You dont have javascript enabled! Please enable it!

1976.11.26 | মাওলানা ভাসানীর মৃত্যুতে সাপ্তাহিক বিচিত্রার সকল লেখা

 
পুরোগামী জননেতা
– মাহবুব উল্লাহ

লোকান্তরিত মওলানা ভাসানী শাশ্বত ভবিতব্যের জন্য লোক অন্তরে ঠাঁই নিয়েছেন। মৃত্যু জীবনের পাশাপাশি এক দ্বান্দ্বিক মহাসত্য। প্রকৃতির এই অমোঘ সত্যকে অসম্ভব জয়ে পারঙ্গম মানুষ আজো নিয়ন্ত্রিত করতে পারেনি। তাই আর সব নশ্বর মানুষের মতই মওলানা ভাসানী ছিলেন একজন নশ্বর মানুষ। একজন নশ্বর মানুষের তুলনায় মওলানা দীর্ঘায়ু হয়েছিলেন। তার আয়ুস্কাল আরও দীর্ঘিত হলে আমরা হয়ত আশ্বস্ত হতাম। কিন্তু তার মৃত্যুতে প্রকৃতির নিকট আমাদের পরাজয় স্বীকার করা ভিন্ন আর কি গত্যন্তর আছে। এতদ্বসত্ত্বেও তার মৃত্যু এক মহীয়ান মৃত্যু। মরে গেলেও তিনি আজ অমর। লোকান্তরিত হয়েও লোক অন্তরে তার আসন চিরবিদ্যমান থাকবে।

ইতিহাসে কম মানুষের ভাগ্যেই এই সৌভাগ্য ঘটে থাকে। এমন কি অনেক ক্ষণজন্ম পুরুষও এই ভাগ্যে ভাগ্যবান হন না। সভ্যতার উষালগ্নে আদিম দাস সমাজ থেকে আজ পর্যন্ত যত মহাপুরুষ মানব সভ্যতার প্রগতির ইমারত নির্মাণে যে অস্বস্তিকর অবদান রেখেছেন, মওলানা তাদের একজন। তাই, স্পার্টাকাস, টিটান, জোসেফ মাতি, ভিভা জাপতা, ভলতেয়ার ও গ্যাবিবল্ডির পাশাপাশি আর একটি নাম – মওলানা ভাসানী।

গিনির জাতীয় নেতা সেকুতুরে তার ‘আফ্রিকান ইমান যিপাশন’ নামক ভাষণে ১৯৫৯ সালে বলেছিলেন,
“In the world of today, there are three types of organisations and movements. There is the party that speaks of the past and lives on the basis of the past. The member of the party continuously say, ” We have done such and such things in 1900, we have done such and such things in 1910″; they are not capable of saying, “this is what we have done today, and this is what we should do tomorrow “. The second category lives only in the present and its worker are concerned exclusively with day to day problems and make no effort to analyse these problems and carry out the changes that would resolve them into the future…. Indeed, it is in so far as one is concerned with what will take place tomorrow that one can take the appropriate measures to make the future of the country more happy and prosperous. “

মওলানা ভাসানী ছিলেন এমন একজন নেতা, এমন একটি প্রতিষ্ঠান, এমন একটি প্রতীক যিনি অতীতের সাফল্য কিংবা বর্তমানেে বিশৃঙ্খলা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। একটি সুন্দর আগামী দিন সৃষ্টিই ছিল যার রাজনীতি ও সকল কর্মকান্ডের মূল মর্ম বস্তু। এ কারণেও হয়তো মওলানার অনেক উক্তি, অনেক কর্মসূচি সাধারণের চোখে বেখাপ্পা ঠেকেছে, কিংবা একপেষে দোষে দুষ্ট মনে হয়েছে৷ কিন্তু ইতিহাসের বিচারে তার আরাধ্য আগামী দিন যখন একটি বর্তমানে বা অতীতের ঘটনায় পরিণত হয়েছে তখনই আমরা খুঁজে পাই তার অসামঞ্জস্য ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের যথার্থতা।

একজন মহাপুরুষের সঙ্গে একজন সাধারণের তফাত কোথায়? তিনিই মহাপুরুষ, তিনিই প্রতিভাবান যিনি পারেন বর্তমানের জড়তা কিংবা অতীতের অভ্যাসকে অস্বীকার করে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে শেখাতে। এই ভবিষ্যতের কথা ভাবতে শেখানো কোন অপরিণামদর্শী স্থুল হঠকারিতা নয়। কিংবা বাস্তববোধ বিবর্জিত ইউটোপিয়ার রাজ্যে বিচরণও নয়। ইতিহাসের যথার্থ প্রেক্ষিত বিচার করে আগামী দিনকে দেখতে পারার কুশলতায় মওলানা ছিলেন একজন দূরদর্শী মহানায়ক। উপমহাদেশের ইতিহাসে এমন সুদূর প্রসারী দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মহানায়কের আবির্ভাব হয়েছে কিনা বলা শক্ত। তাই, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রতিভা বিচারের কষ্টি পাথর হাজির করেছিলেন, মওলানা ছিলেন তারই নিরিখে একজন মহাপুরুষ। মিল বলেছিলেন, “Genious as a tendency to break the existing customs of the socity.” এই প্রচলিত প্রথার প্রতি অনাস্থা নীতি মওলানা চিরকাল অনুসরণ করেছেন। এ কারণেই মওলানা ভাসানী উপমহাদেশের অন্যান্য জননেতাদের তুলনায় জনগণের অনেক কাছাকাছি, তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার অনেক বেশি মূর্ত প্রতীক হতে পেরেছিলেন।

মওলানার জন্ম হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে গ্রাম বাংলার এক মাঝারি কৃষক পরিবারে। তার দীর্ঘ সত্তর বছরের রাজনৈতিক জীবনে তার এই শ্রেণীভিত্তি তার রাজনৈতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। বস্তুতপক্ষে তার রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মকাণ্ডকে বুঝতে হলে বুঝতে হবে তার এই অর্থনৈতিক অবস্থানকে। সেকালে তার পিতার মত বাংলার ছিল সামন্ত শোষণে জর্জরিত। তাই জমিদার, মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রজাসাধারণের স্বার্থে আন্দোলন সংগঠিত করার মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল তার রাজনৈতিক জীবনের হাতে খড়ি। আসামে ‘লাইন প্রথা’ র বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৩৩৭ এ সন্তোষের অত্যাচারী জমিদারের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠন, সিরাজগঞ্জে বঙ্গ-আসাম প্রজা সম্মেলন, ১৩৩৮ সালের শেষাশেষিতে রংপুরের গাইবান্ধার প্রজা সম্মেলন প্রভৃতি তার আজন্ম লালিত সামন্তবাদ বিরোধী শ্রেণী ঘৃণারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কিন্তু ইতিহাস চেতনায় সচেতন মাওলানা অচিরেই বুঝতে পারলেন যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ কেবল সামন্তবাদের রক্ষকই নয় বরং এর উপর ভর করেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই দেশে টিকে আছে। সুতরাং সেই থেকে মওলানার আন্দোলনের বর্শাফলক দ্বিমুখী নিক্ষিপ্ত হলো। তিনি বুঝতে পারলেন, বৃহত্তর কৃষক আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করতে না পারলে কোন আন্দোলনকেই সফল করা সম্ভব হবে না। সত্যিকার অর্থে বলতে কি এই সত্যটি বৃটিশ শাসিত ভারতে কোন জাতীয় নেতার পক্ষেই সম্যক উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি। এমন কি জওহরলাল নেহেরুও জাতীয় আন্দোলনের সাথে কৃষক সংগ্রামকে সম্পৃক্ত করার এক ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছিলেন। উত্তর প্রদেশে কৃষক সংগ্রাম সংগঠিত করতে গিয়ে তার সেই ব্যর্থতার কথা তার আত্মজীবনীতে বর্ণনা করেছেন। সম্ভবত মওলানার মত আর কারোরই কৃষকদের সঙ্গে তেমন নাড়ীর যোগ না থাকাই বোধহয় এই ব্যর্থতার কারণ। এই বিচারে সমকালীন জাতীয় নেতাদের তুলনায় মওলানা ভাসানী জাতীয় সংগ্রামের এই ব্যর্থ রূপকে অনেক স্বার্থক ভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একটি সাম্রাজ্যবাদ শাসিত দেশে কিংবা একটি আধা ঔপনিবেশিক দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন হল মূলতঃ কৃষক আন্দোলন, যেহেতু জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হলো কৃষক সমাজ।

জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে ১৯১৯ সালে খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে মওলানা ভাসানী সর্বভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের পুরোধার আসনে পরিবৃত হন। মওলানা কখন কোন সালে কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন, তার সঠিক দিন কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। তার মুসলিম লীগে যোগদানের কারণ ছিল তৎকালীন বাংলার মুসলমান কৃষক প্রজাদের স্বার্থ রক্ষায় কংগ্রেসের ব্যর্থতা। কিন্তু, কোন প্রকার সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধি মওলানাকে মুসলিম লীগে যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সন্তোষের হিন্দু জমিদারের বিরুদ্ধে আয়োজিত মওলানার সভার কাহিনী থেকে। এ সম্পর্কে সাহিত্যিক ইব্রাহীম খাঁ লিখেছেন, “মুহরম উপলক্ষে মওলানা সাব কাগমাভরে সভা করবেন বলে ঠিক করলেন। চারিদিকে ঢোল-শোহরত দেওয়া হল। তিনি দরগার পারে বাসা করে বসলেন। প্রচার করলেন সভা উপলক্ষে যত লোক আসবে, তিনি সবাইকে বিনা পয়সায় গোশতের খিচুড়ি খাএয়াবেন। তবে লোক ইচ্ছা করলে সাথে করে চাল, মোরগ, খাসী, গরু, পাতা, তেল, ঘি আনতে পারে।

সন্তোষের আমলারা ঘাবড়ে গেল। তারা তার করে জিলা ম্যাজিস্ট্রেট নুরুন্নবী চৌধুরীকে এনে বলল, ‘দেশময় সাম্প্রদায়িক অশান্তির হাওয়া। এর মধ্যে এই সভা হলে হিন্দু মা – বোনের ইজ্জত যাবে, হিন্দুর বাড়ি লুন্ঠন হবে, আর প্রজারা খাজনা বন্ধ করবে। ” ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সভা বন্ধ করতে রাজি হলেন, মওলানা সাবের কথায় কান দিলেন না। এমন সময় আমি হঠাৎ সেখানে গিয়ে হাজির। শুনে বললাম, ‘সভার ফলে হিন্দু মা – বোনের ইজ্জত যাবে এটা টাঙ্গাইলের মুসলমানদের ওপর একটা কলঙ্কের আরোপ। আমি সে তোহমত স্বীকার করে নেব না। শান্তি ভঙ্গ না হওয়ার দায়িত্ব আমি নিচ্ছিঃ সভা বন্ধ করতে পারবেন না। ‘

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, কিন্তু এত লোক জড় হবে, তারা যদি আপনার কথা না মানে? বললাম, আপনার বন্দুকধারী শ ‘দুই পুলিশ আড়ালে থাকুক, যদি শান্তি ভঙ্গ শুরু হয় তবে তারা গুলি করবে আমার বুকে, তারপর অন্যদের বুকে।

সভার অনুমতি পাওয়া গেল। আমি সভাপতি হলাম। বললাম, মওলানা সাব, খাজনা বন্ধ করা, হিন্দুদের ওপর জুলুম – অত্যাচারের কথা কিন্তু বলবেন না। এ সন্মন্ধে আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে জবান দিয়েছি। ‘ তিনি বললেন, ‘বেশ বলব না, আপনার জবানের ইজ্জত তো রাখতেই হবে’।

হাজার ত্রিশেক লোক জড় হল। তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন। আধঘন্টা খানেক আমার অনুরোধ মেনে চললেন। হিন্দুদের মারতে বললেন না, কিন্তু জমিদারের খাজনা, মহাজনের পাওনা, আর বর্গাদাতাদের শস্য দেওয়া বন্ধ করতে জোরেই বলে দিলেন।”

জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কৃষক প্রজা – স্বার্থ সংরক্ষণই ছিল মুসলিম লীগে মওলানার প্রধান ভূমিকা। বস্তুতঃ মুসলিম লীগের মধ্যে যে অসাম্প্রদায়িক ধারাটি বিদ্যমান ছিল, মওলানা ছিলেন তারই প্রতীক। মুসলিম লীগের মত একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলে থেকেও মওলানা যে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা করতেন, তা’ মওলানার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রাগসরতারই প্রতিফলন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই মুসলিম লীগ যখন থেকে নিপীড়িত মুসলিম জনগণের স্বার্থে কাজ করতে ব্যর্থ হল উপরন্তু মেহনতি মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে মুষ্টিমেয় শোষক শাসকের স্বার্থে কাজ করতে লাগল তখন থেকেই মওলানা মুসলিম লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক চুকিয়ে দিলেন। বিশেষ করে, ‘৪৮ এর ২৭ শে বমজান লালবাগ রমজান পুলিশ হত্যার ঘটনা এবং শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট মুসলিম লীগের স্বরূপ উপলব্ধি করতে মওলানাকে সাহায্য করেছিল। এ কারণেই তিনি পাকিস্তানে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দলের গোড়াপত্তন করেন। এ সময়ের পর থেকে একাধিকবার তিনি শাসকগোষ্ঠীর রুদ্র রোষের শিকার হন। ক্রমান্বয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির গোড়াপত্তন মওলানার বিকাশমান প্রগতিশীল চরিত্রকেই প্রতিভাত করছিল।

ইতিহাসের দ্বান্দিক নিয়মে কোন রাজনৈতিক শক্তি চিরকাল প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে পারে না৷ প্রত্যেক রাজনৈতিক আন্দোলনে তার বিকাশের যুগে প্রগতিশীল এবং তার পতন ও অবক্ষয় প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা রক্ষাশীল। এ কারণেই তিনি তার জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি রাজনৈতিক দল পরিবর্তন করেছেন। এই দল বদলানোর পালা কোন অসামঞ্জস্য কিংবা অস্থিরতার প্রকাশ নয়। বরঞ্চ তার প্রগতিশীলতার সুসামঞ্জস্যেরই প্রতিফলন মাত্র।

১৯৫৭ সালে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ গঠন করিলাম কেন? ‘ শিরোনামায় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, “আজ আমি বলিতে চাই যে, সত্য ও মিথ্যার লড়াই, শোষক ও শোষিতের লড়াই, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্যবাদের লড়াই, ধর্ম অধর্মের লড়াই – বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন যেখানেই হইয়াছে তাতাতে সে সমস্ত নেতা ও কর্মী অংশগ্রহণ করিতেন তাহাদের ত্যাগ, কোরবানী ও নির্যাতন ভোগের মাপকাঠিতে সেই সংগ্রাম বা লড়াই কতটা সাফল্যলাভ করিতে সক্ষম হইয়াছে৷ ইহার নজির বিশ্বনবীর ও তাহার সাহাবাদের জীবনে এ বর্তমান নবীন চীনের মুক্তির ও উন্নতির ইতিহাস আমাদের সম্মুখে মওজুত৷ ” এই উক্তি থেকেই আমরা উপলব্ধি করতে পারি, মওলানার প্রগতিবাদী চেতনা কতটা প্রখর। পাকিস্তানোত্তর কালে একাধিকবার বিভিন্ন রাজনৈতিক পদক্ষেপের মধ্যে দিয়েই মওলানা এর সাক্ষর রেখে গেছেন। আগামী দিনের ইতিহাস কোন পথে এগুবে সেই ঠিকানা মওলানার জানা ছিল। তাই তো তিনি সেই ১৯৫৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি ‘আচ্ছালামু আলাইকুম’ জানাতে পেরেছিলেন। এখান থেকেই শুরু নবীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় যাত্রা। বাংলাদেশ যে ঐতিহাসিক সত্য হয়ে দাড়াবে, মওলানা তা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন।

এ জন্যই আমরা তাকে দেখি স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে জনসংখ্যা ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব ও সম্পদ বন্টনের দাবীতে, ভাষার অধিকারের দাবীতে উচ্চকিত। এরই পাশাপাশি ‘৬৫ এর মওলানাকে আমরা দেখি ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী জনগণকে ঐক্য ও প্রতিরোধ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে। আপাতদৃষ্টিতে অনেকের কাছেই মওলানার এ ভূমিকা স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। কিন্তু বর্তমানের আলোকে এ সত্য কি আমাদের নিকট সুপ্রতিভাত নয় যে ভারতভুক্ত অবস্থা থেকে পাকিস্তান ভুক্ত অবস্থায় বাংলাদেশের সত্যিকারের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন অনেক সহজসাধ্য। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতি তার আস্থা এতোই সুদৃঢ ছিল যে ১৯৭০ এর শেষের দিকে তিনি দৃঢ প্রত্যয়ের কন্ঠে বলতে পেরেছিলেন, “স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান না দেখার আগে আমার মৃত্যু নাই”। অন্যান্য জাতীয় নেতাদের কাছে তখন যানছিল কেবল হিস্যা ভাগের দাবী, মওলানার কাছে তখন তা ছিল স্বাধীনতার দাবী।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রাম এ দেশের বুকে কোন কোন বৈদেশিক শক্তির হস্তক্ষেপকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলতে পারে এবং পরিণতিতে তা’ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি পরিপন্থী হয়ে উঠতে পারে, এই দূরদৃষ্টি মওলানা ভাসানীর ছিল। এ কারণেই তিনি একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে বৈদেশিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। এ কারণেই বোধকরি ভারত অবস্থানকালে তাকে অন্তরীণ জীবন যাপন করতে হয়েছিল। তার এই অন্তরীণ অবস্থার কথা ‘৭২ সালের মাঝামাঝিতে ময়মনসিংহের এক সভায় প্রকাশ করেছিলেন।

শুধু এক্ষেত্রেই নয়, মওলানার রাজনৈতিক চেতনা প্রাগ্রসরতার প্রমাণ মিলেতার রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের ক্ষেত্রেও। ১৯৫৭ সালে সীমান্ত গান্ধী গাফফার খান, আচাকজাই কিংবা মজিদ সিন্ধীর মত যে সব সহযোগীদের নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির যাত্রা শুরু করেছিলেন তাদের অনেকেই তার পথ পরিত্যাগ করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোষ করেছেন। মওলানা তাদের পথগামী হননি। ধর্মপরায়ণতা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আলোক বিবর্জিত হওয়া সত্ত্বেও মওলানা গণচীনের মাও সেতুং এর মধ্যেই দেখতে পেয়েছিলেন মানব মুক্তির পথ। এখানেই পোশাকী বৈভবহীন মওলানার আসল বৈভব।

বাংলাদেশের অভ্যুদয় পরবর্তী কালে মওলানার সম্প্রসারণ বাদী ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধির বিরুদ্ধে যেভাবে জনমত গড়ে তোলার কাজে অক্লান্তভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তা’ থেকেই বোঝা যায় মওলানার দূরদৃষ্টি কতটা প্রখর। একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চরিত্রের মূল উপাদানটি উপলব্ধি করা। এ সেনাবাহিনী যে একদিন আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ বিরোধী ভূমিকা গ্রহন করবে, তা তিনি ১৯৭৩ সালেই বুঝতে পেরেছিলেন। সে বছরে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জনসভায় সেনাবাহিনী ও জনগণের সম্মিলিত সংগ্রামের উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

এ দেশের বুকেও যে ‘এক নেতা ও এক দলের’ শাসন চিরস্থায়ী হবে না এবং এ ব্যবস্থা যে একটি কাদা মাটির পা ওয়ালা দৈত্য বই আর কিছুই নয় তা তিনি এ ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের সময়ই বলেছিলেন সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দলের কাছে। তিনি মাত্র ছয় মাস অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। অচিরেই তার এই ভবিষ্যৎ বাণী সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল।

দেশের স্বাধীনতা বলতে তিনি কেবল মুষ্টিমেয় ধনী বণিক গোষ্ঠীর স্বাধীনতাই বোঝেন নাই। স্বাধীনতা বলতে তিনি বুঝতেন কৃষক শ্রমিক আপামর জনগণের স্বাধীনতা। এ কারণেই তার আজীবন সাধনা ছিল কৃষকদের সংগঠিত করা। ১৯৫৬ সালে তথাকথিত গণতান্ত্রিক নেতাদের অগ্রাহ্য করে গঠন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি এবং ১৯৬৯ এ কৃষক সেচ্ছাসেবক বাহিনী। পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সেচ্ছাসেবক ও সেচ্ছাসেবক বাহিনীর গঠনমূলক কাজের কর্মসূচি ও খসড়া গঠনতন্ত্রে মওলানা ভাসানী বলেন, “মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব মানুষকে লইয়া মানুষের জন্যই অনুষ্ঠিত হইবে। যে মানুষের জন্য বিপ্লব করা হয় তাহারা কে? তাহারা হইতেছে দেশের জনসাধারণ, যাহারা সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শোষিত ও নিগৃহীত হইতেছে। এই শোষণের অবসান ঘটাইয়া সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থা কায়েম করিবার প্রাথমিক স্তর হিসেবে দেশে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজন। “

মওলানা ভাসানী কখনোই সুষ্ঠু সংগঠন গড়ে তুলতে সক্ষম হননি। কিন্তু তবুও তিনি হয়ে উঠেছেন এককভাবে এক বিরাট সংগঠন, এক বিরাট ইন্সটিটিউশন। তার এই সাফল্যের মূলে কি আছে? কারণ তিনিই তো একমাত্র নেতা যিনি বলতে পারতেন, “মাটিতে পাতিয়া কান, শুনেছি কি কহে মাটির প্রাণ।” সাড়ে সাত কোটি মাটির প্রাণ মানুষগুলো কখন কি অবস্থায় এক বলিষ্ঠ উত্তাল জোয়ারে একাট্টা হয়ে দাড়াবে তা একমাত্র মওলানার অন্যদৃষ্টিতে প্রতিভাত হওয়া সম্ভব ছিল। এ কারণেই তিনি প্রত্যেকটি আন্দোলনেই সময়োপযোগী আহ্বান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। স্বাধীনতার ডাক, ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও সর্বশেষ ফারাক্কা মিছিল তারই সাক্ষর বহন করে।

ইব্রাহীম খাঁ লিখেছেন, “ভাসানীর মওলানা সাহেবের কাজকর্ম দেখে আসার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, লোকটি বাংলার কাল বৈশাখী। প্রচন্ড তার শক্তি, ততোধিক তার বেগ। যেদিকে চলেন, তার দাপটে আধমরা ডাল ভাঙ্গে, জরাজীর্ণ গাছ উপরে যায়, বালি পাতা খসে হাওয়ায় ওড়ে, বুতোঘর ভূমিসাৎ হয়। তারপর কালবৈশাখী কোথাও চলে যায়। নতুন ঘর তোলার দায়িত্ব অন্য লোকের, নতিন চারা লাগানোর ভার অন্য মালীর, নতুন পাতা পল্লব জাগিয়ে তোলার কর্তব্য নব বসন্তের”।

মওলানা অনেক বারই বাংলার শোষিত তৃষিত বক্ষে এই কাল বোশেখীর হাওয়া তুলেছেন। অনেকবারই এই ঝড়ের পর বিশলয় জাগেনি। এর জন্য কি তিনি দায়ী ছিলেন? না, তা মোটেই নয়। তাই, আগামী দিনে বাগান সাজাবার দায়িত্ব যে বাগানকারদের উপর বাতিয়েছে, তারা যদি বাংলাদেশের জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামকে তার চূড়ান্ত যৌক্তিক পরিণতিতে পৌছে দিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে সফল হন, তাহলেই মওলানার ঝড় তোলা সফল হবে।

***

শোকসভা আজ সমগ্র বাংলাদেশ
সংগ্রামী জননেতা মওলানা ভাসানীর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বিচিত্রার সাক্ষাৎকার

মজলুম জননেতা লোকান্তরিত হয়েছেন। আফ্রো – এশীয় – ল্যাটিন – আমেরিকার মুক্তিকামী নির্যাতিত গণমানুষের সোচ্চার কন্ঠস্বর, এশীয় রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের শ্রদ্ধেয় নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর এই অকস্মাৎ মৃত্যু দল মত নির্বিশেষে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষকে গভীরভাবে মর্মাহত করেছে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা সুসংহত করার এক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আমরা এমন একজন মহান নেতাকে হারিয়েছি যিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হয়েও দেশকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তার অকস্মাৎ মৃত্যুতে সাড়ে সাত কোটি মানুষ হয়েছে নিরাশ্রয়ী, গৃহহীন। শতাব্দী প্রবীণ রাজনীতিক মওলানা ভাসানীর সূদীর্ঘ ৭৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি সৎ, সাহসী, নির্ভুল নেতৃত্ব প্রদান করে যে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, বাংলাদেশের মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

ইতিহাসের স্রষ্টা মওলানা ভাসানীর সহজ – সরল, এক নিরহংকার জীবন যাপন, দ্রুত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা, ব্যাক্তি এবং দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা এবং সর্বপরি দেশ ও জাতির জন্য আত্মোৎসর্গ করার মহান ব্রত আমাদের আগামী দিনের রাজনীতিকদের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবে।

কিংবদন্তী মহানায়ক মওলানা ভাসানীর আকস্মিক মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ।

শোকার্ত জনতার মধ্যে যারা দীর্ঘকাল মজলুম জননেতার সঙ্গে কাজ করেছেন, যারা সুদীর্ঘকাল মওলানা সাহেবের সঙ্গে ছিলেন, তার সুখ দুঃখের অংশীদার হয়েছেন, বিচিত্রার পক্ষ থেকে তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহনের দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। খুবই স্বল্প সময়ের ভেতর আমি তার ঘনিষ্ঠ শুভাকাঙ্ক্ষী, (যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে) যাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, তাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন – তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহন করি। তাদের মধ্যে রয়েছেন, জনাব হাজী মোহাম্মদ দানেশ, জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব আবদুল জলিল, জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান, জনাব মীর্জা গোলাম হাফিজ, জনাব মোহাম্মদ তোয়াহা, জনাব সিরাজুল হোসেন খান, মিসেস ফরিদ হাসান।

বিচিত্রা ‘র পক্ষ থেকে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যু সম্পর্কে তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে পৃথক পৃথক সাক্ষাৎকারে তারা নিম্নলিখিত অভিমত ব্যক্ত করেন।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ

মওলানার মৃত্যু প্রতিক্রিয়াশীল দের জন্য পৌষ মাসের মত হয়েছে। তিনি বেঁচে থাকলে এখানে বিদেশী শক্তির এজেন্টদের পক্ষে কাজ করা সহজ ছিলো না৷ তার মৃত্যুর পর বিদেশী এজেন্টদের এখানে কাজ করা অধিকতর সহজ হবে।

বয়োবৃদ্ধ কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ স্মৃতিচারণ করছিলেন। মওলানা সাহেবের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৫০ সালে। জেলাখানায়। বলকে গেলে প্রায় ২৬ বছর একত্রে ছিলেন, মওলানা সাহেবের সঙ্গে কাজ করেছেন। বললেন, “আমি এমন কোন লোক দেখিনি যিনি ওনার মত জনগণের সাথে মিশতে পেরেছেন। হি ইজ ম্যান অব দি পিপল। তার ভেতর কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের জন্য এক ধরণের আলাদা দরদ ছিল। “

জাগমুই সভাপতি এবং জাতীয় কৃষক ফেডারেশনের আহ্বায়ক হাজী মোহাম্মদ দানেশ বলেন, মওলানা সাহেব বেঁচে থাকলে বামপন্থীদের মধ্যে ঐক্যের সম্ভাবনা ছিল। তিনি ঐক্যের আহ্বান জানালে বিভিন্ন বামপন্থী দল তাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসতো। আমি মনে করি, উনি বেঁচে থাকলে বামপন্থীদের উপর প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমণের সম্ভাবনা থাকতো না। এখন যে সমস্যার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

আতাউর রহমান খান

প্রবীণ নেতা, বাংলাদেশ জাতীয় লীগের আহ্বায়ক জনাব আতাউর রহমান খান মওলানা ভাসানীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেন, মওলানা সাহেব এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক উথ্বান পতনের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তার মৃত্যু এক নিদারুণ আঘাত হানলো। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের স্বপক্ষে তার সংগ্রামী ইতিহাস চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আমি মনে করি এবং দৃঢভাবে বিশ্বাস করি, ফারাক্কা প্রশ্নে মওলানা সাহেবের আন্দোলন এবং বলিষ্ঠ প্রতিবাদের জন্যই এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় স্থান লাভ করেছে। আজ যে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমর্থন লাভ করেছি, এর পশ্চাতে রয়েছে মওলানার একনিষ্ঠ অবদান।

জাতীয় লীগ প্রধান বলেন, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে মওলানা সাহেবের বেঁচে থাকার প্রয়োজন ছিল সর্বাধিক। তার এই আকস্মিক মৃত্যুতে আমাদের দায়িত্ব আরো বেড়েছে। সওলানা সাহেবের অসমাপ্ত কাজ এখন আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাপ্ত করতে হবে। সেটাই হবে মওলানার প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন।

প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে আতাউর রহমান খান বলেন, ভাসানী সাহেবের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল ৩০ বছর পূর্বে। বিভিন্ন সময় পাশাপাশি থেকে আন্দোলন করেছেন। ১৯৭০ সালে বন্যা বিদ্ধস্ত বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) নির্বাচন বিরোধী আন্দোলনের ডাক দিলে তিনি মওলানা ভাসানীর পাশে এসে দাড়ান। আতাউর রহমান খানের মতে, মওলানা ভাসানী দলীয় সংকীর্ণতার বহু উর্ধ্বে ছিলেন এবং একমাত্র তিনিই জাতীয় ঐক্য গঠনে সক্ষম ছিলেন।

