You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09 | বাংলাদেশকে সমর্থনদানের কারন ব্যাখ্যাঃ বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন | বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশকে সমর্থনদানের কারন ব্যাখ্যাঃ বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশকে সমর্থনদানের কারন
মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে বীভৎস নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে তা এখন সবারই জানা। –
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারের মতে, পূর্ব বপাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা নয় মিলিয়ন ছুঁয়েছে। এখন পর্যন্ত খুন হওয়া বাঙালির সংখ্যা ৫০০০০ বা দুই মিলিয়ন আমরা যেটাই বিশ্বাস করি না কেন, এই গনহত্যার মাত্রা তুলনা করতে ভিয়েতনাম বা ১৯৫৬-৬৬ সালের ইন্দোনেশিয়ার গনহত্যার কথা মনে করিয়ে দেয়।
এখানের এবং বাইরের জনপ্রতিনিধিরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি নিন্দা জানিয়েছেন, অনেকেই তাদের অবিলম্বে সংযম প্রদর্শনের আহবান জানিয়েছেন এবং কেউ বলছেন যে তাদের সেই পরিবেশ তৈরী করতে হবে যেন শরণার্থীদের ফেরত যাওয়া সম্ভব হয়। জুনের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানে সফর করা বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদল জানিয়েছে যে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দৃশ্যমান এবং পারতপক্ষে উপস্থিতি বহুলাংশে হ্রাস না পেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে তেমন কিছুই বিবেচনা করা হয়নি।
আমি যেমনটি দেখছি, সাতটি কারণবশত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করা উচিত।
প্রথমত, এবং মূল ব্যাপার এটাই যে বাংলাদেশ এর আন্দোলনকে চাপা দেওয়ার অবিরত চেষ্টাটি কাঠের টুকরোর মতোই অর্থহীন হয়ে যাবে। সাম্প্রতিক ডিসেম্বরের স্বাধীন ও প্রতিযোগীতামূলক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যখন ১৬২টি আসনের ১৬০টিতেই জয়ী হয়, তখন দেখা গেছে যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের প্রবল জনসমর্থন আছে । এবং সামরিক বাহিনীর বাঙালী ইউনিটের প্রায় প্রতিটি মানুষ বিদ্রোহ করায়, সংক্ষিপ্ত ও তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে আন্দোলনটিকে নস্যাৎ করার যে প্রচেষ্টা চলছিলো তা ব্যর্থ হয়েছে। তখন থেকেই ইয়াহিয়া খান বার বার বলছেন নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা পাকিস্তান সংসদে আসনগ্রহনের মাধ্যমে তার শাসন ব্যবস্থায় সম্মত হয়েছেন, কিন্তু ১৬০ জনের মাত্র ২২ জন এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন।
শেষ কয়েকমাসে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান এর সুযোগ পেয়েছিলেন এমন কিছু স্বাধীন পর্যবেক্ষক এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বিভিন্ন এলাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ এখনো ভয়াবহ পাশবিক কর্মকান্ড চালানোকে প্রয়োজনীয় ভাবছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সিডনী শ্যানবার্গ, যিনি গত মাসের শেষ সময়টায় পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন, এর মতে ঐ এলাকার পঙ্গু অর্থনৈতিক অবস্থা, ভেঙে পড়া সরকার প্রশাসন, বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গেরিলা আক্রমন, সত্ত্বেও, ক্রমবর্ধমান সামরিক ক্ষয়ক্ষতি এবং বিচ্ছিন্ন জনগন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের কাজেই অটল থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে।

