You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
ভারতীয় প্রতিনিধি মিঃ সমর সেনের বিবৃতি জাতিসংঘ ডকুমেন্টস ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

২. ভারতীয় প্রতিনিধি, মিঃ সমর সেনের বিবৃতি, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

মিঃ প্রেসিডেন্ট, আমরা বিতর্কের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি, এবং আমি আপনার কাছে এবং এই কাউন্সিলের কাছে কিছু মন্তব্য করার সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞ ।

এই বিতর্ক দেখিয়েছে যে নির্বাচনশীলতা হচ্ছে দিনের কার্যশীলতার আলোচ্য বিষয়। এখন, বিভিন্ন প্রতিনিধির দ্বারা একাধিক নীতি উদ্ধৃত হয়েছে, যেমনঃ সার্বভৌমত্ব, প্রাদেশিক অখন্ডতা, অন্যান্য মানুষের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি, এবং ইত্যাদি। কিন্তু আমি ভাবছি, কেন আমরা মানবাধিকার বিষয়ে কথা বলতে লজ্জিত হচ্ছি? গণহত্যা বিষয়ে কনভেনশনে কি ঘটেছে? স্বয়ং-সংকল্প নীতি কোথায় গেল? অন্যান্য যেসব সামাজিক অধিকার এবং কনভেনশনের শপথ আপনারা গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলোর কি হয়েছে? আমরা কি, তবে, আমাদের এই যুগ-শান্তির নীতিবাক্য – শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার- এ কিছু বাছাইকৃত দায়িত্বপালন করবো? ন্যায়বিচার এর অংশে কি ঘটেছে?

আমরা গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত গুরুতর এই ব্যপারে বাচ-বিছার করে অগ্রসর হতে পারবো না। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা জোরদারকরণ সংক্রান্ত ঘোষণা উদ্ধৃত হয়েছে। ঘোষণার আর্টিকেল ২২ – এ কি বলা হয়েছে? অন্যান্য আর্টিকেলের ক্ষেত্রে কি ঘটেছে? আপনার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, আপনি যেটি ইচ্ছা সেটিই বাছাই করতে পারেন, কিন্তু যখন আমি একটি নির্দিষ্ট আর্টিকেল বেছে নিই, তখন সেটিই হয়ে যায় বাছাইকৃত।

আমার ভেবে নেয়া উচিত ছিল যে, সাধারণ, সভ্য পন্থায় বিতর্ক হবে যেখানে প্রতিটি স্পিকার তার বক্তব্যের পক্ষে উপলব্ধ সেরা প্রমাণ দাখিল করে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করবেন; এবং যদি এটি একটি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আমাকে আবার শুরু থেকে গণতন্ত্রের সকল শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তাদের সরকারকে সমর্থন করে শুনে আমিও খুশি হয়েছিলাম। আমি চিন্তা করা উচিত ছিল যে একটি নির্বাচিত সরকার – যেটি অন্তত চার বছরের জন্যে নির্বাচিত হয়েছে- সেখানে এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ সত্য। কিন্তু এই সত্যতার নিশ্চিত প্রমাণ পেয়ে আমি আনন্দিত।

তারপর, আমাকে বলা হয়েছিল যে আমরা এখানে দোষারোপ না করে বরং ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়া এই আগুনকে ঠান্ডা করার ব্যপারে কিছু করার জন্যে। আমার মনে পড়ে ভারতের অদূরেই কিছু অঞ্চলের কথা যেখানে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছেই। আমি বিচার করার দায়ভার ইতিহাসের ওপরই ছেড়ে দেব কিভাবে এবং কি গতিতে মানুষের প্রাণ রক্ষা পেয়েছে এবং সংঘর্ষের আগুন নেভানো হয়েছে। আমরা কি তখন তারপরে ন্যায় বিচার এবং নিন্দা জ্ঞাপন প্রশ্নে ভেবে দেখি নি? আমি এটাকে এ অবস্থায় রেখে গেলাম।

এখন, আমরা যখন এই বিতর্ক শুরু করেছিলাম তখন আমি আমাকে এবং আমার কিছু বন্ধুদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কাউন্সিল আসলে ঠিক কি অর্জন করতে চায়। অনেক বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও- যখন আমি এই গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কে অংশগ্রহণের জন্যে এখানে এসেছিলাম, -প্রধানত যেসব কারনে যা আমি সংক্ষেপে এক মিনিটের মধ্যেই ব্যাখ্যা করবো- আমি আশা করেছিলাম যে কাউন্সিল শান্তি, অগ্রগতি এবং ন্যায় বিচার – এই তিনটি নীতিবাক্যকে আদর্শ ধরে এগিয়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে আমি শক্ত-কন্ঠে বলতে চাইঃ যারা শান্তি, অগ্রগতি এবং ন্যায় বিচার প্রত্যাশী, তাদের অবশ্যই উপলব্ধি করা উচিত যে এসব নীতি সব এলাকাতেই প্রযোজ্য- নিছক ভারত এবং পাকিস্তানের জন্যে নয়, নিছক এই এলাকা বা ঐ এলাকার জন্যে নয়, কিন্তু সব এলাকার জন্যে প্রযোজ্য।
আমরা সবাই তাদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং আমরা নিছকই এসব ধারণা আলাদা করতে পারবো না যে নয় মাস ঘুমিয়ে থেকে হঠাৎ এ ব্যপারে কারও মনে হল তার দ্রুত কিছু করা উচিত।

দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি আমি নিজেকে করেছিলামঃ আমরা কি এটি অর্জন করতে পারবো? আমার মনে হয় আমরা এটি অর্জন করতে পারবো। নিরাপত্তা পরিষদের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে এটি অর্জন করার, কিন্তু আমি বরং সন্দিহান এটি তার ক্ষমতার প্রয়োগ করবে কিনা। যে ক্ষমতা অনেক, অনেক কাল আগে প্রয়োগ করা সম্ভব হত। আমরা অভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থা নিয়ে কাদা-জলের মধ্যে আছি এবং এভাবেই চলছে এবং অবিচ্ছিন্ন এ সমস্যার দিকে ও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে আজকের দিনের এখন পর্যন্ত কোন রকম চেষ্টা করা হয় নি। না, আমরা খুবই ব্যস্ত যেনতেনভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে।

তারপর আমি নিজেকে প্রশ্ন করলামঃ কিভাবে আমরা এটা অর্জন করতে পারি? এখন, এখানে আমার খটকা, সন্দেহ এবং বিক্ষোভ চলে এসেছে। আমার চিন্তা করা উচিত ছিল, আমি আবারও বলছি যে যুদ্ধবিরতির প্রশ্ন বিবেচনার জন্যে যে দল যুদ্ধ করছে , তাদের প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করি কাউন্সিলের এটা ইচ্ছা নয় যে পাকিস্তানি সেনা এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যেকার লড়াই বন্ধ করা উচিত হবে না, এবং সমস্ত এলাকায় যে ভয়াবহ গণহত্যা শুরু হয়েছে, এবং যারা এসব গণহত্যা প্রতিহত করছে তাদের ওপরই এর দোষ চাপানো।

আমার ভেবেছিলাম যে সব লোকের সদিচ্ছাতেই সকল যুদ্ধবিগ্রহের অবসান হবে। এবং আমরা এই মাত্রই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সম্পর্কে যুক্তি শুনলাম- আমি বারংবার এই সমস্যা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছি, এবং আমাদের এই বিষয় নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না- যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অসহায় নারী, শিশু এবং মানুষের বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে, কিন্তু তারা এর কোনো প্রতিবাদ করতে পারবে না কারন সেটা অনৈতিক।

এই কারনে আমরা এখানে বাংলাদেশের মানুষকে আসতে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করতে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা ঘটেনি। এরকম বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থায়, কাউন্সিল কি সত্যিই কোনো বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আশা রাখে?