আবদুল জলিল

তিনি মসজিদে গিয়েছিলেন। আমি তার টিপু সুলতান রোডস্থ বাড়ীতে বসে আলাপ করছিলাম তার স্ত্রীর সঙ্গে। এই বাড়ীতে বহুদিন কেটেছে মওলানা সাহেবের। ১৯৭৩ সালের দিকে, মনে পড়ে, এই বাড়িতেই আমি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে খুব নিকট থেকে প্রথম বারের মত দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। বেগম জলিল বললেন, আপনি বসুন, তকর ফিরতে একটু দেরী হতে পারে। সেই সুযোগে তিনি মওলানা সম্পর্কে বিভিন্ন ঘটনার কথা বললেন, ‘হুজুরের মুখ থেকে আমি এতসব গল্প শুনেছি যে তা লিখলে ১০ টি বড় বই হয়ে যাবে। কিংবদন্তীর নায়ক ছিলেন তিনি। তার গল্প শুনে আমরা বহুদিন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছি। ‘

জলিল সাহেব এলেন। প্রাক্তন ন্যাপ নেতা, মওলানা সাহেবের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। গম্ভীর অবয়ব, বীর পদক্ষেপে এলেন তিনি।

“কী বলবো বলুন! আমরা ছায়া হারিয়ে ফেলেছি। বটবৃক্ষের মতোন তিনি আমাদের ছায়া দিয়েছেন, তিনি তো আর রইলেন না। ” একটু থামলেন জলিল সাহেব। তারপর বেশ একটু সময় নিয়ে বললেন, দুঃখী মানুষের একমাত্র বন্ধু ছিলেন মওলানা। খুব কাছ থেকে দেখেছি, পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারতেন তিনি। ব্যবস্থা গ্রহন করতে বিলম্ব করতেন না এক মুহূর্তও। ডিসিশন নেবার ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ সঠিক রাষ্ট্রনায়কোচিত তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। কোন রকম দোদুল্যমানতা তার মধ্যে ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মওলানা সাহেব ডিসিশন নিতে ভুল করেননি কোন দিন।

জলিল সাহেব বললেন, মওলানা সাহেবের বিচিত্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকলিত হওয়া উচিৎ। আগামীদিনের বংশধরদের জন্য তা হয়ে যাবে এক ঐতিহাসিক দলিল।

ইয়ার মোহাম্মদ খান

মওলানা ভাসানীর এককালীন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ইয়ার মোহাম্মদ খান তার প্রতিক্রিয়ার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, তার মৃত্যুতে যে ‘বিপুল ভ্যাকুয়াম’ সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ হবার নয়। সাধারণত যে কোন মহান রাজনীতিক পরলোকগমন করলেই এ কথা বলা হয়ে থাকে। তবে এই প্রথমবারের মতো আমি ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করলাম, দেশে সত্যিকার ভ্যাকুয়াম তৈরী হয়েছে। তিনি বলেন, আপাতঃদৃষ্টিতে যদিও মনে হয় মওলানা সাহেবের রাজনৈতিক বক্তব্য গুলো ছিল স্ববিরোধীতায় পূর্ণ। কিন্তু বস্তুতঃ মনে হলেও রাজনৈতিক ব্যাপারে মওলানা সাহেবের বক্তব্য এতো এ্যাকুরেট, এতো প্রফেটিক ছিলো আমাদের কাছেই অবিশ্বাস্য লেগেছে কখনো কখনো। সাধারণ্যে মওলানা সাহেবের রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে কখনো কখনো যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে প্রধান কারণ ছিলো, তিনি সমস্ত ব্যাপারগুলিকে অবজেক্টিভলী গ্রহন করতেন।

ইয়ার মোহাম্মদ সাহেব বললেন, “৩২ বছর ধরে দেখেছি, মওলানা পাক্কা মুসলমান হয়েও একজন সম্পূর্ণ নন – কমিউনাল মানুষ। কমিউনিজমে তার বিশ্বাস ছিলো মানসিক যে কোন বড় কমিউনিস্টদের চাইতে তিনি ভালো কমিউনিজম প্র্যাকটিস করে গেছেন। সারাটা জীবন তাকে ছনের ঘরেই দেখলাম৷ ‘প্রো পিপল’ মওলানার হাজার খানেক মিটিং এ আমি উপস্থিত হতে পেরেছি। এতো বড় বক্তা আমি জীবনে কম দেখেছি। খলিফাদের চাইতেও সাধারণ জীবন যাপন করে গেলেন তিনি। সারাটা জীবন এভাবেই কাটলো তার।

মীর্জা গোলাম হাফিজ

বাংলাদেশ – চীন মৈত্রী সমিতির সভাপতি মীর্জা গোলাম হাফিজ ১৯৪৪ সাল থেকে জড়িত ছিলেন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। এই মৃত্যু তাকে দারুণ মর্মাহত করেছে৷ বললেন, ” এই মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে দেশের বামপন্থীদের। বামপন্থীরা মওলানার মৃত্যুতে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। “

হাফিজ সাহেব মধ্যরাত পর্যন্ত মওলানার জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বললেন। মওলানা ছিলেন কিংবদন্তি নায়ক। আসামের ধুবরীতে মওলানাকে নিয়ে কিংবদন্তি চালু আছে। হাফিজ সাহেব অবশ্য কিংবদন্তিতে বিশ্বাস করেন না। তবে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস সম্পর্কে একটি ঘটনার উল্লেখ করলেন। ১৯৪৬ সালে আসামের ধুবরীতে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডদের এক কনফারেন্স ডেকেছিলেন মওলানা সাহেব। ভারত ভাগের প্রাক্কালের ঘটনা এটা। হাফিজ সাহেব তখন প্রাদেশিক মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড- এর ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। তারা ন্যাশনাল গার্ড নিয়ে এলেন ধুবড়ীতে। দু দিন একটানা জার্নি করে ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য গণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। খাবার দাবারের কোন ব্যবস্থাই করা হয়নি। মওলানা সাহেবকে বলা হল। গুরুত্বই দিলেন না তিনি। বললেন, অত ভাবার কি আছে! সব ঠিক হয়ে যাবে। মাত্র দু তিন ঘন্টার ব্যবধানে ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য গণ দেখলেন দূর দূরান্ত থেকে চাল ডাল মাছ মাংস নিয়ে হাজার হাজার মানুষ আসতে লাগলো। রান্না হল, খেয়ে শেষ করা গেল না। সবাই অবাক হয়ে গেলেন। সেই থেকে লোকদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মে গেল, মওলানা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী।

মওলানার মৃত্যুর পর তার প্রতিক্রিয়ার কথা জানাতে গিয়ে হাফিজ সাহেব বলেন, তিনি আপোষহীন নেতা। শ্রেণী সংগঠনের বিশ্বাসী না হয়েও তিনি আপামর জনসাধারণের সাথে মিশেছেন। তাদের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করেছেন। তার সুদীর্ঘ ৭৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, তিনি সময়ের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চাননি। তার পথ ছিল অব্যাহত সংগ্রাম চালিয়ে যাবার পথ। তিনি পার্টিকে আপামর জনসাধারণের দাবী দাওয়া আদায়ের প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছেন – ক্ষমতা দখলের জন্য নয়।

বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক চেতনার মূলে রয়েছে মওলানার অপরিসীম অবদান। তিনি এদেশের সংগ্রামী মানুষের রাজনৈতিক শিক্ষক।

মোহাম্মদ তোয়াহা

তিনি মাত্র দুদিন পূর্বে মেডিক্যাল ছেড়ে যোগীনগরের বাড়ীতে এসেছেন। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তার। তবু সাক্ষাৎকার দিলেন তিনি। বুকে হাত দিয়ে থেমে থেমে কথা বলছিলেন। সাম্যবাদী দলের অন্যতম নেতা, গণশক্তি সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহা। “একজন ন্যাশনাল প্যাট্রিয়ট’কে হারিয়েছি আমরা!”

মওলানা সাহেবের এককালীন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী মোহাম্মদ তোয়াহা বললেন, মওলানা সাহেবের ইন্তেকালে বাংলাদেশ হারালো তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে। এ দেশের রাজনীতিতে অবসান হলো একটি যুগের। মওলানা সাহেব ছিলেন আমাদের জাতীয় সংগ্রামের একজন পুরোধা। পাকিস্তান আমলে তিনি বৃটিশ ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে অবিচল ভাবে সংগ্রাম করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত। তার শেষ সংগ্রামী আহ্বান ছিল রুশ – ভারতের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। “

রাত্রি তখন সাড়ে বারোটা। তোয়াহা সাহেব এমনিতে ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। কথা বলার মতো অবস্থা তার তখন ছিল না। তবুও তিনি সোফায় শুয়ে শুয়ে কথা বলছিলেন। মওলানার প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধাবোধের জন্যই তিনি অনেক কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। আমি উঠবো ভাবছিলাম। তোয়াহা সাহেব বললেন, একটি কথা লিখে নিন, ভাসানী সাহেবের মৃত্যুতে যে ক্ষতি হলো তা পূরণ হবার নয়। তবে সেই শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে তার অসমাপ্ত সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাব আমরা।

সিরাজুল হোসেন খান

তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম শ্রমিক ফেডারেশনের অফিসে৷ মিটিং চলছিল, তিনি আলোচনা করছিলেন। মিটিং শেষে দেখা করেছিলাম তার সাথে।

জাগমুই সম্পাদক এবং শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি সিরাজুল হোসেন খান বললেন, “৯৬ বছর বয়সে তার এই মৃত্যু অস্বাভাবিক নয়। তবে জনস্বার্থে তার বেঁচে থাকার দরকার ছিল। সেদিক থেকে এই মৃত্যু মর্মান্তিক, আকষ্মিক এবং অপ্রত্যাশিত বলে মনে হয়েছে আমার। তার মৃত্যুতে আমাদের জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিরাট শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। “

তিনি খুব দৃঢতার সঙ্গে বলেন, আমাদের প্রচেষ্টা হবে সর্বশক্তি দিয়ে এই শুন্যতা পূরণ করা। জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ করার ক্ষেত্রে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।

জনাব সিরাজুল হোসেন খান বলেন, মওলানা শুধু বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন উপমহাদেশের তথা সারা বিশ্বের শোষিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের নেতা। তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, এক চেটিয়া পুঁজিবাদ আর সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে।

ফরিদা হাসান

রোববার সকালে তার বাসায় গেলাম। তিনি সন্তোষ যাবেন, মওলানা সাহেবের কুলখানিতে। তৈরী হয়েছেন। গাড়ী এসে নিয়ে যাবে নিউ ইস্কাটন থেকে। গাড়ীর অপেক্ষা করছিলেন। ডিভানের উপর বসে বিষণ্ণ ম্লান চোখে তাকিয়ে ছিলেন মিসেস ফরিদা হাসান, ভাসানী ন্যাপের কোষাধ্যক্ষ মরহুম সাইদুল হাসানের বিধবা স্ত্রী৷ চোখের নীচে কালি জমে গেছে, শোকার্ত অবয়ব ফ্যাকাশে উদাস দৃষ্টি তার – মওলানা সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করতেই দু হাত তুলে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললেন হু হু করে। আমি নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলাম। অনেকক্ষণ পর কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, “আমার সব কাজ ফুরিয়ে গেছে। নানা তো আর এখানে আসবেন না।” মওলানা সাহেবের স্নেহাস্পদ মিসেস ফরিদা হাসান তাকে ‘নানা’ বলেই সম্মোধন করতেন।

মওলানা সাহেব ঢাকা এলে প্রায়ই তার ওখানে উঠতেন। মওলানা সাহেবের সেবা করতে পারছেন এটাই যেন তার অহংকার। মিসেস হাসান বললেন, কখনো কখনো মানুষের আত্মা বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে যায় – সেই স্পিরিচুয়াল পাওয়ার তিনি আয়ত্ত্বে এনেছিলেন। মওলানার এ্যাসেসমেন্ট কোন দিন এতোটুকুও ভুল হয়নি। এত বড় মানবতাবাদী লোক আমি জীবনে কম দেখেছি। “

মওলানা সাহেব খুব ভালো ইংরেজি বুঝতেন। মাঝে মাঝে কথাবার্তায় নিতান্ত প্রয়োজনীয়তা বশতঃ জোড়ালো ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করতেন। মিসেস ফরিদা হাসান বললেন, বহু বিদেশী সাংবাদিক নানাকে ইন্টারভিউ করতে আসতেন নানাদের বাড়ীতে। সে সময় আমি তার ইন্টারপ্রেটর হিসেবে কাজ করেছি। তিনি প্রশ্ন শুনেই বাংলায় উত্তর দিয়ে যেতেন। আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করে জবাব জানাতাম। কিন্তু জবাবে কোথাও একটু ভুল করে ফেললে ধরে ফেলতেন। ধমকে উঠতেন, ওভাবে বলছো কেন? পুরো লাইনটা বলে বলতেন, এভাবে বলো। একবার তৎকালীন বৃটিশ হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার মিঃ রয়ফক্স সাহেব এলেন আমার বাড়ীতে নানার সাথে দেখা করতে। মওলানা সাহেবের বয়স সম্পর্কে তিনি ‘সীওর’ ছিলেন না। জিজ্ঞেস করলেনঃ আচ্ছা মওলানা, তোমার সত্যিকার বয়স কত? নানা তখন সরাসরি জবাব না দিয়ে কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করে বললেন, তোমাদের বৃটিশ আইন অনুসারে তোমরা আমাকে যে বয়সে কারাগারে পাঠিয়েছিলে, সেখান থেকে হিসাব করে দেখলেই তো আমার সঠিক বয়সটা পেয়ে যাবে। উত্তর শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন মিঃ রয়ফক্স।

জানেন, ‘ মিসেস ফরিদা হাসান বললেন, ‘আমার তখন মনে হলো, মওলানা বৃটিশ আইনের ‘ল্যাগো’ দিয়েই তাকে জব্দ করলেন।

সাক্ষাৎকার গ্রহন – ইকবাল হাসান

***

মওলানা ভাসানী (১৮৮০ – ১৯৭৬)

– মাহফুজ উল্লাহ

কবে থেকে মওলানা সাহেবের জীবনের শুরু, সে কথা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। যে পরিবারে এবং যে সময়ে তার জন্ম সে পরিবারে তখন কোষ্ঠি করে জন্ম তারিখ টুকে রাখার কোন ব্যবস্থা ছিল না। অতি সাধারণ পরিবার থেকে মওলানা সাহেব উঠে এসেছেন এবং গোটা পরিবারের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম তিনি৷

মওলানা সাহেব বয়সের যে হিসাব দিয়েছেন তাতে তার জন্ম ১৮৮০ সালে। এই হিসেব হয়ত চুলচেরা হিসেব নয়। ভুল ত্রুটির অবকাশ আছে। এ কারণেই শতাব্দী প্রবীণ জননেতা হিসাবে অভিহিত হতেন মওলানা ভাসানী। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তার ‘প্রভু বন্ধু নয়’ আত্মজীবনীতে মওলানা সাহেবের বয়সের যে হিসাব দিয়েছিলেন, তাতে মরহুমের জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৮৫।

এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে যারা মওলানা সাহেবের সমকক্ষ, তাদের সকলেই লোকান্তরিত হয়েছেন অনেক আগে। শুধু বেঁচেছিলেন মওলানা। মহীরুহের মতো বেঁচেছিলেন মওলানা। স্মৃতি রোমন্থন কালে তিনি স্মরণ করতেন মওলানা আজাদ সুবহানী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, গোখলে সি, আর, দাশ, গান্ধী, মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী প্রমুখের কথা। এদের সম্পর্কে কথা তুললেই শ্রদ্ধায় নুয়ে আসত তার মাথা। অনুগত ভক্তের মত তিনি স্মরণ করতেন মওলানা সুবহানীর কথা – যার কাছে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন রব্বুবিয়াত কায়েমেরঃ যে রাতে নাটকীয় ভাবে গৌহাটিতে তিনি আবদ্ধ হয়েছিলেন এই অঙ্গীকারে সেটা ১৯৪৬ সালের কথা। বঙ্গীয় আইনসভার আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র পেশ করে গৌহাটিতে ফিরে গেছেন মওলানা ভাসানী। অপরদিকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তারই অনুসন্ধানে এসেছেন মওলানা আজাদ সুবহানী। রাতের বেলা দুজনের দেখা। ধূমায়িত এ্যাসট্রে’র মধ্যে মওলানা ভাসানীর আঙুল চেপে আজাদ সুবহানী বললেন, ” মওলানা মনে করো, এটাই কাবা শরীফ। এই কাবা শরীফকে ছুঁয়ে তুমি অঙ্গীকার কর যে, তুমি রব্বুবিয়াত কায়েম করবে। ” সেই থেকে মওলানা ভাসানী বহু পথ ঘুরেছেন, বহু সংগ্রামের মশাল জ্বালিয়েছেন, বহু ঘেরাও আন্দোলনের তিনি ছিলেন বিদ্রোহী নায়ক কিন্তু রব্বুবিয়াত কায়েমের সেই অঙ্গীকারের কথা তিনি ভুলতে পারেন নি। সেই অঙ্গীকারের ফলশ্রুতিতে আজকে সন্তোষে গড়ে উঠেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

হাজী শরাফত আলী খানের তিন পুত্র এক কন্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। আজ থেকে ৯০ বছর আগে এ নামে তাকে কেউ চিনত না। সবাই তাকে জানত চেগা মিয়া হিসেবে। ৬ বছর বয়সে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন সেদিনের সেই চেগা মিয়া। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই মারা যান তার ভাই – বোন এবং মা।

বাবা চাচা জীবিত থাকতেই মওলানা সাহেবকে পাঠানো হয়েছিল ময়মনসিংহের কলপা গ্রামে। সেখানে বোগদাদের পীর সাহেব সৈয়দ নাসির উদ্দীন বোগদাদীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে শিশু চেগার জীবন। বাইরের টানে সেই যে ঘরের বের হয়েছিলেন তিনি তারপর আর ঘরে ফেরেননি। বাবা – মায়ের মৃত্যুতে শেষ সম্পর্ক টুকুও ঘুচে যায়। পীর সাহেবের পথ ধরে আসামের মাটিতে পা রাখেন মওলানা সাহেব। সেই থেকে ভিন্ন এক জীবনের শুরু।

আসামের মাটিতে পা রেখে মওলানা দেখলেন এক অসহনীয় দুঃখ-দুর্দ্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে কয়েক লাখ বাঙালী। আসামের জনসংখ্যা তখন সব মিলিয়ে ১৬ লক্ষ। এদের মধ্যে বাঙালী পাঁচ লক্ষ। খাদ্যের আশায়, বস্ত্রের সন্ধানে তখন এই সব বাঙালীরা বাস্তুত্যাগী। নিজ দেশে অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, আশ্রয় নেই। আসামের বিরান জনপদে তাই তখন চলছে বসত গড়ার প্রতিযোগিতা। এই নতুন বসত আসামের জন্য সৃষ্টি করল নতুন এক সমস্যার। সেখানে দেখা দিল জাতিতে জাতিতে সংঘাত। অসমীয়রা বাঙালীদের মেনে নিতে রাজী নয়। বৃটিশ সরকার লাইন করে সীমানা দিয়ে ভাগ করে দিয়েছিলেন দুই সম্প্রদায়ের বসবাসের জন্য। বাঙালীদের ভাগে যে এলাকা পড়ল তাতে তাদের স্থান সংকুলান হয় না। কিন্তু তবু মাথা গুঁজে থাকতে হয়। লাইন ভাঙ্গার উপায় নেই।

এই পরিস্থিতিতে এক রকম ধর্মাবতারের ভূমিকা নিয়েই বাঙালীদের মাঝে উপস্থিত হলেন মওলানা ভাসানী। এর আগেই মওলানা জেনেছেন কেনিয়ার মানুষের লাইন ভেঙে দেয়ার আন্দোলনের কথা। মওলানা সিদ্ধান্ত নিলেন এই লাইন প্রথা ভাঙতে হবে। জাতিগত সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে আসামের পাহাড়ী উপত্যকায়। এদিকে আরো কিছু অসন্তোষের কারণ পেয়ে গেলেন মওলানা। প্রমথেস বড়ুয়ার বাবা তখন গোয়ালপাড়া এস্টেটের পর পরাক্রমশালী জমিদার। মওলানা দেখলেন, ইনি মুসলমানদের পক্ষ থেকে লিখিত ওয়াদা আদায় করেছিলেন যে, তারা সেই জমিদারের “সাম্রাজ্যে” কোন দিন গোহত্যা করবে না। গোহত্যা করলে তারা স্বাভাবিকভাবেই জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। আসাম প্রবাসী বাঙালীদের দাবীদাওয়ার সঙ্গে তাই যুক্ত হল আর একটি ধারা – গরু জবেহ করার অধিকার চাই৷ মওলানা লাইন সিস্টেম বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করলেন ধর্মীয় আন্দোলনকে।

উপরন্তু মওলানা সাহেব দেখলেন ইন্ডিয়া এ্যাক্ট -৮৯ ধারামতে যে কোন নাগরিক যে কোন প্রদেশে বসবাসের অধিকার লাভ করবে। এতে তার ধর্মীয় অধিকার, ভোটের অধিকার, বসবাসের অধিকার তথা কোন অধিকারই খর্ব হবে না। সব মিলিয়ে এবং কেনিয়ার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে এই সময় এই সময় তিনি একটি পুস্তিকাও লিখেন।

ধীরে ধীরে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। মওলানা ভাসানীর কাছ থেকে সংগ্রামের দীক্ষা নিতে শুরু করেন লাখো লাখো আসাম প্রবাসী বাঙালী। সহস্র জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রূপ নেয় বিদ্রোহের। তারই ফলশ্রুতিতে ১৩৪২ বঙ্গাব্দে ভাসান চরের ঐতিহাসিক সম্মেলন। মওলানা সাহেব ব্রেক করলেন লাইন প্রথা। আসামের বুকে প্রতিষ্ঠিত হল ছিন্নমূল বাঙালীদের অধিকার।

এই ঘটনা মওলানা সাহেবের দ্বিতীয় বার আসাম অবস্থানকালীন সময়ের কথা৷ মাঝখানে তিনি কয়েকটি সংগ্রামী বছর কাটিয়ে গেছেন টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ আর রংপুরে। এই কয়েক বছর সংগ্রামের বছর। সম্মেলন আর সংগঠনের বছর। এই সময়ে মওলানা সাহেব রিলিফ নিয়ে বন্যাদুর্গত দের পাশে দাড়িয়েছেন।, কৃষক প্রজা সম্মেলনের আয়োজন করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত হয়েছেন বহিষ্কৃত।

১৩৩৭ এর বন্যায় যখন গোটাদেশ প্লাবিত হয়ে যায়, বন্যার পানিতে সে সময় আসাম থেকে রিলিফ নিয়ে টাঙ্গাইলের বন্যা দূর্গত মানুষের পাশে দাড়ান মওলানা ভাসানী। এসেভ তিনি কাজ শুরু করেন টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলে। ধীরে ধীরে এই মানুষটি সম্পর্কে শ্রদ্ধার ভাবরজেগে ওঠে টাঙ্গাইল বাসীদের মনে। মওলানা সাহেব সম্পর্কে অদ্ভুত সব কথা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। দলে দলে লোক আসতে শুরু করে তার কাছে। কেউ একটু ঝাড় ফুঁক, কেউ চায় একটা তাবিজ, কেউ চায় তার হাতে চুমু খেয়ে ধন্য হতে। বিরাট এক মুরীদ বাহিনী তৈরী হল তার।

তখন সন্তোষে জারি রয়েছে এক হিন্দু জমিদারের জমিদারী এর একটা ইতিহাস আছে। এখানকার সবাই জানেন সে কাহিনী। এক সময় এ জমিদারীর মালিক ছিলেন মুসলমানেরা। কাশ্মীর থেকে আগত পীর শাহ জামান ছিলেন এই জমিদারির মালিক। শাহ জামান ছিলেন নিঃসন্তান। ধর্ম এবং শিক্ষা প্রচারে কাশ্মীর থেকে এসেছিলেন হযরত শাহ জামান। ষাটনা গ্রামের ইন্দ্রনাথ চৌধুরী তার কাছে ফরাসী পড়তেন। শাহ জামানের কাছে তিনি গ্রহন করেন ইসলাম ধর্ম। সেই সঙ্গে তিনি লাভ করেন শাহ্ জামানের দত্তক পুত্রের সম্মান৷ ইন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর ধর্মান্তরিত নাম হয় শাহ এনায়েতুল্লাহ চৌধুরী। এই সময়ে সন্তোষের নাম ছিল খোশনাতপুর। কথিত আছে, শাহ এনায়েতের হিন্দু নায়েবের মেয়ে কমলা পিতার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শাহ এনায়েতকে হত্যা করে এবং এভাবেই জমিদারী হস্তান্তরিত হয়ে যায় আজকে সন্তোষের জমিদার বলে পরিচালিত জমিদারদের হাতে।

১৩৩৭ – এ টাঙ্গাইলে এসে মওলানা সাহেব অন্য আরো অনেক কিছুর সঙ্গে মুসলমানদের পক্ষ থেকে দাবী করলেন জমিদারীর মালিকানা। সেই সঙ্গে যুক্ত হল কৃষকদের বিভিন্ন দাবী দাওয়া। জমিদারদের অত্যাচারে ওরা জর্জরিত। সর্বস্ব হারাতে বসেছে। এই সময়ে ত্রাণকর্তা হিসেবে এলেন মওলানা ভাসানী। গোটা এলাকা জুড়ে শুরু হল অসন্তোষ।

মওলানা সাহেব পীর শাহ জামানের মাজারে উদ্যোগ গ্রহণ করলেন মসজিদ প্রতিষ্ঠার। এজন্য তাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন স্থানীয় জনগণ। কিন্তু বাঁধা এল জমিদারের নায়েব, উকিল মনমোহন নিয়োগীর কাছ থেকে। মওলানা সাহেব বলেছিলেন – তখন টাঙ্গাইলের এস, ডি, ও ফারুক সাহেব। জমিদার আর এস, ডি, ও র বন্ধুত্ব বোতলের কারণে৷

জমিদার অভিযোগ আনলেন, মসজিদ তৈরীর কথা বলে মওলানা জমিদার বিরোধী আন্দোলন শুরু করতে চাইছেন, মওলানা প্রজাদের বলে দিয়েছেন, খাজনা – ট্যাক্স বন্ধ করে দিতে। জমিদার আপিল জানালেন ১৪৪ ধারা জারি করে মওলানাকে তার ১৬ জন সাগরেদ সহ খোশনাতপুর (সন্তোষ) থেকে বের করে দেয়া হোক। ময়মনসিংহের তৎকালীন এস, পি র রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৪৪ ধারা জারি করে দু পক্ষকেই নিবৃত্ত করা হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ থেকে। অপর দিকে ১৪৪ ধারা মোতাবেক কোর্টে মওলানার বিরুদ্ধে রুজু হয় মামলা। মামলা চলাকালীন সময়েই মওলানা ভাসানী বাঁশ গেড়ে এই এলাকা দখল করেন এবং খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা করেন৷

এতে জমিদারের রোষ দিগুণ হয়ে ওঠে। তৎকালীন বাংলার গভর্নর জেনারেলের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন কোলকাতা নিবাসী সন্তোষের মহারাজা। তারই প্ররোচনায় মওলানার উপর নির্দেশ জারি হয় ময়মনসিংহ ছেড়ে চলে যাবার। ময়মনসিংহ ত্যাগী মওলানার আস্তানা এবার সিরাজগঞ্জ। সিরাজগঞ্জ এসেই মওলানা আয়োজন করেন বঙ্গ – আসাম প্রজা সম্মেলনের। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জেন্ট খান বাহাদুর আবদুল মোমিন। সম্মেলনে অন্যান্য দের মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দীও এসেছিলেন। সম্মেলনে প্রস্তাব গ্রহন করা হয়, জমিদারীর অবসান, মহাজনদের নিয়ন্ত্রণে করা চক্রবৃদ্ধি সুদের অবসান প্রভৃতি দাবী জানিয়ে। পাবনায় তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস, এম দাশ এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে সম্মেলনের পাঁচ দিন পূর্বে পাবনা ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন মওলানাকে।

সেই বছরই সবেমাত্র সিরাজগঞ্জের সাথে ট্রেন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কোলকাতার। নির্দেশ মোতাবেক ফিরতি ট্রেনেই কোলকাতা রওয়ানা দেন মওলানা ভাসানী। কলকাতায় গিয়ে তিনি দেখা করেন খান বাহাদুর নাজির উদ্দিন এবং খান বাহাদুর আবদুল মোমিনের সঙ্গে। এদের মাধ্যমে সাক্ষাৎ ঘটে গভর্ণর জেনারেলের সঙ্গে৷ কিন্তু বিশেষ কোন লাভ হয়নি। নিষেধাজ্ঞা জারি থাকে।

১৩৩৮ বঙ্গাব্দের শেষাশেষি মওলানা ভাসানী অনুরূপ আর একটি সম্মেলন আয়োজন করেন রংপুরের গাইবান্ধায়। এই সম্মেলনের কারণে তাকে এবার ছাড়তে হল বাংলাদেশ। আসামের পথে পাড়ি দিলেন মওলানা। সেই আসামে শুরু হল তার ভিন্ন জীবন কাহিনী।

