You dont have javascript enabled! Please enable it! 1976.05.28 | ফারাক্কা মার্চ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা - সংগ্রামের নোটবুক

ফারাক্কা মার্চ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা
প্রচ্ছদ কাহিনীঃ মাহফুজ উল্লাহ

গঙ্গার পানির ওপর নিজেদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিযুক্ত মানুষের মিছিল এগুচ্ছে। অন্তহীন মানুষের মহা মিছিল শুরু হয়েছে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে।রাজশাহী মিছিলের নেতৃত্ব করেছেন শতাব্দী প্রবীণ মাওলানা ভাসানী।রাজশাহী থেকে সীমান্তের কাছাকাছি কনসার্টে মিছিল পৌঁছে যাবে ৩১ ঘন্টায় রাজশাহী আম কুঞ্জের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে মিছিল কণ্ঠে কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে স্লোগান-চলো চলো ফারাক্কা চলো, মরণ বাঁধ ফারাক্কা বাঁধ উড়িয়ে দাও ।

(১)
প্রমত্তা পদ্মার দীর্ঘশ্বাস আর লাখো মানুষের বিক্ষোভ। যুগ-যুগান্ত ধরে এই জনপদের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে গঙ্গা। একদিন মহাদেবের জটা ধরে নেমেছিল এই নদী। হিমালয়ের পাদদেশে গাড়ওয়ালে এর উৎপত্তি,বঙ্গোপসাগরে এর বিলয়। প্রকৃতির তাড়নায় এই রাক্ষুসী গঙ্গা বহুবার গতি পরিবর্তন করে কত বাজার বন্দর, বৃক্ষশোভিত গ্রাম, শস্যশ্যামল মাঠ-প্রান্তর, মসজিদ-মন্দির, মানুষের কীর্তি যে ধ্বংস করেছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রকৃতির এই দুরন্ত ভাঙ্গা-গড়ার সঙ্গে প্রায়শঃ নতি স্বীকার করতে হয়েছে মানুষকে। রাজশাহীর এককালের বর্ধিষ্ণু গ্রাম-চর সাইপাড়া, কাদিরপুর, শ্রীরামপুর, সাহেবগঞ্জ, নবীনগর,হাবাসপুর,নওয়াবগঞ্জ বাজার,বল্লরী প্রভৃতি গ্রাম এই নদীগর্ভে সমাধিস্থ। এইসব গ্রাম স্মৃতি মানুষের মুখে মুখে নানা কাহিনীর সৃষ্টি করেছে। বহু স্মৃতিকথাই আজ বিস্তৃতির গর্ভে বিলীন। গঙ্গার স্বাভাবিক গতি প্রবাহের সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম বিরামহীন।
উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজশাহীর শ্রীরামপুরে অবস্থিত জেলার সরকারি দপ্তর খানা ইউরোপিয়ান সাহেবের কুঠি সাহেবগঞ্জ প্রভৃতি নদীগর্ভে নিমজ্জিত হলে জনসাধারণ ভীত হয়ে ওঠে। অতঃপর বাঁধ দিয়ে শহর রক্ষার চেষ্টা শুরু হয়। ইংরেজি ১৮৮৫ সর্ব সর্ব প্রথম ১৭২৯ ফিট বাঁধ তৈরি হয়।এটাই রাজশাহীর প্রথম সরকারি বাঁধ পরবর্তীকালে আরো একটি বাঁধ তৈরি হয়েছে দুর্বার গতি গঙ্গাকে রোখবার জন্য। আজ আর এসব বাঁধের প্রয়োজন নেই। গঙ্গার বুকে বালিয়াড়ি আজ উপহাস করেছে এই বাঁধকে।
সীমান্ত পেরিয়ে গঙ্গা নাম ধরেছে পদ্মা। এ নদীর উত্তর (উচ্চ) প্রবাহ গঙ্গা, ও দক্ষিণ (নিম্ন) প্রবাহ পদ্মা নামে খ্যাত। ফানডেন ব্রোকের নকশায় (১৬৬০) দেখা যাচ্ছে রাজমহলের কিছু দক্ষিণ হতে আরম্ভ করে মুর্শিদাবাদ কাশিমবাজার এর একটু উত্তর হতে এই গঙ্গার তিনটি দক্ষিণবাহি শাখা একত্রে সোজা দক্ষিণমুখী হয়ে সমুদ্রে যাত্রা করেছে। এক শতাব্দি পর রেনেলের নকশায় রাজমহলের দক্ষিণ-পূর্ব তিনটি শাখা একটি মাত্র শাখায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং তাই হচ্ছে দক্ষিণ বাহিনী গঙ্গা। রেনাল এই দক্ষিণমুখী নদীকে গঙ্গা বলেননি। তিনি গঙ্গা বলেছেন আরেকটি জলধারাকে যে প্রবাহ একটি অধিকতর প্রশস্ত জীবন্ত এবং দুর্গম যেটি পূর্ব দক্ষিণ মুখী হয়ে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে সাগরে মিলেছে। পঞ্চদশ শতকের গোড়া থেকেই বড় গঙ্গা অর্থাৎ পদ্মা বৃহত্তম নদী।
বন্যা বিপ্লবের জলোচ্ছ্বাসে রাতারাতি খাত পরিবর্তনের ফলে পদ্মা যুগে যুগে মানুষের বহু কির্তী নাশ করেছে। এজন্য বহুস্থানে এই নদী কীর্তিনাশা বলে পরিচিত। প্রসিদ্ধি লাভের পর থেকে উত্তর থেকে সরে এসেছে পদ্মা। নওয়াবি আমলে যে পদ্মা মুর্শিদাবাদ ভগবান গোলার মরিচায় কাতলা মারার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হত, আজ সেই পদ্মাই রাজশাহী শহরকে কোলে নিয়ে খেলা করছে।
পদ্মা অর্বাচীন নদী। রেনেল ব্রোকের নকশা পদ্মা প্রশস্ত নদী। সিহাবউদ্দিন তালিশ (১৬৬৬) ও মির্জা নাথের (১৬২৪) বিবরণীতে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংগ্রামের উল্লেখ, ইছামতীর সংগ্রামে ইছামতীর তীরে যাত্রাপালার এবং তিন মাইল উত্তর-পশ্চিমের ডাক চর এবং পদ্মার দক্ষিণ গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র সম্মিলিত প্রবাহের সমুদ্র যাত্রা। কিন্তু তখনও গঙ্গার এই প্রবাহের সর্বত্র পদ্মা নাম পাওয়া যায়না। পদ্মা নামের সন্ধান মেলে আইন-ই-আকবরী ও চৈতন্যদেবের পূর্বব্ঙ্গ ভ্রমণ প্রসঙ্গে।
সেই গঙ্গা-পদ্মা তরঙ্গিনী আজ মৃত প্রায়।পদ্মার বুকে সাহসে বুক বেঁধে কোন মাঝেই এখন আর নৌকা ভাসায় না কোন জেলে মাছের জন্য কাক ভোরে উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে খেলা করে না। ফারাক্কার কাছে বাংলার বুকে আজ শ্মশানের পদধ্বনি। “ও গঙ্গা তুমি বইছো কেন?- এই সুরে আর কেউ গান ধরে না। পদ্মার বুকে চিরে আজ ধু ধু বালিয়াড়ি। সেই গঙ্গাকে স্রোতস্বিনী করে তোলার জন্য শুরু হয়েছে মানুষের মিছিল। দৈনিক বাংলার জহিরুল হক বলেছেন, মিছিলের গতি দুর্বার। মিছিল তার লক্ষ্য পথে দুর্বার বেগে এগিয়ে চলেছে। মিছিলের গতি যেন প্রমত্ত গঙ্গা-পদ্মার সেই হারিয়ে যাওয়া খরস্রোত। মিছিলের গতিবেগ এসেছে প্রিয় মাতৃভূমির সমস্যা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতনতা থেকে।

