You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
নিরাপত্তা পরিষদে পূর্ববংগ পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিবেদন জাতিসংঘ ডকুমেন্টস ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১

নিরাপত্তা পরিষদে পূর্ববংগ পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিবেদন
S/10410 ডিসেম্বর ৩, ১৯৭১

বিভিন্ন সূত্র থেকে মহাসচিবের কাছে আসা সাম্প্রতিক প্রতিবেদন গুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তসহ উপমহাদেশের অপরাপর অঞ্চলসমূহে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। এই পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বিবেচনা করে মহাসচিব এ পর্যন্ত এ সমস্যার বিষয়ে যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন সে বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে প্রতিবেদন পেশ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। জাতিসংঘ সনদের ধারা ৯৯, যা ব্যক্ত করে যে, “মহাসচিব তার মতানুসারে যা কিছু আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে বিবেচনা করবেন তা নিরাপত্তা পরিষদের গোচরীভূত করতে পারেন।”, অনুসারে মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে এ বিষয়ে অবগত রেখেছেন। মহাসচিব মনে করেন পার্টিগুলো নিজেরা অথবা নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের দ্বারা পরিষদে এ বিষয়ে উদ্যোগ গৃহীত হতে পারে।

২। এই প্রতিবেদনটিতে ভারতে পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থী এবং পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অবস্থিত দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠী, উভয়ের জন্য মহাসচিব কর্তৃক ইতোমধ্যে গৃহীত মানবিক উদ্যোগ সমূহ অন্তর্ভুক্ত নয়। এ সংক্রান্ত তথ্য জুলাই, ১৯৭১ এ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে এবং নভেম্বর, ১৯৭১ এ সাধারণ পরিষদে(তৃতীয় কমিটি) পেশ করা হয়েছে। নভেম্বরের ২২ তারিখে তৃতীয় কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে একটি খসড়া রেযল্যুশন অনুমোদন করেছে যা সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে মহাসচিবের উদ্যোগসমূহ অনুমোদন করবে এবং মহাসচিব ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংক্রান্ত হাই কমিশনারকে অনুরোধ করবে আন্তর্জাতিক সহায়তা সমন্বয়ে তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে এবং ভারতে শরণার্থীদের এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে এর সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত সাধারণ পরিষদ তৃতীয় কমিটির খসড়া রেযল্যুশনটি অনুমোদনের জন্য বিবেচনা করেনি।

৩। ২০ জুলাই, ১৯৭১ তারিখে, মহাসচিব নিম্নোক্ত স্মারকলিপিটি নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি বরাবর পেশ করেছেনঃ

(ক) বর্তমানে কিছু মাস যাবত, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যবৃন্দ এবং জাতিসংঘের আরও বহু সদস্য পূর্ব পাকিস্তান ও সংলগ্ন ভারতীয় প্রদেশ সমূহের পরিস্থিতির পরিণতি অথবা সম্ভাব্য পরিণাম সম্পর্কে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। আমি নিজে মার্চ ১৯৭১ এর ঘটনাসমূহের পরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার উদ্বেগ ব্যক্ত করেছি এবং তখন হতেই পাকিস্তান ও ভারত সরকারের সাথে জাতিসংঘে তাদের সংসদীয় প্রতিনিধি এবং অন্যান্য সূত্র, উভয়ের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে আসছি। এ ক্ষেত্রে আমি মানব কল্যাণ ও মানবিক নীতি উন্নয়ন ও নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ সনদের ধারা ২, অনুচ্ছেদ ৭ এর বিধানাবলী পালন করা এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সহযোগিতার কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করার বিষয়ে জাতিসংঘ সনদ অনুসারে মহাসচিব সহ জাতিসংঘের দ্বৈত দায়িত্ব সম্পর্কে কঠোরভাবে সচেতন ছিলাম।

