You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.05 | জাতিসঙ্ঘের সাধারন পরিষদে মিঃ মাহমুদ আলীর  বিবৃতির অংশবিশেষ | জাতিসঙ্ঘ ডকুমেন্টস - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
জাতিসঙ্ঘের সাধারন পরিষদে মিঃ মাহমুদ আলীর  বিবৃতির অংশবিশেষ জাতিসঙ্ঘ ডকুমেন্টস ৫ অক্টোবর, ১৯৭১

দেশভাগের সময় আমরা (পূর্ববঙ্গের মানুষ) পাকিস্তানের মাত্র একপঞ্চমাংশ ভূমির মালিকানা পাই যা নানান সমস্যায় পূর্ণ ছিল। যেভাবে ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা ভাগ করা হয়েছে তাতে আমাদের ঠকানো হয়েছে নিদারূনভাবে।আমরা আমাদের প্রতিবেশীর সাথে সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।স্বাধীনতার মাত্র দুইমাস পরেই ভারত দেশভাগের মূলনীতি সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করে, যখন তারা মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু ও কাশ্মীরে সৈন্য পাঠায়। সেই সৈন্যরা একজন স্বেচ্ছাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জনগনের বৈধ প্রতিরোধকে চুরমার করে দেয়।ভারত এইরকম আচরণ করার সুযোগ পায় বিদায়ী সাম্রাজ্যবাদী শাসকের কারণে।পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার মুসলিম অধ্যুষিত জায়গা যা ভারতকে দিয়ে দেয়া হয় সেটাকে ব্যবহার করে ভারত কাশ্মীরের অনুপ্রবেশের পথ হিসেবে। আমরা কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্য পাঠানোর নিন্দা করি যা ভারত ও আমাদের স্বাধীনতার মূলনীতির বিরোধী এবং উপনিবেশিক শাসকের মত আচরণ। ভারত আমাদের বলেছিল যে এই অনুপ্রবেশ সাময়িক, কাশ্মীরের শাসক যিনি তার জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত তার শাসনের প্রতি ভারতের হস্তক্ষেপ অস্থায়ী এবং কাশ্মীরের জনগণ তাদের নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই এক নিরপেক্ষ গণভোটের মাধ্যমে গড়ে তুলবে। পরবর্তীতে এই বিরোধ যখন জাতিসঙ্ঘে নিয়ে যাওয়া হল, ভারতের এই অঙ্গীকার আন্তর্জাতিক চুক্তিতে পরিণত হল। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই গণভোটের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরের আত্ননিয়ন্ত্রণ এর অধিকার পাওয়ার জন্য জাতিসঙ্ঘের সমাধান মেনে নিল। আজকের দিন পর্যন্ত সেই চুক্তি অবাস্তবায়িত অবস্থায় আছে। এই বিরোধ দুইবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের সূচনা করেছে। এটি আমাদের সম্পর্কে টানাপোড়েনের সৃষ্টি করেছে যা আমাদের দুই পক্ষেরই ক্ষতি করেছে। অথচ এত ক্ষতির পরও ভারত এখন পর্যন্ত কাশ্মীরের লোকজনকে সাথে নিয়ে কোন সমাধানের উদ্যোগ নেয়নি।
জম্মু ও কাশ্মীর এর দখলকৃত অংশে ভারত একটি পুতুল সরকার টিকিয়ে রেখেছে এবং সেখানে যে-ই জাতিঘসঙ্ঘের সমাধানের দাবি জানায় তাকেই শাস্তির মুখোমুখি করা হয়। কাশ্মীরের খ্যাতিমান নেতা শেখ আব্দুল্লাহকে ১৫ বছর বন্দী করে রাখা হয়েছিল এবং এখন তাকে তার জন্মভূমিতে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখা হয়েছে।জনপ্রিয় দলগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখা হয়েছে, যেমন প্লেবিসিট ফ্রন্ট, যারা জম্মু ও কাশ্মীর এর লোকেদের আত্মনিয়ন্ত্রণ এর অধিকার চায়। রাজনৈতিক কর্মীদের উপর নির্যাতন, জনসমাবেশে ক্রমাগত গুলি, দেশপ্রেমিক নাগরিকদের ক্রমাগত হয়রানি করা ভারতের দখলকৃত কাশ্মীরের মানুষের জীবনের ভয়ানক দিক। বহু লোক সেখান থেকে পালিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে। ভারত সরকার তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য কোন ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করেছে।

