You dont have javascript enabled! Please enable it!

এ, এম, এ মুহিত

নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালিরা সংগঠিত হতে থাকে। নিউইয়র্কের ‘ইষ্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকা’ ঘূর্ণিঝড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা নিয়ে কথা তুলে আর বাঙালিদের জন্য সাহায্যের আবেদন করা হয়। কাজী শামসুদ্দীন আর ডঃ আলমগীর মার্চ মাসে স্বাধীনতার দাবি উঠান, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের নালিশ করেন আর জাতিসংঘের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের আয়োজন করেন। ২৫শে মার্চ গণহত্যা শুরু হলে এই লীগ নাম পরিবর্তন করে এবং জুন মাস পর্যন্ত বাঙালি সমাজের প্রতিনিধি ভূমিকা পালন করে। ২৫শে পরে মার্চের শহরে শহরে লীগের শাখা গড়ে ওঠে তবে তাঁরা সকলেই নিজস্ব কার্যক্রম অনুযায়ী এগুতে থাকে। সমন্বিত সংগঠন গড়ে উঠতে কয়েকমাস চলে যায়। তবে নিউইয়র্কের ‘লীগ অব আমেরিকা’ই বাংলাদেশ আন্দোলনে অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করে।
মার্চ মাসে যখন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়, তখন স্বাভাবিকভাবে আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠি। আমাদের মধ্যে এই ধারণা ছিল যে, সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে এবং এর ফলে বাঙালিরা ও বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের অধিকার লাভ করবে। এখানে বলা দরকার যে, সামরিক বাহিনী বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে এ রকম একটা আশংকা আমরা করেছিলাম। কিন্তু যখন আলোচনা শুরু হয় তখন আমাদের মনে হয়েছিল যে এই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম।

২৫ তারিখ ভোর ৪টার দিকে আমেরিকা পররাষ্ট্র বিভাগের একজন বন্ধু আমাকে ফোন করে খবর শুনতে বলেন। আমার নিজের বাসায় রেডিও ছিল না তাই আমি গাড়ীতে গিয়ে রেডিও শুনি এবং ২৫শে মার্চের রাত্রির ঘটনা জানতে পারি। খবরটি শোনার পর একটি কথাই আমার বার বার মনে হচ্ছিলো এবং সেটি হচ্ছে ‘পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটেছে’। দূতাবাসের অবস্থা কিছুটা অদ্ভুত ছিল কারণ আমরা দেশ থেকে সঠিক বা পুরো খবর পাচ্ছিলাম না। অতএব আমাদের প্রতিক্রিয়াও কিছুটা ভিন্ন হচ্ছিল। পাকিস্তানী কর্মচারীরা তখন বেশ হতবাক। তারা মোটেই জারিজুরি খাটাচ্ছিল না, বরং বলা যায় যে কিছুটা চুপচাপই ছিল।

২৯শে মার্চ সোমবার ওয়াশিংটনে বাঙালিদের একটি সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। কেপিটাল হিল, হোয়াইট হাউস, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভবনের সামনে এই সমাবেশ হয়। প্রায় দুইশত মানুষ আসে এবং এদের মধ্যে বেশ কিছু সরকারী কর্মচারী এবং গবেষক ছিলেন। যথা জনাব সাফদার, জনাব খোরশেদ আলম, জনাব রহিম , অর্থনীতিবিদ মহিউদ্দীন আলমগীর, শামসুল বারী, ডঃ ইউনুস এবং আরো বেশ কয়েকজন। এখানে উল্লেখ করা উচিৎ যে, এই সমাবেশ আয়োজনে দূতাবাসের নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ন যেহেতু তারাই ফোনের মাধ্যমে বেশিরভাগ যোগাযোগ স্থাপন করেন। সমাবেশ শেষ করার পর আমার বাসায় প্রায় ৭০জন মিলিত হন এবং ভবিষ্যত কর্মপন্থা নিয়ে আমরা আলোচনা করি।

পাকিস্তান দূতাবাসের অর্থনৈতিক কাউন্সিলর হিসেবে আমেরিকার সহকারী পর্যায়ে বিভিন্ন মহলে আমার যোগাযোগ ছিল এবং আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, এদের সঙ্গে আমার সংযোগগুলি আন্দোলনের পক্ষে ব্যবহারের চেষ্টা করবো। স্টেট ডিপার্টমেন্টে ক্রেইগ বাক্সটার আমাদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রেখেছিলেন। তিনি বহু তথ্য আমাদের দেন যেগুলো আমাদের আন্দোলনের পক্ষে সহায়ক হয়ে উঠে। টাউনসেগু সোয়েজি এইড দফতরে বাংলাদেশ ডেস্ক এর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি আমাদের আন্দোলনের এমনই সমর্থন ছিলেন যে আমেরিকার নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। এছাড়া আরচার ব্লাড, যিনি ঢাকায় কনসান জেনারেল ছিলেন বিভিন্ন ধরনের তথ্য যেসব তথ্য প্রেরণ করেন সেসব কাহিনী ওয়াশিংটনে প্রকাশ পেলে আমাদের আন্দোলন আরও জোরদার হয়। এপ্রিলের শুরুতে হারভার্ডের মাস্ন, মার্গলিন ও ডর্ফম্যান বাংলাদেশ সমস্যার একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের স্বপক্ষে বাংলাদেশের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মার্গলিন ও পরে ডর্ফম্যান আলমগীর মহিউদ্দীনকে নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে কংগ্রেসে জোর তদবীর চালান । পয়লা এপ্রিল সিনেটর কেনেডী, সিনেটর মনডেল বাংলাদেশের স্বপক্ষে জোরালো বিবৃতি দেন। আমার বেশিরভাগ সময় কাটত বিশ্বব্যাংক, স্টেট ডিপার্টমেন্ট, এইড, কংগ্রেস আর সংবাদপত্রের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ আলোচনায়। আমি তাঁদের এটাই বুঝানোর চেষ্টা করতাম যে বাংলাদেশ আর পাকিস্তান কোনদিনই এক হবে না এবং এটা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ পাকিস্তানকে হত্যাকান্ড বন্ধ করে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে বাধ্য করা। আর এটা সম্ভব সাহায্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। কারণ পাকিস্তান যতই সাহায্য পাবে ততই সে তার হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাবে।