এমতাবস্থায়, শরনার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত যাওয়া সম্ভব করতে তারা উপায় খুঁজছে- পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষের এমন নিশ্চয়তা শুধু মাত্র তাদের বালখিল্যতা কিংবা সত্য চাপা দেওয়ার কুটিল চেষ্টা হিশেবেই বিবেচিত হতে পারে । (সেপ্টেম্বর ২৩, ১৯৭১ নিউ ইয়র্ক টাইমস দেখুন)
দ্বিতীয়ত, পূর্ব বাংলার স্বাধীন রাষ্ট্র আন্দোলন ইতিহাসকে সমর্থন করে। সেই পরিবেশ যা ১৯৪৭ এর পাকিস্তান তৈরীর মাধ্যমে চূড়ান্ত পরিনতি পেয়েছিল- মূলত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার মুসলিম সম্প্রদায়ের আতঙ্ক যে তারা হিন্দু-অধ্যুষিত স্বাধীন ভারতে বৈষম্য এবং নিপীড়ন এর শিকার হবে- তা যৌক্তিকভাবে একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দাবী তোলেনি। ১৯৪০ এর বিখ্যাত লাহোর প্রস্তাব, যেখানে উপমহাদেশ বিভাজনের ধারনায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ অটল ছিলো, বাস্তবে তাতে একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোনো দাবী করা হয়নি বরং সেক্ষেত্রে দাবী ছিলো, ‘ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলি ‘স্বাধীন রাজ্য গঠন’ করার জন্য দলভুক্ত করা উচিত’। কিন্তু, মূলত পশ্চিমা মুসলিম লীগের নেতারা বিগত বছরগুলোতে পূর্ব বাংলায় প্রচলিত প্রবল হিন্দু-বিরোধী মনোভাবকে ব্যবহার করে একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য কিছু মুষ্টিমেয় বাঙালীর আনুগত্য জয় করতে সমর্থ হয়েছিলো এবং ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন এই দাবীতে শেষপর্যন্ত সম্মত হয়।
তা সত্ত্বেও , নতুন দেশের দুই অর্ধাংশের মাঝে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও সাংস্কৃতিক আচরণে প্রবল পার্থক্য , যার এক অর্ধাংশ মধ্য-প্রাচ্য করে অনুসরন করে , অন্য অর্ধাংশ মৌলিক সংস্কৃতিতে পুরোপুরি ভারতীয় এবং উৎসাহিত যেমনটা বিখ্যাত মুসলিমদের সাহিত্যের জন্য হিন্দু বাঙ্গালী কবি রবীন্দ্রনাথ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে ইসলামের শক্তিতে দ্রুতই তাদের মাঝে একই পরিচয়ের ধারনা গড়ে উঠেছিল এবং তারা খুব দুঃখজনক ভুল এর দিকে চালিত হয়েছেন- একথা বুঝতে প্রাচ্যের নেতাদের খুব বেশী সময় প্রয়োজন হয়নি।
নবগঠিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনিতে পশ্চিমাদের প্রাধান্যের সাথে পূর্ব বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রশাসকদের স্বল্পতা (যা মূলত বিভাজনের সময় দেশান্তরী হিন্দুদের জন্য ঘটে) মিলিয়ে স্বাধীনতার পর পরই পূর্ব অঞ্চলে রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তার করতে পশ্চিম পাকিস্তানীরা সক্ষম হয় এবং এই অবস্থা এই বছরের শুরু পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিলো। ১৯৪৭ থেকে শুধু মাত্র কেন্দ্রীয় সরকারই পশ্চিমা অধ্যুষিত ছিলো না , বরং একই অবস্থা পূর্ব বাংলার সরকারী চাকুরীতেও বহুলাংশে সত্য ছিলো এবং এটা এ সত্ত্বেও হয়েছিলো যে পূর্ব অঞ্চলে জনসংখ্যা ৭৫ মিলিয়ন এবং পশ্চিম অঞ্চলে জনসংখ্যা মাত্র ৫৮ মিলিয়ন।
ফলাফলস্বরূপ দুই অর্ধাংশের মাঝে অর্থনৈতিক ভারসাম্যের ব্যাপক স্থানান্তর হয়। পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানীকৃত কাঁচামাল, বিশেষত পাঁট, ‌ থেকে পাওয়া বৈদেশিক মূদ্রা ব্যবহার করা হয়েছে পশ্চিমের জন্য কাঁচামাল ও ভোগ্যপন্য ক্রয় করতে এবং পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋনের প্রায় ৭০%-ই পশ্চিমে ব্যয় হয়। একারনবশত, পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নতি তরান্বিত হয়েছে এবং পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং রাজনৈতিক অধীনতার ধারনার সাথে অর্থনৈতিক দারিদ্র্যতার তীক্ষ্ণ ধারনাও মিশে গেছে।