(২)
১৬ ই মে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে শুরু হয়েছে ফারাক্কা মহামিছিলের অভিযাত্রা। এর আগে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে রাজশাহী এসে পৌঁছেছে মানুষের ঢল। ছোট শহর রাজশাহী, এককালে রানী ভবানীর জমিদারি বলে খ্যাত এই শহর মানুষের পদভারে টলটলায়মান। কেমন করে সুদূর অতীতে এই জেলার নামকরণ হয়েছিল রাজশাহী আছে নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। অনেকে বলেন, একসময় বহু রাজার বাস ছিল শহরে। সে জন্যে নামকরণ হয়েছে রাজশাহী। আজ অনেকেই একথা মানতে রাজি নন।
ফারাক্কা মিছিলের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে মানুষ। যুবক বৃদ্ধ কৃষক-শ্রমিক, কুমার কুমারী,জেলে তাঁতি এসেছেন সবাই।
রোববার সকাল দশটায় শুরু হলো মহামিছিলের অভিযাত্রা। সকাল দশটার আগেই মাদ্রাসা ময়দান ভর্তি হয়ে গেছে কণ্ঠের স্লোগানে এবং হাতে ব্যানার। সকাল ১০-১৫ মিনিটে মাওলানা ভাসানী এলেন ময়দানে। মঞ্চে উঠলেন তিনি প্রাচ্যের শতাব্দি প্রবীণ মানুষটি ঘোষণা করলেন আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ফারাক্কা সমস্যার সমাধানের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।এখনো আমরা আলোচনা করছি, কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। আমি মনে করি, ভারতের জন্য এখনো সময় আছে।
আমরা আপসে ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে আগ্রহী ভারত যদি আমাদের শান্তিপূর্ণ প্রস্তাবে সাড়া না দেয়, বিশ্বের শান্তি কর্মী জনগণ ও ভারতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করবে। মাওলানা ভাসানী আরো বলেনঃ আমরা শান্তি চাই কিন্তু তারা যুদ্ধ চায়। বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ভয়ে ওরা সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছে। আমি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে তাদের জানিয়ে দিচ্ছি, আমরা আমাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবো।সঙ্গে সঙ্গে লাখো মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো গগনবিদারী শ্লোগান-“নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার।
মাত্র ১০ মিনিট কথা বলেন মাওলানা ভাসানী। এত কথা নয় যেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিক্ষোভের বহিরপ্রকাশ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রতিটি মানুষ শুনেছে তার কথা। শুনেছে আর গগনবিদারী স্লোগানের পেটে পড়েছে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে সমবেত মানুষ এই মানুষ যুগ যুগ ধরে মাওলানা ভাসানীকে দিয়েছে সংগ্রামের প্রেরণা।
আসামে বস্তুর থেকেই বাঙ্গালীদের দিয়ে মাওলানা ভাসানীর সংগ্রামে হাতে খড়ি লাইন প্রথার বিরুদ্ধে যে মানুষটি আন্দোলন শুরু করেছিলেন জীবনের পূর্বাহ্নে, জীবনের সায়াহ্নে এসে আজও তার সেই সংগ্রামী পদযাত্রা অব্যাহত আছে। এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আজ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নটি অত্যন্ত জরুরি জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি তৈরি করতে চান মাওলানা ভাসানী।
বক্তৃতা শেষ করে মাওলানা ভাসানী এগিয়ে গেলেন মিছিলের সম্মুখভাগে এবার শুরু হবে মহা মিছিল গ্রীষ্মের সূর্য তখন তাপ ছড়াতে শুরু করেছে ঘড়িতে সময় দশটা বেজে ৩০ মিনিট।

