You dont have javascript enabled! Please enable it! 1930 | ত্রিশ দশকের বাঙ্গালী মুসলমান সমাজ | আবুল কালাম শামসুদ্দীন | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ - সংগ্রামের নোটবুক

ত্রিশ দশকের বাঙ্গালী মুসলমান সমাজ
আবুল কালাম শামসুদ্দীন

সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭

১৯৯১ পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা মুসলমানদের ধংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। সে সময় বিভিন্ন সরকারী নথিপত্রেও মুসলমানদের ধংস করার মনোভাব স্পষ্ট। ইংরেজ বিজয়ের পর, হিন্দুরা ইংরেজীকে গ্রহণ করে। মুসলমানরা তা করেনি। ফলে শিক্ষা, দীক্ষা, চাকরীক্ষেত্রে সর্বত্র হিন্দুরা মুসলমানদের স্থান দখল করে। এর ফলে মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থাও ক্রমশঃ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে হানটারও লিখেছেন, “একশ বছর আগেও মুসলমানরা এত গরীব ছিল এটা ভাবা যেতনা। মুসলমানরা একশো বছরে নিঃস্ব হয়ে গেছে।’ সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত মুসলমানরা ইংরেজদের প্রতি তাদের অসহযোগ অব্যাহত রাখে। এর ফলে হিন্দুরা জাঁকিয়ে বসে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজরা মনে করল এটা মুসলমানদের কাজ এবং মুসলমানরাই করিয়েছে। যদিও এতে নানা সাহেব প্রমথ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও ছিলেন। এ ফলে মুসলমানরা এক করুন অবস্থায় সম্মুখীন হয়। এ সময়ে এগিয়ে এলেন স্যার সৈয়দ আহমদ। তিনি দেখলেন এ অবশ্য চলতে থাকলে মুসলমানরা অবলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই তিনি প্রথমেই মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি ফেরানোর চেষ্টা করেন। তিনি বললেন মুসলমানদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং মুসলমানরা যাতে ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করে সেই চেষ্টা করলেন। একই সঙ্গে কাজে নামলেন নওয়াব আবদুল লতিফ ও আমীর আলী। এর পরেই মুসলমানেরা ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করে। স্যার সৈয়দ আহমদের উদ্যোগে আলীগড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় কলেজ, স্কুল। শিক্ষা বিস্তারই স্যার সৈয়দের মূল কাজ ছিল। মুসলমানদের এই নবচেতনাগল্প সময়ে ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় কংগ্রেস। স্যার সৈয়দ আহমেদ মুসলমানদের সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করতেও বারণ করেন, কেননা তাহলে প্রতিযোগিততায় হিন্দুদের সঙ্গে তারা হেরে যাবে। স্যার সৈয়দ আহমেদ শিক্ষা বিস্তারেই অধিক মনোযোগী ছিলেন। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে ১৯০৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে কেন্দ্র করে গঠিত হয় মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠন মুসলীমলীগ।
(১) সেই থেকে মুসলমানদের রাজনীতির সন্মেলন। তখন মুসলমানরা শিক্ষিত হয়ে উঠেছে। ভাবল একটু রাজনীতি না করলে চলবেনা। ১৯০৯ সালে মুসলমানরা সিমলায় বড়লাটের কাছে ডেপুটেশন দিয়ে দাবী করলেন-তাদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
(২) এ দাবী মেনেও নেয়া হল। এটা ছাড়া মুসলমানদের গত্যন্তর ছিলনা। সাধারণ নির্বাচনে মুসলমানরা জিততে পারতো না। এর আগে ১৯০৫ সালে বঙ্গ ভঙ্গ হয়। বঙ্গ ভঙ্গের ফলে মুসলমানদের সুবিধা হয়। পূর্ব বাঙলা আসাম নামে প্রদেশ হল। এখানে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এই বঙ্গ ভঙ্গ হিন্দু সমাজে ভয়ানক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন ও করল। এতে দুঃখ পেল মুসলমানরা। কেননা তাদের আশ্বাস দেয়া । হয়ে ছিল এটা settled fact. হিন্দুদের আন্দোলনেয় ফলে ১৯১১ সালে বঙ্গ ভঙ্গ রদ হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। এখানে অফিস আদালত সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হল। বঙ্গ ভঙ্গ রদ হয়ে যাওয়ায় মুুসলমানদের স্বার্থের দ্বানি হয়। নওয়ার সলিমুল্লাহ আশা করেছিলেন এর ফলে মুসলমানরা সুযোগ সুবিধে পাবে। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যাওয়ায় তিনি এমন আঘাত পেলেন যে সেই আঘাতে ১৯১৫ সালে শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন। এর ফলে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে অবনতি ঘটে। এই পরিস্থিতিতে ১৯৩০ সালে ময়মনসিংহের রফিকউদ্দিন তরফদার, আবদুল হামিদ শাহ প্রমুথ , কৃষক-প্রজা সমিতি গঠন করেন। এই সমিতি কৃষকদের অবস্থা উন্নয়নের জন্য, প্রজাসত্ব আইন সংশোধনের জন্য আন্দোলন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু, জমিদাররা এই আন্দোলনে বাধা দেয়। হিন্দুদের অত্যাচারে মুসলমানরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। এমন অবস্থা হয়েছিল যে হিন্দু, মহাজনদের কাছে মুসলমানদের মাখা বিক্রী হয়ে গিয়েছিল। শেরে বাংলা ফজলুল হক, খাজা নাজিমীন এদের উদ্যেগেই ১৯৪২ সালে প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হয়। নাজিমুদ্দীন তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। এই প্রজাস্বত্ব আইনে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা হল এবং ঋণ সালিশী বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। ঋন সালিশী বোর্ডের কায়ণেই মুসলমানরা রক্ষা পায়। এর ফলে টিকে গেল মধ্যবিত্ত শ্রেণী। বলা চলে মুসলমান মধ্যবিত্তের উদ্ভব হল। তখন কলকাতা রাজধানী। সে সময় মুসলমানদের কোন পত্র পত্রিকা ছিলনা। এই সময় মুসলমানদের মুখপাত্র হিসেবে ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদ। আজাদ পত্রিকা মুসলমানদের দাবী আওয়া, অভাব অভিযোগেয় কথা খুব জোরে শোরে বলতে লাগল। মুসলমানদের জন্য চাকুরী নিশ্চিত করারও দাবী তোলে।
(৩) মুনসলমানদের সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টা করে আজাদ এবং মাসীক মোহাম্মদী। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সর্বত্র শিক্ষা দীক্ষার ক্ষেত্রে যে হিন্দুয়ানী ভাব প্রচারের চেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আজাদ এবং মোহাম্মদী। এ কারণে মাসীক মোহাম্মদী প্রকাশ করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা। তখন বিশ্ববিদ্যালয় মনোগ্রামে লেখা থাকতো ‘শ্রী পদম। এটা মুসলমানদের আবেগকে আঘাত করে। তারা বলে এটা সরস্বতীর বাহন। তাই তারা মেনে নিতে পারে না। আজাদ এবং মোহাম্মদীর কারণেই এটা উঠে যায়। তখন আরেকটি সমস্যা ছিল। পাঠ্যপুস্তকে কিংবা পরীক্ষার খাতায় কোন মুসলমান শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। মুসলমানরা এর বিরদ্ধেও আন্দোলন করে। শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্টে আইন পাশ করে এসব শব্দের ব্যবহার অনুমোদন করা হয়। সোজা কথায় আজাদের কারণেই মুসলমানদের সংস্কৃতি রক্ষা পায়। একই সময় চাকুরী ক্ষেত্রেও মুসলমানদের জন্য শতকরা ৪৫ ভাগ চাকুরী সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। সাম্প্রদায়িক’ কথাটা তখনই চালু হয়। মুসলমানরা যা বলতে হিন্দুরা ডাকেই সাম্প্রদায়িষ্ণ বলে আখ্যা দিতো। হিন্দুদের পত্র পত্রিকায়ও এনিয়ে প্রচুর লেখা হতো। আজাদ পত্রিকা এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাবে দাড়ায়। ভাবখানা যেন এই, মুসলমান অসাম্প্রদায়িক হতে পারে না। বসুমতী, আনন্দবাজার, স্বরাজ, স্বদেশ প্রভৃতি পত্রিকা ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপ্রচার করত। আজাদ একা সে সমালোচনার জবাব দিত। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তারা আজাদের যুক্তির কাছে দাঁড়াতে পারছেনা।