You dont have javascript enabled! Please enable it! 1977.01.14 | জেনারেল জিয়ার চীন সফর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা - সংগ্রামের নোটবুক

1977.01.14 | জেনারেল জিয়ার চীন সফর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা

বিবরণ

প্রায় দেড় বছর আগে বাংলাদেশকে চীন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি প্রদান করে৷ এরই প্রেক্ষিতে এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে দুই দেশের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। মাঝে দুই দেশ থেকেই বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রতিনিধি দলের যাতায়াত ঘটে দুই দেশের মধ্যে। সম্প্রতি সেনাবাহিনীর প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমন্ত্রণ জানানো হয় গণপ্রজাতন্ত্রী চীন থেকে। এ আমন্ত্রণের প্রেক্ষিতে জেনারেল জিয়া ২ রা জানুয়ারী থেকে ৫ ই জানুয়ারী পর্যন্ত চার দিনের এক শুভেচ্ছা সফরে চীনে যান। এই সফর আমাদের জাতীয় জীবনে এক নবতর অধ্যায়ের সূচনা করে।

২ রা জানুয়ারী, রোববার। ভোরের কুয়াশা তখনো কাটেনি। বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে যাত্রা শুরু করলেন জেনারেল জিয়া মহান দেশ চীনের উদ্দেশ্যে। শুরু হল যাত্রা। জেনারেল জিয়া একা নন। সঙ্গে রয়েছে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। তবে নেতৃত্বে রয়েছেন তিনি। প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের কৃষি দফতরের দায়িত্ব প্রাপ্ত সদস্য আজিজুল হক, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান শফিউল আজম, পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেন ও বানিজ্য সচিব মতিয়ুর রহমান৷ এ ছাড়াও প্রধান সামরিক প্রশাসকের ব্যক্তিগত কর্মচারীগণ সহ আরো কয়েক জন কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের একটি ছোট দলও তার সঙ্গে ছিলেন।

পিকিংয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বিমান বন্দরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের কাছে অল্প সময়ের জন্য সাক্ষাৎকারেও মিলিত হন। তাদের কাছে তিনি বলেন, আমি ও আমার প্রতিনিধি দল চীনের সরকার ও জনগণের জন্য বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের ভালবাসা ও প্রীতি বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। একই সঙ্গে গত দেড় বছরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতা ও সমর্থনের কথা উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

‘৭৫ এর রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করলে জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র, প্রত্যক্ষ হামলা, ফারাক্কা সমস্যার মত আঘাত আসতে থাকে। এসব প্রতিটি সমস্যাই ছিল বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক বিরাট পরীক্ষার সময়। কিন্তু বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ সেই সময় দৃঢতার সঙ্গে প্রতিটি হীন ষড়যন্ত্রকে রুখে দাড়িয়েছেন এবং প্রতিহত করেছেন। এ সময়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে সব সময়ই মহান চীনের জনগণ ও সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা এদেশের প্রতিরোধ সংগ্রামে রেখেছে অসীম অবদান। আর এজন্যই সেই মহান দেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলোচনা করতে পারা এবং মত বিনিময় করতে পারা আমাদের জন্য একটা বিরাট সুযোগ।

ঢাকা বিমান বন্দর ত্যাগের প্রাক্কালে বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন অনেকেই। এদের মধ্যে ছিলেন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ডঃ আব্দুর রশীদ, কর্ণেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম, এম, হক, ছয়ফুর রহমান এবং অন্যান্য উচ্চ পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাগণ। ঢাকাস্থ চীনা চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স মিঃ মও পিং ও চীনা দূতাবাসের অন্যান্য কুটনীতিকরা এসেছিলেন বিমান বন্দরে জেনারেল জিয়াকে শুভ বিদায় জানাতে।

বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ ও সরকারের শুভেচ্ছা নিয়ে বিমান ঢাকা ত্যাগ করে ২ রা জানুয়ারী, রোববার। ঐদিনই পিকিংয়ে পৌছে বিমান বিকেলে। পিকিং বিমান বন্দরের তখন তরুণীর সাজ। ব্যানারে আর পতাকায় বিমান নতুন সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। শোভিত রয়েছে দুই দেশের জাতীয় পতাকা। জেনারেল জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমান বন্দরে উপস্থিত রয়েছেন স্বয়ং চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো-ফেং। আরো রয়েছেন উপ – প্রধানমন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন, পররাষ্ট্র মন্ত্রী হুয়াং হুয়া ও অন্যান্য চীনা নেতৃবৃন্দ। এ ছাড়াও উপস্থিত রয়েছেন হাজার হাজার জনতা ও তরুণ তরুণী।
প্রত্যেকের হাতে রয়েছে রং-বেরঙের ফলের মালা।

পিাকিং বিমান বন্দরে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটটি পৌছার সঙ্গে সঙ্গে বিমান থেকে অবতরণ করলেন জেনারেল জিয়া। এরপর প্রতিনিধি দলের অন্যান্যরাও নেমে এলেন। জেনারেল জিয়াকে বিমান বন্দরে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং। চীনা রীতি অনুযায়ী চেয়ারম্যান কর্তৃক কোন অবিথিকে স্বাগত জানানো হচ্ছে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান। জেনারেল জিয়াকে বিমান বন্দরে সরকার প্রধান হিসেবে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করা হয়। এর পরেই জেনারেল জিয়া বিমান বন্দরে পরিচিত হন উপ-প্রধান মন্ত্রী লী- শিয়েন নিয়েন, পররাষ্ট্র মন্ত্রী হুয়াং হুয়া ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে।

পিকিং বিমান বন্দরে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল যখন অবতরণ করেন, তখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ১০ ডিগ্রী নীচে। কিন্তু পিকিং বিমান বন্দরের সমবেত জনতার উল্লাসমূখর শ্লোগানে এবং সাদর অভ্যর্থনার উষ্ণতায় এ শীতলতা ঢাকা পড়ে যায়। চিরায়ত চীনা রীতিতে বিভিন্ন জাতিসত্তার নানা বৈচিত্র্যময় পোষাকে সজ্জিত জনসাধারণ ও হাজার হাজার ছেলে মেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে নৃত্যের তালে তালে। বর্ণালী ফুলের মালা উত্তোলিত হাত আর ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ‘, ‘জেনারেল জিয়াউর রহমানকে স্বাগতম ‘ ধ্বনীতে বিমান বন্দরকে মুখরিত করে তোলে। মোটের উপর সমগ্র পিকিং বিমান বন্দর ও রাস্তার দু ধার ছিল উৎসবের সাজে সজ্জিত। প্রায় ২০ মিনিট কাল এ বর্ণাঢ্য সম্বর্ধনা চলে। এর মধ্যে শুরু হয় সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়ার গার্ড অফ অনার। চীনের সাম্প্রতিক সফরকালে জেনারেল জিয়াকে সরকার প্রধান হিসেবে সম্বর্ধনা দেয়া হয়।

এই বিপুল সম্বর্ধনার মধ্য দিয়েই চীনা জনগণ ও সরকার বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের প্রতি গভীর ভালবাসা ও শুভেচ্ছা ব্যক্ত করেন। এ ব্যাপারে একজন সাধারণ চীনবাসী তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন। মন্তব্যে তিনি বলেন, ‘এ অনুষ্ঠান হচ্ছে পিকিংয়ের জনগণের জীবনের একটি বিশেষ দিন।’

