1976.04.09 | বাংলাদেশে সংসদ সদস্যদের সামাজিক অবস্থান | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ এপ্রিল ১৯৭৬
বাংলাদেশে সংসদ সদস্যদের সামাজিক অবস্থান
অনুন্নত দেশে একজন সংসদ সদস্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনে তাদের প্রভাব অনস্বীকার্য।
সাধারণতঃ দেখা যায় সংসদ সদস্যরা সব সময় একটা বিশেষ শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের একজন সংসদ সদস্য যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন, আমাদের দেশের সংসদসদস্যরা সেই শ্রেণী থেকে আসেন না। অনুন্নত দেশগুলোর এটাই বৈশিষ্ট।
পাকিস্তান আমলে যে শ্রেণী জাতীয় সংসদের প্রতিনিধিত্ব করতো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে শ্রেণীর পরিবর্তন ঘটেছে। এখানে প্রতিনিধিত্ব করছে অন্য শ্রেণী। সেই শ্রেণী, বিশেষ অবস্থায় , বিশেষ পরিস্থিতিতে সমাজতে নেতৃত্ব দিয়েছে।
দেশে বর্তমানে কোন জাতীয় সংসদ নেই। দেশে পট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদ বাতিল করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদ এবং জাতীয় সংসদের সদস্যদের নিয়ে প্রশ্নের অন্ত নেই। প্রশ্ন উঠেছে তাদের সামাজিক ভূমিকা নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় সংসদের প্রতিনিধি হিসাবে তারা কতটুকু দায়িত্ব পালন করছেন?
বাংলাদেশে এই জাতীয় সদস্যদের নিয়ে একটি গবেষণা চালানো হয়েছিল আজ থেকে বেশ কিছুদিন আগে। গবেষণাটি চালিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ডঃ রওনক জাহান। উক্ত গবেষণায় বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের একটা পূর্ণাঙ্গ সমাজচিত্র ফুটে উঠেছিল। দেশে যখন একটা নৈরাজ্য, অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছিল, তখন এগিয়ে এসেছিলেন রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ। সমস্ত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করেও তারা সংসদ সদস্যদের নিয়ে এ গবেষণাটি চালান।
পরিস্থিতির কারণে সে গবেষণার ফলাফল শেষ অব্দি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি সংসদ সদস্যদের বর্তমান ভূমিকা জনসমক্ষে তুলে ধরা। গবেষণার কাজ এখনও শেষ হয়নি। এ কাজ এখনও চলছে। ডঃ রওনক জাহান এখন বিদেশে। তার হয়ে গবেষণার শেষ কাজটুকু এখন করে যাচ্ছেন ডঃ হারুন।
উদ্দেশ্য মূলতঃ এ গবেষণাটা শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়েই এ গবেষণাটা চালান হয়। ডঃ জাহান তার গবেষণার জন্য সর্বমোট ২৮৩ জন সংসদ সদস্যের সাথে আলাপ করেন।
গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল তিনটিঃ
(ক)সংসদ সদস্যদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিচয় ও তাদের ভূমিকা,
(খ) জাতীয় সংসদের বাইরে তাদের ভূমিকা,
(গ) উঁচুস্তরের সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে তাদের সম্পর্ক।
আজকের নিবন্ধে সংসদ সদস্যদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিচয় নিয়েই আলোচনা করবো।
গবেষণার সুবিধার জন্য সংসদ সদস্যদের কাছে তাদের বয়স, পিতার শিক্ষাগত যোগ্যতা, নিজ শিক্ষাগত যোগ্যতা আর বিগত রাজনৈতিক আন্দোলন গুলোতে তাদের ভূমিকা ইত্যাদি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। এসব প্রশ্নের উত্তরে সংসদ সদস্যরা অনেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উত্তর দিয়েছেন, অনেকে এড়িয়ে গেছেন।
ফলাফল
গবেষণায় দেখা গেছে, সংসদ সদস্যদের সবাই বয়সে তরুণ। এদের তিন ভাগের এক ভাগ জাতীয় সংসদে নতুন এসেছেন। তিনভাগের একভাগের রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনায় পাঁচ বছরের কম সময়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। শতকরা ৮৯ জন সংসদ সদস্যের পিতা মেট্রিক পাস করেননি, জাতীয় সংসদ সদস্যদের অভিভাবকদের (পিতা) শতকরা ৩৫ জন কৃষিজীবি, ১৮ জন জমির মালিক, ১৪ জন ব্যবসায়ী এবং মাত্র ৫ জন আইন ব্যবসা করেন। শতকরা ৪৭ জন সংসদ সদস্যদের পিতার বাৎসরিক আয় দশ হাজার টাকার উপরে।
