You dont have javascript enabled! Please enable it! 1977.09.09 | মুসলিম নারী মুক্তি | সুফিয়া কামাল | সাপ্তাহিক বিচিত্রা - সংগ্রামের নোটবুক

মুসলিম নারী মুক্তি | সুফিয়া কামাল | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭

১৯১১ সনের সম্ভবতঃ ২০শে জুন আমার জন্ম। সঠিক ইংরেজী তারিখ জানা নেই। তবে বাংলা মাসের হিসেবে দশই আষাঢ়-পশ্চিমা একসময় কোঠিন ছিল। নদীর ভাঙ্গনে সবকিছু হানিয়ে গেছে। একটা বিশেষ রক্ষণশীল সময়ে জন্ম হলেও পরিবারই আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তবে প্রথম জীবনে বাইরের জগতের সঙ্গে খুব কম পরিচয় ছিল। আমরা ছিলাম ঘরের পর্দানশীল মহিলা। তাই উর্দূ, ফার্সী পড়াই যথেষ্ট ছিল-বাংলা ইংরেজী পড়া তো দুরের কথা। কিন্তু শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের মেয়ে হিসেবে আমি অনেক সুযোগ পেয়েছি। আমাদের বাড়ীতে ইংরেজী, সাহিত্য, সংস্কৃতি সব কিছুর চর্চা হতো। পড়াশোনা, আলোচনা হত। আর আমরা ছিলেম সাহিত্য বিষয়েউৎসাহী। একই সঙ্গে ধর্মীয় পরিবেশও ছিল। আমাদের নামাজ রোজাও করতে হত।
আমাদের পরিবারে আমার আম্মাই আমাকে বাংলা শিখিয়েছেন। ঐ সময় থেকে আমার সাহিত্যের প্রতি আগ্রহের শুরু। জমিদার বাড়ী বলে আমাদের বাড়ীতে পাইক-পেয়াদা থাকত। ওরা সন্ধ্যা বেলায় বেহালা ঘাজাতপুথি পড়ত আর আমি দোতালায় বসে বসে সে পুথি শুনতাম। ঐ সময় আমাদের বাড়ীতে প্রবাসী পত্রিকা আসতো। এই প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে মনে হতো কবিতা লেখা যায়। আর গদ্য যে সুন্দর হয় তা জানলাম বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের গল্প ‘হেনা’ পড়ে। বানান করে করে পড়েও বড় সুন্দর লেগেছিল। তখন চুরি করেই বাংলা পড়তে হতো। বাংলা পড়া তখন একটা বেয়াদবীর ব্যাপার ছিল। সেই সময় বেগম রোকেয়া, সারা তৈফুর, তাহের বাণু, এদের অনেকেই লিখতেন। ওদের লেখা পড়ে মনে হতো ওরা যখন লিখতে পারেন, তখন আমি কেন লিখতে পারবো না? সেই থেকে আমার লেখার শুরু। সে কি আর লেখা ? লেখা লেখা খেলা। তখন আমরা গ্রামেই থাকতাম। পরে কলকাতা গিয়ে যখন বেগম রোকেয়াকে দেখলাম তখন আমার লেখাপড়া শেখার আগ্রহ হল। কিন্তু লেখা পড়া শেখা হল না। আবার বরিশালে ফিরে এলাম। শায়েস্তাবাদের পরিবেশ ছেড়ে যখন বরিশাল এলাম তখন থেকেই লেখার চর্চা করতাম। তখন বরিশালে সুকুমার দত্ত, সরোজদত্ত এরা একটা পত্রিকা বের করতেন। ওদের পত্রিকায় ১২/১৩ বছর বয়সে আমার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। ওরা দেখে বললেন লেখার হাত আছে। এরপর ‘তরুণ’ নামের একটি পত্রিকায় আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি বছর দুই চলেছিল। আমার এই লেখায় পরিবারে নানা আপত্তি উঠল। এ সময় আমার ছোট মামা ঢাকায় থাকেন। তিনি একদিন বরিশাল গিয়ে আমার কবিতা লেখার খাতা-পত্র নিয়ে এলেন। তার মধ্য থেকে কয়েকটি কবিতা ঢাকার ‘অভিযান’ পত্রিকায় ছাপা হয়। কাজী নজরুল ইসলাম তখন ঢাকায়। তিনি আমার কবিতা পড়ে উৎসাহ জানিয়ে আমাকে একটি চিঠি লেখেন। ওতে বলেন—“মোতাহেরা বান লিখছে। তুমিও লেখ । আমি কলকাতায় যাচ্ছি। তুমি সেখানে ‘সওগাত’ পত্রিকায় লেখা পাঠাও। কোন অসুবিধে হবে না। কলকাতায় গিয়ে সওগাত সম্পাদক নাসিরুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আলাপ হলো। সওগাত সাহিত্য মজলিশে আসা যাওয়া শুরু হলো। নাসিরুদ্দীন সাহেব আগ্রহ করে লেখা নিলেন—লেখা ছাপার জন্যে। সে সময় আমার পরিবারের পরিবেশটা অত্যন্ত কড়া ছিল। বাড়ীতে নানারকম অসুবিধেও ছিল। পরিবারের গণ্ডী ছিটকে যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম তখন থেকেই লেখা শুরু করি। কাজী নজরুল ইসলাম এ সময় প্রায়ই আমাদের বাড়ীতে আসতেন। তিনি আমাকে লেখার জন্য উৎসাহ জোগাতেন। এ সময় রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিনে আমি একটি কবিতা লিখে পাঠাই। কবিতাটি পড়ে উৎসাহ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আমাকে একটি চিঠি লেখেন। এর পর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি তাঁর জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে যাই। বোরকা পড়েই রবীন্দ্রনাথের বাড়ী গিয়েছিলাম। সিড়ি দিয়ে যখন উঠছি তখন রবীন্দ্রনাথ বললেন ‘আমাদের পরিবারে বোরকা ছিলো, এখন আর নেই। এখনো তোমাদের পরিবারে আছে। তিনি আমাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিলেন। এরপর