বিমান বন্দর থেকে জেনারেল জিয়াকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। এখানেই পিকিং এ অবস্থান কালে তার জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়। এ দিনই সন্ধায় সম্মানিত অতিথি জেনারেল জিয়ার সম্মানে এক রাষ্ট্রীয় ভোজসভার আয়োজন করেন চীনের উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন। গ্রেট হল অফ দ্য পিপল এ অনুষ্ঠিত এ ভোজসভায় উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হুয়াং হুয়া, জাতীয় গণ কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াও লিয়েন উয়ি সহ বিভিন্ন চীনা নেতৃবৃন্দ ও বিদেশী কূটনীতিক গণ। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল সহ এ ভোজসভায় উপস্থিত ছিলেন প্রায় পাঁচ শত জন।

এই বিশাল ভোজসভায় জেনারেল জিয়াকে স্বাগত জানিয়ে চীনে উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন বলেনঃ আমাদের বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশের পরিশ্রমী জনগণ ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ প্রতিরোধের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য রেখেছেন। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে বাংলাদেশের জনগণ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢভাবে সংগ্রাম করছে। জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি বলেনঃ বিশেষ করে গত বছর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ বহিঃশক্তির চাপ অগ্রাহ্য করে তাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব দৃঢতার সাথে রক্ষা করেছে যার মধ্য দিয়ে তাদের গভীর দেশপ্রেম ও সাহসিকতার সাথে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রতিফলন ঘটেছে। দুই দেশের বন্ধুত্ব উন্নয়নে দুটি দেশেরই যৌথ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

প্রত্যুত্তরে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে জেনারেল জিয়া বলেনঃ বাংলাদেশে আমরা আপনাদের মহান দেশকে আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বলেই মনে করি৷… আমাদের দুই দেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক নতুন হলেও আমাদের বন্ধুত্ব হাজার হাজার বছরের প্রাচীন৷… কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশেই ক্ষুধা, রোগ, নিরক্ষরতা ও বেকার সমস্যার মত মারাত্মক সমস্যাদির মোকাবেলায় সর্বশক্তি নিয়োজিত করতে পারব। এই উদ্দেশ্যেই অবিচলভাবে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সমূহের সাথে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে সমতা, স্বাধীনতা ও একে অপরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করে চলেছি। ‘

ভোজসভায় মিলিত হওয়ার আগেই উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন জিয়ার সঙ্গে একটি স্বল্প কালীন আলোচনাও সেরে নেন।

চার দিনের এ শুভেচ্ছা সফরের প্রতিটি দিনই জেনারেল জিয়ার জন্য খুবই ব্যাস্ততম দিন। তবে এর মধ্যে সফরের দ্বিতীয় দিনটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ দিনটিতেই অনুষ্ঠিত হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা বৈঠক। পিকিংয়ের গ্রেট হল অফ দ্য পিপল – এ অনুষ্ঠিত দীর্ঘ তিন ঘন্টা ব্যাপী এ আলোচনা চলে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ও চীনের উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন এর মধ্যে। আলোচনায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছাড়াও মত বিনিময় হয় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে। আন্তর্জাতিক বর্তমান অবস্থার পর্যালোচনাও করা হয় বৈঠকে। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা এবং চীনের উপ-প্রধান মন্ত্রী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্য বৃন্দ ও চীনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

বৈঠকেই জানা যায়, গতদিনের ভোজ-সভায় দু-দেশের দুই নেতা দু-দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বকে উত্তরোত্তর আরো জোরদার করার অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেন। জেনারেল জিয়া বৈঠকের প্রারম্ভেই পুনর্বার চেয়ারম্যান মাও সেতুং, প্রধান মন্ত্রী চৌ এন-লাই ও লাল ফৌজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নায়ক চুতে হৃর মৃত্যুতে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে গভীর শোক জ্ঞাপন করেন। সাম্প্রতিক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের কথা স্মরণ করে তিনি বলেনঃ চীনা জনগণের বীরোচিক গুণাবলীর এটিই এক নিদর্শন যে তারা এসব বিপর্যয়ে মুষড়ে না পড়ে চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং এর প্রেরণাদায়ক নেতৃত্বে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন এবং ঈপ্সিত লক্ষ্যের পানে এগিয়ে চলেছেন। চীনা জাতির সর্বোচ্চ নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য এবং ইতিমধ্যে যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য তিনি চেয়ারম্যান হুয়ার প্রতি সাদর অভিনন্দন ব্যক্ত করেন।

সফরের তৃতীয় দিনে পিকিংয়ের গ্রেট হল অফ দ্য পিপল – এ অনুষ্ঠিত হয় চূড়ান্ত বৈঠক। ৭৫ মিনিট ব্যাপী এ দীর্ঘ আলোচনায় অংশ নেন এক দিকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ও চীনের বর্তমান চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং। এছাড়াও চীনের পক্ষে উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী হুয়াং হুয়া ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেনও উপস্থিত ছিলেন৷ এ বৈঠকেও দুই নেতার মধ্যে পুনর্বার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়৷

বৈঠকে চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বাংলাদেশের জনগণের দৃঢ সংকল্পের এবং কৃষি উন্নয়নের জন্য গৃহীত ব্যবস্থাবলীর প্রশংসা করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রতি চীনের সমর্থনের কথা পুনরায় ঘোষণা করে বলেনঃ চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদারের ব্যাপারে আমাদের গভীর আস্থা রয়োছে৷ একই সঙ্গে চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যে বলেনঃ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি যে কোন বৈদেশিক হুমকি, শত্রুর বিরুদ্ধে অভিন্ন সংগ্রামে জনসাধারণকে সমন্বয়, ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাকে সাহস জোগায়। তিনি একই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেন যে, স্বাধীনতা রক্ষায় সদা সতর্ক থাকতে হবে এবং সচেতন জনগণের স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নিতে পারে না।

বৈঠক শেষে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও সাক্ষরিত হয়। চুক্তির বিষয়বস্তু ছিল কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা। চুক্তি মোতাবেক চীন বাংলাদেশকে নিজের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান থেকে কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দান করবে৷ এ ব্যাপারে একটি সার ও একটি বস্ত্র কারখানার সম্ভাবতা যাচাইয়ের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ দলও পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সাক্ষর করেন প্রতিনিধি দলের নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং চীনের পক্ষ থেকে সাক্ষর করেন চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং। এছাড়াও অন্য একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এটি ছিল বানিজ্য চুক্তি৷ এ চুক্তির অধীনে উভয় দেশ উভয় দেশ থেকে বছরে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের মালামাল আমদানী করবে বলে ঠিক হয়।

স্বাক্ষরিত এ বানিজ্য চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ চীন থেকে আনবে ধাতব ও খনিজ পদার্থ, কয়লা, সিমেন্ট, বিলোট, লৌহ পিন্ড ও হালকা শিল্প দ্রব্য, বস্ত্র এবং সুতা। অন্য দিকে চীনে রফতানী করবে পাট ও পাটজাত দ্রব্য, পাকা ও কাঁচা চামড়া, কাগজ ও কাগজ থেকে প্রস্তুত দ্রব্য।

এসব চুক্তি ব্যাতিরেকেও ইতিমধ্যে একটি চীনা বিশেষজ্ঞ দল ঢাকায় এসেছেন। এরা ক্ষুদ্র সেচ ও অন্যান্য প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখছেন। ধান গবেষণার উন্নয়ন, গম, তুলা, ফলমূল ও শাকসবজী উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারেও চীন বাংলাদেশকে সাহায্য করবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ দুই দিন এসব বৈঠক এবং চুক্তি সম্পাদন ছাড়াও জেনারেল জিয়া ও তার দল কৃষি ক্ষেত্র, তাচাই থেকে শিক্ষা গ্রহন প্রদর্শনী, গণমুক্তি বাহিনীর একটি ইউনিট, পিকিং এবং কোয়াং চাউয়ের ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান সমূহ পরিদর্শন করেন। এসব জায়গায় জেনারেল জিয়া চীনা জনগণ ও সরকারের স্বতঃস্ফূর্ত সাদর অভ্যর্থনা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্বর্ধনা লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ও তার দল চীনের সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক প্রাচীর দর্শন করেন ও তার শীর্ষদেশে আরোহন করেন।