(খ) এই পরবর্তী দায়িত্বটির কথা মনে রেখেই আমি ভারতে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ, উভয়ের জন্য সহায়তার আবেদন করেছিলাম। ঐ আবেদনের প্রেক্ষিতে পাওয়া সহায়তা সমূহকে সঞ্চালিত করার লক্ষ্যে আমি জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারকে ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে মনোনীত করেছি ভারতে অবস্থানরত পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য, আর পাকিস্তান সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে ঢাকায় একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে যথাসম্ভব কার্যকরভাবে আন্তর্জাতিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য। এই উভয় প্রকার মানবিক সাহায্য সংক্রান্ত প্রতিবেদন অন্যত্র সবিস্তারে পেশ করা হয়েছে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ উভয় অপারেশনের বিষয়ে পরিষদের কাছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার এবং আন্ত-সংস্থা বিষয়ক সহকারী মহাসচিব কর্তৃক প্রদত্ত বিবৃতির ভিত্তিতে ১৬ জুলাই, ১৯৭১ তারিখে সম্পূর্ণ আলোচনা করেছেন। আমি এ সুযোগে আমার আবেদনে উদারভাবে সাড়া দেয়ার জন্য সরকারসমূহ, জাতিসংঘের সংস্থা ও প্রোগ্রামসমূহ এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসমূহের প্রতি আমার উষ্ণ কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করছি। একইসাথে আমি এক্ষেত্রে আমার প্রতিনিধিদের সহযোগিতা করার জন্য ভারত ও পাকিস্তান সরকারকেও সাধুবাদ জানাচ্ছি।

(গ) গত মার্চ থেকেই সময় যতই বয়ে যাচ্ছিল, আমি ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি এবং শঙ্কা বোধ করেছি ঐ অঞ্চলে প্রায় সকল ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অব্যাহত অবনতি লক্ষ্য করে। সহায়তার জন্য আমার আবেদনের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদার সাড়া সত্ত্বেও প্রাপ্ত অর্থ ও সামগ্রীসমূহ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং ভারত সরকার এখনও অনির্দিষ্ট সময়কালের জন্য লাখো শরণার্থী, যাদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে, তাদের ভার বহনে ভয়াবহ এবং সংহতিনাশক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে দু’টো পরপর বিপর্যয় মোকাবেলা করতে, যার একটি প্রাকৃতিক, আন্তর্জাতিক ও সরকারি উদ্যোগ ক্রমবর্ধমান হারে ব্যাহত হচ্ছে রাজনৈতিক সমঝোতার পথে উল্লেখযোগ্য উন্নতির অভাব এবং পূর্ব পাকিস্তানে আইন, শাসন ও জনপ্রশাসনের উপর এর প্রভাবের ফলে। সেখানকার জনগণের দুর্ভোগের সাথে শীঘ্রই গুরুতর খাদ্যাভাব, এমনকি দুর্ভিক্ষ পর্যন্ত যুক্ত হতে পারে যদি না বড় মাপের ত্রাণ কার্যক্রম কার্যকর ভাবে পরিচালনার উপযোগী একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নয়ন করা যায়। সমানভাবে গুরুত্ববহ এই সন্দেহাতীত বিষয়টি যে, সমঝোতা এবং উন্নত রাজনৈতিক পরিবেশ এবং ত্রাণ প্রচেষ্টার সাফল্য এখন ভারতে আছে এমন উদ্বাস্তুদের যেকোনো বড় অনুপাতে ফিরে আসার জন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত। এটি এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিয়ামকগুলো দুষ্টচক্রের এমন একটি ধারা সৃষ্টি করেছে যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক মানবিক সমস্যা মোকাবেলার উদ্যোগসমূহকে মারাত্মক ভাবে হতাশাগ্রস্ত করছে।

(ঘ) এসকল মানবিক ট্রাজেডির সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। যে হিংস্র আবেগ জাগ্রত হয়েছে, উপমহাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রদায়গুলোর আন্তঃসম্পর্কে তা সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, এবং ভারত ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যকার সম্পর্কও এ সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ অঞ্চলের প্রদেশসমূহের আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের মূলনীতির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তা থেকে প্রায়ই ভ্রাতৃঘাতী শত্রুতার উত্থানের ইতিহাস রয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক মানসিক প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব ঘটিয়েছে। বর্তমান ক্ষেত্রে, সেখানে বিপদের একটি অতিরিক্ত উপাদান বিদ্যমান, কেননা এ সঙ্কটটি উন্মোচিত হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার একটি দীর্ঘস্থায়ী ও অমীমাংসিত বিবাদের প্রেক্ষাপটে , যে বিবাদ মাত্র ছয় বছর আগে তাদের মধ্যে প্রকাশ্য যুদ্ধের সূচনা ঘটিয়েছিল। যদিও শান্তি প্রতিষ্ঠায় উভয় দেশের সরকারের সদিচ্ছা প্রশ্নাতীত, তবু তাদের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের পরিস্থিতি সুনির্দিষ্টভাবে উদ্বেগজনক। সীমান্ত সংঘর্ষ, চোরাগোপ্তা হামলা, এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড আরও নিয়মিত হয়ে উঠছে, এবং এর সবই আরও গুরুতর হয়ে উঠছে যেহেতু প্রত্যাবাসিত হতে হলে শরণার্থীদেরকে এই বিপদসংকুল সীমান্ত পাড়ি দিতে হবে। আমরা যারা জাতিসংঘে আছি তারা এটাও ভুলে যেতে পারি না যে একটি বৃহৎ সংঘর্ষ উপমহাদেশে অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে যেতে পারে।