- অর্থহীন গালিগালাজ করছে। আজাদের মালিক মওলানা আকরাম খান একসময় কংগ্রেসের সদস্যও ছিলেন। সেসময় সেবক পত্রিকা প্রকাশ করে জেলেও গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন। আজাদ এই ভূমিকার জন্য সরকারের কোপানলে পড়েনি। মুসলমানদের তখন দ্বৈত ভূমিকা ছিল। হিন্দুদের বিরুদ্ধে ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে। মুসলীম লীগ এই দ্বৈত ভূমিকা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে বলল মুসলমানরা একটা জাতি। হিন্দু জাতির চেয়ে আলাদা। তৎকালীন সময়ে রাজধানী কলকাতার সে সমম্বি তা পূর্ব বাঙ্গলাকে মূলধন করেই। পূর্ব বাঙ্গলার সম্পদ লুট করে গড়ে ওঠে রাজধানী কলকাতা। তখন পূর্ব ৰাঙলায় মুসলমানদের লেখাপড়ারও সংযোগ ছিলনা। কলকাতা গিয়ে পড়াশোনার মত অবস্থা ছিল না। সেসময়ে শেরে বাংলা মুসলমানদের শিক্ষার প্রসার ঘটান। তার উদ্যোগে পূর্ববাঙলার বিভিন্ন স্থানে বহু, স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। আজাদ পত্রিকা অবশ্য প্রথম দিকে মূলত কৃষক আন্দোলনের অখপাত্র এবং কৃষক সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। মওলানা আকরাম খান , সেসময় কৃষক সমিতির সম্পাদক ছিলেন। খান বাহাদুয় আমল মোমন, স্যায় আবদায় ফুৰি প্ৰমৰ যখন কৃষক সমিতির সভাপতি তথশ মওলানা আকরম খান কৃষক সমিতি সম্পাদক। যখন মুসলাদীস মুসলমানদের সংগঠন হিসেবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে তখন তিনি মুসলীম লীগে যোগ দেন। একারণে তাকে কৃষক সমিমির নেতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এ সময়ের আয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ১৯৩৫ সালের ইন্ডিয়া একট। এই সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদকে মুসলমানেরা ভালোভাবেই গ্রহণ কয়ে কিন্তু হিন্দয়া এতে অসন্তুষ্ট হয়। আজাদ এই একটের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করে এবং হিন্দুদের সমালোচনা করে। আজাদ তখন থেকেই স্বাধীনতার কথা বলত। মুসলমানদের এই বৃটিশ ও হিন্দু বিরোধী দ্বৈত ভূমিকার জনক স্যার সৈয়দ আহমদ। হিশ দশকেয় সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে মুসলমানদের বিশেষ সম্পর্ক ছিলনা। এ আন্দোলনে যোগ দিতে হলে কালী সাধনা, কালী পুজা করতে হতো বলে মুসলমানরা এই আন্দোলনকে আপন ভাবতে পারেনি। এই চেতনা রাজনৈতিক নয়, ধমীয়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে নিন্দা করে কোন আলোচনা আজাদে প্রকাশিত হতো না। তাই বলে তাদের বীর হিসেবেও চিহ্নিত করা হতো না। এ সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচেছ’ বন্দে মাতরমে। বিরদ্ধে আমাদের আন্দোলন। আমরা বলেছি আনন্দমঠের সঙ্গে সংযন্ত বলেই বন্দেমাতরম জাতীয় সংগীত হতে পারে না। এখানে। দেশকে ‘মা’ হিসেবে ব্যাপনা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা তা মেনে নিতে পারিনি। কেননা এর মধ্যে একটা পৌত্তলিকতার মনোভাব আছে। আনন্দ মঠের বিরদ্ধে একই সময়ে আয়ো প্রতিবাদ উথিত হয়। তখন কোলকাতা ‘নাট্য নিকেতনের পক্ষ থেকে অহীন্দ্র চৌধুরীআনন্দমঠের নাম বদলিয়ে ‘সন্তান’ নাম দিয়ে নাট্যানুষ্ঠানের ব্যাবস্থা করেন। এ অবস্থায় সরকারী পক্ষ থেকে বলা হয় এতে আপত্তি হতে পারে। ফলে অহীন্দ্র চৌধরী এসে আমাদের বলেন সে নাটক দেখতে যাওয়ার জন্যে। এবং তিনি বলেন মুসলিম বিদ্বেষী অংশটুকু বাদ দিয়ে সন্তানের মঞ্চায়ন করা হয়েছে। আমরা কয়েজন গিয়ে দেখতে পেলাম বন্দেমাতরম বাদ দেয়া হয়নি। জানালাম, বন্দে মাতরম বাদ দিতে হবে। অবশেষে বন্দে মাতরম বাদ দিয়েই ‘সস্তান’ মঞ্চারিত হয়। এই সময়ে মুসলমানদের কেউ আসল পরিচয়ে সিনেমা থিয়েটারে ” যোগ দিতেন না। নিজ পরিচয়ে গানও গাইতেন না–যেমন- কে, মলিলকের কথা। আমরা তাকে হিন্দু বলেই জানতাম। হঠাৎ একদিন তিনি সওগাত অফিসে এসে বলেন তার নাম আবুল কাসেম মলিফ। আমরা ত শুনে অবাক। অনেকে আবার মুসলমান নামদিয়ে গান গেয়ে নজরুলের গান জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেন। যেমন আবদুল গণি, আবদুল লতিফ। আব্বাস উদ্দীন যখন গাইতে শুরু করেন তখন নিজ নামেই গান গাইতে শুর কয়েন। আর বাধা নিষেধ মানেননি। এই সময়ে সওগাতে মুসলমান মহিলাদেরও ছবি প্রকাশিত হ3ে শম করে। এ বিরোধিতা ছিল ফাঠ মোলাদের বিরুদ্ধে-নবীন পন্থীরা কোন বাধা মানতেন না। বাংলা ১৩৩৩ থেকে ১৩৩৫ পর্যন্ত আমি