‘তাচাই’ – পরলোকগত চেয়ারম্যান মাও সেতুং এর নিজস্ব চিন্তাধারায় রচিত একটি আদর্শ গণকমিউন। চীনের পূর্ব সীমান্তে পাহাড়ী এলাকা তাচাই এক সময়ে অনুর্বর আর ঊষর এলাকা ছিল। ১৯৬৪ সালে চেয়ারম্যান মাওয়ের আহ্বান ছিলঃ “কৃষিতে, তাচাই থেকে শিক্ষা নাও।” এই আহ্বানের মাত্র ১২ বছরে তাচাই আজ কৃষিক্ষেত্রে যে অনন্য অবদান রেখেছে, তা যে কোন উন্নয়নশীল দেশের জন্য আদর্শ স্বরূপ। এ জন্যই তাচাই থেকে শিক্ষা গ্রহন প্রদর্শনী যে কোন দেশের লোকের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আজিজুল হক এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন যে, তাচাই আমাদেরকে অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছে। জেনারেল জিয়া এর পরে তিং লিং যাদুঘরে মিঃ রাজবংশের সম্রাটদের সমাধি পরিদর্শন করেন। চীনা ইতিহাসে এ রাজবংশের উদ্ধৃতি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

এর পরেই আসে চীনের সেই ঐতিহাসিক প্রাচীর দর্শনের পালা। এক সময় শক, সুণ আর মোঙ্গল দস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে প্রাচীর তৈরী হয়েছিল আজ তা ইতিহাস প্রসিদ্ধ দর্শনীয় বস্তু হিসাবে পরিগনিত হয়েছে। জেনারেল জিয়া পায়ে হেঁটে প্রাচীরের সুউচ্চ শীর্ষে আরোহন করেন। এই সময় এর শীর্ষদেশে আরোহন করা ছিল একটি কঠিন কাজ। কারণ তখন পশ্চিমের পাহাড় থেকে আসল তীব্র হিমেল হাওয়া। তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কেরও দশ ডিগ্রী নীচে। এই তীব্র শীতে জেনারেল জিয়ার সঙ্গী যারা হয়েছিলেন, তারা নীচে নেমে আসেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতা চূড়ান্ত লক্ষ্য প্রাচীর শীর্ষে আরোহন করেন। চূড়ায় পৌছে যাওয়ার ব্যাপারে চেয়ারম্যান মাও সেতুং এর একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছেঃ “যে চূড়ায় উঠতে না পারে, সে বীর নয়।” চূড়ায় উঠার পর একজন চীনা নাগরিক চমৎকৃত হয়ে এই উক্তিটি স্মরণ করে বলেনঃ “বাইরের খুব কম লোকই প্রাচীরের শীর্ষ দেশে পৌছতে পেরেছে৷ “

সফরের তৃতীয় দিনে সন্ধায় অনুষ্ঠিত হয় চীনের উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন এর সম্মানে দেয়া জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রদত্ত ফিরতি ভোজসভা। ভোজসভায় জেনারেল জিয়া চীনা জনগণ ও সরকারের প্রতি তাদের অভূতপূর্ব আতিথেয়তার কথা উল্লেখ করেন।

চীনের উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার ন্যায্য সংগ্রামে এবং বৈদেশিক হামলা প্রতিহত করার ব্যাপারে চীন সব সময় বাংলাদেশের পাশে দাড়াবে। ” মিঃ লী শিয়েন নিয়েন চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানের বৈঠকের কথা উল্লেখ করে বলেনঃ আজ দুই নেতা বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনা করেছেন।

পরদিন সফরের চতুর্থ দিন। এবার পিকিং ছাড়ার পালা। তবে চীন ছাড়ার পালা নয়। এবার গন্তব্যস্থান চীনের ঐতিহ্যবাহী বন্দর নগরী ক্যান্টন। এই ক্যান্টনেই অনুষ্ঠিত হল বানিজ্য মেলা। ক্যান্টন একই সঙ্গে কোয়ান্টং প্রদেশের রাজধানী। বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু এবারেও বিদায় কালীন আন্তরিক ও প্রাণঢালা সম্বর্ধনার ঘাটতি নেই। শোককে শক্তিতে পরিণত করার প্রতিজ্ঞায় যে জাতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সে জাতির বিদায় সম্বর্ধনাও কম জাঁকজমকপূর্ণ নয়। বিদায় কালে জাঁকজমকপূর্ণ পিকিং বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন চীনা নেতৃবৃন্দ ও হাজার হাজার জনতা। সবার হাতেই রঙীন ফুলের তোড়া আর কন্ঠে দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্বের চিরস্থায়ীত্ব কামনা করে শ্লোগান। অতিথি ভবন থেকে বিমান বন্দর পর্যন্ত পথের দু’ ধার ছিল বর্ণাঢ্য ব্যানার আর পতাকায় সুসজ্জিত। বড় বড় ঝোলানো পতাকায় লেখা ছিলঃ বাংলাদেশ এবং চীনা জনগণের বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক।”

বিদায় দানকালে অতিথি ভবন থেকে বিমান বন্দর পর্যন্ত উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন তার সঙ্গে আসেন। এ ছাগাও যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হচ্ছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রী হুয়াং হুয়া, ডেপুটি চীফ অব জেনারেল স্টাফ ইয়াও য়ি লিহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। বিমান বন্দর ত্যাগের প্রাক্কালে চীনা তরুণ তরুণীরা শুরু করে তাদের ঐতিহ্যগত নাচ। জেনারেল জিয়া ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে দেখা করেন। এর পর শুরু হয় যাত্রা – ক্যান্টনের উদ্দেশ্যে।

পরদিন সফরের চতুর্থ দিন। এবার পিকিং ছাড়ার পালা। তবে চীন ছাড়ার পালা নয়। এবার গন্তব্যস্থান চীনের ঐতিহ্যবাহী বন্দর নগরী ক্যান্টন। এই ক্যান্টনেই অনুষ্ঠিত হল বানিজ্য মেলা। ক্যান্টন একই সঙ্গে কোয়ান্টং প্রদেশের রাজধানী। বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু এবারেও বিদায় কালীন আন্তরিক ও প্রাণঢালা সম্বর্ধনার ঘাটতি নেই। শোককে শক্তিতে পরিণত করার প্রতিজ্ঞায় যে জাতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সে জাতির বিদায় সম্বর্ধনাও কম জাঁকজমকপূর্ণ নয়। বিদায় কালে জাঁকজমকপূর্ণ পিকিং বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন চীনা নেতৃবৃন্দ ও হাজার হাজার জনতা। সবার হাতেই রঙীন ফুলের তোড়া আর কন্ঠে দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্বের চিরস্থায়ীত্ব কামনা করে শ্লোগান। অতিথি ভবন থেকে বিমান বন্দর পর্যন্ত পথের দু’ ধার ছিল বর্ণাঢ্য ব্যানার আর পতাকায় সুসজ্জিত। বড় বড় ঝোলানো পতাকায় লেখা ছিলঃ বাংলাদেশ এবং চীনা জনগণের বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক।”

