শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ এর বিবৃতি | জাতিসংঘ ডকুমেন্টস | ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ-এর বিবৃতি
ডিসেম্বর, ১৯৭১
আজ আমরা সকলে যে প্রতিবেদন পেয়েছি,তাতে ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে প্রকাশ্য শত্রুতার অবস্থা প্রদর্শিত হয়েছে।এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার উপর কবরসম হুমকি দেখতে পারছি।এতে দক্ষিণ এশীয় জাতির যুদ্ধের আশ্রয় নেয়াটা দুঃখজনক ও অপ্রয়োজনীয়।
মার্চ মাস থেকে গত মাসগুলোতে,আমরা সকলে একটি গুরুতর দুঃখজনক ঘটনার সাক্ষী হয়েছি।গত বছরের সাইক্লোন-এর ব্যাপারে আসি,বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি,পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক দ্বন্দ্ব লাখো মানুষের অব্যক্ত ক্ষতি করেছে,ভারতে অনন্য মাত্রায় নতুন ও দুঃখজনকভাবে শরণার্থী শিবির তৈরি হয়েছে,যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উন্মুক্ত শত্রুতা এনেছে।এখন সময় এসেছে এই দুই বৃহৎ দেশের মধ্যকার শান্তি বজায় ও ধারণ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে কার্যকর ও দ্রুততার সাথে এঁদের বিশিষ্ট নৈতিক কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করতে হবে।
গত কয়েকমাসের ঘটনাসমূহ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অসীম ঝঞ্ঝাপূর্ণ ছিল।যেহেতু মাননীয় রাষ্ট্রপতি এই বছরের শুরুতে কংগ্রেসকে তাঁর প্রতিবেদনে পরিষ্কার করেছেন,দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে শান্তির ও স্থিতিশীল কাঠামো গঠনের যাতে এই এলাকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান হতে পারে।এই কাজে আমাদের চেষ্টার কার্যকারিতা নির্ভর করছে এই অঞ্চলের গোষ্ঠীর নিজেদের পারস্পরিক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান ও জাতীয়,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষমতার উপর যাতে নিয়মমাফিক পরিবর্তন সম্ভবপর হয়।এই অধোগামী সামরিক অবস্থা,যার সম্মুখীন আমরা এখন হচ্ছি,আমাদের জন্য এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কাজে সাহায্য করা উত্তরোত্তর অসম্ভব প্রতিপন্ন হচ্ছে,যেটার প্রতি আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
আমার সরকার এখন ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে যে প্রতিকূলতা তৈরি হচ্ছে তা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিকূলতা প্রবল আকার ধারণ করেছে।পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সেনাদলের বহিরাক্রমন অনুমোদিত হয়েছে।এটা এখন পরিষ্কার যে পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্তে উভয় দেশের বাহিনী সামরিক যুদ্ধে লিপ্ত।এখন সর্বাপেক্ষা জরুরী এটাই যে এই শত্রুতার ইতি টানা যা একটি পরিপূর্ণ দ্বন্দ্বকে ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করতে পারে।আমরা এই জটিল বিষয়ে অচেতন নই যা এই দুঃখজনক ও বিপদজনক ঘটনার গোড়ায় নিহিত।কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই প্রত্যয়ে অতিরিক্ত জোর খাটাতে পারবেনা যে,বলের উপর অবলম্বন করে কোনো লাভ পাওয়া যাবে না শুধুমাত্র দক্ষিণ এশীয়দের জন্য আর বড় কোনো দুঃখজনক ঘটনা বয়ে আনা ছাড়া।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার দক্ষিণ এশিয়াতে এই বর্তমান সঙ্কটে মানুষের কষ্ট কমানো,যুদ্ধদমন এবং এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে বৃহত্তর পদক্ষেপ নিয়েছে।যুক্তরাষ্ট্র গোড়ার দিকেই ভারতের শরণার্থীদের ও পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষ এড়াতে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং দ্রুত সাড়া দিয়েছে উভয় দেশে বিপুল পরিমানে সহযোগীতা প্রদানের মাধ্যমে।আমরা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মানবিক প্রচেষ্টায় ২৪৫ মিলিয়ন দানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি।