পরেই গঠিত হয় আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম। এখানে বেগম রোকেয়া, শামসুন্নাহার মাহমুদ, আমি প্রমুখ যোগ দেই। এর পরই হামিদা মোমেন ও অন্যান্য মহিলাদের উদ্যোগে গঠিত হল ইন্ডিয়া উইমেনস এসোসিয়েশন। আমিই প্রথম মহিলা যে ওখানকার সদস্য হলাম। তারপরে অন্যান্যরা যোগ দেন। থাকাকালীন সময়ে যখন আমার বয়স ১৪/১৫ বৎসর তখন পালকি চড়ে বোরকা পরে মাতৃমঙ্গলে কাজ করতে যেতাম। সদর গার্লস স্কুলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই মাতৃমঙ্গল। আমাদের দেখে সবাই বলাবলি করত ‘নিঃসন্তান’ মেয়েরা মাতৃমঙ্গলে কাজ করতে যাচ্ছে। . বেগম রোকেয়া যদি না থাকতেন তাহলে আজকের মেয়েরা পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে থাকত। অথচ আমরা বেগম রোকেয়ার জন্য কিছুই করিনি। বেগম রোকেয়ার নামে রোকেয়া হল হয়েছে—অথচ হলের মেয়েরা বেগম রোকেয়াকে চেনেনা-বেগম রোকেয়া কে জানে না। আমরা পায়রা বন্ধ গিয়েছিলাম, তার স্মৃতি রক্ষা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কেউ কিছু করল না। আমরাই বা কি করবো জানি না। সে সময় মুসলমান মহিলাদের মধ্যে একমাত্র বেগম শাহনাওয়াজ রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করতেন। তবে এদেশেও হিন্দু-মুসলমান মহিলারা রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। যখন স্বদেশী আন্দোলন, জোরদার হয়েছে তখনকার কথা মনে আছে। বরিশালে তাঁত বসানো হয়েছে। ঢেকিতে ধান কুটা হত। সেসময় মহিলারা ইচ্ছে করলেও রাজনীতিতে যোগ দিতে পারেননি। এসব আন্দোলনে হিন্দু মেয়েরা যোগ দিয়েছে। তবে আমরা সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। তখন রাজনীতি করতাম না। আমার পরিবার থেকে রাজনীতির শিক্ষা পেয়েছি। এ ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা লক্ষ্যণীয়। ইসলামই বলেছে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা সমানভাবে দিতে হবে। ইসলামে বিধান রয়েছে মেয়েরা বাবার, স্বামীর সম্পত্তির অধিকার পাবে। কোলকাতা শহরে বোরখা পড়ে বীতে বস্তীতে কাজ করেছি। কোলকাতায় কাজ করার সময় বিশেষ ঘটনার মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়ার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তখন আমি আমার আম্মা সহ কোলকাতায় এক জনের সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ী গিয়েছি। এই অবস্থায় একদিন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের গাড়ী এল। গাড়ী থেকে নেমে এলেন ছোট-খাটো একজন সুন্দরী মহিলা। তিনি এসে আক্ষেপ করে বললেন—সকলের মেয়ে যখন পড়ছে তখন আমার আত্মীয়ের মেয়েরা পড়াশোনা করেনা। এটা আমার কত বড় দুঃখ। তারপর তিনি আমাকে তার স্কুলে যেতে বললেন। আমি বললাম—আমি কিভাবে পড়বো ? আমাকে ত দেশে ফিরে যেতে হবে। বারো বছর পর আমি সে স্কুলে যোগ দিলাম। তখনো কি প্রতি বন্ধকত। এ সময়ে বেগম রোকেয়াকে অনেক প্রতিকুলতার মোকাবেলা করতে হয়েছে। সওগাত অফিসে আমরা যখন যাওয়া শুরু করি তখন নাসিরুদ্দীন সাহেব আমাদের অনেক উৎসাহ জুগিয়েছেন। তিনি বলতেন-বোরকা আর পরা চলবে না—আমার মেয়েদের বোরকা খুলে রাখতে হবে। মেয়ে দের এগিয়ে আসতে তিনি অনেক সাহায়্য করেছেন। তখনকার দিনে একটি মুসলমান মেয়েকে সম্বর্ধনা দেয়া সোজা কথা নয়। তখন নাসিরুদ্দীন সাহেব তাই করেছিলেন ফজিলাতুন নেসাকে সম্বর্ধনা জানিয়ে। এরপর কোলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া উইমেনস কনফারেন্স। এ সম্মেলনে বাইরে থেকে বহু মহিলা এসেছিলেন। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, বেগম রোকেয়া এরা আমাদের অনেক দুর নিয়ে গেছেন। পর্দা ছাড়তে শিখিয়েছেন। মুসলমান লেখকরাও আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। যখন লিখতে শুরু করি তখন তো ছন্দ বুঝতাম না। লিখে লিখে গান বানিয়ে গাইতাম। তবে পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন মহল থেকে উৎসাহ পেয়েছি। দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে তখনো ঢাকায় এসে চেষ্টা করেছি মহিলাদের জন্য কিছু করতে। এসব কাজে মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছি। দেশের মানুষের সে ভালোবাসা কি করে শোধ করব। জানি না।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.09.09-1.pdf” title=”1977.09.09″]