বিদায় দানকালে অতিথি ভবন থেকে বিমান বন্দর পর্যন্ত উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন তার সঙ্গে আসেন। এ ছাগাও যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হচ্ছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রী হুয়াং হুয়া, ডেপুটি চীফ অব জেনারেল স্টাফ ইয়াও য়ি লিহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। বিমান বন্দর ত্যাগের প্রাক্কালে চীনা তরুণ তরুণীরা শুরু করে তাদের ঐতিহ্যগত নাচ। জেনারেল জিয়া ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে দেখা করেন। এর পর শুরু হয় যাত্রা – ক্যান্টনের উদ্দেশ্যে।
ক্যান্টন যাত্রার সময় পিকিং থেকে জেনারেল জিয়ার সঙ্গী হন চীনের জাতীয় গণকংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াও লি-লিন এবং উপ-পররাষ্ট্র মন্ত্রী হান নাইন-লু। ক্যান্টনেও জেনারেল জিয়া ও তার প্রতিনিধি দলের জন্য অপেক্ষা করছিল সাদর অভ্যর্থনা। ক্যান্টন বিমান বন্দরও পতাকা আর ব্যানারে ছিল সুসজ্জিত। হাজার হাজার তরুণ-তরূণী তাদের চিরায়ত রীতিতে ‘ড্রাগন’ এবং অন্যান্য নৃত্যের তালে তালে তাদের অতিথিকে স্বাগত জানায়। ক্যান্টনের বিমান বন্দরে জেনারেল জিয়াকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন ক্যান্টন নগরীর বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান চিয়া লিন রি।

এ দিনই সন্ধায় জেনারেল জিয়া ও তার প্রতিনিধি দল কোয়ান্টং প্রদেশের বিপ্লবী পরিষদের দেয়া নৈশভোজে আপ্যায়িত হন। ভোজসভায় কোয়ান্টং প্রদেশের ভাইস চেয়ারম্যান জেনারেল জিয়ার উদ্দেশ্যে নেতৃত্বের প্রশংসা করে আশাবাদ প্রকাশ করেনঃ “বাংলাদেশ তার নেতৃত্বে সমৃদ্ধি অর্জন করবে।” প্রতি উত্তরে জেনারেল জিয়া ধন্যবাদ জানিয়ে বলেনঃ “বাংলাদেশ সব সমই নির্যাতিত জনগণকে সমর্থন জানাবে।”
তিনি আরো বলেনঃ “আমি বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা দু দেশের স্বার্থেই প্রয়োজন। “

এ ছাড়া তিনি ক্যান্টনে একটি গণ-কমিউনও পরিদর্শন করেন। এ গণ-কমিউনিটির জনসংখ্যা প্রায় ৭৭ হাজার৷ গণ-কমিউনে একদিকে যেমন রয়েছে কৃষি উৎপাদনের প্রকরণ তেমনি রয়েছে শিল্প ইউনিট। জেনারেল জিয়া ও তার দল ঘুরে ঘুরে এ গণ কমিউনের প্রতিটি প্রকল্প পরিদর্শন করেন এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

এর পরদিন বিদায়ের পালা। চারদিনের আন্তরিক আতিথেয়তায় মুগ্ধ জেনারেল জিয়ার জন্য এ বিদায় ছিল খুবই করুণ। বিদায় জানাতে বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন প্রাদেশিক বিপ্লবী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান লিন লি-মিখ, চীনের উপ-পররাষ্ট্র মন্ত্রী হান নিয়েন লুঙ্গ ও জাতীয় গণকংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াও লিলিন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এ ছাড়াও হাজার হাজার চীনা জনতা ও তরুণ তরুণী। এদের নাচ আর শ্লোগানে মুখরিত বিদায় সম্বর্ধনা যেমনি ছিল হৃদয়স্পর্শী তেমনি বর্ণাঢ্য। কন্ঠে ছিল “বাংলাদেশ – চীন মৈত্রী জিন্দাবাদ ” ধ্বনী।

সফরের শেষে বিদায়ের প্রাক্কালে একই সঙ্গে ঢাকা ও পিকিং থেকে যুগপৎ ভাবে ঘোষিত হয় একটি যুক্ত ইশতেহার। ইশতাহারে জেনারেল জিয়াউর রহমানের চীন সফরের কালে আলোচনা ও তার ফলশ্রুতি উল্লেখ করা হয়। (যুক্ত ইশতেহার দ্রষ্টব্য) ।

চার দিনের এ সফর শেষে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও তার দল ঢাকায় পৌছেন ৬ ই জানুয়ারী, বৃহস্পতিবার। এ চার দিনের চীনের পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টিভি প্রভৃতি গণমাধ্যম সমূহো এ সফরের ফলাও প্রচার করা হয়। প্রায় প্রতিদিনই চীনের কোন না কোন পত্রিকায় জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতিকৃতি সহ খবর ছাপানো হয়েছে।

৬ ই জানুয়ারী ঢাকা বিমান ডপৌছলে তাকে বিপুল সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। এ সময় বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন বিমান বাহিনী প্রধান ও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল এ, জি, মাহমুদ, প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ, কুটনৈতিক মিশনের প্রধানগণ, উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ। হাজার হাজার জনতা ও স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা বিমান বন্দরের দুই পাশে জেনারেল জিয়াকে স্বাগত জানাতে দাড়িয়ে থাকে এবং তাকে প্রাণঢালা স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন জ্ঞাপন করে।

বিমান বন্দরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের কাছে সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে জেনারেল জিয়া বলেনঃ “এক কথায় বলতে গেলে এই সফর, পারস্পরিক সমঝোতা ও আলোচনা পুরোপুরিই সফল হয়েছে।!

চীনা জনগণ ও নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করো জেনারেল জিয়া বলেনঃ তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার রয়েছে। দুটি দেশই কৃষির উপর জোর দিয়েছে। সেচ ব্যবস্থা, পল্লী উন্নয়ন, আবাসিক সমস্যার সমাধান ও বিশেষ করে আত্মনির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে চীনের সাফল্য লক্ষণীয়। আমরাও আত্মনির্ভরশীলতার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছি।

তিনি বলেনঃ জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে এবং অন্যান্য বিষয়ে আমাদের ভূমিকার প্রতি চীনের দৃঢ সমর্থন রয়েছে। চীনের সর্বত্রই আমাদের ভূমিকা বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

চীনা জনগণের কোন বিষয়টি তাকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করেছে তা’ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেনঃ তাদের নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রমের জন্য তাদের বিপুল উদ্যম এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের দৃঢ মনোবল আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে। “

পকেটে হলুদ রঙের রুমাল এবং গায়ে ধূসর রংয়ের স্যুট পরিহিত জেনারেল জিয়া ছিলেন খুবই উৎফুল্ল। জেনারেল জিয়া এক পর্যায়ে বলেনঃ চীনে তার এ সফর তৃতীয় বিশ্বের স্বার্থের অনুকূল।
তিনি আরো বলেনঃ অতি সম্প্রতি চীনের মহান নেতা ও শিক্ষক চেয়ারম্যান মাও সেতুং, প্রধান মন্ত্রী চৌ এন-লাই ও মার্শাল চু তেহ’র মৃত্যু ও ভয়াবহ ভূমিকম্পে চীনের জনগণ এক মারাত্মক আঘাতের সম্মুখীন হয়েছিল। তবে চীনা জনতা সৎ সাহস ও দৃঢ সংকল্পের সঙ্গে সংকটের মোকাবেলা করেছে এবং এগিয়ে চলছে।