ভারতের এই রকম মানসিকতার আরেকটি পরিচয় পাওয়া যায় গংগা নদীর পানির সমবন্টন নিয়ে বিরোধ সামাল দেয়ার চেষ্টায়। গঙ্গা নদী ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেই প্রবাহিত হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান পড়েছে ভাটিতে। ভারত তার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ফারাক্কা নামক স্থানে একটা ব্যারাজ নির্মাণ করেছে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে গঙ্গার পানিকে খালের মাধ্যমে অন্য একটি নদীতে প্রবাহিত করা। এর ফলে শুকনো মৌসুমে পূর্ব-পাকিস্তান খুবই অল্প পরিমাণ পানি পাবে অথবা পাবেই না। ফলে সেই অঞ্চলের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের নিজেদের ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী এই ব্যারাজ পূর্ব পাকিস্তানের সাতটি জেলার ৩৬ লাখ একর ভূমির জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। এটি গঙ্গার পানি প্রবাহ ও এর অসংখ্য খাল ও শাখানদীকেও আক্রান্ত করবে। এটি কৃষি উৎপাদন, শহরের পানির চাহিদা মেটানো, শিল্প-কারখানায় পানির ব্যবহার এবং ফিশারিজ ও বনভূমি বিশেষ করে সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ফেলবে। ফারাক্কার পরে, পাকিস্তানের অংশে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে গেলে এটি নদী-তীরবর্তী এলাকায় পলিমাটির জমাট বাড়াবে এবং বর্ষাকালে বন্যার সম্ভাবনা বাড়াবে। এই সমস্ত ব্যাপার গুলি প্রায় আড়াইকোটি লোকের জীবন ও জীবিকাকে আক্রান্ত করবে, যা পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার তিনভাগের একভাগ।
এটি দূর্ভাগ্যজনক হলেও বিস্ময়কর নয় যে, ভারত একই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের লোকেদের জন্য সচেতনতার ভান করেছে, আবার একই সাথে এই অঞ্চলের অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য নানারকম প্রকল্প নিয়েছে। অন্য অনেক ইস্যুর মতই ভারতকে এই ইস্যুতে পাকিস্তানের তরফ থেকে আলোচনা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যখনই আলোচনার সময় আসে, তারা নানা কৌশলে প্রকৃত সমস্যা এড়িয়ে যায়।

আমি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দুইটি প্রধান বিরোধের কারণ উল্লেখ করেছি। এই বিরোধ ছাড়া এবং পাকিস্তানকে দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন করার অতীত ভূমিকা ব্যতীত, বর্তমান ভারত ও পাকিস্তানের পরিস্থিত এমন এক হুমকির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে যাতে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা অচিন্তনীয়। ভারতীয় শাসকরা যদি যুদ্ধংদেহী না-ই হত, তাহলে কি তারা প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ নেয়ার অস্বাভাবিক ও বিরক্তিকর চেষ্টা করত? তারা কি বিবেকের পরিচয় দিয়ে আমাদের নিজস্ব ব্যাপারে নাক গলানো থেকে বিরৎ থাকত না? আজকে আমার দেশ ও ভারতের সীমান্তে যে ঘটনা ঘটছে তা সাধারণ ছোটখাট সীমান্ত সংঘর্ষ নয়। এটি জাতিসংঘের এক সদস্য দেশ পাকিস্তানের ভূমির উপর জাতিসংঘের আরেক সদস্য দেশ ভারতের অস্ত্রসজ্জিত অনুপ্রবেশ।
ভারত গত কয়েকমাস ধরেই পাকিস্তানের সাথে চোরাগোপ্তা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের নিজের ভূমিতে সরকার যে রকম সামরিক অভিযানই চালাক না কেন, ভারতের তাতে আতংকিত হওয়ার কোন কারণ ছিল না, তারপরও তারা পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে ২,০০,০০০ সৈন্য ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র জমায়েত করেছে। এই বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে ক্রমাগত গোলা ও মর্টার নিক্ষেপ করে চলেছে। তারা প্রায়ই সশস্ত্র সৈন্যদের পাঠাচ্ছে আমাদের ভূমিতে, যারা ধ্বংস ও মৃত্যুর কারণ হচ্ছে।তারা নানাবিধ অস্ত্র মোতায়েন করছে এবং প্রায় সময়ই তারা নানা অন্তর্ঘাতী কাজ করে পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনীতি পঙ্গু করার চেষ্টা করছে।