এপ্রিল মাস পর্যন্ত আমি আমার কাজ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাই কিন্তু দূতাবাসের ব্যবস্থা এরপর পরিবর্তন হয়। এইসময় বাঙালি প্রতিরোধের শেষ কেন্দ্রস্থল ভেঙ্গে যাওয়ার পর পাকিস্তানীরা নিশ্চিত হয় যে তাদের পুরোপুরি পক্ষে চলে গেছে এবং তারা তখন আমাদের উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে।
৮ই এপ্রিল ‘শাহীন’ এবং ‘ময়নামতি’ নামে দু’টি পাকিস্তানি জাহাজ থেকে কয়েকজন বাঙালি নাবিক পালিয়ে যান। তখন জাহাজগুলো বালটিমোরে অবস্থান করছিলো। তাঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির জনাব গ্রিনোর সঙ্গেও যোগাযোগ হয়। তিনি তাঁদের উদ্ধার করেন এবং উকিলের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন যিনি তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেন।

১৩ই এপ্রিল বিবিসির মাধ্যমে জাকারিয়া চৌধুরী ঘোষনা করেন যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ থেকে আমরা অনুমান করি যে আন্দোলন এবার নতুন পর্যায়ে শুরু হবে। জাকারিয়া চৌধুরীর সঙ্গে আমার টেলিফোনে যোগাযোগ হয় এবং তিনি দীর্ঘায়িত মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে উপদেশ দেন। এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ যেতে পারে। ১৬ই এপ্রিলে সম্মেলনে আমি পাকিস্তানী প্রতিনিধি হিসেবে যাই এবং সেখানে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার প্রচন্ড বাক বিতন্ডা হয়। এই বাক বিতন্ডার বিষয় ছিল তুরস্ক কর্তৃক পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দান। এরপর তিনদিন পর আমাকে আমাকে এই সম্মেলন থেকে প্রত্যাহার করা হয় এবং চলাফেরার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এক কথায় আমাকে যতদূর সম্ভব অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আমি তবুও আমার কাজ চালিয়ে যেতে থাকি। আমি ১২ টার সময় বের হয়ে যেতাম এবং প্রায় চারটার দিকে অফিসে ফিরতাম। এই সময়টুকুতে আমি আমার যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ চালিয়ে যেতাম।

২৭শে এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ম্যাকনমারার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। আমি পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের আবেদন জানাই। তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের সহকারি পরিচালক গ্রেগিরু ভোটার সঙ্গে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রাখতে থাকি। তিনি বাংলাদেশের বিষয়টি দেখাশুনা করতেন। তাছাড়া ইউ এস এইডের মিঃ ডন ম্যকডোনাল্ড এর সঙ্গেও যোগাযোগ অব্যাহত থাকে।

১৩ই এপ্রিল দূতাবাসের কর্মচারী এবং আরো কয়েকজন চাঁদা তুলে হারুন রশীদকে কলকাতায় পাঠান সংবাদ সংগ্রহ এবং সঠিক অবস্থান জানতে। হারুনুর রশীদ বিশ্বব্যংকে চাকুরী করতেন। তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনে অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি কলকাতায় গিয়ে মুজিব নগর সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এর সাথেও দেখা করেন। তিনি শপথ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন। ফিরে এসে তিনি খুব একটা উৎসাহব্যাঞ্জক খবর দিতে পারেন নাই। তিনি জানান, অবস্থা এখনো পরিস্কার না এবং আন্দোলনে ভারতের কাছ থেকে পূর্ন সমর্থন পাচ্ছে না। এসময় ‘আমেরিকান সোসাইটি ফর আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ‘ল’ এর বার্ষিক অধিবেশনে গ্যাটলিয়ের ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং অব্যাহত রয়েছে। এই সম্মেলনে আমি যোগ দিই কিন্তু দূতাবাস অন্য একজন পাকিস্তানীকে প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করে। এপ্রিল মাসে ২৬ তারিখে নিউইয়র্ক দূতাবাস থেকে মাহমুদ আলী বাংলাদেশের পক্ষে তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেন। এমনিতেই তাঁর প্রতি পাকিস্তানী গোয়েন্দারা প্রসন্ন ছিলেন না যেহেতু তিনি সে বছর জাঁকজমকের সাথে একুশে ফেব্রুয়ারী পালন করেছিলেন। পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনী সেই থেকে তাঁর পিছে লেগেই ছিল।

মে মাসের প্রথম পক্ষেই বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে । ৯ ই মে জনাব এম এম আহমেদ ওয়াশিংটন পৌঁছেন। ১১ই মে পাকিস্তান সমস্যার ওপর কংগ্রেসে ‘গ্যালাগার শুনানী’ শুরু হয় । ১২ই মে জনাব রেহমান সোবাহান একটি প্রেস কনফারেন্স করেন এবং সেটি অত্যন্ত সফল হয় । এই সাংবাদিক সম্মেলনের পর জনমত আমাদের আন্দোলনের পক্ষে আরো তীব্র হয়ে উঠে এবং প্রচুর প্রচার হয় । একই সময় দূতাবাসের সহকারী শিক্ষা অফিসার জনাব এ আর খান গ্যালাগার শুনানীতে উপস্থিত থাকার জন্য চাকুরীচ্যুত হন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ লবী সংগঠিত ও জোরদার হয়ে উঠে। বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলে চাপ প্রয়োগ আরো তীব্র এবং ফলপ্রসূ হতে থাকে। এই প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল একটিই। তা হলো পাকিস্তানকে প্রদত্ত সামরিক এবং অন্যান্য সাহায্য বন্ধ করা।

