You dont have javascript enabled! Please enable it!

1976.07.02 | বাজেট ১৯৭৬ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা

বাজেট’ ৭৬

১৯৭৪-৭৫ অর্থ বছরের হতাশাব্যাঞ্জক অবস্থাকে উৎরে ১৯৭৫-৭৬ নিয়ে আসে অনেকগুলি স্বার্থকতা। জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমান্বয়ে কমে যায়।গত বছর যেখানে মোট উৎপাদন মাত্র দু শতাংশ বেড়েছিল এ বছর সেখানে হয়েছে প্রায় বারো শতাংশ। পাট ধানের বিপরীতমুখী মূল্য পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসে যায়। ব্যাংকসমূহ নিত্য নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে মুদ্রা সরবরাহ করে সঠিক, ঋণ নীতিমালা হয় যথোপযুক্ত। অর্থনীতির এই উন্নততর অবস্থার মধ্যে দিয়ে এসে যায় পরবর্তী অর্থ বছরের জন্যে বাজেট প্রণয়নের সময়। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গত ছাব্বিশে জুন বাজেট ঘোষণা করেন।
১৯৭৬-৭৭ এর বাজেটঃ

উদ্দেশ্য
জেনারেল জিয়া বাজেট ঘোষণা করতে গিয়ে এর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন, অর্থনীতির অবিরাম স্থিতিশীলতার গুরুত্ব সামনে রেখে ১৯৭৬-৭৭ সালের বাজেট ও উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণীত হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতিকে পুনরায় মাথাচাড়া দিতে দেয়া যেতে পারে না। মূল্যস্তরকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দেয়া হবে না; ব্যালান্স অব পেমেন্ট পরিস্থিতির ওপর সদাসতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে বাঞ্চনীয় বিবেচিত না হলে কিছুতেই ঘাটতি অর্থ সংস্থানের আশ্রয় গ্রহণ করা হবে না। আগামী বছরের বাজেট প্রকৃত অর্থে জাতীয় সম্পদ শতকরা ৫ ভাগ বৃদ্ধি পাবে এই ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে। এতে মাথাপিছু আয় এবং অর্থনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য অবশ্যই বজায় রাখতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সহায়তার উদ্দেশ্যে অধিক পরিমাণে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের জন্য অর্থনীতিকে অবশ্যই সবল করে তুলতে হবে। ১৯৭৬-৭৭ সালে সামগ্রীকভাবে কৃষি খাতে শতকরা ২.৮ ভাগ এবং অন্যান্য খাতে শতকরা ৮—৯ ভাগ জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে।

মূল বাজেট
বাজেটে রাজস্ব অংশে আয় দাঁড়াবে ৯৬৬ কোটি টাকার কিছু বেশী, ব্যয় ৭৬৮ কোটি টাকা এবং উদ্ধৃত হবে ১৯৮’৫০ কোটি টাকা।সাধারণ প্রশাসন প্রতিরক্ষা শিক্ষা ও বিদেশী ঋণ পরিশোধ বাবদ উচ্চ বরাদ্দের ফলে ৭৫-৭৬ এর তুলনায় রাজস্ব ব্যয় বাড়ছে বারো শতাংশ।
রাজস্ব বাজেটের আয় আসবে বিভিন্ন কর থেকে ৭২৯ কোটি টাকা এবং কর বহির্ভূত আয় হবে ২৩৭ কোটি টাকা। শুষ্ক খাতে আদায় হবে ৩১৩ কোটি টাকা আয়কর থেকে আসবে ৮৮ কোটি টাকা, আবগরী শুল্ক খাত থেকে ২০০ কোটি টাকা বিক্রয় কর থেকে ১১৪ কোটি টাকা। করের বাইরে যেসব আয় হবে সেগুলো আসবে স্টাম্প, রেজিস্ট্রেশন, রেলপথ, সুদ,ডাক ও তার এবং রাষ্ট্রায়ও খাত থেকে।
রাজস্ব ব্যয়ের প্রধান প্রধান খাতগুলো হবে প্রতিরক্ষা (১৫৫ কোটি টাকা), স্বাস্থ্য (১০২ কোটি টাকা), পুলিশ (৪৪ কোটি টাকা), রাষ্ট্রীয় রেলওয়ে (৫৮ কোটি), সাধারণ প্রশাসন (৪৩ কোটি) অপ্রত্যাশিত ব্যায় (৪০ কোটি), অন্যান্য (১৯৪ কোটি) রাজস্ব ও কর আদায়কারী (২২ কোটি), স্বাস্থ্য (২৭ কোটি) বাংলাদেশ রাইফেলস (১৮ কোটি)। এছাড়া অন্যান্য খাতগুলো মিলিয়ে বাজেট সর্বমোট হবে ৭৬৮ কোটি টাকার ব্যয়।

বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট
বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন অংশ ব্যয় ধরা হয়েছে ১২২২ কোটি টাকা। এ টাকা ধরা হলেও অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে কার্যকালীন ঘাটতির জন্যে দশ শতাংশ কম করে নীট উন্নয়ন কর্মসূচীর জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে ১১০০ কোটি এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর জন্যে ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। অতঃএব নীট উন্নয়ন ব্যয় দাড়াচ্ছে ১১৪২ কোটি টাকা।
এই বিরাট পরিমাণ উন্নয়ন খরচার উৎস হিসাবে বৈদেশিকসহ অবদান হবে ৭৪৫ কোটি টাকা। খাদ্য উদ্বৃত্ত ১৭১ কোটি টাকার বিদেশী সাহায্য এর সঙ্গে যোগ করতে হবে। রাজস্ব বাজেটের উদ্ধৃত হতে ২০৯ কোটি টাকা আসবে। তাহলে সর্বমোট উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য আয় দাঁড়াচ্ছে ১১২৫ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যয় নির্ণয় করা হয়েছে ১১৪০ কোটি টাকা। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা।

কর ব্যবস্থা
এবারের কর ব্যবস্থার প্রধান চরিত্র হলো প্রত্যক্ষ কর। এ সম্পর্কে জেনারেল জেনারেল জিয়া বলেন, নতুন আর্থিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে আমরা কোন আয় বাড়ানোর মত সংকীর্ণ মনোভাব দ্বারা চালিত হব না। বাজেট ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যাবলী সজীব ও তৎপর করার প্রয়োজনীয়তা আমাদের মনে রাখতে হবে। ইতিপূর্বে সরকার পরোক্ষ সব কর থেকে প্রত্যক্ষ করের ওপর অধিক জোর দিতে চেয়েছেন, কিন্তু তা সহজসাধ্য হয়নি। বর্তমান বাজেটে স্বল্প আয়ের মানুষকে অব্যাহতি দেয়ার উদ্দেশ্য কর আরোপনীয় আয়ের নিম্নসীমা ৮৪০০ হতে বাড়িয়ে ৯,০০০ টাকা করা হয়েছে।
কৃষি আয় উপার্জনকারীর করভার শিথিল করার উদ্দেশ্যে উৎপাদন ব্যয় ও অন্যান্য প্রকৃত খরচ বাদ দেয়ার পর যে নীট কৃষিম আয় থাকে তার প্রথম ৩৬০০ টাকাকে করা আরোপণ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এর ফলে প্রদত্ত উৎপাদন ও অন্যান্য খরচের এলাউন্স বাদে কৃষিক্ষেত্রে ১২,৬০০ টাকা পর্যন্ত আয়ের জন্যে কোন আয়কর দিতে হবে না।
সীমিত আয়ের ব্যক্তিদের করভার লাঘব করার জন্যে কতকগুলি রিবেট প্রদান করা হয়েছে। অপ্রচলিত দ্রব্যাদির রফতানী ব্যবসা থেকে আয়ের ওপর যে আয়কর হয় তার শতকরা পনের ভাগ থেকে পঁচিশ ভাগ শর্তসাপেক্ষে কর রেয়াত করা হত। এখন এর পরিমাণ দ্বিগুণ করা হয়েছে।
কর অবকাশ এবারে অনেকটা সম্প্রসারিত করা হয়েছে। শিল্পন্নয়ন ত্বরান্বিত করা, গৃহনির্মাণ উৎসাহিত করা এবং পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে এ সম্প্রসারণ করা হয়।
১৯৪৭ সালের জমি হস্তান্তর অধ্যাদেশ বাতিল করে আয়কর আইনে একটি পরিপূর্ণ বিধান সংযোজিত হয়েছে। এখন থেকে জমি করসমূহকে একত্রিত করা হয়েছে।
২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজোতের খাজনা মওকুফ অব্যাহত রাখা হয়। খাজনা,সেচ ও অন্যান্য ভূমিভিত্তিক করের পরিবর্তে ভূমি উন্নয়ন কর নামে একক কর প্রবর্তন করা হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জোতের সেচ ও অন্যান্য পরিচিত হবে এটা করের হার হবে নিম্নরূপঃ
২৫ বিঘার ঊর্ধ্বে বিঘাপ্রাপ্ত পাঁচ টাকা। শহরাঞ্চলে, (ঢাকা,নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনায়) বিঘাপ্রতি শিল্প ও ব্যবসায় লটের জন্যে পাঁচ শ টাকা, বাস্তু ও অন্যান্য প্লটের জন্যে বিঘা প্রতি এক শ টাকা, অন্যান্য শহরে যথাক্রমে এক শ ও পঞ্চাশ টাকা। বিভিন্ন পানি প্রকল্পগুলোর ব্যয় নির্বাহের জন্যে উপকৃত ব্যক্তিদের ওপর সুফল- পরিমাণের তিন শতাংশ হারে পানিকর বসানো হবে। ভূমি উন্নয়ন কর থেকে হবে মোট আয় হবে ষোল কোটি এবং পানিকর থেকে হবে বিশলক্ষ টাকা।

