You dont have javascript enabled! Please enable it! 1976.10.12 | ১৯৭৬ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিস্থিতি | সাপ্তাহিক বিচিত্রা - সংগ্রামের নোটবুক

1976.10.12 | ১৯৭৬ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিস্থিতি | সাপ্তাহিক বিচিত্রা

ঘরোয়া রাজনীতি

বিভাজনের রাজনীতি এমনই যে, পলিটিক্যাল পোলারাইজেশনের প্রক্রিয়ায় রাজনীতিবিদেরা সমর্থন ও সংগঠনের আশায় যে কোন সমাধানে প্রস্তুত থাকেন। আর তাই ঘরের বাইরে না বেরোতেই ‘ঘরোয়া রাজনীতির’ আওতায় রাজনৈতিক দলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে বায়ান্নয়। রাজনীতি এখন পল্টনে নয়,চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নিয়ম অনুযায়ী, আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন যারা পেয়েছেন, তারা ভালভাবেই আসর জমিয়ে বসেছেন। যাদের চিঠি আসেনি, তারা এখনো হতাশ হননি। অপেক্ষা করছেন অনুমোদনের। কিন্তু তাই বলে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেমে নেই।
রাজনীতির ধরন ধারনই এখন আলাদা। এখন আর শিবগঞ্জ কিংবা রামগঞ্জে দলের শাখা গঠিত হয় না। নেতারা সফর শেষে ঢাকা ফিরে এলে, ঢাকায় বসেই গঠিত হয় সেই দলের শিবগঞ্জ অথবা রামগঞ্জ শাখা।সবাই এখন সমর্থন আদায়ে ব্যস্ত।
বিভাজনের রাজনীতির সূত্রপাত ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী, সেই রাজনীতির ধারা এখনো চলছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কয়টি আর কয়টি লীগ, তার সঠিক হিসেব, যাদের জন্য এই রাজনীতি, তাদের কেউ দিতে পারবেন না। তাঁরা চেনেন গুটি কয়েক মুখকে– যাদের দেখেছেন অতীতে, বর্তমানেও দেখছেন এবং ভবিষ্যতেও দেখবেন।
রাজনৈতিক কার্যক্রমের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পর থেকেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির ভাঙ্গা গড়ার পালা। আওয়ামীলীগাররা নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডেমোক্রেটিক লীগ কিংবা জাতীয় জনতা পার্টির, ভাসানীপন্থী একজন নেতৃত্ব দিচ্ছেন পিপলস লীগের, বাকশাল আর আগের অবস্থায় নেই— সেই গাটছড়ার কথাও কেউ বলছেন না। দল ভেঙ্গে যাঁরা বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা আবার ফিরে এসেছেন পুরনো দলে। নতুন করে তৈরী হচ্ছে দলীয় কাঠামো, গঠনতন্ত্র আর ঘোষণাপত্র।
এ কাহিনীর শেষ নেই। নির্বাচন যখন আপাতঃ লক্ষ্য, তখন প্রস্তুতিও নির্বাচন কেন্দ্রিক। অথচ সেই নির্বাচন নিয়েই দেখা দিল তোমার মতবিরোধ। বিদেশ থেকে ফিরে এসেই মওলানা ভাসানী আহবান জানালেন আগ্রাসী দানবের সঙ্গে লড়বার স্বার্থে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে। আর অমনি শুরু হয়ে গেল বিবৃতির লড়াই। বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী বললেন, দেশের জনগণ এ মুহূর্তে নির্বাচন চায়না। জনগণের এই মানসিকতা কর্তৃপক্ষীয় মহলকে অনুধাবন আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন সিদ্ধান্ত তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। তাই দেশের জনগণ এ মুহূর্তে নির্বাচন চায় কিনা গণভোটের মাধ্যমে তা যাচাই করা দরকার।
সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা বিবৃতি দিলেন মুসলিম লীগ প্রধান খান এ সবুর, জনতা পার্টি প্রধান এম, এ, জি ওসমানী এবং ডেমোক্রেটিক লীগের পীর মোহসেন উদ্দিন(…. মিয়া)। ডেমোক্রেটিক লীগের পক্ষ থেকে এ বিতর্কে অংশ নিলেন না খন্দকার মোশতাক আহমদ। দলীয় কর্মকর্তাদের দিয়ে বিবৃতি দিয়ে তিনি দেখতে চাইলেন কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?
বিবৃতিতে পীর মোহসেন উদ্দিন বলেন,এর দ্বারা জনগণের নিকট সাধারণ নির্বাচন প্রদানের ব্যাপারে সরকারের প্রতিশ্রুতিকে পাল্টাতে বলা হয়েছে। শাসনতন্ত্র বাতিলের সুপারিশ দেশকে অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক শূন্যতা এবং নৈরাজ্যবাদের আবর্তে নিক্ষেপ করবে। অতীতে বহু রক্তপাত হয়েছে। দেশ আর সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ভার বহন করতে পারছে না। জনগণ এখন শান্তির অন্বেষায় ঘুরছে। নির্বাচিত গণপরিষদকে বোগাস পার্লামেন্ট বলার মাধ্যমে মওলানা সাহেব নির্বাচক, নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং নির্বাচনের প্রতি তার অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। —–বিশেষভাবে দেশে যখন সামরিক আইন বর্তমান তখন ক্ষমতা দখল সম্পর্কে তার বিপ্লবী কথাবার্তা বাংলাদেশের প্রতি বৈরী দেশ ও বিদেশী কায়েনী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী দ্বারা লালিত-পালিত শক্তির সঙ্গে যোগসাজশের ইঙ্গিতবাহী।
বিবৃতিতে খান সবুর বললেন, মওলানা সাহেব একদিকে জনগণের পরিপূর্ণ ও প্রশ্নাতীত সার্বভৌমত্বের বক্তব্য উপস্থাপন করছেন অন্যদিকে জনগণের ইচ্ছা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসাবে ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন। সাধারণ নির্বাচনের প্রতি মওলানার বিরোধিতার অর্থ হইল একটি সরকারপরিচালনার দায়িত্ব বহনে তাহার অপারগতা এবং জনগণ যে তার স্ববিরোধী ভূমিকাকে গ্রহণ করবে না সে সম্পর্কে তার সচেতনতা।
জেনারেল ওসমানী তার বিবৃতিতে বললেন, দেশের লোক নির্বাচন চায় কি না যাচাই করার ব্যাপারে রেফারেন্ডামের ব্যবস্থা করা উচিত বলে মওলানা ভাসানীর উক্তিতে মনে হয় তিনি একবারের স্থলে দুইবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছেন।—– মওলানা সাহেবের নির্বাচিত গণপরিষদ ও শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত উক্তি দুঃখজনক। মূলতঃ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত গণপরিষদের প্রত্যক্ষ রায়ের ভিত্তিতেই বাংলাদেশের জন্ম। উক্ত গণপরিষদ বা বর্তমান শাসনতন্ত্রকে বাদ দিলে বাংলাদেশ কার্যতঃ পাকিস্তানের একটি প্রদেশের মর্যাদার ফিরে যাবে না কি?
এইসব বিবৃতির পরই এলো পাল্টা বিবৃতি। সন্তোষ থেকে পাঠানো বিবৃতিতে মাওলানা ভাসানী বললেন,যারা আমার দেশপ্রেম সম্পর্কেও প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন,বাংলাদেশের প্রতি তাদের কারো কারো আনুগত্য এখনো প্রমাণসাপেক্ষ। একই সময়ে ন্যাপ সম্পাদক মশিউর রহমান এ সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘খন্দকার মোশতাক আহমদের দলের আহবায়ক কমিটির সদস্য কি ভুলে গেছেন যে আওয়ামী ও বাকশাল রাজত্বের হোতা খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতে স্বৈরতন্ত্র ও নির্মম শাসন ব্যবস্থা এ দেশে চালু করেছিলেন। এক এক করে