সংক্ষেপে বলা যায়, ভারত আমাদের সাথে পুরোপুরি যুদ্ধবাজদের মত আচরণ করছে এবং পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়নি কারণ পাকিস্তান সরকার যথেষ্ট সংযত আচরণ করছে।
গোলা ও মর্টার নিক্ষেপ এবং অন্যান্য সহিংস আচরণ আমাদের সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাকে এই সভায় দুইটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করতে দিন যাতে বোঝা যাবে বর্তমানে আমরা কি পরিস্থিতিতে আছি।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী সিলেট জেলার সীমান্তে পাঁচটি স্থানে প্রায় ১০০০ গোলা নিক্ষেপ করে। ভারতীয় গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত গ্রামগুলো হচ্ছে মান্তালা, কমলাপুর, জয়পুর,আরামনগর,হর্ষপুর। ১২ জন নারী ও ৮ জন শিশুসহ মোট ২৮ জন গ্রামবাসী নিহত হয়েছে, আহত আরো ৩০ জন।এই হতাহতদের মধ্যে টেলিফোন বিভাগের কয়েকজন কর্মীও আছে যারা সেই সময় সেখানে টেলিফোনের লাইন ঠিক করছিল। টেলিযোগাযোগের লাইনগুলো ভারতীয় বাহিনীর বিশেষ লক্ষ্যবস্তু। গোলা নিক্ষেপের পরে ভারতীয় বাহিনী এই এলাকাগুলোতে অনুপ্রবেশ করে। পাকিস্তান বাহিনী সেখানে অভিযান চালায় এবং নানারকম অস্ত্র উদ্ধার করে যার মধ্যে আছে হালকা মেশিনগান, ১৪৫ বাক্স গোলাবারুদ, ১০০ ইস্পাতের হেলমেট, ৪০ টি মাইন,কয়েকটি ওয়ারলেস সেট এবং ৩৮৭ টি গ্রেনেড।
ভারত পাকিস্তানের খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রীর সরবরাহ লাইনের উপর হামলা করে একটা দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি করতে চাইছে। কিছুদিন আগে “চালনা”য় আমেরিকান খাদ্যাবাহী জাহাজের ক্ষতিসাধনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ কয়েকজন দুর্বৃত্তকে আটক করেছে যারা ভারতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থিত পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য আনা খাদ্যাবাহী জাহাজগুলো ডোবানোর জন্য নিয়োজিত। এই দুর্বৃত্তরা ভারত থেকে মাইন এবং এর ব্যবহারের শিক্ষা পেয়েছে। ভারত তার নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পূর্ব-পাকিস্তানের সাড়ে সাতকোটি জনগণের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ঘটাতে চাইছে এইসব অন্তর্ঘাতী কাজ করে। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পূর্ব-পাকিস্তানের খাদ্য সংকটের ব্যাপারে সচেতন থাকে তাহলে ভারতকে এইসব অন্তর্ঘাতী কাজ থেকে বিরত রাখা তাদের দায়িত্ব। এইদিকে যদি নজর দেয়া না হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘের কর্তব্য আরেকটি ধ্বংসযজ্ঞ থেকে দক্ষিণ এশিয়াকে রক্ষা করা।
গত ২০ জুলাই, জাতিসংঘের মহাসচিব উ-থান্ট একটি স্মারকলিপি প্রদান করেছেন যেখানে উপমহাদেশের শান্তির প্রতি হুমকির ব্যাপারে তার উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। মহাসচিব এই অঞ্চলের অবস্থার ক্রমাগত অবনতিতে শংকা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন,
“বর্তমান পরিস্থিতে আরো একটি বিপদ আছে, (দুপক্ষের মধ্যে) অমীমাংসিত সমস্যা সমূহ, যেটার কারণে ছয়বছর আগে একটা যুদ্ধ ঘটে গেছে”

সীমান্তের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন,
“পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের অবস্থা খুবই ঝামেলাপূর্ণ, সীমান্ত সংঘর্ষ,চোরাগোপ্তা হামলা,অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপ ক্রমাগত বাড়ছে…”