(ঙ) উপমহাদেশে বিরাজমান দুঃখজনক পরিস্থিতিকে নৈতিকভাবে বিচার করা খুবই সহজ। অনেক বেশি কঠিন রাজনৈতিক ও মানবিক বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া এবং সংশ্লিষ্ট জনগণকে তাদের ব্যাপক দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করা। এই পরবর্তী কর্মপন্থাটিই, আমার মতে, জাতিসংঘকে অনুসরণ করতে হবে।

(চ) আমার মনে হয় না আমি বর্তমান পরিস্থিতি এবং এর সম্ভাব্য পরিণতির অতিরিক্ত নেতিবাচক চিত্র অঙ্কন করেছি। আমার কাছে থাকা তথ্যের আলোকে, আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই উপসংহারে পৌঁছেছি যে, সে সময়টি পার হয়ে গিয়েছে যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের অপেক্ষা অব্যাহত রাখতে পারতো এবং পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় থেকে পরিস্থিতির অবনতি হতে দেখতে পারতো এই আশায় যে ত্রাণ কার্যক্রম, মানবিক উদ্যোগ এবং সৎ উদ্দেশ্য মানুষের দুর্ভোগ ও সম্ভাব্য দুর্যোগ লাঘবে যথেষ্ট হবে। আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন বর্তমান পরিস্থিতির সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে, শুধু মানবিক দৃষ্টিকোণ বিচারে নয়, বরং, শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও কর্মকাণ্ডের কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণেও। আমার মনে হয় বর্তমান দুঃখজনক পরিস্থিতি, যাতে মানবিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে এদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে, তা সমগ্র জাতিসংঘের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ স্বরূপ যা অবশ্যই মোকাবেলা করতে হবে। এই ধরণের অন্যান্য পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও ঘটতে পারে। যদি সংগঠনটি এখন এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে, তাহলে এটি ভবিষ্যতে একই ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নতুন দক্ষতার উন্নয়ন ও প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন করতে পারবে।

(ছ) নিরাপত্তা পরিষদের এজেন্ডায় উল্লিখিত নয় এমন একটি বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির কাছে প্রতিবেদন পেশ করার অস্বাভাবিক পদক্ষেপ আমি নিয়েছি এই কারণে যে, এই বিষয়টির রাজনৈতিক প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যবৃন্দ সমস্যাটির বিষয়ে অবগত না হওয়া পর্যন্ত মহাসচিব এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা সুপারিশ করতে পারেন না। আমি বিশ্বাস করি, জাতিসংঘের অতি অবশ্যই উচিত শান্তি রক্ষায় এর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং সম্প্রীতি ও প্রণোদনায় এর বৈচিত্র্যময় সংস্থানের সহায়তায় মানবিক ট্রাজেডি যা ইতোমধ্যে সংঘটিত হয়েছে তা প্রশমন এবং পরিস্থিতির আরও অবনতি এড়ানো, উভয় উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করা।

(জ) নিরাপত্তা পরিষদ, বিশ্বে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ, এমন একটি অবস্থানে আছে যেখান থেকে তারা বর্তমান পরিস্থিতিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ ও সতর্কতার সাথে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে একটি সর্বসম্মত উপসংহারে পৌঁছাতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই, পরিষদের সদস্যদের নিজেদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই আলোচনা আনুষ্ঠানিক হবে না কি অনানুষ্ঠানিক হবে, গোপনে হবে, না কি প্রকাশ্যে হবে। এই পর্যায়ে আমার প্রধান উদ্দেশ্য এই আলোচনার জন্য একটি ভিত্তি এবং সুযোগ তৈরি করে দেয়া এবং এ বিষয়ে আমার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা যেন, এই দুঃখজনক পরিস্থিতির সমাধান করতে পারে এমন সম্ভাব্য সকল পন্থা এবং উপায়ই বিবেচনা করে দেখা হয়।