যখন গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি হরণ করেছিলেন তখন পীর সাহেবকে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।…. মওলানা ভাসানীকে সময় বুঝে রাজনীতি করবার অভিযোগ করেছেন সেই দুদু মিয়া যিনি নিজেই সময় বুঝে বাকশাল নেতা মোশিতাম আহমদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গোপনে তার ব্যক্তিগত দূত হিসেবে পাকিস্তানে মোশতাকের দালালী করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। অপর পক্ষে জনাব সবুর দুই দুইবার-ই মুজিব এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে বন্ড দিয়ে তার অন্যান্য সহকর্মীকে জেলে ফেলে মুজিবের অনুকম্পায় মুক্তি লাভ করেছিলেন।এতো গেল ঘরোয়া রাজনীতির প্রথম পর্যায়—বিবৃতি আর পাল্টা বিবৃতির পালা। এর পরেই শুরু হল সাংবাদিক সম্মেলন— দলীয় ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র প্রকাশের জন্য। সাংবাদিক সম্মেলনে খন্দকার মোশতাক আহমদ বললেন, তাঁর দল সমাজতন্ত্র নয়, ফ্রি ইকনমি প্রতিষ্ঠা করবে। এই বক্তব্যের পাশাপাশি অন্য সব ক’টি দলের কর্মকর্তারা জানালেন, তারা সবাই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। জেনারেল ওসমানী আর এক ধাপ এগিয়ে বললেন, তিনি শুধু সমাজতন্ত্র নন,শাসনতন্ত্রে যে চারটি মূলনীতি রয়েছে তারা সবক’টিতেই বিশ্বাস করেন। জাতির পিতা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে খন্দকার মোশতাক বলেন, জাতির আবার পিতা থাকে নাকি? কোন্ জাতির পিতা আছে? জাতির পিতা চাচা, মামা থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। অপরদিকে জেনারেল ওসমানী বললেন, ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের কারণ বলতে গিয়ে খন্দকার মোশতাক বললেন, ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ তার বিঘোষিত নীতি থেকে সরে যায়। অথচ তিনি আওয়ামী লীগ থেকে সরে যাননি।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচে’ বেশী মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে। বাস্তবে এ প্রশ্নেই প্রয়োজন ছিল ঐক্যমতের। ফারাক্কা যখন আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃত তখন মুসলিম লীগ প্রধান খান এ- সবুর বললেন, এটা দ্বি-পাক্ষিক সমস্যা। শুধু তাই নয়, তার দল ক্ষমতায় গেলে এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে অর্থবহ আলোচনা করবে। পাল্টা বক্তব্য হিসেবে লেবার পার্টির মওলানা মতিন বললেন, খান সবুর বিদেশী স্বার্থের তল্পিবাহক হিসেবে এ বক্তব্য উপস্থিত করেছেন।
খান সবুর বললেন, তার দল ডেমোক্রেটিক লীগের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত করবে। আর ডেমোক্রেটিক লীগ প্রধান প্রত্যাখান করলেন সে বক্তব্য।খান সবুর মুসলিম লীগ গঠন করলেন আর পাল্টা বিবৃতি দিয়ে নতুন মুসলিম লীগ গঠনের কথা ঘোষণা করলেন প্রাক্তন এম, এন,এ আব্দুল মতিন। জেলখানার হত্যা প্রসঙ্গে প্রায় একই বক্তব্য উপস্থাপিত করলেন ভাসানী ও ইউ পি পি নেতৃবৃন্দ। তারা বললেন, ক্ষমতায় গেলে তারা এর নিন্দা করবেন। খন্দকার মোশতাক বললেন, তিনি সব ধরনের হত্যার নিন্দা করেন।
