শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে লিখিত খোলা চিঠি | ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস কালচারাল অরগানাইজেশান | আগস্ট, ১৯৭১ |
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রতি খোলা চিঠি
ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস কালচারাল অরগানাইজেশান
আগস্টের চার তারিখের বক্তব্যে আপনি পাকিস্তানে সহায়তা প্রেরণ অব্যাহত রাখা সমর্থন করেছেন, সাম্প্রতিক বক্তব্যের বিরুদ্ধে নিম্নসভার সিদ্ধান্তকে গ্রাহ্য করেননি এবং পাকিস্তানি কূটনীতিকদের যারা কিনা ইসলামাবাদ সামরিক জান্তার ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের প্রতি ঘৃণা জানিয়ে সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন জোরালো প্রতিবাদকে আমলে নেননি, এমনকি এইদেশে ও বিশ্বজুড়ে নৈতিক গণ বিক্ষোভের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
এই বিষয়ে প্রশাসনের ঋজু অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, আপনি পাকিস্তানীদের সাহায্য প্রদানের সপক্ষে আপনার বক্তব্যের একজন সমর্থক দাড় করাতে পারেননি, এমনকি আপনার নিজের দলের পক্ষ থেকেও গতদিন বৈদেশিক সাহায্য বিল সংক্রান্ত আলোচনায় এই সহায়তা বন্ধের প্রস্তাব উথাপন করা হয়েছে। এই অসমর্থিত সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখা কি এটাই অনুমোদন করে যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্যকে অগ্রাহ্য করে শাসন বিভাগ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে অপ্রীতিকর কাজ সম্পাদন করছে?
আইন পরিষদের আপিলের প্রেক্ষিতে এই বিষয়ে সবাই অবগত হলেও চলুন আমরা ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবনের চেষ্টা করি। কোনভাবেই এটি কোন সাধারণ বিষয় নয় যেটি আপনার বক্তব্যে উঠে এসেছে এমনকি মিস্টার কিসিংঞ্জারের প্রখর প্রজ্ঞার উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।আমেরিকা এবং বিশ্বের বিবেক পূর্ব বাংলার নারকীয় অত্যাচারে পদদলিত হয়েছে এবং এই মামলার জন্য উন্মুক্ত আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। অসংখ্য পরিবারের এই সংকটজনক অবস্থায় চোখ বুঝে থাকা ও সবার অলক্ষে নিষ্ঠুর অঞ্চলে অস্ত্রবাহী জাহাজ প্রেরণ আমলাতান্ত্রিক ভুল সিদ্ধান্ত ও চরম অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়।
বিপুল নৈতিকতার দায় ছাড়াও, আপনি বক্তব্যে বলেছেন এই সাহায্য প্রত্যাহার করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের রিফিউজি সমস্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করবে, জাতিসংঘের সাথে পাকিস্তানের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে,’ এবং বর্তমানে এটি খাদ্য সরবরাহের কাজে নিয়োজিত থাকবে, এবং পাকিস্তানের প্রতি এই আনুকূল্য ‘ভারতীয় উপমহাদেশের সংগঠিত ঘটনাবলীকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে কাজ করবে’ যা কিনা প্রতারণাপূর্ণ।
পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক সমস্যার স্থায়ী মিমাংসা পাশ কাটিয়ে রিফিউজি সমস্যা নিরসনের কোনমতেই সম্ভব নয়। এবং কোন রাজনৈতিক ফয়সালা সম্ভব নয় যেখানে এই সত্য অস্বীকার করা হয়েছে যে, মনস্তাত্ত্বিক, নৈতিক, বাস্তবিকভাবে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানীদের গণহত্যা, স্বৈরাচার এবং নিপীড়নকে সহ্য করে তথাকথিত স্থুল বানোয়াট ঐক্য বজায় রাখবে। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণ দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির ধারক যারা হাজার মাইল দূরে বিভক্ত এবং সেই বিভেদ অকল্পনীয়ভাবে বেড়েই চলেছে!