জনাব এম এম আহমেদ ওয়াশিংটনে এসে কয়েকটি কাজ করার চেষ্টা করে। তিনি সব জায়গায় প্রচার করতে থাকেন যে অবস্থা যত খারাপ বলা হচ্ছে মোটেই ততটা খারাপ নয়, আওয়ামী লীগের সমর্থন সর্বব্যাপী নয়, তাছাড়া বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জানান যে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান একান্ত প্রয়োজনীয়। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা মার্চের ‘গন্ডগোলের’ কারনে খারাপ হয়ে গেছে। অতএব ঋণ শোধের সময় বাড়িয়ে দেওয়া হোক।

জনাব এম এম আহমেদের সাথে পূর্বে থেকেই আমার আলাপ ছিল এবং তাঁর সাথে এক দীর্ঘ বৈঠক হয়। সেখানে আমরা খোলাখুলি আলাপ করি । তিনি খোলাখুলি বলেন যে, নির্মম ও দুঃখজনক ঘটনা চতুর্দিকে ঘটেছে ব্যপকভাবে। সবার মানসিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ এবং বাঙালিদের মনোভাব সহজ অনুমেয়। মার্চের ঘটনার পর যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা সারানো সত্যিই সমস্যা হবে। তিনি আরো বলেন যে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করতে আসলেই আগ্রহী। তিনি একদল মধ্যপন্থী আওয়ামী লীগের লোকজন খুঁজছেন এবং অবশ্যই ৬ দফাতে যতদূর মেনে নেয়া হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ইয়াহিয়া খান আসলেই যা চেষ্টা করছেন তা কি করতে পারবেন। তিনি বলেন সে ব্যপারে নিশ্চিত কোন উত্তর দিতে পারছি না। সেটি একটি কঠিন সমস্যা বটে । এম এম আহমেদ আরো বলেন যে, মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা চলছিল তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবগুলিই কার্যকরী কিনা। তিনি বলেছিলেন যে, প্রস্তাবগুলো কার্যকরী করা সম্ভব তবে সামান্য যৌক্তিকরণের প্রয়োজন আছে। যেমন প্রতিরক্ষার জন্য শিল্পখাত এবং কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন কেন্দ্রের হাতেই থাকবে। বৈদেশিক মুদ্রার ব্যপারে দুটি একাউন্ট তখনই সম্ভব নয়, ভবিষ্যতে হতে পারে। বিদেশী সাহায্য সংক্রান্ত আলাপ আলোচনা প্রদেশভিত্তিক হওয়া উচিৎ না। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে সাহায্যকারীর সাথে আলাপ শুরুর আগে ভিন্ন প্রদেশের প্রয়োজন ও দাবীগুলো সম্পর্কে একমত হওয়া যেতে পারে ও তাঁর ভিত্তিতে আলোচনা হতে পারে । ইয়াহিয়া খান তাঁকে ভূট্টোর সঙ্গে আলাপ করতে বলেন। কিন্তু ভূট্টো কেবলমাত্র রাজনীতি নিয়েই আলাপ করতে চান। তিনি বলেন তাঁর মতে ভূট্টো প্রস্তাবগুলি কোনমতেই মেনে নিতে রাজী ছিলেন না। যদিও তিনি (এম এম আহমেদ) আমাকে জানান যে, ২৫শে মার্চের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে তাঁর কোন ধারনাই ছিল না যে এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে, আমার বিশ্বাস , তিনি ঢাকা ত্যাগের আগেই তাঁর আভাস পেয়েছিলেন। ব্যাক্তিগত পরামর্শ হিসেবে তিনি আমাকে জানান যে দেশে ফিরে যেতে চাইলে আমি কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম সচিব হিসেবে কাজ করতে পারি।

মে মাসের শেষের দিকে আমেরিকার কংগ্রেসে ‘ফরেইন এসিস্টেন্স এমেন্ডমেন্ট’ প্রস্তাব পেশ করা হয়। সিনেটে স্যাক্সাবি-চার্চ প্রস্তাবে পাকিস্তানে সব সাহায্য বন্ধ করার দাবী করা হয়। আর হাউস অব রিপ্রেজেন্টিটিভে গ্যালাগার প্রস্তাবে একই দাবী উত্থাপন করা হয়। এদিকে দূতাবাসের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পড়ে। বহু লোককে চাকরীচ্যুত করা হচ্ছিল। আমরা দেশের কোন খবরই পাচ্ছিলাম না এবং আমাদের কোন কাজও করতে দেয়া হচ্ছিল না। বহু পাকিস্তানকে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং তাঁরাই সব কাজ করতো। এ সময় দূতাবাসের উপ-প্রধান জনাব এনায়েত করিম হৃদ রোগে আক্রান্ত হন। তিনি ছিলেন বাঙালিদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্মকর্তা।