(৩)
মিছিল শুরু হতেই মিছিলের পুরোভাগে এসে দাঁড়ালেন নেতৃবৃন্দ। মাওলানা ভাসানী রয়েছেন একটি নীল বর্ণের গাড়িতে তার সামনে এগিয়ে চলেছে অগ্রণী পুলিশের ভ্যান পেছনে রয়েছে নিরাপত্তা প্রহরীদের মিছিলে কত লোক হয়েছে তার হিসেবের কোন ব্যবস্থা নেই।মিছিলের শুরু থেকে শেষ দেখা যায় না যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ মিছিল সামনে এগোচ্ছে আর রাস্তার দু’ধারে মানুষ যোগ দিচ্ছে মিছিলে মিছিলে মিছিলে উচ্চারিত হচ্ছে স্লোগান।
মাদ্রাসা ময়দান থেকে রাজশাহী কোর্ট এর দূরত্ব তিন মাইল পুরো মিছিল যখন অতিক্রম করে গেল রাজশাহী কোর্ট তখনই শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি বৃষ্টির আগে চারদিক অন্ধকার করে লোক ধূলিঝড়।
সকলের আশঙ্কা এই বুঝি মিছিল ভেঙে যায়। এই বুঝি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে সবকিছু কিন্তু প্রকৃতির উপর কটি উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছে মিছিল সঙ্গে রয়েছে মাওলানা ভাসানী আবহাওয়ার কারণে খোলা জিপে এর পরিবর্তে তিনি চড়েছেন গাড়িতে। সেই সঙ্গে রয়েছে তার অসুস্থতা। অতীতের মতো এখন আর তিনি কষ্ট করতে পারেন না কিন্তু মিছিলের দিন ভোর বেলা থেকেই থাকে দেখা যাচ্ছিল উৎফুল্ল এবং মনে হচ্ছিল স্বীয় সংকল্পে দৃঢ় প্রতীক্ষ।
১৬ ই মে মিছিল শুরুর আগে আমরা যখন মাওলানা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম তখন তিনি শুয়ে। মাওলানা সাহেব শুধু বললেন মিছিল যাবেই, শেষ লক্ষ্য পর্যন্ত। একটি কথা, কিন্তু কতখানি আত্মপ্রত্যয়ের প্রতীক না শুনলে বোঝার উপায় নেই।
রাজশাহী থেকে প্রেমতলী। এগারো মাইল।এখানেই মিছিলের মধ্যকালীন যাত্রাবিরতি। মিছিলকারীরা এখানে পাবেন চিড়া-গুড় শ্রী চৈতন্য ও তদীয় শ্রী বিষ্ণু প্রিয়ার স্মৃতিবিজড়িত প্রেমতলী। এক সময় এ এলাকার গৌরাঙ্গ বাড়িতে এদের স্বর্ণনির্মিত মূর্তি ছিল। ১৯৫৭ সালে এখানকার সবাই তো এই মূর্তি চুরি করে নিয়ে মুর্শিদাবাদে মেলা বসেছে কিন্তু সেই তমালতলা আজও আছে শান-বাঁধানো লোকেরা বলে এটি ২৫ বছরের পুরনো।
নদীর এপারে প্রেমতলী ওপারে ভগবানগোলা এখানে সিরাজ বন্দী হয়েছিলেন। ভাঙ্গনের মুখে ভগবানগোলা তলিয়ে গেছে। আছে শুধু স্মৃতি।
একসময় প্রেমতলির মেলায় হাজার হাজার লোকের সমাগম হত শ্রীচৈতন্য পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ শেষে গঙ্গাসাগরে গমনপথের প্রেমতলী স্নান তর্পণ করেছিলেন বলে সেখানে মেলার সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৭৬-এ এসে প্রেম তন্তু তৈরি হয়েছে নতুন ইতিহাস ইতিহাস জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার ইতিহাস রাজশাহীর বিদেশি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বিদ্রোহের ইতিহাস অজানা নয়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ফকির বিদ্রোহ প্রভৃতি বিদ্রোহের ঢেউ এখানেও লেগেছিল এক সময় এসব বিদ্রোহের নায়ক ছিল ডাকাত। যেমন বিদ্রোহ রাজশাহীর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে তার মধ্যে রয়েছে রুবেল হাতির প্রজা বিদ্রোহ, নাটোর কৃষক সম্মিলনী, বিলমাড়ীয়া প্রজা আন্দোলন, বীরকুৎসা প্রজা আন্দোলন, মন্দা প্রজা আন্দোলন প্রভৃতি। নীল বিদ্রোহের সময়ে জেলার ২৪ টি নীলকুঠি আক্রান্ত হয়েছিল। আজো এ এলাকার মানুষ এসব কাহিনী গর্বভরে স্মরণ করেন সেই কথিত সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্তমান। এবার বিক্ষোভের লক্ষ্যে ভিন্ন। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথে শত সহস্ত্র মানুষ এসেছেন প্রেমতলিতে।ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে দুপুর দুইটার মধ্যে মিছিল এসে পৌঁছল প্রেমতলিতে। মিছিলকারীরা গর্বিত। পথ হাঁটার ক্লান্তি ওদের নেই। প্রেমতলিতে স্বল্পকালীন অবস্থানের পর এরা রওনা দেবেন নবাবগঞ্জের পথে। এবারের যাত্রাপথ ১৯ মাইল দীর্ঘ।

(৪)
মহানন্দার তীরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এখন মহাকুমা টাউন। নবাবগঞ্জের বিপরীত দিকে বারোঘরিয়া যখন রেশম পাঠ প্রভৃতির কারবারের জন্য প্রসিদ্ধ বন্দর বন্দর তখন এর পরিচিতি বারোঘরিয়া নওয়াবগঞ্জ হিসেবে। একসময় রেশমের কারবার উঠে যায় তারপর বারোঘরিয়া নাম ও ঘুচে যায়। এবং ৪/৫ মাইল উত্তরে চাঁপাই এর পত্তন ঘটে। ১৯০৩ সালে ১২ জন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত হয় নবাবগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটি।
সেই নওয়াবগঞ্জ অভিমুখে প্রান্তরে থেকে বিকেল তিনটায় শুরু হয়েছে মিছিলের যাত্রা আকাশের মেঘ কেটে গেছে রোদ উঠেছে সেই সঙ্গে সঙ্গে মিছিল ধারণ করেছে আরো জঙ্গি আকার। পুরো ভাগে রয়েছেন মাওলানা ভাসানী।
১৯ মাইল দীর্ঘ রাস্তার দু’ধারে অসংখ্য মানুষের ভিড় ওরা ঘর থেকে অপেক্ষা করছেন অধীর আগ্রহে কখন আসবেন তাদের প্রিয় নেতা আসবে মিছিল এরা সবাই মিছিল যাত্রী পথে কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছে তরুণ পাতা দিয়ে অনাড়ম্বর আয়োজন, কিন্তু প্রাণ বন্যায় ভরপুর।আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই দাঁড়িয়ে আছেন সেইসঙ্গে আছেন গৃহবধূরা। এরা মিছিলযাত্রী নন। ত্ররা মিছিল কে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়েছেন।
কখনো কখনো মনে হচ্ছে এ পথ যাত্রার শেষ নেই।পথের দুধারে আম্রকুঞ্জে মানুষের ভিড়। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় আম। মিছিলকারীদের সেদিকে নজর নেই। ওদের অভিযাত্রা সম্মুখের সীমান্তের দিকে। সন্ধ্যা ছয়টায় মাওলানা ভাসানী এসে পৌঁছালেন চাপাইনবাবগঞ্জে। মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে এল মিছিলের একটা অংশ।
নবাবগঞ্জে এসে মাওলানা ভাসানী ঘোষণা করলেন ভারত ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে রাজি না হলে তিনি ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু করবেন। তিনি বলেন ফারাক্কার প্রতিক্রিয়ায় এবছর বাংলাদেশের ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীকে বাংলাদেশে এসে ফারাক্কার প্রতিক্রিয়া স্বচক্ষে দেখার জন্য পুনরায় অনুরোধ জানান। এখানে মাওলানা ভাসানীর নিজেই স্লোগান তুলেন।
নবাবগঞ্জে মেয়েছেলের রাত্রিকালীন বিরতি ক্ষুদ্র শহর নবাবগঞ্জে কোথাও ঠাঁই নেই। শত সহস্র মানুষের ভিড়ে কোথাও এতোটুকু জায়গা নেই। স্কুল-কলেজসহ সর্বত্র জায়গা করা হয়েছে মিছিলকারীদের থাকার জন্য। ওদিকে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। স্থানীয় সম্বর্ধনা কারীদের একদল ব্যান্ড বাজিয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন মিছিলকারীদের রাত বাড়ছে সেই সঙ্গে বাড়ছে মিছিলকারীদের ভিড়। এখান থেকে সোমবার ভোরে যাত্রা শুরু হবে কনসার্টের দিকে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সোমবার সকাল আটটায় মিছিলের শুরু নবাবগঞ্জ ছাড়িয়ে উপরে প্রবাহিত হচ্ছে মহানন্দা আজকের মহানন্দা ক্ষীণাঙ্গী স্রোতধারা একসময় বরেন্দ্রভূমির পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত হতো এই নদী। বৃহত্তম ঐতিহাসিক মনে করেন মুর্শিদাবাদের ভৈরবী মহানন্দার প্রাচীন খাত।ফারাক্কা
মিছিল পরিচালনার জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে গত ১৬ ই মে ফারাক্কা প্রতিরোধ নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয় এটি সম্পাদনা করেন সিরাজুল হোসেন খান।
অষ্টাদশ শতকের থেকে আয়িরগঞ্জের নিকট তিস্তা মহানন্দা সঙ্গে মিলে ছিল এবং মহানন্দা রামপুর বোয়ালিয়া কাছে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হতো। তারও আগে এক সময় মহানন্দা লাখনোতি গৌড়ের ভেতর দিয়ে করতোয়ায় পূর্নভবা এবং নিজ প্রবাহের জল নিষ্কাশন করত। ফানডেন ব্রোকের (১৬৬০) সময় মহানন্দার গতি ছিল আরো পশ্চিমে তখন রাম্পার বায়ালি আর দক্ষিণে মহানন্দা নদী পদ্মা তখন আরও দক্ষিণে প্রবাহিত এই দুই নদীর ঘাটের কাছে মিলিত হত।
মহানন্দার শতাব্দী প্রাচীন খরস্রোতা রূপ আর এখন নেই। মহানন্দার স্রোতধারা এখন বিগত যৌবনা। তাই সম্ভব হয়েছে নৌকা দিয়ে মিছিলকারীদের পারা পারের ফেরি বানানো।এবারের মতো অতীতে আর কখনো মহানন্দার এই হতশ্রী কেউ দেখেনি। মহানন্দার তোড়ে এখন আর জনপদ বিলীন হয়ে যায় না।
নৌকা ফেরিতে সেই মহানন্দা অতিক্রম করে মিছিল চলেছে শিবগঞ্জ হয়ে কানসাটের দিকে। নবাবগঞ্জ থেকে শিবগঞ্জের দূরত্ব ১৫ মাইল আর শিবগঞ্জ থেকে কানসাট ৬ মাইল।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কথা ছিল মিছিল যাবে শিবগঞ্জ হয়ে মনাকষা। শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ঠিক হলো মিছিল যাবে কানসাট। ওখানেই মহামিছিলের প্রথম পর্যায়ের বিরতি ঘোষণা করবেন মাওলানা ভাসানী।