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ১৭ এপ্রিল “বিশ্বের মানুষের প্রতি” নিবেদনে বলেন, পাকিস্তান এখন মৃত এবং অসংখ্য লাশের স্তূপে চাপা পড়েছে। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের মধ্যে অমোচনীয় দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। পূর্বপরিকল্পিতভাবে গণহত্যার সূচনা করে ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের কবর খুঁড়েছেন। তার ০১১ নির্দেশেই পেশাদার খুনিরা ‘জাতির ঐক্য রক্ষার নৃশংসভাবে মানুষ হত্যার বৈধতা পেয়েছে। তাদের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও হিংস্র কর্মকাণ্ডে মানবতার লেশমাত্র ছিল না। পেশাদার সৈন্যরা উপরের মহলের আদেশ পেয়ে মিলিটারি নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে সভ্যতার ইতিহাসের চরম পাশবিকতার সাথে শিকারি পশুর মত খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং ধ্বংসে নিয়োজিত হয়। তাদের এই কর্মকাণ্ডের ফলে বোঝা যায় যে দুইটি ভিন্ন রাষ্ট্রের চিন্তা ইয়াহিয়া ও তার দোসরদের মনের গভীরে প্রোথিত ছিল, কেননা নিজের দেশের মানুষের প্রতি কেউ কখনই এরকম নির্মম আচরণ করতে পারে না।
জনাব প্রেসিডেন্ট, আপনি কি দেখতে পারছেন না নৈতিকভাবে এই ভাবনা বা ধারণা কতটা ভোঁতা যে, এতকিছু সহ্য করেও জনগণ পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে এবং নিজেদের হিংস্র পশুদের দয়ার উপর ভরসা করবে যারা কিনা নিষ্ঠুর, নির্দয়ভাবে তাদেরকে নিপীড়ন করেছে?এই অরাজকতার রাজত্বের সাড়ে চার মাস গত হয়েছে, আক্রান্ত পক্ষের কূটনীতিকরা আমাদের সকলের চেয়ে ভালোভাবে সামগ্রিক ঘটনাবলীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়ে ঘোষণা করেছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সামরিক বা অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রশ্নই আসে না। এই সহযোগিতাই এই গণহত্যাকে বৈধতা প্রদান করে।
প্যাত্রিক হেনরির, ‘আমাকে হয় স্বাধীনতা দাও, নয় মৃত্যু’শুনে যারা বড় হয়েছি তাদের জন্য এটি মেনে নেওয়া খুব কঠিন যারা নিজের চোখে বাবা-ভাইকে হত্যা হতে দেখেছে, বোনকে গণধর্ষিত, ঘরবাড়ি জ্বালানো, কলকারখানা, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তাদের নেতাদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে হত্যা করা হয়েছে, এই দুঃশাসন থেকে তারা মৃত্যুবরণকে শ্রেয় গণ্য করবেন। জাতিসংঘের কতিপয় পর্যবেক্ষকরা কি সেগুলো দেখেছেন? এরকম ভয়ঙ্কর শাসনের অধীনে যেতে বলার দুঃসাহস আপনার হবে তো?
আমেরিকার সামরিক বাহিনীর সহযোগীর বিরুদ্ধে কি কিছুই করা হবে না যতই তারা অকথ্য নির্যাতন করুক? আপনি বলেছেন, ‘আমরা পাকিস্তানের সরকারের উপর কোন চাপ প্রদান করব না। (এর মানে কি আপনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, আপনি বাংলাদেশকে চিনেন এবং অবচেতনভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারকে স্বীকার করে নিয়েছেন?) আপনি আরও বলেছেন, ‘তাহলে সেটি হিতে বিপরীত হবে। এই বিষয়ে আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনা করতে হবে।’
এই দোসরদের কর্তৃক হাজার হাজার মানুষ হত্যা, মানবতার চরম অবমাননা স্বত্বেও আপনারা সকল ধরনের দায়-দায়িত্ব সচেতনভাবে এড়িয়ে যাবেন? এভাবে বিচার করলে, চায়না সমর্থন লাভ করতে পারে, আমাদের বদলে বন্ধু হিসেবে তাদের নিকট ট্যাঙ্ক, জেট, অগ্নি প্রক্ষেপক, মেশিনগান ইত্যাদি আনুগত্য লাভের জন্য কাজে লাগানো হতে পারে যার মাধ্যমে কমুনিজমের অবাধ প্রবাহ প্রতিহত করা সম্ভব হবে!