২ রা জানুয়ারী জেনারেল জিয়া বাংলাদেশ থেকে চীন সফরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন চীনা জনগণ ও সরকারের জন্য বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের শুভেচ্ছার ডালি নিয়ে। তিনি ফিরে এসেছেন ৬ ই জানুয়ারী বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের শুভেচ্ছার ঝুড়ি নিয়ে। এ এক অদ্ভুত রাখিবন্ধন।

এই সফল সফরের মধ্যে দিয়ে দু দেশের হাজার হাজার বছরের বন্ধুত্বের ইতিহাসে নবতর অধ্যায়ের সংযোজন ঘটেছে। উত্তরণ ঘটেছে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিকের।

গত মাসে জেনারেল জিয়া ঘোষণা করেছিলেন, “আমরা একা নই”। তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি দেশই পারস্পরিক স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর সম্মানের ভিত্তিতে আমাদের বন্ধু৷ ৮০ কোটি জনগণের মহান চীন নিজেও তৃতীয় বিশ্বেরই একজন সদস্য। সেদিক দিয়ে তারাও আমাদের বন্ধু। এবার জেনারেল জিয়াউর রহমানের সফরের মধ্য দিয়ে সেই ধ্বনিই আরো নিবিড় করে প্রতিফলিত হয়েছে।

চার দিনের এই সফরের আলোকেই জেনারেল জিয়া চীনের বর্তমান চেয়ারম্যান ও প্রধান মন্ত্রী হুয়া কুয়ো ফেং এবং উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েনের প্রতি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাংলাদেশ সফরের জন্য। দুই নেতাই এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন হৃষ্টচিত্তে। ঠিক হয়েছে পরবর্তীতে দিনক্ষণ ঠিক করা হবে এ সফরের। এতে করেই প্রতিফলিত হচ্ছে বন্ধুত্বের গাঢতা।

এ ছাড়াও আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামকে চীনা জনগণ ও সরকারের সহযোগিতাই গত দেড় বছরে প্রভূত শক্তি যুগিয়েছে আমাদেরকে৷ জেনারেল জিয়ার বর্তমান সফল সফরে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রাম ও সংকল্প নবতর দ্যোতনা পাবে। আমরাও বলতে পারব, ” বাংলাদেশী জাতি উঠে দাড়িয়েছে।”

***

জেনারেল জিয়ার চীন সফর
তাৎপর্য

সেনাবাহিনী প্রধান এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পাঁচ দিন ব্যাপী গণচীন সফরের পর ৬ ই জানুয়ারী ঢাকা ফিরেছেন। দেশে ফিরে তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এক কথায় বলতে গেলে এই সফর পারস্পরিক সমঝোতা ও আলাপ আলোচনা পুরোপুরি ভাবেই সফল হয়েছে। ‘ তিনি আরও বলেছেন, ‘সফল চীন সফর বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়া অধ্যায়ের সূচনা করেছে।’

পিকিং এ জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সরকার প্রধানের পূর্ণ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিমান বন্দরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং তাকে অভ্যর্থনা জানান। পাঁচ দিনের এই সফরের পর দুই সরকারের পক্ষ থেকে একটি যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়।

বাংলাদেশ ও গণচীনের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে জেনারেল জিয়ার এই সফরের সাফল্য রাজনৈতিক দিক দিয়ে শুধু তাৎপর্যপূর্ণ নয়, বাংলাদেশের ক্রমবিকাশমান অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। অর্থনৈতিক জীবনের যে সোনালী স্বপ্ন এখন প্রতিটি বাংলাদেশীর মনে তার বাস্তবায়নে গণচীনের সহযোগী বন্ধুত্ব অত্যন্ত মূল্যবান।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত হয়েছিল। রুশ-ভারত দুই পরাশক্তির পরিপূরক অর্থনীতি ব’নে বাংলাদেশকে এক সময় চরম মূল্য দিতে হয়েছে। দেশের মাঝে শত শত স্মাগলার সৃষ্টি করে তাদের অবাধ দৌরাত্ম্যের সুবিধার্থে খোলা রাখতে হয়েছে সীমান্তকে – পরিণাম সকলেরই জানা, চুয়াত্তরে প্রাণ দিতে হয়েছে কয়েক লক্ষ মানুষকে। যাদেরকে প্রাণ দিতে হয়নি তাদের ঐ প্রাণ রক্ষার্থে যাপন করতে হয়েছে অবর্ণনীয় দুঃখের জীবন – ভবিষ্যৎকে জলাঞ্জলি দিয়ে, যাবতীয় মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি আর কালো টাকার শখের করাতেও এ দেশের অর্থনীতি খন্ড বিখন্ড হয়ে অস্তিত্বহীন ছিলো।

পচাত্তরের আগস্ট ও নভেম্বরের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এই পঙ্গু ও রুগ্ন অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছে। জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সচল সজীব অর্থনীতি এখন ভিক্ষুকের অপবাদ থেকে জাতিকে অনেকাংশে রক্ষা করেছে। আত্মনির্ভরশীলতার লক্ষ্যে জাতি এখন দৃঢ পদক্ষেপে এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস সবল অর্থনীতির ভিত্তি রচনায় কার্যকরী হয়ে উঠেছে। জেনারেল জিয়া এই পুনর্গঠনের প্রথম সোপান হিসেবে গ্রামকে দেশীয় অর্থনীতির প্রাথমিক ইউনিট হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। তদনুযায়ী কাজও করতে শুরু করেছে। গ্রামকে গঠনের জন্য ম্যান – পাওয়ারকে সম্পূর্ণ রূপে নিয়োগের আয়োজন চলছে। তরুণ সমাজও অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। জেনারেল জিয়ার এই আত্মনির্ভরশীলতার অভিযানে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে দেশীয় সম্পদের সর্বোত্তম বিকাশ ও দেশীয় সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতায় বেশী জোর দিয়েছেন। এই অভিযান যে সাফল্যমণ্ডিত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ বাংলাদেশের যা আছে তাই নিয়েই গড়ে উঠবে – এ স্বপ্ন আজ আর সুদূর পরাহত নয়।

এমতবস্থায় গণচীনের বন্ধুত্ব প্রয়োজন রয়েছে বৈকি। গণচীনে পাঁচ দিনের সফর শেষে জেনারেল জিয়া এ জন্যই বলেছেন – চীনের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে।

তদপুরি বন্ধু হিসাবে চীনের উপর নির্ভর করা যায়, কারণ বাংলাদেশের মতো চীনও বন্ধুত্বের মর্যাদা দেয় কেবল কথায় নয়, কাজেও। অন্যের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক সুবিধা আদায়, অর্থনৈতিক শোষণ – এই সব চীনের আদর্শ বিরোধী। চীন কোন দেশের রাজনৈতিক জীবনকে প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা করে না। সেদিক থেকে এই নিরাপদ বন্ধুত্ব বাংলাদেশকে স্বাবলম্বী অর্থনীতির সোপানে আরোহনে প্রভূত সহায়তা করতে পারে। অথচ রুশ – ভারত এই দুই পরাশক্তির বন্ধুত্বের নামে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য রাজনীতির কর্মকাণ্ডে দাবার ঘুঁটি চালতো ইচ্ছে মতো। তার প্রমাণ বাংলাদেশের মতো আর কোন দেশ পেয়েছে কিনা সন্দেহ।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের যে বৈশিষ্ট্য আজ সবচেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে – তা হলো কোটি কোটি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ঔপনিবেশিক শোষণ বা আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারণ বাদী আগ্রাসনের মুখে চীনের মতো একটি দেশের বন্ধুত্ব অত্যন্ত প্রয়োজন, কারণ প্রকৃত অর্থনৈতিক উজ্জীবনের দ্বারা একটি দেশ তাে সার্বভৌমত্ব অটুট রাখতে পারে – এই উজ্জীবনের জন্য চীন সহায়ক শক্তি। বস্তুতঃ এশীয় উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য আমাদের পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বৃহৎ শক্তি ও আধিপত্যবাদী সম্প্রসারণ বাদী চক্রের উদ্যত গ্রাস থেকে দেশকে রক্ষা করতে গেলে যে শক্তির প্রয়োজন তা সংগ্রহ করতে হবে দেশের ভেতর থেকেই৷ স্বাধীনতা উত্তরকালে চীন সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, বাংলাদেশও করতে যাচ্ছে। দেশীয় সম্পদ ও জন-সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের লক্ষ্যে জেনারেল জিয়ার পদক্ষেপ এ দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ গঠনে যে সহায়ক হয়েছে, তার প্রতিফলন জন জীবনে আজ স্পষ্ট। বিদেশী পত্র পত্রিকাতেও এ সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের সৃষ্টিশীল অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে চীনের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে, জেনারেল জিয়ার সফল সফর, সেই লক্ষ্যে একটি মূল্যবান কার্যকরী পদক্ষেপ।