২৯ শে মে শনিবার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে নিউ ইয়র্কে আমার সাক্ষাত হয়। একই সময় জনাব এফ আর খানে নেতৃত্বে শিকাগোয় ‘ডিফেন্স লীগ অব বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। মোটামুটি এ রকম চিন্তা করা হয় যে এই সংগঠনটি আমেরিকার বিভিন্ন বাঙালিদের সমন্বয়কারী সংগঠন হিসেবে কাজ করবে। ওয়াশিংটনে ‘বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার’ও একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে যেসকল আমেরিকান ডাক্তার কোন না কোন সময়ে কাজ করতেন তাঁরা এই সংগঠনে সুক্রিয় ছিলেন। সবার সাথে আলোচনার পর স্বিদ্ধান্ত হয় যে, মাহমুদ আলী (নিউ ইয়র্কে) গঠিত সংগঠনকে আর্থিক সাহায্যদান করা হবে এবং আমি কোন বাঙালি সংগঠনে ১৫ই জুন যোগদান করবো। ৬ই জুন শিকাগোতে জনাব এফ আর খানের বাসায় একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত বাঙালি আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো সবাই উপস্থিত হয়। এই সভাতেই ডিফেন্স লীগ অব আমেরিকা জন্মলাভ করে। এক্ষেত্রে উল্ল্যেখ্যে যে, জনাব খানের বহু ইহুদী বন্ধু আর্থিকভাবে এই আন্দোলনকে সাহায্য করেন।

এই সভায় আমি কয়েকটি সমস্যার কথা উল্লেখ করি। প্রথমটি হচ্ছে নিউইয়র্কে মাহমুদ আলীকে যে সাহায্য দেওয়ার কথা ছিল তা দেওয়া হয় নাই। দ্বিতীয়তঃ কার্যনির্বাহী পরিষদের বিভিন্ন সদস্য বার বার দূতাবাসের কর্মচারীকে আনুগত্য প্রকাশের জন্য কিন্তু নিজেরা আমেরিকাবাসী হওয়া সত্ত্বেও ছদ্মনাম ব্যবহার করছিলেন। আমি প্রশ্ন করি যে তাঁরা যখন নিজেরাই ছদ্মনাম ব্যবহার করছেন তাহলে কিভাবে আশা করেন যে দূতাবাসের কর্মচারীরা আনুগত্য প্রকাশ করবেন। অবশ্য এখানে উল্ল্যেখ্য যে তাঁদের কর্মকান্ড বা স্বিদ্ধান্তে আমি নিজে খুব একটা প্রভাবিত হই নাই যেহেতু আনুগত্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত আমি আগেই নিয়েছিলাম।

এর মধ্যে দূতাবাসে আমার পদ বিলুপ্ত করা হয় এবং পাকিস্তানে বদলী করা হয়। বস্তুতপক্ষে আমি শিকাগোর সভা থেকে আমি এই খবর পাই। এ সংবাদ পাওয়ার পর আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে ইয়াহিয়া খানকে একটি চিঠি লিখি। বলাই বাহুল্য। চিঠির কোন উত্তর আমার কাছে আসে নাই। ৩০শে জুন মুজিবনগর সরকারের প্রতি আমি আনুগত্য প্রকাশ করি। আমার বাসা বেসরকারী দূতাবাসে পরিনত হয় এবং আমি মুজিব নগর সরকারের পক্ষে কাজ করি। তবে আমার স্বিদ্ধান্তের খবর সাময়িকভাবে গোপন রাখা হয় যেহেতু আমার কিছু সহকর্মী আনুগত্য প্রকাশ করতে আগ্রহী ছিলেন এবং তাঁদের কিছু সময়ের প্রয়োজন ছিল।

জুন মাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল কংগ্রেসে বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ওপর শুনানী। জন রেডি ঢাকা থেকে ফিরে এই শুনানিতে স্পষ্ট বিবৃতি রাখেন। তিনি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার সপক্ষে মন্তব্য রাখেন। এই শুনানী ও আরো অনেক কর্মকান্ড থেকে এটাই প্রমানিত হয় যে মার্কিন সরকারী বিপক্ষে একটি প্রভাবশালী মহল বাংলাদেশকে সরাসরি সমর্থন করেছেন। ৫ই জুলাই মুজিবনগর সরকার সমস্ত বাঙালি কূটনীতিককে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আহবান জানান। আমেরিকায় অবস্থিত বেশিরভাগ কূটনীতিক সিদ্ধান্ত নে যে, আগষ্ট মাসের প্রথমদিকে মুজিবনগর সরকারের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করবেন। এই সব তথ্য আমি মুজিব নগর সরকারকে জানাই। এ সময়ের মধ্যে জনাব এনায়েত করিম দ্বিতীয়বারের মতো হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এই ঘটনা মানসিকভাবে অনেক কূটনীতিককে দুর্বল করে দেয়। সবার মধ্যে “ কি হবে, কি হয়” একটা ভাব দেখা যায়। আমি মুজিব নগর সরকারকে আবার জানাই যে অবস্থার অবনতি ঘটেছে এবং অনেকে আনুগত্য প্রকাশ নাও করতে পারে।

এতদিন পর্যন্ত আমি জনসমক্ষে কোন বক্তব্য রাখিনি কিন্তু এই অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নিই যে এবার খোলাখুলি কাজ করতে হবে। সিনেটর কেনেডি আমাকে আমন্ত্রন জানান একটি সাক্ষাৎকারে তাঁর বদলে উপস্থিত হবার জন্য। ২৭শে জুলাই এন বি সি টেলিভিশনের ‘কমেন্টস’ অনুষ্ঠানে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাখ্যা করি কেন পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করেছি। অনুষ্ঠানটি ১লা আগষ্ট প্রচারিত হয়।