(৫)
নবাবগঞ্জ থেকে শিবগঞ্জ পথের দুধারে ভিন্ন চিত্র। পথের দু’ধারে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছেন অযুত জনতা। মিছিলকারীদের অভ্যর্থনা জানানোই এদের ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে রয়েছে পানি সহ বিভিন্ন খাবারের ব্যবস্থা। শান্ত আমকুঞ্জের নিচে সারি বেঁধে বসে আছেন গৃহবধূরা। দুই-একজন আবার উৎসাহভরে পড়ছেন প্রচারপত্র। দুপুরের মধ্যেই মিছিল পৌঁছে যায় কানসাটে। একসময় রাজমহলের নিচে দিয়ে সোনা মসজিদ ও মহদীপুরকে বায়ে রেখে খিরির বিল, কুমীরদহের বিল হয়ে কানসাটের প্রান্তদেশ দিয়ে প্রবাহিত হতো পদ্মা। এই প্রাচীন খাত আজ পাগলা নামে খ্যাত। কানসাটে পৌছেই হাজার হাজার মিছিলকারী নামলেন পাগলার জলে ক্লান্তি ধুয়ে ফেলবার জন্য।
বিকেল চারটায় মিছিলকারীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন মাওলানা ভাসানী ঘোষণা করবেন ভবিষ্যতের কর্মসূচি। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। আর কানসাট হাইস্কুল ময়দানে ভিড় বাড়ছে। ইতোমধ্যে মাওলানা ভাসানী পৌঁছে গেলেন কানসাট।
বেলা চারটে পনেরো মিনিটে মাওলানা সাহেব এলেন মঞ্চে। মাওলানা সাহেব ঘোষণা করলেন গঙ্গার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিসাব ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে ভারতকে বাধ্য করার জন্য আমাদের আন্দোলনের এখানেই শেষ নয়।
মাওলানা ভাসানী ঘোষণা করলেন বাংলাদেশের ন্যায্য হিসাব দাবি মেনে নিয়ে ফারাক্কা সমস্যার ন্যায় সঙ্গত সমাধানে ভারত অস্বীকৃতি জানালে তিনি আগামী এক মাসের মধ্যে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে এ বছরের ১৬ ই আগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু করবেন।
শান্তিপূর্ণ মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণা করে মাওলানা সাহেব বলেন, বাংলাদেশের দরিদ্র নিরস্ত্র মানুষের ভয়ে ভারতকে যখন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করতে হয়েছে তখন তার অবিলম্বে ফারাক্কা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত।
লাখো কণ্ঠে গগনবিদারী “নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার ধ্বনির মধ্যে মাওলানা ভাসানী বলেন, ভারত সরকারের জন্য উচিত বাংলাদেশীরা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায় না কারো হুকুমকে পরোয়া করে না। যেকোনো মূল্যে মাতৃভূমির রক্ষার আমাদের এই সংকল্পকে ভারত সরকার যেন হুমকি হিসেবে না ভাবেন। যেকোনো হামলা থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষা করা আমাদের দেশাত্মবোধক কর্তব্য এবং অধিকার।
আবেগে বাকরুদ্ধ কন্ঠে মাওলানা বলেন, রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং কানসাটে যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে তাতে আরো নতুন নতুন গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সংশোধিত হতে থাকবে। তিনি জাতীয় স্বার্থে সব দলের লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর ভাষণে মাওলানা সাহেব বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছেন।
তিনি বলেন এই সরকার জনগণের নির্বাচিত সরকার না হলেও আমি আশা করি তারা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন, মত প্রকাশের ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেবেন।
সদ্যসমাপ্ত মহামিছিলের উল্লেখ করে তিনি বলেন এ মিছিল শান্তিপূর্ণ এবং তা বাংলাদেশের এলাকার মধ্যে ছিল। তিনি বলেন যদি আপোসে এবং শিগগিরই এই গুরুতর সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে তিনি আরও শক্তিশালী এবং আরো বড় মিছিল সংঘটিত করবেন এই সঙ্গে তিনি আরো বলেন, পরবর্তী মিছিল বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে থাকবে এমন কোনো নিশ্চয়তা তিনি দিতে পারেন না।
মাওলানা সাহেব স্বার্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন কোনো হুমকি, ধামকি কিংবা চোখ-রাঙানিতে বাংলাদেশের জনগণকে কাবু করা যাবে না। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিসাব তাদের সর্ব সার্বভৌম অধিকার কায়েমের সংগ্রাম চলবেই।
জাতি ধর্ম এবং রাজনৈতিক মতামত নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণ গঙ্গার পানির ন্যায্য হিসাব আদায়ের লড়াই চালিয়ে যাবে।
বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর ভারতীয় সৈন্য সমাবেশের নিন্দা করে বৃদ্ধ জননেতা বলেন এ ধরনের সশস্ত্র হুমকিতে বাংলাদেশকে দমানো যাবে না কিংবা অনভিপ্রেত উসকানিতে তারা ঘাবড়াবে না।বাংলাদেশের জনগণ জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবেই প্রয়োজন হলে বিদেশি হামলা প্রতিরোধে এবং রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ থেকে তারা পিছ পা হবে না।
৯৫ বছরের বৃদ্ধ নেতা মাওলানা ভাসানী বিশাল জনসমুদ্রের উদ্দেশ্যে গত কয়েকবছরে জাতীয় জীবনের অন্তরায় দুর্নীতি প্রবেশ করেছে তা উচ্ছেদের জন্য ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলার উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি ঘোষণা করেন মত্তজুদদার, কালোবাজারি, চোরাচালানী ও দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের অবশ্যই উৎখাত করতে হবে। তিনি সর্ব পর্যায়ে জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য শ্রমিকদের প্রতি কঠোর পরিশ্রম করার আবেদন জানান।
তিনি বলেন দেশের শতকরা সাড়ে ৯৭ জন মানুষ শ্রমজীবী এবং এরাই দেশের সত্তিকারের স্থপতি- শতকরা আড়াইশো জন সুবিধাভোগী। নয়।
মাওলানা ভাসানী বলেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ কোন বিশেষ শ্রেণীকে বিষয়শ্রেণীকে জনগণকে শোষণ করার অধিকার দেননি এবং আল্লাহর ইচ্ছায় হবে আমাদের জাতীয় উন্নয়নকে সুসংহত করার চালিকাশক্তি।
মাওলানা ভাসানী বলেন অত্যাচারী সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন আল্লাহ কোনদিন তাকে ক্ষমা করবেন না।

তিনি বলেন ফারাক্কা যারা তৈরি করেছে আল্লাহ তাদের রেহাই দেবেন না। তিনি বলেন যে গঙ্গার পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার পরিণতি দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর উপরই বর্তাবে।
গঙ্গা নদী দিয়ে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তা প্রত্যক্ষ করার উদ্দেশ্যে মিসেস গান্ধীকে বাংলাদেশ সফরের জন্য মলানা ভাসানি পুনরায় আমন্ত্রণ জানান।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন শত্রুপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ঐতিহ্যগত দিক থেকে বাংলাদেশ বিপ্লবী জনগণ তাদের কাছে মাথা নোয়াবে না।
তিনি বলেন বাহুবল আর চোখ রাঙানিকে বাংলাদেশের ৮ কোটি মানুষ ভয় করে না। যে কোন মহলই চোখ রাঙ্গাক না কেন, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। কোনো বড় প্রতিবেশী যদি এমনটি করে তাহলে তাতে তাদের পতনেরই সূচনা হবে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের নিপিরিত জনগন সৌভ্রাতৃত্ব ও প্রতিবেশী হিসেবে থাকতে চায়।
মাওলানা ভাসানী বলেন একটি রাজনৈতিক ঝড় আত্মসন্য। নির্যাতিত মানুষের অসন্তোষের এই ঝড় একদিন কায়েমী স্বার্থবাদকে আঘাত হানবেই।
আজ ভারত ও বাংলাদেশের নির্যাতিত কোটি কোটি মানুষের বৃহত্তর স্বার্থেই বর্তমানের সকল বিরোধ মিটিয়ে ফেলা উচিত।
কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত নদী যার ভাটি অঞ্চল বাংলাদেশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এমন নদীতে ফারাক্কার মতো কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আরো জটিলতা সৃষ্টি করেছে। যে জনগণ একদিন সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছিল।
মাওলানা ভাসানী বলেন ইসলাম ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যে কোন সম্প্রদায়ের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ও চরম সহিংসতার পথ দেখিয়েছে। বাংলাদেশের মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এবং সকল শ্রেণীর মানুষ তাদের মাতৃভূমিকে ভালোবাসে। তিনি বলেন যে কোন দিক থেকে আক্রান্ত হলে মাতৃভূমির প্রতিটি ইঞ্চি জমি রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণ জেহাদ ঘোষণা করবে।
তিনি আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার বাক স্বাধীনতা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ধর্ম কোন তান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তিনি আরো বলেন আমরা বলি না কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দিক কিন্তু ভারতকে অবশ্যই আমাদের ন্যায্য হিস্যা দিতে হবে।

