You dont have javascript enabled! Please enable it!

জনগণের দিকে তাকিয়েই যুদ্ধ করেছি

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিচিত্রার বৈঠক

“মুক্তির জন্যে, স্বাধীনতার জন্যে দেশের মানুষ লড়েছে।এই লড়াকু মানুষের অগ্রবাহিনী হিসেবে অস্ত্র নিয়ে যারা লড়েছেন তাদেরকেই মনে করি মুক্তিযোদ্ধা।” তর্কের মাঝখানে কথা কয়টি ছুড়ে দিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জনৈক কর্মকর্তা।
এই বিচিত্রা অফিসে বসে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়। আলোচনায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন—মাহফুজুর রহমান,ফতেহ আলী চৌধুরী, আবু সাঈদ খান, আবুল কাসেম,নাসিরউদ্দিন, বাচ্চু,নঈম জাহাঙ্গীর। বিচিত্রার পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী এবং মাহফুজউল্লাহ।সেই আলোচনার ফলাফল এই প্রতিবেদন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আদর্শ উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই আমাদের প্রশ্ন ছিল কারা মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচিত হবেন।ফতে আলি বললেন, ৭১-এর পর রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লক্ষ থেকে বেড়ে উনিশ লক্ষে দাঁড়িয়েছে।সবাই দেখা গেল সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা।যুদ্ধ সেখানে গৌণ। এর কারণও ছিল।কেননা তখন আর যুদ্ধে যাবার সাহসের প্রয়োজন নেই। স্বার্থটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কি করে নাম ভাঙ্গিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যাবে, উদ্দেশ্য চরিতার্থ হবে সেটাই বড় কথা। এই জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যে জুটেছে অপবাদ।
আমরা এই গ্লানি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তি দিতে চাই।সেজন্যেই সংসদকে হতে হবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংসদ, এখানে আমাদের প্রশ্ন ছিল— তা’হলে কারা মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচিত হবেন?মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণার পর তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করিয়া সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কমান্ডার-ইন-চীফের অধিনায়কত্বে যাহারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গঠনতন্ত্র, নিয়মাবলী ও আদর্শের প্রতি আস্থাশীল তাহারাই সদস্য হইবার যোগ্য বলে বিবেচিত হইবেন।” গঠনতন্ত্র থেকে উদ্বৃতি দেওয়া শেষ হওয়ার আগেই সাঈদ বললেন, “এটা কোনো চূড়ান্ত নিয়ম নয়। আর এর কিছু অসুবিধাও আছে। কেননা আমরা ‘৭১-এর ১৭ই এপ্রিল তৎকালীন মন্ত্রীসভা গঠনের চেয়েও ২৬শে মার্চের ঘোষণাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। ইতিমধ্যে ফাতে আলী বললেন, ‘৭১ সালে ভারতে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিল। আমরা মুজিব বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধা মনে করি না।ওদের উদ্দেশ্য ছিল।ওরা যুদ্ধ করেন। ওরা ছিল রাজনীতির হাতিয়ার। মুক্তিযোদ্ধা মানে যারা ‘৭১ সালে ১১টি সেক্টরে অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াই করেছে।
নঈম জাহাঙ্গীর এ কথা ঠিক এভাবে মানতে রাজী নন। তিনি আর একটু বাড়িয়ে বলতে চান। সকলের অভিমত এক। তর্ক চলতেই থাকে। সমাধান হয় না। নঈম জাহাঙ্গীর বললেন, “আমরা হাত তোলা মুক্তিবাহিনী নই।” এই বিতর্কের মাঝখানে বিচিত্রার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী বললেন, (প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা) “আসলে মুক্তিযোদ্ধা বলে তারাই বিবেচিত হবে যারা ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ থেকে শুরু করে ‘৭১ সালের ডিসেম্বর ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সশস্ত্র লড়াই করেছেন।” সবাই মেনে নিলেন শাহাদাত চৌধুরীর আপোষ ফর্মুলা। ততক্ষণে চা এসেছে। চা