পাকিস্তান এ সময় কিছু বাঙালিকে তাঁদের পক্ষে প্রচারের জন্য আমেরিকা পাঠায়। ওয়াশিংটনে যারা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে দুজনের সাক্ষাত হয় জুলাই মাসের প্রথম দিকে । জনাব মাহমুদ আলী তো বলে বসলেন যে গণহত্যা কিছু হয়নি। শুধু দুস্কৃতিকারীরা কিছু মারা গেছে আর বাঙালিরা বিহারীদের মেরেছে। তিনি আরও জানালেন অবস্থা আয়ত্তের মধ্যে আর শেখ মুজিবের কোন জনপ্রিয়তা নেই। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম যে তাঁর আত্মীয় সিলেট হাঁসপাতালের ডাঃ শামসুদ্দিনকে কে বা কেন হত্যা করেছে। তিনি অবলীলাক্রমে মিথ্যে কথা বললেন যে বেখেয়ালীতে গোলাগুলিতে মৃত্যু হয়েছে। তিনি আমাকে দেশে ফিরতে উপদেশ দিলেন। তবে এও বললেন যে কেন্দ্রীয় সরকারে গেলে ভাল হয়। তার কথাবার্তা আওয়ামী লীগ বিশেষ করে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তাঁর উষ্মা ও ক্ষোভ প্রকাশ পেল। তিনি দূতাবাসের হুকুমমত বিভিন্ন লোকের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করেন এবং সংবাদপত্রে চিঠিপত্র লিখেন। জনাব হামিদুল হক চৌধুরীকে খুন খারাবীর বিবরণ দিতে বেশ বস্তুনিষ্ঠ বলেই মনে হলো। তিনি বললেন যে বিহারীরা বাঙালিদের খুব মেরেছে এবং সেনাবাহিনী জুলুম করেছে। সব পরিবারেরই কিছু কিছু না কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অথবা প্রান হারিয়েছে। যে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে তা সারতে বহুদিন লাগবে। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে ভাব করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নাই। কিছুদিন হয়তো দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হিসেবে থাকতে হবে। তাঁর মূল কথা ছিল দোষ যারই হোক ভারতের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের বন্ধুত্ব হতে পারে না। আমি যখন তাঁকে বললাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে আর কিছুদিন পরে যেখানে আমরা ইতিহাস বিশ্লেষন করতে পারবো। তখন তিনি রাগের সাথেই বলেন, “ তোমাদের বাংলাদেশে আমাকে পাবে না”। আমি হেসে বললাম, “আমরা তাহলে জেনেভায় বসেই বিগত দিনের আলোচনা করতে পারবো। হক সাহেব অনেক গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের সাথে দেখা করেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে পূর্বপাকিস্তানের জন্য বিশ্বব্যাংক কি করতে পারে, কি উপদেশ তিনি এ ব্যাপারে মিঃ ম্যাকনামারকে দিতে পারেন। দূতাবাস তাকে নানা কাজ করতে বলে ও তাঁর জন্য চিঠি পত্র তৈরি করে দেয়। কিন্তু তিনি নিজের ইচ্ছায়, নিজের ঢং এ পাকিস্তানের প্রচারকার্য করেন।

বাঙালি কূটনীতিক জনাব এস এ করিম দূতাবাসের কাজে বিদেশ গিয়েছিলেন। তিনি নিউ ইয়র্ক পাকিস্তান মিশনের দ্বিতীয় ব্যাক্তি ছিলেন এবং মার্কিন মুল্লুক যত বাঙালি কর্মকর্তা ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র। তিনি প্রথম থেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি আফ্রিকা সফর শেষ করে ওয়াশিংটনে আসেন। তিনি এসে তাঁর সহকর্মীদের বুঝালেন যে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করার আর যৌক্তিকতা নাই আর বাংলাদেশ সরকারের আহবানে সাড়া দিতে কোন দ্বিধা দ্বন্দের অবকাশ নেই। তিনি বলিষ্ঠভাবে একে একে সব কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান। সবচেয়ে সমস্যা ছিল অসুস্থ জনাব এনায়েত করিমকে নিয়ে। তিনি অত্যন্ত অসুস্থ ছিলেন এবং তাঁর চিকিতসার জন্য যথেষ্ট অর্থের প্রয়োজন ছিল। তাঁর এই অবস্থা সহকর্মীদের মন দুর্বল করে দেয়। পরে সিদ্ধান্ত হল করিম দম্পতির সাথে সরাসরি আলাপ করাই ভাল। কিন্তু বেগম করিম এবং জনাব এনায়েত করিম উভয়ে অত্যন্ত সাহস দেখান। জনাব করিম বলেন যে , তাঁর স্বিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি বলেন, “ আমি আপনাদের সাথেই আছি”।