জীবনের সুদীর্ঘ ১৩ বছর আসামে প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন মওলানা। এই সময়ে কখনো জেল খেটেছেন, কখনো গ্রেফতার এড়াতে গিয়ে পাহাড়ের গুহায় মগ্ন থেকেছেন ধ্যানে। তোরাব ফকির ছিলেন এই সময়ে মওলানা ভাসানীর নিত্য সহচর। একমাত্র আসামেভ মওলানা সাহেব জেল খেটেছেন ৮ বছর। আন্দোলন করে আসামের প্রাদেশিক পরিষদে নিশ্চিত করেছেন বাঙালীদের জন্য ৯ টি আসন। আসাম প্রবাসী বাঙালীদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১১ বছর ভোগ করেছেন আসাম আইনসভার সদস্যপদ।

আসাম মওলানাকে অনেক কিছু দিয়েছে। দিয়েছে গৌরব, দিয়েছে খ্যাতি। মওলানার রাজনৈতিক জীবনের রোমাঞ্চকর অধ্যায় কেটেছে আসামে। এত কিছুর পরেও আসাম দেশ ভাগাভাগির সময় পড়েছে ভারতের ভাগে৷ এজন্য মওলানা দায়ী করেন তৎকালীন আসাম মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দকে। সে সময় মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে একদিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মওলানা ভাসানী, অন্য দিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্যার স্যার সাদুল্লা। মওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট এবং স্যার সাদুল্লা আসামের মুখ্যমন্ত্রী। বিরোধ এদের বহুদিনের। একজন বাঙালী, অপরজন অসমীয়া।

এই বিরোধ চুড়ান্ত রূপ নেয় বড়পেটা সম্মেলনে। সম্মেলনে নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন চৌধুরী খালেকুজ্জামান। আরো এসেছিলেন কাজী মোহাম্মদ ঈশা এবং মামদোতের নওয়াব। শেষোক্ত দুজনের ওপর মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির নির্দেশ ছিল মওলানা ও স্যার সাদুল্লার মধ্যেকার বিরোধ নিষ্পত্তির।

যথাসময়ে শুরু হল বড়পেটা সম্মেলনের কাজ। মঞ্চে দাড়িয়ে স্যার সাদুল্লার বিরুদ্ধে একে একে সবকটি অভিযোগ উথ্বাপন করলেন মওলানা ভাসানী৷ মঞ্চে বসে রয়েছেন অন্যান্য দের সঙ্গে স্যার সাদুল্লা। মওলানা এমন ভাবে বক্তব্য তুলে ধরলেন যাতে উপস্থিত শ্রোতামন্ডলী স্যার সাদুল্লাকে অভিযুক্ত করেন। এর পর এলো স্যার সাদুল্লার অভিযোগ খন্ডনের পালা। কিন্তু ততক্ষণে জনমত তৈরী হয়ে গেছে স্যার সাদুল্লার বিরুদ্ধে। নিরুপায় সাদুল্লা তার বক্তব্য শেষ না করেই বিদায় নিলেন। সন্ধায় সরকারী ডাক বাংলোয় শুরু হলো আপোস আলোচনা। কিন্তু চূড়ান্ত সমাধান হলে না। গভর্নরের কাছ থেকে জরুরী তার বার্তা পেয়ে চলে যেতে হল সাদুল্লাকে। ততক্ষণে জাপানী বোমারু বিমান বোমা ফেলেছে কোহিমা এবং ডিব্রুগড়ে। সাদুল্লার প্রতিনিধি হিসেবে থেকে গেলেন তৎকালীন মন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরী।

ব্যক্তিগত ভাবে সাদুল্লার বিরুদ্ধে মওলানার অভিযোগের অন্ত ছিল না। মওলানা বলতেন, লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট গোপীনাথ বরদলুই তাকে সমর্থন দার করলেও সাদুল্লা তাকে সমর্থন দান করেননি। সাদুল্লা যখন আসামের মুখ্যমন্ত্রী তখন আসামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। এমনকি এর জন্য তিনি চেষ্টাও করেননি। মওলানা ভাসানী একাই ৩২ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেছেন আসামে। অথচ শেষ দেশ ভাগাভাগির সময়ে সাদুল্লাই জয়ী হলেন। এ দুঃখ মওলানার বহুদিনের। স্মৃতি রোমন্থনের সময়ে মওলানা বলতেন, সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ কমিটি তাকে বাদ দিয়েই ভাগাভাগির প্রস্তাবে আপোস করে৷

আসামে মওলানা ভাসানীর সংগ্রাম ছিল দারিদ্রের বিরুদ্ধে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে এবং আসাম সরকারের বিরুদ্ধে। আসামে থাকাকালীন সময়ে, সম্ভবত, ১৯৩৭ সালেই মুসলিম লীগে যোগদান করেন মওলানা ভাসানী। শেষ দিকে, আসামের দিনগুলো কাটিয়েছেন কারান্তরালে। মুক্তি পেয়ে ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার মাটিতে পা রাখেন মওলানা।

পাকিস্তানে এসেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মওলানা ভাসানী। প্রায় একই সময়ে তিনি সংগঠিত করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৪৯ সালে কোলকাতা থেকে ফিরে এসে সোহরাওয়ার্দীও মওলানার সাথে যোগ দেন।

১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় এলে তার বিরুদ্ধে ভুখা মিছিল পরিচালনা করে মওলানা। ১৬ ই অক্টোবর ঢাকায় আসেন লিয়াকত আলী খান। সেদিনই আরমানীটোলা ময়দানে জনসভার আয়োজন করেন মওলানা ভাসানী। সমাবেশ শেষে যে বিক্ষোভ মিছিল হবার কথা ছিল, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট৷ তা বন্ধ করার জন্য আলী আহমেদ ও আতাউর রহমান খানকে অনুরোধ জানান। তারা এ অনুরোধ মওলানা ভাসানী কে জানালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। কাজেই ১৬ ই অক্টোবর বিকেলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের সেই জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভাই সর্বপ্রথম পূর্ব বাংলার তৎকালীন মন্ত্রী সভার বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করে।

সভাশেষে, মওলানার নেতৃত্বে বের হয় ভুখা মিছিল। মিছিলটি নাজিরা বাজার রেল ক্রসিং এর কাছে উপস্থিত হলে পুলিশ তাতে বাঁধা দান করে। এ সময় যখন অন্যান্যদের সঙ্গে পুলিশের তর্ক চলছে, তখন মওলানা ভাসানী রেলক্রসিং এর কাছেই নামাজ পড়তে দাড়িয়ে যান৷ এই সময়, এই অবস্থায় একজন পুলিশ তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে এলে ব্যারিস্টার শওকত আলী সে লাঠি ধরে ফেলেন। এর পরেই অন্যান্য দের সাথে গ্রেফতার করা হয় মওলানাকে। কারাগারে ১৯৫০ সালে তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। এর পরই তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সরকার।

জেল থেকে বেরুনোর পর শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। পুনর্বার ভাষা আন্দোলনের সময় তাকে যেতে হয় কারাগারে – ১৯৫২ সালে। ১৯৫৩ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে মুসলিম লীগের জন বিরোধী আচরণের জবাব দেন মওলানা ভাসানী – ১৯৫৩ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে৷

১৯৫৫ সালের দিকে ধর্ম নিরপেক্ষতার দাবীতে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দেন মওলানা। এখানেই মওলানার সঙ্গে অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরোধের সুত্রপাত। ১৯৫৬ সালে এ বিরোধ চূড়ান্ত রূপ নেয়, যখন মওলানা দাবী তোলেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের। সে বছর কাগমারীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনেই দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায় আওয়ামী লীগ। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের দাবী তোলেন মওলানা। ফলশ্রুতিতে তাকে আখ্যায়িত করা হয় ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে।

১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন মওলানা ভাসানী। একই সময় ঢাকায় গোটা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক নেতা ও কর্মীদের এক সম্মেলনের আয়োজন করেন মওলানা। এই সম্মেলনেই ন্যাপের সাংগঠনিক কাঠামো চূড়ান্ত রূপ নেয়। ন্যাপ গঠনের কারণ হিসেবে মওলানা ভাসানী বলেছেন,

“যুগে যুগে ধরিয়া আমাদের পূর্ব পুরুষগণ মুক্তি ও গণতন্ত্রের যে আদর্শ লইয়া সংগ্রাম করিয়া গিয়াছেন, যে আদর্শ ও প্রেরণায় উদ্ভুদ্ধ হইয়া আমরা পাকিস্তান সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলাম সেই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শ আজও বাস্তবে রূপায়িত হয় নাই৷ আমাদেন স্বাধীন পাকিস্তান অর্জনের পর দশ বছর অতিক্রান্ত হইলেও মজলুম জনসাধারণের জীবনে স্বাধীনতার ছোঁয়াচ লাগে নাই৷ পাকিস্তানের কোটি কোটি নরনারী আজো নিষ্পেষিত, অত্যাচারিত ও শোষিত। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও জনসাধারণের আর্থিক দূর্গতি নিরসনের সওয়াল নিয়েই একদা আওয়ামী লীগ গড়িয়া উঠিয়াছিল। সেই আওয়ামী লীগের নেতারাও আজ ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাহাদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির খেলাফ করিতেছেন। এবং আওয়ামী লীগ সংগঠনকে উহার নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত করিয়াছে।

বার বার প্রতারিত হইয়া দেশের মানুষের মনে সন্দেহ জাগিতেছে এবং তাহারা নিরাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হইতেছেন। আজ আমি বলিতে চাই যে, সত্য ও মিথ্যার লড়াই, শোষক ও শোষিতের লড়াই, জমিদার ও প্রজার লড়াই, সুদখোর মহাজন ও ঘাতকের লড়াই, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্যবাদের লড়াই, ধর্ম অধর্মের লড়াই – বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন যেখানেই হইয়াছে, তাতে যে সমস্ত নেতা ও কর্মী অংশগ্রহণ করিতেন, তাহাদের ত্যাগ, কোরবাণী ও নির্যাতন ভোগের মাপকাঠিতে সেই সংগ্রাম বা লড়াই ততটা সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হইয়াছে। ইহার নজীর বিশ্বনবী ও তাহাদের সাহাবাদের জীবনে ও বর্তমান নবীন চীনের মুক্তি ও উন্নতির ইতিহাস আমাদের সম্মুখে মজুত। পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বহু লোকের বহু ত্যাগ, কোরবাণীর ইতিহাসও আমাদের সম্মুখে মওজুত আছে। কিন্তু ওই সমস্ত ত্যাগী দেশপ্রেমিক দের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতার পূর্বেই অথবা স্বাধীনতার কিছুদিন পরেই আমাদিগকে চিরদিনের জন্য তাহাদের সাধনা ও আদর্শ হইতে বঞ্চিত করিয়া আল্লাহ্ র ইচ্ছায় পরলোক গমন করিয়াছেন। আজ যাহারা পাকিস্তানের কর্ণধার, ইহাদের মধ্যে যখনই যে দল ক্ষমতা দখল করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে খুব কম লোকই আছেন যাহারা স্বাধীনতা সংগ্রামে কোন প্রকারের কোরবানি বা নির্যাতন ভোগ করিয়াছেন। নির্যাতিত নেতা যে রূপ ভাবে দেশের নির্যাতিত জনসাধারণের প্রতি দরদ রাখেন, যাহারা জীবনে কখনো জালেমের জুলুমে পতিত হন নাই, তাহাদের পক্ষে দেশের লোকের প্রতি সেরূপ দরদ রাখা সম্ভপর নহে।

তাই আজ আমার মনে হয় আজ মরহুম কায়েদে আযম, মরহুম মওলানা আলী, হেকিম আজমল খাঁ, মওলানা শওকত আলী, মওলানা হযরত মোহানী, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ প্রভৃতি ত্যাগী মহাপুরুষ গণ জীবিত থাকিয়া পাকিস্তানের উভয় অংশের কর্ণধার রূপে শাসন পরিচালনা করিতেন, তাহা হইলে আজ দশ বৎসর আল্লাহর মর্জি পাকিস্তানের আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নৈতিক উন্নতি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাইত। বিশেষ করিয়া প্রায় দুই শত বৎসরকার বিদেশী ইংরেজের শাসন ও শোষণের তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণ করিলে পাকিস্তানের বর্তমান কর্ণধার গণ যেভাবে পুনরায় বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী ও শোষকদের নিকট পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করিবার জন্য সামরিক চুক্তি করিয়া পুনরায় দেশবাসীকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন, তাহাতে শঙ্কিত না হইয়া উপায় নেই। উপরে উল্লেখিত মরহুমেরা রাজনীতি করিতেন দেশী ও বিদেশী সকল শ্রেণীর শোষকদের কবল হইতে মুক্ত করিয়া দেশ ও জাতিকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করিতে। বর্তমানে যাহারা রাজনীতি করেন, তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই করেন ক্ষমতা লাভ ও নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য। তাই দেখা যায়, ক্ষমতা লাভের পূর্বে যাহাদের বিশেষ কিছু সহায় সম্পত্তি ছিল না, তাহারাও যখন ক্ষমতায় যান তখন কিছুকালের মধ্যেই ণিজের জন্য ২/৩ মনজেলা বাড়ী, গাড়ী, আত্মীয় স্বজনের চাকুরী, পারমিট, লাইসেন্স ইত্যাদির সাহায্যে দলীয় মোসাহেব ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের অবস্থা আমূল পরিবর্তন করিয়া ফেলে। ইহা লক্ষ্য করিয়া পর পর বিভিন্ন দল গদী দখল করিবার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করিতে থাকে৷ দেশ, জাতি ধ্বংস হইলো কিনা তাহা লক্ষ্য করিবার মত দৃষ্টিভঙ্গি এখন পর্যন্ত যত যত দলের লোক ক্ষমতা দখল করিয়াছে, তাহাদের সমষ্টিগতভাবে কোন দলের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয় নাই। প্রত্যেক দলের নেতারাই প্রতিযোগিতামূলক ভাবে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ হাসেল করতে আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছে এবং করিতেছে৷ ইহার প্রতিকার না হওয়ার একমাত্র কারণ পাকিস্তানের মেরুদণ্ড পল্লীবাসীদের ভিতর সত্যিকার কর্মসূচি লইয়া আমরা সংগঠন স্থাপন করিতে পারি নাই। বর্তমানে যে কোন রাজনৈতিক দলই হোক না কেন, তাহাদের শাখা সমিতি সামান্য যাহা কিছু কায়েম হইয়াছে, তাহাতে গ্রাম্য প্রতিনিধি নাই বললেই চলে। অধিকাংশই শহরের উকিল, মোক্তার, ব্যবসায়ী ইত্যাদি শ্রেণীর লোক। গ্রামে বাস কলে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৫ জন লোক কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলে ই তাহাদের সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধি নাই। তাই আমার মনে হয় যে, পাকিস্তানের উভয় অংশে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক কৃষক সমিতি অধিক পরিমাণে কায়েম করা প্রয়োজন।

পূর্ব পাকিস্তানের ৬০ হাজার গ্রামের ৪ কোটি কৃষক ভূমিহীন মজুর বিড়ি – শ্রমিক অন্যান্য ছোট ছোট কারখানার শ্রমিক, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পের মালিক ব্যবসায়ী, প্রাইমারী, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বেসরকারী কলেজ প্রভৃতির শিক্ষক, মৎসজীবি প্রভৃতির হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফলেই আজও পাকিস্তান টিকিয়া আছে৷ তাহাদিগকে বাঁচাইতে পারিলেই পাকিস্তান বাঁচিবে, তাহাদের আন্তরিক সহযোগিতা লাভের দ্বারাই কৃষি, শিল্প ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি গঠনমূলক কাজে উন্নতি লাভ করা সম্ভবপর। উভয় পাকিস্তানের পল্লীতে ভ্রমণ করিলে দেখা যায়, একশত টাকার নোট তো দূরের কথা, দশ টাকার নোট ভাঙ্গাইতেও পঁচিশ ত্রিশ বাড়ী ঘুরিয়া খুচরো টাকা পাওয়া যায় না। ইহার দ্বারাই পরিষ্কার ভাবে বুঝা যায় যে, দেশের সম্পদ ও অর্থ ক্রমেই বিদেশী শোষক ও দেশীয় চোরাকারবারি, বড় বড় অফিসার, মন্ত্রী, মেম্বার প্রভৃতি কতিপয় অতি অল্প সংখ্যক লোকের নিকট জমা হইতেছে। জীবনে যাহাদের করাচী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, লাহোর শহরে ছোটখাটো বাড়ীও ছিল না, তাহাদের মধ্যে অনেকেই আজ এ সব শহরে ১০/১৫ টা বাড়ী উঠাইয়া উচ্চ হারে ভাড়া প্রদান করিয়া হাজার হাজার টাকা আয় করিতেছে। ইহাতেও পল্লীবাসীদের কোন হিসাবের কারণ হইত না যদি তাহাদের নিকট যে অর্থ আছে, তাহা দিয়া শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়িয়া দেশের লক্ষ লক্ষ ভূমিহীন মজুর ও বেকার যুবকদের কাজের সংস্থান করিয়া দিয়া মোটা ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করিয়া দিতেন। আমার আন্তরিক বিশ্বাস আজ সমস্ত পাকিস্তানের চোরাকারবারি ও পারমিট শিকারীদের হাতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা আছে। এই টাকার কোন হিসেব নিকেশ সরকারকে দিতে হয় না। স্যুটকেসে ভরিয়া প্লেনে বা গাড়ী স্টিমারে চড়িয়া পারাপার করা যায়। ইহার ফলে আমাদের মতো অনুন্নত দেশের পক্ষে শিল্প প্রতিষ্ঠান কায়েম করার অপরিহার্য কর্তব্য টি ক্রমেই পিছাইয়া পড়িতেছে। বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের যাহারা আমাদের শাসক গোষ্ঠীর পরম বন্ধু তাহাদের তৈরী মাল আমাদের দেশের বাজারে বিক্রি করিয়া কোটি কোটি টাকা মুনাফা লইয়া যাইতেছে৷ ইহার ফলে দেশ ও জাতির আর্থিক দুরাবস্থা ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে। বিদেশী মুদ্রা একমাত্র কৃষকদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফলে উৎপাদিত কাঁচামাল দ্বারাই সংগৃহীত হইতেছে, শিল্পজাত দ্রব্য বিদেশে পৌছাইয়া ভিন্ন দেশের স্বর্ণ পাকিস্তানে আনার ব্যবস্থা খুব কমই হইতেছে৷ ইহার জন্য দুঃখ প্রকাশ করিয়া বসিয়া থাকলে হইবে না৷ এই অবস্থার পরিবর্তন করিতে এবং যখন যে দল জনসাধারণের ভোটে প্রতিনিধি গদী দখল করিবে তাহারা যাতে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও চোরাকারবারী পারমিট শিকারীদের প্রশ্রয় দিতে না পারে এবং দেশের জনগণের ইচ্ছা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সুষ্ঠু কর্মসূচী গ্রহন করিয়া দেশের গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করিতে বাধ্য হয় এবং তাজ্জন্য সারা দেশময় গণ-আন্দোলন জোরদার করিতে হইবে এবং দেশের প্রকৃত দেশদরদী ও চরিত্রবান লোকেরা যাহাতে জনসাধারণের প্রতিনিধি হইতে পারেন, তাহার দায়িত্ব জনসাধারণকে গ্রহন করিতে হইবে। আমাদের দেশে মোটেই ভাল যোগ্য লোক নাই ইহা বলিলে সত্যের অপলাপ হইবে৷ ভালো লোা যাহারা আছেন, তাহার নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মোটেই অগ্রসর হইতে চান না। ইহার প্রধান কারণ এ দেশের প্রত্যেকটি নির্বাচনে টাকা খরচের যে হুড়োহুড়ি দেখা যায়, তাহাতে একমাত্র চোরাকারবারী, ঘুষখোররাই এরূপ টাকা খরচ করিতে পারে৷ আদর্শবাদী ও সৎলোক যাহারা আছে, তাহাদের পক্ষে বর্তমানে ছেলে মেয়ে সহ জীবন যাত্রা নির্বাহ করাই কঠিন। তদপরি নির্বাচনের জন্য ২০ – ৩০ হাজার টাকা খরচ করা শুধু অসম্ভবই নয়, আকাশকুসুম। তাই চোরাকারবারী ও ঘুষখের শ্রেণীর লোক ২০ হাজার হইতে ৬০ হাজার টাকা খরচ করিয়া যদি জয়লাভ করিতে পারে তাহা হইলে অল্পদিনেই তাহার খরচের টাকা মুনাফাসহ উশুল করিতে এবং ভবিষ্যতে আর একবার নির্বাচনে প্রার্থী হইলে সে টাকাও অর্জন করিতে সক্ষম হয়। ইহার প্রতিকার না করিতে পারিলে দেশের সৎ ও আদর্শবাদী লোককে আইনসভায় পাঠানো কিছুতেই সম্ভব হইবে না।

মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, আওয়ামী লীগ প্রভৃতি দল ক্ষমতায় যাইয়া দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করিয়াছেন। তাই আজ পাকিস্তানের জনসাধারণের মনে নতুন আশা ফুটাইয়া তুলিবার জন্য এবং আমাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শকে রূপায়িত করার জন্য আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত গণতন্ত্রকামী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করিবার প্রয়োজন বোধ করিলাম। দেশবাসীর নিকট আমি আবেদন জানাইতেছি যে – কৃষক মধ্যবিত্ত শ্রমিক ও অন্যান্য মজলুম জনসাধারণের আর্থিক উন্নতি, সমাজসংস্কার ও কৃষকের হাতে জমি খাদ্য সংকটের সমাধান, শিল্পোন্নয়ন ও শ্রমিকের উপযুক্ত মজুরী দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, যুক্ত নির্বাচন প্রথাকে সুদৃঢ় করা, স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমস্ত প্রকার সামরিক জোট হইতে আমাদের দেশকে মুক্ত করিয়া পাকিস্তানকে একটি পূর্ণ স্বাধীন, সার্বভৌম ও জনকল্যাণ মূলক ফেডারেল রাস্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়া পাকিস্তানের উভয় অংশের গণতন্ত্র কামীগণ একটি মঞ্চে মিলিত হউন। আমি বিশ্বাস করি যে, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশ ও জনসাধারণের প্রতি যত বিশ্বাসঘাতকতাই করিয়া থাকুক না কেন, পাকিস্তানের উভয় অংশের গণতন্ত্রকামীগণ যদি আজ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হন, তাহা হইলেই পাকিস্তানের মজলুম জনসাধারণের মুক্তি আসিবে এবং আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত হইবে এবং আমাদের পাকিস্তান সেদিন দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র বলিয়া পরিগণিত হইবে৷ পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সে সংগ্রামে কামিয়াবী হইতে পারিবে বলিয়া আমার বিশ্বাস।

মওলানার এই বক্তব্য প্রচারিত হয়, “ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করিলান কেন” শীর্ষক পুস্তিকায়। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। এর আগে ১৯৫৬ সালে কৃষক সমিতি গঠন করেন মওলানা ভাসানী। সেদিন প্রগতিশালীরা এ কাজে মওলানাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। ন্যাপ এর সাংগঠনিক কাঠামোতে মওলানার সঙ্গে এসেছিলেন বহু নেতৃবৃন্দ। এদের মধ্যে ছিলেন খান আবদুল গাফ্ফার খান, জি, এম, সৈয়দ মিয়া ইফতেখার উদ্দিন, শেখ আবদুল মজিদ সিন্ধী, গাউস বকস বেজেনজো এবং আব্দুল সামাদ খান আচাকজাই।

১৯৫৭ সালে ন্যাপ প্রতিষ্ঠিত হলেও, ১৯৬৭-৬৮ সালেই এর মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়৷ এ সময়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে তৎকালীন পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। এর মধ্যে রয়েছে আইয়ুবের সামরিক শাসন জারি, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে মওলানা ভাসানীর চীন সফর প্রভৃতি।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগাভাগির পর মওলানার যে রাজনৈতিক জীবন ছিল, সে জীবন ঘটনাবহুল জীবন। কিন্তু পূর্বেকার ন্যয় থ্রিলিং নয়। পাকিস্তান আমলে তিনি শুধু রাজনীতির ভাঙ্গা গড়াই দেখেছেন। জেলে কাটিয়েছেন বহু সময়। ১৯৫৪ সালে যখন ৯২(ক) ধারা জারি হয় তখন তিনি লন্ডনে। ইষ্কান্দার মির্জা ক্ষমতায় বসেই ঘোষণা করলেন মওলানা ঢাকায় এলেই তাকে হাবিলদার দিয়ে বিমানবন্দরে গুলি করে মারবেন। সঙ্গত কারণেই তিনি সহসা দেশে ফিরতে পারলেন না। বেশ কিছুদিনের জন্য আটকা পড়ে গেলেন লন্ডণে। এক সময় দেশেও ফিরলেন। রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্য দিয়ে ১৯৫৮ সালে জারি হল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। মির্জাপুরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তাকে নিয়ে আসা হল ঢাকায়। অন্তরীণ করে রাখা হল ধানমন্ডির এক বাসভবনে। এখানে ৪ বছর ১০ মাস অন্তরীণ থাকা অবস্থায়ই বেশ কয়েকবার তিনি টনক নাড়িয়ে দিয়েছেন সরকারের৷
যে বাড়ীতে তিনি অন্তরীণ ছিলেন, তার পাশের বাড়ীটি ছিল এককালীন স্পীকার আবদুল ওয়াহাব খানের৷ সরকার এই বাড়ীটি ভাড়া নেন বাংলাদেশে নিয়োজিত একজন মার্কিন পানি বিশেষজ্ঞের জন্য। মওলানা এর পরিচয় দিয়েছেন ‘হাই স্কুল পাস পানি মাপা ইঞ্জিনিয়ার ‘ বলে।

অন্তরীণ থাকা অবস্থায় সময় কাটাবার জন্য মওলানা পুষেছিলেন হাঁস, মোরগ, গরু, ছাগল। তার পাশের বাসার সেই মার্কিন সাহেবের সুখের বিষয় ছিল ফুল বাগান। প্রায়ই মওলানার মোরগ গিয়ে সাহেবের বাগানের ফুল গাছ নষ্ট করে ফেলত। একদিন সাহেব রেগে গিয়ে তার নিজের বন্দুক দিয়ে যায় এ্যাংলো ইন্ডিয়ান চাকরদের হাতে। আদেশ ছিল ফুল গাছ নষ্ট করতে এলেই যেন গুলী করে মেরে ফেলা হয় মোরগগুলিকে। সাহেব অফিসে চলে গেলেও চাকরদের আর সাহসে কুলোয়নি। তারা মওলানাকে এসে বলে হুজুর, আপনার মোরগগুলোকে যদি বেঁধে না রাখেন, তাহলে আমাদের চাকরী যাবে। ঘটনা শুনে মওলানা তাদের জবাব দেন, তোমাদের সাহেব এলে বলে দিও, আমার একটা মোরগ যদি মরে, তাহলে আমি ঢিল মেরে তার মাথা ভেঙ্গে দেব। ঘরে ফিরেই এ কথা শুনে ভড়কে যায় সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের টেলিফোন করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। সন্ধার পর মওলানার সাথে দেখা করতে এলেন তৎকালীন এডিশনাল চীফ সেক্রেটারী ও পুলিশের ডি আই জি। তখন পুলিশের ডি, আই, জি এ, এম৷ এ, কবীর। তারা এসেই বলেন, হুজুর করেছেন কি? আমরা আমেরিকানদের ভীষণ ভয় পাই। এই হুমকির ফলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। ‘ মওলানা জবাব দেন, “পশু পক্ষী অবলা প্রাণী। তাদের অপরাধের শাস্তি খোয়াড়। আইন ভাঙলে আমার মোরগ খোয়াড়ে যাবে। আমি জরিমানা দিয়ে ছাড়িয়ে আনবো কিন্তু আমেরিকান সাহেবকে মারার ক্ষমতা কে দিয়েছে? তাকে এদেশে থাকতে হলে এ দেশের আইন মেনে চলতে হবে। ” এই কথা শুনে সরকারী কর্তাদ্বয় ঘাবড়ে যান। তারা জানতে চান মওলানার এসব কথা কি উপরে জানানো যাবে? মওলানা জবাব দেন, আমি রাজনৈতিক বন্দী। আমার আর কী হবে। না হয় বন্দী জীবন আরো চার পাঁচ বছর বাড়বে। তাছাড়া ফাঁসীর বয়স পেরিয়ে এসেছি, এখন আর ফাঁসী হবার ভয় নেই।

এই কথা যখন মওলানা সাহেব বলেছিলেন তখন মাঝে মাঝেই একটি মন্তব্য জুড়ে দিচ্ছিলেন। তা হল – আমেরিকান কাওয়ার্ড। তা না হলে আমার ঐ ধমকে কেউ ভয় পায়। আমাদের সরকারও ছিল আমেরিকান দের ভয়ে অস্থির।, সে কারণে মাসিক ১৮০০০ টাকা মাইনে দিয়ে নদীর অবস্থা জানে না এমন একজন লোককে বানিয়েছে এক্সপার্ট। এরা শুধু এয়ারকন্ডিশনড ঘরে বসে অফিস করে।

অন্তরীণ থাকা অবস্থায়ই মওলানা জানতে পেরেছিলেন বেলুচিস্তানের মুক্তিকামী মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা। তাদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা। অনশন ধর্মঘটের মুখে অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো এক তারবার্তায় তিনি বললেনঃ “বেলুচিস্তানে আজ উত্তেজনা বিরাজ করছে এবং বহু মানুষ কারান্তরালে। এই অবস্থার অবসানের জন্য আমি আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করি এবং আশা করি বেলুচিস্তানের জনগণের একতা এবং শক্তি গঠনমূলক কাজে ব্যবহৃত হবে৷ “

সামরিক শাসন জারি হবার ফলে ন্যাপের সাংগঠনিক কাঠামোও ভেঙ্গে পড়ে। সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর ন্যাপ ও কৃষক সমিতি পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন মওলানা। ‘৬৪ সালে ১৯ শে জানুয়ারী তাই মওলানার আহ্বানে গোটা পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী পালিত হয় সর্বজনীন ভোটাধিকার দিবস।

১৯৬৩ সালের চীন সফর শেষে দেশে ফিরে এলে বিপুল সম্বর্ধনা জানানো হয় মওলানাকে। ১৯৬৪ সালে পুনরায় টোকিও সফরে যান মওলানা – বিশ্ব ধর্মীয় সম্মেলনে যোগদান করতে।

১৯৬৫ সালে পাক – ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের একতা ও সংহতির প্রতি সমর্থন জানান মওলানা। সরকারের প্রতি এই সমর্থনের জন্য পরবর্তী কালে তার সমালোচনা করেন অনেকে। যে সমালোচনার কারণ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ এবং সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট কর্তৃক মওলানাকে গার্ড অফ অনার প্রদান।

১৯৬৫ সালের ১৮ ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে মওলানার পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আলী কাসুবী প্রেসিডেন্টের মিলিটারী সেক্রেটারী জানান যে, মওলানা ভাসানী বেলুচিস্তান সমস্যা সহ বন্দী মুক্তির বিষয়টি নিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করবেন। কাসুরীর চিঠিতে বলা হয়ঃ

The moulana had asked me to explain that when he sees the president, he will in the light of the decisions of the working committee of the All Pakistan National awami party, raise the questionof the settlement of various problems connected with Baluchistan and request for the release of a large number of members of the National Awami Party who have been arrested after the recent proclamation of emergency. There is the question of the release of several important important political leaders who have been in detention or imprisonment for years as also the question of withdrawal of still an executed orders of detention passed against several political persons in the east and west Pakistan. He would like you to inform the president of this because he fears that considerable misunderstanding would arise if the government can not find its way to favourably consider his requests in this behalf.