আপনি কি গণহত্যা বন্ধের জন্য আপনার প্রভাবকে আসলেই কাজে লাগিয়েছেন আপনার কথিত ‘ব্যক্তিগত পর্যায়ে’ যেমনটি আপনি চার মাস পূর্বে উল্লেখ করেছিলেন? যদি করে থাকেন, তাহলে বুঝতেই পারছেন আপনার মনোনীত পন্থাটি কতটা কার্যকরী! এটি কল্পনা করাও কঠিন যে ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান কর্তৃক মানবতার বিরুদ্ধে কত অসংখ্য অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। এর চেয়ে খারাপ শাসন আর কি হতে পারে? আপনি বরং প্রভাব বিস্তারের জন্য ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করুন জনাব নিক্সন,
যদি না করেন, তাহলে আপনার বৈদেশিক নীতির অসাধারণ নৈতিক ও মানবিক তাৎপর্য থাকলেও বাংলাদেশের সাথে ভুল সম্পর্ক স্থাপিত হবে। এছাড়াও অভিনব শান্তি প্রণেতা হিসেবে স্মরণীয় হওয়ার স্বপ্নের কি হবে? বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বৈদেশিক নীতিকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখার সময় কি হয়নি? এখন কি সময় নয় পেশাদার শক্তির রাজনীতির ময়দানে ঘুঁটি উল্টানোর? আত্ম অহমিকায় অন্ধ হওয়া বিশ্বশান্তির পক্ষে অন্তরায়। পেন্টাগন পেপার উন্মোচন করেছে যে, যথাসময়ে নীতিনির্ধারক যারা মানুষের জীবন ও ভাগ্য নিয়ে পরিকল্পনা করে তাদের সতর্ক করা হলে সেই বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা যেত। তাদের চাতুর্যপূর্ণ পদস্থলনে কতইনা ভাল হত! অধিকাংশ সময়ই তারা এতই জ্ঞানী, তথ্যসমৃদ্ধ যে প্রজ্ঞার জন্য তাদের ঘাটতি থেকে যায়। এই কারনেই মগজ ধোলাইকারিদের মানুষ অবিশ্বাস করে।
জনতার সম্মতিই একমাত্র একটি সরকারের অস্তিত্বকে বৈধতা প্রদান করে। এই হিসেবে ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, তাদের বাহিনী এবং সাঙ্গপাঙ্গরা পূর্ব বাংলায় থাকার বৈধতা হারিয়েছে। মি প্রেসিডেন্ট, আপনি যদি অবিশ্বাস্যভাবে সন্ত্রাসের এই রাজত্ব কায়েমের বিরুদ্ধে একটি শব্দও জনতার সম্মুখে উচ্চারণ না করেন বরং উল্টো প্রতিরক্ষা ও আক্রমণের মাধ্যমে ঐক্য বজায় রাখতে চান, কংগ্রেসের সমালোচনা স্বত্বেও তখন সঙ্কটের সময় আস্থার ঘাটতি দেখা দেয়। আমাদের নতুন ১৮-২৫ বয়সি ভোটাররা কি ভাববে এব্যাপারে?
এখন আসুন ইয়াহিয়া খানের অসাধারণ ঘোষণায়, যেখানে তিনি বিশ্বের কাছে বলেন আওয়ামী লীগ ও তাদের অনুসারীদের হাতে ১০০,০০০ বাঙ্গালী নিহত হওয়ার দরুন তিনি মার্শাল আইন জারি করতে বাধ্য হয়েছেন যাতে করে এই রক্তাক্ত অভ্যুথানের অবসান ঘটে! এই বিশাল মিথ্যার কারণ খুবই সরল। যেখানে বিদেশি এবং পাকিস্তানী সাংবাদিকরা পঁচিশে মার্চের রাতের পর থেকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের রিপোর্ট করতে ব্যর্থ হন, সেখানে ইয়াহিয়া খান নিজেই কিভাবে সে গল্প বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন, প্রতিবার উপস্থিত থেকে, সেই দিনের পূর্ব পর্যন্ত, আওয়ামীলীগের শেখ মুজিবুর রহমানের আলোচনা চলাকালীন জনসমক্ষে তিনি ‘পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন? আমরা এখন জানি যে, ইয়াহিয়ার আলোচনা চালানোর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যে সেনাবাহিনীকে গণহত্যার জন্য প্রস্তুতির সময়ক্ষেপণ করা, অথচ সম্প্রতিই পাকিস্তানআনুষ্ঠানিকভাবে মানবাধিকার রক্ষার সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে!