এবং তিনি শুধু এই অঞ্চল নয়, সমগ্র বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকির উল্লেখ করে বলেন,
“জাতিসংঘে আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারব না যে উপমহাদেশের যুদ্ধ খুব সহজেই ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে”
সংক্ষেপে বলা যায়, উ থান্ট পরিষ্কারভাবে বর্তমান অবস্থাকে শান্তির প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছেন এবং নিরাপত্তা পরিষদের কাছে আবেদন করেছেন যে তারা যেন বর্তমান পরিস্থিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ ও সতর্কতার সাথে বিবেচনা করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
২৯ সেপ্টেম্বরে আমার উত্তরে আমি উল্লেখ করেছি যে আমার সরকার নিরাপত্তা পরিষদের সাথে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত এবং আমাদের দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর জন্য কাউন্সিলের জন্য একটি উপযুক্ত অফিস কমিটি বানানোর প্রস্তাবকে স্বাগত জানাচ্ছে। আমি এখানে আমাদের এই প্রস্তুতির কথা পুনরাবৃত্তি করছি।
অপরদিকে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি যথারীতি বিপরীত। তারা দাবি করে এটি ভারত বনাম পাকিস্তানের সমস্যা নয়। তারা বিশ্ববাসীকে বিশ্বাস করাতে চায় এই সমস্যা সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তান তৈরি করেছে এবং ভারত তার পরোক্ষ শিকার হিসেবে অসংখ্য শরনার্থীর বোঝা বহন করছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য কি? ভারতের অনুপ্রবেশ হচ্ছে প্রকৃত সত্য যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি।

বিশ্ববাসী পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে গত কয়েকমাসে অনেক শুনেছে। বেশিরভাগ কথাই এসেছে বহিরাগতদের কাছ থেকে। তাদের সবারই সত্য বলার দায় নেই। অনেকে মহত্ত্বের ভান করে থাকে। কিন্তু আমি আমার ব্যক্তিগত মতামতই বলতে চাই। আমি পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছি। ভারতের বিদেশমন্ত্রীর মত আমি ভুল বিবৃতি ও অপপ্রচার এর বিলাসিতা করতে পারি না। এই সম্মেলন থেকে আমি সোজা পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাব। আমাকে আমার লোকেদের মধ্যেই বাঁচতে হবে, তাদের মতই কষ্ট সহ্য করতে হবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য যেকোন মানবিক উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাব। আমার দুঃখ এই যে, আমাদের দেশের পরিস্থিত বিশ্ববাসীর কাছে ঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি, অনেক ভুল বুঝছে। বিভিন্ন তথ্য এমনভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে যে মনে হবে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান এর মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এই বেদিতে আজ একজন পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের কন্ঠকে তোলে ধরা হোক যে কন্ঠ ঘোষণা করবে যে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ পরস্পরের ভাই, তাদের ঐক্য অবিনশ্বর, এবং তারা যখন একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন করবে সেটি হবে প্রত্যেকের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্বলিত। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এই বাস্তবতা নিয়ে আগেও অনুশোচনা করেনি, এখনও করে না। এটা সত্য যে আমাদের আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন নিয়ে সমস্যা আছে, জাতীয় সম্পদের সঠিক বন্টন ও দুই অঞ্চলের তারতম্য দূর করা নিয়ে সমস্যা আছে। কোন বহুভাষী ও বহুজাতি সম্বলিত রাষ্ট্রই এই সমস্যাগুলো থেকে মুক্ত নয়। এক রাষ্ট্রের সমস্যায় অন্য রাষ্ট্রের খুশি হওয়া উচিত নয়। আমরা পাকিস্তানীরা খুবই দুখজনক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছি, আমরা চরমপন্থার রুপ দেখেছি, আমরা অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গেছি। কিন্তু এসবের পরেও আমরা উপলব্ধি করেছি যে আমাদের রাষ্ট্রসত্তার ভাঙ্গন, আমাদের ঐক্যের বিনাশ কোন সমাধান নয়, যা অন্য অনেকে মনে করে।