৪। ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ তারিখে, সাধারণ পরিষদের ২৬ তম অধিবেশনে আমার বার্ষিক প্রতিবেদনের ভূমিকায় আমি এই সমস্যাটির প্রতিটি দিক পরিষদের গোচরীভূত করেছি। আমি আমার প্রতিবেদনটি নিম্নলিখিত পর্যবেক্ষণ দ্বারা শেষ করেছি-
“এই ব্যাপক দুর্যোগে সংশ্লিষ্ট সরকার এবং জনগণকে সম্ভাব্য সকল সহায়তা প্রদানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি সুস্পষ্ট বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু, যা আমি উল্লেখ করেছি, মূল সমস্যাটির সমাধান সম্ভব হবে কেবল যদি সমঝোতার ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক সমাধান এবং মানবিক নীতির প্রতি সম্মানবোধ অর্জন করা যায়।”
এই কল্পে, পূর্ব পাকিস্তানে মার্চের ঘটনাবলীর পর থেকেই আমি নানাভাবে আমার প্রভাব ব্যবহার করেছি। এবং অবশ্যম্ভাবীভাবেই, তা করেছি প্রচারের আড়ালে। সমস্যাটির বিশেষ গুরুত্বের কারণে, আমি শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ১০ অগাস্ট, ১৯৭১ তারিখে এ সংশ্লিষ্ট নিম্নলিখিত বিবৃতিটি প্রকাশ করেছিঃ
“মহাসচিব মনে করেন এটি একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং সূক্ষ্ম ব্যাপার যা একটি সদস্য রাষ্ট্র,এই ক্ষেত্রে, পাকিস্তান এর বিচার ব্যবস্থার কর্মদক্ষতার অন্তর্ভুক্ত। মানবীয় এবং রাজনৈতিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই এটি অনেকের জন্যই একটি বিশেষ আগ্রহ এবং উদ্বেগের বিষয়। মহাসচিব বিভিন্ন সরকারের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন বার্তা পেয়েছেন এবং প্রায় প্রতিদিনই আরও বার্তা পাচ্ছেন এবং সকল বার্তার একটি সাধারণ বক্তব্য এই যে, শান্তি এবং স্বাভাবিক অবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা সুদূরপরাহত হবে যদি না উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। প্রতিনিধিদের সাথে মহাসচিব এই মর্মে একমত যে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্যের যে কোনো পরিবর্তন পাকিস্তানের সীমার বাইরেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।”
আমি ইতোপূর্বে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে এই বিষয়ে একটি চিঠি প্রেরণ করেছি।

৫। ২২ অক্টোবর তারিখে মহাসচিব তাঁর ২০ জুলাই এর স্মারকলিপি (উপরে অনুচ্ছেদ ৩ দ্রষ্টব্য) অনুযায়ী এ সমস্যাটির সকল দিক নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের সরকার প্রধানদের সাথে ব্যাপক আলোচনার সম্ভাব্য উপযোগিতার কথা বিবেচনায় রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে একইরকম বার্তা প্রেরণ করেছেন। বার্তাগুলো নিম্নরূপঃ
(পৃষ্ঠা ৩২২ দ্রষ্টব্য)

৬। ২২ অক্টোবর তারিখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মহাসচিবের ২০ অক্টোবরের বার্তার জবাব দিয়েছেন, যা নিম্নরূপঃ
(পৃষ্ঠা ৩২২-৩২৩ দ্রষ্টব্য)

৭। ১৬ নভেম্বর তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মহাসচিবের ২০ অক্টোবরের বার্তার নিম্নলিখিত জবাব প্রদান করেছেনঃ
(পৃষ্ঠা ৩২৩-৩২৪ দ্রষ্টব্য)