পান করতে করতে আমাদের আলোচনা এগিয়ে চলে। সংসদের আহবায়ক মাহমুদুর রহমানের কাছে জানতে চাইলাম, আপনারা কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করছেন? তিনি জবাব দিলেন, “প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরী করে এবং পুনর্বাসনের কথা বলেন।” আমাদের পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘৭১-এর যুদ্ধের সময়তে পুনর্বাসনের অঙ্গীকার ছিল না। আপনারা পুনর্বাসনের কথা বলে কি মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থনৈতিক প্রলোভন দেখাচ্ছেন? জবাবে তিনি বললেন, ” ‘৭১-এর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গত চার বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর যে উদ্দেশ্যমূলক নির্যাতন হয়েছে তাতে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই এখন হতাশাগ্রস্ত।
চার বছরের অত্যাচারে মুক্তিযোদ্ধারা জর্জরিত।এটা আসলে তাদের একত্রিত করার জন্য।”ইতিমধ্যে ফতে আলী বললেন,” আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক পুনর্বাসন চাই।তাদের সম্মানের পুনর্বাসন চাই যতক্ষণ এই সম্মান ফিরিয়ে দেয়া না যাবে ততক্ষণ সমস্যার সমাধান হবে না।’ ৭১-এর যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছেন,দেশের কাছে তাদের চাইবার কিছুই নেই একমাত্র সম্মান ও গৌরব ছাড়া।” তিনি আরো বললেন, সবাই বলে স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবকে প্রতিষ্ঠা করার কথা।কিন্যু স্বাধীনতা যুদ্ধকে প্রতিষ্ঠিত করবো আর যোদ্ধারা রাস্তায় পড়ে থাকবে এটা হাস্যকর। যে সত্যিকারের যোদ্ধা তাকে যোদ্ধা হবার গৌরব দিতে হবে।কেননা মানুষের জন্মের ইতিহাস তার উপরে রেখাপাত করে।তিনি বললেন, ১৫ই আগষ্টের পর দেশ এক সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে।সীমান্তে বৈদেশিক হামলা।সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনে স্বাধীনতা সংরক্ষণে আজ মুক্তিযোদ্ধাদের এক হতে হবে।এই জন্যেই এলাকা ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে হবে।এরপর আমাদের প্রশ্ন ছিল,বিগত চার বছরে দলমত নির্বিশেষে কি সব মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অত্যাচার হয়েছে? আবু সাঈদ বললেন,যারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিল তাদের উপর অত্যাচার হয়নি।
আওয়ামীলীগ তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। আমরা আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে যুদ্ধ করিনি। জনগণের দিকে তাকিয়েই যুদ্ধ করেছি। যখন ভারতে ছিলাম তখন অনেক কিছু বুঝেও পরিস্থিতির কারণে প্রতিবাদ করতে পারিনি। যে কারণে ১৬ই ডিসেম্বরের পর আমরা সেনাবাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছি। অন্য কারো কাছে নয়।
এরপর আমাদের প্রশ্ন ছিল, গঠনতন্ত্রে জনগণের যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা সে সম্পর্কে—আপনাদের অভিমত কি? এতক্ষণ চুপ করে থাকা আবুল কাশেম বললেন, “আমরা খেয়ে পড়ে বাঁচার স্বাধীনতা চাই। এই স্বাধীনতার জন্য আমরা যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।” আমাদের প্রশ্ন ছিল, এ জন্য কি আপনার কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব মেনে নেবেন? তাঁরা বললেন,এই সংগ্রাম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নাও হতে পারে। এই আলোচনার ফাকে কথা গড়িয়ে গেল সাহসিকতার জন্য প্রহত্ত পুরস্কারের প্রশ্ন। নাসিরউদ্দিন বাচ্চু বললেন, যারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে তাদের জন্য একটি বিশেষ পদক বা ব্যাজের প্রবর্তন করতে হবে।এই প্রবর্তন হবে সঠিক তালিকার ভিত্তিতে। কথার মাঝখানে মাহফুজুর রহমান বললেন, বিগত দিনে সেনাবাহিনীর বাইরে যে সব বীরত্বসূচক পদক দেয়া হয়েছে সেক্ষেত্রে কারচুপি আছে। যুদ্ধকালীন সময়ে এসব পদক ঘোষিত হয়নি। অথচ প্রথানুযায়ী এসব যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ঘোষিত হয়।