ঘাটতি পূরণ পদ্ধতি
ঘাটতি অর্থসংস্থান করে স্বাভাবিক অবস্থায় ঘাটতি পূরণ করা হবে না বলে জেনারেল আশ্বাস দিয়েছেন। পনের কোটি টাকা ঘাটতি পূরণ প্রসঙ্গে তিনি প্রথমতর প্রত্যক্ষ কর ও দ্বিতীয়তর ভর্তুকি হ্রাসের ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন। প্রত্যক্ষ কর করেছি। ভর্তুকির ফলে মুদ্রা সরবরাহ অনেকটা বেড়ে যায়, মূল্যমানও ফল স্বরূপ বেড়ে যায়। এ জন্যে রাসায়নিক সারের ভর্তুকি হার বিশ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে। যার ফলে ইউরিয়ার মণপ্রতি দর পঞ্চাশ টাকা থেকে বেড়ে ষাট টাকা হবে, টিএসপির মূল্য হবে চল্লিশ থেকে আটচল্লিশ টাকা। ভর্তুকি কমিয়ে সরকার এই টাকা ব্যবহার করবেন ঘাটতি পূরণের কাজে।

অন্যান্য
কৃষিখাত, বন্যানিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ উন্নয়ন, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কার্যাবলীর জন্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দের দ্বারা কৃষির ওপর সর্বাধিক অগ্রাধিকার প্রদান এই বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে। এরপর শিল্প পরিবহন ও যোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সামগ্রিক উন্নয়নকে লক্ষ্য রেখে যথোপযুক্ত মুদ্রা সরবরাহ ও বাণিজ্য নীতি তৈরি করা হবে।

লক্ষ্যমাত্রা
খাদ্যোৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক কোটি একত্রিশ লক্ষ টন। সার বিতরণের পরিমাণ ৫২৫ হাজার টন দাঁড়াবে। ১৯৭৬-৭৭ সালে পাট উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫৫ লক্ষ বেল। চায়ের উৎপাদন মাত্রা রয়েছে সাত কোটি দশ লক্ষ অয়াউন্ডের উপরে। চল্লিশ হাজার হবে পাম্পের সংখ্যা—আগামী জুন সমাপণীতে।