দুর্ভিক্ষের সংকট এড়ানো গেছে,কিন্তু উভয় দেশেই বিপুল ত্রাণের প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান।সুতরাং মাননীয় রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসকে অতিরিক্ত ২৫০ মিলিয়ন দানের অনুরোধ জানিয়েছেন,যা পরবর্তী খাদ্য চালানের জন্য ব্যবহৃত হবে,যদি প্রয়োজন হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার,ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে এবং যুদ্ধ এড়াতে সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছে যা মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি করত ও শরণার্থীদের নিজ ঘরে ফেরা বিলম্বিত করত।আমরা ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশকেই যুদ্ধ,যা সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করে,এড়াতে আহ্বান জানিয়েছি।বিশেষভাবে,যুক্তরাষ্ট্র সরকার উভয় দেশকে তাদের সীমান্ত থেকে সামরিক বাহিনী সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।পাকিস্তান এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।দুঃখজনকভাবে,ভারত করেনি।যুক্তরাষ্ট্র বারংবার তাদের বক্তব্য স্পষ্ট করেছে যে,ঊর্ধ্বগামী সামরিক উত্তেজনার কারণে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের গতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে যার ফলস্বরূপ শরণার্থীরা তাদের ঘর ছাড়ছে এবং গেরিলা যুদ্ধ উদ্দীপনা পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায়।যুক্তরাষ্ট্র ভারত সরকার কে দেখিয়েছে যে,শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান ও শরণার্থীদের ফেরত যাওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অগ্রগতিতে ক্রমবর্ধমান সামরিক উত্তেজনা বাধা সৃষ্টি করছে।
আমরা চিহ্নিত করেছি যে পূর্ব পাকিস্তান এখনো একটি মৌলিক রাজনৈতিক বাসস্থান লাভ করেনি।যখন আমরা অবিরত এটাই অনুভব করছি যে রাজনৈতিক সমাধান-ই একমাত্র আদর্শ সমাধান,তখন আমরা পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে একটানা হিংস্রতার কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না।পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে উন্নতির উদ্দেশ্যে জরুরি ভিত্তিতে এই শত্রুতার তাৎক্ষণিক অবসান ও সৈন্য প্রত্যাহার প্রয়োজন।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য শক্তির আশ্রয় নেয়া গ্রহণযোগ্য নয়।ভারতীয় কর্মকর্তারা এখন ঘোষণা করেছে যে নিয়মিত ভারতীয় সৈন্যদের আদেশ দেয়া হয়েছে ভারতীয় প্রতিরক্ষা সচিবের সংবাদে দেয়া বক্তব্য অনুসারে পূর্ব পাকিস্তানে “কোনো সীমাবদ্ধতা ছাড়া” কর্মকাণ্ড শুরু করার পদক্ষেপ নিতে।যে উদ্দেশ্য আমাদের এখানে একত্র করেছে-একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ার-তা ব্যহত হবে যদি এমন একটা পরিস্থিতি মেনে নেয়া হয় যেখানে কোনো সরকার যুক্তরাষ্ট্রের হুকুমনামা লঙ্ঘন করে সামরিক সৈন্য দ্বারা নিজের সীমান্ত অতিক্রম করে অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে।
আমরা বিশ্ববাসীকে এখন আমাদের সাথে যোগদানের আহ্বান জানাচ্ছি,তারা ভারত ও পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ করুক যাতে তারা অবিলম্বে তাদের সামরিক আভিমুখ্যের ইতি টানে-বৈদেশিক এলাকা থেকে অনতিবিলম্বে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।নিশ্চয় এই পরিষদ এমন বিক্ষুব্ধ অবস্থায় এর থেকে কম কোনো দাবি জানাতে পারে না।
প্রধান সচিব বিভিন্ন উপলক্ষে আমাদের সকলের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে।তিনি তাঁর নিজস্ব সৎ কর্মচারীদের এই সকল সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।দুঃখজনকভাবে,ভারতীয় সরকার তাঁর এই শুভচিন্তাকে স্বাগত জানায়নি।অতি সম্প্রতি,২০ই অক্টোবর,তিনি প্রধানমন্ত্রী গান্ধী ও ইয়াহিয়াকে চিঠির মাধ্যমে সতর্ক করেছেন যে, “এই পরিস্থিতি দুই দেশের মধ্যে খুব সহজেই দুর্ঘটনামূলক প্রতিপন্ন হতে পারে,কিন্তু পূর্ণবিস্তৃত শান্তির জন্য বিশাল হুমকি তৈরী করতে পারে”।
