শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্ট-এর কাছে জাতিসংঘের মহাসচিবের উ-থান্ট- এর স্মারকলিপি | জাতিসংঘ ডকুমেন্টস | ১৯জুলাই, ১৯৭১ |
সিকিউরিটি কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের নিকট জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট এর স্মারকলিপি
বর্তমান সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্য এবং জাতিসংঘের অন্য সদস্য দেশ কয়েকমাস যাবত পূর্ব পাকিস্তান ও সংলগ্ন ভারতীয় অংশে ঘটে যাওয়া বিষয় এবং তার পরবর্তী সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বা পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ঘটনার অতি স্বল্প সময় পরপরই আমার উৎকন্ঠা রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান-কে জানাই এবং জাতিসংঘে ভারত ও পাকিস্তানের সংসদ প্রতিনিধি ও অন্যান্যদের মাধ্যমে অবিরত যোগাযোগ রেখে চলেছিলাম। আর এই মতবিনিময়ে আমি মহাসচিব হিসেবে জাতিসংঘ দলিলের প্যারা ৭ অনুচ্ছেদ ২ এর বিধান ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহযোগিতা দ্বারা মানবজাতির কল্যান ও মানবিক নীতি প্রতিষ্ঠায় দ্বৈত দায়িত্ব পালন করা বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ ছিলাম।
পর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থী এবং পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থানরত জনগণের সাহায্যের জন্য আবেদনকরাকে প্রথম পরবর্তী দায়িত্ব হিসেবে মনে করেছিলাম। এই সকল আবেদনকে গতি দেয়ার জন্য জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনারকে ভারতে থাকা শরণার্থীদের ফোকাল পয়েন্ট নিযুক্ত করেছিলাম এবং পাকিস্তানের সম্মতিতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিকট ত্রাণ পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য ঢাকায় একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিলাম। এই দুই মানবিক প্রচেষ্টা অপর জায়গায় বিস্তারিত লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং ১৬ জুলাই ১৯৭১ তারিখে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলে এই উভয় কার্যক্রম নিয়ে পর্ণাঙ্গ আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ও আন্ত সংস্থা বিষায়ক এর সহকারী মহাসচিবের কাউন্সিলে দেয়া বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে সরকারকে আমার উষ্ণ কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ গ্রহণ করেছি। আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘের এজেন্সী, বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও কিছু স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা যারা এগিয়ে এসেছে আমি তাদের আমার উষ্ণ কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার প্রতিনিধিদের তাদের কর্মক্ষেত্রে সমন্বয় সাধনের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের সরকারকে আমি সাধুবাদ জানাই।
মার্চের শেষে সপ্তাহ গড়াতে লাগল আর আমার অস্বস্তি বাড়তে লাগল এবং সর্বদিক দিয়ে ঐ নির্দিষ্ট এলাকায় অটল ধ্বংস উপলব্ধি করতে লাগলাম। ভারতে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য আমার আবেদনের প্রেক্ষিতে করা সহায়তার প্রতি দয়ালু প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও অর্থ ও অন্যান্য সরবরাহ পর্যাপ্ত নয় এবং ভারত সরকার এখন পর্যন্ত অপরিমাপযোগ্য সময়ের জন্য ক্রমবর্ধমান লাখো শরণার্থীদেও দেখাশুনার ক্ষেত্রে সমস্যাসঙ্কুল অবস্থায় মুখোমুখি হচ্ছে।
একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ পূর্ব পাকিস্তানের পরর্বতীতে আসন্ন দুটি দূর্যোগ রাজনৈতিক স্থিরতা ও জনপ্রশাসন,আইন শৃংখলায় প্রকৃত উন্নতির কমতির কারণে আন্তর্জাতিক ও সরকারী সকল প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্থ হচ্ছিল। যেখানে বৃহৎ পরিসরে ত্রাণ কার্যক্রম কার্যকর ভূমিকা নিতে পারত সেই স্থানে উন্নতি না ঘটাতে পারলে চরম খাদ্যসংকট দূর্ভিক্ষে পরিবর্তিত হয়ে বিপদ বয়ে আনতে পারে। একইভাবে বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত বৃহৎ সংখ্যক শরণার্থী ফেরত আনার অনিবার্য পূর্বশর্ত হিসেবে উন্নত রাজনৈতিক স্থিরতা এবং ত্রাণ কার্যক্রমের সফলতা সন্দেহাতীতভাবে খুব গুরুত্বপর্ণ। এই অবস্থাটা এমন ছিল যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ধারক দুষ্টচক্রের ক্রম তৈরি করেছিল যা বৃহৎ আকারে যা মানবিক সমস্যা নিরোধে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক মহলের কাজ বিপর্যস্ত করছিল।
এই সকল মানবিক বিপর্যয়ের ফলাফল সুদর প্রসারী। সংঘাতের অনুভূতি উপমহাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীদের সম্পর্কে এবং ভারত পাকিস্তানের সরকারের সম্পর্ককে অবনতি ঘটানোর একটি গুরুত্বপর্ণ উপাদান হতে পারে। রাষ্ট্রের ভূখন্ডের অখন্ডতা এবং আÍপরিচয়ের সংঘাত পর্বেও ভ্রাতৃহত্যার আকাংখার উত্থান ঘটিয়েছে। আর সমসাময়িক কয়েক বছর আন্তর্জাতিক মহলে এটি মানবিক প্রতিক্রিয়াকে উসকে দিচ্ছে। এই বর্তমান বিষয়ে আরেকটি অতিরিক্ত বিপদ হলো যে ভারত দীর্ঘ সময়ের এবং অমীমাংসিত সংকটের বৈপরীত্য অবস্থান যা ছয় বছর আগেও একটি উন্মুক্ত যুদ্ধের উত্থান ঘটিয়েছিল। যদিও উভয় সরকারের শান্তির বিষয়ে দৃঢ় ইচ্ছা নাই এবং দুই দেশের অস্থিরতা নিরসন বিষয়ক কোন ইঙ্গিতও নাই। পূর্ব পাকিস্তানের সীমানার অবস্থাটি নিয়মিতভাবে সমস্যাময় ছিল। সীমানা সংঘাত,গুপ্ত হামলা এবং চরমপস্থীদের কার্যক্রম প্রায়শই ঘটত আর শরণার্থীদের এই সংঘাতময় সীমানা দেশে প্রবেশের জন্য পার হতে হতো। জাতিসংঘের কারো কাছে এটি উপেক্ষা করার মতো ছিল না যে, উপমহাদেশে এই সংঘাত সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
উপমহাদেশে বহাল থাকা এরূপ সংকটময় অবস্থায় নৈতিক রায়ে খুব সহজেই পৌঁছানো যায়। রাজনৈতিক ও মানবিক সভ্যতায় এই অবস্থা মেনে নেয়া এবং অগণিত সমস্যায় জড়িত জনগণকে পথ দেখানোতে সাহায্য করা অতীব কষ্টের ছিল। জাতিসংঘ পরবর্তীতে তা অবশ্যই অনুসরণ করবে বলে মনে হয়।
আমি মনে করি না যে, বর্তমান অবস্থার কোন চিত্রকে এবং সম্ভাব্য পরিণতিকে খুব রূঢ় করে উপস্থাপন করেছি। প্রাপ্য তথ্যের আলোকে আমি অনায়েসে এই উপসংহারে পৌঁছাতে পারি যে, আন্তর্জাতিক মহল এই অবনতির অবস্থা ধারাবাহিক ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং ত্রাণ কার্যক্রম, মানবিক সাহায্য এবং সদিচ্ছা এই মানবিক দুর্দশা ও দুর্যোগকে পরিবর্তন করার জন্য যথেষ্ট। বর্তমান অবস্থার সম্ভাব্য পরিণতি শুধুমাত্র মানবিক বোধ থেকে নয় বরং শান্তি ও সুরক্ষার প্রতি প্রকৃত হুমকি হিসেবে দেখছি এবং ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও কার্যক্রমে জাতিসংঘকে কার্যকর সংস্থা হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা নিয়ে আমি আশাবাদি।
মানবিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক সমস্যা মিলিত হয়ে বর্তমানে যে সংকটময় অবস্থার সৃস্টি হয়েছে তা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে জাতিসংঘকে মোকাবিলা করতে হবে। এরূপ অবস্থা ভবিষ্যতেও উদ্ভব হতে পারে। যদি এখন এই সংস্থা এরূপ অবস্থা মোকাবিলা করতে পারে, তবে তা ভবিষ্যতে নতুন দক্ষতা ও নতুন শক্তির বিকাশ করতে পারবে।
এটি এই কারণে যে আমি এমন একটি বিষয়ে কথা বলছি যে বিষয়টি কাউন্সিলের আলোচ্যসচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এই বিষয়ে রাজনৈতিক বিষয়বস্তু এত দূরবর্তী গুরুত্ব বহন করে যে, মহাসচিব সংক্ষিপ্ত কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ নিরাপত্তা পরিষদকে দিতে পারেন না। তাছাড়া আমি বিশ্বাস করি যে, ইতোমধ্যে সংগঠিত মানবিক বিপর্যয়রোধে এবং অবস্থার অবনতি ঠেকানোর জন্য জাতিসংঘের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাময় শান্তিকামী এবং বিভিন্ন সমন্বয় সমৃদ্ধ একটি সংস্থা হিসেবে অবশ্যই এবং অধিকতরভাবে অগ্রগ্রামী ভূমিকা পালন করা উচিত হবে।
পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতর সংস্থা হিসাবে নিরাপত্তা পরিষদের সর্বোচ্চ মনোযোগের জায়গা হলো বর্তমান এই অবস্থা এবং যে সকল পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেই স্থানে পৌঁছাতে সম্মত হওয়া। সাধারণভাবে নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যরা ঠিক করবেন যে, এরূপ সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিক বা অনুষ্ঠানিকভাবে নেয়া হবে কিনা। এই পর্যায়ে আমার প্রাথমিক মনোযোগের বিষয় এই বিপর্যয় অবস্থার সমাধান করতে পারে এরূপ সম্ভাব্য সমাধান বের করার একটি ভিত্তি এবং সুযোগ তৈরি করা।
পরামর্শটি সরলভাবে এই যে, হাইকমিশনারের একটি ছোট প্রতিনিধিদল কঠোর সীমিত কার্যবিবরণে এবং পরীক্ষণ হিসাবে কার্যপরিধি হাতে নিবে। জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনের সাথে পরামর্শক্রমে এই প্রতিনিধিদল সংশ্লিষ্ট সরকারের সিদ্ধান্তের উপর কার্যক্রম চালাবে। যদি সম্ভব হয় শরণার্থীদের নিজ রাষ্ট্র পুনরুদ্ধারে সহযোগিতা করাই এই পরামর্শটির একমাত্র লক্ষ্য।
অপর দলিলটিতে (নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির নিকট উথান্ট এর স্মারকলিপি) প্রাথমিকভাবে নিরাপত্তা পরিষদের সক্ষমতা এবং জাতিসংঘ দলিলে মহাসচিব এর সক্ষমতার বিষয়টি সরিয়ে রেখে আন্তর্জজাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয় নিয়ে কাজ করা হয়েছে। ১৯৬৬ সালে ২ ডিসেম্বর ১৩২৯তম সভায় আমি এটি পুনরায় উপস্থাপন করি। মহাসচিব এর অবস্থানকে সম্মান করে এই সংস্থা যে সকল মুল বিষয়ের মুখোমুখি হয়েছে এবং তাদের নজরে আসার পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের অস্থির বিকাশকে উপস্থাপন করে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে তার কার্যক্রমকে বিবৃত করে একটি বিবৃতি প্রদান করেন।
এই স্মারকলিপি নিরাপত্তা পরিষদের একটি আনুষ্ঠানিক দলিল নয় এবং ঐ অঞ্চলে ব্যাপক ও প্রকৃত বিপদ বিষয়ে আমার গভীর উদ্বেগ উপস্থাপনের জন্য লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং তাতে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা অত্যন্ত গভীর দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় করেছেন।