শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
ভারত সরকার কর্তৃক জাতিসংঘ মহাসচিবের ত্রাণ সংক্রান্ত স্মারকের জবাব | জাতিসংঘ ডকুমেন্টস | ২ আগস্ট, ১৯৭১ |
১. বর্তমানে ভারতে আশ্রয় নেওয়া পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের পুনরায় স্বদেশে পুনর্বাসন করা যে এখন অত্যন্ত উদ্বেগ ও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এ ব্যাপারে মহাসবিবের সাথে ভারত সরকারও একমত প্রকাশ করছে। এর চেয়েও আরো বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো পূর্ব পাকিস্তানে চলমান সামরিক নৃশংসতা বন্ধ করা এবং এর প্রভাবে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিচ্ছেন। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে ইতিমধ্যে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থিদের ফিরে যাওয়াও অসম্ভব। ভারত সরকার গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে শরণার্থীদের ফিরে যেতে উৎসাহিত করা, থামানো বা আরো আগমন বন্ধের চেষ্টার পরও ২০শে মে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানের নাগরিকদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণার পরপরই প্রায় ৪০ লক্ষ শরণার্থীর আগমন ঘটেছে।
২. ৭০ লক্ষাধিক শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন এবং দিন দিন এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে এর মূল কারণ হলো পূর্ব পাকিস্তানে তাদের নিজ বাসস্থানে ফিরে যাওয়ার মত অনুকূল পরিবেশের অনুপস্থিতি। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের নিয়মিত পাঠক মাত্রই এখন এই বিষয়ে জ্ঞাত আছেন যে পূর্ব পাকিস্তান বিশৃঙ্খলা, সামরিক দমন পীড়ন এবং বাংলাভাষীদের উপর হত্যাযজ্ঞ এখনো চলমান। নিরপেক্ষ বিদেশী পর্যবেক্ষকগণ পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে এবং ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের দূর্দশার চিত্র সরেজমিনে দেখে যে রিপোর্ট দিয়েছেন এবং বিশ্বব্যাংকের দেয়া রিপোর্ট থেকেও এসব তথ্য প্রমাণিত হয়।
৩. লক্ষাধিক শরণার্থী যারা বর্তমানে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, এবং এই সংখ্যা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে, এদের দেখভাল করা যে ভারত সরকারের উপর বোঝাস্বরূপ হয়ে উঠেছে তা ইতিমধ্যেই সবার গোচরীভূত হয়েছে। এরই সাথে এই বিষয়েটিও সকলের নজরে এসেছে যে সাম্প্রতিককালে পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া পরপর দুটি দূর্যোগ পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলায় সকল চেষ্টাই বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, এই দুই দূর্যোগের একটি প্রাকৃতিক, একটি মানুষসৃষ্ট এবং এর মূল কারণ হলো রাজনৈতিক সমন্বয়ের জন্য বাস্তবসম্মত উপায়ের অনুপস্থিতি যার প্রভাব পড়েছে পূর্ব পাকিস্তানের আইন, অনুশাসন ও জনপ্রশাসনের উপর। শরণার্থীদের ভারত থেকে ফিরিয়ে নেয়ার অপরিহার্য শর্ত হলো পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতিসাধন করা। পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখন্ডতা ও স্বাধিকারের মূলনিতির মধ্যকার দ্বন্দ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসে যেখানে সামরিক বাহিনী সংখ্যাফরিষ্ঠ জনগণকে দমিয়ে রেখেছে, এই সামরিক জান্তাই গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বিকৃতি জানিয়েছে এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর নির্বিচারে গণহত্যা, সাংস্কৃতিক নিপিড়ণ, নির্যাতন আরম্ভ করেছে। এই মূল সমস্যার যদি সমাধান করা না হয় তাহলে শরণার্থীবিষয়ক এই সমস্যার সমাধানের জন্য নেয়া সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। সকল চেষ্টাই যে ব্যর্থ হবে তাই শুধু নয়, এর ফলে মূল বিষয় থেকেও আন্তর্জাতিক নজর সরে যাবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হওয়া এই বিস্তৃত এবং ভয়ঙ্কর আকারের সামরিক নির্যাতনেরও সম্প্রসারণ ঘটবে।
