You dont have javascript enabled! Please enable it!

ওয়াহিদুল হক

১৯৭১ সালের আন্দোলন হঠাৎ করে হয় নি। এর পেছনে সংগ্রাম ও চেতনার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই ইতিহাসের সাথে সবাই পরিচিত। তবে আমার বিশ্বাস যে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন এই চেতনা প্রবাহের ধারাকে এগিয়ে নিয়েছে সবচেয়ে বেশি এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা সবসময়ে এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে। নিজেদের বৃত্তে এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকেনি এবং এর চরিত্রও কেবলমাত্র কলা-ক্রিয়ার মধ্যে সীমিত ছিল না।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবার্ষিকী উপলক্ষে যেসব সভা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় তার মূল সুর ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা। স্বাভাবিক কারণেই পাকিস্তান সরকার এর বিরোধীতা করে। কিন্তু যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা এই উৎসব উদযাপনে সৃষ্টি হয় তা থামিয়ে রাখার মত শক্তি কারও ছিল না। এই উদযাপনের সরাসরি ফসল হচ্ছে ‘ছায়ানট’ যা পরে আমাদের গভীরতম বিশ্বাস ও মূল্যবোধ প্রসারের অন্যতম কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। অতএব বাঙালীদের রাজনীতি সবসময়ে তার সংস্কৃতির উপর নির্ভর করেছে। হয়ত বা অন্য যে কোনো দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের চেয়েও।

১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর খবর আসে যে মহাপ্রলয় হয়েছে তখন প্রথমে খুব একটা কাউকে নাড়া দেয়নি। ঐ সময়ে আমরা কয়েকজন খবরের ভাষা বুঝি যে ওখানটায় একটা কিছু ঘটেছে। তাড়াহুড়ো করে ‘দুর্যোগ নিরোধ কমিটি’ গঠন করে নগ্ন পদযাত্রা শুরু করি রাস্তায় ‘ভিক্ষা দাওগো, পুরবাসী’ গানটা গেয়ে। আমরা তখনকার দিনেই প্রায় ৫০ হাজার টাকা উঠাই। এর মধ্যে দুর্যোগের ব্যাপকতার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্যোগবাসীদের সাহায্য করার জন্য আমরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাতেই কাজ করতাম। জায়গার নাম ছিল চর কাজল (রায়পুরা)। ৭ই মার্চ সেখানে ছিলাম। পরে ঢাকায় ফিরে এসে দেখি খুবই খারাপ যদিও কত খারাপ তা ধারণা করিনি।

পঁচিশের রাতে আমি আমার সংবাদপত্র অফিসেই ছিলাম। সারারাত ধরে শুধু আওয়াজ শুনেছি। ২৬ তারিখে বের হওয়া যায়নি। অতএব ২৭ তারিখে আমরা অফিস ত্যাগ করতে সমর্থ হই।

আমার গাড়ীতে করে আমরা প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই এবং বন্ধু-বান্ধবদের খবর নেই। কাউকে পাই, কাউকে পাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা দেখে আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। ড. সরওয়ারের মাধ্যমে আমি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগ করি এবং তাকে বলি এই মুহূর্তে কি কাজ করা উচিত তা যেন সবাইকে জানিয়ে দেয়া যায়। এরপর আমি জনাব রেজা আলীর (বিটঙী) সাথে যোগাযোগ করি। তিনি ছিলেন একাই রাইফেল ক্লাবের সদস্য। আমি তাকে বলি তার কাছে যা আছে তা আমাকে দেবার জন্য। রেজা আলী আমাকে ১২টা রাইফেল দেন। আমি এই অস্ত্র নিয়ে সাভার চলে যাই এবং দেওয়ান ইদ্রিসের কাছে দিই। তিনি ছিলেন উক্ত এলাকার একজন নেতা। ২৭ তারিখ আমার স্ত্রীকেও সেখানে দিয়ে যাই এবং পরে ঢাকায় ফিরে আসি।