একটি শঠতার কথা প্রচলিত আছে যে পাকিস্তান দুইবার(১৯৪৭ এবং ১৯৬৫) আত্মরক্ষার খাতিরে আক্রমণ করেছে, বিশেষ করে কম্যুনিস্ট আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে। এরকম সহযোগী কি আমেরিকা কিংবা ‘মুক্ত বিশ্বের’ নিরাপত্তার জন্য কোন অবদান রাখতে পারে? যদি মানুষ হত্যা, গণতন্ত্রে বিশ্বাসঘাতকতা, মানবতার সকল সীমা লঙ্ঘনের কোন রাজত্ব থাকলে এই সেই রাজত্ব, যেটি মি প্রেসিডেন্ট নিক্সন আপনি সমর্থন করছেন। যদি কোন শাসক দ্বারা তার নিজের জনগণ অপশাসনের শিকার হয়, তাদের রক্ষা করতে অপারগতা জানায়, স্বৈরাচারী হয়ে অত্যাচার করে তাহলেও কি ‘আমেরিকার নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য’ এই ভিত্তিতে সমর্থন করবেন?
.
নৈতিক বিষয়গুলো ছাড়াও, যদি আমরা সেনাবাহিনী এবং সিয়াটো হিসেবে গঠিত সামরিক জোট গুলোর তাদের গঠিত হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত অন্যান্য সকল উন্নতি বিবেচনা করি, তাহলে এইরকম একটি সময়ে পুনরায় এই প্রশ্নের সম্মুক্ষীন হওয়াই কি যুক্তিসংগত নয় যেঃ প্রশাসন কি শুধুমাত্র তাদের পুরানো অবস্থানের পুনরাবৃত্তি করছে? ৭,৫০,০০,০০০ বাংলাদেশি ও ৫৫,০০,০০,০০০ ভারতীয় এবং আমেরিকান ও বিশ্ব নৈতিকতার মানদন্ডের বিরোধীতার ঝুঁকি নিয়ে আপনি এর আনুগত্য পাওয়ার জন্য যে মুল্য দেবেন পাকিস্তান কি আসলেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তার যথার্থতা প্রমান করার মত গুরুত্বপুর্ণ? তাহলে এক্ষেত্রে “মানবসমাজের অভিমতের প্রতি যথাযোগ্য সন্মান” কি নির্দেশ করে? এবং যদি একজনকে রাজনৈতিক সদস্যের থেকেও বেশি কিছু হতে হয় তাহলে এরকম পরিস্থিতিতে একজনের প্রতিজ্ঞার প্রতি যে বিশ্বাস এবং একজন খৃস্টান হিসেবে যে মান বজায় রাখাতে হয় তা কি নির্দেশ করে?
আর একটি গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। আপনি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উভয়ই আমাদেরকে এই আভাস দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে চায়না যা করবে তা আপনার ওপর ভীষন চাপ সৃষ্টির আশংকা আছে, তাই নয় কি? আপনি ধরে নিন যে যদি, উদাহরন সরূপ, অন্য কোন যুক্তিসংগত সমাধান না থাকায়, বাংলাদেশের জনগণের তাদের নিজেদের সরকার গঠন সম্ভব করতে তার সীমিত অভিপ্রায়ের ঘোষণা দিয়ে এবং লক্ষ লক্ষ হতভাগ্য শরনার্থীদের স্বাধীন ভাবে নিজের দেশে ফিরে যেতে সাহায্য করতে ভারতকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য পরিচালিত করা হত, তাহলে চীন তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
স্পষ্টতই আপনি এবং জনাব কিসিঞ্জার অন্যান্য বিষয়ে তার পান্ডিত্যপূর্ণ দক্ষতা থাকা সত্বেও পীকিং শাসনব্যাবস্থার ধরন সম্পর্কে সাধারন বিপদজনক ধারনা পোষণ করেন। এটা ব্যাপকভাবে অনুমিত যে মাও এর শাসনব্যাবস্থা রাশিয়াকে অনুসরন করে, এমনকি নির্দয় নিপীড়নের জন্য প্রস্তুতির স্ট্যালিনবাদী প্যাটার্ন, তথাপি আক্রমনেও।