৪. কিছুদিন পূর্বে যুবরাজ সদরুদ্দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত বিভিন্ন জাতিসত্ত্বা ও বিভিন্ন ভাষাভাষী সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ স্বদেশ পুনর্বাসনের পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করবে। UNHCR গত ১৬ জুলাই জেনেভায় অনুষ্ঠিত ECOSOC সম্মেলনে এই বিষয়ে কোনো প্রস্তাব দেয় নি যে সীমান্তের উভয় পাশে শরনার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রতিনিধিদের অবস্থান শরণার্থীদের তাদের নিজ বাস্থানে ফিরিয়ে নিতে কোন ধরণের সাহায্যে আসবে।
৫. এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার বুঝতে পারছে না যে ভারতের সীমান্তে গুটিকয়েক সৈন্যের উপস্থিতি কি সুফল বয়ে আনবে। আমাদের বিশ্বাস যে শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যাবার ব্যাপারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শক্তির মোকাবেলা করতে তারা কোনরূপ সাহায্য করতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি জনগণকে দমনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকার পাশবিক শক্তি প্রয়োগ করেছে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এর ফলে ইতিমধ্যেই ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যাওয়া যেমন অসম্ভব হয়ে পড়েছে তেমনি আরো শরণার্থীদের ভারতে নেয়ার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে।
৬. ভারত সরকার শরণার্থীদের নিজদেশে ফেরত পাঠানোর বিপক্ষে নয় বরং আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে উদ্বিগ্ন এবং তাদের ফেরত পাঠানোর পূর্বশর্ত হলো পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থার উন্নতি সাধন করা যাতে শরনার্থীদের পরবর্তীতে ভারতে আসতে না হয়। প্রসঙ্গক্রমে, মহাসচিব নিশ্চয় ৩০ জুন UNHCR এর করা প্রতিবেদনটি দেখেছেন যাতে ভারত সরকার শরণার্থীদের ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দিচ্ছে পাকিস্তানের এই মিথ্যা অভিযোগ খণ্ডন করা হয়েছে। যুবরাজ সদরুদ্দিন বলেন যে ভারত সরকার শরণার্থীদের ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দিচ্ছে এই অভিযোগের কোন প্রমাণ নেই। ৩০ জুলাই আবার এক প্রশ্নের জবাবে যুবরাজ বলেন যে ভারত সরকার শরণার্থীদের ফেরত যেতে বাধা দিচ্ছে এমনটা বলা যৌক্তিক হবে না। ১৯ জুলাই, কাঠমন্ডুতে ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ নামে একটি বৃটিশ সংস্থার দুজন স্বেচ্ছাসেবক ভারত সরকার শরণার্থীদের জিম্মি করে রেখেছে এবং তাদের স্বদেশে ফিরে যেতে বাধা দিচ্ছে পাকিস্তানের এই অভিযোগকে ‘ছাইপাঁশ’ বলে মন্তব্য করেন। ১০ জুলাই যুক্তরাজ্যের নিম্নকক্ষের সদস্য জনাব কর্ণেলিয়াস ই. গালাগার নিম্নকক্ষে একটি ভাষণ দেন যাতে তিনি উল্লেখ করেন ‘পাকিস্তান সরকারের নেয়া পদক্ষেপের কারণে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তার প্রতিশ্রুতিতে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত প্রশংসার দাবিদার। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাশবিক শক্তি প্রদর্শন করে যে উসকানী মূলক পরিস্থিতির সূচনা করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার অবিশ্বাস্য সংযম প্রদর্শন করেছে এবং শরণার্থীদের প্রতি অপরিসীম সহানুভূতি দেখিয়েছে। যদি কোন সরকারকে সৎ এবং মানবদরদী বলা যায় তাহলে প্রথম শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করার পরের কয়েক সপ্তাহ থেকেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এই সম্মান অর্জন করেছেন। শরণার্থীদের উর্ধমুখী সংখ্যা এই অকাট্য প্রমাণ দেয় যে পাকিস্তান সরকার নির্বাচনে জয়ী দলকে দমন করার জন্য নিষ্ঠুর নীতির আশ্রয় নিয়েছে। শরণার্থীদের কিয়দংশের সাথে বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাতকারের উপর ভিত্তি করে আমি এখন বিশ্বাস করি যে, বাঙালির বুদ্ধিজীবী জীবনকে ধ্বংস করার জন্য অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে চেষ্টা করা হয়েছে কারণ সেনাবাহিনী ছাত্র-শিক্ষক এবং অন্যদের উপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। আমার মতে, এই ঘটনা গণহত্যার নামান্তর। উপরিউক্ত প্রতিবেদনসমূহ এবং এই বিষয়ক অন্যান্য প্রতিবেদন থেকে দায়িত্বশীল এবং গ্রহণযোগ্য একটি প্রতিবেদনও পাওয়া যায় নি যাতে শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যার্থতা বা তাদের ভারতে আগমনের কারণ হিসেবে পূর্ব বাংলায় বর্তমান আসহনীয় ও দুঃখজনক ঘটনা ব্যাতীত অন্য কোন কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে।