনগর’। কোলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকার ২১/এ বালুহাক্কাক লেনে এ পত্রিকার দফতর ছিলো। কোলকাতাসহ ভারতের পত্রপত্রিকায় ‘দৈনিক জয় বাংলা’র ব্যপক প্রচার হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ কর্তৃপক্ষ তাদের পত্রিকার নাম ‘জয় বাংলা’ রাখেন। এই দলীয় মুখপত্রটির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না। ‘জয় বাংলা সংবাদ সংস্থা'(জবাসস) নামটি অবশ্য আর কেউ ব্যবহার করে নি।

একাত্তরের ১৫ এপ্রিল মধ্যরাতে আমি ভারতের বালুরঘাট শহরে পৌঁছি। এটা পশ্চিম বাংলা রাজ্যের পশ্চিম দিনাজপুর জেলা সদর। পরদিন ১৬ এপ্রিল নওগাঁয় মেজর হকের সঙ্গে ১৪ এপ্রিলের আলোচনা মোতাবেক স্থানীয় এমএলএ শ্রী বীরেশ্বর রায় এবং পশ্চিম দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার কথা জানাই। উভয়েই জানালেন বিষয়টি উচ্চতর কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। আমাদেরকে সক্রিয়ভাবে কোনো সাহায্য দানের ব্যাপারে তারা কিছুই অবগত নন। এরপর ঐ দিনই খবরের কাগজ কিনে বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার’ ও ইংরেজী দৈনিক ‘অমৃত বাজার’ পত্রিকার টেলিগ্রাফ ঠিকানা সংগ্রহ করে বালুরঘাট থেকে ‘জবাসস’ নাম দিয়ে একটি রিপোর্ট পাঠাই। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই কোলকাতা পৌঁছে গেছেন এবং পরদিন ভোরে এক্সপ্রেস বাসে বালুরঘাট থেকে কোলকাতা রওয়ানা হই। কোলকাতায় পৌঁছে পত্রপত্রিকায় মুজিবনগর সরকার গঠনের খবর দেখলাম।

কোলকাতা আগে কখনো যাইনি। কাউকে চিনিও না। স্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ‘যুগান্তর’ পত্রিকার অফিসে গেলাম। সম্পাদক শহরে ছিলেন না। বার্তা সম্পাদক কবি শ্রী দক্ষিণারঞ্জন বসুর ঠিকানা নিয়ে তার বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং তাকে ‘জয় বাংলা’র কপিগুলো দেই। প্রবীণ সাংবাদিক শ্রী বসু সস্নেহে আমাকে গ্রহণ করে সব খবরাখবর নিলেন। তার বাাসায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ঠিকানা সংগ্রহ কোলকাতা বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সঙ্গে যুক্ত প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী তারাশংকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং ‘জয় বাংলা’র কপি উপহার দেই। তিনি সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলেন। এরপর চৌরঙ্গীর কিড স্ট্রীটের স্টেট গেস্ট হাউজে যাই এবং ইনচার্জকে অনুরোধ করে রাতের জন্য একটি রুম পাই।

পরদিন ১৯ এপ্রিল সকালেই বাংলাদেশ মিশনে গিয়ে জনাব হোসেন আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং নওগাঁ এলাকার বিস্তারিত খবর জানাই। তাকে বলি এখনো চেষ্টা করলে নওগাঁ এলাকাটি আমাদের দখলে রাখা সম্ভব। তাকে আরো জানাই সক্রিয় সাহায্য পেলে আমাদের বাহিনী বাংলাদেশের সমগ্র উত্তরাঞ্চল দখলে রাখতে পারে এবং আমাদের সরকারও দেশের অভ্যন্তরে থেকেই কাজ চালাতে পারে। তিনি আমাকে সরকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করার জন্য একটি লিখিত রিপোর্ট দিতে বলেন। আমি তখন মিশনের টাইপিষ্ট দিয়ে দেশে থাকাকালীন মুদ্রিত ‘জবাসস’-এর প্যাডে একটি রিপোর্ট টাইপ করিয়ে দুই কপি জনাব হোসেন আলীকে দেই। জনাব হোসেন আলী এই রিপোর্টটি আমাদের কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দিবেন বলে জানান। আমার কাছে কোনো বৈধ ট্রাভেল ডকুমেন্ট নেই বিধায় আমাকে মিশন থেকে আমাকে একটি পরিচয়পত্র দেয়া হয়। একই দিনে মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারী জনাব আরআই চৌধুরী,প্রেস এ্যাটাসে জনাব মকসুদ আলীর সঙ্গেও পরিচয় হয়। এর ৩/৪ দিন পরে পুনরায় জনাব হোসেন আলীর সঙ্গে মিশনে সাক্ষাৎ হলে তিনি আমাকে জানান ১৯ তারিখের ‘জবাসস’র রিপোর্টটি তিনি আমাদের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে পৌঁছে দিয়েছেন।

১৮ ও ১৯ তারিখ দুদিন ষ্টেট গেষ্ট হাউজে থাকার পর সেখানে অবস্থানরত গণপরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা জনাব অধ্যাপক ইউসুফ আলীর সুপারিশে আমাকে আরো ৭ দিনের জন্য গেষ্ট হাউজে থাকতে দেয়া হয়।

