You dont have javascript enabled! Please enable it!

মোহাম্মদ বয়তুল্লাহ

স্বাধীনতার পর প্রথম যেই কাজটা দরকার, তা হলো সংবিধান প্রণয়ন। এর জন্য যেই কমিটি গঠন করা হয়, তাকে গণপরিষদ বলে। আমাদের স্বাধীনতার পর, মাত্র ৮ মাসে যেই চমৎকার সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল, সেই গঠনতন্ত্র কমিটিতে অর্থাৎ গণপরিষদের একজন সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ বয়তুল্লাহ।

নওগাঁ ৭ উইং ই,পি,আর হেডকোয়ার্টারে ২৫শে মার্চের পূর্ব হতে ক্যাপ্টেন ও মেজর পর্যায়ের পাঞ্জাবী অফিসারবৃন্দের উপস্থিতির কারনে সংগ্রামের শুরুতে কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মার্চের শেষ ভাগে মেজর নাজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন বদলী হয়ে নওগাঁ আসেন এবং তাঁরা উভয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। তাঁরা প্রথমেই উপরোক্ত পাঞ্জাবী মেজর, ক্যাপ্টেন ও তৎকালীন নওগাঁর পাঞ্জাবী এস,ডি,ও-কে গ্রেফতার করেন। এ সময় আমি নওগাঁ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলাম। আমার সক্রিয় সহযোগিতায় কয়েকদিনের মধ্যেই নওগাঁর বিভিন্ন ই,পি,আর ক্যাম্পের পাঞ্জাবী ও পাঠান সিপাহীদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। এবং এর ফলে সমগ্র নওগাঁ শত্রুমুক্ত হয়।

আমার নেতৃত্বে এবং মেজর নাজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিনের পুর্ণ সহযোগিতায় বহুসংখ্যক যুবকদের সামরিক শিক্ষা দানের জন্য নওগাঁ কে,ডি স্কুল ও ডিগ্রি কলেজ প্রশিক্ষন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ঐ সময় বগুড়ায় পাক-বাহিনীর গুরুত্বপুর্ণ অর্থসম্ভার (Arms Ammunition dump) ছিল। রংপুর দিনাজপুর থেকে পাক বাহিনী উক্ত অস্ত্রশস্ত্র দখল করার জন্য বগুড়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকলে ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিনের নেতৃত্বে কিছুসংখ্যক ই,পি,আর ও কিছুসংখ্যক নতুন শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবককে নিয়ে বগুড়ার উত্তর ধারে খান সেনাদের অগ্রগতি রোধ করা হয়। তার কিছুসংখ্যক সৈন্য মারা গেলে তারা পশ্চাদপসরণ করে। এই যুদ্ধে নওগাঁর ১৪ বছর বয়স্ক বাবলু নামক এক তরুন যোদ্ধা প্রথম শহীদ হন। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে ঐ সময় বগুড়া থেকে বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। ইতিমধ্যে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এইসব তরুন মুক্তিযোদ্ধা ও ই,পি,আর জোয়ানদের নিয়ে ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিনের নেতৃত্বে পাঞ্জাবীদের তৎকালীন শক্ত কেন্দ্র (Strong hold) রাজশাহী সেক্টর আক্রমন করা হয় এবং বহু পাঞ্জাবী সৈন্য খতম করা হয়। রাজশাহীর যুদ্ধ পরিচালনায় অস্ত্ররসদ সরবরাহ এবং সামগ্রিক যুদ্ধ পরিকল্পনা শহীদ মেজর নাজমুল হক-এর নেতৃত্বে নওগাঁ হতে পরিচালিত হয়। এই পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হিসেবে আমি সামগ্রিক সহযোগিতা প্রদান করি।