সওগাতের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেছি। তখন সর্বত্র এটা জোয়ার এসে গিয়েছিল। একদিকে আব্বাস উদ্দীন, নজরুল ইসলামের গান, অন্যদিকে মোহামেডন পেটিং এর খেলা। ১৯৩৪ এর আগে মোহমেডান স্পােটিং কখনো কলকাতার মাঠে চ্যাম্পিয়ন হয়নি। সে বছরই মোহামেডন পোটিং চ্যাম্পিয়ন হয় এবং ১৯৩১ পর্যন্ত তা একটানা অব্যাহত থাকে। মোহামেডানে খেলোয়াড়রা তখন সবাই মুসলমান। মোহামেডান স্পােটিং এর অর্থ সংকুলান ঘধ্যে মুসলমানদের চাঁদায় সাহায্যে। এ সময় পনেরো টাকা ছায়ে চাঁদা দিয়ে কয়েক হাজায় মুসলমান মোহামেডান স্পােটিং ক্লাবেয় সদস্য হয়েছিলেন। এ ছাড়াও অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন ইস্পাহানী কিংবা ঢাকার নবাব পড়িয়ে সদস্যরা। নবাব পরিবায়ের খাজা নরক্ষীন তখন মোহামেডন ক্লাবের সেক্রেটারী। মোহামেডানের বিজয় এতই আলোড়ন সটি কয়েছিল যে নজরুল ইসলাম এর উপর একটি সুন্দর কবিতাও লিখে ফেলেন। ভবন বাঙালী, মুসলমান ও পশ্চিমা মুসলমান ভাষা, সংস্কৃতির পার্থক্য স্বত্ত্বেও বঞ্চণ্য, যিশ, আধিপত্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের সঙ্গে বাঙলাদেশের মুসলমানদেয় রেষারেষির ভাব ছিল কিন্তু তা প্রকাশ পেতো না। এখানকার মুসলমানরা ভেবেছিলেন ওখানকার মুসলমানরা বিবেচক হবেন। কিন্তু তা হয়নি। এরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতো ওয়া ভালো লোক। তাদের প্রতি সহযোগিতার মনোভাবও ছিল। যেমন মোহামেডান স্পোটিং এর খেলোয়াড়দের মধ্যে খোন্দকার নাসিম, ফিরোজদ্দীন ও সামাদের কথা বাদ দিলে আর সবাই অবাঙালী ছিলেন। এতে অসুবিধা। হয়নি। পরে অবশ্য পশ্চিমা মুসলমানদের চরিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। ত্রিশ দশকে কতগলি গৰুত্বপর্ণ ঘটনা ঘটে যেসব সম্পর্কে মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দিধা বিভক্ত। যেমন, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা। মুসলমানদের মধ্যে যারা অগ্রসর অংশ তারা এর নিন্দা করে ছিলেন অনন্যরা এ ধরনের কাজকে পছন্দ করতেন না এটা কমিউনিষ্টদের ব্যাপার বলে। আবার যেমন, কাঠমোল্লারা অন্যধর্মে বিয়েকে ঘণা করত কিন্তু শিক্ষিত শ্রেণী সমর্থন করত। যেকারণে হমায়ন কবির বিয়ে করার পর উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। সে সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার। কংগ্রেস সদস্যপদ ।
(৪) এই সময়ে আজাদে বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। একবার শুধ, কিছু উৎসাহী ছাত্র ‘আনন্দমঠ’ পড়িয়ে ছিল। আমরা তা সমর্থন করিনি। তখন আজাদে বহ, হিন্দ কর্মচারীও কাজ করতেন। এদের একজন, সহকারী সম্পাদক বাধা চক্রবর্তী। এই উদার চেতা ও অমায়িক মানুষটির সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিলো। তৎকালীন নেতা এম, এন, রায়ও আজাদ অফিসে এসেছিলেন। আজাদ অফিসের সভায় মুসলমানদের দাবীকে তিনি সমর্থন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে জিন্নাহ-এর সঙ্গে দেখা করে তিনি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তাব দেন। তৎকালীন পরিস্থিতিতে আমরা একটি রেনেসা সোসাইটি গঠন করেছিলাম। এর আহবায়ক ছিলেন মজিবর রহমান খাঁ। যখন দেশভাগের কথা ওঠে তখন আমরা সেই সোসাইটির পক্ষ থেকে বাঙলা ভাগের ব্যাপারে একটি ম্যাপ তৈরী করে দিয়েছিলাম। যেখানে দেখানো হয়েছিল হুগলী নদী বরাবর সীমানা হবে। জিন্নাই সেটা সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী, ফজলুর রহমান প্রমুখ তা সমর্থন করেননি তারা বলেছিলেন পূর্ণিয়া, ঝড়খণ্ড, আসাম, বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হবে। আমরা বলেছিলাম সেটা সম্ভব হবেনা। ১৯৩২ সনে কলকাতার এলবার্ট হলে আমাদের বঙীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির পক্ষ থেকে আয়োজিত হয় ৫ম বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন। কবি কায়কোবাদ ছিলেন মূল সম্মেলনে সভাপতি। অন্যান্য অধিবেশনের মধ্যে বিজ্ঞান অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেছিলেন ডঃ কুদরত-ই-খুদা, ইতিহাস অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন ইসলামিয়া কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল জইনুল ইসলাম প্রমুখ। তৎকালীন ভিন্ন একটি সংগঠন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে আমাদের তেমন সুসম্পর্ক ছিলোনা। ভায়া আমাদের আহবান করতেননা। কিন্তু ১৯৩২ এর সম্মেলনে আমরা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কর্তাব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। এতে তারা খুশী হয়েছিলেন। তাই সম্মেলন শেষে পরদিন আমাদের তাদের অফিসে আমন্ত্রণ জানান এবং আমরা যাই। আমাদের তখন আরেকটি পরিচয় ছিল। আমাদের বলা হতো সওগাভী গ্রুপ। এই সওগাতী গ্রুপের সঙ্গে কাজী আবদুল ও ‘শিখা’ গ্রুপের একটা বিরোধ ছিল। একশ্রেণীয় মুসলমানের এদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা ছিল। আমাদের সঙ্গে বিরোধ ছিল অনেকটা আদর্শগত কারণে। কাজী আবদুল ওদুদরা ছিলেন রাম মোহন পন্থী এবং ভাই তারা বলতেন আমরা ‘হিন্দু মুসলমান। আমরা এটা মানতে পায়তামনা। এতে মনে হয় ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্যগত ভাবে হিন্দুদের সঙ্গে মিল রয়েছে। এটা ঠিক নয়। আমরা বলতাম হিন্দি (ভারতীয়)মুসলমান বললে আপত্তি নাই। শিখা গ্রুপ হিন্দু, মুসলমান মিলনের চাইতে মিশ্রণ চাইতেন বেশী করে। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ হিন্দুদের কারণেই মুসলমানরা মিলতে চাইলেও মিশতে পারতনা। পলাশী যুদ্ধের পর থেকেই হিন্দু মুসলমান বিরোধ শুরু হয়। এর পর থেকে হিন্দুরা সুবিধে গ্রহণ করতে থাকে। মুসলমানরা ইংরেজ শাসন মেনে নেয়নি। মেনে নেয়নি বলেই সিপাহী বিদ্রোহের সময় তারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় গ্ৰান্ড ট্রাংক রোডে বহু মুসলমানের মাথা লটকানো হয়েছিলো। সেসময়ের পত্র পত্রিকায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হতো। স্কুল-কলেজে পড়তে গিয়ে হিন্দুরা আলাদা বসত। যেমন আমাদের এলাকা যেখানে শতকরা ৯৯ জন মুসলমান। সেখানে জমিদার। একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই স্কুল মুসলমানদের বসায় আলাদা ব্যবস্থা ছিল। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমরা যখন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে পড়তাম সেসময় হাত পেতে পানি খেতে হতো। হিন্দুরা গ্লাসে পানি খেতে। আমরা ঐ গ্লাস ধরতে পারতামনা। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ এভাবেই হয়ে ছিল। ১/২. ১৯০৬ সালের অক্টোবর মাসে আগাখানের নেতৃত্বাধীন ৭০ জন মুসলমানকে সিমলার গ্রীষ্মকালীন আবাসে বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দেয়া হয়। এরা, যে আবেদনপত্র সঙ্গে নিয়ে যান তাতে স্বাক্ষর করেন বিভিন্ন রাজ্যের মন্ত্রী, ভূস্বামী, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, এবং মহামান্য রাজার বহু মুসলমান প্রজা খালেদ বিন সাঈদ তারThe political system of Pakistan গ্রন্থে বলেছেন ‘Lord Minto assured the delegation that he was entirely in accord with their case. লর্ড মিল্টোন সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন এবং সেইমতোবেক ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর ঢাকায় গঠিত হয় মুসলীমলীগ। মুসলীম লীগের ঘোষণা পত্রে বলা হয় “To foster a sense of loyalty to the British government among the muslims of India.’ আগা খানের সঙ্গে আলোচনাকালে লর্ড মিন্টো এই মর্মে পর আরোপ করেন যে মুসলমানদের রাজনৈতিক কার্যকলাপের উদ্দেশ্য, হচ্ছে হিন্দুদের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে মোকাবেলা করা। গ্যান কোভস্কী এবং পলোনসকায় এ সম্পর্কে ‘পাকিস্তানের ইতিহাস (১৯৬৪) গ্রন্থে- মন্তব্য করেছেন, এর পরই আগা খান মুসলীম লীগ নেতৃবৃন্দুকে নির্দেশ দেন “To apply all their energy to furthering Brstish Prestige and instiling respect and affection for the British in Public M nd.