১৯ এপ্রিল কোলকাতার দৈনিক ‘যুগান্তর’ ‘জবাসস’ সম্পর্কিত এবং মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত দেশের বাইরে ‘জবাসস’ প্রচারিত প্রথম সংবাদটি ছাপা হয়। এতে উত্তরাঞ্চলের সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং অবিলম্বে সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। ঐ দিনই ভারতের সর্ববৃহৎ সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর কোলকাতা ব্যুরোর ম্যানেজার শ্রী সুধীর চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করি এবং বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক হিসেবে বিশ্বের লেখক এবং সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত জোরদার করার আহবান জানিয়ে বিবৃতি দেই। পিটিআই তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা বিশ্বে এটি প্রচার করে।

২০ এপ্রিল প্রায় সবগুলো দৈনিকের প্রথম পাতায় এ বিবৃতিটি ছাপা হয়েছে দেখতে পাই। ২১ এপ্রিল পিটিআই-র মাধ্যমে প্রচারিত আরেকটি বিবৃতিতে বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধের জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্ব বিবেকের প্রতি আহবান জানাই। এতে বাঙালি মুসলমান নিধনযজ্ঞে পাকিস্তানী বর্বরদের সাহায্য না করার জন্য আরসিডি জোটভুক্ত ইরান ও তুরস্কের মুসলমান ভাইদের প্রতিও আহবান জানাই। এতে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্যও আবেদন জানানো হয়। এটিও ২২ এপ্রিল দৈনিক পত্রিকাগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। এরপর ভারতের অপর সংবাদ সংস্থা উইএনআই’র কোলকাতা ব্যুরোর ম্যানেজার শ্রী ইউআর কালকুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব সম্পর্কিত আমরা ‘জয় বাংলা’র বিষেশ সংখ্যার রিপোর্টির উদ্ধৃতি দিয়ে ২৫ এপ্রিল উইএনআই দুটি রিপোর্ট প্রচার করে। ২৬ এপ্রিল এ রিপোর্ট বিভিন্ন দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপা হয়।

যুগান্তরের হেডিং ছিলো- ”বীরের এ রক্তস্রোত’।

Statesman-এর “Student Forced Pak Army Column Retreat”।

-( অনুবাদঃ স্টেটসম্যানের শিরোনামঃ ‘ছাত্ররা পাক আর্মি বাহিনীকে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য করেছে)
দিল্লীর Times of India-“Many a Heroic saga from Bangladesh” ইত্যাদি।

-( অনুবাদঃ দিল্লীর টাইমস অব ইন্ডিয়ার শিরোনামঃ ‘বাংলাদেশের অসংখ্য ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা‘)

এর আগে ১৯ শে এপ্রিল আকাশবাণী, কোলকাতায় যোগাযোগ করি। ২১ এপ্রিলের সংবাদ পরিক্রমায় ‘জয় বাংলা’ সম্পর্কে এবং আমার প্রদত্ত বিবৃতিগুলো উল্লেখ করা হয়।

এ সময়ের মধ্যেই কোলকাতার সব প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা যথা- আনন্দবাজার, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, যুগান্তর, অমৃত বাজার পত্রিকা, স্টেটসম্যান, সাপ্তাহিক দেশ, অমৃত ইত্যাদির সাংবাদিকসহ কোলকাতা প্রেসক্লাবের সেক্রেটারী ও সদস্যদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়। এভাবেই ভারতীয় তথা বিশ্ব প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে কোনো প্রকার সরকারী সাহায্য বা আনুকুল্য ছাড়াই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ও অরাজনৈতিক প্রচেষ্টায় ভারতে প্রবেশের এক সপ্তাহের মধ্যেই একটা কার্যকর যোগসূত্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হই।

কোলকাতায় অবস্থানকালে সাংবাদিক ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কোলকাতা সফররত সর্বোদয় নেতা শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গেও ২৮ এপ্রিল সাক্ষাৎ করি এবং আমাদের মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তাকে অবহিত করি। শ্রী নারায়ণ তার এই সফরকালে বাংলাদেশী নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, শ্রী নারায়ণ এবং তার নেতৃত্বাধীন সর্বোদয় ও গান্ধী আদর্শবাদী আন্দোলনের ভারতব্যাপী শত শত প্রতিষ্ঠানের শাখা উপশাখাগুলো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে বেসরকারী পর্যায়ে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছে। শ্রী নারায়ণ ভারতে এবং ভারতের বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন এবং ব্যাপক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন। এ সময় প্রায় প্রতিদিন প্রবীণ সাংবাদিক শ্রী দক্ষিণারঞ্জন বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতাম। তিনি আমাকে বাংলাদেশের একজন তরুণ সাংবাদিক হিসেবে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। একদিন সে তার অফিসের টেবিলের উপর রক্ষিত রাশি রাশি কাগজপত্র দেখিয়ে আমাকে বলল, ” দেখো রহমত, এগুলো যুগান্তর এবং অমৃতের পাঠকদের কাছ থেকে পাওয়া তোমাদের বাংলাদেশের এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতা, গান ইত্যাদি। এবং প্রতিদিনই আসছে। দুচারটি পড়ে দেখলাম। সবই আবেগপূর্ণ ভাষায় লেখা। এ কথা সত্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সকল বাংলা ভাষাভাষি বাঙালির মনকেই আবেগ আপ্লুত করেছিলো।