বাংলাদেশের সীমান্তে যে মুহূর্তে ভারতীয় বাহিনী সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে, যখন ভারত থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত দুষ্কৃতিকারীরা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যকলাপ চালাচ্ছে এবং ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত যখন গঙ্গার পনি প্রত্যাহার করে গত বছরের চেয়েও ভয়াবহ এক বিপর্যয়ের মুখে আমাদের মাতৃভূমিকে ঠেলে দিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে জেনারেল জিয়াউর রহমানের চীন সফরের তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর যে কোন আঘাত প্রতিহত করতে এবং বিদ্ধস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করতে দৃঢ প্রতিজ্ঞ। জেনারেল জিয়ার এই সফরের মাধ্যমে চীনা নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের এই বলিষ্ঠ ভূমিকা সম্যকরূপে অবগত হয়েছেন এবং সমর্থন করেছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্টের পরিবর্তনের পর চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ৭ ই নভেম্বরের বিপ্লবী অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছে। এর পর দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটেছে। উভয় দেশের মধ্যে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে কুটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উভয় দেশের কয়েকটি বানিজ্য প্রতিনিধি দল পর্যায়ক্রমে সফর বিনিময় করেছেন। ঢাকায় সিনদ্বুয়া বার্তা সংস্থা এবং পিকিং এ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ -চীন মৈত্রী সমিতির একটি দল মৈত্রী সফরে চীন গিয়েছেন এবং বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রতিনিধি দলও ইতিপূর্বে চীন সফর করেছেন। শেষোক্ত প্রতিনিধি দলের নেতা বাংলাদেশ টাইমস এর সম্পাদক এনায়েতউল্লাহ খান চীন সফরের পর দেশে ফিরে একজন প্রভাবশালী চীনা নেতার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিলেন, “দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতি চেয়ারম্যান মাও সেতুং গভীর মনোযোগ দিয়েছেন। ‘ চেয়ারম্যান মাও সেতুং এর অবর্তমানে চীনের বর্তমান নেতৃবৃন্দ সেই একই নীতি অব্যাহত রেখেছেন এবং বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ বিরোধী ভূমিকা ও সংগ্রামকে অকুন্ঠ সমর্থন দান করেছেন।

১৯৭৬ সালের জানুয়ারীতে ভারত যখন বাংলাদেশের সীমান্তে (কলমাকান্দা ও দূর্গাপুরে) প্রথম হামলা চালায় তখন পিকিং বেতার ও চীনা পত্র পত্রিকায় মন্তব্য সহ ভারতের এই আগ্রাসী হামলার চিত্র বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ফারাক্কা প্রশ্নে চীন দৃঢভাবে বাংলাদেশের ভূমিকাকে সমর্থন করে আসছে এবং ভারতের আগ্রাসী তৎপরতার নিন্দা করেছে। এছাড়াও প্রচলিত বাজার দর থেকে কম দামে পণ্য সরবরাহ করে চীন বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনে সাহায্য করছে।

বাংলাদেশের জনগণ তৃতীয় বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর মতো আধিপত্যবাদকে পরাস্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে চীন তৃতীয় বিশ্বের জনগণের এই সংগ্রামকে দৃঢ ভাবে সমর্থন করে। জেনারেল জিয়া চীন সফর কালে দৃঢভাবে ঘোষণা করেছেন যে, ‘সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চীন ও তৃতীয় বিশ্বের জনগণের সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণ দৃঢভাবে পাশে দাড়াবে। বাংলাদেশ সব সময় তৃতীয় বিশ্বের নির্যাতিত জনগণকে সমর্থন জানাবে। ‘ জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং বাইরের আগ্রাসনকে প্রতিহত করার সংগ্রামে বাংলাদেশের প্রতি চীনের সমর্থনের কথাও জেনারেল জিয়া দৃঢতার সঙ্গে ঘোষণা করেছেন।

১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার যুদ্ধে এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন, মা বোনদের ইজ্জত লুন্ঠিত হয়েছে এবং কোটি কোটি টাকার ধন সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। দেশ ও জাতির সেই ভয়ানক বিপর্যস্ত অবস্থায় মুজিব সরকার গদিতে আসীন হয়ে সারা দেশে কায়েম করেছিল লুটপাট, সন্ত্রাস আর চোরাচালানের অবাধ রাজত্ব৷ সেই সময় ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন অসম চুক্তি করে এবং বাংলাদেশের উপর তাদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এক নৈরাজ্য জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল৷ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারতীয় অর্থনীতির পরিপূরক হিসেবে গড়ে তুলে জাতীয় অর্থনীতি কে পঙ্গু করে রাখা হয়েছিল এবং শিল্প ও কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল।

বাংলাদেশের সচেতন জনগণ তখন থেকেই আধিপত্যবাদী রাশিয়া ও সম্প্রসারণবাদী ভারতের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। ১৫ ই আগস্টের পরিবর্তন ও ৭ ই নভেম্বরের বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের সেই চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

গত এক বছরে জাতীয় অর্থনীতি পুনর্গঠনে ও পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য অনেকখানি। জাতিসংঘে ও জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের ভূমিকা গণচীন সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহের সমর্থন লাভ করেছে। জেনারেল জিয়ার চীন সফরের সময় চীনা নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক বজায় থাকা একাধিক কারণে প্রয়োজন। ভারত যেহেতু দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় একটি সম্প্রসারণবাদী ও উপ বৃহৎ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সেহেতু ক্ষুদ্র ও দূর্বল প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রকি ভারত হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। দূর্বল প্রতিবেশী সিকিমকে ভারত ইতিমধ্যেই গ্রাস করেছে, নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে খর্ব করার জন্য বিভিন্ন ভাবে আগ্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ দৃঢভাবে এই ধরণের আগ্রাসী তৎপরতার প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং ক্ষুদ্র দেখগুলোকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে একে প্রতিহত করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।

জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রাম ছাড়াও জাতীয় অর্থনীতি পুনর্গঠনের সংগ্রামে চীন বাংলাদেশকে কার্যকরী সহযোগিতা প্রদান করতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশকে চীন অর্থনৈতিক বুনিয়াদ শক্তিশালী ভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে, যা না হলে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামও সফল হতে পারে না।

জেনারেল জিয়ার চীন সফরের মাধ্যমে এই সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হয়েছে এবং প্রাথমিক পদক্ষেপও ইতিমধ্যে গ্রহন করা হয়েছে৷