এটা খুবই দূর্ভাগ্যজনক যে, আমাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি একটি সহিংস পরিস্থিতির তৈরি করেছে। পাকিস্তানের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভারতের সাথে এর সম্পর্কের কথা মনে না রাখলে কেন এই অবস্থা তৈরি হয়েছে বোঝা যাবে না।

কিন্তু এই সমস্যার মূলে রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকারকে দমন করা- এটি কষ্টকল্পনা। পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাহলে তারা অপেক্ষাকৃত কম স্বাধীন হল কিভাবে? যেখানে তারাই কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের ক্ষমতা রাখে। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরা নিজেরাই পারে তাদের ভুলগুলো ঠিক করতে, নিজেদের মধ্যকার ভারসাম্যহীনতা দূর করতে। একটা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ নিজেরাই বের হয়ে যেতে চাইবে এটা অবিশ্বাস্য। বিচ্ছিন্ন হতে চায় সাধারণত সংখ্যালঘুরা। আমি আবারও বলছি পূর্ব পাকিস্তানীরা পাকিস্তানে সংখ্যালঘুও না, আদিবাসীও না। এই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এই অঞ্চলের জনগণের বৃহৎ অংশের প্রতিনিধিত্ব করে না। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে তারা নিজেরাৎ(বিচ্ছিন্নবাদীরা) সংখ্যালঘু হয়ে গেছে, তাদের অবস্থান বলে দিচ্ছে যে জনগণের তাদের সাথে নাই। এই রকম বিচ্ছিন্নতা রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে দিতে পারে, বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিতে পারে। এই রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে পূর্ব পাকিস্তানী বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই দায়ী থাকবে।
পূর্ব পাকিস্তানের বিশৃংখলা আর ভারতের প্রতিক্রিয়া পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কয়েকমাস ধরেই ভারতের যুদ্ধ প্রস্তুতি অরক্ষিত সীমান্ত থেকে ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্থানের অভ্যন্তরে এগোচ্ছে। সকংটের শুরুতেই ভারত তাদের সীমানার উপর দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। এর মুলে রয়েছে এক ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা। কিন্তু পরবর্তীতে নিরপেক্ষ তদন্তে দেখা যায় এই ছিনতাই এর সাজানো ঘটনা ঘটিয়েছে ভারতীয় অফিসাররাই, ভারতের উপর দিয়ে পাকিস্তানের বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করার একটা অজুহাত তৈরির জন্য। নিষিদ্ধকরণ অবৈধ এবং ভারতের আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার সাথে সাংঘর্ষিক। এখন পর্যন্ত ভারত এই সমস্যা সমাধানের সব আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রত্যাখান করেছে। যখন সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়েছে, পাকিস্তান কঠিন বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তখন ভারত আমাদের দুই সীমান্তেই সৈন্য সমাবেশ করেছে।
বাইরের শক্তির এই হুমকি এবং দেশের অভ্যন্তরের গোলাযোগ, এই দুই পরিস্থিতির কারণে দেশের ভিতর নৈরাজ্য ও ভারতের হস্তক্ষেপ বন্ধে পাকিস্তান সরকার নিরুপায় হয়ে সব রকম ব্যবস্থা নিয়েছে। আমি এই সভায় উপস্থিত সকল সম্মানিত প্রতিনিধিদের কাছে জানতে চাই, এই রকম পরিস্থিতে কোন বৈধ সরকারের হাতে আর কি উপায় আছে?