এপ্রিলের শেষে এক সন্ধ্যায় আবার আমাদের মিশন প্রধান জনাব হোসেন আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। অনেক বিষয়ে আলাপ হলো। তাকে বললাম ভারতের অন্যান্য অঞ্চল বিশেষ করে রাজধানী দিল্লীতে এবং ভারতের অন্যান্য অবাঙালি অধ্যূষিত এলাকায় আমাদের নিজস্ব লোকজন নেই বললেই চলে। আর এসব এলাকাতে আমাদের বিপক্ষে পাকিস্তানীদের অপপ্রচার চলছে। আমি দিল্লী থেকে এসব প্রচারণার পাল্টা জবাব এবং সর্বভারত এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেসরকারীভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার চালাতে চাই। তিনি আমার সঙ্গে একমত হন এবং আমাকে কোলকাতা ও দিল্লী মিশনের সঙ্গে সংযোগ রাখতে বলেন।

দেশ ছাড়ার সময় আমার সঙ্গে যে স্বল্প টাকা ছিলো তা বদলিয়ে ভারতীয় ২৫০ টাকার মতো পেয়েছিলাম। কোলকাতায় ১৯ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ষ্টেট গেষ্ট হাউজে থাকার সুযোগ হয়েছিলো বলে থাকা বাবদ কোনো ব্যয় হয়নি। তবে খাওয়া ও যাতায়াত ব্যয়ে পুঁজি প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো। পশ্চিম বাংলার বিধানসভার অধিবেশনের সময় এগিয়ে আসছিলো বলে ষ্টেট গেষ্ট হাউজ খালি করার সরকারী নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। এ ভবনটি এমএলএ হোষ্টেল হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। এ পরিস্থিতিতে যুগান্তরের সাংবাদিক শ্রী পরেশ সাহা প্রাক্তন ঢাকা জেলাবাসী পূর্ব রেলওয়েতে কর্মরত শ্রী তরুণ গুহের গোবরা অঞ্চলের বাসায় আমার থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিলেন। শ্রী গুহ আমার দিল্লী যাবার টিকিটের বন্দোবস্ত করে দিলেন এবং তার মহল্লার তরুণদের সমিতি ‘আদর্শসংঘ’র সদস্যরা চাঁদা তুলে আমাকে ১০০ টাকা দেন। সাহিত্যিক শ্রী শংকরের সুপারিশে উল্টোরথে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত একটি লেখা দিয়ে আরো ৫০ টাকা পাই। এভাবেই ৪ঠা মে ট্রেনযোগে দিল্লী রওয়ানা হয়ে পরদিন ৫ মে দুপুরে দিল্লী ষ্টেশন থেকে শ্রী গুহের দেয়া ঠিকানায় তার ভাগ্নের বাসায় যাই। সেখান থেকে যুগান্তরের দিল্লী অফিসে এবং তাদের পরামর্শমত পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল শ্রীমতী পদ্মজা নাইডুর নেতৃত্বাধীন দিল্লীর মহিলাদের ‘বাংলাদেশ এ্যাসিসট্যান্স কমিটি’র অফিসে যাই। কমিটির সহায়তায় দিল্লীর জয়সিংহ রোডের ওয়াইএমসিএ ট্যুরিষ্ট হোষ্টেলে এক সপ্তাহের জন্য আমার থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়।

এখানে প্রথমেই দিল্লী, বোম্বাই ও মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত ইংরেজী দৈনিক ও শন্যান্য সাময়িকী কিনে প্রচারণার গতি প্রকৃতি আঁচ করে নেই। আইইএনএস (ইন্ডিয়ান এন্ড ইস্টার্ন নিউজপেপার সোসাইটি) ভবনে অবস্থিত কোলকাতার যুগান্তর ও হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ব্যুরোর কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পারি রাজধানীর পত্র পত্রিকাগুলো আমাদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভুতিশীল তবে প্রভাবশালী হিন্দুস্তান টাইমসের বিশেষ করে চিঠিপত্র কলামে বাংলাদেশ ও শেখ মুজিব বিরোধী বিতর্ক চলছে। কয়েকদিনের পত্রিকা পড়ে আমার সে ধারণাই হয়েছে।

যেমন ৭ তারিখের পত্রিকায় লক্ষ্ণৌ থেকে তিন মুসলমান ভদ্রলোক লিখেনঃ-

“………… the majority of Indian Muslims must not be expected to encourage those who are torch bearers of disruptive tendencies in Pakistan ……..”