মির্জা সামাদ একজন প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা। তার সাথে আমার আলাপ হয় পরিস্থিতি নিয়ে। অস্ত্র সংগ্রহ করা এবং প্রয়োজনবোধে ভারতীয় সাহায্য নিয়ে পাকসেনাদের পরাজিত করা। আমার মনে হয়েছিল রাজনৈতিক কারণেই ভারত আমাদের পক্ষে থাকবে।

২রা এপ্রিল কামাল সিদ্দিকী, কাজী ইকবাল এবং আবুল খায়ের লিটুকে নিয়ে গাড়ীতে করে আমরা রওয়ানা হই। পথে সাভার থেকে হাসান ইমামকে তুলে নেই। তাঁর পরিবারও সাভারে ছিল দেওয়ান ইদ্রিসের গৃহে। আরিচা দিয়ে আমরা নৌকাপথে ঝিনাইদহ যাই এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি যে নদীর ওপারে ‘জয় বাংলা’ পতাকা উড়ছে! সেখানে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমার সাথে থানা পুলিশ অফিসার মাহবুবের আলাপ হয়। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী, কামাল সিদ্দিকী এবং আরও কয়েকজন। জানতে পারি কামাল সিদ্দিকী প্রায় ১০০ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন।

মেহেরপুর বর্ডার বি.এস.এফ সৈন্যদের সাথে দেখা হয়। আরও দেখা হয় কানাডীয় সাংবাদিকদের সাথে। তাঁরা আমার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন যা পরে বহু জায়গায় প্রচারিত হয়। বি.এস.এফ.-এর সহায়তায় আমরা কলকাতায় পৌঁছাই।

কলকাতায় গিয়ে রাজনৈতিক নেতা মনসুর হাবিবের বাসায় উঠি। এরপর দেখা করি ভবানী সেন এবং ইন্দ্রজিত গুপ্তের সাথে। তাদের বোঝাবার চেষ্টা করি যে ভারতীয় সেনাবাহিনী যদি যশোর দখল করে নেয় এবং দূর্গ স্থাপন করতে পারে তবে আমরা নিজেরাই যুদ্ধ করতে পারবো।

এর মধ্যে লক্ষ্য করি যে যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে তারা এখনও একত্রিত হয়নি যদিও ‘কিড স্ট্রিট’-এর এম.পি হোস্টেলে অনেকেই জমায়েত হয়েছে। আমার সাথে আওয়ামী লীগারদের কোনো যোগাযোগ ছিল না অতএব আমি হাসান ইমামকে বলি তাদের সাথে যোগাযোগ করতে। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই যে ঢাকায় ফিরে আমার পরিবারকে নিয়ে আসবো। ২৭ এপ্রিল ঢাকা পৌঁছি। লক্ষ্য করি যে শহরের চেহারা পাল্টে গেছে। চারদিকে থমথমে ভাব। মানুষ হাঁটাচলা করছে সন্ত্রস্তভাবে। সবার সাথে পরিচয়পত্র। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন বাড়ীতে হামলা হচ্ছে এবং মানুষদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তাদের প্রায় কেউই ফিরছে না।

এরই মধ্যে পালাবার একটা মোটামুটি রুট সৃষ্টি হয়েছে। শিবের বাজার হয়ে সোনাইমুড়ি দিয়ে বর্ডার পর্যন্ত যাওয়া যায়। অটোরিকশা দিয়ে আমরা কয়েকজন এভাবে আবার সীমান্ত পার হলাম। কিড স্ট্রিট তখন বেশ লোকারণ্য। অমিতাভ দাশগুপ্ত (ভারতীয় বামপন্থী নেতা) এদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং তিনি চেষ্টা করেন আমাকে এদের সাথে কাজ করার সুযোগ করে দিতে কিন্তু তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেহেতু জানা যায় আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কারও প্রবেশাধিকার নাই।

