৫ম বাহিনী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা ৫ই জুন ১৯৭৬
আহমদ আনিসুর রহমান
পঞ্চম বাহিনী একটি উর্দিবিহীন বাহিনী দ্বিবিধ বাহিনী। উর্দিবিহীন (১) গেরিলা বাহিনী এবং (২) পঞ্চম বাহিনী। গেরিলা বাহিনী। সাধারণতঃ দেশপ্রেমিক বিপ্লবী যুদ্ধে লিপ্ত। কিন্তু পঞ্চম বাহিনী ঠিক তার উল্টো—বিদেশ প্রেমিক এবং প্রতিক্রিয়াশীল। অনেক সময় পঞ্চম বাহিনী গেরিলা স্ট্র্যাজেডি ও ট্যাকটিকসও গ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে সে হবে গেরিলা পঞ্চম বাহিনী। আবার অনেক সময় পঞ্চম বাহিনীটি অন্য কোন বাহিনীর উর্দিতে অস্তিত্বমান। তখন সে হবে ছদ্মবেশী পঞ্চম বাহিনী। ওপরে তার সাধ স্বরুপ তলে তলে তার অন্য চেহারা। সে যাই হোক সবক্ষেত্রেই পঞ্চম বাহিনী একটি চম চম বাহিনী অর্থাৎ বিদেশের হালুয়া রুটি বা নির্দেশনামায় তার কাজ-কর্ম চলে। পঞ্চম বাহিনীর অনেকে ঐ বাহিনীতে নাম লেখায় হালুয়া রুটির আশায় আবার অনেকের ক্ষেত্রে, কবির ভাষায়,“মন মোর তোমারে চায় জানি না কি আশায়।” অর্থাৎ তারা হালুয়া রুটি না পেয়ে পঞ্চম বাহিনীর জন্য কাজ করে। অনেক সময় হয়তো তারা ঐ বাহিনীর কার্যধারাকেই মনে করে প্রকৃত মহৎ ও মঙ্গলকর। তখন কেবলমাত্র ‘মঙ্গলা লোকের আনন্দ লোকে” বিরাজ করবার জন্যই যেন তারা নিজের খেয়ে নিজের মোষ তাড়াতে ব্যস্ত হয়। আবার অনেক সময় অনেকেই এটা না জেনেই যে তারা আসলে পঞ্চম বাহিনীর কাজ করছে—ঐ বাহিনীর সদস্যরুপে কাজ করে যায়। সারাজীবন কাজ করে গিয়ে এমন কি মরবার সময়ও তারা জানতে পারে না। তারা আসলে বেচেও থেকেছে এবং অবশেষে মারাও যাচ্ছে পঞ্চম বাহিনীর স্বার্থে। কি বিচিত্র এই আন্তর্জাতিক মাৎস্য ন্যায়ের রাজনৈতিক পৃথিবী।
“পঞ্চম বাহিনী” শব্দটির প্রথম উদ্ভব ঘটে ১৯৩৬—১৯৩৮-এর স্পেনীয় গৃহযুদ্ধে। চারটি বাহিনী নিয়ে রাজধানী মাদ্রিদের দিকে অগ্রসর মান ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্ত শাস্তির শায়েস্তা করছিল মাদ্রিদের ভেতর থেকেই ছদ্মবেশে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত পঞ্চম আরো একটি ফ্যাসিস্ত বাহিনী। তখন থেকেই দেশের বা দলের ভেতরে মিশে থেকে বহিঃশত্রুর সহযোগিতা করে যাওয়া বিশ্বাস ঘাতকদের “পঞ্চম বাহিনী” বলা হতে শুরু করে। এরা হলো ঘরের শত্রু বিভীষণ যখন একটি বৃহৎ ও ধূর্ত প্রতিবেশী তার লোলুপ দৃষ্টির শিকার একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকে গ্রাস করতে চায় বা তাবেদার করে রাখতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন তার বহুমুখী পরিকল্পনার একটি দিক হয়ে ওঠে সেই রাষ্ট্রটির ভেতর পঞ্চম বাহিনীর অস্তিত্ব নিশ্চিতকরণ। এটা করা যেতে পারে দ্বিবিধ উপায়েঃ (১) পঞ্চম বাহিনী প্রেরণ করে এবং (২) স্থানীয় ভাবে পঞ্চম বাহিনী সৃষ্টি করে। এই দুটো মৌলিক পন্থার সংমিশণে আরো দুটো পন্থার উদ্ভব হতে পারে যথাঃ (ক) সম্ভাব্য শ্রী পঞ্চমীদের সংগ্রহ করে স্বদেশে নিয়ে এসে তাদের সংগঠিত করে পুনঃ প্রেরণ ও (খ) ‘প্রেরিত’ ও ‘স্থানীয়’ শ্রীপঞ্চমীদের সমন্বয়ে একটি পঞ্চম বাহিনীমূলক চক্রজাল গড়ে তোলা। শিকারী যতভাবে সম্ভব শিকারটিকে আটকে ফেলতে চায়। তাই শিকারী রাষ্ট্রসমূহ সাধারণতঃ শিকার রাষ্ট্রের ভেতর উপরোল্লিখিত চতুর্বিধ উপায়ের যে ক’টিতে সম্ভব—পঞ্চমবাহিনী প্রেরণ ও নিয়োগ করে থাকে।