-(অনুবাদঃ “…পাকিস্তানে যারা বিধ্বংসী কাজ-কারবার করছে, তাঁদের উৎসাহ দেয়া ভারতীয় মুসলিমদের উচিৎ হবে না…”)

শেখ মুজিবের কার্যকলাপের নিন্দা করে লেখা হয়- “……..the responsibility of the carnage and bloodshed in East Bengal lies entirely on him”

-(অনুবাদঃ “…পূর্ব বাংলায় রক্তপাত এবং গণহত্যার দায়ভার সম্পূর্ন শেখ মুজিবের উপর বর্তায়…”)

এছাড়া আরো অনেক যুক্তি তর্কের অবতারণা করা হয়।

৯ মে’র সংখ্যায় ‘Bangladesh and the Indian press’ (বাংলাদেশ এবং ভারতীয় প্রেস) শিরোনামে প্রকাশিত ৩টি চিঠিতে লেখকেরা ভারতীয় প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গণহত্যার খবর ফলাও করে প্রচারের জন্য ভারতীয় পত্রপত্রিকার নিন্দা করেন। তারা এ প্রচারকে অতিরঞ্জিত, নীতি বহির্ভূত বাড়াবাড়ি, পরোক্ষভাবে খোদ ভারতীয় অখন্ডতারও প্রতিকুল বিধায় ভারতের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী বলে আখ্যয়িত করেন। এসব চিঠিপত্র এ পত্রিকায় পূর্বে প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয় মন্তব্যের সমর্থনে লিখা হয়।

এসব বক্তব্যের বিপক্ষে এবং আমাদের স্বপক্ষে কোনো লেখা ছাপা হচ্ছে না দেখে এ প্রচারণার একটি যথাযথ প্রত্যুত্তর দেবার সিদ্ধান্ত নেই এবং ‘In defense of Mujib’ (শেখ মুজিবের প্রতিরক্ষায়) শীর্ষক একটি দীর্ঘ পত্র লিখে এ পত্রিকার জাদরেল সম্পাদক মিঃ বি জি ভার্গিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। স্বাধীনচেতা এ সাংবাদিক সরকারী মতামতেরও খুব একটা তোয়াক্কা করতেন না। আমি তাকে বলি, ‘আপনাদের পত্রিকায় আমাদের বেশ সমালোচনা করা হচ্ছে কিন্তু আমাদের স্বপক্ষে কিছুই দেখছি না’। এই বলে ব্রীফকেস খুলে আমার টাইপ করা চিঠিটা তার হাতে দেই। তিনি মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়েন। আমি চিঠিটা শেষ করেছিলাম ‘জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা’ দিয়ে। তিনি বলেন, ‘এ দুটি বাক্য বাদ দিতে হবে, এগুলো শ্লোগান’। আমি বলি প্রথমটি বাদ দিতে পারেন তবে দ্বিতীয়টি রাখতে হবে কারন ‘জয় বাংলা’ আমাদের জাতীয় শ্লোগান। তিনি আমাকে প্রথম শ্লোগানটা বাদে বাকী চিঠিটা হুবহু ছেপে দিবেন বলে জানান।

মিঃ ভার্গিজের কাছে যুক্তি সহকারে আমাদের সংগ্রামের কারণগুলোও ব্যাখ্যা করি। এরপরে তার পত্রিকার কলামে বাংলাদেশবিরোধী বিতর্ক বন্ধ হয়ে যায়। ১০ মে আমার চিঠিটা ছাপা হয়। ১৩ মে আমাদের সমর্থন এবং পাকিস্থানপন্থীদের নিন্দা করে একসাথে ৫ টি চিঠি ছাপা হয় এবং ১৫ মে লক্ষ্ণৌর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হাবিবুল্লাহ এবং দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের প্রফেসর কে এ ফারুকীর পাকিস্তানীদের নিন্দা এবং আমাদের আন্দোলন ও নেতাকে সমর্থন করে লিখিত ২টি চিঠি প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রভাবশালী হিন্দুস্তান টাইমসের পাতায় পাকিস্থানপন্থীদের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার প্রচেষ্টার শোচনীয় পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রফেসর ফারুকী পাকিস্তানী বাহিনীকে তৈমুর, চেংগীস ও হালাকু খানের মতো বর্বর বলে আখ্যায়িত করেন।