মুদ্রানীতি
মুদ্রানীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে জেনারেল বলেন, মুদ্রাস্ফীতির চাপ যাতে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে তার জন্যে মুদ্রা সরবরাহ ও ঋণের ক্ষেত্রে শৃংখলা সংরক্ষণ অব্যাহত রাখতে হবে।উৎপাদন ও মূল্যস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় সাধনের জন্যে অন্যান্য বিষয় ছাড়াও, ঋণগ্রহীতাগণ কর্তৃক ব্যাংক ঋণের সুষ্ঠু— ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আমি এখানে অবশ্যই উল্লেখ করবো যে রাষ্ট্রায়ত্ত কর্পোরেশন— এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর এব্যাপারে একটা বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। চলতি বছরের ন্যায় আগামী বছরে ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চাহিদার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দান অব্যাহত থাকবে। কৃষি ঋণের চাহিদার প্রতি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হবে। সঞ্চয় বাড়াবার জন্য বাজেটে এক নতুন ব্যবস্থা দেওয়া হয়। সরকারী ইত্যাদি কর্মচারীদের যাদের আয় সাড়ে সাতশ টাকার উপরে তাদের বাধ্যতামূলকভাবে
২ ১/২% সঞ্চয় করতে হবে।

মন্তব্য
রাজস্ব বাজেট তৈরী হয়েছে উদ্বৃত্ত বাজেট হিসাবে। দেশে এখনো ১৯৬৯-৭০ এর তুলনায় মূল্যমান বেশী আছে। এ অবস্থায় উদ্ধৃত বাজেট তৈরীর মাধ্যমে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে দামের উপর প্রভাব বিস্তারের মানসিকতা প্রকৃত অর্থে সঠিক। কিন্তু সামগ্রিক বাজেটে রয়েছে ঘাটতির মতাদর্শ। যদিও ঘাটতির পরিমান অত্যন্ত ম, তবু তা প্রকৃত অর্থে ঘাটতি চরিত্রকে প্রতিফলিত করছে। এখানে একথা বলা যায় যে যেহেতু গত অর্থবছর গুলোর তুলনায় এ অর্থবছরে মূল্যস্তর প্রচুর কমেছে এবং মুদ্রাসংকোচন নীতির ফলে বাজারে চালু মুদ্রার সংখ্যা কমে গেছে সেহেতু ঘাটতির পরিমান বাড়াবার প্রয়োজন হলে তা অনায়াসে করা যের। অথচ সাধারণ জনগণের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে তা করা সম্ভব হয়নি।
ঘাটতি পূরণের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে কিছুটা নতুনত্ব। অনুন্নত দেশগুলোতে সাধারণতঃ পরোক্ষ করকে বেশি ব্যবহার করা হয়। জনপ্রিয়তার সুবিধার জন্যেই এটা করা হয়। বাংলাদেশেও এ নিয়ম প্রচলিত ছিল। এবারে প্রত্যক্ষ করকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষ করের সবচেয়ে বড় সুবিধা এই যে, উচ্চবিত্তের লোকের উপর এর প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে বেশি পড়ে। ফলে সাধারণ জনগণ অপেক্ষাকৃত সুবিধা ভোগ করতে পারে। এবারের বাজেটে এ সুবিধা বর্তমান।
উচ্চবিত্তের সত্তা নিরূপণে বাজেটে এক নতুন ভূমিকা পালন করেছে। আয়করের সর্বনিম্ন সীমা বাড়িয়ে দেওয়ায় মূল্যবৃদ্ধিজনিত সমস্যা থেকে আরও অধিক জনগণ মুক্তি পাবে। কৃষি আয়ের ব্যাপারে একই ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বল্প আয়ের কৃষকেরা কর মুক্ত। ভূমি উন্নয়ন কর নামের নতুন কর প্রকৃত অর্থে ভূস্বামীদের উপরেই পড়ছে। চালের দামে পতন ঘটায় এমনিতেই কৃষকরা কিছুটা চিন্তিত তার ওপর এ কর হয়তো কিছুটা অস্বস্তিকর হতে পারে। তদুপরি সারের উপর ভর্তুকি তুলে দেওয়ায় সারের দাম যাচ্ছে মনপ্রতি বেড়ে। সুতরাং সারের দামের বৃদ্ধি একটু কষ্টকর হয়ে যেতে পারে।