পূর্ব পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের কারণে সৃষ্টি হওয়া বর্তমান পরিস্থিতি খুবই দুঃখজনক। কিন্তু বিশ্ববাসী এখনও সম্পূর্ণ জানে না যে এই পরিস্তিতির পেছনে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ কতটা দায়ী। শরণার্থী সমস্যার কারণে ভারতের যে উদ্বেগ তা সম্পূর্ণ মানবিক, কিন্তু এটা সম্পুর্ণ ভিন্ন আলোচনার বিষয়। শরণার্থীদের ঘরে ফেরার বিষয়টি পাকিস্তান সরকারের সহযোগিতা নিয়ে সমাধান করা যেত। আমাদের ও জাতিসংঘের যৌথ সহায়তায় এটি সমাধান করা যেত,পাকিস্তানের সাথে আলোচনা করা যেত। এখানে রাজনৈতিক প্রভাব না খাটিয়ে, দুইপক্ষ একসাথে এই শরণার্থীদের তাদের ভি্টেয় ফিরে যেতে সহায়তা করতে পারত।
আমাদের জন্য যেটা সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, ভারত সরকার অপপ্রচার চালিয়ে এবং নানা কর্মকান্ডের মাধ্যমে শরণার্থী ইস্যুকে ব্যবহার করছে। সীমান্তে সংঘর্ষ ঘটিয়ে,মর্টার ও গোলা বর্ষণ করে ভারত আমাদের নাগরিকদের সীমান্ত অতিক্রম করা অসম্ভব করে রেখেছে।ভারত সীমান্তে এদের উপস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোর জন্য সদস্য সংগ্রহ করে থাকে।

এইটি হচ্ছে ভারত সরকারের নীতি, যাতে করে আমরা আমাদের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে না পারি। সাধারণ এমেনেস্টির ঘোষণা,আমাদের প্রেসিডেন্টের আবেদন, জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার এবং পূর্ব পাকিস্তানের তার প্রতিনিধির উপস্থিতি, ফিরে আসা শরণার্থীদের গ্রহণকেন্দ্র এবং তাদের পূনর্বাসন প্রকল্পের ব্যবস্থা করা-সকল ভাবেই আমরা ঘোষণা করছি যে, আমরা আমাদের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছি । ১৯ জুলাই তারিখে মহাসচিব উ থান্ট ভারত ও পাকিস্তান সরকার উভয়কে প্রস্তাব দিয়েছেন যে U.N.H.C.R এর সদস্যরা সীমান্তের দুই পাশেই অবস্থান নিয়ে শরণার্থীদের ফিরে আসার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবে। আমরা সানন্দে এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছি। আর ভারত, বলাই বাহুল্য, প্রত্যাখান করেছে।
ভারত সরকার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পেছনে যে যুক্তি দেখিয়েছে তা হল শরণার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসা নিরাপদ নয়। প্রথমত, ভারত নিজেই এই ফিরে আসা অনিরাপদ করে রেখেছে। দ্বিতীয়ত, “নিরাপদ পরিস্থিতি” বলতে ভারত বুঝিয়েছে, তাদের বিদেশমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, ভারতের পছন্দসই একটি রাজনৈতিক সমাধান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য নেতারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে যে তারা শরণার্থীদের ফিরে যেতে দিবে শুধুমাত্র যখন তথাকথিত “বাংলাদেশ” প্রতিষ্ঠিত হবে। সোজায় কথায় যখন পূর্বপাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হবে এবং ভারতের অধীনে আসবে।