একই সময়ে দিল্লীর প্রধান সংবাদপত্রের সম্পাদক ও অন্যান্য সাংবাদিক এবং সংবাদ সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করি। ১০ মে ইউএনআই দিল্লী থেকে আমার রাজধানীতে অবস্থান এবং কাজকর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে তিন প্যারার একটি সংবাদ প্রচার করে। এছাড়া আকাশবাণীর(অল ইন্ডিয়া রেডিও) কেন্দ্রীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করি। আকাশবাণীর মহাপরিচালক শ্রী এ কে সেনের পরামর্শ অনুযায়ী আকাশবাণীর বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের, বিশেষ করে উর্দু সার্ভিসের জন্য আমাদের মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে কতগুলো কথিকা রচনা করি। একটি সিরিজ হিসেবে প্রচারের জন্য তিনভাগে এগুলো লিখি। মূল শিরোনাম ছিলো ‘Recent event in Bangladesh’ (পাকিস্তানে সাম্প্রতিক ঘটবাবলী)। উপ-শিরোনাম ছিলো ‘Historical Background (ঐতিহাসিক পটভূমি)। ১৯৪৭ সালের আযাদী থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ঘটনার ভাবাবেগবর্জিত সংক্ষিপ্ত তথ্যমূলক বিশ্লেষণ; Election in Pakistan and Aftermath (নির্বাচনের ফলাফল, অসহযোগ আন্দোলন ও স্বাধীনতার ঘোষণার প্রেক্ষাপট) এবং শেষেরটি Genocide in Bangladesh (২৫ মার্চের পরের গণহত্যার বিবরণ এবং পাকিস্তানের মিথ্যা প্রচারণার জবাব)। ইংরেজীতে লেখা এ কথিকাগুলো উর্দুতে অনুবাদ করে আকাশবাণী দিল্লী কেন্দ্রের বহিবিশ্ব উর্দু সার্ভিসের বিশেষ অনুষ্ঠানে ১৯৭১ সালের ২, ৪ ও ৮ জুন প্রথম প্রচারিত হয় এবং পরে পুনঃপ্রচারিত হয়। প্রতিটি কথিকার জন্য ১০ মিনিটের বেতার সময় বরাদ্দ ছিলো। এছাড়া আকাশবাণী দিল্লীর ‘হামারে মেহমান’ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের উপর আমার একটি ১০ মিনিটের টিভি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয় ১৪ মে। এটি উর্দুতে গৃহীত হয় এবং ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দুতে আমার বক্তব্য পেশ করি। একই দিন দিল্লী টেলিভিষন তাদের ‘আজকাল’ অনুষ্ঠানে আমার একটি ১০ মিনিটের টিভি সাক্ষাৎকার প্রচার করে। মুক্তিযুদ্ধের উপর এ সাক্ষাৎকারে একই সাথে দিল্লী সফররত আওয়ামী লীগের ধর্মীয় ফ্রন্ট আওয়ামী ওলামা লীগের সভাপতি জনাব খায়রুল ইসলাম যশোরীর সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হয়। শ্রোতাদের সুবিধার্থে এটি হিন্দিতে গৃহীত হয় এবং আমরা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে শ্রোতাদের বোধগম্যভাবে আমাদের বক্তব্য পেশ করি। মাওলানা যশোরী তখন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ভারতীয় ওলামাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এছাড়া তরুনদের জন্য সর্বভারতীয় অনুষ্ঠান যুব বাণীতেও আমার আরেকটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। আকাশবাণীতে প্রচারিত কথিকাগুলো উর্দু অনুবাদ সাংবাদিক জনাব নজমুল হাসান কয়েকটি উর্দু পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন।

মে এবং জুন এই দুই মাসে দিল্লীস্থ প্রচারমাধ্যমগুলোর সহায়তায় ব্যাপক প্রচার চালাই। আকাশবাণীতে প্রচারিত কথিকাগুলোর মূল ইংরেজীতে স্ক্রীপ্ট সাইক্লোস্টাইল করে ‘জবাসস’ এর External Bureau (বহিঃদপ্তর) নাম দিয়ে দিল্লী, বোম্বাই, মাদ্রাজ ও অন্যান্য এলাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের পত্র পত্রিকার ঠিকানায় ডাকযোগে পাঠাই। দিল্লীর অনেক প্রবীণ সাংবাদিক বন্ধু আমাকে হেসে জিজ্ঞেস করতেন, “রহমত, আপনার ‘জবাসস’র External Bureau (বহিঃদপ্তর)-টা কোথায়?” আমিও হেসে জবাব দিতাম, “আমাদের সব কিছুই এখন চলমান, আজ এখানে কাল ওখানে। আমার হাতের ব্রীফকেসটাই আপাততঃ ‘জবাসস’ এর চলমান ব্যুরো”।

দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুনদের একটি মুখপত্র AEON (কাল) এর সম্পাদক তাদের বাংলাদেশ সংখ্যার জন্য আমার একটি লেখা নেন। এ সময়েই দিল্লীতে যাত্রাবিরতীকালে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেষ্ট হাউজে অবস্থানরত ডঃ এ আর মল্লিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি।

দিল্লী যাবার পূর্বে কোলকাতা থেকে একজন উত্তর কোরীয় সাংবাদিককে সাথে নিয়ে বনগাঁও এলাকার শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে ক্যাম্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছিলাম। কয়েকটি ছবিও নিয়েছিলাম। এর উপরে ভিত্তি করে “UN must rush to the rescue of victims” (জাতিসংঘের অতিসত্বর আক্রান্তদের উদ্ধারে এগিয়ে আসা উচিৎ) নামে একটি সচিত্র রিপোর্ট তৈরী করি। বোম্বাই থেকে প্রকাশিত ইংরেজী, উর্দু, হিন্দি, মলয়ালম ইত্যাদি ভাষায় মুদ্রিত BLITZ (ব্লিটজ)-এর ১৫ মে এটি প্রকাশিত হয়।

“জবাসস এর External bureau’ (বহিঃদপ্তর)-এর নামে কিছু বাংলা দেশাত্মবোধক কবিতার ইংরেজী অনুবাদ সাইক্লোস্টাইল করেও প্রচার করা হয়েছিলো। এ সম্পর্কিত কিছু রিপোর্ট কোলকাতার অমৃত ও দেশ পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিলো। দেশ পত্রিকার নিয়মিত ফিচার ‘ঘরোয়া’র লেখক ‘শ্রীমতি'(শ্রীমতি সুজয়া সেন)-এর সঙ্গেও দিল্লীতে আমার পরিচয় হয়েছিলো। মাতৃসমা এ মহিলার স্নেহ আমার অনেকদিন মনে থাকবে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি তার অকৃত্রিম দরদ ছিলো। জওয়াহরলাল নেহেরু প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ন্যাশনাল হেরাল্ডের সম্পাদকীয় পাতায় ‘জবাসস’ প্রচারিত “Bengaless are not cowards” (বাঙালিরা কাপুরুষ নয়) নামক একটি কবিতাও ছাপা হয় ১৩ মে।