The Moulana further requests you to convey to the president that he and the national Awami party are doing their atmost to organize the defence efforts of Pakistan in every part East and West Pakistan. Our party approaches the matter as a sacred duty and he will not relax our efforts in this behalf despite the fact that frequently our efforts are frustrated by the adoption of awooden or bureaucratic attitude by the personages in high position. Should the president at any stage desire to discuss the problems arising out of National defence with the moulana or the obtain his views in this behalf, the Moulana will regard himself duty bound to attend at once.

প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সঙ্গে এ ধরণের সাক্ষাত্ এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি মওলানার সমর্থন – এসব কারণে ন্যাপের অভ্যন্তরে তার বিরোধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ’৬৫ র নির্বাচনে সংযুক্ত বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে মিস জিন্নাহর নাম প্রস্তাব করাতে পুনরায় মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক মঞ্চে জনগণের কন্ঠ হিসেবে অবতীর্ণ হন। ১৯৬৬ সালের প্রথমদিকে হাভানায় অনুষ্ঠিত প্রথম ত্রী মহাদেশীয় সম্মেলনে যোগ দেন মওলানা ভাসানী। কিউবার রাজধানীতে এ সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয় ৩রা জানুয়ারী থেকে ১২ ই জানুয়ারী পর্যন্ত।

১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে ন্যাপের আন্তকলহ প্রকাশ হয়ে পড়ে। মুজাফ্ফর সাহেবরা ন্যাপের রিকুইজিশন কাউন্সিল আহ্বান করার নোটিশ দেন। আর মওলানা ভাসানী কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন রংপুরে – ৩০ শে নভেম্বর। ২৯ শে নভেম্বর আহ্বান করেন কৃষক সমিতির কাউন্সিল অধিবেশন।

ন্যাপের কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা যে ভাষণ দেন তা এক স্বরণীয় ভাষণ। এ ভাষণেই মওলানা ব্যাখ্যা করেন কেন তিনি খেলাফত আন্দোলন করেছেন, কংগ্রেস করেছেন, পরবর্তীতে কেন আওয়ামী লীগ এবং সবশেষে ন্যাপ গঠন করলেন। মওলানার জীবনের দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমার এ এক জীবন্ত দলিল। জাতীয় জীবনের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের স্থিরচিত্র। কৃষক সমিতির কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানী বলেন,

“জাতীয় রাজনীতির সংকট যেমন প্রতিদিন বৃদ্ধি পাইয়া চলিতেছে, ঠিক অন্যদিকে বড় পুঁজি পরিচালিত ধনবাদী, সামন্তবাদী সরকারের গনবিরোধী চরিত্র আরো প্রকট হইয়া উঠতেছে। এই সরকার যেন জনগণের হইতে বিচ্ছিন্ন। সরকারের এই বিচ্ছিন্নতা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাইতেছে। বলা যাইতে পারে, আজ সরকার জনগণের থেকে সবচাইতে বেশী বিচ্ছিন্ন। সংকটের পর সংকট জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের দিকে ঠেলিয়া দিতেছে। সরকারী নির্যাতনের মুখোমুখি দাড়াইয়া জনতা তাহার বাঁচার আন্দোলনে রূপ দিতে চাহিতেছে। কিন্তু জনতার আশা আকাঙ্ক্ষাকে জয়যুক্ত করিতে পারে এমন এক বলিষ্ঠ ও সুষ্ঠু নেতৃত্বের অভাবের ফলে জন্ম নিতেছে হতাশা। জাতীয় জীবনে যখন এই অবস্থা, তখন আন্তর্জাতিক দিক দিয়া বিচার করিলে দেখা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিকে কাঁপাইয়া তুলিয়াছে জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তি, গণতন্ত্র ও শান্তিকামী এশিয়া – আফ্রিকা – ল্যাতিন আমেরিকার মতন জনতার ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের তরঙ্গের পর তরঙ্গ। …… দায়িত্বের তুলনায় আমাদের কর্মী সংখ্যা কম। তাই, প্রতি জেলার কর্মী সংখ্যার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া এলাকা বাছিয়া নিতে হইবে, সারা জেলাব্যাপী সাধারণ প্রচারের পাশাপাশি নির্দিষ্ট এলাকা বাছিয়া নিয়া তার উপরে জোর দিতে হইবে।….. আজ আমাদের শপথ নিতে হইবে দেশ হইতে সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ – সামন্তবাদ ও বড় ধনিকের এবং স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহীকে উচ্ছেদ করিয়া গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের সংগ্রামকে জয়যুক্ত করিয়া তুলিব এবং এই সংগ্রামকে জয়যুক্ত করিয়া তুলিব এবং এই সংগ্রামকে জয়যুক্ত করিবার মধ্য দিয়া আমাদের দেশে এক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করিব। “

ন্যাপ ও কৃষক সমিতির এই দু টি কাউন্সিল অধিবেশন শেষেই মওলানার রাজনীতি নতুন মোড় নেয়৷ ন্যাপের এই কাউন্সিল অধিবেশনেই মওলানা ঘোষণা করেন, “আমাদের বিগত দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা হইতে আমরা সুস্পষ্ট ভাবে দেখিয়াছি যে, ন্যাপ ব্যাতিত আমাদের দেশের বর্তমান অন্য সব রাজনৈতিক দলই নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হইয়াছে। তার প্রধান কারণ ঐ সমস্ত দলের দোদুল্যচিত্ত নেতৃত্ব। আমি তাই অত্যন্ত দৃঢ ভাবেই বিশ্বাস করি যে, আজিকের দিনে আমাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম সর্বহারা শ্রেণী, অপর কোন শ্রেণী নয়। “

গণঅভ্যুত্থান ও মওলানা ভাসানী

১৯৬৮ – ৬৯ সালে সমগ্র দেশব্যাপী যে গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল তরঙ্গ বয়ে যায়, সে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলনের সূত্রপাত করেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এ আন্দোলনের পেছনে অন্যান্য ঘটনাও কারণ হিসেবে কাজ করেছে, কিন্তু প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন মওলানা।

১৯৬৮ সালের ৫ ই অক্টোবর সন্তোষে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ন্যাপ কেন্দ্রীয় কমিটির এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ১০ দফা দাবীর ভিত্তিতে ৩ রা নভেম্বর থেকে দাবী দিবস পালনের। দাবীগুলো ছিল, ১) বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা কার্যকরীকরণ, ২) বন্যা পীড়িত অঞ্চল গুলোকে দূর্গত এলাকা বলে ঘোষণা করা, ৪)প্রদেশ ব্যাপী পূর্ণ বেশন ব্যবস্থা চালু, ৫) সকল রাজবন্দীদের মুক্তি, ৬) দেশ হতে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, ৭) পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ৮) প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান, ৯) শিক্ষা সংকোচন নীতি বাতিল ও ১০) ভিয়েতনাম ও প্যালেস্টাইনীয় জনগণের প্রতি পাকিস্তান সরকারের প্রকাশ্য সমর্থন ঘোষণার দাবী।

এ কর্মসূচীর ভিত্তিতে ৩ রা নভেম্বর প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে। মওলানা ভাসানী ১৪ বছর পর১৯৫৪ সালের মত পুনর্বার পল্টন ময়দানে জনগণকে উত্তেজিত করার মত ভাষণ দেন। সভায় ভাষণ দানকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দানের দাবী উল্লেখ করে বলেন যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। গণচীনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল বিশেষের অপপ্রচারের নিন্দা করে মওলানা ভাসানী বলেন, সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পর গণচীন সাহায্য না করলে আমাদের আজাদী বিপন্ন হত এবং এখানে আজ অশোকস্তম্ভ খচিত পতাকা উড়ত।

এই সময়ে, ছয় দিনের ব্যবধানে, মওলানা ভাসানী ১১ ই অক্টোবর তার সন্তোষস্থ বাসভবনে বিরোধী দলীয় নেতাদের এক বৈঠকের আহ্বান করা হয়। বৈঠকের আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয় আওয়ামী লীগ (উভয় গ্রুপ) কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও এন, ডি, এফ নেতৃবৃন্দের কাছে। তবে মস্কো ন্যাপ, জামাতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যেসব রাজনৈতিক নেতা এই আমন্ত্রণ লিপি পেয়েছিলেন, তারা হচ্ছেনঃ নুরুল আমিন, আবদুস সালাম খান, আবু হোসেন সরকার, আতাউর রহমান খান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, জহিরুদ্দিন, আবুল মনসুর আহমদ, ইউসুফ আলী চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক, খাজা খয়ের উদ্দিন ও জনাব মাহমুদ আলী।

১৪ ই অক্টোবর দৈনিক পাকিস্তানে মওলানা ভাসানীর এক বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে মওলানা ভাসানী বলেন, রাষ্ট্রের অহিত চিন্তাকে যারা প্রশ্রয় দেন এবং আমেরিকা ও ভারতের মদত চান তাদের সাথে তার কোন আপোষরফা নেই। তিনি বলেন, “আমি বর্তমান সরকারের বিরোধিতা করি। কিন্তু রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সংহতিকে সবার উপরে স্থান দেই” বিভিন্ন বিরোধী দলের ঐক্যজোট গঠন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি ঐক্যজোট গঠনের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে আলাপ আলোচনার জন্য তিনি বৈঠক আহ্বান করেছিলেন। তিনি বলেন, ইতিপূর্বে বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করতেন যে, তিনি তার সহকর্মী মনোনীত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে অন্যান্য দলের সাথে আলাপ আলোচনা চললেও বয়োবৃদ্ধ নেতা মওলানা ভাসানী স্বয়ং কখনো আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানাননি। তিনি এবারে তাই বৈঠক ডেকেছেন এবং প্রধানত পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

১৩ ই অক্টেবর রবিবার বিকেলে এন, ডি, এফ নেতা জনাব দেলদার আহমেদ, জনাব নুরুর রহমান এবং জনাব অলী আহাদ মওলানা ভাসানীর সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। সন্ধায় আওয়ামী লীগ (পি, ডি, এফ) সম্পাদক মুজিবর রহমানও দেখা করেন মওলানা সাহেবের সঙ্গে।

‘৬৮ সালের ১ লা ডিসেম্বর বিকেলে ৬ ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য জনসভার প্রচার চালানোর জন্য মওলানা ভাসানী গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড, জিন্নাহ এভেনিউ, ন্যাশনাল ব্যাংক কর্ণার ও বায়তুল মোকাররমের পথসভায় ভাষণদান করেন। পথসভার জন্য একটি মিছিল বের করা হয় কাপ্তান বাজারস্থ ন্যাপ অফিস থেকে। শোভাযাত্রায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মশিউর রহমান, কৃষক সমিতির জনাব আবদুল হক এবং শ্রমিক ফেডারেশনের জনাব সিরাজুল হোসেন খান। পথসভায় মওলানা ভাসানী ৬ ই ডিসেম্বরের কর্মসূচী পালনে সহযোগিতার জন্য সকল বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এবং সার্বভৌম অধিকার আদায় করার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। পথসভায় বের হওয়ার আগে মওলানা ভাসানী ন্যাপ কার্যালয়ে এক কর্মীসভায় ভাষণ দেন।

৬ ই ডিসেম্বর ভাসানী ন্যাপের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট জনসভা। সভায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা। বক্তৃতা করেন ন্যাপ সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহা, শ্রমিক ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সিরাজুল হোসেন খান ও কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক। বক্তৃতা প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী বলেন, জনগণের দাবীগুলো মেনে না নেওয়া হলে, দেশব্যাপী তীব্র গণবিক্ষোভ দেখা দেবে। অত্যাচার, উৎপীড়নের মাধ্যমে জনগণকে কাবু করা যায় না। ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মারফতই জনগণের মন জয় করা যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের ঘটনাবলী উল্লেখ করে মওলানা ভাসানী বলেন, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, জনাব ভুট্টোকে সম্বর্ধনা জানানোর অপরাধে ছাত্রদের ওপর গুলি বর্ষণ করা হয়েছে। এই জনসভাটি অনুষ্ঠিত হয় ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ উপলক্ষে।

জনসভা শেষে এক বিরাট মিছিল গভর্নর হাউস ঘেরাও করে। এখানে পুলিশের সঙ্গে জনতার ইট পাটকেল বিনিময় হয়। পরে মিছিল বায়তুল মোকাররমের সামনে আসে ইফতার বিরতির জন্য। এ সময়ে, ধর্মঘটের দাবী তোলে অটোরিকশা ড্রাইভাররা, ৭ ই ডিসেম্বর হরতাল ঘোষণা করার জন্য। ইতিপূর্বে জনসভায় মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেছিলেন ১২ ই ডিসেম্বর হরতাল কর্মসূচী। ইফতার শেষে, বায়তুল মোকাররম থেকে বেরিয়ে এসে ঘোষণা করেন, ৭ ই ডিসেম্বর পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে হরতাল পালিত হবে গোটা শহরে। এর পরই কয়েক সহস্র লোক মিছিল নিয়ে বেরিয়ে যায় হরতাল কর্মসূচী ঘোষণার জন্য।

৭ ই ডিসেম্বর স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় ঢাকায়। এ হরতাল সফল করার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করে অটোরিকশা ড্রাইভাররা। ৭ ই ডিসেম্বর সকাল থেকেই ঢাকা শহরের পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। সরকারী ভাবে হরতাল বিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করা হয়। হরতাল দমনে জন্য পূর্বাহ্নেই জারি করা হয় ১৪৪ ধারা।

হরতালের দিন ভোরবেলা থেকেই বাস ও রিকসা চলাচল বন্ধ থাকে। সকালে দু একটি স্টেটবাস চললেও শেষ পর্যন্ত তাও বন্ধ হয়ে যায়। সকাল থেকেই জনগণ মারমুখী হয়ে উঠেন। দশটার দিকে নিউ মার্কেট, পুরনো পল্টন, নয়া পল্টন, শান্তি নগর প্রভৃতি এলাকার উত্তেজনা চরমে পৌছে।

নিউ মার্কেটের নিকটবর্তী নীলক্ষেত এলাকায় অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য টহলকারী পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে পাকিস্তান ইলেকট্রনিকস নামক একটি দোকানের দরজা বন্ধ অবস্থায় ভেতরে কর্মরত ২৮ বছর বয়স্ক যুবক ইসহাক এবং সেখানে কর্মরত ওয়াপদার কর্মচারী জনাব মজিদ (৩০) গুলিবিদ্ধ হন। দোকানের কপাট ভেদ করে গুলি ভেতরে ঢোকে৷ দুপুরে মজিদ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।

৭ ই ডিসেম্বর হরতালে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ৮ ই ও ১০ ই ডিসেম্বর প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান জানান মওলানা ভাসানী। ৮ ই ডিসেম্বর যোহর নামাজ শেষে ৭ ই ডিসেম্বরের শহীদের উদ্দেশ্যে গায়েবানা জানাজা পাঠ করতে গেলে, বায়তুল মোকাররমের সামনে মওলানা ভাসানীকে বাঁধা দেয় পুলিশ। এ সময় মওলানার সঙ্গে ছিলে আরিফ ইফতেখার সহ কয়েকজন ন্যাপ নেতৃবৃন্দ।

১৪ ই ডিসেম্বর ভাসানী ন্যাপের পক্ষ থেকে জনাব মশিউর রহমান ঘোষণা করেন, ২১ ডিসেম্বর থেকে মওলানা ভাসানী ঘেরাও আন্দোলন শুরু করবেন। তিনি বলেন, ন্যাপ কর্মীরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে থানা, মহকুমা ও ডিসিদের ঘেরাও করে তাদের দাবী দাওয়া পেশ করবেন। ঘেরাও আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ২১ শে ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী পাবনা শহরে এক বিরাট জনসভায় ভাষণ দেন। পাবনা টাউন হল ময়দানে আয়োজিত এই সভায় ভাষণদানকালে মওলানা বলেন, তার দল আগামী সাধারণ নির্বাচন বর্জন করবে এবং জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো, এয়ার ভাইস মার্শাল আসগর খান, এস, এম মুর্শেদ অথবা বিরোধী দলের অন্য যে কোন নেতার অংশগ্রহণে বিরোধিতা করবে। তিনি বলেন, তার দল শুধু যে নির্বাচন বর্জন করবে তাই নয়, বরং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে কোন দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছা পোষণ করে তবে উক্ত দলের মতামত পরিবর্তন করানোর জন্য তার দল চেষ্টা করবে। মওলানা বলেন, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নয়, বরং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এক বিরাট গণ আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি সকল বিরোধী দলগুলোর ঐক্য কামনা করেন। মওলানা ভাসানী দাবী করেন, পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করতে হবে।
এই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন পাবনা জেলা ন্যাপের সভাপতি জনাব আবদুল আউয়াল। বক্তৃতা করেন পাবনা জেলা ন্যাপের সেক্রেটারি জনাব আবদুল মতিন, ও কৃষক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আলাউদ্দিন আহমেদ। সভাশেষে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এক বিরাট জঙ্গী মিছিল পাবনা ডেপুটি কমিশনারের বাড়ী ঘেরাও করে। এই ঘেরাওয়ের মধ্যে দিয়ে সূত্রপাত ঘটে ঘেরাও আন্দোলনের।
২৯ তারিখ মওলানা ভাসানী যখন পাবনায় ঘেরাও আন্দোলনের সূচনা করেন তখন সে আন্দোলন শুধু পাবনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। একই দিনে ঢাকা জেলার নরসিংদী থানায় হাতিবদিয়ায় ঘেরাও আন্দোলনের সূত্রপাত করেন ১১ দফা আন্দোলনের বীর শহীদ আসাদুজ্জামান। ছাত্রজীবন শেষে আসাদুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে থাকলেও তৎকালীন রাজনীতির গতিধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সল্প সময়ে হাতিবদিয়ায় শক্তিশালী কৃষক ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলেন আসাদ।

১ লা জানুয়ারী (৬৯) থেকে কৃষক সমিতির সভাপতি হিসেবে নিম্নোক্ত প্রচারপত্রটি প্রকাশ করেন মওলানা।

“৮ ই জানুয়ারী হইতে ১৫ ই জানুয়ারী গ্রামে গ্রামে হাতিবদিয়ার ও নড়াইলে গণহত্যা, ধরপাকড় ইত্যাদি জুলুমের বিরুদ্ধে জনসভা ও ঘেরাও মিছিল করুন।
শুধু শহরের আন্দোলন…. স্বৈরাচারী সরকারের জুলুম বন্ধ হইবে না… সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের দূর্নীতি, দৌরাত্ম ও ঘুষ বন্ধ হইবে না… সার্টিফিকেট প্রথা, মাল ক্রোক, বডিওয়ারেন্ট বন্ধ হইবে না। আখ ও পাটের ন্যায্য মূল্য কৃষকেরা পাইবে না… নদী সিকস্তি জমির খাজনা মওকুফ হইবে না… নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমান যাইবে না। বিড়ি শ্রমিক, ফ্যাক্টরী শ্রমিক ও ভূমিহীন মজুর দের জীবন রক্ষার জন্য ন্যায্য মজুরী পাওয়া যাইবে না… বন্যা পীড়িত এলাকায় ও গ্রামে পূর্ণ রেশন ব্যবস্থা চালু করা যাইবে না এবং খাজনা ও লোনের টাকা মাফ পাওয়া যাইবে না। কৃষি উন্নয়নের জন্য পানি সেচের ব্যবস্থা হইবে না। বাস্তুহারা মোজাহেরদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যাইবে না। জেলে, মাঝি, তাঁতি, কুমার, কামারদের উন্নতির ব্যবস্থা হইবে না৷ মুসলমানদের জন্য হজ্বের কার্ড পাওয়া যাইবে না।

মাথা ভারী শাসন কমাইয়া শাসন কমাইয়া গরীব কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা সম্ভব হইবে না, বাধ্যতামূলক প্রাইমারী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করা যাইবে না। স্কুল কলেজের ছাত্রদের বেতন পরীক্ষার ফিস, পুস্তকের দাম কম হইবে না।

পূর্ব বাংলার সাড়ে ছয় কোটি মানুষের জীবন মরণ সমস্যা – পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রচলন করা সম্ভব হইবে না। ভয়াবহ বন্যার স্থায়ী প্রতিরোধের ব্যবস্থা হইবে না। রাজবন্দী দের মুক্ত করা সম্ভব হইবে না। পাক – মার্কিন সামরিক চুক্তি সেপ্টো. সিয়াটো চুক্তি বাতিল হইবে না। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ খতম হইয়া কৃষক মজুর রাজ সমাজতন্ত্রবাদ কায়েম হইবে না ততদিন – যতদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৬ কোটি মানুষের বাস, ৬২ হাজার গ্রামে ৪ হাজার ইউনিয়নে আন্দোলনের ঢেউ ঝাপাইয়া পড়িবে না, ততদিন মুক্তি নাই।

তাই আজ দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলের ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবর্গ ও কর্মীদের নিকট আমার আকুল আবেদন কৃষক সমিতির সহিত কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া এই জুলুম বিরোধী দিবস সাফল্যমণ্ডিত করিয়া তুলিতে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করুন।

আমি, আমার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও কৃষক সমিতি যে কোন রাজনৈতিক দলের সহিত বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারের জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে কোন আন্দোলনে পূর্ণ সহযোগিতা করিয়া সর্বপ্রকার ত্যাগ বরণ করিতে কোনপ্রকার ত্রুটি করিব না – একমাত্র নির্বাচনের (ইলেকশনের) জন্য কোন যুক্তফ্রন্টে যোগদান করিব না”

উনসত্তরের অভ্যুত্থান যখন সমগ্র দেশব্যাপী জনগণকে আন্দোলিত করেছে, সেসময় ফেব্রুয়ারী মাসে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একটি গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব করেন সরকার। মওলানা ভাসানী প্রথম থেকেই বিরোধিতা করেছিলেন এ বৈঠকের। এই বিরোধিতার জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ইত্তেফাক এর মঞ্চে নেপথ্য কলামে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে নিম্নোক্ত মন্তব্য করা হয়ঃ

“প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠককে ব্যর্থ করবার জন্য এক সুক্ষ চাল লক্ষ্য করা যাইতেছে। কোন কোন মহল হইতে এক্ষণেই প্রচার শুরু হইয়াছে যে, বিরোধী দলের সহিল আলাপ আলোচনা সফল হইলে অন্তর্বর্তী কালীন জাতীয় সরকার গঠনের সম্ভাবনা রহিয়াছে। ইহা ঘোড়ার আগে গাড়ী জুড়িয়া দিবার মত এবং ইহাকে আমরা এই মুহূর্তে ক্ষমতার টোপ ফেলান বলিয়া মনে করি। আজ সারাদেশের মানুষ – ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত শ্রেণী তথা সর্বস্তরের মানুষ যে সংগ্রাম করিতেছে, রক্ত দিয়াছে, তাহা হইল রাষ্ট্রে তাদের ছিনাইয়া নেওয়া অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। বিগত দশকের কুশাসন, অনাচার – অত্যাচার ও শোষণের পরিণতি হিসাবে এই গণজাগরণ – নমীনেশন মন্ত্রী হওয়ার জন্য কিংবা বর্তমান মন্ত্রীদের বদলে বিরোধী দলীয় লোকেদের দ্বারা মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য নয়। জনগণ রাষ্ট্রে তাদের অধিকার ফিরিয়া পাইলে, দেশে জনগণের সার্বভৌমত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইলে, জনগণের ভোটে ও সমর্থনে যারা প্রতিনিধি নির্বাচিত হইবেন, গণতন্ত্রের বিধান মতে তাদের সংখ্যা গরিষ্ঠ দল দেশের শাসনভার গ্রহন করিবেন এবং যে প্রোগ্রামের ওয়াদা দিয়া তারা নির্বাচিত হইবেন, সেই প্রোগ্রাম কার্যকরী করার দায়িত্ব তাদের উপর বর্তাইবে। আমরা যতদূর বুঝি,ইহাই হইলো বর্তমান সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে জনগণের অধিকার যদি স্বীকৃতি লাভ করে এবং তন্মধ্যে শাসনতন্ত্র সংশোধিত কিংবা পরিবর্তিত হয়, একমাত্র তাহা হইলেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে এবং এই একটি মাত্র উদ্দেশ্যে কোন সাময়িক ব্যবস্থা করা যাইতে পারে।

জনপ্রতিনিধিত্ব হীন জগাখিচুড়ি ধরণের মন্ত্রীসভা গঠনে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা মনে করি, দেশবাসীও চায় না। আশা করি, এ মহল হইতে যত সুক্ষ্ম প্রচার চালানো হউক না কেন, তার প্রতি কোন গুরুত্ব না দিয়া বাস্তবক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলি কি করে না করে সেদিকেই আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিৎ। এই প্রসঙ্গে মওলানা সাহেবের সাম্প্রতিক যে সকল বিবৃতি বক্তৃতা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা নিয়া কিছুটা আলোচনা করা দরকার। অতীতের বিবৃতি বক্তৃতার উদ্ধৃতি না দিয়া সম্প্রতি খুলনায় তার দলীয় কাউন্সিল সভায় তিনি যে দাবী করিয়াছেন, এখানে শুধুমাত্র তারই উল্লেখ করিতে চাই। বিভিন্ন সংবাদ পত্রে প্রকাশিত খবর হভতে জানা যায়, তিনি দাবী করিয়াছেন যে, তার দলীয় ১৪ দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফা গ্রহন করার পরই তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সহিত সাক্ষাৎ করিতে প্রস্তুত আছেন। প্রথমতঃ কোন রাজনৈতিক দলের প্রোগ্রাম অন্য কোন দল গ্রহন করিবে, এরূপ প্রস্তাব অবাস্তব ও গণতন্ত্রের রীতিনীতি বিরোধী। প্রোগ্রামের ভিত্তিতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয় এবং একমাত্র জনগণই বিভিন্ন দলের প্রোগ্রাম যাচাই করার মালিক মোক্তার। অন্য কোন দলকে বা দলসমূহকে নিজ দলের প্রোগ্রাম মানিয়া নিতে বলার, অর্থ হইল, প্রকৃত প্রস্তাবে অপরাপর দলের অস্তিত্ব বিলোপ সাধনের দাবী তোলা, গণতন্ত্রের ইতিহাসে এরূপ প্রস্তাবের নজীর আছে কি না, মওলানা সাহেবের নিকটই আমরা সে প্রশ্ন করিতে চাই। মওলানা সাহেব বয়োবৃদ্ধ, রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও তিনি শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। এদেশের আন্দোলনে যারা নির্যাতন ও জেল জুলুম ভোগ করিয়াছেন। মওলানা সাহেবের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, কংগ্রেস ১৯৩০ সালে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহন করে। কিন্তু এতত্সত্ত্বেও বিভিন্ন আন্দোলন চলার পর গান্ধী – আরউইন চুক্তি ইত্যাদি সম্পাদিত হয়। মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালে যে লাহোর প্রস্তাব গ্রহন করে, তাতে বাংলা কিংবা পান্জাব অথবা আসামকে বিভক্ত করার প্রস্তাব ছিল না। অপর দিকে কংগ্রেসও ‘অখন্ড ভারতের’ স্বাধীনতার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করিয়াঠে। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী থাকা সত্ত্বেও এবং বৃটিশ শাসকদের হাতে নির্যাতিত হবার পরেও তারা লর্ড ওয়াভেল ও মাউন্টব্যাটেনের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন নাই? পাক – ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা তো শেষ পর্যায়ে আলাপ আলোচনা বৈঠক মারফতই অর্জিত হইয়াছিল। দেশী ও বিদেশী শাসকের পার্থক্য এখানে তুলিলাম না।

