You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
সভিয়েত-ভারত যুক্ত বিবৃতি (মস্কো থেকে প্রকাশিত) বাংলাদেশ ডকুমেন্টস ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

দুই পক্ষই পুরোপুরিভাবে একমত হয়েছিল যে এই চুক্তির প্রভাব অসামান্য এবং উভয় রাষ্ট্রের জন্যই ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ এবং এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্ব পারস্পারিক সম্মান, আস্থা এবং প্রতিবেশিসুলভ সহযোগিতাকে শক্তিশালী করবে। এই চুক্তি নিশ্চিত করে যে শভিয়েত-ভারত বন্ধুত্ব কোন ক্ষনস্থায়ী পরিস্থিতির উপর নয় বরং দুই দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদী পারস্পারিক উন্নতি এবং অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতির জন্য বহুমুখী পারস্পারিক সহযোগীতা এবং দুই দেশের শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য প্রতিষ্ঠিত।
দুই পক্ষই চুক্তির শর্ত এবং মূলনীতি অনুসারে সোভিয়েত-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে তাদের দৃঢ় সংকল্পের ঘোষনা দিল। তারা সন্তোষের সাথে লক্ষ্য করলেন পারস্পরিক অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগীতার উন্নতি এবং গুরুত্বারোপ করলেন পারস্পারিক সহযোগীতা উন্নয়নের সম্ভাবনার ওপর বিশেষত লোহা এবং ইস্পাত শিল্পে ইস্পাতের সঙ্কর ধাতু এবং অলৌহ ধাতুবিদ্যা এবং পেট্রো-কেমিক্যাল শিল্পে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলের অনুসন্ধান, জরিপ এবং পরিশোধনের ক্ষেত্রে।
মহাকাশ গবেষণা, পারমাণবিক শক্তির শান্তিপুর্ণ ব্যাবহার, পরস্পরের শিল্প বাণিজ্যের উন্নতির মত ক্ষেত্র গুলোতে পারস্পারিক সহযোগীতার স্বরুপ নিরুপনে গৃহীত পদক্ষেপসমুহে উভয় পক্ষই সন্তোষ প্রকাশ করলেন। তারা সহযোগীতার নতুন ক্ষেত্র চিনহিতকরনকে গুরুত্বপুর্ন হিসেবে বিবেচনা করলেন।
এই যোগাযোগে মতৈক্যে পৌছান হয়েছিল যে দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা মিলিত ভাবে কাজ করবেন উপরিল্লিখিত বিষয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা প্রণয়নে। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক এবং কারিগরি সহযোগীতার লক্ষে একটি আন্ত-সরকারি কমিশন প্রণয়নে।
প্রধান আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলো নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় এবং বোঝার জন্য চুক্তি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন স্তরে চুক্তি এবং সম্পর্ক তৈরির গুরুত্ব উভয় পক্ষই অনুধাবন করল।
চুক্তির প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের জনগণের অকুন্ঠ সমর্থন এবং বিশ্বব্যাপী এই চুক্তিকে স্বাগত জানানোয় তারা সন্তোষ প্রকাশ করলেন।
এশিয়া সহ সারা বিশ্বে স্নায়ুচাপ কমানো এবং বিশ্বব্যাপী শান্তি ও সহযোগীতাকে জোরদার করার লক্ষ্যে ভারতের জোটভুক্ত না হওয়ার নীতিকে সম্মান জানায় সোভিয়েত পক্ষ।
ভারত পক্ষও বিশ্বব্যাপী শান্তি সহযোগীতা এবং বন্ধুত্বকে জোরদার করার লক্ষ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের শান্তিপুর্ন পররাষ্ট্র নীতির প্রতি তাদের সম্মান জানায়। তারা চলমান আন্তর্জাতিক সমস্যাসমুহের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিনিময় বিষয়গুলো নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতের অবস্থানের নৈকট্য প্রকাশ করে। উভয় পক্ষই প্রধানত এশিয়ার পরিস্থিতির পরিবর্তন, সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনার স্নায়ুচাপ এবং আগ্রাসন প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের মাধ্যমে শান্তিপুর্ন এশিয়া গঠনের দিকেই প্রধানত মনযোগ দিচ্ছিল।
উভয় পক্ষই পুর্ববাংলায় সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী থেকে উদ্ভুত মর্মান্তিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং এই অঞ্চলে শান্তি রক্ষায় কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যাক্ত করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী সোভিয়েত পক্ষকে অবহিত করেন যে পুর্ব বাংলা থেকে আগত ৯০ লক্ষাধিক শরণার্থীর উপস্থিতি ভারতে সামাজিক এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং অর্থনৈতিক চাপের সৃষ্টি করছে। যার ফলে ভারতের আর্থসামাজিক কর্মকান্ড ব্যাহত হচ্ছে।
পুর্ব বাংলা থেকে শরণার্থীর আগমনে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে ভারতের মানবিক তৎপরতার ভুয়সী প্রশংসা করেন সোভিয়েত পক্ষ এবং শরণার্থী স্রোতে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সমস্যা তারা উপলব্ধি করতে পারছেন বলে ব্যক্ত করেন।
শরণার্থী আগমন ঠেকাতে এবং ভারতে অবস্থানকারী সকল শরণার্থীদের অনতিবিলম্বে তাদের নিজদেশে ফেরত পাঠাতে ভারত সরকার প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেবে বলে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকেও সোভিয়েত পক্ষ বিবেচনায় নেয়।
২রা এপ্রিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের কাছে সুপ্রিম সোভিয়েত প্রেসিডিয়াম ,সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দেয়া বার্তায় সোভিয়েত পক্ষ শরণার্থী সমস্যা এবং পুর্ব বাংলায় ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী থেকে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে তাদের অবস্থান পুনরায় ব্যাক্ত করেন।
২৫শে মার্চ ১৯৭১ থেকে পুর্ব বাংলায় পরিস্থিতির পরিবর্তন বিবেচনায় নিয়ে উভয় পক্ষই শান্তি রক্ষার জন্য এবং শরণার্থীদের নিজ দেশে দ্রুত, নিরাপদে এবং সসম্মানে প্রত্যাবর্তনের জন্য পুর্ব বাংলার জনগণের আকাঙ্ক্ষা, অধিকার এবং বৈধ স্বার্থের কথা মাথায় রেখে যেসব সমস্যা থেকে এই পরিস্থিতির উদ্ভব তার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভুত পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে উভয় পক্ষই পারস্পারিক যোগাযোগ বজায় রাখা এবং চলমান বিষয়াদি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী বিনিময়ে একমত হয় উভয় পক্ষ।
দুই পক্ষ দক্ষিন-পুর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং ইন্দোচীন এলাকার শান্তি এবং সেখানকার মানুষের নিরাপত্তা, জাতীয় স্বার্থ এবং বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজ ভবিষ্যৎ গঠনের অধিকারের জন্য সেখান থেকে সকল বিদেশী বাহিনী সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজনীয়তার পক্ষে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করে।
তারা দক্ষিন ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের ৭ দফা প্রস্তাবনাকে শান্তিপুর্ন রাজনৈতিক নিষ্পত্তির ভিত্তি হিসেবে স্বাগত জানায় এবং প্রস্তাবনার পক্ষে নিজেদের সমর্থন ব্যাক্ত করেন।
মধ্যপ্রাচ্যের tense পরিস্থিতি নিয়ে দুই পক্ষ তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে। তারা জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৬৭ সালের ২২শে নভেম্বরে প্রণীত প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদী, স্থিতিশীল এবং ন্যায়সংগত শান্তির জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