এই সময়ে আর্টিলারীর অভাবে সংগ্রাম ব্যাহত হতে থাকলে এবং পাক-বাহিনীর আরিচা-নগরবাড়ী হয়ে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে পারে এই আশংকায় উন্নত ধরনের অস্ত্রপ্রাপ্তির আশায় আমি প্রথমে একাকী মালহদ শহরে ভারতীয় সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ-এর জন্য যাই। সেখানে নবাবগঞ্জের এম,সি,এ ডাক্তার মঈনউদ্দিন ওরফে মন্টু ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা হয়। সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের সাথে আলোচনার পর ঠিক হয় যে সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট অস্ত্র সরবরাহ করতে তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তৎপুর্বে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে তাদের আলোচনা প্রয়োজন। এমতাবস্থায় আমি নওগাঁ ফিরি এবং মেজর নাজমুল হককে সাথে নিয়ে পুনরায় মালদহ যাই। এ সময়ে ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে ক্যাপ্টেন গিয়াস রাজশাহী সেনানিবাস দখলের প্রায় কাছাকাছি অবস্থায় পৌঁছেছিলেন। অস্ত্র সাহায্য প্রাপ্তির আশ্বাস নিয়ে আমি ও নাজমুল হক নওগাঁ ফিরে আসি। কিন্তু ২/১ দিনের মধ্যে পাক সৈন্য ভারী কামান ও অন্যান্য অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে নগরবাড়ী অতিক্রম করে পাবনা দখল করার পর ট্রেনযোগে নওগাঁ অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকলে আমরা আত্মরক্ষার্থে ১৭ই এপ্রিল তারিখে মেজর নাজমুল হকের সাথে পরামর্শ করে বালুর ঘাট হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করি।

উল্লেখ্য যে, এই এলাকার সমস্ত সংগ্রামের অধিনায়ক মেজর নাজমুল হক শিলিগুরি থেকে তরঙ্গপুর ফেরার পথে আকস্মিকভাবে স্বহস্তচালিত জীপ দুর্ঘটনায় শহীদ হন।

এরপর আমি পশ্চিম দিনাজপুরের রায়গঞ্জের মুক্তিফৌজের সামরিক শিক্ষা শিবিরে, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর ও বগুরায় শিক্ষানবিশ যুবকদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ করার জন্য দীর্ঘদিন অবস্থান করি এবং ট্রেনিং ক্যাম্প হতে সামরিক শিক্ষাপ্রাপ্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের মুক্তি সেনাদের নিয়ে ‘শোবরা অপারেশন’ শিবিরে অবস্থান করি। এবং তাদের সঙ্গে থেকে তাদেরকে সঙ্গে থেকে তাদেরকে সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ করতে পারি পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বিভিন্ন এলাকা সেক্টরে বিভক্ত করলে আমি তরঙ্গপুর ‘শোবরা অপারেশন’ ক্যাম্পের জন্য সিভিল লিয়াজোঁ অফিসার নিযুক্ত হয়ে কাজ চালিয়ে যেতে থাকি।

যে সমস্ত এলাকায় খান সেনাদের গেরিলা যুদ্ধে ঘায়েল করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বান্ধাইখড়া। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে এখানে ৫টি বিরাট নৌকাভর্তি প্রায় ৭০/৮০ জন খান সেনাকে তাদের অফিসারসহ ব্রাশ ফায়ারে খতম করা হয়। সাহাগোলা ব্রীজ ধ্বংস করে দেয়া হয়। এবং সৈন্য বোঝাই একটি রেলগাড়ি বিধ্বস্ত করে দেওয়া হয়। এখানে প্রায় শতাধিক খান সেনা নিহত হয়। নগা-মহাদেবপুর হাই রোডের মধ্যে হাপানিয়া গ্রামে মাইন বিস্ফোরণের দ্বারা একটি সৈন্য বোঝাই ট্রাক বিধ্বস্ত করা হয়। এতে ৮/৯ জন পাক সেনা মারা যায়। হাপানিয়ার দক্ষিনে আরেকটি বিস্ফোরণে দু’জন অফিসারসহ ৫/৬ জন পাক সৈন্য নিহত হয়।

-মোহাম্মদ বয়তুল্লাহ
গণপরিষদ সদস্য (সাবেক এম, এন, এ)
রাজশাহী ২২ অক্টোবর, ১৯৭২

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!