পরবর্তিতে আমরা প্রশ্ন রেখেছিলাম, কেন তারা ‘৭১ সালে লড়াই করেছিলেন? প্রত্যুত্তরে আবুল কাশেম বললেন, ‘৭১-এর সংগ্রাম রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম। গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম।অথচ ১৬ই ডিসেম্বরের পর এই জিনিসকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। সংগ্রান যখন শুরু হয় তার পরপরই বিদেশী হস্তক্ষেপের ফলে গোজামিল তৈরী হয়। তারপর থেকে ক্রমাগত বৈদেশিক হস্তক্ষেপের ফলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এরপর এরই পরিণতিতে প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণ থেকে ভিন্ন এক শ্রেণীর শাসক। এরা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ। পরবর্তী পর্যায়ে এই বিদেশী শক্তির সমর্থনপুষ্ট শাসকগোষ্ঠী আমাদের উপর অত্যাচার চালায়। তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৫ই আগষ্ট ও ১৭ই নবেম্বর। এবং সঙ্গত কারণেই আমরা সে পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছি।
এরপর আমরা জানতে চাইলাম, গঠনতন্ত্রে তারা যে রাজনৈতিক টাউটদের কথা বলেছেন তাদের পরিচয় কি? একসঙ্গে তারা জবাব দিলেন, যারা সম্প্রসারণবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তারাই রাজনৈতিক টাউট। এদের কারণেই প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা সামাজিক কারণে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বেকার। তাই বলে মুক্তিযোদ্ধারা চাকরিতে ৩০% পদ সংরক্ষণের বিরোধী। এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধাদের আপত্তি আছে। আমরা সুবিধাভোগী হয়ে গোটা জাতি থেকে আলাদা হতে চাই না। আমাদের বেদনা স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। যুদ্ধের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। এর পরিবর্তন কোথাও ইতিবাচক, কোথাও নেতিবাচক।
এ প্রসঙ্গে আমাদের প্রশ্ন ছিল জনগণের সঙ্গে তারা সরকারের সম্পর্ক কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন? জবাবে ফতে আলী বললেন, ‘৭২ সাল থেকে লক্ষ করেছি সরকার জনগণের সমস্যাকে উপেক্ষা করছেন। এর মাঝে শাহাদাত চৌধুরী বললেন, আসলে বিগত দিনে মাফিয়া কায়দায় চলেছে নৈরাজ্যের শাসন। ভূঁইফোর মূল্যবোধহীন এক শ্রেণীর শাসন।সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। অবক্ষয় রোধ করার চেষ্টা হয়নি।
আসলে সম্ভবও ছিল না। বাংলাদেশে যারা বাস করে তাদের জাতীয় চরিত্র যতদিন চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত না হবে ততদিন সংকটের হাত থেকে মুক্তি নেই। এরপর জানতে চাইলাম গঠনতন্ত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করা সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে তাদের অভিমত কি? হাসতে হাসতে নাসিরউদ্দিন বাচ্চু বললেন, আসলে একজন যোদ্ধার জন্য যুদ্ধের প্রধান নিয়ম। যুদ্ধের নিয়মই আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে ভ্রাতৃত্ববোধ।আমাদের সর্বশেষ প্রশ্ন ছিল, বর্তমান সরকারের সঙ্গে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্ক কি? সকলের পক্ষ থেকে মাহফুজুর রহমান বললেন, মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের বিশ্বাস করে। সরকারও স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের কথা বলেছেন। সেখানেই আমাদের একতা। আমাদের নিজস্ব ভিত্তি আছে,আদর্শও আছে।আমরা সেই আদর্শের বাস্তবায়নে সামনে এগিয়ে যাব। সেখানে হয়ত তখনও সরকারের সঙ্গে আমাদের কখনও মিলবে না।আমাদের দাবী একটি– আমরা মুক্তি যোদ্ধার গৌরব নিয়ে স্ব স্ব অবস্থানে বেঁচে থাকতে চাই এবং যখনই প্রয়োজন আসবে তখনই দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াব।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1976.07.23-bichitra.pdf” title=”1976.07.23 bichitra”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!