এক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন বিষয়ে অন্য রাষ্ট্রের নগ্ন হস্তক্ষেপের এই চেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ কি আর আছে? মাত্র গত বছরেই ভারত সরকার আমাদের সকলের সাথে জাতিসঙ্ঘের চার্টারে স্বাক্ষর করেছে যেখানে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা শক্তিশালী করণের কথা বলা হয়েছে এবং দেশের আকার, অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক অবস্থান, সামাজিক, রাজনৈতিক পদ্ধতি নির্বিশেষে কোন রাষ্ট্র অন্য কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। এবং এই শর্ত সমূহ কোন অবস্থাতেই শিথিলযোগ্য নয়।
ভারতের এই হস্তক্ষেপ পাকিস্থানের একার সমস্যা নয়। এটি সকল রাষ্ট্রের সমস্যা, যারা নিজেদের সার্বভৌমতা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চায়। পরস্পরের উপর হস্তক্ষেপ না করার নীতির সাথে যদি আপোষ করা হয় তাহলে সকল রাষ্ট্র যারা তাদের প্র্তিবেশীর চেয়ে ছোট বা দুর্বল তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। আমি এই সভার নিকট আবেদন করব যাতে তারা ভারতের মনোভাব পরিবর্তন করতে শক্তি প্রয়োগ করে। আমাদের কথা যদি জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে বলব আমরা ভারতের এই বলপ্রয়োগ ঠেকিয়ে আমরা একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌছতে চেষ্টা করব আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায়।
ভারত যে উপমহাদেশে আরো কিছু সমস্যা তৈরি করেছে আমরা যেন তা ভুলে না যাই। নাগা জনগণ যারা ভারতীয় নয় তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত এর নিজের সীমানার ভেতরে ছোট ছোট আদিবাসী সম্প্রদায় গুলোর উপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে দ্রাবিড় জনগণ, শিখ ও বাংগালিরা। কিন্তু আমরা এইগুলোকে ইস্যু বানিয়ে ভারতের নিজস্ব ব্যাপারে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করিনি। আমরা শুধু চাই ভারত আমাদের মতই উপলব্ধি করুক যে নৈরাজ্য ও বিচ্ছিন্নতা তাদের জন্যও বিপদজনক।
আমি যদি বর্তমান ভারত পাকিস্তানের সম্পর্ক এককথায় বলি, তাহলে বলতে হবে যে, এই পরিস্থিতি শান্তির জন্য ভয়াবহ হুমকি যা অবশ্যই দূর করা উচিত যদি এই দুই দেশ নিজেদের নাগরিকদের জীবনমান উন্নত করতে চায়। আমরা ভারতের জনগণকে আমাদের শত্রু মনে করি না। যদিও এটা পাকিস্তানের দিকে আক্রমণ, পাকিস্তানের জনগণের প্রতি ভারত সরকার এর বিশ্বাসভঙ্গতা। আমরা আশা করি ভারত উপলব্ধি করবে যে শক্তিশালী পাকিস্তান ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি অসম্ভব। একইভাবে আমরা আরো আশা করব পৃথিবীর সকল বড় বড় শক্তি এইটি উপলব্ধি করবে যে পাকিস্তানকে দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্য ও স্থায়িত্ব নষ্ট করবে এবং এর ফলে চির অশান্তি তৈরি হবে।