তৃতীয়ত, স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ সব ধরনের কার্যকারিতার দাবী পূরণ করবে। বিগত কয়েক মাসের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে দেশটির অবশ্যই খুব ভালো পরিমানের আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন হবে। কিন্তু ভবিষ্যতে দেশটি পাঁট এবং চা রফতানির থেকে আয় করা বৈদেশিক অর্থে তার প্রয়োজনীয় চাহিদার বড় অংশ পূরন করতে সমর্থ হবে। ভারতের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি করলে তারা স্পষ্টত লাভবান হবে, এই বাণিজ্য পূর্ব ওপ শ্চিম পাকিস্তানের ভেতরকার বাণিজ্যের চেয়ে অনেক বেশী অনুকূল শর্তে হবে। এবং সমগোত্রীয় সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ যুক্তি হলো পূর্ব পাকিস্তানে কোনো আন্দোলন সুসংগঠিত হবে যা বিচ্ছিনতাবাদী আন্দোলনে দখলকৃত অন্য প্রায় সকল এলাকার মতো নয়। কেননা আজকের অপাকিস্তানের পশ্চিমা এবং পুর্বের অংশদুটো প্রায় ১০০০ মাইল দূরত্বে অবস্থিত, তাই নতুন বিভাজনের রেখা কোথায় হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বায়াফ্রার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পরিস্থিতি থেকে এক্ষেত্রে এটি স্পষ্টত বিপরীত।
পঞ্চমত, পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদের সফলতা আন্তর্জাতিকভাবে বিপর্যয়মূলক হবে না। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে এটি হবে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভৌগলিক সীমারেখা পরিবর্তন করতে সফল হয়েছে। আবার বায়াফ্রার ঘটনার সাথে তুলনা করলে, এটি অন্য কোনো স্থানের সুপ্ত বিচ্ছিন্নতাবাদকে জাগিয়ে তুলবে- এমন সম্ভবনা কিন্তু খুব বেশী নয়। এটা অংশত একারনে যে আফ্রিকার তুলনায় এশিয়াতে রাজনৈতিক সীমারেখা, নৈতিক এবং সাংস্কৃতিক রূপরেখার সাথে বেশী সংগতিপূর্ণ হয়। এবং এটাও যে, বিচ্ছিনতার আন্দোলন হতে পারে এমন নতুন স্বাধীন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের আন্দোলন মৌলিক, এমন অঞ্চলের ক্ষেত্রে যেখানে যা তার ‘মাতৃ-দেশ’ থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। সকল ধরনের গুরুত্ব বিবেচনায় এটা আসলে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী আন্দোলন (ইউরোপিয়ান শক্তির বিরুদ্ধে নয়- তা ব্যতিত)।
ষষ্ঠত, বাংলাদেশ যদি শুধু মাত্র একটি গেরিলা ধারনা হিশেবেই রয়ে না যায় তাহলে তুলনামূলক ভারতের অস্থিতিশীল পরিণতি আরও সীমিত মাত্রার হবে। সার্বভৌম বাংলাদেশের সফল বাস্তবায়ন এর কারনে অনেক পশ্চিম এর বাঙালিই আশা করবে যে বৃহত্তর বাংলা গঠনের জন্য একদিন তাদের প্রদেশও বাঙ্গালদেশের সাথে একীভূত হবে। কিন্তু পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসঃ এবং মিলিয়ন সংখ্যক পশ্চিম বাঙালি ভারতের অন্যান্য প্রদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাতে করে ভারত থেকে পশ্চিম বাংলার বিচ্ছিন্ন হবার আন্দোলন হওয়াটা খুবই অসম্ভব।
এমন কি বাংলাদেশেই বৃহত্তর বাংলার জন্য কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের কোনো চেষ্টা নেই। বাংলার উপর কলকাতার কর্তৃত্বের বিরোধীতা পূর্ববাংলার জাতীয়তাবাদের ভিত্তির শেকড় এবং কাছাকাছি সংকৃতি ও অর্থনীতি সত্ত্বেও একথা বিশ্বাস করার কোনো কারন নেই যে নিজেদের জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য অসংখ্য জীবন বিসর্জন দেওয়া ৭৫ মিলিয়ন বাংলাদেশী তাদের দেশকে পশ্চিম বাংলার সাথে একীভূত করার ইচ্ছেপোষন করবে। এটাও উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর একটি যাদের জাতীয়তাবাদ তাদের জাতীয় পতাকায় ভৌগলিকভাবে চিহ্নিত করে দেওয়া আছে।