সংসদ সদস্যদের শতকরা ৭০ জন গ্রাজুয়েট অথচ তাদের পিতাদের শতকরা ১০ জন ছিলেন বিএ পাশ।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, সংসদ সদস্যদের অনেকেই আইন ব্যবসা করেন৷ অথচ ষাট এর দশকে তৎকালীন পাকিস্তানী আমলের পার্লামেন্টে সদস্যদের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল বেশী৷ এরও আগে চল্লিশের দশকে পার্লামেন্ট মূলত আইন ব্যবসায়ীদের দ্বারাই নির্ধারিত হতো। গত নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে শতকরা ২৬ জন আইনজীবী ও শতকরা ২৩ জন ব্যবসায়ী। শতকরা ১২ জন শুধুমাত্র রাজনীতি করেন। কৃষিজীবী শতকরা ১৫ জন। শতকরা ৬৬.৬ জন কৃষিকাজ ও আইন ব্যবসা দুটোই এক সাথে করেন।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, শতকরা ৭০ জন সংসদ সদস্যদের বাৎসরিক আয় বিশ হাজার টাকার ওপরে৷ শতকরা ১২ জনের আয় ৫০ হাজার টাকার ওপরে। শতকরা ৩০ জন এম, পি ‘র ২৫ বিঘার উপরে জমি আছে। রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী ও ময়মনসিংহ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের জমির পরিমাণ অন্যান্য এলাকার চাইতে বেশি। নির্বাচিত এম, পি দের শতকরা ২৫.৪ জনের রাজনৈতিক সংগঠন গুলতে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ১০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে শতকরা ৫৩ জনের এবং ১৫ বছরের বা কার উর্ধ্বে অভিজ্ঞতা রয়েছে শতকরা ৪১ জনের। এদের অধিকাংশই ১৯৬৯ – ৭০ থেকে তাদের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছেন। শতকরা ৭৬ জন বলেছেনঃ তারা কখনো তাদের নিজস্ব দল ত্যাগ করেননি৷ শতকরা ২৩ জন বলেছেনঃ তারা তাদের পূর্বের দল ত্যাগ করে নতুন দলে এসেছেন এবং এম, পি হয়েছেন। নির্বাচিত এম, পি দের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিলঃ জাতীয় সংসদে শাসনতন্ত্র সংশোধন সম্পর্কে তারা কোন প্রস্তাব আনতে চেয়েছিলেন কি না? এর উত্তরে ৫০ জন এম, পি (২৮৩ জনের মধ্যে) কোন উত্তর দেননি। সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ (১১২ জন পক্ষে এবং ৯১ জন বিপক্ষে) সংশোধনী আনার পক্ষে ছিলেন। অর্থাৎ শতকরা ৫৯ জন শাসনতন্ত্রে সংশোধনী (এমেগুমেন্ট) আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা কেউই পরিষ্কার করে বলেননি যে তারা কোন ধরণের সংশোধনী আনতে চেয়েছিলেন।
সংসদ সদস্যদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, আপনার মতে দেশের প্রধান তিনটি সমস্যা কি? এর উত্তরে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন শতকরা ৪৫.৬ জন, শতকরা ৪৫.৬ জন উল্লেখ করেছেন অর্থনৈতিক সমস্যার কথা, শতকরা ৪৩.৯ জন উল্লেখ করেছে খাদ্য সমস্যার কথা৷ এসব সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে শতকরা ৭৪ জন উৎপাদন বাড়ানোর কথা উল্লেখ করেছেন। শতকরা ১৯ জন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের কথা উল্লেখ করেছেন। শতকরা ২৪ জন শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও বরিশাল থেকে নির্বাচিত এম, পি রা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির উপর জোর দিয়েছেন। অপরপক্ষে নোয়াখালী, পাবনা, দিনাজপুর ও টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা অর্থনৈতিক সমস্যার উপর জোর দিয়েছেন।
জাতীয় সংসদ সদস্যদের কাছে থেকে যেসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে, সেগুলো এ রকমঃ
প্রশ্নঃ সংসদ সদস্যদের বয়স কত?