যখন উভয় সরকার শান্তির প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে স্বীকৃত হয়েছেন এবং শত্রুতা না করা নির্ধারণ করেছেন,পরিস্থিতি নিম্নগামী হচ্ছে এখন পর্যন্ত নিয়মিত সৈন্যদল বিভিন্ন দফায় নিযুক্ত আছে।
এখনি সময় যাতে আমরা প্রধান সচিবের আহ্বানে মনোযোগ দেই।এখনি সময় উভয় দেশ অনতিবিলম্বে বৈদেশিক এলাকা থেকে সৈন্যদল প্রত্যাহার করার পদক্ষেপ নেয় ও ইতি টানে।এখনি সময় ভারত সরকার পাকিস্তান সরকারের সাথে যোগদান করে প্রধান সচিবের সৎ কর্মচারীদের সহযোগিতার মাধ্যমে পুনর্মিলন প্রক্রিয়ার প্রস্তাবের ব্যপারে চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিত।
আমরা সবাই প্রচুর যুদ্ধ দেখেছি।আমরা সকলে দেখেছি ও শুনেছি যেসব সমস্যা আমাদের বিভক্ত করে তা সমাধানে জোর দেয়ার কথা।সেই সময় এখন অতীত যখন আমাদের-ই কেউ যথার্থই যুদ্ধকে অবলম্বন করে প্রতিবেশী দেশে পরিবর্তন আনতে গিয়েছে যেটা হয়তবা আমাদের জাতীয় স্বার্থে মানানসই হিসেবে আমরা দেখে থাকি।আমরা সবাই জানি যে নিশ্চিতভাবে ভারত ও পাকিস্তানের নেতারা জানেন যুদ্ধের ভয়াবহ খরচের কারণে মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে না।
তাহলে আমরা সকলে দ্রুত সম্মত হই যে এই দুঃখজনক সময়ের দরকারি পদক্ষেপ নিয়ে ইতি ঘটানো এবং দেরি না করে বৈদেশিক এলাকা থেকে সৈন্যদল প্রত্যাহার করতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা গঠনে অগ্রগতি হতে পারে,যার মাধ্যমে শরণার্থীরা ফিরে আসতে পারে ও শান্তি নিশ্চিত হয়।যুক্তরাষ্ট্র সংগঠনের মাধ্যমে যথোপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে সহায়তা করতে প্রস্তুত শত্রুতার অবসান ঘটাতে ও সৈন্যদল প্রত্যাহার করতে যাতে এই এলাকায় রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে উন্নতিসাধনের প্রক্রিয়ায় স্থায়ী শান্তি তৈরী হয়।
একটি প্রচেষ্টায় রক্তপাত বন্ধ,জীবন বাঁচানো,অকথিত কষ্ট লাঘব করতে আমরা একটি খসড়া সমাধান প্রবর্তন করেছি যা শীঘ্রই জারি করা হলে আরেকটি ভয়ানক যুদ্ধ থেকে পৃথিবীর মানুষ পরিত্রাণ পেতে পারে।আমার সরকারের পক্ষ হতে,আমি এই খসড়া সমাধান জমা দিচ্ছি যা আমাদের দৃষ্টিতে পরিস্থিতির দাবি পূরণ করবে।আমি খুব সংক্ষেপে এটা পড়ে শোনাতে চাই।
প্রতিরক্ষা সংগঠন
ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিগণের বক্তব্য শোনা হয়েছে,মানা হচ্ছে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধবিগ্রহ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
১। ভারত ও পাকিস্তান সরকারকে লড়াই বন্ধের জন্য অবিলম্বে জরুরী সকল পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানানো;
২। অনতিবিলম্বে ভারত-পাকিস্তান সীমানার অপরদিকে অবস্থানকারী অস্ত্রধারী কর্মীবৃন্দদের প্রত্যাহার করে নিজ নিজ জায়গায় ফিরানো;
৩। প্রধান সচিব,ভারত বা পাকিস্তান সরকারের অনুরোধে,ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করবে যাতে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্যদল প্রত্যাহার বাস্তবায়নের উপর প্রয়োজনমত প্রতিবেদন দিতে পারে ইউএনমোজিপি কর্মীবৃন্দকে।
৪। ভারত এবং পাকিস্তান সরকার ও অন্যান্য সম্পর্কিতদের আহ্বান জানানো যেন তারা তাদের উত্তম প্রচেষ্টা জাহির করার মাধ্যমে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা নিজ উদ্যোগে ফিরে আসে;
৫। সকল রাষ্ট্রকে আহ্বান জানানো যাতে এলাকার শান্তি নষ্ট হয় এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকে;
৬। ভারত ও পাকিস্তান সরকার কে আমন্ত্রণ জানানো যাতে তারা প্রধান সচিবের সৎ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে উপমহাদেশের নিরাপত্তা ও শান্তি বজায় রাখার প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেয়;
৭। প্রধান সচিবকে অনুরোধ করা যাতে নিরাপত্তা সংগঠন কে এই সমাধান বাস্তবায়নের উপর প্রতিবেদন পাঠায়”।