“পঞ্চমবাহিনী” ‘ফ্রেজ’টি বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দিকের হলেও বিষয়টি অতি পুরাতন। প্রাচীন রামায়ণ কাব্যে শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রে রামচন্দ্র পক্ষের পঞ্চম বাহিনী হিসাবে বিভীষণ ও তার দলবল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বিভীষণ (ও তার দলবল) ছিলেন ‘স্থানীয়’ পঞ্চমবাহিনীর নমুনা। একই ভাবে ইলিয়ড কাব্যে বর্ণিত ট্রয়ের যুদ্ধে “ট্রোজান ঘোড়ার” অন্তর্ঘাতী সৈন্যরা ছিলো ‘প্রেরিত’ পঞ্চম বাহিনী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অজেয় তুরস্ককে ভেতর এবং বাহির দু’দিক থেকেই আক্রমণের সম্মুখীন করে ফেলবার জন্য বৃটিশরাও তুরস্কে পঞ্চম বাহিনী প্রেরণ করেছিল। একদিকে আরব সপ্ত নায়কের ছদ্মবেশে লরেন্স অব অ্যারাবিয়াকে প্রেরিত পঞ্চমী ও অন্যদিকে মক্কার শরীফ হুসেন অন্যান্য আরব নেতাদের স্থানীয় পঞ্চম বাহিনী হিসাবে ব্যবহার করে। বৃটেন তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণাঞ্চলে তথাকথিত আরব জাতীয়তাবাদের নামে অন্তর্ঘাতের ব্যবস্থা করে তুরস্ককে কাবু করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। শিকার রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে চেহারা মেলে এমন চেহারার সৈন্য বা অন্তর্ঘাতকর্মীদের শিকার রাষ্ট্রে সামরিক শিক্ষক করে পাঠিয়ে সেখানকার স্থানীয় লোকদের দিয়ে তৈরী করে নেয়া পঞ্চম বাহিনীতে তাদের নিয়োগের মাধ্যমেও একটি শক্তিশালীও মারাত্মক পঞ্চম বাহিনী দাড় করানো যায়। ১৯৪৫ সনে পোল্যান্ডে সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং ১৯৬৪ সনের দিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন প্ররোচনায় থাইল্যান্ড এইরূপ কাজ করেছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে।
পঞ্চম বাহিনী যে শুধু সামরিক চরিত্রেরই হতে হবে তার কোন অর্থ নেই। সামরিক বাহিনীতে অথবা সামরিক বাহিনীর বাইরে তারই এলাকায় আলাদা একটি ছদ্মবেশী সামরিক সংগঠন হিসেবে যেভাবে তার অস্তিত্ব সম্ভব ঠিক একইভাবে দেশের আমলাতন্ত্র শিক্ষা সার্ভিস পুলিশ এবং তথ্য ও বেতার বিভাগের মত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও এদের ছদ্মবেশী অস্তিত্ব সম্ভব। শিকারী রাষ্ট্র ক্রমেই হয় আগ্রাসন নয় পঞ্চম বাহিনীর শুধু একক চেষ্টা নয় উভয়ের সংমিশ্রণে শিকার রাষ্ট্রটিকে করায়ত্ত করতে চায়। পঞ্চম বাহিনীকে তাই সে ক্রমেই সমাজ ও রাষ্ট্র যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ তথা ‘কী’ পোজিশনে পৌছে জেকে বসতে নির্দেশ দেয়। দরকার হলে এজন্য তাকে সাহায্য করেঃ বিভিন্ন চ্যানেলে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে চাপের বা অন্য কিছুর মুখে বিভিন্ন জ্ঞাত বা অজ্ঞাত পঞ্চমীদের আকাঙ্ক্ষিত পদে ক্ষমতাসীন করে দিতে বাধ্য করে দরকার হলে অপগন্ড এক একটি পঞ্চমীরও অতি শ্রদ্ধেয় ধরনের সব “ইমেজ” তৈরি করে দেয়—মিথ্যা অথচ সংগঠিত প্রচার এমন কি আন্তর্জাতিক তদবীরের মাধ্যমে। এই ভাবে রাষ্ট্রটির “জীবনকাঠি” হাতে করে সে রাষ্ট্রটিকে তাবেদার পরিণত করে। তারপর দরকার হলে ক্রমে তাকে “একদেহে লীন” করে ফেলাটাও আর কঠিন থাকে না।
অনেক সময় এবং সত্যি বলতে কি অধিকাংশ সময়ই শিকার রাষ্ট্রের এমন কি শিকারী রাষ্ট্রের জনগণও ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। কেননা জনগণ প্রায়শঃই প্রচারের শিকার এবং পত্রিকা রেডিও ইত্যাদিকে বেদবাক্যের মত বিশ্বাস করে কিন্তু অনেক সময় জাতি বিদ্রোহ করে বসে ফলে দিনের পর দিন অতি সাধনায় গড়ে তোলা শ্রীপঞ্চমী তাসের ঘরটি মুহূর্তে ভেঙে পড়ে।
০০০০