৮। ২২ নভেম্বর তারিখে মহাসচিব ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ১৬ নভেম্বরের পত্রের জবাবে নিম্নলিখিত বার্তা প্রেরণ করেনঃ
আমি অত্যন্ত সম্মানের সাথে আপনার ১৬ নভেম্বরের পত্রের প্রাপ্তিস্বীকার করছি, যাতে আপনি আমার ২০ অক্টোবর, ১৯৭১ তারিখের পত্রের জবাব দিয়েছেন। আমি আলোচ্য পরিস্থিতিতে আমার দাপ্তরিক সুনামসমৃদ্ধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আমার প্রস্তাব বিবেচনায় মহামান্যর দৃষ্টিভঙ্গীর সুচিন্তিত ও বিস্তারিত অভিব্যক্তির প্রশংসা করছি, এবং বিশেষ করে সাধুবাদ জানাচ্ছি মহামান্যর এই বক্তব্যকে যে আপনার সরকারের পাকিস্তানের সাথে সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পরার কোনো অভিপ্রায় নেই। তবে আমি মহামান্যর চিঠির অনুচ্ছেদ ৫ এর বক্তব্য- “পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের রক্ষার বর্তমান প্রচেষ্টা” এবং “মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে একে পাক-ভারত বিবাদ হিসেবে বিবেচনা করা কেবল উত্তেজনা বৃদ্ধি করবে” এর দ্বারা বিভ্রান্ত বোধ করছি। আমি আরও বিভ্রান্ত বোধ করছি অনুচ্ছেদ ৮ এর বক্তব্য দ্বারা যেখানে বলা হয়েছে যে যদি আমি ‘এই দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটি বিচার’ করি তবেই আমি ভারত সরকারের সমর্থন পেতে পারি।
এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমি মহামান্যর নিকট আমার প্রস্তাবের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করার প্রয়োজন বোধ করছি। আমার ২০ অক্টোবরের চিঠিটি নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির নিকট ২০ জুলাই, ১৯৭১ তারিখে পেশকৃত স্মারকলিপির অনুসরণে লিখিত ছিল, যাতে বর্ণিত দৃষ্টিভঙ্গীই মহামান্য তাঁর চিঠিতে প্রকাশ করেছেন। কার্যত, আমার উদ্দেশ্য ছিল এই যে এই স্মারকলিপিটি আমার দাপ্তরিক সুনামসমৃদ্ধ কর্মকাণ্ডের রেফারেন্স হিসেবে কাজ করবে।
আমি স্বাভাবিকভাবেই, যথাসম্ভব বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে এই ভীষণ গুরুতর পরিস্থিতিটিকে বিচার করতে চেয়েছি এবং আশা করেছি যে উভয় দেশের সরকার প্রধানের সাথে এ বিষয়টি পর্যালোচনার সুযোগ পাবো। কোনো একটি মূল ইস্যুকে পাশ কাটানো বা নির্দিষ্ট কোনো ইস্যুতে সমস্যাটিকে সীমিত করার উদ্দেশ্য আমার ছিল না। যদিও, স্বাভাবিকভাবেই, মহাসচিব হিসেবে সনদ অনুসারে আমি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি কোনো সম্ভাব্য হুমকিকে উপেক্ষা করতে পারি না যার অস্তিত্ব বর্তমানে উপমহাদেশে রয়েছে।

মহামান্য অবগত আছেন যে সুনামের সাথে দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সম্মতি এবং সহযোগিতা প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতিতে, অত্যন্ত পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করছি যে এই অপরিসীম মারাত্মক ও জটিল সমস্যাটিতে মহাসচিবের দাপ্তরিক সুনামের চর্চার কোনো ভিত্তিই দেখা যাচ্ছে না।

৯। ২৩ নভেম্বর তারিখে, মহাসচিব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে আরও একটি চিঠি পেয়েছেন যা নিম্নরূপঃ
আমি আপনার কাছে গভীর উদ্বেগের সাথে এই বার্তা প্রেরণ করছি এমন এক গুরুতর পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে, যা পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে বিনা উসকানিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যাপক মাত্রার আক্রমণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে।
(খ) ২১ নভেম্বর সশস্ত্র হেলিকপ্টার সমর্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে আমাদের সীমান্ত ফাঁড়ি কব্জা করেছে এবং পাকিস্তানের সীমার ভেতর প্রায় ১০ মাইল পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করেছে। একই দিন, ২৩তম ভারতীয় ডিভিশনের অপর আর একটি ব্রিগেড অবশিষ্ট ডিভিশনের সমর্থন সহকারে পাকিস্তান সীমান্তের আট মাইল অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নোয়াখালী জেলার বেলোনিয়াতে আক্রমণ করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাবডিভিশনেও আক্রমণ করা হয়েছে ৫৭ তম ডিভিশন এর অধীনে এবং আমাদের দুটো সীমান্ত ফাঁড়ি, মুকুন্দপুর ও সালদা নদী, কব্জা করা হয়েছে। সিলেট জেলার মৌলভিবাজার সাবডিভিশনে দুটি ব্যাটালিয়ন গ্রুপ আক্রমণ করেছে এবং তারা ধলাই, অষ্টগ্রাম ও জকিগঞ্জ সীমান্ত ফাঁড়ি কব্জা করেছে। এই ব্যাটালিয়ন গ্রুপে ছিল দুটি গুর্খা কোম্পানি। আরেকটি আক্রমণ পরিচালিত হয়েছে রংপুর এর ভুরুঙ্গামারি অঞ্চলে যেখানে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তান সীমান্তের পনের মাইল অভ্যন্তরে নাগেশ্বরী পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করেছে। যশোর জেলায় চৌগাছার বিপরীতে নবম ডিভিশনের একটি ব্রিগেড দ্বারা একটি গুরুতর আক্রমণ পরিচালিত হয়েছে ট্যাঙ্ক ও এয়ার কভারের সহায়তায়। ভারতীয় টাঙ্ক সেখানে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রায় আট মাইল পর্যন্ত প্রবেশ করেছে। ভারতীয় একটি বিমান হামলা পাকিস্তান এয়ার ফোর্স প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। একটি ভারতীয় যুদ্ধ বিমান ধ্বংস হয়েছে এবং আমরা হারিয়েছি দুটি। যুদ্ধে ছয়টি ভারতীয় ট্যাঙ্ক ধ্বংস করা হয়েছে এবং আমাদের আটটি ট্যাঙ্ক বিধ্বস্ত হয়েছে। যশোর বিমান ঘাঁটিতে থেমে থেমে গোলাবর্ষণ চলছে। ময়মনসিংহ জেলার কড়ইতলায় আমাদের সীমান্ত ফাঁড়িতে পুনঃপুনঃ আক্রমণ প্রতিহত করা হয়েছে।

