You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.17 | পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতিসংঘের কার্যধারার উপর প্রণীত বার্ষিক প্রতিবেদনে মহাসচিবের মুখবন্ধের অংশবিশেষ | জাতিসংঘ ডকুমেন্টস - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতিসংঘের কার্যধারার উপর প্রণীত বার্ষিক প্রতিবেদনে মহাসচিবের মুখবন্ধের অংশবিশেষ জাতিসংঘ ডকুমেন্টস ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি বিষয়ে জাতিসংঘের
কার্যক্রমের উপর প্রণীত বার্ষিক প্রতিবেদনে
মহাসচিবের মুখবন্ধের মূল অংশবিশেষ
পূর্ব পাকিস্তানে
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং তার পরিণতি জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে আমার কাছে গভীর উদ্বেগের বিষয়। এই গৃহযুদ্ধ পাকিস্তানে একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট এর থেকে উদ্ভূত কিছু সমস্যা খুব জরুরীভাবে উদ্বেগের কারণ ছিল। গত নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড়ের পরে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা বহু মৃত্যু, ধ্বংস ও বিধস্ততা ডেকে এনেছিল। বিপুল সংখ্যক জনগণের এই ঝুঁকি মারাত্মক ছিল এবং তারা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল এবং তা ভারতের কর্তৃপক্ষের সীমিত সম্পদের উপর অসহনীয় বোঝা স্বরূপ স্বাস্থ্য ও ত্রাণ সংক্রান্ত সীমাহীন সমস্যা বয়ে এনেছিল। নজিরবিহীন মাত্রায় আন্তর্জাতিক সহায়তা পূর্ব পাকিস্তানে দুর্দশাগ্রস্থ জনগণের জন্য জরুরীভাবে প্রয়োজন ছিল।

১৯৭১ সালে মার্চ মাসে এই ঘটনা ঘটার অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে আমার উদ্বেগ আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছিলাম এবং আমি অবিরতভাবে ভারত ও পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিসহ অন্যান্যদের মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে চলছিলাম।

আর এই মতবিনিময়ে আমি মহাসচিব হিসেবে জাতিসংঘ দলিলের প্যারা ৭ অনুচ্ছেদ ২ এর বিধান ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহযোগিতা দ্বারা মানবজাতির কল্যাণ ও মানবিক নীতি প্রতিষ্ঠায় দ্বৈত দায়িত্ব পালন করা বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ ছিলাম।

পূর্ব পাকিস্তানে থেকে আগত শরণার্থী এবং পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত জনগণের সাহায্যের জন্য আবেদন করাকে আমার প্রথম পরবর্তী দায়িত্ব হিসেবে মনে করেছিলাম। এই সকল আবেদনকে গতি দেয়ার জন্য জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনারকে ভারতে থাকা শরণার্থীদের ফোকাল পয়েন্ট নিযুক্ত করেছিলাম এবং পাকিস্তানে সম্মতিতে পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের নিকট ত্রাণ পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য ঢাকায় একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিলাম। এই দুই জরুরী ত্রাণ ব্যবস্থার পাশাপাশি, আমার পূর্ণ সম্মতিতে হাইকমিশনার যারা বর্তমানে ভারতে আছেন তাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাগমনকে সহায়তার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিলেন।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ও আন্তঃসংস্থা বিষয়ক এর সহকারী মহাসচিবের কাউন্সিলে দেয়া বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে ১৬ জুলাই ১৯৭১ তারিখে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলে এই উভয় কার্যক্রম নিয়ে পূরনাঙ্গ আলোচনা হয়েছে। আলোচনা শেষে, মহাসচিব কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমকে কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট পূর্ণ সমর্থন করেন।

ভারতের শরণার্থীদের প্রতি আমার আবেদনে তাৎক্ষণিক সাড়া দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ অনুদানের প্রস্তাব পাওয়া যায়। যদিও বা, যতখানি অর্থ ও সরবরাহ পাওয়া গিয়েছিল তা পর্যাপ্ত ছিল না এবং ভারত সরকার এখন পর্যন্ত অপরিমেয় সময়ের জন্য ক্রমবর্ধমান লাখো শরণার্থীদের দেখাশুনার ক্ষেত্রে সমস্যা সংকুল অবস্থার মুখোমুখি হয়।

আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে মূলতঃ প্রাথমিক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরিত ত্রাণ কার্যক্রম প্রয়োজনীয় চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত ছিল। এই প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করতে চাই যে, পাকিস্তানে সরকার এবং পূর্ব পাকিস্তান ত্রাণ বিষয়ে আমার কার্যক্রমে যে সকল দেশ জড়িত হয়েছিল তাদের অবদান যেন পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের নিকট পৌঁছে যায় তার নিশ্চয়তার জন্য আমি সর্বদা তাদের সজাগ রেখে চলেছিলাম।

শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন করানোর প্রচেষ্টায় সফল হওয়া যাচ্ছিল না। কারণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে শরণার্থীদের ২৫ মে এর মধ্যে প্রত্যাবর্তন করে আনতে সম্মতি দিয়েছিল, যদিও তা অপর্যাপ্ত শরণার্থী সাড়া দিয়েছিল এবং ভারত ও অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্য হতে জানা যায়, শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছিল।

সবচেয়ে জটিল বিষয় এই যে, রাজনৈতিক স্থিরতা, জনপ্রশাসন, আইন শৃঙ্খলায় প্রকৃত উন্নতির কমতির কারণে আন্তর্জাতিক ও সরকারী সকল প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্থ হচ্ছিল। যেখানে বৃহৎ পরিসরে ত্রাণ কার্যক্রম কার্যকর ভূমিকা নিতে পারত সেই স্থানে উন্নতি না ঘটাতে পারলে চরম খাদ্যসংকট দূর্ভিক্ষে পরিবর্তিত হয়ে বিপদ বয়ে আনতে পারে। একইভাবে বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত বৃহৎ সংখ্যক শরণার্থী ফেরত আনার অনিবার্য পর্বশর্ত হিসেবে উন্নত রাজনৈতিক স্থিরতা এবং ত্রাণ কার্যক্রমের সফলতা সন্দেহাতীতভাবে খুব গুরুত্বপর্ণ। এই অবস্থাটা এমন ছিল যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ধারক দুষ্টচক্রের ক্রম তৈরি করেছিল যা বৃহৎ আকারে যা মানবিক সমস্যা নিরোধে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক মহলের কাজ বিপর্যস্ত করছিল।

এই সকল মানবিক বিপর্যয়ের ফলাফল সুদর প্রসারী। সংঘাতের অনুভূতি উপমহাদেশের ধর্মীয় ও প্রান্তীয় গোষ্ঠীদের সম্পর্কে এবং ভারত পাকিস্তান সরকারের সম্পর্কে অবনতি ঘটানোর একটি গুরুত্বপর্ণ উপাদান হতে পারে। রাষ্ট্রের ভূখন্ডের অখন্ডতা এবং আত্মপরিচয়ের সংঘাত পর্বেও ভ্রাতৃহত্যার আকাংখার উত্থান ঘটিয়েছে। আর সমসাময়িক কয়েক বছর আন্তর্জাতিক মহলে এটি মানবিক প্রতিক্রিয়াকে উসকে দিচ্ছে। এই বর্তমান বিষয়ে আরেকটি অতিরিক্ত বিপদ হলো যে ভারত দীর্ঘ সময়ের এবং অমীমাংসিত সংকটের বৈপরীত্য অবস্থান যা ছয় বছর আগেও একটি উন্মুক্ত যুদ্ধের উত্থান ঘটিয়েছিল। যদিও উভয় সরকারের শান্তি বিষয়ে দৃঢ় ইচ্ছা নাই এবং দুই দেশের অস্থিরতা নিরসন বিষয়ক কোন ইঙ্গিতও নাই। পূর্ব পাকিস্তানে সীমানার অবস্থাটি নিয়মিতভাবে সমস্যাময় ছিল। সীমানা সংঘাত,গুপ্ত হামলা এবং চরমপস্থীদের কার্যক্রম প্রায়শই ঘটত আর শরণার্থীদের এই সংঘাতময় দেশে প্রবেশের জন্য সীমানা পার হতে হতো। জাতিসংঘের কারো কাছে এটি উপেক্ষা করার মতো ছিল না যে, উপমহাদেশে এই সংঘাত সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।

উপমহাদেশে বহাল থাকা এরূপ সংকটময় অবস্থায় নৈতিক রায়ে খুব সহজেই পৌঁছানো যায়। রাজনৈতিক ও মানবিক সভ্যতায় এই অবস্থা মেনে নেয়া এবং অগণিত সমস্যায় জড়িত জনগণকে পথ দেখানোতে সাহায্য করা অতীব কষ্টের ছিল। জাতিসংঘ পরবর্তীতে তা অবশ্যই অনুসরণ করবে বলে মনে হয়।

আমি মনে করি না যে, বর্তমান অবস্থার কোন চিত্রকে এবং সম্ভাব্য পরিণতিকে খুব রূঢ় করে উপস্থাপন করেছি। প্রাপ্য তথ্যের আলোকে আমি অনায়েসে এই উপসংহারে পৌঁছাতে পারি যে, আন্তর্জাতিক মহল এই অবনতির অবস্থা ধারাবাহিক ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং ত্রাণ কার্যক্রম, মানবিক সাহায্য এবং সদিচ্ছা এই মানবিক দুর্দশা ও দুর্যোগকে পরিবর্তন করার জন্য যথেষ্ট। বর্তমান অবস্থার সম্ভাব্য পরিণতি শুধুমাত্র মানবিক বোধ থেকে নয় বরং শান্তিও সুরক্ষার প্রতি প্রকৃত হুমকি হিসেবে দেখছি এবং ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও কার্যক্রমে জাতিসংঘকে কার্যকর সংস্থা হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা নিয়ে আমি আশাবাদী। মানবিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক সমস্যা মিলিত হয়ে বর্তমানে যে সংকটময় অবস্থার সৃস্টি হয়েছে তা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে জাতিসংঘকে মোকাবিলা করতে হবে।