৩, এই সময়কার কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করলে আজাদ পত্রিকার ভূমিকা ‘ সম্পর্কে জানা যাবে। ১৯৩৮ সালের ২৮শে জুন আজাদ লিখেছে : বঙ্কিমচন্দ্রের শততম বার্ষিকী উৎসব সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। এই উপলক্ষে বাংলায় একশ্রেণীর সাহিত্যিকের যে মনোভাব ও আচল,সস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে, তাই এই যে, মুসলমানরা বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যের যেসব এটির উল্লেখ করিয়া থাকেন জোর করিয়া গুণ বলিয়া প্রতিষ্ঠিত করিবেনই। মুসলমানেরা বঙ্কিমচন্দ্রের অসাধারুণ সাহিত্য প্রতিভা মত-মণ্ডকে স্বীকার করিয়া থাকেন কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ এই যে, বাংলা সাহিত্যকে তিনি যতই উন্নত করিয়া থাকুন না কেন, বাংলার জাতীয়তাকে তিনি কলুষিত করিয়াছেন। বাঙ্গালা তিনি বুঝিয়াছেন বাঙ্গলার হিন্দুকে ; তাই হিন্দু, জাতীয়তাকেই তিনি অখণ্ড বাঙ্গালীর জাতীয়তা বলিয়া চালাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। আর এই ভ্রান্ত জাতীয়তায় আদর্শের মোহ হইতে আজও এক শ্রেণীর বাঙালী মুক্তি লাভ করতে পারিল না। ইহা দেশের পরম দুর্ভাগ্য। এই দুর্ভাগ্য ঘুচাইবার জন্য বঙ্কিমচন্দ্রকে দেশবাসীর বুকে সত্যিকার ও বাস্তবগল্পপে প্রতিষ্ঠিত করিবার প্রয়োজন অত্যন্ত বেশী। আমরা আশা করিয়াছিলাম, এবারকার অতিবার্ষিকীতে এই শুভ কার্যের সুত্রপাত হইবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দেশবাসীর দুর্ভাগ্য, কতিপয় সাম্প্রদায়িকতাবাদী হিন্দুর হাতে যারা বাংলার হিন্দুত্বাতিরক্ত অন্য কিছু আছে বলিয়া মনে করে না, তাদের হাতে এই অতিবার্ষিকীর ভার পড়িয়াছে। কিন্তু ইহাদের জানা উচিত সেদিন আর নাই—জাগ্রত মোছলেম জনমতকে তারা আর কে স্তোক দিয়ে ভুলাইতে পারিবে না। মোহামেডান স্পােটিং ক্লাব লীগে চ্যাম্পিয়নশীপ লাভ করে পর পর কয়েকবার। মোহামেডানের এই সাফল্যকে স্বাগত জানিয়ে বিওি দেন স্যার গজনভী এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৩৮ সালেয় ১১শে জুলাই প্রকাশিত এ রিপোর্টে বলা হয়, স্যার গজনবীর অভিনন্দন “শাবাশ’’! মোহামেডান স্পােটিং তোমরা পরপর পাঁচবাক্স লীগ চ্যাম্পিয়নে গৌরব অর্জন করিয়াছ—সেজন্য আমার অভিনন্দন। তোমাদের তুলনা শুধু তোমরই। কলিকাতার লীগ ফুটবলে ইতিহাসে তোমাদের কৃতিত্বের কোথায়ও প্রতিদ্বন্দী নাই। আজও তোমরা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছ। গৌৱব-মহিমায় তোমাদের শিল্প আজ সৰার উর্থে। অনাগতকালেও তোমরা নতুন রেকর্ড ও নুতন সম্মান অর্জন করিবে—ইহাই আমার কামনা—যেন সকল ভারতীয় তোমাদের গৌরবে গৌরবাম্বিত হয়। শুভেচ্ছা গ্রহণ কর। শহীদ ছোহরাওয়ার্দীয় অভিনন্দন “মোহামেডান দলের কৃতিত্ব আজ সকল প্রশস্তির উর্ধে। তাছারা সত্যিকার এছলামিক ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হইয়া যে বিপল বাধা বিপত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছে এবং ধীরেয় ন্যায় সংগ্রাম করিয়া যে জয়মালা বহিয়া আনিয়াছে তাহার জন্য জগতের যে কোন জাতি গৌরব অনুভব করিতে পারে।”
৪ হুমায়ুন কবীর সম্পর্কে তখন অনেকেই বিক্ষুব্ধ ছিলেন। ১৯৩৮ সালের ১০ই জুলাই আজাদে প্রকাশিত ‘মিঃ হুমায়ন কবীরের বিরুপ সম্বর্ধনা শীর্ষ এক রিপোর্ট বলা হয় ঃ
চট্টগ্রাম, ৯ই জুলাই । চট্টগ্রাম মুসলিম লীগের উদ্যোগে অদ্য হক মন্ত্রীমণ্ডলীর সমর্থনে একটি বিরাট শোভা যাত্রা বাহির করা হয়। অধ্যাপক হুমায়ন কবীর ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতিত্বের জন্য অদ্য এ স্থানে আগমন করিলে তাহাকে কৃষ্ণপতাকা প্রদর্শন করা হয়। মোছলেম সংহতির ধ্বসকারক ফিরিয়া যাও’ ‘সমাজদ্রোহী ফিরিয়া যাও প্রভৃতি ধ্বনিসহকারে জনসাধারণ তাহাকে সম্বর্ধিত করে।”
৫. বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির এই সম্মেলন সম্পর্কে নিমোক্ত রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় মাসিক মোহাম্মদী, মাঘ, ১১৩৯ সংখ্যায়ঃ