অসহযোগ আন্দোলন, বিলাতে দুই দুইটি গোলটেবিল বৈঠক, ম্যাকডোনাল্ড এওয়ার্ড মাফিক ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন সম্পর্কে মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা, কংগ্রেস কর্তৃক ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন, মুসলিম লীগ কর্তৃক ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ ঘোষণা প্রভৃতির কথাও মওলানা সাহেবের মনে থাকার কথা। মওলানা সাহেব প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান সম্পর্কে তার প্রোগ্রাম সম্পূর্ণ ভাবে গ্রহনের যে পূর্ব শর্ত আরোপ করিয়াছেন, সে সম্পর্কে তাকেই আমরা জিজ্ঞেস করিতে চাই যে, ইহার কোন নজির আছে কিনা। তিনি যদি স্বীকার করেন যে, তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না, বিপ্লব মারফত ক্ষমতা দখলে তিনি বিশ্বাসী, তাহা হইলে তার সহিত আমরা একমত হই কি না হই তার মনোভাব ও নীতি সম্পর্কে আমাদের একটা স্পষ্ট ধারণা জন্মাইবে।

আমরা তাকে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করিতে চাই যে, তিনি যখন ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সাথে সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন এবং ‘পিন্ডি হইতে লাহোর গমন করিয়াছিলেন তখন তিনি আলোচনার কি কি পূর্ব শর্ত দিয়াছিলেন এবং আলোচনা দ্বারা কি কি অধিকার বা তার দলীয় প্রোগ্রামের কয় দফা আদায় করিয়াছিলেন। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে শুধু আমরাই নই, দেশবাসীও তার কাছে বিস্তারিত তথ্য দাবী করিতে পারে। তাকে আমরা স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, সেই সময় তার দলীয় লোকজন সহ অন্যান্য দলের বহু কর্মী ও নেতা কারাগারে বিনাবিচারে আটক ছিলেন। শুধু তাই নয়, এ দেশের লোকের ভোটের অধিকার ছিল না, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার খর্বিত ছিল, অনেক ট্রেড ইউনিয়নকে সরকার কলমের এক খোঁচায় বাতিল করিয়া দিয়াছিলেন, কৃষকদের উপর করভার এবং তহশিলদার ও টাউটদের অত্যাচারে আজিকার মত সেদিনও বিরাজমান ছিল।

রাজনীতিতে মতবিরোধ থাকা সুষ্ঠু গণতন্ত্রেরই লক্ষ্মণ। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সহিত মওলানা সাহেবের মতবিরোধ থাকা স্বাভাবিক, দূষণীয় তো নয়ই। কিন্তু আমরা কি তাকে স্মরণ করাইয়া দিতে পারি যে, মওলানা সাহেব গত কয়েক বৎসর যাবৎ দেশের সমস্যাদি নিয়া বিশেষ ভাবেন নাই, শুধুমাত্র পররাষ্ট্র নীতিই তাহার চক্ষের সামনে একমাত্র সমস্যা ছিল। তার বক্তব্য, পররাষ্ট্র নীতি তার নির্ধারিত পথে প্রবাহিত হইলে দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান সহজ হইবে। দেশের রাজনীতি তে পররাষ্ট্র নীতির মূল্য নাই, এ কথা আমরাও বলি না, কিন্তু নিজ দেশের মানুষ যখন সর্বপ্রকার অধিকার বঞ্চিত, শোষিত, লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত, সেই সময় শুধু পররাষ্ট্র নীতিকে কার্যতঃ একমাত্র প্রোগ্রামে পরিণত করা বিধেয় নহে। বরং ইহা গমনে সন্দেহের সৃষ্টি করিয়া থাকে৷ মওলানা ভাসানীর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাবের খবর আমরা রাখি, যদিও আজ সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞায় অনেকটা রদবদল হইয়াছে। পূর্বে আমরা সাম্রাজ্যবাদ বলতে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোকেই বুঝতাম। সাম্প্রতিক কালে কমিউনিস্ট বিশ্ব, বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার মাঝে মার্কসবাদের ব্যাখ্যা নিয়া(আমরা মনে করি এই দুইটি দেশের নেতৃত্ব নিয়া) মতবিরোধ শুরু হইবার পরে বিশ্বের দুইটি প্রধান কমিউনিস্ট রাষ্ট্র – একে অপরকে সাম্রাজ্যবাদী চর বলিয়া অভিযোগ করিতেছে। আমরা আজ কম্যুনিস্ট বিশ্বের এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করিতে চাই না। কিন্তু মওলানা সাহেব কি চান, তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করিলেই আমরা এবং দেশব্যাপী তার সম্পর্কে স্পষ্ট মতামত করিতে সক্ষম হইব। সবাই তার সহিত একমত হইতে পারিবে কিনা, সেটা অবশ্য ভিন্ন কথা।

এখন নিজের দেশের দিকে আসা যাক। তিনি যদি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পূর্ব বাংলার অধিকার সম্পর্কে আজিকার মত পূর্বেও সচেতন ও দৃঢ থাকিতেন তাহা হইলে তিনি এবং তার দল – ৬ দফা এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রচারণা করিয়াছিলেন কেন? তাকে আমরা ছয় দফা গ্রহণ করিতে বলি না, জনগণই ৬ দফা, ৮ দফা, ১৪ দফা সবকিছু যাচাই করিবার অধিকারী। কিন্তু ৬ দফার মধ্যে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল সি, আই, এ র হস্ত আবিষ্কার করিয়াছিল, বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও তারাই বা কেন একই সুরে তখন কথা বলিতেছিলেন। ৬ দফাকে তিনি কিংবা যে কেহ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পরিপূরক বলিয়া গণ্য করিতে না পারেন
, কিংবা কেহবা অতিরিক্ত দাবী মনে করিতে না পারেন, সেটা সম্পূর্ণ আলাদা কথা।

মওলানা সাহেবের সহিত বহুদিন আমরা একত্রে কাজ করিয়াছি, তার সাথে আমাদের মতবিরোধএ হইয়াছে৷ আমরা চাই না যে, মওলানা সাহেবের মুখ হইতে এমন কথা বাহির হউক – যার দ্বারা তিনি জনসাধারণের সম্মুখে অবাস্তব প্রতি প্রতিপন্ন হন অথবা আমাদিগকে তাহার সমালোচনা করিতে হয়। তার দলীয় প্রোগ্রাম সম্পর্কে আমাদের কোন বক্তব্য নাই, প্রোগ্রামের অর্থ আমরা জানি। ভাল ভাল কথা, সহজ ভাষায় প্রোগ্রাম রচনা করা এ যুগে কোন কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। প্রোগ্রাম বাজারে ছাড়া আর প্রোগ্রামকে কার্যকরী করার সামর্থ্য থাকা না থাকার মধ্যেই পার্থক্য। তবে এক দলের প্রোগ্রাম অন্য দল গ্রহন করে না, ইহা ডিক্টেটরী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়৷ গণতান্ত্রিক বিধি – ব্যবস্থায় প্রোগ্রামের ভাল – মন্দ বিচার করার অধিকার একমাত্র জনগণেরই রহিয়াছে, অন্য কাহারও নয়। মওলানা সাহেবের নিকট আমাদের সনির্বদ্ধ অনুরোধঃ আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করি – যাতে ছোট বড় সকল রাজনৈতিক দলের স্ব স্ব কর্মসূচী দেশের প্রকৃত মালিক জনসাধারণের কাছে যাচাই করিবার উথ্বাপন করিবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যে কোন দলের পক্ষে নিজের প্রোগ্রাম অন্যের ঘাড়ে চাপাইবার প্রস্তাব হাস্যকর। “

১৬ ই ফেব্রুয়ারী পল্টনে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন মওলানা ভাসানী। জনসভায় ভাষণদান কালে মওলানা বলেন, প্রয়োজন হলে ফরাসী বিপ্লবের মত জেলখানা ভেঙ্গে মুজিবকে নিয়ে আসব। দুই মাসের মধ্যে ১১ দফা কায়েম এবং রাজবন্দী দের মুক্তি দেওয়া না হলে খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হবে। সভার শুরুতে মওলানা ভাসানী সার্জেন্ট জহুরুল হকের গায়েবানা জানাজা পাঠ করেন। ২২ শে ফেব্রুয়ারী কারাগার থেকে, মুক্তিলাভ করেন শেখ মুজিবর রহমান এবং সন্ধায়ই মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মিলিত হন রূদ্ধদ্বার বৈঠকে।

২৬ শে ফেব্রুয়ারী গোলটেবিলে বৈঠক শুরু হয়। ৮ ই মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের আহ্বানে পশ্চিম পাকিস্তান সফরে লাহোরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন মওলানা ভাসানী। সে সফরে শাহিওয়ালে মওলানার উপর হামলা চালায় জামাতের গুন্ডারা।

৯ ই মার্চ দেশের বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানী ও পিপলস পার্টির প্রধান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিমের জনগণের স্বীকৃত দাবীর প্রেক্ষিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানের আদর্শের সাথে সঙ্গতি রেখে সমাজতন্ত্র, প্রতিষ্ঠা এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপ অপসারণ এবং সকল প্রকারের উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা ও সিটো সেন্টো থেকে সরে আসার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চুক্তি সাক্ষর করেন।

২৪ শে মার্চ, ১৫ দিনের পশ্চিম পাকিস্তান সফর শেষে ঢাকা ফিরে আসেন মওলানা ভাসানী। বিমানবন্দরে মওলানা ভাসানীকে যে সম্বোর্ধনা জানানো হয়, তা অভূতপূর্ব। বিমান বন্দর থেকে ইস্কাটন গার্ডেন (মরহুম সাইফুল হাসানের বাসভবন) পর্যন্ত লক্ষাধিক লোক শোভাযাত্রা সহকারে মওলানাকে নিয়ে যায়। এদের হাতে ছিল লাঠি, মাথায় ছিল লাল টুপি। এই মিছিলের অধিকাংশই ছিল সংগঠিত শক্তি। ২৪ শে মার্চ সন্ধায়ই মওলানা সাহেব সন্তোষে চলে যান। যাবার সময় তিনি আভাস দিয়ে যান যে, ২৫ শে তারিখ হতেই পুনর্বার সামরিক শাসন জারি হচ্ছে। এবং ২৫ শে মার্চ পুনরায় সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা থেকে সরে দাড়ান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান।

অভ্যর্থনার সেই দিন গুলোতে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণ মূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক ‘টাইম’ পত্রিকার ১৮ ই এপ্রিল (৬৯) সংখ্যায়। মওলানার ভূমিকা মন্তব্য করতে গিয়ে ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ শিরোনামে ‘টাইম’ প্রতিনিধি বলেছেন,

“শরতের মেঘমুক্ত আকাশের মতই শুচি শুভ্র শশ্রু মন্ডিত উজ্জল তার মুখাবয়ব। রাজধানী ঢাকা থেকে ৬০ মাইল উত্তর পূর্বের একটি গ্রামে তিনি তার নাতি নাতনীদের কাছে যেমনি স্নেহময় এক খেলার সাথীতেমনি এই ৮৬ বছর বয়স্ক আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার দেশের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র বাঙালী কৃষকের কাছে একান্ত আপনজন ‘মওলানা’ বা ‘প্রাণের হুজুর’। কিন্তু এই দয়ালু, স্নেহশীল দাদুই পাকিস্তানী রাজনৈতিক অঙ্গনে ভায়োলেন্সের প্রধান উদ্ধাতা।

একজন মাত্র একজন মানুষই গতমাসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ‘লৌহমানব’ খ্যাত আইয়ুব খান কে সিংহাসন ত্যাগে বাধ্য করেছেন। এই মুহূর্তে ভাসানীই একমাত্র ব্যাক্তি, যিনি ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বিভক্ত একটি জনপদের আপাতঃ শান্ত পরিস্থিতির জন্য বড় এক ভীতি। সামরিক শাসনের আড়ালে এই আপাতঃ শান্ত ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ জনপদটি একটি শ্বেতশুভ্র শশ্রুমন্ডিত মুখমন্ডলের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ভাসানীর প্রধান বাঙালী প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ মুজিবর রহমান সহ পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই একটি ব্যাপক ভীতির কারণে নিশ্চুপ। কিন্তু ভাসানী অকুতোভয়। তার বাঁশের বেড়া দেয়া ক্ষুদ্র কুটিরে তার অনুসারী এবং সাংবাদিকদের এখনো অবারিত দ্বার। খড়ের টুপিটি মাথায় আঁটতে আঁটতে এবং সবুজ সোয়েটারটিকে শরীরে ঠিকমত গলাতে গলাতে ‘টাইম’ এর করেসপডেন্ট ড্যান কগিনকে সোজা একটি প্রশ্ন করে বসলেন, ” আমার ভয় কিসের? আমি আমার লোকদের জন্য ফাঁসিতে ঝুলতেও রাজি। “

এ ধরণের একটি বিস্ফোরণাত্বক উক্তি একমাত্র বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধেই উচ্চকিত। ক্ষমতারোহনের পর ইয়াহিয়া খান তার প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে শান্তির উপরেই বেশী জোর দিয়েছেন। এমনকি, শান্তি রক্ষাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, নিয়মতান্ত্রিক শাসনে ফিরে যেতে আমাদের বেশ কিছু সময় লাগবে। কিন্তু ভাসানী বসে নেই। তিনি ইতিমধ্যেই কড়া সুরে জানিয়ে দিয়েছেন,

“সমস্যা সমাধানে আমাকে সহ পাকিস্তানী সব রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বৈঠকে না বসলে আমি পুনরায় আমার পথকে বেছে নিতে বাধ্য হবো। “

মূলতঃ স্বাধীনতার পূর্বে স্বাধীনতার কথা উচ্চকিত করে তুলছেন। তিনি অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পশ্চিমা দের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে তার সংগ্রামে বদ্ধপরিকর। তার দাবী হয় বর্তমান সরকার অতীতের অসাম্যের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য নতুবা তিনি অন্য পথ দেখবেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলেন, “জনগণ আইয়ুবের বিরুদ্ধে যা করেছেন, ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধেও তা ই করবেন। কিন্তু এ সময় এ বিক্ষোভ হবে আরো মারাত্মক, আরো ভয়ংকর। “

পাকিস্তানীরা কি সত্যিই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে? প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে ভাসানী উত্তেজিত হয়ে ছুড়ে দিলেন একটি মোক্ষম পাল্টা জবাব, সেনাবাহিনীর পক্ষে কি সাড়ে বারো কোটি পাকিস্তানীকে হত্যা করা সম্ভব হবে? উত্তর ভিয়েতনামীরা কি যুদ্ধ থেকে পিছপা হয়েছে। আমরাও তাদের মত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাসিন্দা। বিদ্রোহের আগুন একবার জ্বলে উঠলে জনগণকে কোন কিছুতেই শান্ত করা যাবে না। “

ভাসানীর এই বাণী অবিশ্বাস্য ভাবে সত্যকেই প্রতিভাত করে। যতদূর বোঝা যায়, পাকিস্তানীরা আর সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করবে না। ভাসানীর অনুসারী পূর্বাঞ্চলের কৃষক সমাজ তো নয়ই। এছাড়াও রয়েছে তার তিন থেকে চার কোটি দরিদ্র গ্রামীণ অনুসারী। তারা ভাসানীকে জীবন্ত মহামানবের মত ভক্তি করে, শ্রদ্ধা করে। গত ষাট বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি সৃষ্টি করেছেন তার এই অনুসারীদের। প্রথম লগ্নে বৃটিশ রাজ এবং পরে ভূস্বামী দের বিরুদ্ধে শোষিত দারিদ্র্য পীড়িত এই সব কৃষক সমাজের পক্ষে ৬০ বছরের অক্লান্ত লড়াই ই তাকে এ সম্মান দিয়েছে৷ পোশাকে আশাকে চলনে বলনে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাদাসিধা এই মানুষটি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পদব্রজে সতত থেকেছেন ধর্ম আর রাজনীতিকে প্রচারের কাজে৷ তার এই আদর্শকে তিনি বলেছেন, ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র ‘।

অন্যান্য যেসব মুসলিম আলেম রয়েছেন তাদের সঙ্গে ভাসানীর মতবাদের পার্থক্য হচ্ছে ইসলাম এবং ভাসানী কথিত সমাজতন্ত্র মিশতে পারে না। তার সমালোচক দের অভিযোগ, তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের প্রসার ঘটাচ্ছেন। কারণ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে খুবই দূর্বল হবে এবং চীন ও পার্শ্ববর্তী কমিউনিস্ট শাসিত ভারতীয় প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গের প্রভাব এ উপরে ফেলা অনেক সহজ হয়ে যাবে। ভাসানী নিজে কমিউনিস্ট নন, কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা সবাই প্রগতিশীল বামপন্থী এবং ব্যক্তিগত ভাবে এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে পিকিংয়ের সাথে সম্পর্ক যুক্ত।

একজন উদার ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ হিসাবে ভাসানী ধর্মের সকল গোড়ামীর উর্ধ্বে। এ ব্যাপারে তার যুক্তি হল, “আমার ধর্ম হচ্ছে বিপ্লবী ধর্ম এবং আমি একজন ধার্মিক লোক। অতএব, আমার ধর্ম হচ্ছে সকল প্রকার অন্যায় আর অসত্যের প্রতিবাদ। ” তিনি প্রচলিত সমস্ত ব্যবস্থাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে, প্রচলিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিলেই এবং সম্পূর্ণ রূপে উদঘাটিত করলেই সেখানে নতুন ব্যবস্থার উন্মেষ ঘটতে পারে। ১৯৫২ সালে তার প্রথম চীন সফলের সময় কালীন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ “চীন মিত্রতা” কেও তিনি কখনও অস্বীকার করেননি। এ ব্যাপারে তার মন্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি স্পষ্টতই বলেছেন, একমাত্র নাস্তিকতা ছাড়া চীনের সবকিছুকেই মনে প্রাণে সমর্থন করি।”

ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের শেষ দিনগুলি

দ্বিতীয় বার সামরিক শাসন জারির পর রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন বিরাট শুন্যতা বিরাজমান, সেসময়ে ২৯ শে আগস্ট (৬৯) বগুড়া জেলার মহীপুরে এক সর্বদলীয় কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কিন্তু অন্যান্য নেতৃবৃন্দের কারণে ১০ ই আগস্ট ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে সে সম্মেলন স্থগিত করার ঘোষণা করেন তিনি। সাংবাদিক সম্মেলনে মওলানা বলেন, নির্বাচনের পূর্বে শাসনতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রশ্নে নেতৃবৃন্দ কে অবশ্যই ঐক্যমত্যে পৌছাতে হবে। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট ভেঙ্গে দেয়ার দাবীকে ঘোলাটে করে লাভ নেই। আমাদেরকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহন করতে হবে। সম্মেলনে মওলানা কৃষকদের দূরাবস্থা এবং বন্যা ও দেশে দূর্ভিক্ষাবস্থার কথা বর্ণনা করেন এবং ২৯ শে আগস্ট প্রস্তাবিত সর্বদলীয় কর্মী সম্মেলনের পরিবর্তে মহীপুরে ঐ তারিখে আহ্বান করেন কৃষক কর্মী সম্মেলন।

২৮ শে আগস্ট সকালে প্রবল বর্ষণ সত্ত্বেও, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল সংখ্যক কর্মী উপস্থিত হতে থাকেন সম্মেলনে। সম্মেলনে ভাষণ প্রসঙ্গে মওলানা বকেয়া খাজনা আদায়ের জন্য বডিওয়ারেন্ট, কৃষকের গরু, তৈজস পত্র, চাষের সরঞ্জাম ক্রোকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ৪ঠা অক্টোবর সাহাপুরে অনুষ্ঠিত হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি ‘ র সেচ্ছাসেবক ও সেচ্ছাসেবিকা বাহিনী সম্মেলন। সেই থেকে লাল টুপি বাহিনীর আয়োজন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর, এর পূর্বে এ ধরণের আরেকটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন মওলানা ভাসানী – কাগমারীতে।

৪ঠা অক্টোবর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেই মওলানা বেরিয়ে পড়েন উত্তরবঙ্গ সফরে। ২৩ শে সেপ্টেম্বর পাবনার চরাঞ্চলে এক প্রকাশ্য কৃষক কর্মী সভায় পুলিশ বাধা দেয় মওলানাকে। এতে জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে মওলানা শুধু তাদের ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে বলেন।

৪ ঠা অক্টোবর নির্ধারিত সময়ে শুরু হয় সম্মেলন। এর আগে এই সম্মেলন পিছিয়ে দেবার জন্য তৎকালীন গভর্নর এডমিরাল আহসানও অনুরোধ করেছিলেন মওলানা কে। কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্তে অটুট থাকেন মওলানা। আর সম্মেলনে আগত কয়েক সহস্র জঙ্গী কৃষকের উদ্দেশ্যে প্রতিরোধের ডাক দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তাদের অশীতিপর নয়নমণি।

সে বছরই ৩ রা অক্টোবর ঢাকায় বাঙালী – বিহারী দাঙ্গা দেখা দিলে মোহাম্মদপুর -মীরপুর এলাকায় ছুটে যান মওলানা। ৪ঠা অক্টোবর দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় দাঙ্গা বিরোধী মিছিল পরিচালনা করেন মওলানা স্বয়ং।

পরবর্তী পর্যায়ে, ১৯৭০ সালের ৯ ই জানুয়ারী ও ১৯ শে জানুয়ারী সন্তোষে যথাক্রমে জাতীয় সম্মেলন ও কৃষক সেচ্ছা সেবক-সেবিকা সম্মেলন আহ্বান করেন মওলানা।

৯ ই জানুয়ারী সম্মেলনে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য কৃষক – শ্রমিক রাজ প্রতিষ্ঠার সংকল্পের কথা ঘোষণা করেন মওলানা ভাসানী। তিনি বলেন, লাহোর প্রস্তাবে ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ মর্যাদা স্থাপনের সংগ্রামে তিনি তার শেষ রক্তবিন্দু দানে প্রস্তুত রয়েছেন এবং যারা এই কঠোর সংগ্রামে তার সাথে শরীক হবেন বলে তাদেরও সংকল্প উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, সাম্রাজ্যবাদের দালাল ও সি আই এ এজেন্ট দের স্থান এই সংগ্রামে নেই। যারা পারমিট শিকার করতে চান বা উসেদারী করে ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা করতে চান তাদের স্থান অন্যত্র খুঁজতে হবে। তিনি ঘোষণা করেন, প্রবল জনমত গড়ে তুলে প্রচন্ড গণশক্তির জোরে তিনি লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ দাবী আদায় করবেন। তিনি বলেন, বিপ্লব শুধু বন্দুক দিয়ে হয় না, গণশক্তির জোরে প্রবল জনমত দ্বারাও বিপ্লব সাধিত হতে পারে৷ গণশক্তির কাছে আণবিক বোমাও হার মানতে বাধ্য। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রবল গণশক্তির মুখে রাজ্য জয় করতে পারে না, তাদের আণবিক বোমা কাগুজে বাঘ হতে বাধ্য।

এই সম্মেলনেই মওলানাকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় একটি সমন্বয় কমিটি। এখানেই গৃহীত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তানের মর্যাদা অর্জন দাবীর ৬ দফা কর্মসূচী ‘। এ সম্মেলনে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১০ ই জানুয়ারী পল্টনে একটি বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন মওলানা।

১৯ শে জানুয়ারীর কৃষক সম্মেলনে এক নতুন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা ঘোষণা করেন মওলানা। তিনি বলেন, মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব মানুষকে লইয়া মানুষের জন্যই অনুষ্ঠিত হইবে৷ যে মানুষের জন্য এই বিপ্লব করা হয় তাহারা কে? তাহারা হইতেছে দেশের জনসাধারণ, যাহারা সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শোষিত ও নিগৃহীত হইতেছে। এই শোষণের অবসান ঘটাইয়া সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থা কায়েম করিবার প্রাথমিক স্তর হিসেবে দেশে সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রয়োজন।… কর্মীরা নিজ নিজ এলাকার জনসাধারণের জীবনের সাথে মিলাইয়া তাহাদের বিশেষ বিশেষ সমস্যা গুলো তুলে ধরিবে এবং উহা সমাধানের জন্যই আন্দোলন করিবে। জনসাধারণের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করিতে হইবে, এই ধরণের আলাপ আলোচনা হইতেই কর্মীরা তাদাদের কাজের শক্তি পাইবে। মনে রাখিকে হইবে, জনসাধারণ তাহাদের সমস্যার কথা কর্মীদের চাইতে ভালো জানেন, ভালভাবে বোঝেন, কারণ তাহারাই এই সমস্যায় জর্জরিত। কর্মীরা যেন সবজান্তার ভাব লইয়া জনসাধারণের সাথে কথা না বলে, তাহা হইলে কর্মীরা জনসাধারণের বিরক্তি উৎপাদন করিবে এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অপূরণীয় ক্ষতি করিবে। কর্মীরা বিনয়, সহানুভূতি ও ধৈর্য্যের সঙ্গে জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশার কথা শুণিয়া, পরে কি করণীয় সেই সন্মন্ধে আলোচনা করিবে। ঔদ্ধত্য ও একগুয়েমি বিপ্লবের ব্যর্থতা আনিবে। মনে রাখিতে হইবে, এই বিপ্লব কোন সংস্কারমূলক কাজ নহে, কারণ সমাজের শোষণ ব্যবস্থার কাঠামো অটুট রাখিয়া কেবল মাত্র উহার বাহিরের দিকটা সংস্কার করিলে, দেশের মানুষের মুক্তি নেই। সাংস্কৃতিক বিপ্লব এক যুগান্তকারী নতুন জীবনের দিশারী কর্মপন্থা। কারণ কেবলমাত্র শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থাই দেশের অগ্রগতি ও উন্নতি সুনিশ্চিত করিতে পারিবে। সকল প্রকার শোষণের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের গতি প্রবাহিত হইবে।

আমাদের দেশে দুই ধরণের কাজ, শোষণ প্রতিরোধ ও শোষণ ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া ফেলা এবং সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠন ও উন্নয়ন মূলক কাজ একই সঙ্গে করিবার সুযোগ রহিয়াছে। এই দুই কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পাদন করিলে, দেশের কৃষক ও অন্যান্য মেহনতি জনসাধারণ অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেদের সত্যিকারের মুক্তি আনিকে পারিবে। “

এ সময় গোটা পাকিস্তানে কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য মোট পাঁচটি সম্মেলনের আয়োজন করেন মওলানা। পাকশী(শাহপুর) তে যে যাত্রার শুরু, পশ্চিম পাকিস্তানের টোবাটেক সিং শেষে ঢাকার রেসকোর্সে বিরতি। টোবাটেক সিং – এর সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় ২৩ শে মার্চ, ১৯৭০. আর রেসকোর্সে সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠান হয় ২ রা অক্টোবর। প্রবল বর্ষণ সত্ত্বেও সেদিনের সেই সম্মেলন শেষে শত সহস্র জনতা মওলানার নেতৃত্বে গভর্ণর হাউজের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে ‘পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক মজুর, ক্ষেত মজুর, মধ্যবিত্ত, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কামার কুমার জেলে, তাঁতি, মাঝি, হরিজন, বাস্তুহরা, নদী সিকস্তি, মোহাজের, হকার, বস্তিবাসী, ছাত্র শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, নিম্ন বেতনভুক কর্মচারী সহ সকল সর্বহারা মেহনতি মানুষের পক্ষ থেকে গভর্নর সমীপে স্মারকলিপি পেশ করেন মওলানা। এই স্মারক লিপির দাবী ছিল ২৮ টি। মওলানা একে অভিহিত করেন ‘চরমপত্র’ বলে।

১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ ১৩ দিনের জন্য শেষবারের মত পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন মওলানা। সেবারের সেই সফরে ১৩ দিনে মোট ১২ টি জনসভায় বক্তৃতা করেন মওলানা ভাসানী। লাহোর থেকে কোয়েটা পর্যন্ত সর্বত্রই হাজার হাজার জনতাকে সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। চোস্ত উর্দু বলতে পারেন বলে যেতে পারেন তাদের হৃদয়ের কাছাকাছি।

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরে এলেন তিনি ২২ শে অক্টোবর। তারপরই সেই প্রলয়ংকরী ১২ ই নভেম্বর। মওলানা সাহেব তখন ধানমন্ডীর ৫ নম্বর রোডে পলিক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। দেশবাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন, ‘তাকে মাপ করে দিতে হবে’। ব্রংকাইটিসের কারণে কথা বলতে পারেন না। এ সময়ে দক্ষিণ বঙ্গের মানুষের আর্তচিৎকার তাকে উতলা করে দিল। ছুটে গেলেন তিনি ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বিধস্ত দক্ষিণ বাংলায়।

ফিরে এসে ৪ঠা ডিসেম্বর ঢাকার এক বিশাল জনসভায় অভিযুক্ত করলেন সরকারকে। চুকিয়ে দিলেন সমস্ত সম্পর্ক পশ্চিমের সঙ্গে। সেদিনের সেই জনসভায় মওলানার ভাষণ আজো অনেকের মনে গেঁথে আছে৷ দুর্গত মানুষের করুণ অবস্থার এক দলিলচিত্র হিসেবে।

২০ শে ডিসেম্বর সাতক্ষীরার এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে মওলানা বললেন, ৭ কোটি৷ বাঙালী ভারত বা অন্য কোন রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব মেনে নেবে না এবং প্রয়োজন হলে তারা তাদের শেষ রক্তবিন্দু বিসর্জন দিতেও কুন্ঠাবোধ করবে না।