এম, এ, জি ওসমানী বললেন, তিনি সব হত্যার নিন্দা করেন তবে যেহেতু জেলখানার হত্যা তদন্ত করার জন্য তদন্ত কমিশন নিয়োগ করা হয়েছে তাই সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে রাজি নন। জনগণের সার্বিক উন্নতি ও কল্যাণের প্রশ্নে যেসব বক্তব্য উত্থাপিত হয়েছে তার মর্মার্থ প্রায় একই। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নেও সবাই প্রায় একধরনের কথা বলেছেন। সবাই বলেছেন জোটনিরপেক্ষতার কথা, ইসলামী সম্মেলনের প্রতি সমর্থনের কথা, সর্বোপরি সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়-এর কথা।
এ সবের বাইরে, মৌলিক প্রশ্নে বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করছেন নেতৃবৃন্দ। নির্বাচনের প্রশ্নে মওলানা ভাসানী যখন সরাসরি নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার কথা বললেন, তখন তার বক্তব্যের সমর্থনে এগিয়ে এলেন মওলানা মতিন। কিন্তু ন্যাপ মহল থেকে মওলানার বক্তব্য সম্পর্কে দেয়া হলো ভিন্ন ব্যাখ্যা। জনাব মশিউর রহমান বললেন, মওলানা ভাসানী নির্বাচন কিংবা গণতন্ত্রের বিরোধী নন। তবে দেশের জনগণ এ মুহূর্তে নির্বাচন চায় কিনা, সে সম্পর্কে তিনি গণভোট অনুষ্ঠানের জন্যে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। একই সময়ে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি প্রস্তাব দিয়েছেন সকল গণতান্ত্রিক দলের মিলিত কনভেনশনের মাধ্যমে নির্বাচনের যুক্তিসংগত তারিখ নির্ধারণের। পিপলস লীগ নেতা, একসময়ে ভাসানী ন্যাপের একমাত্র ভাইস চেয়ারম্যান ডঃ আলীম আল রাজী বলেছেন, নির্বাচনের প্রশ্নে রেফারেন্ডাম হতে পারলে নির্বাচন হতে বাধা কোথায়। শাসনতন্ত্র বাতিলের প্রশ্নেও নেতৃবৃন্দ একমত হতে পারেন নি। মওলানা ভাসানী সরাসরি এই শাসনতন্ত্র বাতিলের কথা বলে দিয়েছেন। ডক্টর রাজী বলেছেন, সামরিক শাসন জারী হবার ফলে শাসনতন্ত্র আপনা আপনি বাতিল হয়ে গেছে। জনতা পার্টি প্রধান এম, এ, জি ওসমানী এ বক্তব্য মানতে রাজি নন। তার মতে গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা তৈরী শাসনতন্ত্র, যার ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেই শাসনতন্ত্র বাতিলের প্রশ্ন উঠে না। তার দল সেই পুরোপুরি মেনেই কাজ করবে। এই বক্তব্য উপস্থাপিত করতে গিয়ে জনাব ওসমানী অবিশ্যি সেই শাসনতন্ত্রেই সংশোধনী এনেছেন। তার দলীয় ঘোষণাপত্র অনুযায়ী পরিষদের সদস্য সংখ্যা হবে ২০০ জন। অথবা যে শাসনতন্ত্রের প্রতি তিনি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন সে শাসনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী সদস্য সংখ্যা ৩১৫ জন। সংসদের সদস্য সংখ্যা প্রশ্ন পিপলস লীগ আর এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। জনসংখ্যার দোহাই দিয়ে ডঃ রাজী বলেছেন, তাঁর দল জয়ী হলে সংসদের সদস্য সংখ্যা হবে ৪০০ জন। এসব প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, জাসদ, কিংবা মোজাফফর ন্যাপ কোন বক্তব্য এখনো রাখেনি। অনুমোদনের পূর্বেই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের দলীয় নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। মোজাফফর ন্যাপ এখনো প্রকাশ্যে কোনো বিবৃতি না দিলেও, দলীয় নেতারা সাবেক রিলিফ চোর ও দুর্নীতিবাজদের শাস্তিদাবী করেছেন।