“এবারে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সম্মিলনের যে পঞ্চম অধিবেশন হইয়া গেল, বাংলার মুসলমানের সাহিত্যিক জীবনে সে এক অপূর্ব রসউৎসব। ২৫শে ডিসেম্বর (১৯৩২) প্রাতে কলিকাতা এলবার্ট হলে সম্মিলনের অধিবেশন শুরু হয় :
কবি নজরুল ইসলাম, এস এস রসলোক বিহারী, এস মধুকরদল শীর্ষক একখানি স্বরচিত গানকরিলেন, সভা জনের কর্ণে যেন মধুৰৃষ্টি হইয়া গেল। গান শেষে কবি শাহাদাৎ হোসেন ‘আবাহন’ শীর্ষক একটি কবিতা পাঠ করিয়া সমাগত সখী সাহিত্যিকগণকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাইলেন। কবির সমস্তটুকু অন্তর যেন উন্মুখ আগ্রহে সাহিত্যপথের সহযাত্রীদের চিন্তাকে অভিবাদন করিল। তারপর এক দুঃখের কাহিনী নিবেদন। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতী মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেব মধুপুরে পীড়িত, তিনি সম্মিলনে উপস্থিত হইতে না পারিয়া পত্রে সকলের নিকট ক্ষমা চাহিয়াছেন এবং সম্মিলনের পূর্ণ সাফল্য কামনা করিয়াছেন। তাছাড়া সস্থলাভিষিক্ত হইয়া অভ্যর্থনা সমিতির অন্যতম সহকারী সভাপতি খান সাহেব মৌলবী সৈয়দ এমদাদ আলী এক সংক্ষিপ্ত অভিভাষণে সকলকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করিলেন। তারপর হইল সভাপভিবরণ। “মহাশ্মশান কাব্যের’ বৃদ্ধ কায়কোবাদ সভাপতির আসন গ্রহণ করিলেন। মৌলবী সৈয়দ এমদাদ আলী সাহেব প্রথমে তাঁহাকে, পরে কবি নজরুল ইসলামকে পুষ্পমাল্য ভূষিত করিলেন, স্বেচ্ছাসেবকগণের নায়ক মিঃ আবদুল ওয়াসেফ সৈয়দ সাহেবের কষ্ঠে মালা পরাইয়া দিলেন। সভায় করতালির উৎসব চলিল। মিঃ নুটু, বিহারী চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক সংগীত গীত হইলে পর সম্মিলনের কাজ পুরাপুরি আরম্ভ হইয়া গেল!
সভাপতির অভিভাষণ পাঠ সমাপ্ত হইলে মিসেস আয়, এস, হোসেন, মুনশী শেখ আবদুর রহিম ও মৌলবী ইসমাইল হোসেন শিরাজীর মৃত্যুতে গভীর শোক সচক প্রস্তাব সভা সকলে সসন্দ্ৰমে দ্ন্দায়মান হইয়া গ্রহণ করিলেন। তারপর আবার কবি নজরুল ইসলামের গান। জনমণ্ডলী, মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া সে গান শুনিল। সভাপতি কবি কায়কোবাদ উচ্ছসিত আবেগে চেয়ার হইতে উঠিয়া নিজে গলদেশ হইতে ফুলের মালা উম্মোচন করিয়া তাহা স্বহসে কবি নজরুল ইসলামের গলায় পরাইয়া দিলেল। নজরুল প্রনত হইয়া বৃদ্ধ কবির কদমবুসী করিলেন। সভায় করতালিধ্বনি পড়িয়া গেল। এই দৃশ্য প্রায় ৪০ বৎসর পূর্বেকার এক দৃশ্য অভিন্ন পাখায় ভয় কৱিয়া যেন ভাসিয়া আসিল-যেদিন এমনি এক সভায় সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ভাবী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের গলায় স্বহস্তে নিযজের মালা খুলিয়া পরাইয়া দিয়াছিলেন।
অপরোহ বসিল দর্শন শাখা বৈঠক। সভাপতি অধ্যাপক ফাজেয় উদ্দিন আহমদ এম, এ, অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি কর্তৃক পুষ্প মাল্যে ভূষিত হইয়া আসন গ্রহণ করিলেন। তারপর গান। তাহার অভিভাষণ পাঠ সমাপ্ত হইলে কয়েকটি সুস্পষ্ট প্রবন্ধ পাঠ করিলেন লেখকেরা অথবা তাহাদের হইয়া তাঁহাদেৱ বন্ধুরা। তারপর হইল: দুই ইতিহাস শখিার অধিবেন। সভাপতি অধ্যাপক জহুরুল ইসলাম এস, এ, পুষ্পমাল্য দ্বারা অভিনন্দিত হইয়া আসনে বসিলেন। গান গল্প হইল। সংগীত শেষে তিনি অভিভাষণ পাঠ করিলেন। তাহা আছানে লেখকেরা অনেকগুলি প্রবন্ধ পড়িয়া শুনাইলেন।