এরপর মৈত্রেয়ী দেবীর সাথে যোগাযোগ হয়। তিনি এই পর্যায়ে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। জানা যায় যে একটি বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। তাঁরই উদ্যোগে প্যাড ছাপানো হয়। স্ট্যাম্প, ইত্যাদিও প্রস্তুত করা হয়। আরও খবর পাওয়া যায় যে বি.এস.এফ-এর মাধ্যমে একটি বেতার ট্রান্সমিটারও পাওয়া যাবে।

এপ্রিলের শেষ দিকে খবর আসে যে ‘জয় বাংলা’ নামে একটি পত্রিকা বের হচ্ছে। এর অফিস বালু হাক-কাক লেনে। এও খবর শুনি আব্দুল মান্নান এই পত্রিকার দায়িত্বে আছেন। জহির রায়হান তাঁর সাথে যোগাযোগ করেছিলেন কিন্তু তাঁকে সাময়িক ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। যা হোক বেতার কেন্দ্রের ব্যাপার নিয়ে আমরা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ি। শামসুল হুদা চৌধুরী, মোস্তফা মনোয়ার, কামরুল হাসান, এম. আর. আখতার মুকুল এবং আমি একটি কমিটি গঠন করি। সার্কাস এভিনিউ-এর বাসায় আমরা বসতাম। ঠিক হয় যে জামিল চৌধুরী এবং মোস্তফা মনোয়ার বাজেট ও কর্মী তালিকা তৈরি করবেন। তাঁরা তা প্রস্তুত করেন এবং হিসেব দাঁড়ায় মাসিক ১৮,০০০ টাকা সব খরচ ধরে। কিন্তু আওয়ামী লীগ মহলে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে বাজেট ধরা হয়েছে দৈনিক ১৮,০০০ টাকা। এই সব ঘটনার পর আমরা বেতার কেন্দ্র থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি নিজেদের ইচ্ছায়।

আমি আবার ঢাকায় আসি এবং কয়েকজনকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে যাই। এর মধ্যে পরিচিত হচ্ছেন বেনু এবং শাহীন মাহমুদ। কলকাতায় যাবার আগে তাদের বিয়ে দিয়ে তারপর নিয়ে যাই। ততদিন পশ্চিম বঙ্গ শিল্পী সাহিত্যিক সহায়ক সমিতি গঠিত হয়েছে। দীপেন বিশ্বাস ছিলেন এর সংগঠক। অর্থও সংগৃহীত হয় এবং প্রায় সব শিল্পী-সাহিত্যিক এর সাথে জড়িয়ে পরেন। যে সাংস্কৃতিক দল তৈরি হয় তার সভাপতি হন সনজীদা খাতুন, আমি হই পরিচালক। এর নাম দেয়া হয় ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। মে মাসে এটা গঠিত হয়। স্কোয়াডের সদস্য সংখ্যা ছিল একশজনের মত।

১৪৪, লেলিন সরণীতে পি.পি.আই. অফিসের একটি কক্ষে রিহার্সাল হতো। তিরিশ দিনের প্রতিদিনই রিহার্সাল হয়। ৩রা জুন প্রথম অনুষ্ঠান হয় রবীন্দ্র সদনে। শাহরিয়ার কবির রচিত ‘রূপান্তরের গান’ নামে একটি গীতি আলেখ্য। আলোকসজ্জা ও মঞ্চ সাজাবার দায়িত্বে ছিলেন মোস্তফা মনোয়ার। যদিও আমাদের সামর্থ্য সীমিত ছিল তবুও অনুষ্ঠান কল্পনাতীতভাবে সফল হয়। বহু সুধীজনের সামনে আমাদের এই অনুষ্ঠান প্রচুর প্রশংসা লাভ করে। আমাদের মনোবল দারুণ বেড়ে যায়।