এখন, খুব সংক্ষেপে এসব কিছু বাস্তবতা ব্যাখ্যা করা যাক। শরণার্থীরা একটি বাস্তব ঘটনা। এটি কেবলমাত্র একটি অর্থনৈতিক ভারের প্রশ্ন নয়। আমি সেটা বারবার ব্যাখ্যা করেছি, সুতরাং আমি সে প্রসঙ্গে আর যাবো না। কিন্তু যাই হোক, শরণার্থীরা বাস্তব। জনগণ, তাদের নিজস্ব জীবন-তাদের ইচ্ছেমত পালনের জন্যে যে সুতীব্র আকাঙক্ষা- সেটি একটি অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতা। এসব জীবন নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তানের কোনরূপ আশা নেই। সরকারের সবগুলো প্রশাসনের সম্পূর্ণ পতন একটি বাস্তবতা। বিভিন্ন ধরণের সশস্ত্র সংঘাত বাস্তব। ২৫শে মার্চের পর থেকে পাকিস্তানের বিভিন্ন ধরণের প্ররোচনা এবং আগ্রাসন একটি বাস্তব সত্য। ফলস্বরূপ, আত্মরক্ষার অধিকার খাটাতে গিয়ে প্রতিরোধ শুরু হয়েছে, এবং আমরা সাবধান করে দিয়েছি যে আমরা কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই এই অধিকার প্রয়োগ করবো। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতি একটি বাস্তবতা। বাংলাদেশ নিজেই একটি বাস্তবতা। এসব বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে গড়া এসব বাস্তব সত্যকে যারা গ্রহণ করেন না, তাদের অধিকারে তারা সেটা করতেই পারেন। আমরা এখানে কাউকে যুক্তি দিয়ে বুঝাতে আসি নি যাদের যুক্তি শোনারই ইচ্ছা নেই। যাদের প্রকৃত ঘটনা দেখারই ইচ্ছা নেই, কেউই তাদেরকে জোর করে ঘটনা দেখাতে পারবে না। উক্তি আছে, ঐ ব্যক্তির মত অন্ধ আর কেউ নেই যে দেখতেই রাজি নয়।

আমরা যদি এই বাস্তবতার বিরুদ্ধে যাই, আমি আশংকা করছি যে শুধু ভারতই কিন্তু না, বরং পুরো জাতিসংঘ ধারণাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধন্যবাদ দিতে চাই, ভারত-সোভিয়েত চুক্তির জন্যে নয়, বরং এটি সেইসব দেশ, যারা এসব বাস্তবতার স্বরূপ মেনে নিয়েছে।
এসব বাস্তবতা বিভিন্নভাবে আলোর দেখা পেয়েছে, কিন্তু খুব বেশিই ধীরে। নয় মাস পর, আমরা এখনও বাস্তবতার ধারেকাছেও যেতে পারি নি।

ভারত-সোভিয়েত চুক্তি সম্পর্কে বেশি কিছু বলা হয় নি, যে এটি একটি দাসত্বের বন্ধন। এখন, যারা বিশ্বাস করে যে দেশ হিসেবে ভারতকে অন্য কোন শক্তি আজকে নিয়ন্ত্রণ এবং শাসন করতে পারবে, তা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বিদ্যায় তারা একেবারেই অল্প। তাদের বিদ্যার প্রয়োজন নেই, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের মনোযোগ প্রয়োজন। পাকিস্তান একই ঘটনা বর্ণনা করেই যাচ্ছে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির কারনে জোরপূর্বক নির্বাচন এবং পরবর্তীতে তাদের রায় বাতিল ছিল অবশ্যম্ভাবী। আবার, আমি এটা এ অবস্থাতেই ছেড়ে দেব কারন আমরা সত্য সম্পর্কে একটু বেশিই জানি……। এই পর্যায়ে আমি সুস্পষ্টভাবে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে চাই। আমরা ইতিপূর্বেও পরিষ্কারভাবে বলেছি, কিন্তু আমি আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে পড়ছিঃ

“আমরা আমাদের অবস্থান পুরোপুরি স্পষ্ট করেছি এবং আমরা তা দৃঢ়ভাবে মেনে চলবো, যে সংকটাপন্ন অবস্থায় আমরা পড়েছি- অন্যান্যদের জন্যে বুঝতে যদিও এটা কঠিন হতে পারে- সেটা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, আমাদের সমগ্র সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো এবং ৫০০ মিলিয়নেরও বেশি ভারতবর্ষের মানুষের ও আরও অনেকের জন্যে কঠিন জীবন। আমরা একটি প্রতিবেশী দেশ থেকে চারবার আক্রমণের শিকার হয়েছি, এবং আবারও আমরা হুমকির সম্মুখীন। বিভিন্ন দেশের আয়তন এখানে সামান্যই প্রাসঙ্গিক, ছোট ক্ষমতার জন্যে শক্তিশালী মিত্র, ব্যয়বহুল এবং দক্ষ সামরিক যন্ত্রপাতি, এবং অদ্ভুত উচ্চাভিলাষ থাকতে পারে। এর সাথে যোগ করুন আমরা আমাদের দোরগোড়ায় ৭৫ মিলিয়ন মানুষের ধবংসের ভয়াবহ ঝুঁকির সম্মুখীন। আমরা এটা কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারবো না এবং আমরা এটা সহ্য করবো না। ”
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!