এই কারণে মহাসচিব হিসেবে এই সমস্যাটি নিরাপত্তা পরিষদের নজরে নিয়ে আসা আমার দায়িত্ব বলে মনে করেছি। ২০ জুলাই নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্ট বরাবর একখানা স্মারকলিপি পেশ করি। উক্ত স্মারকলিপিতে উপরিউক্ত বিবেচনা মাথায় রেখে আমি উল্লেখ করি যে, এই বিষয়ে রাজনৈতিক বিষয়বস্তু এত দূরবর্তী গুরুত্ব বহন করে যে, মহাসচিব সংক্ষিপ্ত কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ নিরাপত্তা পরিষদকে দিতে পারেন না। তাছাড়া আমি বিশ্বাস করি যে, ইতোমধ্যে সংগঠিত মানবিক বিপর্যয়রোধে এবং অবস্থার অবনতি ঠেকানোর জন্য জাতিসংঘের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাময় শান্তিকামী এবং বিভিন্ন সমন্বয় সমৃদ্ধ একটি সংস্থা হিসেবে অবশ্যই এবং অধিকতরভাবে অগ্রগ্রামী ভূমিকা পালন করা উচিত হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতরের সংস্থা হিসাবে নিরাপত্তা পরিষদের সর্বোচ্চ মনোযোগের জায়গা হলো বর্তমান এই অবস্থা এবং যে সকল পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেই স্থানে পৌঁছাতে সম্মত হওয়া। সাধারণভাবে নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যরা ঠিক করবেন যে, এরূপ সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিক বা অনুষ্ঠানিকভাবে নেয়া হবে কিনা। এই পর্যায়ে আমার প্রাথমিক মনোযোগের বিষয় এই বিপর্যয় অবস্থার সমাধান করতে পারে এরূপ সম্ভাব্য সমাধান বের করার একটি ভিত্তি এবং সুযোগ তৈরি করা।

এই সমসাময়িক সময়ে আমি আন্তর্জাতিক শান্তি ও সুরক্ষা বিষয়ক একটি স্মারকলিপি দাখিল করি। আমি মহাসচিব হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনকালে একটি মানবিক প্রস্তাব দাখিল করি যার মূল লক্ষ্য ছিল জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার দুই দেশের সীমানায় সীমিত প্রতিনিধির মাধ্যমে স্বেচ্ছায় শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনকে সহযোগিতা করা। প্রাথমিক পর্যায়ে, আমার পরামর্শ এরূপ যে, দুই সরকারের সম্মতিতে ও আলোচনায় দুই বা তিনটি জায়গায় এই কাজে প্রতিনিধিদের স্থাপন করা। পাকিস্তান সরকার আমার এই পরামর্শ মেনে নিলেও শরণার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত যাওয়াকে প্রতিরোধ করছে না মর্মে ভারত সরকার এই পরামর্শ মেনে নেয় না।

সাম্প্রতিক সময়ে, পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ কার্যক্রমকে শক্তিশালী করার জন্য আমি কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ঢাকায় অবস্থানরত আমার প্রতিনিধির সুপারিশমতে জাতিসংঘে কর্মরত কর্মকর্তাদের সংখ্যা এই অপারেশনে বৃদ্ধি করি এবং তাতে কার্যকারিতা যথেষ্ট উন্নত হয়। এতে করে এই সংস্থা এমন একটি উন্নতর অবস্থানে পৌঁছেছে যে, যে সকল দেশ দাতা হিসেবে অবদান রাখছে, তাদের এই বিষয়ে আশ্বস্ত করতে পেরেছে যে তাদের দান, তাদের লক্ষ্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিকট পৌছে যাচ্ছে। আমি আশা রাখি যে, জাতিসংঘের কার্যক্রম শক্তিশালী হওয়ায়, পূর্ব পাকিস্তানের জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য আরো ত্রাণ অর্জন করতে সক্ষম হব।

এরূপ ব্যাপক আনুপাতিক দুর্যোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংশ্লিষ্ট সরকার ও জনগণকে সম্ভাব্য প্রতি ক্ষেত্রে সাহায্য করার নির্দিষ্ট দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু, আমার মতে, মূল সমস্যা তখনই সম্ভব যখন ভ্রাতৃত্বের সূত্রপাত ও মানবিকতার মূলনীতির বিবেচনায় রাজনৈতিক সমাধান হবে।