এ ছাড়া সাংস্কৃতিক লেনদেন ও মত বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ – চীনের অভিজ্ঞতাকে নিজেদের কাজে লাগাতে পারে। জেনারেল জিয়া তার চীন সফরের প্রাক্কালে চীনের কৃষি ও সেচ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব সাফল্য সমূহ পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি চীনা জনগণ ও নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।…. কৃষির উপর আমরাও সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছি৷ ‘ জেনারেল জিয়া চীন সফর শেষে ঢাকা বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের কাছে অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের বিরাট সাফল্যের প্রশংসা করতে গিয়ে সেচ ব্যবস্থা, পল্লী উন্নয়ন, আবাসিক সমস্যার সমাধান ও বিশেষভাবে আত্মনির্ভরশীলতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, ‘আমরাও আত্মনির্ভরশীলতার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছি।’

জেনারেল জিয়া বলেছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বের স্বার্থ রক্ষায় চীনের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও অন্যান্য প্রশ্নে আমাদের ভূমিকার প্রতি চীনের সমর্থন রয়েছে। চীনের যেখানেই আমরা গিয়োছি, সেখানেই জনগণ আমাদের ভূমিকাকে বিপুলভাবে প্রশংসা করেছে।

চীন সরকার জেনারেল জিয়ার এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেছেন। বিমান বন্দরে চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং স্বয়ং এসে জেনারেল জিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন। চেয়ারম্যান মাও সেতুং কখনো কোন বিদেশী অতিথিকে বিমান বন্দরে এসে অভ্যর্থনা জানাননি। চীনো ইতিপূর্বে কখনো পার্টির চেয়ারম্যান বিমান বন্দরে এসে কোন বিদেশীকে অভ্যর্থনা জানাননি। চীনের রীতি অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যানের এই ধরণের অভ্যর্থনা প্রদানের অর্থ হচ্ছে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনেরই নিদর্শন স্বরূপ।

জেনারেল জিয়া ঢাকা বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা যে দিন পিকিং পৌছান, সে দিন সেখানে খুব ঠান্ডা ছিলো কিন্তু চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং, উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন এবং বিমান বন্দরে উপস্থিত অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এ ঠান্ডাকে অগ্রাহ্য করে তাদেরকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং এবং উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন বাংলাদেশ সফরের জন্য জেনারেল জিয়ার আমন্ত্রণ গ্রহন করেছেন।
প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, ইতিপূর্বে চেয়ারম্যান মাও সেতুং মাত্র দুই বার বিশেষ ঐতিহাসিক কারণে শুধু মস্কো সফর করেছিলেন।

জেনারেল জিয়াউর রহমান তার চীন সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য বয়ে এনেছেন এক দূর্লভ সম্মান। এই সম্মান কেবল সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ বিরোধী, আত্মনির্ভরশীল ও সংগ্রামী জাতিরই প্রাপ্য। বাংলাদেশ এই প্রথম তার পররাষ্ট্র নীতির মাধ্যমে এক যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছে। গণচীন সহ তৃতীয় বিশ্বের আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ বিরোধী দেশ সমূহের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ভেতরেই নিহিত রয়েছে স্বাধীন, সার্বভৌম ও আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা মর আকাঙ্ক্ষা ও অঙ্গীকার।

***

যুক্ত ইশতেহারের পূর্ণ বিবরণ

চীনা গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের আমন্ত্রণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান সামরিক প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং তার দল ১৯৭৭ সালের ২ রা জানুয়ারী থেকে ৬ ই জানুয়ারী পর্যন্ত সরকারী ভাবে চীন গণপ্রজাতন্ত্র সফর করেন।

চীনে অবস্থান কালে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও তার দল একটি গণকমিউন, কৃষি ক্ষেত্র, তাচাই থেকে শিক্ষাগ্রহণ প্রদর্শনী, গণমুক্তি বাহিনীর একটি ইউনিট এবং পিকিং ও কোয়াং চাউথের ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থানগুলো পরিদর্শন করেন। এসব জায়গায় চীন সরকার ও জনগণ তাদেরকে সাদর অভ্যর্থনা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্বর্ধনা জানান।

চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান এবং চীন গণপ্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় পরিষদের প্রধান মন্ত্রী হুয়া কুয়ো ফেং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন এবং তার সাথে বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনা করেন। বৈঠকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান চীনা জনগণের মহান নেতা ও শিক্ষক চেয়ারম্যান মাও সেতুং, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই এবং জাতীয় গণকংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান চু তেহ’ র মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহনের জন্য কমরেড হুয়া কুয়ো ফেং কে আন্তরিক অভিনন্দন জানান। চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং এর জন্য তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতার উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, এশিয়ার পরিস্থিতি এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রশ্নে মত বিনিময় করেন। উভয় পক্ষ আলোচনার ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

এই সফরকালে দুই সরকাে অর্থনৈতিক ও কারিগরী সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি ও বানিজ্য ও মূল্য পরিশোধ সংক্রান্ত অপর একটি চুক্তি সাক্ষর করেন।

বাংলাদেশের জনগণ বাইরের হস্তক্ষেপ রোধে, জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে যে ব্যপক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছেন, চীনের সরকার ও জনগণ তা আনন্দের সাথে উল্লেখ করেন। চীনের সরকার ও জনগণ এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ন্যায়সংগত সংগ্রামের প্রতি তাদের দৃঢ সমর্থনের কথা পুনরায় উল্লেখ করেন।

চীনের সরকার ও জনগণ তাদের দেশকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে বিজয় ও সাফল্য অর্জন করেছেন বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ তার প্রশংসা করেন এবং তাইএয়ানকে যুক্ত করার ও মাতৃভূমির পুনরেকত্রীকরণের পবিত্র লক্ষ্যের ব্যাপারে চীনা জনগণের প্রতি দৃঢ সমর্থন জানান।

উভয় পক্ষ সন্তোষের সাথে উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের চীন সফর সম্পূর্ণ সফল হয়েছে এবং তা দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতার উন্নয়নে পারস্পরিক সমঝোতা ও দুই দেশের জনগণের মধ্যেকার ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী জোরদার করতে এবং আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্বের ঐক্য বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সরকারী সফরে আসার জন্য চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং এবং উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন কে আমন্ত্রণ জানান। চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং এবং উপ-প্রধান মন্ত্রী লী শিয়েন নিয়েন আনন্দ ও ধন্যবাদের সাথে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। সফরের সময় পরবর্তী কালে ঠিক করা হবে।

***

রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় জেনারেল জিয়ার ভাষণ

মাননীয় মিঃ লী শিয়েন নিয়েন,
মান্যবরবৃন্দ,
বন্ধুগণ,
আমাকে এই মহান দেশে সৌজন্য সফরের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার যে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তার জন্য আমি অত্যন্ত আনন্দিত। চীনের মাটিতে পদার্পনের পর আমাদের যে জাঁকজমকপূর্ণ সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছে, তা খুবই হৃদয়গ্রাহী ও স্মরণীয়। আপনার বিদ্বগ্ধ বক্তব্যে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথাই উদার ভাবে ধ্বনিত হয়েছে। চীনের চিরায়ত সৌজন্য ও ঐতিহ্যবাহী যে আতিথেয়তা আমাদের প্রতি প্রদর্শন করা হয়েছে তার জন্য আমার প্রতিনিধি দল ও ব্যক্তিগত ভাবে আমার নিজের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।

আপনাদের মহামান্য চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং, আপনি, আপনাদের সরকার ও চীনা জনগণের গভীর বন্ধুত্বের অনুভূতি বহন করে এনেছি।