১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারী সন্তোষ থেকে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে ৯ ই জানুয়ারী সন্তোষ জাতীয় সম্মেলনে যোগদানের জন্য আহ্বান জানান। বিবৃতিতে মওলানা সাহেব জানান, ইতিহাসের আলোকে যাচাই করে দেখলে যে কেহ স্বীকার করবেন যে, এই সংগ্রাম মোটেও অযৌক্তিক, বেআইনী কিংবা রাষ্ট্র দ্রোহীতা মূলক নয়। অখন্ড ভারতের দশ কোটি মুসলমানের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবী, কাশ্মীরের পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবী ও ফিলিস্তিনের সর্বহারা আরবদের মুক্তি সংগ্রাম প্রকৃত পক্ষে একই পর্যায়ভুক্ত। যারা এই সত্যকে দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করে নেবেন এবং নিঃস্বার্থ ও নির্ভীক হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধীকার সংগ্রামে যোগদান করতে চান একমাত্র তারাই সন্তোষের সম্মেলনে যোগদান করতে পারেন।

মওলানা ভাসানী বলেন, এইবার আমার বয়সের শেষ সংগ্রামের চুড়ান্ত ঘোষণা। বিগত ৪ ঠা ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে অখন্ড ভারতের দশ কোটি মুসলমানের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি নির্যাতিত ও শোষিত বাঙালীর পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার যে শপথ গ্রহন করেছি তার জন্য আমাদেরকে বহু কোরবানী দিতে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আমার আন্তরিক বিশ্বাস, আমাদের এই ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিশ্বের ন্যায়বিচারকামী মানুষের নৈতিক সমর্থন থাকবে এবং শত ত্যাগের বিনিময়ে হলেও আমরা জয়ী হব।

মওলানা ভাসানী বলেন, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে মুসলিম লীগ সরকারের বদৌলতে শাসক ও শোষকগোষ্ঠী যখন পূর্ব পাকিস্তানকে সকল ক্ষেত্রে পঙ্গু করার জন্য তৎপর, তখন হতেই আমি তৎকালীন পাঁচ কোটি বাঙালীর অধিকার বজায় রাখার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ি৷ পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের সদস্যদের অনুরোধে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে পরিষদে ‘অপজিশন’ গঠন করার মাধ্যমে ১৯৪৮ সাল হতেই আমার এই সংগ্রাম শুরু হয়। মরহুম শেরে বাংলা ফজলুল হক, বগুড়ার মরহুম মোহাম্মদ আলী, মরহুম দেওয়ান লুৎফর রহমান, মরহুম আহমদ আলী মৃধা, মরহুম খাজা নসরুল্লাহ প্রভৃতি প্রভাবশালী সদস্যসহ মোট ৪৫ জন পরিষদ সদস্য এই সংগ্রামে শরীক হন। কিছু দিন পরই তাদের কেহ বর্মার রাষ্ট্রদূত, কেউ চীফ হুইপ, কেউ বা রাজস্ব মন্ত্রী, কেউ বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, কেউ বা পাবলিক সার্ভিস কমিশনার, কেউ বা জজ, কেহ আবার এডভোকেট জেনারেল হয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যান৷ আর আমি মরহুম লিয়াকত আলী খান ও মরহুম নাজিমুদ্দীন সরকারের ‘বিষফোড়া’ হয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আড়াই বছর কারারুদ্ধ থাকি৷ স্বাধিকার আন্দোলনের অঙ্কুর এইভাবে বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমি মোটেই হতাশ হয়ে যাইনি বা দমে পড়িনি। জেল থেকে বের হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের চর অবস্থা দেখে আমি ব্যথিত হই। অবশেষে নিরুপায় হয়ে দশ কোটি মুসলমানের এক কালের প্রিয় দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করি৷ পরবর্তী কালে আবার সরকারী ইনামের আশায় বা নির্যাতনের ভয়ে অধিকাংশই ‘আওয়ামী লীগের সাথে সংশ্রব নেই’ বলে কেটে পড়ে। কাগমারী সম্মেলনের সময় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানাই। এবার আমার বিরুদ্ধে জেহাদে নামলেন খোদ আওয়ামী লীগের কিছু কর্মকর্তা। তারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র ঘোষণা করতে থাকেন যে, আমি হিন্দুস্তানের এজেন্ট হিসেবেই পাকিস্তানকে দ্বি খন্ডিত করার জন্যই ‘আসসালামু আলাইকুম ‘ জানিয়েছি। এই পর্যায়ে আমি নিরুপায় হয়ে পড়ি এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রতিষ্ঠা করি। ন্যাপের মধ্যেও আবার কয়েকজন কর্মকর্তার আবির্ভাব ঘটল যারা ন্যাপ করলেও গোপনে ঘনিষ্ঠ ভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করে যেত। এহেন তথাকথিত কমিউনিস্টরাও আমার বিরুদ্ধে গোপন জেহাদ শুরু করে দেয় এবং বলে বেড়াতে থাকে যে আমি সাম্প্রদায়িক, আমি সেচ্ছাচারী ইত্যাদি। তারাও ধীরে ধীরে আমার সংশ্রম ত্যাগ করে চলে যায়। কিন্তু দেশবাসী অবগত আছেন কত ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমি সংগ্রাম ও আন্দোলনের কর্মসূচী অনুসরণ করে চলেছি।

মওলানা ভাসানী বলেন, দেশের আজ চরম দূর্দিন। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করলেই চলবে না। উহাকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তোলার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। যারা এই সংগ্রামে শরিক হবেন তাদেরকে এই দাবীতে গণভোট প্রদানের আন্দোলন, গ্রামে গ্রামে জাতীয়তাবোধ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অনুকূলে জোর প্রচারাভিযানঃ বিদেশী পণ্য, ব্যাংক ও বীমা বর্জন, গ্রামবাসীর নিকট ২৩ বছরের শোষণের সঠিক চিত্র তুলে ধরা এবং বাঙালীর দরদী সেজে যারা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে তাদেরকে ধ্বংস করার সংগ্রাম শুরু করতে হবে।

সাময়িক ভাবে এই পাঁচটি দৃষ্টিকোণ থেকে সংগ্রামের প্রাথমিক পর্যায় কেটে উঠলে আরো ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী কর্মসূচী অবশ্যই গ্রহন করতে হবে। তবে একটি কথা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতিত কৃষক, মজুর, হারি প্রভৃতি শ্রেণীর মুক্তি আন্দোলনে সক্রিয় সমর্থন দান করে যাব। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ মুক্ত কৃষক শ্রমিক রাজ কায়েম হলেই কনফেডারেশন স্থাপনের আশা করা যেতে পারে।

সন্তোষ সম্মেলনের পরদিন পল্টন ময়দানে এ জনসভায় ভাষণ দেন। এর পরেই বেরিয়ে পড়েন প্রদেশ সফরে। উদ্দেশ্য স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবীর পক্ষে জনমত গড়ে তোলা।

সফরের শেষ পর্যায়ে মওলানা গেলেন চট্টগ্রামে। লালদিঘী ময়দানে ভাষণ দিলেন ২১ শে মার্চ বিকেলে। ২৩ শে মার্চ পল্টনে তার ভাষণ দেয়ার কথা। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে মওলানা আর ঢাকায় এলেন না, সোজা চলে গেলেন সন্তোষের বাড়ীতে। দেশব্যাপী তখন বিক্ষোভ আর বিদ্রোহ।

২৫ শে মার্চ নতুনভাবে জারি হল সামরিক শাসন। শুরু হল বিভীষিকাময় দিন। সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দিল মওলানার কুড়েঘর। যমুনার বুকে নাও ভাসিয়ে দিলেন মওলানা। পাড়ি দিলেন অনাগত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে।

বাংলাদেশ ও মওলানা

১৯৭০ সনের জনসভায় এবং অনুসারীদের কাছে বিভিন্ন সময় মওলানা বলেছিলেন, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান না দেখে তিনি মরবেন না। স্বল্প সময়ে মওলানার এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে সত্যে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে দেশান্তরী হবার জন্য যমুনার বুকে পাড়ি দিয়েছিলেন মওলানা। আর ১৯৭২ সালের ২২ শে জানুয়ারী ‘নানান জল্পনা কল্পনার’ অবসান ঘটিয়ে ময়মনসিংহ হয়ে টাঙ্গাইল পৌছলেন মওলানা ভাসানী। ভারত থেকে ফিরে আসার পথে মেঘালয় প্রদেশের মধ্যে দিয়ে হালুয়াঘাট সীমান্তে প্রবেশ করেন।

২৫ শে মার্চ সন্তোষ থেকে পালিয়ে যাবার পর এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন মওলানা। ৪ ঠা এপ্রিল পৌছলেন পাবনার শাহজাদপুরে। মওলানা বলেছেন স্ত্রী ও বিবাহিত এক কন্যাকে নিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে তাকে ১৭ মাইল হাঁটতে হয়েছে। তার বড় দুঃখ ছিল বাড়ী ছেড়ে চলে যাবার সময় তাকে চশমা ফেলে যেতে হয়েছে। রংপুর জেলায় কামারজানি হয়ে ধুবরী দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন মওলানা। ভারতের মাটিতে পা দিয়েই মওলানা বুঝলেন সেখানে বিরাজ করছে ভিন্ন পরিস্থিতি।

দেশে ফিরেই, মওলানা ভাসানী প্রস্তাব দিলেন জাতীয় সম্মেলনের। গুরুত্ব আরোপ করলেন বামপন্থী ঐক্যজোটের উপর। সেই থেকে বাংলাদেশের মাটিতে মওলানা ভাসানীর নতুন রাজনীতির সূত্রপাত। সেদিনই মওলানা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বেশিদিন স্থায়ী হবার নয়। তাই ২০ শে জানুয়ারী সন্তোষের গ্রামের বাড়ীতে এ, এফ পি ‘ র সংবাদদাতার সঙ্গে সাক্ষাৎকার মওলানা বললেন, ‘বাংলাদেশ পাকিস্তানী শাসনের স্থলে ভারতীয় শাসন প্রতিষ্ঠার কোন সম্ভাবনা নেই। এ কারণেই মওলানা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা – ভবিষ্যতের রাজনীতিবিদ। তাই বিভিন্ন সময়ে অতীতের রাজনীতিবিদরা তাকে ভুল বুঝেছে, বর্তমানের রাজনীতিবিদেরা তাকে গ্রহন করতে পারেননি।

১৯৭১ সালের ৯ ই মার্চ পল্টন ময়দানে শেষ জনসভায় ভাষণ দিয়ে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মওলানা। আর ১৯৭২ সালের ৯ ই ফেব্রুয়ারী পুনর্বার এলেন ঢাকায়। এবার আর জনসভায় ভাষণ দিতে নয়। অসুস্থ হয়ে পি, জি হাসপাতালে ভর্তি হতে। ১০ ফেব্রুয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তার সাথে দেখা করতে গেলেন।

২৬ শে ফেব্রুয়ারী মওলানা ভাসানী প্রথম সাবধান বাণী উচ্চারণ করলেন। সন্তোষের কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাষণ দিতে গিয়ে বললেন, “রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে যদি কৃষকের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ করা না যায়, তাহলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। শুধু তাই নয়, কৃষককে অনাহারে রেখে কতিপয় ধনীর জন্য ব্যবস্থা করা হলে স্বাধীনতা বিপণ্ন হবে। এই ভাষণেই মওলানা হুশিয়ার করে দিলেন, চোরাচালানের বিরুদ্ধে। বললেন, চোরাচালানের ফলে বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম, দুঃখ বাড়ছে সাধারণ মানুষের।

২ রা এপ্রিল (৭২) পল্টন ময়দানে মওলানা প্রথম আহ্বান করলেন জনসভা। কিন্তু ঘুর্ণিঝড়ের জন্য জনসভা পিছিয়ে দিয়ে তারিখ ঠিক করলেন ৯ ই এপ্রিল। সেই জনসভায় মওলানার প্রথম প্রকাশ্য সাবধান বাণী। লক্ষাধিক মানুষের জনসভায় প্রায় পঞ্চাশ মিনিটের বক্তৃতায় মওলানা নক্সালপন্থীদের বিনা বিচারে হত্যার বিরোধিতা করে বলেন, ‘নক্সাল কারো গায়ে লেখা থাকে না’। বললেন, ‘মুজিবর তুমি আর মুজিব ভাই নও। তুমি এখন জাতির পিতা ও প্রধান মন্ত্রী। ‘ মওলানা ঘোষণা করলেন, ‘তোমরা যত খুশী দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট দাও, তবে একবার যদি আগুন জ্বলে উঠে তাহলে তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের আর দেখা যাবে না।’ চোরাচালান সম্পর্কে মওলানা বলেন, সরকারে বসে যারা চোরাচালানের কথা বিশ্বাস করে না তারা ভ্রান্ত। দেশের সম্পদ সীমান্তের ওপারে চলে যাচ্ছে আর তারা বলছে, ‘,চোরাচালান হয় না’.

সেই থেকে চোরাচালান, দূর্নীতি আর কালোবাজারীর বিরুদ্ধে মওলানার জেহাদের শুরু। এর পর মওলানা ঘুরে ঘুরে দেশের বিভিন্ন জনসভায় ভাষণ দেন। ২৯ শে এপ্রিল শিবপুরে আয়োজিত দু দিন ব্যাপী পূর্বাঞ্চলীয় কৃষক সম্মেলনে উদ্ভোধনী ভাষণে মওলানা বলেন, সমাজতন্ত্র দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ কৃষক শ্রমিকের মুক্তির একমাত্র পথ। শোষক শ্রেণীকে নির্মূল করার জন্য সমাজতন্ত্র কায়েম করা না গেলে বাংলাদেশের কৃষকের মুক্তি আসবে না। তিনি বললেন, আমরা মন্ত্রীত্ব বা ক্ষমতা লাভের জন্য রাজনীতি করি না, মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করি। কাজেই কোন মোহই আমাদের সংকল্প থেকে নিবৃত্ত করবে পারবে না। অতিপরিচিত বজ্র কন্ঠে মওলানা বলেন, ‘স্বাধীনতার পর লুটপাট সমিতি জনগণের উপর নির্যাতন করছে। রাতারাতি গাড়ী বাড়ীর মালিক হয়েছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করে জনজীবনে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে হবে।’

‘৭২ সালের মে মাসে যখন সমগ্র বাংলাদেশ ব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দিতে শুরু করে, সেসময় নোয়াখালী, কুমিল্লা সহ কয়েকটি স্থানে জনসভা করে সর্বদলীয় খাদ্য সম্মেলনের আহ্বান প্রস্তাব দেন৷ প্রতিটি জনসভায় মওলানা হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘এখনই খাদ্য সংকটের মোকাবেলা করা না হলে অবর্ণনীয় দুর্ভিক্ষে প্রাণ দেবে বাংলার শত সহস্র মানুষ। মওলানার এই ভবিষ্যদ্বাণী নির্মমভাবে প্রমাণিত হয়েছে ‘৭৪ সালে – যখন আর দূর্ভিক্ষ মোকাবেলা করার ইচ্ছে ছিল না সরকারের। ‘

এই সময়ে বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নতুন ধারার প্রবর্তন করে সাপ্তাহিক ‘হক কথা ‘ প্রকাশ করেন মওলানা। একসময়ে মহীপুর থেকে বুলেটিন আকারে প্রকাশিত হল ‘হক কথা ‘। বাংলাদেশ আমলে মওলানা একে নিয়মিত সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। সেদিনের এই দিন গুলোতে ‘হক কথা’ র ছিল যাদুকরী ভূমিকা। অথচ ‘হক কথা’ র এই ঔদ্ধত্যের জন্যই জুন মাসে ‘হক কথা’ র সম্পাদক ইরফানুল বারীকে গ্রেফতার করেন সরকার।

‘৭২ সালের শেষ দিকে খসড়া শাসনতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করেন মওলানা ভাসানী। ২২ শে অক্টোবর এক বিবৃতিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী শাসনতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘সংবিধানে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অহেতুক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যা একনায়কত্ব বাদী শাসনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে এই আশঙ্কাকে।

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে (২৫ ডিসেম্বর) সন্তোষে মওলানা আহ্বান করলেন নিখিল বাংলা জোয়ান কর্মী সম্মেলন। মওলানা ঘোষণা করলেন, চোরাচালান, মজুদদারী, কালোবাজারী, ঘুষ, দূর্নীতি, হাইজ্যাক, রাহাজানি, ডাকাতি, গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস ও ফ্যাসিবাদী হামলা প্রতিরোধ করাই হবে এই কর্মী সম্মেলনের মূল লক্ষ্য।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর মওলানা ভাসানী সংগ্রাম চালিয়েছেন কালোবাজারী, চোরাচালানী, ঘুষ, দূর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষকে রক্ষার জন্য বার বার আবেদন জানিয়েছেন, সর্বোপরি জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলে।

অনাহারক্লিষ্ট মানুষকে বাঁচানোর দাবীতে ‘৭৪ সালের ১৫ ই মে মওলানা শুরু করলেন অনশন। জীবনে আরো বহু বার তিনি অনশন করেছেন, শেষবারের অনশনের সঙ্গে তার কোনটিই তুলনীয় নয়। অনশনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে মওলানা বললেনঃ
“প্রতিদিন আমার নিকট লোক মারফত ও চিঠি পত্র মারফত জানিতে পারিতেছি যে, বাংলাদেশের বহু গ্রামে অসংখ্য লোক খাদ্যের অভাবে মারা যাইতেছে। ধানের মন ৬৬ টাকা/ চিনা ৫২ টাকা/ মিঠা আলু ২৭/২৮ টাকা তদপুরি হিন্দুস্তানের ছাপানো নোট গরীব লোকেরা ব্যাংকে ভাঙাইতে না পারিয়া শতকরা ১০/১২ টাকা বাট্টা বেজ দিয়া মুনাফাখোর ব্যবসায়ী দের নিকট হইতে ভাঙাইতেছে। গ্রাম বাংলার আটার কল মোবিল / ডিজেলের অভাবে বন্ধ হইয়া যাইতেছে। মানুষ জন পাটায় বাটিয়া গম খাইতেছে। কাপড় ক্রয় করা গরীব, ভূমিহীন মজুর, রিকশাওয়ালা, ট্যাক্সিচালক, পিয়ন, আরদালি, গরীব কর্মচারী প্রভৃতি মেহনতি মানুষ বড় বড় জোতদার বাদে সমস্ত কৃষক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়িয়া মারা যাইতেছে৷
এ গজব লক্ষ লক্ষ শহীদের অতৃপ্ত আত্মারই অভিশাপ। তাই আমি সিদ্ধান্ত গ্রহন করিয়াছি বর্তমান সরকার যদি তাহার দূর্নীতির পথ পরিহার করিয়া দেশের বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতির মোড় না ঘুরাইতে আগাইয়া আসে তবে আগামী ১৫ ই মে তারিখ হইতে আমি দেশ ও জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং অসহায় জাতির বর্তমান করুণ অবস্থার প্রতিবাদে আমরণ অনশন করবো। আমার বৃদ্ধ বয়সে অনাহার ক্লিস্ট জাতির ক্ষুধিতের কাতারে শামিল হইয়া জীবন কোরবানী দিব। “

এই অনশন ধর্মঘট বাংলাদেশের মানুষকে দিয়েছে সংগ্রামী প্রেরণা। অবশেষে সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দের আহ্বানে অনশন ভঙ্গ করলেন মওলানা। কিন্তু ডাক দিলেন আন্দোলনের। আর সর্ব দলীয় সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আন্দোলনের সূচনা করতে গিয়ে সন্তোষের বাড়ীতে অন্তরীণাবদ্ধ হলে মওলানা। কিন্তু মওলানা জানতেন এই দুঃশাসন স্থায়ী হবার নয়। সবাইকে তিনি বললেন, ধৈর্য্য করে অপেক্ষা করার জন্য। তাই ১৫ ই আগস্ট যেদিন দুঃশাসনের অবসান ঘটল, তারপরই বিবৃতি দিয়ে তিনি স্বাগত জানালেন ‘পরিবর্তন ‘ কে।

এ বছরর মে মাসেই মওলানা আহ্বান করলেন ঐতিহাসিক ফারাক্কা মহামিছিল। ফারাক্কা মিছিল ছিল এক স্বাধীন জাতির জয়যাত্রার মহা প্রতীক। পথের ক্লান্তি, রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে শত সহস্র মানুষকে নিয়ে গেছেন সীমান্তে। গঙ্গার এক তরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ একটি জাতির প্রতিবান জানাতে।

পারিবারিক জীবন

স্বামী, পিতা কিংবা দাদু হিসেবে মওলানার পরিচয় অনেকের কাছেই অজ্ঞাত। পরিবার থেকে নিজেও থেকেছেন বিচ্ছিন্ন। অদ্ভুত ভাবে এই মানুষটি চিরদিন আড়াল করে গেছেন তার ব্যক্তি জীবনকে৷ এই ব্যক্তিজীবন রূপ নিয়েছে সমষ্টি জীবনে।

জীবনের বহু সময় তিনি কাটিয়েছেন আত্বীয় পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। তাই পরিবারের সদস্য দের তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রচুর। আবার তার মেয়ে মাহমুদা স্বীকার করেন – ‘আমরা কেউই বাবার মত হতে পারিনি।’ বাবার জীবন তাদের কাছে এক অচেনা জীবন।

প্রথম জীবনে ঘরের বাহির হয়েছিলেন বলে দীর্ঘ দিন ঘর তাকে বাঁধতে পারে নি। ৪৫ বছর বয়সে বগুড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেন মওলানা সাহেব তার গুরুর নির্দেশে। মওলানা সাহেবের প্রথম স্ত্রী আজও জীবিত। ১৯ বছর বয়সে তিনি এসেছেন একজন পুরুষের ঘর করতে। এখন বয়স তার পঁচাত্তর। বিত্তবান ঘরের এই মহিলা সুখে দুঃখে থেকেছেন তার পাশে। শুধু তাই নয়, পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ৫০০ বিঘা জমি দিয়েছেন ভাসানী প্রতিষ্ঠিত হাজী মোহাম্মদ মোহসীন কলেজের জন্য। ইনি আজকের “বাবুর মা”। এ পক্ষে মওলানার সন্তান সংখ্যা চার। দুই ছেলে দুই মেয়ে।

এছাড়াও আরো দুবার দার পরিগ্রহ করেছেন মওলানা ভাসানী। সেই দুজন সহধর্মিণীর কেউই আজ বেঁচে নেই। রাজনৈতিক কারণেই দ্বিতীয় বার দার পরিগ্রহ করতে হয়েছে মওলানাকে। মওলানা যখন সন্তোষে জমিদার বিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত, সে সময় সন্তোষ তার একটি স্থায়ী আবাস প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সে কারণেই বিয়ে। এই বিয়ে মওলানাকে যোগায় শক্তি ও সাহস। তৃতীয় বার মওলানা সাহেব পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন রংপুরের ভুরুঙ্গামারীর এক মহিলার সঙ্গে। তিনিও আজ বেঁচে নেই। এই ঘরে মওলানার সন্তান সংখ্যা তিন৷ এক ছেলে, দুই মেয়ে।

শেষোক্ত দুজন সম্পর্কে বরাবর মওলানা এক অদ্ভুত গোপনীয়তা বজায় রেখেছেন মওলানা সাহেব। তার সমসাময়িক কোন সহযাত্রীর কাছে এ সম্পর্কে কিছু বলেছেন কি না তা নির্ধারণের উপায় নেই।

রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ বিস্তৃতির কারণে স্বাভাবিক ভাবেই মওলানার পারিবারিক জীবন সাধারণের কাছে রহস্যাবৃত। রাজনৈতিক জীবনে যে মানুষটির কর্মের বিশালতা সূর্যের সঙ্গে তুলনীয় সঙ্গত কারণেই তার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানার ঔৎসুক্য স্বাভাবিক। অথচ অদ্ভুত ভাবে তিনি তার পারিবারিক জীবনকে রেখেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। বগুড়ার বীরনগরের প্রভাবশালী জমিদারের কন্যা আলেমা ভাসানী ‘বাবুর মা’ হয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন ৫৪ বছরের পারিবারিক জীবন। নিজ হাতেই তাকে সারতে হয় সংসারের কাজ। এখানে তিনি জমিদার তনয়া নন, অন্য আর দশটি বাঙালী পরিবারের মতই গৃহবধূ। এই মহিলা কখনও তার ব্যক্তিজীবনকে মওলানার রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে জড়াননি। কিন্তু কি গৃহে কি পরবাসে সবসময় মওলানা ভাসানী স্মরণে রেখেছেন পরিবারের কথা। শৈশব থেকে যেভাবে পরিবেশ আর প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে নিজের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মওলানা ভাসানী ঠিক তেমনিভাবে নিজের পুত্র কন্যাদের ছেড়ে দিয়েছেন জীবন সংগ্রামে। এতত্সত্ত্বেও প্রিয়জনের বিয়োগব্যথায় অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠত মওলানার চোখ। এমনি একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন মওলানার পোষ্যপুত্র মোহাম্মদ হোসেন। দিন তারিখ স্মরণে নেই। শুধু ঘটনা মনে আছে। মওলানার মাতৃহীনা আদরের নাতনী মারা গেছে ঢাকায়। দাফনের জন্য লাশ এসে পৌছল সন্তোষে। তারপরই অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়লেন মওলানা ভাসানী।

ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দ

একসময় হয়তো বিভিন্ন বিষয়ে মওলানা সাহেবের পছন্দ অপছন্দ ছিল। শেষ বয়সে সেসব আর ছিল না। এক সময় তিনি মাছ ধরতে, ঘোড়ায় চড়তে পছন্দ করতেন, শিকার করতে ভালবাসতেন। শিকারের নেশা তার চিরদিনের। এই কারণে স্ত্রীর নামে লাইসেন্সও করে নিয়েছিলেন একটি দোনালা বন্দুকের। নিজ হাতে শিকার করেছেন এমন ঘটনা বহুদিন আগের। কিন্তু বলে দিতে পারতেন বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে কোন মৌসুমে কোন পাখি পাওয়া যায়। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে বলতেন, সিলেটের কোন হাওড়টিতে সবচেয়ে বেশি পাখি মেলে শীতে। ঘোড়ায় তিনি অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগেও চড়েছেন। টাঙ্গাইল অঞ্চলে এখনো ঘোড়ায় চড়ে বহু মানুষ চলাচল করেন। কিন্তু একটি ব্যাপারে মওলানা সাহেব বড়ই এক রোখা। সে হল তার পোশাক। জীবনে বহুবার আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। বহু বরেণ্য নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাতে মিলিত হয়েছেন। সর্বত্র একই পোশাকে দেখা গেছে মওলানা ভাসানীকে – সেই লুঙ্গী আর পান্জাবী। কোথাও এর ব্যাতিক্রম হয় নি। ‘৫৪ সালে ইউরোপ ভ্রমণের সময় যখন লন্ডনে বসে শীতে কাতর হয়েছেন, তখনও লুঙ্গী ছেড়ে অন্য কিছু পরেননি। সস্তা দামের লুঙ্গী আর পান্জাবী পরে কাটিয়ে দিয়েছেন সমগ্র জীবন। কদাচিৎ ব্যবহৃত হয়েছে স্ত্রী৷ এ বিনয় ইচ্ছাকৃত নয়, সহজাত৷ এবং এখানেই মওলানা ভাসানীর গৌরব।

সম্পদের লোভ নয়, ঐশ্বর্যের প্রতিপত্তি নয়, শুধু জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তি জীবনে ধর্মের চেয়ে তিনি বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন রাজনীতিকে। জীবন সায়াহ্নে পৌছে এই মানুষটির মনে প্রায়ই বাজত হতাশার সুর। কথা উঠলেই দুঃখ করে বলতেন, ‘আমরা ত কিছুই দেখে যেতে পারলাম না। মানুষের যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে গেছেন মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা আজাদ, মওলানা সুবহানী আজো মানুষের সে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাদের মত বিদ্বান ও জ্ঞানী লোক যখন পারলেন না, তখন আমার পক্ষেই আর কি সম্ভব। “

রাজনৈতিক জীবনের দীক্ষাগুরু ও সহচরদের কথা মনে উঠলেই ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে উঠত তার মন। এই উপমহাদেশে তিনি রাজনৈতিক জ্ঞানের দিক দিয়ে অনন্য সাধারাণ ব্যক্তি বলে মনে করেন মওলানা আবুল কালাম আজাদকে। মওলানা আজাদের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে সবসময়ই দুই টি ঘটনা উল্লেখ করতেন তিনি। মওলানা ভাসানী বলতেন, যখন মওলানা আজাদের ১৭ বছর বয়স তখন জ্ঞান পিপাসা মেটাবার জন্য তিনি গিয়েছেন কোলকাতার ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীতে। কিন্তু ২১ বৎসর না হলে লাইব্রেরীর সদস্য পদ দেওয়া হয় না কাউকে। নিরুপায় হয়ে মওলানা আজাদ গেলেন লাইব্রেরীর সেক্রেটারীর কাছে। লাইব্রেরী সেক্রেটারী মন্তব্য লিখলেন, আজাদের বয়স ১৭ হলেও লাইব্রেরীর সমস্ত বই পড়ে বোঝার ক্ষমতা রয়েছে তার। তাই বিশেষ কেস হিসাবে তার সদস্য পদ গণ্য করা হোক।

মওলানা আজাদের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে আর একটি ঘটনা বলতে গিয়ে মওলানা ভাসানী বলতেন, “আমি নেহেরুর সঙ্গে খেতে বসেছি। নেহেরু আমাকে বলে মওলানা আপনি আমাকে পন্ডিত বললে আমার লজ্জা হয়। মওলানা আজাদের পাণ্ডিত্যের কাছে আমি কিছুই নই। “