৩রা আগষ্ট মুজিবনগর পররাষ্ট্র সচিব জনাব মাহমুদ চাষী ও তাঁর সহকারী তৈয়ব মাহতাবের সাথে আমার কথা হয়। এছাড়া বিচারপতি চৌধুরীর সাথেও আমি যোগাযোগ করি । ৪ঠা আগষ্ট এক সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করা হয়। সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করি আমি এবং ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকার ন্যাশনাল এফেয়ার্স বিভাগের সম্পাদক রোনাল্ড কোভেন এতে আমাকে সহযোগীতা করেন। তিনিও নিউইয়র্ক টাইমস এর বেঞ্জামিন ওয়েলসকে একদিন আগে আমি জানিয়ে দিই যে সম্মেলনে আমার সব কাছের বন্ধু আনুগত্য পরিবর্তন ঘোষণা করবেন। একই সময় প্রেসিডেন্ট নিক্সন এর প্রেস কনফারেন্স হচ্ছিল যার ফলে আমাদের আনুগত্য প্রকাশের সংবাদ ততটা ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করেনি। তবে এই সাংবাদিক সম্মেলনে নিক্সন বলেন যে আমেরিকা সবসময়ই “পশ্চিম পাকিস্তানের” সাথে থাকবে। তাঁর এই বিশেষ বাক্য ব্যবহার সবারই কানে লাগে এবং এটি ব্যাপক প্রচার লাভ করে। ৫ই আগষ্ট জনাব এম আর সিদ্দিকী আমেরিকায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আগমন করেন। ৩রা আগষ্ট গ্যালাগার সংশোধনী পাস হয়। যদিও সিনেটে এর ভবিষ্যত কি হবে তা নিশ্চিত ছিল না তবুও এটা ছিল বিরাট বিজয়। ১৯শে আগস্ট টরেন্টোতে অক্সফাম আয়োজিত একটি বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। স্যার হিউ কিননীসাইত এতে সভাপতিত্ব করেন আর বৃটেনের জুডিথ হার্ট, ভারতের জেনারেল চৌধুরী , প্রফেসর নুরুল হাসান এবং কানাডায় বহু সংসদ সদস্য এই সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলো সুবিখ্যাত ‘ টরেন্ট ডিকলারেশন’ হিসেবে পরিচিত। এই সম্মেলনে জনাব এম আর সিদ্দিকী এবং আমি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলাম।

এর কিছুদিন পর শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কিত খবর আসে। আমরা এর বিরুদ্ধে জোর তৎপরতা চালাতে থাকি। এর বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়। বেশ কিছু কংগ্রেস সদস্য বিবৃতি দেন এবং এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আগষ্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে আমরা ব্যস্ত ছিলাম বিভিন্ন জায়গায় সভাসমিতি করার মধ্যে। অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল এবং আমরা সেই সব জায়গায় গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি ও প্রবাহ ব্যাখ্যা করতাম। ৩রা সেপ্টেম্বর ডাঃ মালিক গভর্ণর হয়। কিছুদিন পরেকটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে যা পরবর্তীকালে মিথ্যা প্রমানিত হয়।

লস এঞ্জেলস, সান ফ্রান্সিসকো, ডেনভার এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সভা করি। ফিলাডেলফিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান “ ফ্রেন্ডস অব ইষ্ট বেঙ্গল” খুবই সক্রিয় ছিল। সেখানে সুলতানা ক্রিপেনডরফ এবং মাজহারুল হক একটি একটি টিচ-ই এর ব্যবস্থা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মিঃ চার্লস কান এর উদ্যোক্তা ছিলেন। এখানে উল্ল্যেখযোগ্য যে কয়েকজন পাকিস্তানীও এত বাংলাদেশের সমর্থনে অংশগ্রহন করেন যথা জনাব এজাজ আহমেদ। পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সাহায্যে একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় হয়ে উঠে ঐ সময়ে। সিনেটে এ বিষয়ে তর্ক বিতর্ক চলে। অনেকরই মত ছিল যে খাদ্য সরবরাহকে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখা উচিৎ। আমরা যুক্তি দেখাই এ সাহায্য দিলে যে হত্যাযজ্ঞ চলছে তা কখনো বন্ধ হবে না। বরং এতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাহায্যই হবে।

একই সময়ে পাকিস্তান সাহায্য গ্রুপের মিটিং হয়। আমরা বিভিন্ন মহলে এর বিরুদ্ধে তদবির করতে থাকি। হারুনুর রশীদ ও রেহমান সোবহান এ ব্যাপারে খুব সচেষ্ট ছিলেন। পাকিস্তান চাচ্ছিল তাদের দু’শ চল্লিশ মিলিয়ন ডলার মওকুফ করে দেয়া হোক। আমেরিকা এতে রাজি হচ্ছিল না এবং চাপ দিচ্ছিল একশ মিলিয়ন ডলার দাবী থেকে কমিয়ে আনার জন্যে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত ছাড়াই মিটিং শেষ হয়। এখানে একটা বিষয় বলা দরকার। ইউ.এস.এইডের প্রতিনিধি মরিস উইলিয়ামস প্রথমে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ঢাকা সফরের পর তিনি বোধ হয় মত পরিবর্তন করেন। পরবর্তীকালে এন্ডারসন পেপারস থেকে দেখা যায় যে পাকিস্তান সমর্থন ছিল নিতান্তই ওপরতলার ব্যাপার। প্রেসিডেন্ট নিক্সন আর তার উপদেষ্টা হেনরী কিসিঞ্জারই সে কার্যক্রমের হোতা ছিলেন।