(৬)
গঙ্গা-পদ্মার সঙ্গে এদেশের মানুষের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের হিন্দু-মুসলমান সকলের কাছেই এর নদী সমানভাবে প্রিয় গঙ্গা-পদ্মা হিন্দু পুরাণ প্রসিদ্ধ অতি প্রাচীন রামায়ণ ও মহাভারতের কোন পর্বের তীর্থযাত্রা অধ্যায় পান্ডবগণের নন্দা ও শেলী অজানা ভয়ে স্নান ও সাগর সঙ্গমে উপনীত হওয়া প্রসঙ্গে এই গঙ্গা-পদ্মার নেতৃত্বে উল্লেখ আছে ঐতিহাসিক যুগের দশম দ্বাদশ শতকে পদ্মা স্পষ্ট বাজনাব পাড়া পুউআ খালে বহিউ/অদঅ দংগালে ক্লেশ। আজি ভুসুক বাঙালি তইলী/ নিঅ ঘরিণী চন্ডাল।
এ তো গেল হিন্দু পুরাণের কথা। কানসাটের জনসভায় মুসলমানদের জন্য গঙ্গা-পদ্মা কে তুলে ধরলেন মাওলানা ভাসানী ভিন্ন ভাবে বললেন এই গঙ্গা বেহেশতে বেহেশতে যাওয়ার আকারেই ইলিশ আল্লাহর ইলিশ অদ্ভুতভাবে এই মানুষটি মুসলমানদের চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিলেন গঙ্গার জল ও এর ইলিশকে।

(৭)
শুধু চেতনাকে উজ্জীবিত করাই নয়, সেই সঙ্গে মিছিলে অংশগ্রহণকারী লাখো জনতার প্রতি কানসাটে জনসভায় শ্রদ্ধা জানালেন মাওলানা ভাসানী। বললেন আপনাদের পায়ের ধুলো আমরা মাথায় রাখবো। ৯৫ বছর বয়স্ক একজন জননেতার মুখ থেকে এই উক্তি এদেশের মানুষের জন্য আগামী দিনের পথ প্রদর্শক।
সূর্য যখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে যখন আবিরের রঙে লাল হয়ে উঠেছে তখন সীমান্তবর্তী কানসাটে ঘটল মহামিছিলের পরিসমাপ্তি।
সাংগঠনিক দুর্বলতা সত্ত্বেও এই মিছিলের প্রতিক্রিয়া হবে সুদুরপ্রসারী এই মিছিলে সংগঠিতভাবে যোগ দিয়েছেন শ্রমিক ও ছাত্ররা সেইসঙ্গে এসেছেন বিভিন্ন স্তরের মানুষ।
মিছিলের যারা এসেছিলেন সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে তারা অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন। কিন্তু ফিরে গিয়েছেন নতুন দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে। মাওলানা ভাসানী নিজেই বলেন এখানে শেষ নয়। এই মিছিল নতুন এক মিছিলে সূত্রপাত। এই মিছিল রাজনৈতিক রূপকথায় নব দিগন্তের সূচনা করেছে। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মিছিল মিছিল মিছিল কীর্তিনাশা পদ্মার আরেক রূপ। ফারাক্কা মিছিলের প্রতিক্রিয়া এর জমায়েতে, ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ। পলাশীর প্রান্তরে যে স্বাধীনতার সূর্যাস্ত সেই প্রান্তরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়। ফারাক্কা মিছিল সূর্যোদয়ের কিরণ।

(৮)
ফারাক্কা মিছিল যেন স্বাধীন জাতির জয়যাত্রার প্রতীক। রোদ বৃষ্টি ঝড় চলার পথের দৈর্ঘ্য দৈন্যের পীড়ন বাইরের হুমকি কোনো কিছুই আর এদেশের মানুষের সম্মুখ যাত্রা রোধ করতে পারবে না।
শুধু রাজশাহী থেকে কানসাট নয়, বাংলাদেশী জনগণের মহা মিছিল চঞ্চল যাত্রা শুরু করেছে। নৈরাশ্যের অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে। আধিপত্যের অন্ধকার অধ্যায় ছিড়ে ফেলে নিঃসংশয় স্বাধীনতার পথ ধরে।
বাংলাদেশ জেগে উঠেছে। বাংলাদেশ উঠে দাড়াচ্ছে। মানুষের হাতে স্বাধীনতার পতাকা। স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য প্রকৃতির সম্পদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তচক্ষু উপযোগী করে বাংলাদেশের মানুষে আজ মহামিছিলে শামিল। এ মিছিল এখানেই শেষ নয়।