শেষ বয়সে স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলতেন মওলানা। এক কথার মধ্যে আর এক কথার বলে চলে যেতেন অতীতে৷ মওলানা আজাদের কথা বলতে গিয়ে চলে যেতেন আরো অতীতে। মনে পড়ত ১৩২২-২৪ বঙ্গাব্দের কথা। সেসময় শুরু হয়েছে তার রাজনৈতিক জীবনের হাতে খড়ি। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদদের আহ্বানে গেলেন লাহোর৷ এখানেই পরিচয় ঘটে আল্লামা ইকবালের সঙ্গে। সেই সম্মেলনে আলোচনা হয় কিভাবে ইসলাম প্রচারের জন্য ইসলাম প্রচারকদের তৈরী হতে হবে। ইকবাল বলছিলেন মসজিদ কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে৷ এটা মওলানার পছন্দ হয়নি। পরবর্তী জীবনে তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসা দেখেছেন, দেখেছেন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা চীনের মুক্তাঙ্গন শিক্ষা ব্যবস্থা। সবকিছু থেকে সার করে এদেশের উপযোগী করে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়।

ইসলামী দর্শনে এই উপমহাদেশে অদ্বিতীয় পন্ডিত হিসেবে মওলানা আজাদ সুবহানী গণ্য করতেন মওলানা ভাসানী। মওলানা বলতেন মতিলাল নেহেরু যখন এন্ট্রান্স পাস করে পি – এল উকিল তখন আজাদ সুবহানী গ্রাজুয়েট। এরাই যখন মানুষের প্রতিষ্ঠিত অধিকার দেখে যেতে পারলেন না তখন তিনি আর দেখবেন কিভাবে? মওলানার দুঃখ ছিল মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা আসেনি, উপরন্তু মানুষ নৈতিক চরিত্রের স্বাধীনতাও হারিয়েছে। তুলনা দিতে গিয়ে মওলানা বলতেন, ‘আমি দুধে পানি মেশাব কি মেশাব না, সেটা আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা। কিন্তু আগে মানুষ দুধে পানি মেশাত না। ভয় ছিল বাচ্চা (গরুর) মরে যাবে, অকল্যাণ হবে৷ ‘ এখন সে নির্বিঘ্নে পানি মেশায়। একজন ডাক্তার পয়সা নিয়ে ওষুধের বদলে সিরিঞ্জে পানি ব্যবহার করে’। নৈতিক চরিত্রের এই অধঃপতন মওলানাকে ভাবিয়ে তুলত। কথা বলতে বলতে মওলানা তাই বলতেন, বৃটিশ আমলে যারা মন্ত্রী হয়েছেন, তারা ঘুষ খান নাই। নওয়াব আলী ২৭ বৎসর মন্ত্রী ছিলেন কিন্তু কোনদিন তার নামে কেউ ঘুষের অভিযোগ দেয়নি। আবদুল করিম গজনভী মিনিস্টার হয়েও জনগণের জন্য কিছু করেননি। কিন্তু নিজে কখনো ঘুষ খাননি। একবার শুধু নওয়াব মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে আড়াই লক্ষ টাকার একটা কেলেঙ্কারি প্রকাশ হয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তিনি পদত্যাগ করেন। ‘ দেশ ভাগ হওয়ার পর নৈতিকতার যে পরাজয় মওলানা দেখেছেন, তা তাকে ব্যথিত করেছে। তিনি শুধু ভাবতেন কিভাবে মানুষের নৈতিকতার মান ফিরিয়ে আনা যাবে। আবার এটাও বলতেন, এভাবে মানুষের নৈতিকতা ফিরিয়ে আনা যাবে না। শোষণ যতদিন থাকবে ততদিন এই অবস্থা থাকবে। আর শোষণের অবসান না হলে একদিন গরীবরা বিকারগস্ত হয়ে ধনীদের হত্যা করে ফেলবে।

ব্যক্তি জীবনে অভিনব সব ঘটনার কথা বলতে গিয়ে মওলানা স্মৃতি চারণ করতেন উল্লেখযোগ্য ঘটনার। ১৯৫৪ সালের নভেম্বরে তিনি গিয়েছেন স্টকহোমে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদান করতে। সেখানে খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বিপদে পড়লেন তিনি। চারজন বসেছেন একেক টেবিলে। আর পরিবেশন করা হচ্ছে শুয়োরের মাংস। মওলানার খেতে মন চাইল না। তিনি জানেন, ওটা হারাম। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখলেন মিশরের প্রতিনিধিরা পরম তৃপ্তি সহকারে ওটা খাচ্ছেন। কৌতুহল বশত মওলানা এগিয়ে গেলেন সেই টেবিলের দিকে। কায়রো থেকে আগত এক প্রফেসার মওলানার কথা শুনে বললেন, ‘আপনার প্রবৃত্তি না হলে খাবেন না। কিন্তু হারাম এটা কোথায় পেলেন?’ মওলানা জবাব দিলেন, ‘কোরানে আছে।’ প্রফেসার বললেন, ‘কোরানের অপব্যাখ্যা করবেন না। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি অন্য মাংসের চাইতে এটা অনেক বেশী সুুস্বাদু। সুতরাং আল্লাহ নিষেধ করতে পারে না। আর তাছাড়া ডাক্তারী মতেও এটা খুব ভাল’। এই মন্তব্য শুনে নিরাশ হয়ে গেলেন মওলানা। কিন্তু সেই মাংস আর তার খাওয়া হল না।

এবার আর এক অভিজ্ঞতার পালা। ডঃ শহীদুল্লাহ্ কে নিয়ে মওলানা ভাসানী গেছেন এক সভায়। সেখানে কমিউনিজম এবং ইসলাম সম্পর্কে বক্তৃতা করতে গিয়ে ডঃ শহীদুল্লাহ্ মন্তব্য করেন, কমিউনিস্ট আর শুয়োর এক জিনিস। শুয়োর যেমন বিভিন্ন ফসল খেয়ে ফেলে তেমনি সমস্ত দর্শন কথা অস্বীকার করে কমিউনিস্টরা ধ্বংসের কাজে ব্যস্ত হন। বক্তৃতা শেষ হবার পর মওলানা ডঃ শহীদুল্লাহ্ কে বললেন, ‘আপনি এত বড় বিদ্বান মানুষ হয়ে এ জাতীয় মন্তব্য করলেন কি করে?’ শহীদুল্লাহ্ পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন, ‘মওলানা আপনি জানেন না, আসলে এটা সত্য। ‘ সেদিন মওলানা আর কথা বাড়াননি। কিন্তু কথা উঠলেই বলতেন, ‘অথচ এ লোকটার সব গুলো ছেলেই তার মৃত্যুর আগে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন হয়ে পড়ে।

ভক্ত আর মুরীদদের কাছে মওলানা ভাসানী শ্রদ্ধার আসনে আসীন। দূর দূরান্ত থেকে প্রতিদিন বহু মুরীদ আসতেন হুজুরের দরবারে। হুজুরের একটু অনুগ্রহ লাভের আশায়। কারো হাতে একটা লাউ কিংবা এক জোড়া মোরগ অথবা একটা কাঁঠাল। সবই হুজুরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। যিনি খালি হাতে আসছেন তিনি কদমবুসি করেন কিংবা হাত মিলিয়ে হুজুরের হাতে গুজে দিতেন কয়েকটি টাকা। সন্তোষের কাছাকাছি যারা থাকে ওরা প্রায় প্রতিরাতেই আসে হুজুরের দরবার হলে। সেখানে, সারাদিনের কর্মক্লান্তির পর হুজুরের নামে জিকির হয়, মুর্শিদী গানের আসর বসে। হুজুরের হিসেব অনুযায়ী এমনি এক লক্ষ মুরীদ তার ছড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের সর্বত্র। ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতে এদের দেখা মেলে সন্তোষে। ভক্ত মুরীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী সম্ভবত আসামে। হুজুর বলতেন, ওরা এখনও আসে – বর্ডার ডিঙিয়ে আসে৷ ‘

শেষ কথা

মওলানা ভাসানীর জীবন কাহিনী এখন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। এই মহানায়কের জীবনাবসানের মধ্যে আজ নতুনভাবে অনুভূত হচ্ছে অতীত অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা। তোরাব গঞ্জের তোরাব ফকিরও সব কথা স্মরণ করতে পারেন না। মওলানার সঙ্গে যার পরিচয় হয়েছিল ১৩২৪ সনে। সেই থেকে তোরাব ফকির মওলানার নিত্য সহচর। যমুনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে বহুবার মওলানার সঙ্গে ঘুরে বেরিয়েছেন তোরাব ফকির। বয়সের ভারে তোরাব ফকিরের স্মৃতিও ম্লান হয়ে এসেছে। ফিকে হয়ে এসেছে জীবনের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। তোরাব ফকিরের মতো মওলানার আর এক সহচর কইস্যা দেওয়ানও আজ বেঁচে নেই। ‘৭১ সনে শহিদী মৃত্যুবরণ করেছেন ধলেশ্বরী চরের সম্রাট কইস্যা দেওয়ান। তাই সল্প সময়ে সম্ভব নয় উদ্ধার করা মওলানার বর্ণাঢ্য ৯৬ বছরের জীবন।

যে আসামে মওলানার রাজনৈতিক জীবনের হাতে খড়ি, যে আসামের মানুষ তাকে যুগিয়েছে সংগ্রামের প্রেরণা সেই আসামে এখন সীমান্তের ওপারে অপর এক দেশ। ইচ্ছে থাকলেও মওলানা সাহেব যেতে পারেননি। শুধু কথা উঠলে মনে করতেন সুরমা ভ্যালী আর আসাম ভ্যালীর কথা। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন তিনি এই আসামে। গিয়েছিলেন এক পীরের মুরীদ হিসেবে৷ ফিরে এসেছেন লক্ষ মানুষের রাজনৈতিক গুরু হিসেবে। দীর্ঘদিন পর একবার ‘৭১ সালে তার সুযোগ হয়েছিল পুরনো সহকর্মী মুরীদ ও ভক্ত দের সঙ্গে দেখা করবার। কাছালং, ডিব্রুগড়, শিবসাগর, ধুবরী, কাছাড় এসব এলাকার মানুষ আজও ভুলতে পারে না ভাসান চরের মওলানাকে। যে মানুষটি জনসভায় জনসমাগমের জাদু দেখিয়ে উপাধি পেয়েছিলেন ভাসানীর মওলানা। তোরাব ফকির বলেন, ‘লোক জড় করে অন্য সবকিছুকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন মওলানা সাহেব। তাই আবদুল হামিদ খাঁ নামের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে গেল ভাসানী শব্দটি। চরের নাম হয়ে গেল ভাসানীর চর। ‘৭১ সালে মওলানা গিয়েছিলেন সে চরে। নদীর স্রোতে এ চরের অনেকখানিই বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো টিকে আছে তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল।

কৈশোরে (১৬ বছর বয়সে) যে মানুষটির রাজনৈতিক জীবনের শুরু, ৯৬ বছরে নয়, বহুপূর্বেই তার পূর্ণতা ছিল আকাঙ্খিত। কিন্তু মওলানার রাজনৈতিক সংগ্রাম আজও অসমাপ্ত। এর কারণ বোধকরি রাজনৈতিক জীবনে তার একাকীত্ব এবং বিতর্কিত ভূমিকা। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক জীবনে মওলানা ভাসানী পেয়েছেন বহু সহকর্মী ও ভক্তদের। এদের কেউই শেষ পর্যন্ত মওলানার সঙ্গে থাকেননি। বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পথ। মওলানার রাজনৈতিক জীবনেও কম চড়াই উৎরাই নেই। কংগ্রেস থেকে মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগ থেকে আজাদ পাকিস্তান পার্টি। তারপর আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি। সবশেষে হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি। এই দীর্ঘ পথযাত্রায় কেউই শেষ পর্যন্ত মওলানার সঙ্গে থাকেননি। এমনকি গাফফার চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘দেখি তিনি মানুষের সকলের এমনকি, আমাদেরও আশা/নক্ষত্র সংঘের মত মানুষের জামাতে জামাত। দেখি তিনি রাখী হাতে/আমাদের মিলিত সংগ্রাম/মওলানা ভাসানীর নাম’। জাতীয় প্রয়োজনে, সংকট উত্তরণে আমাদের মিলিত সংগ্রামের নাম মওলানা ভাসানী। অন্য সময় তিনি থাকেন উপেক্ষিত।

মওলানা কর্মময় জীবনের পূর্নাঙ্গ ইতিহাস যেদিন রচিত হবে, যেদিন অনেক অপ্রকাশিত কথা প্রকাশিত হবে, শুধু সেদিনই সম্ভব তার যথার্থ মূল্যায়ন। নিস্তরঙ্গ জীবন প্রবাহে একটি মানুষ কেমন করে কোটি কোটি মানুষের জীবনে আশার আলো দেখিয়েছেন, মুক্তির বাণী শুনিয়েছেন, তার মূল্যায়ন এখন সম্ভব নয়। মওলানা শুধু জানতেন, তার সফেদ পান্জাবী দিয়ে গোটা দেশ ঢেকে দিতে। আর এ কারণেই লক্ষ কোটি হৃদয় যুগ যুগ ধরে উজ্জল নক্ষত্রের মতো খচিত হয়ে থাকবে মজলুম জননেতা সর্বহারার নয়নমণি মওলানা ভাসানীর নাম।

[মওলানা ভাসানীর প্রতি আমার প্রথম অনুরাগের জন্ম ১৯৬২ সালে। সে আমলে নিষিদ্ধ বই – ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ পড়ে। তারপর সে অনুরাগ পরিণত হয়েছে শ্রদ্ধায় এবং বিশ্বাসে। আজ আর বোঝাতে পারব না সেই প্রথম দিনের কথা। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ পনেরো বছরে আমি মওলানাকে দেখেছি অনুরাগী, রাজনৈতিক সমর্থক কর্মী এবং সাংবাদিক হিসেবে। দেখেছি কাছ থেকে, অনুভব করেছি তার উপস্থিতি দূর থেকে। সেই দেখা ও জানার ভিত্তিতে তৈরী হয়েছে এই জীবন কাহিনী। আমার এ লেখার ভিত্তি, মওলানা সাহেবের মুখ থেকে শোনা তার জীবন সংগ্রামের কাহিনী। এছাড়াও তথ্য সরবরাহ করে কৃতজ্ঞ করেছেন মওলানা সাহেবের পোষ্যপুত্র মোহাম্মদ হোসেন, ‘হক কথা’ সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ ইরফানুল বারী, সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট কামরুন্নাহার লাইলী, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের শফিকুল ইসলাম, বিচিত্রার চিন্ময় মুৎসুদ্দি এবং জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল হোসেন খান। ভবিষ্যতে সম্ভব হলে পরিপূর্ণ ভাবে তৈরী হবে জীবন কাহিনী – সংগ্রামের শতবর্ষের ইতিহাস। ]

***

সন্তোষের মওলানা
– রাশেদ খান মেনন

“এই প্রথম সন্তোষ থেকে না খেয়ে ফিরছি। ” – লোহানী ভাইয়ের কথায় সবাই চমকে ফিরে তাকালাম। কিছুক্ষণ আগেই সন্তোষের হুজুরখানায় কুড়েঘরের পাশে বাংলাদেশের মুকুটহীন সম্রাটকে নামিয়ে এসেছি। মুঠো মুঠো মাটি ছড়িয়ে দিয়েছি সবাই তার কবরের উপর। ‘ এতক্ষণ কারোরই খেয়াল ছিল না। ঠিক সেই সন্তোষ। লাখো মানুষের ভীড়। গ্রামের কৃষক কামার -কুমার – ছুতোর – মাঝি সবাই আছে। ঢাকা – টাঙ্গাইল থেকে গাড়ীতে এসেছে শহরের লোক। সবাই তাদের হুজুরকে দেখতে যাচ্ছেন। কিন্তু কি আশ্চর্য ব্যতিক্রম। হৈ চৈ নেই – সব নিরব নিশ্চুপ। মুহুর্মুহু স্লোগানের বজ্র নিনাদ শোনা যাচ্ছে না। মাইকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু তাতে সেই ডাক নেই – ‘ভাইও…. ‘। আর কেউ জিজ্ঞেস করছে না, ‘খেয়েছ? এই দ্যাখ ঘরে কিছু নেই। ন্যাও, এই কলাটা ধর। মহম্মদ, চাল চড়ায়ে দে”

অসীম ক্লান্তিতে সবাই ভেঙে পড়লাম। না, কোন খাটুনীর ক্লান্তি নয়৷ সব হারাবার বেদনায় যখন মানুষের মনটা হু হু করে ওঠে সেই ক্লান্তি। কে এখন বলবেঃ মুজিব, নক্সাল কারো গায়ে লেখা থাকে না। গুলী করার হুকুম দিছ? সাবধান হয়া যাও।” কে বলবে, “ইসলাম নিয়া ব্যবসা কোর না। এ দেশ হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রিষ্টানের দেশ। সাম্প্রদায়িকতা চলবে না, চলবে না, চলবে না। “
আর আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই বা কে বলবে, “ইন্দিরা হুঁশিয়ার, বাংলাদেশ কারো পদানত থাকতে রাজী নয়। তোমার চক্রান্ত বন্ধ কর। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম থাকবেই, ইনশাল্লাহ। “

সন্তোষ এ দেশের ইতিহাস। সন্তোষের জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে শুরু করে কাগমারী সম্মেলন। এ দেশের ইতিহাসের নতুন মোড় পরিবর্তন। বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী উঁচুতে তুলে ধরলেন পূর্ব বাংলার পতাকা। এরপর থেকে শুরু হল সন্তোষ মওলানার বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচারের বন্যা। লুঙ্গী সর্বস্ব মওলানা সন্তোষের জমিদারী বেদখল করে কায়েমী স্বত্ত্ব নিয়েছেন। ইত্তেফাকে পড়েছি কি বৈভবে মওলানা ভাসানী সন্তোষের জমিদার বাড়িতে দিন যাপন করেন। রাজনীতির জ্ঞান তখনো হয়নি – বিশ্বাসও করেছি।

বাষট্টির কথা। আইয়ুবী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে। তার কিছু দিন পরেই মওলানা ভাসানী হাসপাতালে। যে কেবিনে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন সেই কেবিনেই বন্দী অবস্থায় চিকিৎসার জন্য এসেছেন। আমরা ক জনা চুপি চুপি সবার চোখ এড়িয়ে কেবিনের ওপাশের উন্মুক্ত ছাদের দিকের জানালা দিয়ে মওলানা সাহেবকে দেখতে গেলাম। নামাজ পড়ছেন। অনুচ্চ কন্ঠে আমাদের সাথী আজিজ ভাই ডাকলেন – ‘হুজুর’! তখনও জানতাম না সন্তোষের মওলানার সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করতে হবে। মিথ্যা প্রচারের ‘জমিদারী বালাখানা’ সন্তোষের ভাঙা ঘরে তার সাথে একই বিছানায় রাত কাটাতে হবে। ঘরের দাওয়ায় বসে দেখব কিভাবে আলাপ করছেন দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসা কৃষক গ্রামের মানুষের সাথে। আবার সেই লোকই অনর্গল ভাবে আলাপ করে চলেছেন বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে।

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান তখন শেষ হয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে এসে আন্দোলনের স্রোতধারায় ভেসে পড়লেও, যখন ভাঁটায় টান এলো, তখন ঠাঁই পাচ্ছিলাম না। শেখ মুজিব গোল টেবিল বৈঠকে আপোষে রাজী হয়েছিলেন, এসে তারা প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদী আচ্ছাদনে আড়াল করছে আপোষকে। অন্য দিকে বাম আন্দোলনের নেতৃত্বে সমস্ত গণ আন্দোলনের নেতৃত্বে সমস্ত গণ অভ্যুত্থানকেই আখ্যায়িত করেছে পেটি – বুর্জুয়া সংস্কারবাদী আন্দোলন হিসাবে। জনগণের বিরাট অভ্যুত্থানের মর্ম বস্তুকে তারা মানতে রাজী নয়। দলে, উপদলে বিভক্ত হয়ে তারা এক একটি তত্ত্ব হাজির করেছেন। পশ্চিম বাংলার নক্সালবাড়ীর আন্দোলনের মর্মবস্তুকে উপলব্ধি না করে তার অনুকরণে “বিপ্লবী মোড়কে” মোড়া নতুন নতুন কথা বলেছেন। আমাদের মধ্যে, আমার মধ্যেও একই বিভ্রান্তি। আমরা সবাই তখন পথ খুঁজছি। কাজী জাফর টঙ্গীর ঘেরাও আন্দোলনের নতুন সৃষ্টিকে সংহত করার চেষ্টা করছে৷ রক্ষা করার চেষ্টা করছে এই বিভ্রান্তির আড়াল থেকে। সংশোধনবাদী বিভেদের চক্রান্ত থেকে উদ্ধার করে বহু পরিশ্রমের বিনিময়ে গড়ে তোলা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন তে ভাগার প্রক্রিয়া চলছে। পরপরই বিলোপ অভিযানের প্রক্রিয়াও। এরই সুযোগ গ্রহন করে একদিকে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ার ক্ল্যাশ শুরু হয়ে গেছে। বিভ্রান্ত জনগণের পথ, বিভ্রান্ত আমরাও, আমিও।

হঠাৎ সন্তোষ থেকে ডাক এলো। মওলানা সাহেব বললেন, “মেনন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন সর্ব বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছিল। ভাগ বিভক্তিতে আজ তোমরা নিঃশেষ। বিপ্লব করবে? তোমাকে গ্রামের ছেলেরা চেনে। এত বড় সুযোগ হারাইও না। আমি বলি, তুমি কৃষক সমিতি কর। ” কৃষক আন্দোলনে অনাগ্রহ ছিল না। বরং আগ্রহের আতিশয্যই ছিল। ইতিমধ্যেই বন্ধুবর মান্নান ভুঞা শিবপুরে কৃষক আন্দোলনের কাজ শুরু করেছে। ২৯ শে ডিসেম্বর মওলানার আহ্বানে শহীদ আসাদের নেতৃত্বে হাতিবদিয়ায় হাট হরতাল হয়ে গেছে। কিন্তু ভাগ উপভাগে বিভক্ত, কর্মসূচী হীন কৃষক সমিতি কিভাবে করব? মওলানাই পথ নির্দেশ দিলেন। সঠিকভাবে বলতে গেলে ছাত্র আন্দোলনের সে সময়কার ঘুর্ণিপাক থেকে হাতে ধরে তুলে নিয়ে এলেন কৃষকের পাশে – এ দেশের শতকরা নব্বই জন মানুষের পাশে। এর আগেই তিনি পাকশীতে লালটুপি কৃষক সম্মেলনের আহ্বান করেছিলেন। বামপন্থী একাংশ বললেন, “মওলানা মেলা বসিয়েছেন”।

অন্য অংশ বেশ জোরে সোরে কাজে নেমে পড়েছেন। আমরা কেন তরফেই পড়ি না। মওলানা ভাসানী আমাকে বললেন, ” তুমি পাকসী সম্মেলনের ‘চীফ অবজারভার’। আমি চীফ অবজার্ভারের আগা মাথা বুঝলাম না। কোন অর্থও খুঁজে পেলাম না – কেউই পেল না। কিন্তু মওলানা ভাসানী তার স্বভাবসিদ্ধ রীতিতে এই নামাস্ক চাপিয়ে দিয়েই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মফস্বল শহর – গ্রামাঞ্চলে অসংখ্য কৃষক সম্মেলনের লাল টুপির জমায়েতে। এর আগে গ্রামের কৃষককে চিনেছি ছাত্র আন্দোলনের পরিধি থেকে। কিছুটা উপর থেকে তাদের দেখেছি। মওলানা এবার আমাকে মিলিয়ে দিলেন তাদের মাঝে। যেখানে বাংলাদেশের প্রাণস্পন্দন ধ্বনিত হয়, যাদের ঘামে রক্তে ফলে সোনালী ফসল।

পাকসী সম্মেলনের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। লাখো মানুষের মাথায় লালটুপি নিয়ে বজ্রনির্ঘোষে সংগ্রামের শপথ নিল। তখনও ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের ৫৪ ধারায় প্রকাশ্য জায়গায় সভা মিছিল নিষিদ্ধ। সুতরাং পাটখড়ির বেড়া দিয়ে ঘেরাও তৈরী হোল। তৎকালীন সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্সের উর্ধতন কর্মকর্তা (বর্তমান এন – এস – আই প্রধান) সফদর সাহেব মওলানা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলে মওলানা তাকে ছোট ঘরে বসে প্রাঞ্জল ভাষায় অনেক কথা বুঝিয়ে দিলেন। আমাদেরও পরিচয় করিয়ে দিলেন তার সাথে।

মওলানার যুক্তির সামনে কোন আইনই টিকল না। সম্মেলন শেষে তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল সারা বাংলাদেশে।

এমন সময় মওলানা আবার আহ্বান করলেন সন্তোষে কৃষক সম্মেলন। আমাকে নিযুক্ত করলেন প্রধান সংগঠক। হাতে মাত্র সময় দেড় মাস। ভাগে ভাগে বিভক্ত বামপন্থী আন্দোলনের কেউ এগিয়ে আসতে রাজী নন সম্মেলন সফল করতে। চোখে শর্ষে ফুল দেখতে লাগলাম। কিন্তু মওলানা নির্বিকার, আমাকেও অভয় দিচ্ছেন, কাছে কাছে রাখছেন। যখন যা প্রয়োজন করার, তার নির্দেশনা দিচ্ছেন।

এ সময়ই সন্তোষের ইতিহাসে আর এক নতুন মোড় পরিবর্তন। বর্তমান সন্তোষের ভিত্তি তখনই স্থাপিত হল। তখন মওলানা ভাসানীকে অতি কাছে পেয়েছি। এ বিছানায় শুয়ে সংকোচে ঘুম আসেনি। তিনি নিঃসংকোচে বহু রাত অব্দি গল্প করেছেন, তার অতীত জীবনের অভিজ্ঞতার কথা, ভবিষ্যৎ সংগ্রামের প্রস্তুতির কথা। দেখেছি সেই রাজনীতিক কর্মধারার অপূর্ব কৌশল।

কৃষক দাওয়ায় এসে গোল হয়ে বসেছে। প্রথম আলাপ শুরু করেছেন আগামী বার কি ফসল করতে হবে। পেঁয়াজ বুনলে লাভ হবে না অন্য কিছু। তারপর কাউকে কাউকে পানি পড়া দিয়েছেন। আনারস পাতা বা তেল পড়ে দিয়েছেন। আবার তৎক্ষনাৎই কোমড়ের গোঁজ থেকে দুমড়ে যাওয়া কয়টা টাকা বের করে দিয়ে বলেছেন – ডাক্তার দেখাস। তারপর ধর্মের ব্যাখ্যা, চিকিৎসার কার্যকারিতার কথা বর্ণনা করতে করতে চলে গিয়েছেন রাজনীতিতে – কেবল দেশের নয়, বিশ্বের। সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা তার সহজ সরল ভঙ্গীতে কৃষকদের বুঝিয়েছেন। চীনের কমিউন উৎপাদন ব্যবস্থা কেমন, কত অংশ রাষ্ট্রের জন্য রাখা হয়, কত অংশ অক্ষম, বৃদ্ধ অনাথদের জন্য, কত অংশ ভবিষ্যতের জন্য এবং বাকী কিভাবে বন্টন হয় – সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন তাদের। তারপর তাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা। বলেছেনঃ সংগঠিত হও। কৃষক যদি সংগঠিত হয় তবে কে তাকে ঠেকাতে পারে। পার্লামেন্টে কৃষকের আসন চাই। তার জন্য তৈরী হও। এরপর নির্বাচনে কৃষক সমিতিই মনোনয়ন দেবে।

তার বলার ভঙ্গী নিজস্ব। বিজ্ঞান মাফিক বা তত্ত্ব মাফিক নয়। কিন্তু এটা কি পার্লামেন্টে শ্রেণী সমূহের প্রতিনিধিত্বের দাবী নয়? কৃষি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা নয়?