আগেই বলেছিলাম জুন মাসের দিকে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বাংলাদেশ এনফরমেশন সেন্টার স্থাপিত হয়। প্রথমে এটা পরিচালনা করেন মিসেস আনা টেইলর এন্ড ডেভিড ন্যালিন। বাঙালিদের মধ্যে রাজ্জাক খান ও তাঁর বন্ধুবর্গ এবং মহসীন সিদ্দিকী এটা চালাতেন। এর প্রধান কাজ ছিল কংগ্রেসে লবি করা ও বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করা। এই সেন্টারের সঙ্গে বাঙালি জামান(কচি) এবং মার্কিন ডেভিড ওয়াইজব্রডের নামেই প্রচার লাভ করে। এরা জুন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন ও তৎপরবর্তীকাল পর্যন্ত সক্রিয় থাকেন। আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্র ও শিক্ষকেরা দল বেঁধে ওয়াশিংটনে এসে ক্যাপটিল হিলে লবি করে যেতে ওই সংগঠনের সাহায্য নিতেন। বোষ্টন , ইন্ডিয়ানা, টেকসাস, শিকাগো, নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, লস এঞ্জেলস এবং আরো অনেক জায়গা থেকে বাঙালি ছাত্র , শিক্ষক ও গবেষকরা নির্দিষ্ট নির্ঘন্ট অনুযায়ী ওয়াশিংটনে এসে লবি করতেন। আমরা সব সিনেটর এবং কংগ্রেসম্যানদের ফর্দ বানিয়ে নিশ্চিত করাতাম যে সবাইকে আমাদের বলার সুযোগ হয়েছে। মূলতঃ মার্কিন নাগরিকরা বেশী করে লবী করতো, বাঙালিরা তাঁদের সঙ্গ দিতেন। আমার মনে হয় লবি দল হিসেবে আমরা বেশ সুসংগঠিত ও সুসংহত ছিলাম। আর এতে ছিল বাংলাদেশ মিশন ও ইনফরমেশন সেন্টারের যৌথ প্রচেষ্টা। আমার মনে পড়ে কোনদিন বিকেলে হয়তো কেউ আমার বাসায় রাত্রি যাপনে আসলেন আর পরের দিন সকালেই কেপিটল হিলে চলে গেলেন এবং সেখান থেকেই বিকালে বিদায় নিয়ে তাঁর কর্মস্থলে ফিরে গেলেন। এরা নিজের ইচ্ছায় আসতেন, দেশপ্রেম তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। অক্টোবরে লবির কাজ তুঙ্গে কারন তখন টার্গেট ছিল বৈদেশিক সাহায্য বিল।

সেপ্টেম্বরের শেষে অথবা অক্টোবরের শুরুতে বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতিসংঘ বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল পাঠানো হয় এবং তাতে আমিও অন্তর্ভূক্ত ছিলাম। পাকিস্তান এইড কনসরটিয়ামের সভা শেষে আমি নিউইয়র্কে প্রতিনিধি প্রতিনিধি দলে যোগ দিই। আমরা বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করি এবং আন্দোলনের পক্ষে ৪৭টি সমর্থনসূচক বিবৃতি সংগ্রহ করি। কমবেশী সব দেশই আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং সবাই চাচ্ছিল একটি রাজনৈতিক সমাধান। এ সময়ের একটি বিশেষ ঘটনা আমাকে আলোড়িত করে। ১৪ই অক্টোবর বেলমন্ট প্লাজা হোটেলে রাত ৯/১০টার দিকে ডঃ এ আর মল্লিক, ডঃ মফিজ চৌধুরী এবং আরো কয়েকজন এক সাথে বসে আলাপ করছিলাম। এমন সময় খবর এলো যে মোনায়েম খান মারা গেছেন। আমরা আনন্দে হর্ষধ্বনি করে উঠি। এমন সময় হঠাৎ করে মল্লিক সাহেব গম্ভীরভাবে বললেন যে, দেখো, যুদ্ধ আমাদের কি রকম করে ফেলেছে। একটি মানুষের মৃত্যুতে আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠি।

৮ই নভেম্বর পাকিস্তানে সব ধরনের অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১০ই নভেম্বর “পাকিস্তান অর্থনৈতিক সাহায্য” বিল পাস হয়। এ বিলে বলা হয় যে, যতদিন পর্যন্ত রিফিউজিদের ফিরে যাওয়ার মত অবস্থার সৃষ্টি হবে না ততদিন কোন অর্থনৈতিক সাহায্য করা হবে না।

আর একটি গুরুত্বপূর্ন প্রস্তাব ছিল যে “হেলষ্টকি প্রস্তাব”। এই প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ন অংশ ছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানকে চাপ প্রয়োগ করা।

নভেম্বরের শেষে বর্ডার এলাকায় গোলাগুলি শুরু হবার পর বিভিন্ন মহলে অন্য ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যেতে লাগলো। তখন সবাই চিন্তা করছিল কিভাবে এই রক্তক্ষয় বন্ধ করা যায়। সে বাঙালিদেরই হোক, পাকিস্তানীদেরই হোক কিংবা রাজাকারদেরই হোক। এছাড়া পুনর্বাসন নিয়েও চিন্তাভাবনা শুরু হয়। এমনকি মুজিব নগরের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন দেশ পরিচালন করতে পারবে কিনা তা কিয়েও কিছু কিছু প্রশ্ন উঠে। আমার মনে পড়ে সিনেটর স্যাক্সাবি, যিনি এই আন্দোলনের একজন গোঁড়া সমর্থক ছিলেন, আমাকে একদিন ডেকে নিয়ে বললেন,” আমাকে আশ্বাস দাও যে , দেশ স্বাধীন হলে তোমরা তা পরিচালনা করতে পারবে।”

ডিসেম্বর মাসে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমরা এক প্রকার নিশ্চিত ছিলাম যে যুদ্ধে আমরা জয়ী হবোই। যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে একটা ঘটনার কথা উল্ল্যেখ করা যায়। অক্টোবর মাসের দিকে সারওয়ার মুর্শেদ খানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান এর পক্ষ থেকে চিঠি আসে। এতে ছিল বিমান বাহিনী গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং ভারী কামান-গোলার বিশদ বিবরণ কিন্তু এই বিবরণ বা প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের তালিকা খুবই উদ্ভট ছিল যেহেতু এইসব সংগ্রহ করা অসম্ভব ছিল এবং এর জন্য অর্থ প্রয়োজন হতো তাও আমাদের ছিল না । অবশ্য যুদ্ধে ভারত আমাদের সাহায্য করবে তা আমরা সহজেই অনুমান করেছিলাম। জুন মাসে বোষ্টনের ফিরোজের উদ্যোগে বেশ কিছু কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি আমরা মুজিবনগরে পাঠাই। বোধ হয় এতেই ধারনা হয়েছিল যে ভারী অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতেও আমরা সক্ষম হব। নভেম্বরের শেষেই মনে হয়েছিল সরাসরি যুদ্ধ অবশ্যাম্ভাবী কিন্তু পাকিস্তান যে সেই যুদ্ধ শুরু করবে এমন নির্বুদ্ধিতার আশংকা আমরা মোটেই করিনি।