মহামিছিলের মহানায়ক
জহিরুল হক
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মে মাসের ১৭ তারিখের সকাল। টিপ টিপ বৃষ্টি ঝরছে আকাশ যত কালো তার চাইতে আধার যেন বেশি। আম্র কানন আর লিচু বাগানে ঘন অন্ধকারে পর্দা টেনে বৃষ্টি ঝরছে মন্থর ধারায়। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষ্য নেই আকাশ ভরা মেঘ।
আকাশে মেঘ। আম বন, লিচু গাছের নিচে সরু রাস্তায় মানুষের ঢল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাত কাটানোর পর লাখো জনতার মিছিল চলছে সীমান্তের দিকে। বৃষ্টিমুখর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বজ্র নির্মোক স্লোগান মুখে নিয়ে মিছিল পার হয়ে যাচ্ছে মহানন্দা। ফারাক্কা মহা মিছিল চলছে কানসাট সীমান্তে মহানন্দা পার হয়ে সামনে আরো ১৬ মাইল পথ।
মহামিছিলের মহানায়ক মাওলানা ভাসানী তখনও সীমান্ত পথে যাত্রা শুরু করেননি। কিছুক্ষণ পর তার মিছিল অনুগমন করার কথা। মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে। আর মাওলানা ভাসানী তখন কথা বলছিলেন কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের উকিলের বৈঠকখানায় বসে তিনি স্মৃতিচারণ করছিলেন বিগত দিনের রাজনীতির। স্বপ্ন দেখেছিলেন ভবিষ্যৎ সমাজ ব্যবস্থার। সীমান্ত মুখি মিছিলের স্লোগানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল থেকে থেকে। স্লোগানের আবহে সেই বৃষ্টিমুখর সকালে শতাব্দি প্রবীণ জননেতা বলেছিলেন ব্রিটিশ ভারতে সিরাজগঞ্জ কৃষক সম্মেলনের কথা এক পয়সায় চাঁদা তোলা হয়নি। কৃষকরা সামর্থ্য অনুযায়ী নিয়ে এসেছিল চাল-ডাল তরু তরকারী নুন লাকড়ি। এক মুঠো চাল চুরি করার কথা কেউ ভাবেনি। একবেলায় ১৮ শ মন চাল ডালের খিচুড়ি হয়েছিল। তার পরও উদ্বৃত্ত ছিল ৯ শ মন চাল। লাকড়ি তেল নুন এর হিসাব বাদই থাক। নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করলেন কাকে বিশ্বাস করবো? পয়সা দেখলে কার মাথা ঠিক থাকে না। কোন প্রোগ্রাম নিলেই বের হয় চাঁদা তুলতে। কত টাকা চাঁদা তোলে তার হিসাব দেয় না। হিসাব চাইলে বলে রশিদ বই হারিয়ে গেছে। এদের বিশ্বাস করো না তোমরা যারা হাজার হাজার বিঘা জমির মালিক, যাদের বাড়ির সীমানায় অন্যের জমি নেই, তারাই সব কৃষক নেতা। এরা কৃষকের সমস্যা, কৃষকের দুঃখ বোঝে না। তোমরা যাও একটা গ্রাম বেছে নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করো সার্ভে করো। দেখবে কৃষকের মেরুদন্ড নেই।
মাওলানা ভাসানী বক্তা। সাংবাদিকরা নবীন শ্রোতা। কথা বলতে বলতে অসুস্থ বৃদ্ধ জনতার কন্ঠ আবেগে জড়িয়ে গেল। বললেনঃ আজ আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি। আমি গরীব কৃষকদের জন্য কি করে যেতে পারবো জানিনা। তবে এখন মনে হয় এদের সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। এদের যে বিশ্বাস অর্জন করেছিলাম তার মূল্য আমি দিতে পারিনি। এই গরীব মানুষের ভোট এনে আমি বারবার গদিতে বসিয়েছি কতগুলো বেইমান কে। যারা ওয়াদা করে ওয়াদা রাখে নি। যারা কৃষকের কথা ভুলে নিজেরা সম্পদের পাহাড় তৈরি করেছে। আজ আর কিছু করতে পারি, বা না পারি একটা কথা কৃষকদের বলে যাব-এসব নেতাদের তোমরা বিশ্বাস করো না নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হও।
মাওলানা বলে চললেন- সংগ্রামে এই স্বাস্থ্য নিয়ে ঘুরতে না পারি অন্তত আমার ১২ লক্ষ মুরিদকে একথা বলে যাবো। সাংবাদিকদের তিনি জানিয়ে দিলেন কিভাবে তিনি মুরিদদের দীক্ষা দেন। ছাপানো ফর্মে লেখা থাকে “আমি আজীবন সাম্রাজ্যবাদ” সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিয়া কৃষকরা কায়েমের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করিব। আমি রোজা, নামাজ, হজ, জাকাত নিয়মিত আদায় করিব। ডুপ্লিকেট কপির মাওলানা ভাসানী স্বাক্ষরিত কপিটি থাকে মুরিদদের কাছে তার মধ্যে স্বাক্ষরিত কপিটি থাকে মাওলানা সাহেবের কাছে। ধর্মপ্রাণ দরিদ্র কৃষকদের মনে দুর্বার রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টির এই কৌশল একান্তই মাওলানা ভাসানীর নিজের। সর্বহারা রাজনীতির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে যারা কৃষকদের কাছে যেতে চেষ্টা করেন এই কৌশলের কাছে তারা পরাস্ত হতে বাধ্য।
মাওলানা ভাসানী আশাবাদী। কৃষকদের মধ্য থেকেই কৃষক নেতা বেরিয়ে আসবেন। তিনি বলেন দিন সামনে রয়েছে। খুব দূরে নয়, দেখবে এখন যারা নেতা তারা কেউ নেই কৃষকেরা এগিয়ে এলে এরা তখন পালাবে।
কৃষকেরা কখন জেগে উঠবে আর কখন পরিচিত নেতারা পালাবে, সেদিনের সেই বৃষ্টিমুখর সকালে মলানা ভাসানি তা বলেননি। কিন্তু দুদিন আগে শুনেছিলাম হক কথার সম্পাদক সৈয়দ ইরকানুল বারীর কাছে। মনাকষা সীমান্তে যাওয়ার পথে বারী সাহেব মাওলানা ভাসানী সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিলেন। একথা সে কথার মাঝখানে তিনি জানালেন মাওলানা সাহেব তার “খাস মুরিদদের” বলেছেন হাজার ১৯৮০ সালের জন্য প্রস্তুত থাকতে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সারা পৃথিবীতে মোট কতগুলো দেশ সমাজতান্ত্রিক হয়ে গেছে তেমনি একটা বিরাট পরিবর্তন হবে বলে মাওলানা সাহেব মনে করেন। মাওলানা সাহেবের এই ধারনার পিছনে কি যুক্তি রয়েছে বাড়ির সাহেবের তা জানার কথা নয়। তবে অতীতের ইতিহাস বলে মাওলানা ভাসানী যা বলেন তা নয়। এবং মাওলানা সাহেবের শরীর সকালের কথা থেকে বুঝা যায় ১৯৮০ সালের ভবিষ্যৎ পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেবে কৃষক সমাজ।
প্রেমতলীতে ও তিনি একই কথা বলেছিলেন। ১৬ ই মে ফারাক্কা মহামিছিল দ্বি-প্রহরীক বিরতির জন্য রাজশাহী শহর থেকে ১৩ মাইল দূরে প্রেমতলী থেমেছে। এর আগে মুষল ধারায় বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে মিছিল এসেছে প্রেমতলিতে। তখন আর বৃষ্টি নেই। রোদে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে মিছিলকারীদের মুখ। একটা পিকআপ ভ্যানের উপর মাইক্রোফোন বাধা। পিকআপ ভ্যানের পাদানিতে একটা পা রেখে মাউথপিস নিয়ে বক্তিতা দিচ্ছিলেন ভাসানী…….. মাউথপিস হাতে লংমার্চ এ বক্তৃতা করছিলেন মাওলানা। দরিদ্রতা আজ এই ঐতিহাসিক মিছিলের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে মানুষের ঐক্য। এই ঐক্য রেখে তোমরা এগিয়ে গেলে কোন বাহিনী আর গরিবকে শোষণ করতে পারবে না। কৃষকরাজ তোমরা ইনশাল্লাহ কায়েম করতে পারবে…….
অনন্য রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অধিকারী মাওলানা ভাসানী ভবিষ্যতের কি ছবি দেখেছেন তা তিনি ছাড়া কেউ জানেনা। ফারাক্কা মহা মিছিল করে রাজশাহী থেকে কনসার্ট সীমান্ত পর্যন্ত ৫০ মাইল পথে তিনি কি ইতিহাস সৃষ্টি করালেন, তার মূল্যায়ন ভবিষ্যতেই হবে।
এই মুহূর্তে শুধু এতটুকু বলা যায় এই মিছিলের মাধ্যমে এই বৃদ্ধ জন নেতার ওপর জনগণের আস্থা আবার নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে। একমাস আগে ঢাকার ইসলামিক ফাউন্ডেশন হলে এক ক্ষুদ্র সমাবেশে তিনি ঘোষণা করলেন ফারাক্কা মিছিলের কথা। তারপর যেন সব দায়িত্ব চলে গেল সারা মিছিলে যাবেন তাদের উপর। এলাকাভিত্তিক কোন সাংগঠনিক সভা সমাবেশ হলো না। নামমাত্র সাংগঠনিক কমিটির সদস্যদের মিছিলের আগ পর্যন্ত রাজশাহীতে দেখা গেল না। শুধু মাওলানা ভাসানী বসে রইলেন রাজশাহীতে। কখনো পান চিবোতে চিবোতে, কখনোবা লিচু খেতে খেতে কথা বললেন দর্শনার্থীদের সঙ্গে। কি বিরাট কর্মসূচি। ৫০ মাইল পদযাত্রার সাফল্য ও অসাফল্যের ঝুঁকি। অথচ বৃদ্ধ নেতার চোখে-মুখে উদ্বেগের লেশমাত্র নেই। অবিচল আস্থা নিয়ে তিনি বসে আছেন নির্বিকার। মিছিল হয়ে গেল এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত। একজন কৃষক, একজন শ্রমিক থেকে, একজন সীমান্ত প্রহরী পর্যন্ত রচিত হলো এক অবিচ্ছন্ন ঐক্যের সেতু।মনাকষা সীমান্তের চৌকা ফাড়ি। দেড় মাইল দূরে ভারতীয় ভূখণ্ড সব্দালপুর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সব্দালপুর থেকে এগিয়ে এসে সীমান্ত খুটির উপরে ছাউনি ফেলেছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় কোন ভয়ের সারি। আর আমাদের চৌকা ফাঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন মাত্র এক প্লাটুন বিডিআর-এর জোয়ান তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম বিপক্ষের শক্তির সামনে তারা দাঁড়াতে পারবেন কিনা উত্তরে তিনি বললেন কেন পারব না পেছনে আপনারা তো কয়েক লক্ষ এসেছেন।
সীমান্ত প্রহরীর মনে এই কঠিন আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছেন মাওলানা ভাসানী। যে বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে এই বৃদ্ধ নেতা ডাক দিয়েছিলেন ফারাক্কা মহামিছিলের। মিছিলে যোগ দিয়েছেন দেশের লাখো জনতা।