রাজনৈতিক দল

বাংলাদেশ জাতীয় লীগ

জনাব আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় লীগ বৈধ দল হিসেবে ছাড়পত্র পেয়েছে গত ২৩ শে সেপ্টেম্বর। জাতীয় লীগ প্রধান জনাব আতাউর রহমান খান পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন দু’বছর।স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সনে গঠিত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি যোগ দেন।
বাংলাদেশ জাতীয় লীগের ঘোষণাপত্র এবং কর্মসূচীতে বলা হয়ঃ জাতীয় লীগ প্রশাসন তন্ত্রের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন সমস্ত মূল বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ সরকারী নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। অন্য সব শিল্প প্রতিষ্ঠান বেসরকারী নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে।বাংলাদেশ জাতীয় লীগের মূলনীতিসমূহ হচ্ছেঃ ধর্ম মানব জীবনের ভিত্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আমাদের পবিত্র আমানত। রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে সংসদীয় গণতন্ত্রই আমাদের আদর্শ। শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা— কল্যাণমূলক রাষ্ট্র আমাদের লক্ষ্য। নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা, শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও মুসলিম বিশ্বের সহযোগিতা আমাদের কাম্য।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি

রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় শর্তযুক্ত প্রক্রিয়াগুলো শেষ করবার পর গত ২০শে সেপ্টেম্বর মওলানা ভাসানী নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বৈধ দল হিসেবে সরকারী স্বীকৃতি পেয়েছে। দলের প্রধান মওলানা ভাসানী এদেশের বয়োবৃদ্ধ নেতা।
সরকারের কাছে পেশকৃত ন্যাপের ঘোষণাপত্র এবং কর্মসূচীতে বিবৃত বক্তব্যে বলা হয়ঃ পার্টির মূলনীতি থাকবে দুটি— জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র।পার্টি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ও পরিচালনার মূল, ভারী ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী। এ ছাড়া অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তিগত বিনিয়োগকে রাষ্ট্র সর্বপ্রকার সুযোগ প্রদান করবে। পার্টি জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে মূল ভিত্তি করে বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করবে। পার্টি রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক নীতিতে অবিচল থাকবে। পার্টির নেতৃত্বে কোরান ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করা হবে না এবং অন্য কোন ধর্ম বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হবে না।

বাংলাদেশ পিপল্ স লীগ

রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় ডঃ আলীম আল রাজীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ পিপলস লীগ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল সরকারী অনুমোদন পেয়েছে। দলের নেতা ডঃ আলিম আল রাজী ব্যক্তিগত জীবনে একজন আইনজীবী। ডঃ রাজী এর আগে ভাসানী ন্যাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ পিপলস লীগের কর্মসূচী, আদর্শ ও উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে ডঃ আলীম আল রাজী সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তার দল নির্বাচিত হলে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে এবং বর্তমান তিনশ’ জনের পরিবর্তে পার্লামেন্টে চারশ’ সদস্যের বিধান রাখবে। তিনি পিপলস লীগের অর্থনৈতিক লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন যে, তার দল পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার পরিবর্তে সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম করতে চান।

বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক লীগ

সরকার ঘোষিত রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় খোন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক লীগ নামে একটি নতুন দল অনুমোদন পেয়েছে। দলের নেতা খোন্দকার মুশতাক আহমদ ১৯৪১ সন থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি মুজিব নগরে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৫ সনে গঠিত শেখ মুজিবের বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। ১৫ই আগস্টের অভ্যুথানে শেখ মুজিব নিহত হলে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে অনুমোদন পাবার পর খোন্দকার মুশতাক আহমদ গত ১লা অক্টোবরে অনুষ্ঠিত দলের সাংবাদিক সম্মেলনে বলেনঃ গণতন্ত্রকে রক্ষা করবার জন্যেই ১৫ই আগষ্টে অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হাতে নিতে হয়েছে।……. আওয়ামী লীগে এখন থেকে কাজ করা সম্ভব নয়, সমীচীনও নয়।আওয়ামী লীগ যতদিন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল ততদিন ছিলাম। ডেমোক্রেটিক লীগের ঘোষণাপত্র কর্মসূচীতে সমাজতন্ত্রকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। খোন্দকার মুশতাক আহমদ এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন….. ‘আমরা ফ্রি ইকনমিতে বিশ্বাসী’।

তফসিলী ফেডারেশন

নতুন ধরনের একটি রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি এসেছে রাজনৈতিক দলবিধির আওতায়। দলটির নাম তফসিলী ফেডারেশন। নেতা হিসেবে রয়েছেন মিঃ রসরাজ মন্ডল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য খোন্দকার মোশতাক যখন প্রেসিডেন্ট তখন তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। এ দলের আদর্শ ও কর্মসূচি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি।

গণমুক্তি পার্টি

রাজনৈতিক দলবিধি অনুসারে অপর আর একটি নতুন দল হচ্ছে গণমুক্তি পার্টি। দলের প্রধান হিসেবে রয়েছেন আবদুল হামিদ। এ দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য বা কর্মসূচী সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ তৎকালীন পাকিস্তান পরিষদ সভার একজন এম, এন, এ।