সন্তোষে এ সময় অনেক বিদেশী কুটনৈতিক আসতেন। আমাকে মাঝে মাঝেই দোভাষীর কাজ করতে হোত। তার কথার তোড়ে ইংরেজি অনুবাদ করতে খুব মুশকিল হোত। কোথাও ভুল হলে নিজেই ইংরেজীতে সংশোধন করে দিতেন। কোন সময় চোস্ত উর্দু বা আরবীতেও কথা বলতেন। আবার গ্রামের মানুষ যেই আসত অমনি তাদের সাথে অনর্গল তাদের ভাষাতেই কথা বলতেন।

সন্তোষের কৃষক সমিতির অফিসের সামনে তিনি একটা ছোট সাইন বোর্ড টানিয়ে রেখেছিলেন। তাতে লেখা ছিলঃ হুকুমতে রব্বানিয়া – আল্লার রাজত্ব কায়েম কর। মৌল মৌলবীরা কেউ এলে তাদেরকে কোরানের আয়াত বা মুসলিম মনিষীদের জীবনী উদ্ধৃতি দিয়ে সমাজতন্ত্র ব্যাখ্যা করে বোঝাতেন। বলতেন আমার সমাজ তন্ত্র – ইসলামী সমাজতন্ত্র।

মওলানার এই উক্তিতে অসম্ভব বিরক্ত হতাম। বিভ্রান্ত বোধ করতাম। একদিন না পেরে জিজ্ঞাসা করলামঃ হুজুর, আপনার এই ইসলামী সমাজতন্ত্র কি জিনিস?
তিনি বললেনঃ শোন, একটা গল্প শোন। একবার উত্তর ভারত দিয়ে ট্রেনে করে আসছি। এক স্টেশনে শুনি পানি পেড়ে পানি হাঁকছে – হিন্দু পানি – মুসলমান পানি। কৌতুহল নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দেখলাম একই কুয়া থেকেই হিন্দু পানি, মুসলমান পানি তোলা হচ্ছে! ” এর কোন জবাব দিতে পারিনি।

একই সময়, আরেকটা প্রশ্ন করেছিলাম, “হুজুর, আপনি যে পানি পড়া দেন, এতে মানুষের রোগ ভাল হয়?”
বললেন, “শোন, মানুষের বিশ্বাসে আঘাত দিও না। ওরা বিশ্বাস করে আসে – তাতেই অনেক উপকার হয়। আর গাছ – গাছড়ায় দ্রব্যগুণ আছে। আর দেখ ত আমি ওদের ডাক্তারের কাছে যেতে বলি।”

সন্তোষে মওলানা ভাসানীকে দেখেছি কিভাবে ফসলের কথা, ধর্মের কথা বলতে বলতে গ্রামের কৃষককে রাজনীতিতে, সংগ্রামের আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার কৌশল যে কতখানি গ্রহনীয় তা নিয়ে বিতর্ক আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু অনুকরণীয়।

এরপর সম্মেলনের কথা। ১১ ই জানুয়ারী সম্মেলস হবে। সম্মেলনের স্থানের নাম ‘শহীদ আসাদ নগর’ (সন্তোষ)। বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা উঠছে। মওলানা সাহেবের কাছে জমা দিচ্ছি। অনেকেই সরাসরি তার কাছে এসেই জমা দিচ্ছেন। লাখো লোকের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পায়খানা প্রস্রাব পানির ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু এ কি মওলানা সাহেব যা আসছে তা দিয়ে কেবল বড় বড় গাছ আনাচ্ছেন। মোসলেম ভাইয়ের (মওলানার মুরীদ ও ম্যানেজার) তদারকিতে বিরাট ঘর উঠছে। ভাবলাম এটাই সম্ভবতঃ মূল মন্ডপ হবে।

কিন্তু শেষ হবে কবে? চিন্তায় অস্থির। কারণ একটু ত্রুটি হলে সহকর্মীদের অনেকেই মাথায় লাঠি মারবে (প্রায় মারতেই বসেছিল)। হলুদ কোথায়, মরিচ কোথায়, চাল কোথায়? মওলানা সাহেব নির্বিকার।
মাঝে মাঝে হুকুম দিচ্ছেন, এটা জোগাড় কর। ওখানের সভাতে যাও। যা জোগাড় করতে বলেছেন তার পরিমাণ এত বেশী যে জোগাড় করাই অসম্ভব। আমার দুর্দশা দেখে অভিজ্ঞ একজন পরামর্শ দিলেনঃ মওলানা যা বলবেন, তার এক চতুর্থাংশ যদি জোগাড় করতে পারেন, তাই যথেষ্ট। অন্যকেও তিনি একই কথা বলেছেন। সুতরাং নিশ্চিত থাক।

নিশ্চিত না হলেও কিছু করার ছিল না। কিন্তু কি আশ্চর্য! সম্মেলনের পূর্ব রাতেই হাজার হাজার মানুষ এসে পড়ছে। এর মধ্যেই দেখলাম নৌকায় নৌকায় খিচুড়ি পাক হয়ে যাচ্ছে। মওলানা সাহেব নিজে তদারকি করছেন, সঙ্গে আমি। কোথাও অভাব নেই। বিশৃঙ্খলা যা হবার আমাদের নিজেদের ধৈর্য্য হীনতার জন্য হয়েছে। কেউ না খেয়ে ফেরেনি। বরঞ্চ সমস্ত সম্মেলনে, মওলানার বক্তৃতা নতুন প্রাণ সঞ্চার করল এ দেশের কৃষক সংগ্রামীদের মনে। নতুন শপথ নিলেন সবাই।

একে একে ফিরলেন সবাই। পরদিন বিশে জানুয়ারী শহীদ আসাদ দিবসে পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে হরতাল আহ্বান করা হয়েছে। আমাকে রেখে সহকর্মীরা ঢাকায় ফিরে গেছেন। শেষরাতে ঘুমিয়েছি। ভোরে মওলানার স্নেহ স্পর্শ, ঘুম থেকে উঠতে বললেন। ঘরে ডাকলেন। হাত মুখ ধুয়ে মওলানার ঘরে দেখি কানিজ ফাতেমা, সি, আর, আসলাম, মেজর ইসহাক ও অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা গোল হয়ে মওলানাকে ঘিরে বসেছেন। মওলানার সামনে এক গামলা গরুর গোস্ত। সবার হাতে পরাটা। আমার হাতেও পরাটা দিলেন। সন্তোষের মওলানার কাছ থেকে পরম তৃপ্তি ভরে সবাই আমরা খাবার তুলে নিলাম। ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।

কিন্তু এ দিনের ক্লান্তি দূর হবার নয়। সন্তোষের কেউ আর আমাদের ডাকবে না। আদর করে গায়ে হাত দিয়ে বলবেন না, “খাইছ? হাবুর মা ওদের মিষ্টিগুলো দাও!”

আশা করেছিলাম মওলানা আবার সন্তোষে ডাকবেন। জাতীয় প্রতিরোধের ডাক তিনি দিয়েছেন। রুশ – ভারতের আগ্রাসনের হাত থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাতে হবে। ১৪ ই নভেম্বর মেডিক্যাল হাসপাতালে কাজী জাফরকে সে কথাই বলেছিলেন।

মওলানা ভাসানী সে ডাক দিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু বলে গেছেন ঐক্যবদ্ধ জাতীয় প্রতিবাদ গড়ে তুলতে। সেই কথা আমরা রাখব – এটাই হোক সবার প্রতিজ্ঞা।

***

আর এক সন্তোষ
– জহিরুল হক

১৯৭০ সালের ১৯ শে জানুয়ারী। সূর্য সবে উঠেছে। বাংলার দিগন্ত ছাপিয়ে গাঢ কুয়াশায় আচ্ছন্ন, ধুম্রতা ভেদ করে লাল আলো সবে ঝরে পড়তে শুরু করেছে। গাছের মাথায়, ঘাসের ডগায় শিশির কণায় রূপোলী চিক ধরেছে। নতুন সূর্যের লাল আলোয় পিঠ দিয়ে এখানে ওখানে বসে আছে খন্ড খন্ড জনতা। অতি সাধারণ, নিরাভরণ। পরণে লুঙ্গী, ময়লা, আধ ময়লা জামা গায়ে। কনকনে হাওয়া থেকে বাঁচার জন্য কেউ কেউ বসে আছেন নাক মুখ চাদরে ঢেকে। কেউ বা বসে আছেন হাতের লাঠি শক্ত করে ধরে। কারো পাশে রাখা লাঙ্গল৷ কারো কাঁথা কাপড়ের পুঁটুলির সাথে বাঁধা কাস্তে। এদের বয়স, স্বাস্থ্য, চেহারার ভিন্নতা আছে। পার্থক্য আছে জামা কাপড়ের রং এ। কিন্তু একটি আভরণ সব ভিন্নতা দূর করে অভিন্ন করেছে সবাইকে – সকলের মাথায় রয়েছে লালটুপি।

সূর্য আরো উপরে উঠছে। লালটুপি আরো আসছে। পাঁচজন দশ জনের এক একটি দল, শতেক – দেড়শ জনের এক একটি লাইন, হাজার দেড় হাজারের এক একটি মিছিল। কারো গতি জঙ্গী। কেউ বা পথ শ্রান্তিতে ক্লান্ত। কেউ আসছেন বাসে ট্রাকে। কিছু দূরে নেমে তারাও আসছেন বাকী পথটুকু হেঁটে। যারা আগে এসেছেন, তারা হাতের লাঠি উঁচিয়ে স্লোগান দিয়ে অভিনন্দিত করছেন নতুনদের আগমন।

শীতের জড়তা লাঘবের জন্য সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে এতক্ষণ যারা উত্তাপ সংগ্রহ করছিলেন তারাও উঠে পড়লেন। কে হুকুম দিয়েছে জানি না। এক সময় দেখা গেল হাজার হাজার লাল টুপি চত্বর পদক্ষিণ করতে শুরু করেছে। সবাই ঘুরছেন কাতার বন্দী হয়ে। হাতের লাঠি অন্ধকারে ট্রেসার বুলেটের মত আকাশে উৎক্ষিপ্ত, কন্ঠ থেকে বারুদের ফুলকির মত ঝরে পড়ছে স্লোগান। লালটুপির আগমণ তখনো অব্যাহত। যারা আসছেন তারাও শরীক হচ্ছেন প্রদক্ষিণরত কাতার বন্দী মিছিলের পেছনে। মোহনায় ঘুর্ণীপাকের সৃষ্টি করে লাল টুপির এক ফেনায়িত উত্তাল সাগরের রূপ নিল।

সন্তোষে আমার সেই প্রথম আসা। ১৯৭০ সালের ২৯ শে জানুয়ারী। ভোর পাঁচটার মধ্যেই এসে পৌছেছিলাম। টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করেই দেখলাম একটার পর একটা তোরণ। জাতি ধর্ম দেশ কাল নির্বিশেষে এক একজন বিখ্যাত ব্যক্তির নামে তৈরী করা হয়েছে সে সব তোরণ, টাঙ্গাইল থেকে সন্তোষ পর্যন্ত। শীত – সকালের কুয়াশা উপেক্ষা করে সেই তোরণের নীচে দিয়ে শুরু হয়েছে অসংখ্য মিছিলের যাত্রা। মওলানা ভাসানী কৃষক সম্মেলন ডেকেছেন সন্তোষে। প্রভাতের রাঙা আলোর সাথী হয়ে লালটুপির মিছিল যাচ্ছে সেখানে।

মওলানা ভাসানী চাদোয়া খাটানো একটা মাটির ঢিবির ওপর দাড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন সমবেত লাখ লাখ কৃষকের উদ্দেশ্যে। তার ভাষণের জ্বালাময়ী ভাষা বারবার রোষে উত্তপ্ত করে তুলছিল কৃষকদের। অধিকার হরণকারী শাসক – শোষকদের বিরুদ্ধে স্লোগানের ঝড় তুলে তারা প্রকাশ করেছিল তাদের অন্তরের সেই উত্তাপ।

দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক একটি অধ্যায় সৃষ্টির স্নায়ুকেন্দ্র – টাঙ্গাইল শহর থেকে অনেক দূরে সন্তোষের নিভৃতপল্লীতে। এর পর গিয়েছি আরও বহুবার। আবার গেলাম অতি সম্প্রতি। গত ১৮ ই নভেম্বর, বৃহস্পতিবার দুপুরে।

খন্ড খন্ড জনতা এখানে সেখানে। পাঁচজন দশজনের এক একটা দল আসছেন। শতেক – দেড়শ জনের এক একটি লাইন আসছে ক্ষেতের আল ধরে। হাজার – দেড় হাজারে মিছিল আসছে। মানুষ আসছে ট্রাকে বাসে। ১৯৭০ সালের ১৯ শে জানুয়ারী প্রথম আসার দিনটিতে যেমন দেখেছিলাম, তেমন জনস্রোত সন্তোষের পথে। কিন্তু নেই উত্তাল তরঙ্গের উদ্দামতা। সেদিন দেখেছিলাম তারা আসছেন উদয় উষার আলোর সাথে। মাথায় তাদের লাল টুপি। আজ তারা আসছেন মধ্যাহ্ন পেরিয়ে যাওয়া রোদের ধূসরতায়। মাথায় তাদের সাদা টুপি। মওলানা ভাসানী আজ সন্তোষে কোন সম্মেলনে যোগদানের ডাক দেননি। কিন্তু তবু তারা আসছেন। আসামের বন জঙ্গল সাফ করা কৃষকের অধিকার সংরক্ষণের সংগ্রাম, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর পূর্বক্ষণে, আটচল্লিশের উপ নির্বাচনে, বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের মিছিলে, চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার প্রথম প্রবক্তা হিসেবে, উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানে বেয়নেটের মুখে, সত্তরের মহা প্রলয় শবাকীর্ণ উপকূলে, দেশের আনাচে কানাচে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বারবার বিধস্ত ঘরের আঙিনায় মওলানা ভাসানীর সাথে তাদের যে পরিচয়… তারা আসছেন সে পরিচয়ের টানে। তারা আসছেন সেই যাদুকরী আকর্ষণে – যে আকর্ষণে মাত্র একটি ডাক শুনে তারা যোগ দিয়েছিলেন ফারাক্কা মহামিছিলে। রাজশাহী থেকে কানসাট সীমান্ত পর্যন্ত পথে হেঁটে গিয়েছিলেন ৫৪ মাইল পথ। মওলানা দুর্বার নেতৃত্ব আর তার প্রতি জনগণের একান্ত বিশ্বাসের নির্যাস – ফারাক্কা মহা মিছিল কাঁপিয়ে দিয়েছিল দিল্লীর শাসন। তাই আমাদের সীমান্তে মওলানা ভাসানী মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণার পর খবর বেরিয়েছিল “অমৃতবাজার পত্রিকায়” – ‘এ সেন্স অব রিলিফ’ শিরোনামে।

সেই নেতৃত্বের চির অবসান ঘটেছে। আজ হাজার হাজার মানুষ বরাবরের মতই সন্তোষ আসছে। কিন্তু এ আর এক সন্তোষ। নেই সেই আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান দৃঢ কন্ঠস্বর। নেই অতিথিপরায়ণ সেই বৃদ্ধের এত লোকের খাওয়া দাওয়ার জন্য ছুটোছুটি। নেই বক্তৃতা, স্লোগান। মূক, নিস্তরঙ্গ জনসমুদ্র। আসছে, যাচ্ছে। বিকেল চারটায় মওলানা ভাসানীর লাশ দাফন করা।

মওলানা ভাসানীর বাড়ীর ভেতরে গেলাম। উঠোন ভর্তি সারা গাঁয়ের মহিলারা। উনুনে আজ তারা আগুন দেন নি। ঢেকিতে তোলেন নি ধান। আত্মার আত্মীয় মারা গেছেন। সবাই কাঁদছেন। তাদের বিলাপ শুনে আলাদা করা যাবে না কে মওলানা ভাসানীর মা, কে মেয়ে, আর কে বা বোন। ঘরের ভেতরে গেলাম। মওলানা সাহেবের তক্তপোষটি আমার অনেক দিনের চেনা। এর কোণে বসে মওলানা সাহেবের কথা শুনেছি। নোট নিয়েছি। অনেক দিন বলেছেন, ‘জুতা খুলে উপরে উঠে বসো।’ সেই তক্তপোষটির এক কোণে মওলানা সাহেবের ব্যবহৃত বিছানা বালিশ গুটিয়ে রাখা। মাঝখানে কাঠের ফাঁকে গুঁজে ধরা একটা আগর বাতি জ্বলছে।

ঘরের মেঝেতে বসে কাঁদছেন মওলানা সাহেবের পত্নী বেগম আলিমা খাতুন। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন অন্য কয়েকজন মহিলা। ফিরে গেলাম ১৯৭০ সালের মে মাসে। তারিখটা ঠিক মনে নেই। সন্তোষে নিখিল পাকিস্তান ন্যাপ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। বাঘা বাঘা নেতারা এসেছেন উভয় পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকা থেকে। তাদের খাওয়া দাওয়ার বিভিন্ন ব্যবস্থা করতে বেগম আলিমা খাতুন সকাল থেকে প্রাণান্ত। দুপুরের দিকে বাড়ীর ভিতরে গিয়েছি। বেগম আলিমা খাতুন আমাকে ডেকে বললেন… “ভাসানীর মওলবী এত লোকের জন্য সংগ্রাম করছে, ভাত কাপড়ের ব্যবস্থার দাবী জানাচ্ছেন সরকারের কাছে, কিন্তু তার মৃত্যুর পর আমার, আমার সন্তানের কি হবে তার ব্যবস্থা কি সে করেছে, তখন কি কেউ আমার খোঁজ নিতে আসবে… এটা তাকে জিজ্ঞেস করো….”। বেগম আলিমা খাতুন কথা শেষ করতে পারলেন না, তক্ষুনি মওলানা সাহেব এসে জানতে চাইলেন, “রান্নার কতদূর?”….

এই স্মৃতিচারণের মধ্যেই মওলানা সাহেব এলেন। তার কফিন এনে নামানো হলো উঠোনে। বেগম আলিমা খাতুন চিৎকার করে লুটিয়ে পড়লেন সেই কফিনের উপর। বুকফাটা বিলাপ আর করুণ কান্নার মাঝে মহিলাদের দেখানো হল মওলানা সাহেবের মুখ।

তারপর দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে তিনি যাদের জন্য সংগ্রাম করেছেন, সেই কামার, কুমার, তাতী, মাঝি, জেলে, কৃষকদের মাঝে নিয়ে যাওয়া হলো তার কফিন। তারা হাজারে হাজারে অপেক্ষা করছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে। খেটে খাওয়া মানুষ। পরনে ছেড়া কাপড়। গায়ে ধুলো, শোকে মলিন চেহারা। তারা তাদের অন্তরের মুকুটহীন সম্রাট – পীর বাবা হুজুরের কফিন সামনে রেখে আদায় করলেন নামাজে জানাজা। তখন দুটো পয়তাল্লিশ মিনিট। এরপর কফিন এনে রাখা হলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের উত্তর দিকে হাজরাখানার সামনে কবরের পাশে। এবার হাজার হাজার মানুষকে চারটা পর্যন্ত দেখানো হবে মওলানা সাহেবের মুখ। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কাতার বন্দী হয়ে আসছে একজনের পর আরেকজন। গরীব মহিলারাও এসে দাড়িয়েছেন এসে লাইনে। সারা রাত ধরে দেখালেও বোধহয় লাইন শেষ হবে না। কারণ প্রতি মুহূর্তেই লাইন দীর্ঘতর হচ্ছে। এক মহিলা ভিড় ঠেলে বাড়াবাড়ি করে সামনে আসার চেষ্টা করছিলেন। একজন জোয়ান তাকে পিছু হঠতে বললে তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আমার হুজুর কোন দিন কাউকে ভয় করেন নি। আমিও তোমাকে ভয় করি না।’ এই বলেই তিনি কেঁদে ফেললেন। নাম জানলাম, রাবেয়া খাতুন। টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালের একজন ধাত্রী। মওলানা সাহেবের অসুস্থতার সময় একবার ২৬ দিন তার পরিচর্যা করার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, মওলানা সাহেবের মৃত্যুর খবর বেতারে শুনেই সারা রাত জেগে সকালের মধ্যেই একবার কোরান খতম করেছেন…

বিকেল চারটা বেজে গেল। কবর তৈরী হয়ে গেছে আগেই। ভক্ত মুরীদরা নিজ হাতে তৈরী করেছেন হুজুরের কবর। শুধু তৈরী করেননি, চার পাড় পাকা করে দিয়েছেন। ভক্তির পরশ বুলিয়ে হাত দিয়ে লেপে মসৃণ করে দিয়েছেন কবরের মেঝে। কয়েক মুহূর্ত বাকী। তারপরই অবিনশ্বর নাম মওলানা ভাসানীর নশ্বর দেহ নামিয়ে দেয়া হবে কবরের অন্ধকারে। নবম ডিভিশনের এক প্লাটুন সৈনিক করলেন প্রেজেন্ট আর্ম। শাণিত হলো একের পর এক – একুশটি রাইফেল। সমাপ্ত হল ‘খোলা ফায়ার’। অবনমিত হলো রেজিমেন্টের কাভার। সাড়ে সাত কোটি মানুষের বেদনাহত হৃদয়ের পুঞ্জীভূত সমস্ত শোক একত্র হয়ে ঝরে পড়লো সাইরেনে করুণ সুরে।

রূপকথার মহা নায়ক মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মরদেহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নামিয়ে দেয়া হলো চির শান্তির অন্তিম শয়ানে। আকাশ বাতাস মথিত করে উচ্চারিত হলো কালেমা শাহাদাত -” আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু…….. ওয়া রাসুলুল্লাহ! “

দাফন সমাপ্ত। একটির পর একটি ফুলের মালা নিবেদন করা হচ্ছে কবরে। অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিবেদিত যে মহা প্রাণ অগ্নিপুরুষ জীবনকে কোন দিন পুষ্পশয্যা বলে গ্রহণ করেন নি… কৃতজ্ঞ দেশবাসী অশ্রুসজল নয়নে তার কবরে রচনা করল পুষ্পের মিনার।

কবরের পাশ থেকে ফিরে আসছি। মনে পড়লো অনেক কথার মাঝে মওলানা ভাসানীর এক বিখ্যাত কথা, “দারিদ্রকে শেষ করে দাও, শোষণকে নির্মূল করে দাও, তবেই আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে” দারিদ্র শেষ হয় নি, শোষণও নির্মূল হয় নি।
মওলানা ভাসানী কি ফুরিয়ে গেলেন?

***

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সংবাদপত্রে প্রকাশিত মওলানার প্রথম সাক্ষাৎকার

‘বিদ্রোহী বাংলার কন্ঠস্বর’ আবার ফিরে এসেছেন। ফিরে এসেছেন তার চিরকালের বাংলায়। যে বাংলা তাকে দিয়েছে সংগ্রামের প্রেরণা, দীক্ষিত করেছে তাকে সংগ্রামী চেতনায়, লালন করেছে সকল সুখ দুঃখে, সেই বাংলার বুকে ফিরে এসেছেন তিনি। ফিরে এসেছেন অশীতিপর বৃদ্ধ জননেতা মওলানা ভাসানী।

স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরী উন্মুখ হয়েছিল তাকে সম্বর্ধনা জানানোর জন্য। কিন্তু তিনি সরাসরি চলে গেছেন তার গ্রামের বাড়ী সন্তোষে। ১৩৩৭ সালে সর্ব প্রথম এই সন্তোষে ঘর বেঁধেছিলেন তিনি। আজ সে সন্তোষ মাথা গুঁজবারও ঠাঁই নেই তার। তাই ‘তোমরা যেভাবে পার সাহায্য করে আমাকে তিনখানা ছনের ঘর তৈরী করে দাও। আমি দালান কোঠায় থাকতে চাই না। কৃষক মজুরের ঘরেই থাকতে চাই। ‘ – নিজের বসত বাড়ীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে দাড়িয়ে সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানালেন মওলানা।

একদিন স্বাধীন বাংলাদেশের দাবী তুলেছিলেন মওলানা। এই স্বাধীনতার জন্য দেশ ছেড়েছেন তিনি। আজ স্বাধীনতার উষালগ্নে ফিরে এসেছেন। এতদিন তাকে নিয়ে জল্পনা কল্পনার অবসান ছিল না। তিনি কি ফিরে আসবেন? তিনি কি করবেন? কোথায় যাবেন?
এই মানুষটিকে ঘিরে এ ধরণের কল্পনা আজকের নয়। আপন ভুবনে ছড়িয়ে আছেন তিনি। একাকী পথ চলাতেই তার সবচেয়ে বেশী আনন্দ।

এ সব প্রশ্নের জবাব পাবার জন্যই আমরা ছুটে গিয়েছিলাম তার সান্নিধ্যে। আজো তিনি তেমনি আছেন। কথা বলতে বলতে আমাদের মনে হয়েছে কথার মালা সাজিয়ে রেখেছেন তিনি।

মওলানা টাঙ্গাইল পৌছতেই সর্বস্তরের লোক এসেছিলেন তাকে স্বাগত জানাতে। আর সন্তোষের বাড়ীতে এসেছেন তার ভক্ত মুরীদেরা, এসেছেন তার রাজনৈতিক অনুসারীরা, ঢোল বাজিয়ে নৃত্য করতে করতে এসেছেন তোরাব ফকিরের অনুসারীরা।

অন্ধকার থেকে আলোয় বাংলাদেশের উত্তরণ হয়েছে। এই উত্তরণের পটভূমি বলতে যেয়ে মওলানা বললেন, ‘আমি শেখ মুজিবের কাছে অঙ্গীকার বদ্ধ। গত বছরের ২৩ শে মার্চ আমি তাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, স্বাধীনতা সংগ্রামে আমি ও আমার দল (ন্যাপ) এর জন্য পূর্বশর্ত আছে। তাকে (মুজিববাদ) ৬ দফা ত্যাগ করতে হবে। এর মানেই আমি জানতে চাইলাম – তাহলে আপনি কি আওয়ামী লীগের সভাপতি হচ্ছেন? একটু বিরতি নিয়ে মওলানা বললেন – ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে থেকেই আমি মুজিবকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো। পার্টি ছেড়ে অন্য পার্টিতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যতদিন আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রের আদর্শকে বাস্তবায়িত করবার জন্য সংগ্রাম করবে ততদিন পর্যন্ত আমার সমর্থন পাবে। তবে আমি মুজিবের সাথে কথা বলব। আমি তাকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছি। আমি আগামী ৩০ শে জানুয়ারী ঢাকা যাব। আমি তাকে বলব সমাজ যে সমাজতন্ত্র চায় সেই সমাজতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে। আমি বলব আওয়ামী লীগের এমন শাসনতন্ত্র তৈরী করতে যাতে কোন পরিষদ সদস্য স্বজনপ্রীতি, দূর্নীতি, ব্যক্তি স্বার্থকে প্রশ্রয় দান করলে তাকে যেন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

মওলানা বলতে থাকলেন, ‘আজকের যুগে সমাজতন্ত্র ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। আমি ভারতের যেখানেই গেছি, সেখানেই দেখেছি সমাজতন্ত্রের দাবী জোরদার হয়ে উঠছে। সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের পথ বড় কঠিন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বলে চিৎকার করলে হবে না। সম্মিলিত ভাবে দরশ গড়ার কাজে নামতে হবে। মানুষের কল্যাণ কেউ করতে পারবে না যদি তারা নিজেদের মঙ্গল নিয়ে কাজ না করে।

সমাজতন্ত্রের রূপরেখা ব্যাখ্যা করতে যেয়ে মওলানা বললেন, সমাজকেই সমাজতন্ত্র চালাতে হবে। সরকারী আমলা দিয়ে সমাজতন্ত্র হয় না৷ সত্যিকার অর্থে, সমাজতন্ত্র বাস্তবায়িত করতে হলে শ্রমিককে হতে হবে কারখানার মালিক, কৃষককে হতে হবে জমির মালিক। ‘

প্রায় এগারো মাস পর মওলানা ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। এই এগারো মাস তিনি কি করেছেন, কোথায় ছিলেন, এ নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। মওলানাকে ঘিরে বাঙালীর যে ঔৎসুক্য তা আজো আছে। সবাই জানতে চাইতো মওলানা কেমন আছেন? চীনের ভূমিকা সম্পর্কে তার মতামত কি? এ সম্পর্কে জানতে চাওয়ার আগেই মওলানা জানালেন সব। মওলানা বললেন, আমি চেয়েছিলাম চীন-ভারত সংহতি। এ জন্য ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়েছিল। আমার আশা ছিল এশিয়ায় নতুন জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপিত হবে এই দুই জনবহুল মহান দেশের সংহতির ফলে। তাহলে এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের কবর রচিত হত। দূর্ভাগ্যজনক ভাবে তা হয়নি।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলেছে সে সম্পর্কে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এখনও ষড়যন্ত্র চলছে। আমেরিকা আর রাশিয়া আজও চেষ্টা করছে যাতে পাকিস্তান – বাংলাদেশ কে নিয়ে কনফেডারেশন গঠন করা হয়। কিন্তু আমরা আর একত্রিত হবো না। আমার বিশ্বাস পাকিস্তানও আমাদের নিয়ে মাথা ঘামাবে না। ‘

মওলানা ফিরে এসেছেন। এবার তাকে তার দল পুনর্গঠন করতে হবে। বিচ্ছিন্ন সংগঠনকে গুছিয়ে তুলতে হবে। তাই প্রশ্ন করলাম – আপনি কি ভাবে ন্যাপ পুনর্গঠন করবেন? মওলানা বললেন – ‘আমি এমন কোন সংগঠনে শ্রমব্যয় করব না যে সংগঠন কাজ করবে না।’

– দুই ন্যাপ একত্রিত হবার সম্ভাবনা কতটুকু?
– দুই ন্যাপ কখনোই একত্রিত হবে না।

এ সব কথা বলে মওলানা চলে গেলেন দেশের কথায়। চিরদিন এই দেশের জন্য তাকে বাংলার পথে প্রান্তরে চারণিকের মতো ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। মওলানা বললেন, ‘জুলুম, অত্যাচার করে কেউ থাকতে পারবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। মত বিরোধের জন্য, অপরাধের জন্য গুপ্ত হত্যায় আমি বিশ্বাস করি না। কোন লোক অপরাধ করলে তাকে প্রকাশ্য আতালতে বিচার করতে হবে। ‘

সন্তোষের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাড়িয়ে মওলানা অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি বহু আশা নিয়ে। তার বিশ্বাস তার চিরদিনের স্বপ্ন এবার স্বার্থক হবে। এবার বাংলাদেশের মানুষ আবার প্রাণ পাবে। তিনি মনে করেন, ‘এ ত্যাগের প্রয়োজনীয়তা ছিল। আমাদের উপলব্ধির জন্য, সৃষ্টির জন্য এ ত্যাগ তিতিক্ষা সাহায্য করেছে। ধ্বংস না হলে সৃষ্টি হয় না। ‘

আসবার আগে মওলানা বললেন, ‘আমি নগণ্য কর্মী, নেতা নই।’ মওলানার এ সারল্যই তাকে দিয়েছে লক্ষ প্রাণের ভালবাসা। অযুত প্রাণের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
(পুনর্মুদ্রিতঃ দৈনিক বাংলা, ২৬ শে জানুয়ারী/৭২)

সাক্ষাৎকার গ্রহণেঃ মাহফুজউল্লাহ

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1976.11.26-bichitra.pdf” title=”1976.11.26 bichitra”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!