(গ) পূর্ব পাকিস্তানের চতুর্দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্তত ১২টি ডিভিশন মোতায়েন করা হয়েছে। তার সাথে আছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ৩৮টি ব্যাটেলিয়ন। ২য় ও ৫ম ভারতীয় মাউন্টেইন ডিভিশন যা ইতোপূর্বে চীন সীমান্তে মোতায়েন ছিল তা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের সিলেটের দিকে সরিয়ে আনা হয়েছে নাগাল্যান্ড থেকে যেখানে এখন আর মাত্র একটি ব্রিগেড অবশিষ্ট রয়েছে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর ১২টি স্কোয়াড্রন বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের চারপাশে রাখা হয়েছে। একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, ফ্রিগেট, ল্যান্ডিং শিপ ও দু’টি সাবমেরিন সমন্বয়ে গঠিত ভারতীয় একটি বৃহদাকার নৌ বাহিনী চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরের জন্য উভচর হুমকিস্বরূপ বিশাখাপট্টমের কাছে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান নিয়েছে। চালনা বন্দরমুখী জলযানসমূহে ভারতীয় বাহিনীর মাইন হামলার ফলে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য জরুরী সামগ্রী বোঝাই দু’টি বাণিজ্যতরী বিধ্বস্ত হয়েছে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সরবরাহ গুরুতরভাবে ব্যাহত হবে।

(ঘ) মহামান্য অবগত আছেন, ভারতীয় সামরিক বাহিনী গত কয়েক মাস যাবৎ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তসমূহে চাপ বজায় রেখেছে। বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র-গোলাবারুদ-রসদ সরবরাহ করা এবং ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের সহযোগিতায় পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে হামলা পরিচালনা ছাড়াও, ভারতীয় আর্টিলারি ইউনিটগুলো পূর্ব পাকিস্তান ভূখণ্ডে ক্রমাগত গোলাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, যা আমি ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি যে, গত তিন থেকে চার দিন যাবৎ তারা বিচ্ছিন্ন আক্রমণের পরিবর্তে বিভিন্ন ফ্রন্টে প্রকাশ্য ও বড় মাপের যুদ্ধ শুরু করেছে। সংঘর্ষে তারা ট্যাংক ও বিমানবাহিনী ব্যবহারের মাধ্যমে একে উচ্চতর মাত্রা দিয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর উপর কড়া নির্দেশনা রয়েছে সীমান্ত অতিক্রম না করতে, এবং উপর্যুপরি উসকানির মুখেও সর্বোচ্চ সংযম পালনে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে, আমাদের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার্থে আমাদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করা প্রয়োজন।