যুদ্ধকালীন অবস্থায় কিছু পাকিস্তানী আমাদের মুজিব নগর সরকারের সাথে একটি সমঝোতায় আসতে চেষ্টা করে। তাঁদের কয়েকজন জানায় যে, এই প্রস্তাব ভূট্টোর মস্তস্কপ্রসূত। তারা মুজিবকে ছেড়ে দেয়া হবে যদি শেখ মুজিব সরাসরি জাতিসংঘে এসে পাকিস্তানের ভূখন্ডথেকে সব বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহারের আহবান জানান এবং তাতে আহবানে ভারত সাড়া দেয়। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে একটি রাজনীতিক সমঝোতায় এসে বাঙালিদের সব দাবী মেনে নেবে। প্রস্তাবটি অত্যন্ত চতুর বলে মনে হয়েছিল। আমরা উত্তরে জানাই যে সর্বশক্তি বলতে আমরা ভারত এবং পাকিস্তান উভয়কে বুঝি। ছেড়ে যেতে হলে উভয়কে যেতে হবে একসাথে কিন্তু এই আলোচনা সরকারী পর্যায়ে পৌছানোর আগেই বন্ধ হইয়ে যায়।

১১ ই ডিসেম্বর আরেকটি প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তানীরা এসে উপস্থিত এবং সমঝোতার জন্য চাপ দেয়। তারা এই প্রস্তাব পেশ করার জন্য বিচারপতি চৌধুরীর সাথে দেখা করার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি পাকিস্তানীদের সাথে সাক্ষাতের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে একটি ভীতিপূর্ন ঘটনা ছিল চট্টগ্রামের উদ্দ্যেশ্য সপ্তম নৌবহরের যাত্রা। আমার বিশ্বাস, যদি কংগ্রেসে ব্যাপারটা ফাঁস না হয়ে যেত তাহলে হয়তবা সত্যি সত্যি নৌবহর চট্টগ্রামের নিকট এসে যেত।

এ সময় আমরা সবাই ঢাকার অবস্থা নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলাম। কংগ্রেস সদস্য কোরম্যান কর্তৃক আয়োজিত একটি ভোজসভায় উপস্থিত ছিলাম। সেখানে এশিয়ার ব্যাপার নিয়ে গবেষনারত মার্কিন বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ হয়। সেদিন আমাদের প্রধান চিন্তার বিষয় ছিল নতুন বাংলাদেশ কেমন হবে। যুদ্ধবিধ্বস্থ ও অত্যাচারে নিপীড়িত জাতিকে কি অবস্থায় আমরা পাবো আর কি করে পুনর্বাসন করা যাবে।

১৬ তারিখ দেশ স্বাধীন হলো এবং ১৮ তারিখ জানতে পারলাম বহু বুদ্ধিজীবিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। সেদিন আমি ইয়েলে গিয়েছিলাম অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে ঢাকার পথে বিদায় দেওয়ার দিতে।

বোষ্টনে একদল বাঙালি মার্কিন বন্ধুদের সহায়তায় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক রুপরেখা প্রণয়নে মনোনিবেশ করেছিলেন অক্টোবরের দিকে। মহিউদ্দীন আলমগীর, হারুনুর রশীদ ভূঁইয়া, মতিলাল পাল এরা এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেন। অধ্যাপক ডফম্যান ও হাভার্ড পপুলেশন সেন্টার এবং অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এই উদ্যোগের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিশ্ব ব্যাংকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন এ কাজে আমাদের সাহায্য আসে। মার্চ মাসেই বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্বন্ধে আমি একটা প্রতিবেদন করেছিলাম। ইষ্ট পাকিস্তান পরিকল্পনা বিভাগের তৈরি পরিকল্পনাও আমাদের হাতে আসে। এই সবের ওপর ভিত্তি করে আমরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন পরিকল্পনা খসরা তৈরি করি। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এই খসড়া নিয়ে বাংলাদেশের পথে পাড়ি দেন স্বাধীন হবার অব্যবহিত পরেই।

মুজিবনগর থেকে মন্ত্রী পরিষদ সচিব তাওফিক ইমামের কাছ থেকে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ পরিকল্পনা বোর্ড স্থাপনের খবর পাই । বোর্ডে যোগদানের জন্য অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান ও হারুনুর রশীদের প্রতি আহবান আসে। এই প্রসঙ্গে খাদ্য ও দুর্ভিক্ষের উপর সিনেটর রিফিউজি সাব কমিটির জন্য আমাকে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হয়। এই সাব কমিটির জন্য পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সম্বন্ধেও আরেকটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করি ডিসেম্বরে। ঐ মাসে বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো সম্বন্ধে আরেকটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করার সুযোগ আমার হয়। এসব কাজে বিশ্বব্যাংক এবং ইউ এস এইডের কর্মকর্তাদের সাহায্য ও হারুনুর রশীদের সার্বক্ষনিক সহায়তা কৃতজ্ঞভরে স্বরণ করি। মোটামুটি ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য নানা ধরনের প্রস্তুতির প্রয়োজন আমরা বিদেশে থেকেও অনুভব করি আর তাঁর জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নিই।

স্বাক্ষর/-
আব্দুল মুহিত
৩০ জানুয়ারি, ১৯৮৪

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!