জাতীয় জনতা পার্টি

জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আতাউল গনি ওসমানীর নেতৃত্বে সরকারের বর্তমান রাজনৈতিক দলবিধি অনুসারে জাতীয় জনতা পার্টি নামে একটি নতুন দল স্বীকৃতি পেয়েছে। দলের প্রধান জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ওসমানী গত স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এবং এর পরেও কিছুকাল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে মন্ত্রীও নিযুক্ত হন। বাকশাল গঠনের পর, তিনি তৎকালীন সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন।
জাতীয় জনতা পার্টির আদর্শ, উদ্দেশ্য, নীতি ও কর্মসূচীতে সব রকমের শোষনের হাত থেকে জনগণকে মুক্ত করে ন্যায়সঙ্গত ভাবে সম্পদের যথাসম্ভব সমবন্টের কথা বলা হয়েছে। জাতীয় জনতা পার্টির সমাজতন্ত্রের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন স্বাধীনতার পর, স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্রের কথা বলে সমাজতন্ত্রবিরোধী কাজ করা হয়েছে। তবে তিনি সশস্ত্র পন্থায় বিশ্বাসী নন। সংসদীয় এবং নিয়মতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার পক্ষপাতী। উল্লেখযোগ্য, তার মন্ত্রীত্বের আমলেই সমাজতন্ত্রের কথা বলে আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র বিরোধী কাজ করেছে।
তিনি সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষপাতী নন। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক এক সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিব সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগাররা তাকে হত্যা করেছে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে জানান, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তখনও শ্রদ্ধা ছিল এখনও রয়েছে।” তবে তিনি তাঁকে রাজনীতিতে টেনে আনার বিপক্ষে মত দেন। দেশরক্ষার ব্যাপারে ইসরায়েল এবং যুগোস্লাভিয়ার কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

জাতীয় দল

সরকারের রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় আরও যে ক’টি নতুন রাজনৈতিক দল স্বীকৃতি লাভ করেছে তার মধ্যে মিসেস আমেনা বেগমের নেতৃত্বাধীন জাতীয় দল একটি।দলের নেত্রী আমেনা বেগম সাবেক আওয়ামী লীগের সঙ্গে একসময় জড়িত ছিলেন। একসময়ে আওয়ামী লীগের ৬ দফার জন্য প্রচুর প্রচারণাও করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্বে স্বাধীনতার পূর্বেই আওয়ামী লীগ থেকে চলে এসে জনাব আতাউর রহমানের জাতীয় লীগ থেকে চলে এসে জনাব আতাউর রহমানের জাতীয় লীগে যোগ দিয়েছিলেন। সম্প্রতি তিনি এ নতুন দল গঠন করেন।
রাজনৈতিক দিক দিয়ে জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়ে খসড়া ঘোষণাপত্রে এ দল গণতন্ত্রকে মূলনীতি হিসেবে মেনে নিয়েছে। অর্থনীতির ব্যাপারে তেমন কোনো নির্দিষ্ট রূপরেখা না রেখেই তাঁরা জনগণের সুযোগের সাম্যের পক্ষপাতী। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের প্রতি তাঁদের সমর্থন রেখে তাঁরা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকারী সকল রাষ্ট্রকে বন্ধু এবং হুমকী কটাক্ষকারীদের শত্রু বলে খসড়া ঘোষণাপত্র উল্লেখ করেছেন।

বাংলাদেশ লেবার পার্টি

নতুন আরেকটি রাজনৈতিক বিধিমালার অধীন স্বীকৃত দল হচ্ছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি। দলের প্রধান মওলানা মতিন। তিনি এক সময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পার্টির মূলনীতি হিসেবে এ দল কোরান ও সুন্নাহ্ অনুযায়ী ইসলামী আদর্শ ও মূলনীতির উপর জোর দেবে।তিনি সাধারণ নির্বাচন কমপক্ষে দুই বছর পিছিয়ে দেয়ার পক্ষে মত রেখেছেন।
এছাড়াও এ দল স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এদের মূল লক্ষ্য এবং ধর্মহীনতা নয়, ধর্মপরায়ণতাই অন্যতম আদর্শ বলে মেনিফেষ্টোতে উল্লেখ করেছে। জাতীয় সংহতি ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবিধান সর্ব প্রধান দায়িত্ব বলে কর্মসূচিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ

সাবেক নেজামে ইসলামের নেতা মওলানা ছিদ্দিক আহমদ ও জামাতে ইসলামের মওলানা আবদুর রহিম গঠন করেছেন বাংলাদেশ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ। এই দল ১২ অক্টোবর সরকারী অনুমোদন পেয়েছে। মওলানা ছিদ্দিক এক সাংবাদিক সম্মেলনে (১৭ অক্টোবর) বলেন যে, তার দল দেশে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্য ক্ষমতায় গেলে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করবেন।
তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিদেশী উস্কানির ফল, ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী কারা তা ভেবে দেখতে হবে, তবে আল-বদর আল-শামস রাজাকাররা তার জন্য দায়ী না হওয়ার সম্ভাবনা বেশী কেননা তখন তারা পলায়নে অধিক মনোযোগী ছিল।
আর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “মওলানা ভাসানী সবচেয়ে বৃদ্ধ নেতা। উনি যদি কোরাণ সুন্নাহর আইনের ভিত্তিতে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে পারেন তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর নেতৃত্বে মানব। কিন্তু উনি ইসলাম সম্পর্কে যা বলেন সবতো মানতে পারি না, উনি বলেন, দুনিয়াতে যা কিছু আছে সবকিছুর মালিকানা আল্লাহর। অতএব ব্যক্তিমালিকানায় কিছুই থাকবে না। এটাতো মানতে পারি না। কারণ আমার বউ-বি বি,বাল-বাচ্চা এ সব কিছু আল্লাহর এটা মানতে পারি না।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর)

ন্যাপ (ম) সরকারের রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় বৈধদল হিসেবে রাজনীতি করার ছাড়পত্র পেয়েছে। দলের প্রধান হিসেবে রয়েছেন অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ নিজেই। এদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রথম বিভক্তির কালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মস্কোপন্থী অংশের নেতা হিসেবে পরিচিত হন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের শরিক হন।পরে শেখ মুজিবের বাকশাকে যোগদান করে নিজ দলের বিলোপ সাধন করেন।
ইসলামের মৌলিক ও মানবিক দিক সমূহ বিবেচনা করে পার্টির বর্তমান আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মুখবন্ধে বলেছেন, “আমরা পরকালের মুক্তির জন্য চাই ধর্ম আর ইহকালের মুক্তির জন্য চাই শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা।” আর এ দুয়ের মধ্যে তাঁরা কোন বিরোধও লক্ষ্য করেন না।
পার্টির বর্তমান আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষা করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করে দেশী বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের মোকাবেলা করবে বলে পার্টির কর্মসূচীতে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও পার্টি মেনিফেষ্টোতে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সশস্ত্রবাহিনীর ক্ষেত্রে, ধর্মের ব্যাপারে এবং পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে ৬০টি ধারা সংবলিত হয়েছে।

বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি (মনিসিং)

সাবেক বাকশাল নেতা মনি সিং এর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি সরকারী অনুমোদন লাভে সমর্থ হয়েছে ১২ই অক্টোবর। প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা মনি সিং তৎকালীন পাকিস্তানে অধিকাংশ সময় আত্মগোপন জীবন অতিবাহিত করেন। বামপন্থী আন্দোলনের মস্কোপন্থী নেতা বলে তিনি পরিচিত। বাংলাদেশ হওয়ার পর তিনি এবং তার দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন।
শেখ মুজিবের আমলে তার দল প্রথমে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ (মো) এর সঙ্গে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট করে এবং বাকশালে যোগ দিয়ে তাঁর দলের বিলোপ সাধন করেন। ১৫ই আগষ্টের পর দীর্ঘদিন মস্কোয় অবস্থান করে কিছুদিন পূর্বে দেশে ফেরেন এবং বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি সংগঠিত করেন। এ দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্য এখনো জানা যায়নি।

বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল

এম, এ, আউয়ালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সরকারের অনুমোদন পেয়েছে ১২ অক্টোবর। সাবেক জাসদের কিছু কিছু নেতা ও কর্মী এই দলের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। আদমজী জুট মিলের প্রাক্তন প্রশাসক এম,এ, আউয়াল শেখ মুজিবের সরকার কর্তৃক মিলের প্রশাসকের পদ থেকে অপসারিত হওয়ার পর তৎকালীন ‘জাসদে’ যোগ দেন। পরে তিনি প্রথম সারির নেতা হন।
রাজনৈতিক দল হিসেবে জাসদ সরকারী অনুমোদন লাভের পর এম,এ, আউয়াল বলেছেন যে, নিরবচ্ছিন্ন প্রতিকূলতার মুখেও সারা দেশের সংগঠনের নেতা ও কর্মীরা জাসদের বৈধকরণ ও গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে ফিরে যাওয়ার জন্য যে ঐক্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন তারই ফলশ্রুতি হিসেবে এই দল বৈধ সংগঠন হিসেবে জাতীয় জনতার কাছে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তিনি তার দলকে বিপ্লবী জাতি ও জনতার প্রতিনিধি ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনিবার্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ মসুলীম লীগ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে নিষিদ্ধ এই দল বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত রাজনৈতিক দলবিধি ৭৬-এর শর্ত পূরণ করে বৈধ রাজনৈতিক দলের অনুমতি পেয়েছে গত ২১শে সেপ্টেম্বর।
(যদিও) দলের নেতা জনাব আবদুস সবুর খান সাংবাদিক সম্মেলনে পুরানো মুসলিম লীগের সঙ্গে বর্তমান মুসলিম লীগের সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছেনঃ সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী বর্তমান মুসলিম লীগ একটি নতুন রাজনৈতিক দল। কিন্তু ১৯০৬ সনে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে আমাদের সাদৃশ্য রয়েছে। বাংলাদেশ মুসলিম লীগের নেতা জনাব খান এ সবুর ষাট দশকের প্রথম দিকে আইয়ুব খানের বিরোধিতা করেন, পরবর্তীতে আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার সদস্য মনোনীত হন।
বাংলাদেশ মুসলীম লীগ অনুমোদন পাবার পর দলের নেতা সবুর জনাব খান গত ২৯শে সেপ্টেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেনঃ—ষাট দশক থেকে আমরাও বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেছিলাম। তবে শেখ মুজিবুর রহমানের মতো আমরা তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে চাইনি।— এই প্রথমবারের মতো অমুসলিমরাও মুসলিম লীগের স্থায়ী সদস্য হতে পারবেন।—আমরা ইতিমধ্যেই চারনীতি সহ বাংলাদেশের সংবিধানকে গ্রহণ করেছি এবং একে সমুন্নত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা এই সংবিধান বাতিলেরও পক্ষপাতী নই, তাই এই সংবিধানের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিতে চাই… আমরা বাংলাদেশী মালিকদের জাতীয়করণকৃত পাট ও বস্ত্র কারখানা পুরাতন মালিকদের ফিরিয়ে দেবার পক্ষপাতি। আমরা ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের জাতীয়করণের সম্পূর্ণ বিরোধী।বিদেশী পুঁজি আকর্ষণের জন্যেই এ ব্যবস্থা নেয়া দরকার।… আমরা আটক অবস্থায় যে কোনো ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরোধী। কিন্তু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের হত্যাকান্ড সম্পর্কে এই মুহূর্তে কিছু বলতে চাই না কারণ এটি এখনও বিচারাধীন।… বাংলাদেশ আমাদের আবাসভূমি ও মাতৃভুমি এ বিষয়ে কারো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।বাংলাদেশের জন্মলাভের সাথে সাথে বিনা সংকোচে আমরা এর বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েছি। বাংলাদেশ যে ভাবধারার মধ্যে জন্মলাভ করেছে অর্থাৎ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ সে বিষয়েও আমাদের দৃঢ় আস্থা রয়েছে। আমরা চিরকাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অনুগত থাকব।

বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল

বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের প্রধান হলেন মোহাম্মদ তোয়াহা। এই দলের নেতৃত্বস্থানীয় অন্যান্যরা হলেন শান্তি সেন, মাহমুদ ভূঁইয়া, আলাউদ্দিন আহমদ, প্রমুখ। সাম্যবাদী দল নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবী করেছে।
সাম্যবাদী দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা সাংবাদিক সম্মেলন এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, তাঁদের দলের নীতি ও কর্মসূচীর সঙ্গে বর্তমান সরকারের নীতির সামঞ্জস্য রয়েছে বলে তারা বর্তমান সরকারকে সমর্থন করেন। মোহাম্মদ তোয়াহা এক সময় তৎকালীন পাকিস্তানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ভাসানী) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি মুজিব সরকারের হুলিয়ার প্রেক্ষিতে গোপন সংগঠন করেন এবং সকল কার্যক্রম গোপনে চালান। অতীতে তাঁর রাজনীতির প্রধান লাইন ছিল “শ্রেনী শত্রু খতম”। অবশ্য মুজিবের মৃত্যুর পর প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে এসে তিনি ঘোষণা করেন যে “গলা কাটার রাজনীতি করে ভুল করেছি।” বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল ১২ অক্টোবর রাজনৈতিক দল হিসেবে সব চেয়ে কম সময়ে সরকারী অনুমোদন লাভ করে।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1976.10.22-bichitra.pdf” title=”1976.10.22 bichitra”]