উত্তরঃ ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৩১ জন (শতকরা ১১ ভাগ), ৩১ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে ৬৩ জন (শতকরা ২২.৫%), ৩৬ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে ১১২ জন (শতকরা ৪০%), ৪৬ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে ৬১ জন (শতকরা ২১.৭%), ৫৬ বছরের উর্ধ্বে ১৩ জন (৪৬%)। গবেষণায় দেখা গেছে, ২৮৩ জনের মধ্যে ৯৬ জনের বয়স ৩৫ বছরের নীচে৷
প্রশ্নঃ এম, পি দের পিতার শিক্ষাগত যোগ্যতা
উত্তরঃ অশিক্ষিত (লেখা পড়া জানেন না এমন)ঃ ৪ জন (১%), প্রাথমিকঃ ৯৬ জন (৩৩.৯%) মাধ্যমিকঃ ১১৭ জন (৪১.৩%), কলেজঃ ৩০ জন (১০.৬%), বিশ্ববিদ্যালয়ঃ ২৫ জন (৪.৪%), কারিগরীঃ ৪ জন ও অন্যান্য ৩ জন।
প্রশ্নঃ এমপিদের পিতার পেশা
উত্তরঃ আইনজীবী ১৪ জন(৫%), ব্যবসায়ী ৪১ জন (১৪.৬%), জমির মালিক ৫১ জন (১৮.২%), কৃষিজীবী ১০০ জন (৩৫.৭%), চাকুরীজীবি ৪২ জন (১৪%), শিক্ষা ২১ জন (৭.৫%), ডাক্তার ৭ জন (২.৫%), রাজনৈতিক কর্মী ২ জন(০.৭%), অন্যান্য ২ জন (০.৭%)।
প্রশ্নঃ পিতার ব্যবসায়িক আয়
উত্তরঃ পাঁচ হাজারের নীচে ৬৩ জন (২৩.৫%), দশ হাজারের নীচে ৭৮ জন (২৮.৯%), পঁচিশ হাজারের নীচে ৮০ জন (২৯.৩%), পঞ্চাশ হাজারের নীচে ৩০ জন (১১.১%) ও পঞ্চাশ হাজারের উপরে ১৯ জন (৭%)। মোট ২৬৯ জন।
প্রশ্নঃ এম, পি দের শিক্ষাগত যোগ্যতা
উত্তরঃ ম্যাট্রিক পাস নন ৯ জন (৩.১%), ম্যাট্রিক ৩১ জন (১০.৯%), উচ্চ মাধ্যমিক ৩৫ জন (১২.৩%), ডিগ্রী ১১৯ জন(৪২%), স্নাতকোত্তর ৭৮ জন (২৭.৫%)।
প্রশ্নঃ এম, পি দের নিজস্ব পেশা
উত্তরঃ আইনজ্ঞ ৭০ জন (২৬%)
প্রশ্নঃ এম, পি দের নিজস্ব বার্ষিক আয়
উত্তরঃ ১৪ হাজার থেকে ২০ হাজারঃ ৯১ জন (৩২.১%), ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজারঃ ৯০ জন (৩১.৮%),৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ৬৯ জন (২৪.৩%), ৫০ হাজারের ওপরে ৩৩ জন (১১.৬%)
প্রশ্নঃ এম,পি দের জমির পরিমাণ
উত্তরঃ এক একরের কমঃ ৩ জন (১.২%), ৩ একরের কমঃ ২৬ জন(১০%), ৩ একর থেকে ৬ একরের মধ্যে ৯০ জন (১২.৬%), ৬ থেকে ১০ একর ৩২ জন (১৩.৫%), ১০ থেকে ১৫ একরের মধ্যে ২৫ জন (১০.৫%), ১৫ থেকে ২৫ একরঃ ৪৯ জন(২০.৬%), ২৫ থেকে ৪০ একরঃ ৪৮ জন (২৯.২%), ৪০ একরের উপরে ২৪ জন (১০.২%)।
প্রশ্ন এম, পি দের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা
উত্তরঃ ৫ বছরের কম অভিজ্ঞতা ১৮ জন (৬.৫%), ৫ থেকে ১০ বছর, ৩৭ জন (১৩.৪%), ১১ থেকে ১৫ঃ ৩৩ জন (১১.৯%), ১৫ বছরের উপরে ১৮৮ জন (৬৮.১%)
মোট ২৭৩ জন।
প্রশ্নঃ রাজনৈতিক দল বা সংগঠনে এম, পি দের অভিজ্ঞতা
উত্তরঃ ৫ থেকে ১০ বছর, ৭২ জন (২৭.৩%), ১১ থেকে ১৫ বছর, ১২ জন (৪.৫%), ১৫ বছরের ওপরে ১১০ জন (৪১.৪%)।
মোট ২৬৩ জন।
প্রশ্নঃ রাজনৈতিক দলে এম, পি রা কতদিন ধরে আছেন?
উত্তরঃ পূর্বের রেকর্ডঃ গ্রামে ৪৭ জন (৩৩.৯%), মহকুমা শহরে ১৫৯ জন (৬২%), জেলায় ১৮১ জন (৭০%), শহর পর্যায়ে ৩৪ জন (১৩%)।
মোট ২৫৬ জন।
বর্তমান অবস্থায়ঃ গ্রামে ৫১ জন (২১%), মহকুমায় ৬৯ জন (২৮.৭%), জেলায় ১১৮ জন (৪৯%), জাতীয় পর্যায়েঃ ৫৩ জন (২২%)।
***
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1976.04.09-bichitra.pdf” title=”1976.04.09 bichitra”]