বিদেশি প্রতিক্রিয়া
ফারাক্কায় গঙ্গা নদী থেকে এক তরফাভাবে ভারতের পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে শুরু বাংলাদেশেরই নয় বিদেশেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে ব্যাপক বিক্ষোভ। একইসঙ্গে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন অনেক বিদেশী সরকার ও পত্র-পত্রিকা।

ফ্রান্সঃ
সম্প্রতি ফ্রান্সে বসবাসকারী বাংলাদেশের ছাত্র নাগরিকরা একতরফা পানি প্রত্যাহার কে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড বহন করে বিক্ষোভকারীরা প্যারিসের প্রধান প্রধান রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেসভা করে। সভায় গৃহীত প্রস্তাবাবলী অর্পণের জন্য তারা ভারতীয় দূতাবাসেও গমন করে।

নোভিল ম্যাক্সওয়েলঃ
বৃটেনের বিশিষ্ট সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েল অস্ট্রেলিয়া থেকে বেতার ভাষণে বলেন গঙ্গার পানি বাংলাদেশ জীবন-মরণ সমস্যা। ভারতের ফারাক্কা থেকে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের ফলে নদীমাতৃক এই দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে যাবে।

ইসলামী সম্মেলনঃ
ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনের আতিথ্য দানকারী রাষ্ট্র তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বলেন, গঙ্গার পানি বন্টন প্রশ্নে আমরা উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ এই প্রশ্নের যে ভূমিকা গ্রহণ করেছে তা স্বাভাবিক এবং কারিগরি দিক দিয়ে সঠিক।

চীনঃ
ফারাক্কার ব্যাপারে পিকিং থেকে প্রকাশিত পিকিং রিভিউর (৯নং ইস্যু) অভিমত, গঙ্গা নামের বৃহৎ নদী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। এই নদীর পানিবণ্টন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দীর্ঘদিনের সমস্যা। কয়েক বছর আগে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ১১ মাইল দূরে এই নদীর উপর বাঁধ দেয়। পানি বণ্টনের ব্যাপারে অনেক অনেক বার বৈঠক হলেও ভারতের অনমনীয় মনোভাবের জন্যই কোনো সুরাহায় আসা যায় নি। ভারতে এ বছর একতরফাভাবে ফারাক্কা গঙ্গা নদীর পানি প্রত্যাহার করে তার আগ্রাসী এবং আধিপত্যবাদী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশের ন্যায় সঙ্গত সংগ্রামের প্রতি চীনের সহযোগিতা রয়েছে।

জাপানঃ
সফররত জাপানি মিশনের নেতা সাসাকাওয়াকে ফারাক্কা ব্যাপারে অবহিত করলে তার মন্তব্য, কোন বৃহৎ শক্তির ক্ষমতার অপব্যবহার করা উচিত নয়।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1976.05.28-bichitra-muktadir.pdf” title=”1976.05.28 bichitra muktadir”]