নিরাপত্তা এবং পারস্পারিক সহযোগিতার প্রশ্নকে একটি গুরুত্বপুর্ন পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করে শুধু ইউরোপে নয় বরং সারাবিশ্বে চলমান স্নায়ুচাপ নিরসনে একটি সর্ব ইউরোপীয় সমাবেশ আহ্বানের প্রস্তাবনাকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উন্নয়নে অবদান রাখতে ইচ্ছুক ভারত সরকার স্বাগত জানায়।
উভয় পক্ষই বিশ্বাস করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করা এবং দৃঢ় আন্তর্জাতিক নজরদারিতে সকল পারমানবিক এবং কনভেনশনাল অস্ত্রের সম্পুর্ন নিরস্ত্রীকরন অর্জনই শান্তি এবং নিরাপত্তা রক্ষা এবং শক্তিশালী করার জন্য প্রধানত গুরুত্বপুর্ন।

জরুরী নিরস্ত্রীকরন সমস্যার সমাধানের গ্রহণযোগ্য এবং বাস্তবসম্মত উপায়ের জন্য সব রাষ্ট্রের অংশগ্রহণে বিশ্ব নিরস্ত্রীকরন সম্মেলন আহ্বান করা দুই পক্ষের মতেই অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। অদুর ভবিষ্যতে সকল জৈব ও রাসায়নিক অস্ত্রের উন্নয়ন, উৎপাদন এবং মজুদ নিষিদ্ধকরন এবং তাদের ধ্বংস করার মতৈক্যে পৌছানকে যুদ্ধের জৈব ও রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যাবহার বন্ধের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দুই পক্ষই গুরুত্বপুর্ণ বলে বিবেচনা করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুনঃব্যক্ত করেন যে ভারত মহাসাগর কে শান্তি এলাকা হিসেবে প্রতিষ্টিত করা উচিৎ। সোভিয়েত পক্ষ জানায় যে তারা এ বিষয়কে যাচাই করে দেখতে এবং অন্যান্য শক্তির সাথে সমতার ভিত্তিতে একসাথে বসে সমাধানে পৌছাতে প্রস্তুত রয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত সাম্রাজ্যবাদের পদচিহ্ন দ্রুত এবং সম্পুর্নভাবে বিলুপ্তকরন এবং কলোনিয়াল রাষ্ট্র এবং তার জনগণের স্বাধীনতা প্রদানের জন্য জাতিসঙ্ঘের ঘোষণা বাধাহীনভাবে বাস্তবায়নের আহ্বান জানায় । তারা সব ধরনের জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদের প্রতি তাদের ঘৃণা দ্ব্যার্থহীনভাবে প্রকাশ করে।
দুই পক্ষ ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক ব্যাবস্থার দেশের শান্তিপুর্ণ সহাবস্থানের নীতির প্রতি তাদের আনুগত্য পুনঃব্যাক্ত করেন এবং নিজেদের রাষ্ট্রসমুহের মধ্যে বিদ্যমান ইস্যুসমুহ শান্তিপুর্ণ পথে সমাধানের পক্ষে বলে ঘোষনা দেয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত জাতিসঙ্ঘের ভুমিকার প্রতি গুরত্ব আরোপ করে। উভয় পক্ষই জাতিসংঘকে শক্তিশালী করতে এবং জাতিসংঘের সনদ অনুসারে বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষায় এর কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে তাদের সংকল্প ব্যাক্ত করে।
উভয় পক্ষ আশাবাদ ব্যাক্ত করেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর এবং সফরকালে সোভিয়েত নেতাদের সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠক এবং আলোচনা দুই দেশের মধ্যেকার বন্ধুত্বপুর্ন সহযোগীতা বৃদ্ধিতে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তাকে জোরদার করতে সাহায্য করবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়ন কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারন সম্পাদক এলআই ব্রেঝনেভ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কাউন্সিল অফ মিনিস্টারের সভাপতি এএন কসিগিনকে ভারতসফরের জন্য আন্তরিক আমন্ত্রন জানান। আমন্ত্রন ধন্যবাদের সাথে গৃহীত হয়।
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!