এছাড়া ব্যাঙ্গালোর ও হুবলী থেকে একযোগে প্রকাশিত ঐ এলাকার কানাডা ভাষার Samyukta karnataka group of papers (সমুক্ত কর্ণাটক গ্রুপ অব পেপারস) মে’র শেষে আমর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। দিল্লীর কয়েকজন মুসলমান সাংবাদিক বন্ধু কিছু উর্দু পত্র-পত্রিকাতেও আমার লেখার অনুবাদ পড়েছেন বলে আমাকে জানান। মোট কথা আমার সীমিত প্রচেষ্টায় এই অল্প সময়ের মধ্যেই যতটা সম্ভব প্রচারকার্য চালিয়েছিলাম এবং দিল্লীর সাংবাদিক মহলে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। এ সময়ে শ্রী ফণী মজুমদারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি সংসদীয় দল দিল্লী সফরে আসেন। বেগম নুরজাহান মুর্শেদও এ দলে ছিলেন। দিল্লী প্রেসক্লাব তাদের একটি সম্বর্ধনার আয়োজন করে। শ্রী মজুমদার ও বেগম মজুমদার এ সভায় বক্তৃতা দেন। আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম।

জয়সিংহ রোডের ট্যুরিষ্ট হোষ্টেল থেকে সাংবাদিক বন্ধু শ্রী যতীন্দ্র ভাটনগরের বাসায় কিছুদিন থাকি। এরপরে বাকী সময় দিল্লীস্থ শান্তি পরিষদের আন্তর্জাতিক হোষ্টেলে তাদের মেহমান হিসেবে থাকি। কথিকা ও সাক্ষাৎকারের জন্য আকাশবাণী ও টেলিভিশন এবং অন্যান্য পত্রিকা থেকে দু একটি লেখার জন্য প্রাপ্ত সম্মানীর টাকায় আমার খরচ চলে যায়। থাকার জন্য কোনো খরচ হয়নি। খাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে কিছু খরচ হয়েছে। যাতায়াত, পত্র পত্রিকা কেনা এবং ডাক খরচ সম্মানীর টাকা থেকে চালানো সম্ভব হয়েছিলো।

গান্ধী শান্তি পরিষদের হোষ্টেলে অবস্থানকালে বেনারসের গান্ধীয়ান ইনস্টিটিউট অব ষ্টাডিজ-এর যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক শ্রী সুগত দাশ গুপ্তের সঙ্গে পরিচয় হয়। সর্বোদয় নেতা শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ এ প্রতিষ্ঠানের অবৈতনিক পরিচালক ছিলেন। অধ্যাপক দাশগুপ্ত আমাকে তাদের ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কার্যক্রমে অংশ নেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমি সময়মত যোগাযোগ করার প্রতিশ্রুতি দেই। এ হোষ্টেলে অবস্থানকালে ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপকের সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়। তাদেরকেও মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কাগজপত্র দেই। এছাড়া অল ইন্ডিয়া পঞ্চায়েত পরিষদের সেক্রেটারী শ্রী জি এল পুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তার পরিষদও আমাদের সংগ্রাম সমর্থন করেছিল।

দিল্লীতে অবস্থানকালে আমাদের কুটনৈতিক প্রতিনিধি পাকিস্তান হাই কমিশনের দলত্যাগী সাবেক দ্বিতীয় সচিব জনাব কে এম শাহাবুদ্দিনের সঙ্গেও আমি যোগাযোগ রক্ষা করেছি। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে খবর প্রচারিত হয়, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে নতুন সমরাস্রের চালান পাঠাচ্ছে। বাংাদেশের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থবিরোধী এ আক্রমণের প্রতিবাদ করা হয়। দিল্লীতে ঐ সময়ে মাত্র কয়েকজন খাস বাঙালি ছিলাম। সে কারণে অন্যান্য বাঙালি ও অবাঙালি সমর্থকদের সহায়তায় ২৫ জুন ১৯৭১ সালে মার্কিন দূতাবাসের সামনে এক বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করা হয়। দিল্লীর সাংবাদিক বন্ধুদের সহায়তায় দেশী বিদেশী সংবাদ সংস্থা এবং টেলিভিশন প্রতিনিধিদের দ্বারা এ মিছিলের খবর বিশ্বব্যাপী প্রচারের ব্যবস্থা হয়। দূতাবাসের গেটে রাষ্ট্রদূতের প্রতিনিধির কাছে জনাব শাহাবুদ্দিন প্রতিবাদলিপি অর্পণ করেন। ভারতের সকল প্রধান প্রধান দৈনিকে এ বিক্ষোভের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিলো।

দিল্লীতে আমার কাজ কর্মের বিস্তারিত রিপোর্ট কোলকাতা মিশনে জনাব হোসেন আলীর কাছে পাঠাতাম। জুনের শেষে দিল্লী থেকে কোলকাতা ফিরে এসে জনাব হোসেন আলী, প্রেস এ্যাটাশে জনাব মকসুদ আলী ও অন্যান্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। কোলকাতা ফেরার পর আকাশবাণীর কোলকাতা কেন্দ্র থেকে ৩রা জুলাই “জানেন ওদের মতলবটা কি” শীর্ষক আমার একটি ১০ মিনিটের কথিকা পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয় এবং পরে পুনঃপ্রচারিত হয়। এতে আমি বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত বাঙালিদেরকে জাতিগতভাবে পঙ্গু করার পাকিস্তানী চক্রান্ত সম্পর্কে শ্রোতাদের অবহিত করে হুশিয়ার থাকবার অনুরোধ জানাই। এর পরে আমি যশোর সীমান্ত এলাকায় যাই এবং নানা প্রকার খবরাখবর সংগ্রহ করি। এছাড়া নওগাঁ এলাকার লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বালুরঘাটে যাই। সেখানে নওগাঁর এমএসএ জনাব বায়তুল্লাহ ও অন্যান্যরা ছিলেন। ঐ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের অন্যতম সংগঠক নওগাঁর এমএ জলিলের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় স্থাপিত কয়েকটি ক্যাম্প ঘুরে দেখি এবং খবরাখবর সংগ্রহ করি।

কোলকাতায় অবস্থানকালে আমি গান্ধী শান্তি পরিষদের কোলকাতা কেন্দ্রের আতিথ্য লাভ করি। এ প্রতিষ্ঠানও সীমান্ত এলাকার শরণার্থী শিবিরগুলোতে ‘অক্সফাম’-এর সহযোগীতায় নানা রকম ত্রাণ তৎপরতার ব্যাপকতা সম্পর্কে তার কাছেই একটি ভাল ধারণা পাই।

জুলাইয়ের শেষে উত্তর ভারতের বেনারস শহরে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বাধীন গান্ধীবাদী শিক্ষা ইন্সটিটিউট-এর বাংলাদেশ বিষয়ক কাজকর্মে যোগ দেবার জন্য দিল্লীতে থাকাকালীন যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক দাশগুপ্তের আমন্ত্রণ অনুযায়ী বেনারস যাই। কনসালট্যান্ট অন বাংলাদেশ এ্যাফেয়ার্স হিসেবে প্রাথমিকভাবে তিন মাসের জন্য ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুগক্ত থাকি। আমাকে ৫০০ টাকা সম্মানী দেয়া হয়। এ ফেলোশীপটি তিন মাস পর আবার এক বৎসরের জন্য বাড়ানো হয়েছিলো তবে এর দুমাস পর দেশে ফিরে আসি। ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক পরিচালক ও সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগে ১৮ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর তিন দিনব্যাপী দিল্লীতে ‘বাংলাদেশ নিয়ে বৈশ্বিক সম্মেলন’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ সমর্থক প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিরা যোগ দেন। এ কনফারেন্স ব্যবহারের জন্য নানা রকম ওয়ার্কিং পেপার ইনস্টিটিউট থেকে তৈরী করা হয়। আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্ব পত্র পত্রিকার রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ‘Genocide in Bangladesh’, ‘Bangladesh in world press’ (বাংলাদেশে গণহত্যা এবং বিশ্ব পত্রিকায় বাংলাদেশ) শিরোনামে দু’টি পুস্তিকা প্রস্তুত করি এবং অন্যান্য ওয়ার্কিং পেপার তৈরীতেও অন্যদের সাহায্য করি। এ পুস্তিকা দুটি এবং ওয়ার্কিং পেপারগুলো ঐ কনফারেন্সে বিতরণ করা হয়।

আগষ্ট মাসে খবর বের হয় যে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের বিচার করবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিবেকবান ব্যক্তিরা এর প্রতিবাদ করেন। ভারতের বিভিন্ন জায়গাতেও প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। উত্তর ভারতের বেনারসেওইনস্টিটিউটের যুগ্ম পরিচালক শ্রী সুগত দাশ গুপ্তের নেতৃত্তে বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্যদের প্রায় এক মাইল দীর্ঘ এক প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। আমিও এতে যোগ দেই। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির অনেক ছাত্রও এতে অংশ নেন।

সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে বেনারসে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়। এই সাক্ষাৎকালে শ্রী নারায়ণ আমাকে বলেল, ভারতের অবাঙালি অধ্যুষিত অনেক এলাকাতেই পাকিস্তানপন্থীরা আপনাদের বিরুদ্ধে ২৫ মার্চের আগেই বাংলাদেশে ব্যাপক হারে বিহারী নিধনের অভিযোগ করে প্রচার চালাচ্ছে। বিভিন্ন সভা সমিতিতে আপনাদের পক্ষে বক্তব্য রাখার সময় আমাকেও মাঝে মাঝে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, এ অভিযোগ কতটা সত্যি? আমি তাকে জানাই ২৫ মার্চের আগে বাঙালিরা এ ধরনের কাজ ব্যাপক হারে করেছে এ অভিযোগ সত্যি নয়। দু এক জায়গায় এ ধরনের ছোটখাটো ঘটনা অবশ্য ঘটেছে তাতে উভয় পক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে এটাকে ব্যাপক বিহারী হত্যা কোনো মতেই বলা চলে না। কোনো কোনো এলাকায় বাঙালিরাই বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ২৫ মার্চে পাকিস্তানী গণহত্যা শুরুর পরে আমাদের দখলাধীন কিছু কিছু জায়গায় কিছু বাড়াবাড়ি হয়েছে সেটা সত্য। আর তার জন্য দায়ী হানাদারেরা এবং তাদের সহযোগী বিহারীরা। এর উত্তরে তিনি বলেন ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঘটনা সম্পর্কে আমি আমি আপনার কাছ থেকে নিশ্চিত হলাম। ২৫ মার্চের ঘটনার পরের দায়-দায়িত্ব তো পাকিস্তানীদের। যদিও পাকিস্তান সরকার তাদের শ্বেতপত্রে আমাদের ঘাড়েই দোষ চাপিয়েছে। এরপরে তিনি আমাদের ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঢকা, পশ্চিম পাকিস্তান এবং কিছু নামকরা বিদেশী পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতে এ অভিযোগ খন্ডন করে ব্যাপক প্রচারের জন্য একটি রিপোর্ট তৈরী করার চেষ্টা করতে বললেন। তিনি বলেন, এ রিপোর্ট ভাবাবেগবর্জিত এবং নিরপেক্ষ হতে হবে। এ আলোচনার পরদিন ২৪ সেপ্টেম্বর বিদেশী পত্রিকার ঐ সময়ের কপি খোজার জন্য দ্বিতীয়বার দিল্লী যাই। আমার রিপোর্ট প্রণয়নের জন্য আমি দিল্লীর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ লাইব্রেরী, বৃটিশ হাই কমিশন লাইব্রেরী এবং ইউএস আইএস লাইব্রেরীতে ঢাকা, পিন্ডি, প্যারিস, লন্ডন ও নিউ ইয়র্কের প্রধান প্রধান পত্রিকাসমূহ অনুসন্ধান করি।

এসব পত্রিকার রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ‘Pakistan propaganda-is based on facts?’ (পাকিস্তানি প্রচার-আসলেই কি সত্যের উপর ভিত্তি করে প্রচারিত?) নামে একটি তথ্যমূলক পুস্তিকা রচনা করি। এতে পাকিস্তান সরকারের ‘শ্বেতপত্রে’ বিহারী নিধনেত অভিযোগও খন্ডন করা হয়। আমাদের কোলকাতা মিশনও আমার এ কাজে আগ্রহ দেখান এবং এ রিপোর্টের কপি পাঠানোর অনুরোধ করেন। আমি যথাসময়ে তা পাঠাই। ইনস্টিটিউট থেকে মুদ্রন করে এ রিপোর্টি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। আমিও ডাকযোগে বিভিন্ন সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে এটি পাঠাই।

নভেম্বর মাসে পুনরায় কোলকাতা আসি। এ সময়ে জানতে পারি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী কোলকাতায় অবস্থান করছেন। আমি মিশন থেকে ঠিকানা নিয়ে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র স্ট্রীটের হোটেল পূর্বরাগে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। অনেক আলোচনা হয়। তিনি তখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের রূপরেখা প্রণয়নে ব্যস্ত ছিলেন।

ইতিমধ্যেই ভারত সরকারের সক্রিয় সহযোগীতায় মুক্তিযুদ্ধের তৎপরতা অনেক বৃদ্ধি পায়। এবারে কোলকাতা থেকে শিলিগুড়ি হয়ে মেঘালয় সীমান্ত পথে দেশেত অভ্যন্তরে ঢোকার প্রস্তুতি নিয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাই। ততদিনে সীমান্ত এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে শিলিগুড়ি থেকে ফের কোলকাতা ফিরে আসি। সীমান্তে জোরেশোরে লড়াই চলছে শুনে নভেম্বরের শেষে কোলকাতা ছেড়ে নওগাঁ সীমান্ত নিকটবর্তী ভারতীয় শহর বালুরঘাট রওয়ানা হই। কিন্তু বালুরঘাটে তখন পাকিস্তানী শেলিং-এর কারনে শহর প্রায় ফাকা হয়ে গিয়েছিলো বলে মালদা থেকে পুনরায় কোলকাতা ফিরে আসি। খবর পাই ভারতীয় নিয়মিত বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একযোগে লড়াই চালাচ্ছে এবং বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর পরে ঘটনার দ্রুত পট পরিবর্তন হতে থাকে। ৪ঠা ডিসেম্বর ভারত পাকিস্তান প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হয়। এ পরিস্থিতিতে গান্ধীয়ান ইনস্টিটিউট অব স্টাডিজের সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বেনারসে যাই। সেখান থেকে শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য পাটনা যাই ১১ ডিসেম্বর। শ্রী নারায়ণের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ১৩ ডিসেম্বর কোলকাতা পৌঁছি। শত্রুমুক্ত হওয়ার আশা করা হচ্ছিলো। কোলকাতায় সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ভোর পাঁচটায় এক্সপ্রেস বাসযোগে নওগাঁ সীমান্তের নিকটবর্তী বালুরঘাট রওয়ানা হই। বিকেলে বাসে বসেই রেডিওতে ঢাকায় পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর শুনি। ১৬ থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বালুরঘাট শহরে থাকি। বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার রাস্তাঘাটে পাকিস্তানী মাইন পোঁতা ছিলো এবং ভারতীয় বাহিনী মাইন অপসারনের কাজ চালাচ্ছিলো। ২২ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর জীপে বালুরঘাট ছেড়ে নওগাঁ ফিরে আসি।

-মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ
সম্পাদক, দৈনিক জয়বাংলা, নওগাঁ
জুন, ১৯৮৪

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!