বিপরিত দিকে, বর্তমান পরিস্থিতি ভারতের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকীস্বরূপ। শরণার্থীরা শুধু ভারতের অর্থনৈতিক সম্পদের জন্য ভারী বোঝাই নয়, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একই সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবেও তারা উদ্বেগের কারন। এবং এটা মনে করা হাস্যকর যে তাদের মধ্যকার খুব উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ঘরে ফিরে যাবে যখন কি না পাকিস্তান সামরিক বাহিনী সেখানে অবস্থান করছে। তাই যতক্ষন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারনাটুকু বাঙালির উপর পাকিস্তানিদের অত্যাচারের[ যেহেতু হিন্দুরা বিশেষভাবে এই অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন] কারনে চালিত হচ্ছে , এটা খুব সম্ভবপর নয় যে মিসেস গান্ধীর সরকার তাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলোতে মনোযোগী হতে পারবেন যার জন্য নির্বাচনে তাদের সাপ্রতিক বিজয় অর্জিত হয়েছিলো।

পরিশেষে, শাসনতান্ত্রিক কারনে পাওয়া অর্থনৈতিক সুবিধার ব্যাপারটি বিবেচনা না করলে, বিদ্রোহী-পূর্বাঞ্চলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তা নিশ্চিত ভাবেই পাকিস্তানের নিজের জন্যও ভালো হবে। এটা শুধু মাত্র একারনেই নয় যে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে চালানো দীর্ঘমেয়াদী সামরিক অভিযানের খরচ তাদের বহন করতে হবে না, বরং এটাও যে এতোদিন ধরে পাকিস্তানের চেয়ে নতুন খন্ডিত দেশে স্থিতিশীলতা রক্ষা করা উল্লেখযোগ্যভাবে সহজতর হবে।
এটা সত্য যে, যেকোনো ধরনের উপায়েই বাংলাদেষের স্বাধীনতা অর্জিত হোক না কেন, এটি ভারতের বিপরীতে পাকিস্তানের অবস্থানকে দূর্বল করবে। কিন্তু খন্ডিত দেশটি অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটি হুমকী হবে না, যে কারনে তারা তাদের সামরিক বাহিনীর শক্তির উপর নির্ভর করতে পারে। এবং বর্তমান সময়ে পাকিস্তান অবশ্যই ভারতের সাথে তাদের মুখোমুখি অবস্থানে কিছুটা নমনীয় হতে পারে। কেননা প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পিকিং সফরের ঘোষণা এইসম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সুবিধা এনে দিয়েছে।

বিশ্ববাসীর করনীয়ঃ
সত্যি বলতে বাংলাদেশের হাতে কোনো বিকল্প নেই। এর ভবিষ্যৎ ভাগ্য ভিয়েতনামের মতোই, দেশের মাঝে নির্বিচারে হত্যাকান্ডের মাধ্যমে শৃঙ্খলা বজায় রাখার অসম্ভব এক প্রচেষ্টা যেখানে হয়ত মাত্র একজন যোগ্য নেতা আছেন যিনি সরকারি কর্তৃত্বের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে নিজের সাথে আপোষ করতে বাধ্য হবেন। বৃহৎ শক্তি শান্তি রক্ষার চেষ্টায় থাকা অবস্থায় , পাঁচ থেকে দোষ বছরের সহিংসতার পরে কি এই প্রচেষ্টা বন্ধ হবে? বহির্বিশ্ব ইয়াহিয়ার উপর চাপ প্রয়োগ করলে এখনই এই অবিবেচনাপূর্ণ সহিংসতা সত্যিই এড়ানো যায়।
ইয়াহিয়া সরকারকে আন্তর্জাতিক ভাবে চাপ দেওয়া হলে তা পূর্ব বাংলা থেকে তাদের প্রত্যাহারের ক্ষেত্রেও ফলপ্রসু হবে। পূর্ব বাংলার অর্থনীতি ধ্বসে পড়ায় এবং সামরিক বাহিনীর শিবিরে বড় ধরনের রসদ প্রয়োজন হওয়ায় ইসলামাবাদ সরকারের এখন বহির্বিশ্ব থেকে জরূরীভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। এমন সহায়তা যদি অনবরত প্রত্যাখ্যান করা হয়, ইসলামাবাদ হয়ত পূর্বাঞ্চল ছেড়ে আসতে বাধ্য হবে।