(ঙ) আমাদেরকে সময় সময় আশ্বস্ত করা হয়েছে যে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি এবং বৃহদায়তন যুদ্ধবিগ্রহ আরম্ভ করতে ইচ্ছুক নয়। এটা এখন স্পষ্ট যে, সংযম চর্চার বদলে ভারত নির্লজ্জচিত্তে এবং বিনা উস্কানিতে আগ্রাসনের পথ বেছে নিয়েছে। ভারত এখনও এই মর্মে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে যে পাকিস্তানে হানা দিচ্ছে তথাকথিত ‘মুক্তি বাহিনী’- যা কিনা মূলত ভারতের দ্বারা সৃষ্ট, প্রতিপালিত এবং টিকিয়ে রাখা একটি বিদ্রোহী শক্তি। কেউই ভারতীয় এই দাবি দ্বারা প্রতারিত হবে না যা বর্তমানে অপারেশনের মাত্রা দ্বারা এবং এখন ব্যবহৃত হচ্ছে এমন সরঞ্জামসমূহ যাতে অস্ত্র ও বিমানবাহিনীর অংশবিশেষের অন্তর্ভূক্তি দ্বারা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

(চ) মহামান্য স্মরণ করতে পারেন যে, গত ২০ জুলাই আপনি নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির উদ্দেশ্যে একটি অনানুষ্ঠানিকও গোপনীয় স্মারকলিপি প্রেরণ করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে পরিস্থিতির অব্যাহত অবনতি সম্পর্কে অবহিত করে এবংউপমহাদেশে একটি বৃহত্তর সংঘাতের সম্ভাবনার পপ্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমি আপনার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলামএবং পূর্ব পাকিস্তানি বাস্তুহারা জনগণের পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত আসা তত্ত্বাবধান করার জন্য জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার এর প্রতিনিধিকে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছিলাম। সে সময় থেকেই পাকিস্তান উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমনে নিরাপত্তা পরিষদের প্রভাবক কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছে। পরবর্তী একটি সময়ে আমি সীমান্তে একটি দ্বিপাক্ষিক অস্ত্রবিরতিতেও সম্মত হয়েছিলাম, যে প্রস্তাব অনতিবিলম্বে ১৯ অক্টোবর ১৯৭১ এ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। আরও সাম্প্রতিককালে, আমি আপনার ২০ অক্টোবরের পত্রের প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছি যাতে আপনি ইন্দো-পাকিস্তান চলতি পরিস্থিতির বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন করেছেন এবং একটি মূঢ় ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের সম্ভাবনায় আপনার উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন। সে সময় আপনি সরকারকে তাৎক্ষণিক সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন যেকোনো (development) এড়াতে যা পরিস্থিতিকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং আপনি উল্লেখ করেছিলেন যে, আমরা প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো সময়ে আপনার সহায়তা পেতে পারি। আমি আনন্দের সাথে এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিলাম এবং এ অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিত করার উপায় এবং প্রক্রিয়া আলোচনা করবার জন্য আপনাকে ভারত ও পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম।

(ছ) আপনি লক্ষ্য করবেন যে পাকিস্তান অব্যাহতভাবে উপমহাদেশের বর্তমান সংকটের সমাধানে জাতিসংঘের সহায়তা গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে, এবং ভারত তা অব্যাহতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমাদের অবস্থান এখনও একই আছে, কিন্তু আমাদের আশংকা যে ভারত একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে আগ্রহী নয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি, যা আমি বর্ণনা করেছি, দ্রুতই এমন একটি দিকে অগ্রসর হচ্ছে যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ থাকবে না। এই সংকটের মুহূর্তে আপনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ এখনও এই দুর্যোগকে ঠেকাতে পারে।

(জ) আমি ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের কল্যাণ এবং উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিষয়ে আপনার অব্যাহত উদ্বেগ সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হয়ে আপনার সুপরামর্শের অপেক্ষায় আছি।

১০। ২৬ নভেম্বর, মহাসচিব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে নিম্নরূপ জবাব প্রেরণ করেনঃ

আপনার ২২ অক্টোবর এবং ২৩ নভেম্বর, ১৯৭১ এর পত্রের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আমার দাপ্তরিক সুনাম সমৃদ্ধ কর্মকাণ্ডের প্রস্তাব এবং আমার পূর্বে উল্লিখিত প্রস্তাবনাসমূহের প্রতি আপনার দ্রুত সাড়া প্রদান আমি প্রশংসার সাথে লক্ষ্য করেছি। উপমহাদেশে উত্তেজনা নিরসনে এবং শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি মোকাবেলায় সম্ভাব্য অন্যান্য পদক্ষেপ সম্পর্কে আপনার ২২ অক্টোবরের পত্রে উল্লেখিত প্রস্তাবনাসমূহও আমি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে লক্ষ্য করেছি। আমার ২০ অক্টোবরের পত্রটি নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির উদ্দেশ্যে প্রেরিত আমার ২০ জুলাই, ১৯৭১ এর স্মারকলিপির প্রেক্ষিতে লিখিত হয়েছিল। বৃহত্তর এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আমি আশা করেছিলাম যে, উভয় সরকারের নেতৃবৃন্দের সাথে পুরো পরিস্থিতিটি পর্যালোচনা করবার একটি সুযোগ পাবো, যাতে কিছু সংখ্যক জরুরী এবং জটিল সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে, যা উভয় সরকারকেই মোকাবেলা করতে হয়।