আজ এখানে আমার উপস্থিতি বিশ্বের এক মহান শিক্ষক ও মানবজাতির এক মহান নেতা চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের মহাপ্রয়াণে সীমাহীন শোকে মুহ্যমান চীনা জাতির সঙ্গে পুনরায় একাত্মতা ঘোষণা করবার এক বেদনার্ত অথচ দুর্লভ সুযোগ এনে দিয়েছে। আমরা বাংলাদেশের জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আপনাদের এই অপূরণীয় ক্ষতির সম-অংশীদার। আর ব্যক্তিগত ভাবে আজ আবার আপনাদেরকে আমাদের আন্তরিক ও সহৃদদয় সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

আপনাদের সাফল্য বাংলাদেশ সহ উন্নয়নকারী দেশের কাছে আশার আলোকবর্তিকা হিসেবে সমাদৃত। জাতীয় সম্পদের উন্নয়নের ক্ষত্রে আপনাদের স্বনির্ভরতার বিষ্ময়কর প্রচেষ্টা অন্যের কাছে এক মহৎ এবং অনুকরণীয় উদাহরণ।

আমরা বাংলাদেশীরা বিশ্বাস করি যে, আন্তর্জাতিক আচরণ বিধির উদার ও মহান নীতিমালার ভিত্তিতে আঞ্চলিক ও বিশ্বশান্তি গড়ে ওঠা উচিৎ। পরাধীনতা ও শোষণ থেকে মানবজাতির মুক্তির মৌল আকাঙ্ক্ষা এবং বাইরের কোন চাপ বা হস্তক্ষেপ ছাড়া তাদের নিজস্ব লক্ষ্য নির্ধারণ করবার দৃঢ নীতি অনুসরণ করেই আমরা জাতিসংঘ, ইসলামী কনফারেন্স, জোট নিরপেক্ষ গ্রুপ ও কমনওয়েলথ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিয়েছি।

আমরা বিশ্বাস করি যে, একমাত্র শান্তিপূর্ণ অবস্থাতেই আমরা জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অর্থবহ করে তুলে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে সর্ব শক্তি নিয়োগ করতে পারি। আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে এখনো কিছু অঞ্চল রয়েছে, যেখানে শক্তির স্থায়ী ভারসাম্য অর্জিত হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান অবস্থা এশিয়ায় শান্তির প্রতি হুমকিস্বরূপ। আমরা বিশ্বাস করি যে, দখলীকৃত সমস্ত আরব এলাকা থেকে ইসরাইলী অপসারণ, প্যালেস্টাইনীদের জনমত অধিকারের স্বীকৃতি এবং স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমেই মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী ভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার, সংখ্যা লঘু বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠী জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বৈধ অধিকার পদদলিত করে দক্ষিণ আফ্রিকাতে প্রচন্ড উত্তেজনা ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। ইতিহাস এ কথা বার বার প্রমাণ করেছে যে, অধিকার সচেতন জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। যতদিন পর্যন্ত না বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠী সে দেশের বৈধ প্রতিনিধি দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে ততদিন জনতার সংগ্রাম চলবেই।

ভারত মহাসাগর কে শান্তির এলাকা ঘোষণা করবার নীতিতে আমরা বিশ্বাসী৷ এ বিশ্বাসকে অর্থবহ ও দৃঢ করবার জন্য উপকূলীয় ও পশ্চাদভূমির দেশগুলিকে পরস্পরের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শন অথবা শক্তি প্রয়োগের নীতি পরিহার করতে হবে।

ইতিহাসের ধারায় আমরা পিছিয়ে থাকলেও দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের অপরাপর দেশের সঙ্গে স্থায়ী শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে আমরা বদ্ধপরিকর। কেবলমাত্র এ পরিবেশেই ক্ষুধা, রোগ, নিরক্ষরতা ও বেকার সমস্যার মত মারাত্মক সমস্যাদির মোকাবেলায় আমাদের সর্ব শক্তি নিয়োগ করতে পারব। এই উদ্দেশ্যে আমরা অবিচলিত ভাবে আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমুহের সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে সমতা, স্বাধীনতা ও একে অপরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করবার নীতি অনুসরণ করে চলেছি৷

উপমহাদেশের ঘটনাপ্রবাহের ঘাত-প্রতিঘাত আমাদের সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় এবং আসাদের বাস্তব ও যথার্থ স্বাধীনতাকে সুসংহত করবার সংকল্প থেকে নিবৃত্ত করতে পারে নি। বহু মূল্যবান জীবনের ক্ষতি, সীমান্ত এলাকার অধিবাসীদের সমূহ বিপর্যয়, এমনকি গঙ্গার পানির গতি পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট জনগণের অশেষ দুঃখ দূর্দশা সত্ত্বেও আমরা এ নীতিতে অবিচল রয়েছি। সমতা ও ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে আমরা এসব সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আশা রাখি।

বাংলাদেশ একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে তৃতীয় বিশ্বের ন্যায়সংগত প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে।

আমরা স্বনির্ভরতার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌছতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ উদ্দেশ্যে আমাদের উন্নয়ন নীতির লক্ষ্য পুনর্বিন্যাস করে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহন করেছি। স্বনির্ভরতার জাতীয় পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক এই কর্মধারা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রাণ সঞ্চার করেছে। মুদ্রাস্ফীতি রোধ হয়েছে। মুদ্রা ব্যবস্থা এখন অধিকতর নিয়ন্ত্রিত। অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি জনগণ আগের চেয়ে কম দামে পাচ্ছেন৷

আপনাদের মহান দেশকে আমরা আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বলে মনে করি। আমাদের দুই দেশের কোন সাধারণ সীমান্ত নেই বটে, কিন্তু রাষ্ট্র দুটির নিকটতম সীমানার ব্যবধান মাত্র কয়েক মাইলের। বর্তমান জগতে দূরত্ব কোন অলঙ্ঘনীয় প্রতিবন্ধক নয়৷ তবে নৈকট্য পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে নিশ্চিত সহায়ক। আমাদের দুই দেশের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক নতুন হলেও জনগণের বন্ধুত্ব হাজার হাজার বছরের। মহান চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সপ্তম শতাব্দীতে এবং প্রখ্যাত চীনা আবিষ্কারক চেং হো পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ সফর করেন। হাজার বছরের অধিক কালের এ যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন মৈত্রী ও বন্ধুত্বের সুনিবিড় বন্ধনে ভাস্বর। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের অভিন্নতা আজ সেই ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক কারণগুলিকে আরো শক্তিশালী করেছে।

নব্যচীনকে ব্যক্তিগত ভাবে জানার যে সুযোগ আমাদের দেয়া হয়েছে, তা আমার ও আমার প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আশা করি এই সফর কালে ফলপ্রসূ আলোচনা হবে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা লাভবান হবো। এজন্য আমরা আবার আপনাকে এবং চীনা সরকার ও জনগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

মান্যবর ও বন্ধুগণ, বাংলাদেশ এবং চীনের দ্রুত বিকাশমান ও সুদৃঢ বন্ধুত্ব কামনা করে আপনাদের স্বাস্থ্য পানে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

চীনের বন্ধুপ্রতিম জনগণের অব্যাহত অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি মহামান্য চেয়ারম্যান হুয়া কুয়ো ফেং এবং সম্মানিত লী শিয়েন নিয়েনের সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

কুটনৈতিক মিশনসমূহের প্রধান ও তাদের সহধর্মিণীদের সুস্বাস্থ্য কামনা করি। এই শুভ সন্ধায় উপস্থিত অন্যান্য অতিথির সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

***

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.01.14-bichitra.pdf” title=”1977.01.14 bichitra”]