সন্ধ্যায় বসিল গানের জলসা। নায়কত্ব করিলেন কবি নজরুল ইসলাম। কবি এক একজন গায়ককে সভাস্থ সকলের নিকট পরিচিত করাইয়া দিলেন। তাহার পর পর গান করিলেন। গানের পর গান চলিলগজল গান, ভাটিয়ালী গান, হাসির গান। পরিপুর্ণ সভাগৃহে যেন এক আত্মহারা আনন্দ উছলিয়া উঠিল। মানুষ ভুলিয়া গেল গানেয় মজলিস ভাঙিয়া যাইবে, একটু পরে তাঁহাদিগকে আবার পথের ধুলায় দাঁড়াইয়া দুনিয়ার দুঃখের দাহনে অন্তর পাতিয়া দিতে হইবে। মিঃ একরামউদ্দিমন যন্ত্র সংগীত সহকারে বাঁশী বাজাইলেন। শ্রোতা পায়ের তলা হইতে যেন মাটি সরিয়া গেল। সবশেষে কবি গান গায়ছিলেন। সকল শ্রোতা পাত্র ভরিয়া পান করিলেন সল্পলোকের এ অভিনব আনন্দ অবদান। এইভাবে প্রথম দিনের সাহিত্য সম্মিলন মধুর সমাপ্ত হইল। দ্বিতীয় দিনে (২৬শে ডিসেম্বর) সোমবায় মধ্যাহ্নে বসিল বিজ্ঞানশাখায় বৈঠক। সভাপতি ডাঃ ফুসরৎ-ই-খোদ ডি, এস, সি, আর, এস, পুষ্প মাল্যে অত্যখিত হইয়া আসনে সমাসীন হইলেন। মিঃ একরাম উনি গান গাহিয়া মধ্যাহেয় সাঝের মায়া সৃজন করিলেন। তারপর সভাপতি সুন্দর অভিভাষণ। অভিভাষণের পর প্রবন্ধ পাঠ ভাগ আবার গান।। অপরাহ্নে সাহিত্য শাখার বৈঠক বসিল। অধ্যাপক কাজী আবদুল ওদুদ এম, এ কন্ঠমাল্যে নন্দিত হইয়া সভাপতির আসনে বসিলেন। তাঁহার অভিভাষণ পঠিত হইল। তারপর হইল কয়েকটি সন্দুর প্রবন্ধ পাঠ। সন্ধ্যার পর মূল সম্মিলনের পুনরাধিবেশন হইল। কবি কায়কোবাদ আবার সভাপতির আসনে উপবেশন করিলেন। অধ্যাপক উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য এম, এ, মিঃ আবুল হোসেন, এম এ এল, অধ্যাপক কাজী আকরম হোসেন এম, এ, প্রভৃতি উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলীর পক্ষ হইতে সম্মিলনের উদ্যোগতাগনকে অভিনন্দিত করিয়া বক্তৃতা করেন। তাঁহাদের বক্তব্যের সারমর্ম এইরূপ : আমাদের অবিশ্বাস আজ বিশ্বাস-এ পরিণত হইয়াছে। পনর বছর পূর্বে যাহা চিন্তার অতীত ছিল, অপনাদের চেষ্টায় আজ তাহা বাস্তবে আসিয়া দেখা দিয়াছে। সাহিত্য সম্মিলনের এই অপূর্ব সাফল্য বাংলার মুসলিম জীবনের জয়যাত্রার সূচনা, এক বিপুল শ্রীমণ্ডিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। ইহার পর সভাপতি তাঁহার শেষ মন্তব্যে শাখা-সভাপতিদের প্রশংসাবাদ এবং উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তারপর অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি, সভাপতিগণ, স্বেচ্ছাসেবকগণ এবং অন্যান্য যাঁহার সহযোগিতা দ্বারা সম্মিলনকে সাফল্যমণ্ডিত করিয়াছেন, তাঁহাদের সকলকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সকলের শেষে কবি নজরুল ইসলাম, বিদায় গীতি গাহিয়া গলিঙ্গন সম্মিলন সমাপ্ত করেন। সম্মিলনের দুইদিনে অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার শ্ৰীযক্ত প্রাণ কৃষ্ণ ভট্টাচার্য, স্যার পি সি রায়, অধ্যাপক উমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যক্ষ সরেন্দ্র নাথ মৈত্র, খান বাহাদুর নাসিরুদ্দীন, মনসী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমেদ, নোয়াখালীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ নুরন্নবী চৌধুরী, মিসেস নুরন্নবী চৌধুরী, অধ্যাপক আকরাম হোসেন, এম এ, অধ্যাপক সানাউল্লাহ এম, এ, মৌলবী আবদাল হোসেন এম, এ. এম এল নুরন্নেসা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী, প্রভৃতি খ্যাতনামা। সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিকগণ বিভিন্ন সময় উপস্থিত হইয়াছিলেন। যে সকল সুরশিল্পী গান, গাহিয়া সম্মিলনীর রস উৎসব সার্ধক করেন তাঁহাদের মধ্যে মিঃ একরামউদ্দীন আহমদ, শ্রী নলিনীকান্ত সরকার, শ্রী গোপাল চন্দ্র সেন গুপ্ত, শ্রী অনিল বিশ্বাস, শ্রী নুট বিহারী চট্টোপাধ্যায়, শ্রী ভাব দত্ত, স্ত্রী বট কৃষ্ণ গোস্বামী, প্রভৃতি সম্মিলনের উদ্যোক্তাদের কৃতজ্ঞতার অধিকারী। রবীন্দ্রনাথ, শ্রীযুক্ত রামানন্দ চট্রোপাধ্যায়, মৌলভী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, খান বাহাদুর কমরউদ্দীন, মওলবী আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী প্রভৃতি পত্র লিখিয়া সম্মিলনের সাফল্য কামনা করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কত লক্ষ সম্মিলনের সভাপতি ও কর্মীদের এক প্রীতি সম্মিলনে আহবান করিয়া সৌহার্দের পরিচয় দেন।”

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.09.09.pdf”]