মহামান্য অবগত আছেন যে, দাপ্তরিক সুনামের চর্চার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সম্মতি ও সহায়তা প্রয়োজন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, অনুতাপের সাথে বলতে হচ্ছে যে মহাসচিবের সুনাম চর্চার কোনো ভিত্তিই এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। তবুও, আমি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর যেকোনো প্রকার সাহায্যে আসতে উৎসুক।

আমি গভীর উদ্বেগের সাথে আপনার ২৩ নভেম্বরের পত্রে বর্ণিত পরিস্থিতির বিবরণ পাঠ করেছি। আমি একান্তভাবে আশা করি যে, জাতিসংঘ এই সহিংসতা তীব্রতর হয়ে একটি মূঢ় ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে উপনীত হওয়া এড়াতে উভয় সরকারের সহায়ক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হবে।

আমি লক্ষ্য করেছি যে মহামান্যর মতে আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগ এখনও বিপর্যয় রোধ করতে পারে। যদিও আমি এই বিপর্যয় রোধে যেকোনো কিছু করতে উৎসুক, তথাপি আমি এই মুহূর্তে এই উপসংহারে আসতে বাধ্য হচ্ছি যে আমি জাতিসংঘের সনদ কর্তৃক অনুমোদিত আমার কর্তৃত্বের সীমার মধ্যে যথাসাধ্য কার্যকর এবং অর্থপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছি। মহামান্যর ২৩ নভেম্বরের পত্র অনুসারে, আমি এই বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যবৃন্দের গোচরীভূত করেছি জুলাই এ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির উদ্দেশ্যে প্রেরিত আমার স্মারকলিপির মাধ্যমে, এবং অক্টোবরে, যখন আমি আমার দাপ্তরিক সুনাম চর্চার প্রস্তাব দিই, তখন। আমি অবশ্যই ভারত এবং পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখবো আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় উভয়ের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করতে জাতিসংঘের সামর্থ্য প্রমাণ করবার জন্য এবং বর্তমান দুঃখজনক পরিস্থিতির পেছনে বিদ্যমান মূল সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নির্ণয় করার জন্য।

১১। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে অব্যাহতভাবে অবগত রাখা হয়েছিল মহাসচিবের দাপ্তরিক সুনামসমৃদ্ধ কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত কার্যক্রমের বিষয়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট প্রেরিত মহাসচিবের সকল বার্তার অনুলিপি তাৎক্ষণিকভাবে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল তাঁর অবগতির জন্য।

১২। ২৯ নভেম্বর তারিখে, জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রেরিত একটি বার্তা মহাসচিব এর নিকট পৌঁছে দেন যা নিম্নরূপঃ
“আমি যথাবিহীত সম্মানের সাথে মহামান্যের নিকট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এর নিম্নোক্ত বার্তাটি পৌঁছে দিচ্ছি। এই বার্তাটি গতকাল গ্রহণ করে হয়েছিল এবং গতকাল রাত ৯টায় মৌখিকভাবে আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেল এর নিকট পৌঁছানো হয়েছিলঃ
সূচনাঃ
মহামান্য,
আমার ২৩ নভেম্বরের পত্র হতে জেনে থাকবেন, বিনা উসকানিতে ভারতের সামরিক বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের ফলশ্রুতিতে বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে এক গভীর সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মহামান্য অবগত আছেন যে, আপনার দাপ্তরিক সুনাম সমৃদ্ধ কর্মকাণ্ডের প্রস্তাব গ্রহণ করার পাশাপাশি আমি জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকগণের তত্ত্বাবধানে ভারত ও পাকিস্তান বাহিনীর যুগপৎ অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ভারত, দুঃখজনক ভাবে সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। শান্তির প্রতি হুমকি অপসারণ এবং পরিস্থিতির অধোগমন রোধে, আমি বর্তমানে মহামান্যকে অনুরোধ করছি অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে আমাদের অংশে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য, যেন তারা আমাদের সীমান্ত লংঘনের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে পারেন।
জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!