ভর্তুকি না কমিয়ে বরং সামান্য কিছুটা ঘাটতি অর্থসংস্থান করলে সম্ভবত ভালো হতো। পনেরো কোটি টাকার ঘাটতি অর্থ সংস্থান অর্থনীতির ওপর সামান্যই প্রভাব বিস্তার করবে। ঘাটতি অর্থসংস্থান ছাড়াও সরকার ব্যাংক বহির্ভূত মুদ্রা থেকে নানা উপায়ে যেমন লটারী, সার্টিফিকেট, প্রাইজবন্ড ইত্যাদির মাধ্যমে এ টাকার সংস্থান করতে পারতেন।
অবশ্য এ সঙ্গে একথাও উল্লেখ প্রয়োজন যে যদিও ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে তবু সার বন্টন, পানি উন্নয়ন, পাম্প স্থাপন, কৃষি ঋণদান ইত্যাদি পরিকল্পনাগুলো বাজেটে এত সুষ্ঠুভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যা থেকে বোঝা যায় ভর্তুকি কমের প্রতিক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় করার সবরকম পথই রয়েছে। অতএব সাধারণ ধারণা অনুসারে ভর্তুকি কম করায় দুশ্চিন্তার তেমন কোন যুক্তি থাকে না।
ইতিমধ্যে এ ধারণাও চালু হয়েছে যে প্রতিরক্ষা খাতে আমরা অনেকটা খরচ করতে যাচ্ছি একথাও সবটা ঠিক নয়। কেননা, গত বাজেটের চেয়ে খাতে খরচা বেড়েছে মাত্র সাত শতাংস। যেখানে ভূমি রাজস্ব আদায় খাতে বেড়েছে দশ শতাংশ। রেলওয়ে খাতে বেড়েছে ষোল শতাংশ।স্বাস্থ্য খাতে বেড়েছে বারো শতাংশ। সুতরাং প্রতিরক্ষায় এমন কি বাড়লো। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা খাতে আরও বেশি বৃদ্ধি করা যুক্তিসঙ্গত ছিল।
মুদ্রানীতি সম্পর্কে যে আলোক দেওয়া হয়েছে তা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। ছোট ব্যবসায় অধিক ঋণের প্রয়োজন রয়েছে, অথচ মুদ্রা সরবরাহ যথেষ্ট বাড়ানোও সঠিক হবে না।মুদ্রা সংকোচনের জন্যে কোন কোন দেশ ব্যাংক একাউন্টস পর্যন্ত সাময়িকভাবে ফ্রিজ করে দিয়েছিল। যেমন ভারত। এটি একটি চূড়ান্ত প্রক্রিয়া। অতটা চূড়ান্ত পর্যায় যাওয়ার অসুবিধা অনেক। একথা স্মরণ রেখে কেবলমাত্র ২ ১/২% বলপূর্বক সঞ্চয় যথেষ্ট অর্থপূর্ণ তাও আবার যথেষ্ট আয়কারী শ্রেণীর দাবী করা হয়েছে। এর ব্যবস্থা সঞ্চয় চাহিদাকে মেটাতে পারবে বলে আশা করা যায়।
প্রাইজবন্ড সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে তা আরও সঠিক। বাজারে প্রাইজবন্ড যা চালু রয়েছে তা থেকে সরকার সংগ্রহ করছেন আড়াই কোটি টাকার মত। অথচ বছরে পুরস্কার হিসাবে দিচ্ছেন মাত্র দশ লক্ষ টাকা। এতে সরকারের খরচ পড়ছে ৪%। এ খরচা বর্তমান সুদের হারের বিবেচনায় অত্যন্ত কম। এ অবস্থায় প্রাইজের পরিমাণ পঁচিশ হাজার সর্বোচ্চ পরিমাণ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা করার প্রতিক্রিয়া সরকারের জন্যেও যেমন লাভজনক, জনগণের জন্যেও তেমনি।