পশ্চিমা বিশ্বের এমন চাপের মুখে ইসলামাবাদ সরকারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত বিরোধপূর্ণ হতে পারে, এমনও কি পাকিস্তানের সাথে চীনের আরও বেশী ঘনিষ্ট সমঝোতার হুমকীও এতে থাকতে পারে। কিন্তু বর্তমান সময়ের চেয়েও বেশী যে সহায়তা চীন দিতে পারে তা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। অন্ততপক্ষে ইয়াহিয়া খানের জন্য এই পশ্চিমা-অপমান চীনের প্রভাবকে আরও বিস্তৃত করে তুলবে, এটাই সম্ভব্য যে বাংলা দেশে এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মাঝে লম্বা সময় ধরে যুদ্ধ চললে তাতে পিকিং যথেষ্ট সুবিধা পাবে, এতোটাই যে এটি বাংলাদেশের ধারনাকে আরও বিচ্চিন্নতাবাদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যে কারনেই হোক ইয়াহিয়া গোষ্ঠীর সামাজিক চরিত্রই সেই সীমারেখা টেনে দেবে যতটুকু পর্যন্ত পিকিং পশ্চিম পাকিস্তানকে সমর্থন করতে পারে। এটির সম্ভাবনা কম যে, যখন পূর্বে প্রভাব বিস্তার আরও আকর্ষনীয় হয়ে উঠব, তখন জেনারেল, জমিদার, আমলা এবং বিত্তবান-অধ্যুষিত শাসনের জন্য তারা অতি-উৎসাহী হবে ।

সম্ভবত খুব শীঘ্রই ইসলামাবাদ সরকারকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করা যেতে পারে, যদি বৈশ্বিক মতের চাপ অব্যাহত থাকে এবং ইয়াহিয়ার ধামাচাপা দেওয়ার ব্যবস্থার জন্য এটি বিচ্ছিন্নভাবে সংশয়ী হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা দীর্ঘদিন ধরেই জানেন যে তাদের শাসন পূর্ব অঞ্চলে ঘৃনিত হয়ে আসছে। অনিচ্ছুক বাঙ্গালীদেরকে তাদের নিজেদের রাস্তায় যেতে দেওয়াই যৌক্তিক- এমন ধারনা কোনো ভাবেই খুব নতুন কিছু নয়।
এবং এ ব্যাপারে পূর্ব দৃষ্টান্তও আছে। প্রায় একই পরিস্থিতিতে ১৯৪৯ সালে ডাচ-রা ইন্দোনেশিয়ার উপর থেকে তাদের নিয়ন্ত্রন ছেড়ে দেয়। ১৯৪৮ এর ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়া রিপাবলিকের বিরুদ্ধে তারা আক্রমনের বেপরোয়া চেষ্টা চালায়। পরবর্তিতে মার্চে র ভেতরই এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে তারা ইন্দোনেশিয়ান জাতীয়তাবাদীদের মনোবল ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এরপর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ গেরিলাদের বিপক্ষে দীর্ঘসময় ব্যাপি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে জাতিসংঘ প্রভাবিত করে। দশ বছর পর ফ্রান্স নিজেদের আলজেরিয়া থেকে প্রত্যাহার করে নেয় যখন এটা স্পষ্ট হয় যে তাদের সামরিক বাহিনী কখনোই আলজেরীয় জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে জিততে পারবে না যদিও এক মিলিয়ন মানুষ সেখানে বসবাস করে এবং আলজেরিয়া ফ্রান্সের একটি অংশ ছিলো- এমন বিতর্ক দীর্ঘদিন চলে আসছে। এবং আজকাল ইন্দো-চায়নাতে অ্যামেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে যেমন ভাবে নিজেদের আত্মঅহংকার সংবরণ করতে হচ্ছে- এমন উপমা দেখতে পাওয়া খুব বেশি বিরল নয় ।
ইয়াহিয়ার সরকারকে প্রভাবিত করতে আন্তর্জাতিক চাপ ফলপ্রসু হতে পারে, বিশেষত যদি এটি পূর্বাঞ্চল ত্যাগ করার জন্য চাপ হয়। কিন্তু এটি বলা মিথ্যে হবে না যে, পূর্বাঞ্চলে গনতন্ত্রের পুনঃস্থাপন এবং গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকেপরামর্শপ দেওয়া এখনই বহির্বিশ্বের জন্য সম্ভব না। তাহলে হয়ত ঘটনা আরও ধামা চাপা দেওয়ার প্রবনতার দিকে যাবে।
কঠিন সত্য এটাই যে, পূর্ব বাঙলায় মার্চ ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে ইসলামাবাদ সরকারের মত দূর্বল অবস্থানে থাকা সরকারের জন্য একমাত্র বিকল্প হলো বর্তমান সময়ের মত আরও বেশী দমন নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়া এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্রকরণ।
বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র
৪১৮ সেনওয়ার্ড স্কয়ার, এস ই
ওয়াশিংটন ডিসি ২০০০৩
(২০২)৪৭-১৯৪