এরপর আমরা পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান করে বেড়াতে থাকি। যে ডাকতো আমরা যেতাম। পুজোর সময়ে প্রচুর অনুষ্ঠান করি। কলা মন্দিরেও আমাদের অনুষ্ঠান হয়। তবে আমাদের প্রধান কাজ ছিল ক্যাম্পে ক্যাম্পে সঙ্গীত পরিবেশন করা। বেনু এবং শাহীন মাহমুদ দলের নেতা ছিলেন। সকাল বেলা আমাদের একটি গাড়িতে যতজন ধরতো ততজনকে পাঠানো হতো একটি ক্যাম্পে। সারাদিন প্রোগ্রাম করে তারা ফিরতো আবার পরদিন যাবার জন্য। অনুষ্ঠান চলতো এক ঘন্টা ধরে। আমার অনুমান ২৫০ টিরও বেশি অনুষ্ঠান করা হয়।

সেপ্টেম্বর মাসে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। প্রথম, বিভিন্ন শিল্পী ও সাহিত্যিকদের একত্র করে একটি সংগঠন করা হয়। এর নাম দেয়া হয় ‘লিবারেশন কাউন্সিল অফ দি ইনটেলিজেন্টসিয়া’। এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক এ.আর.মল্লিক। জহির রায়হান এবং আলমগীর কবীর এই সংগঠনে বেশ সক্রিয় ছিলেন।

জহির রায়হান ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। কি প্রচণ্ড পরিশ্রমে সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন তা বলা যায় না। একটা বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। একদিন হঠাৎ খবর পাওয়া গেল যে ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির একটি প্রিন্ট কলকাতায় এসেছে। সারাদিন খোঁজের পর পাওয়া গেল সেটি। শেরপুর এলাকার একটি সিনেমা হলের মালিক সাহস করে নিয়ে এসেছেন। মালিক জানালেন এটা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং প্রিন্ট তিনি দেবেন না। তখন মীমাংসায় বসা হলো। জনাব খায়ের (সংসদ সদস্য) এর দায়িত্ব নিলেন। ষাট হাজার টাকা নগদ দেওয়া হলো মালিককে। এরপর ঠিক হলো ছবি দেখিয়ে যা আয় হবে তার অর্ধেক পাবে শিল্পীরা আর বাকিটা পাবে এম.সি.এ.। জহির রায়হান নিজে কিছুই নিলেন না। মনে রাখা দরকার সবার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।

একই মাসে জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এসে বলেন যে দিল্লীতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হতে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের পক্ষে আমরা যাবো গান শোনাতে। ৩৫ সদস্যের একটি দল নিয়ে আমরা পৌঁছাই। আমাদের অনুষ্ঠান অসাধারণভাবে সফল হয়। মঞ্চ নির্দেশনায় মোস্তফা মনোয়ার আশ্চর্যরকম আবহ সৃষ্টি করেন। সমগ্র অনুষ্ঠান যে কি রকম সাড়া জাগায় তা বলার নয়। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর ভারতীয় গণসঙ্গীতের দুই প্রধান পুরুষ বিনয় রায় এবং জ্যোতিন্দ্র মিত্র মঞ্চে আসেন। এবং গান শোনান। সে অভিজ্ঞতা বলার নয়।

এভাবে আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম বিভিন্ন শিবিরে। একই সাথে চলছিল অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টা। তখন ডিসেম্বর মাস। আমি গেলাম জহির রায়হানের কাছে এই ব্যাপারে আলাপ করা জন্য। তাকে খুব আনমনা মনে হচ্ছিল। আমি কথাটা তুলতেই তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, “ওয়াহিদ ভাই, এসবের প্রয়োজন হবে না। আমি ১৬ তারিখ ঢাকায় যাচ্ছি।” আমি এই কথার কোনো কিছুই বুঝলাম না। কারণ, দেশ যে মাত্র কদিন পরই স্বাধীন হবে ভাবিনি। যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় যে দেশ স্বাধীন তখন আমি নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে ছিলাম। আনন্দে যে কি করেছি তা বলার নয়। ১৬ তারিখেই দেশ স্বাধীন হয়। সেদিনের কথা জহির রায়হান বলেছিলেন দু’সপ্তাহ আগে।

-ওয়াহিদুল হক
মার্চ, ১৯৮৪

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!