তথাকথিত সমাজতন্ত্রের বুলিতে অর্থনীতি ছিল ঘোলাটে, কুয়াশাবৃত। যে কোন একটি দিকে অর্থনীতি মোড় ঘোরানো করানো প্রয়োজন ছিল। ব্যক্তিগত সেক্টরের প্রতি এ বাজেট অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছে। বিনিয়োগ কর্পোরেশন নামক নতুন ব্যবস্থা চালুর আশ্বাস দিয়েছে। যৌথ বিনিয়োগকে করেছে উৎসাহিত। বিদেশী মূলধনকে আহ্বান করা হয়েছে। তাড়াতাড়ি উৎপাদন করতে পারে এ ধরনের শিল্পকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এতে অন্ততঃ একটি মতাদর্শের সুস্পষ্ট বিকাশের কথা খোলাখুলি প্রকাশিত হয়েছে। আলোচনা বা সমালোচনার অবকাশ যাই থাকুক না কেন কুয়াশাচ্ছন্নতার কোন দোষে দুষ্ট নয়।
কর্পোরেশনগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।প্রত্যেক শিল্পের পরিপূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার যাতে হতে পারে সে আশ্বাস দেওয়া যায়। ফলে উৎপাদন বাড়বে কর্মসংস্থান বাড়বে হ্রাস পাবে দ্রব্যমূল্য।
ওয়েজআর্ন স্কীমের ওপর করের হেরফের কাঁচামালের উপর কিছু প্রতিক্রিয়া করতে পারে।
বিদেশী ঋণের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীলতা গত বছরেও ছিল, এবারে আরও বেড়েছে। এ ঋণ যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব না হয় তবে অর্থনীতির জন্যে একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাছাড়া ওই পরিমাণ ঋণ সত্যি সত্যি এসে না পৌছালে পরিকল্পনা ব্যাহত হবে। তবে সঠিক ব্যবহার হলে নিঃসন্দেহে অর্থনীতিতে আরও অগ্রগতি দেখা যাবে।
জিনিসপত্রের দামের ওপর এ বাজেট খুব একটা প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া করছে না। প্রায় কোন দ্রব্যেরই দাম বাড়ানোর সম্ভাবনা নেই। ব্লেড, টেলিভিশন, এক ব্যান্ড রেডিও, মোটর সাইকেল গ্যাসকুকার, ইঞ্জিন ইত্যাদির উপর কর শিথিল করার দাম কমে যাবে। অবশ্য মূল মান এসব দ্রব্যের দাম না কমালেও চলতো। যানবাহনের দাম কমবে। অন্যদিকে পৃত ও নির্মাণ কাজে উৎসাহ দেওয়ায় এবং আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদির দাম কমায় বাসস্থান সমস্যা অনেকটা কমবে।
অতএব এ বাজেট একদিকে যেমন দীর্ঘ মেয়াদি দৃষ্টিসম্পন্ন অন্যদিকে স্বল্প মেয়াদীও। একদিকে জনগণের প্রকৃত আয় বাড়াবার জন্যে আয়কর নীতিতে সুবিধা দেওয়া হয়েছে অন্যদিকে পণ্যাদির মূল্য হ্রাসের দিকে লক্ষ রাখা হয়েছে। ব্যক্তিগত খাত ও কর্পোরেশনগুলোতে অধিক উৎপাদনের ব্যবস্থা রয়েছে। কৃষিজাত পণ্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে বহুবিধ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফারাক্কা সমস্যার একটা সমাধান প্রচেষ্টা ও রয়েছে। যাতে দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন বাড়তে পারে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ জনিত সমস্যারও যথোপযুক্ত জবাব রয়েছে। আমদানী শুল্ক কমিয়ে আমদানী বাড়াবার চেষ্টা করা হয়েছে। অবশ্য আমদানী না বাড়লে সরকারী আয় কমে যাওয়ার ভীতিও অমূলক নয়। যাহোক, কিছু কিছু দ্বিমত থাকলেও একথা জোর গলায় বলা যায় ১৯৭৬-৭৭ এর বাজেট একটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং সুষ্ঠু পদক্ষেপ।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!