কিন্তু মাও এর পন্থা নিম্নোক্তভাবে বোঝার জন্য প্রচুর দলিলপত্র আছেঃ ১৯২০ সালে তার আন্দোলনের শুরু থেকেই, চুড়ান্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লবে, এবং বর্তমান নতুন কূটনীতিতে বিশ্বের চৈতন্য আনতে, মাও তার লোকেদের পুঙ্খানুপঙ্খভাবে শিখিয়েছেন যে, একদিকে হয়ত যে শাসনব্যাবস্থার বিরোধিতা তারা করে তাদেরকে সেই শাসনব্যাবস্থার মোকাবেলা করতে হবে, তা সেটা যতই একটি সাময়িক কৌশলের ব্যাপার হোক না কেন, অপরদিকে “যে-ই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে বা বিপ্লব ঘটায় তার বহিঃসমর্থন থাকে” যেমনটা ১লা আগস্ট সামরিক দিবসে পীকিংয়ের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে।
সংগ্রামী জনতার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য কমিউনিস্ট চীনের একটি বিশাল ইতিহাস আছে, কিন্তু সেটা হয়েছে যখন নিজের সীমান্ত হুমকির সম্মুখীন এটা বোঝার পর তার উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশ এবং পরবর্তীতে ভারতের সাথে তার সীমান্তে কিছু বিতর্কিত এলাকায় দখল নেওয়ার পরেও অনেকটা আক্রমনাত্মক পদক্ষেপের মাধ্যমে। পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশ জটিলতায় তার আচরন বিবেচনা করলে, যখন চীন বস্তুত ভারতকে “পূর্ব বাংলা থেকে সরে দাড়ানোর” জন্য হুমকি দিচ্ছে, এই অবস্থায় ভারতের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন করে, তিনি আদর্শিক, নৈতিক, রাজনৈতিক আত্মঘাত ছাড়া একটি অধিকার পরিপন্থি উদ্ধত শাসনব্যাবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে খুব বেশি দূর যেতে পারবে না। আমাদের এখন প্রয়োজন দক্ষিন এশিয়া উপমহাদেশর চীনা আক্রমনকে ভয় না পাওয়া। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মাও এর কৌশলগত অবস্থানের অর্থ হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশকে মুক্ত করা থেকে ভারতকে যুদ্ধে প্রতিহত করতে চান, যাতে শুধুমাত্র পূর্ব বাংলা নয় পশ্চিম বাংলাও মরিয়া হয়ে ওঠে এবং আর একটি ভিয়েতনামে পরিনত হয় যার জন্য ক্ষেত্র তৈরী আছে, যেমনটা “ চীনের কৌশল, একটি নতুন ভিয়েতনাম” এ লেখক চিত্রিত করেছেন।
যখন বাংলাদেশে সেই মরিয়া অবস্থা আসবে, এবং পাকিস্তানের অনুকূলে ওয়াশিংটনের অবস্থান এবং দিল্লির মারাত্মকভাবে বাংলাদেশ পলিসিকে বিলম্বিত করন সরাসরি এতে অবদান রাখবে- বিশৃঙ্খলাকে নিজেদের কাজে লাগাতে ওস্তাদ পশ্চিম বাংলার সুসজ্জিত ও শক্তিশালী প্রো-চায়না কমিউনিস্ট এবং “উত্তরপূর্ব আগ্নেয়গিরির” অন্যান্য অংশগুলো দেখবে যে কমিউনিস্ট চীন যেভাবে ভিয়েতনাম সংগ্রামকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে সেভাবে তাদেরকেও সহায়তা করছে, এবং মাও তখন ইয়াহিয়া ও তার সংগঠনকে ত্যাগ করবে।
এখনকার জন্য এটা যথেষ্ট, কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনার এবং জনাব কিসিঞ্জারের উচিত ছিল চীন সংক্রান্ত বিষয়াবলি আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করা এবং বোঝা যে আপনারা ভুল পথে আছেন, দক্ষিন এশিয়ার দাবা খেলায় আপনি নিঃসন্দেহে ভুল ঘোড়াকে বাচানোর চেষ্টা করছেন। হেনরির কাছে পীকিং এর একটি “উত্থানের” মূল্য কতখানি? যদি আপনার বর্তমান কার্যকলাপের মাধ্যমে আপনি বাংলাদেশের ব্যাপারটিকে দূর্বল করে দেন এবং দক্ষিন এশিয়ার আরো এক চতুর্থাংশ মানুষকে হুমকির মুখে ফেলে, চীনকে একটি নতুন ও আরো অবনত ভিয়েতনামকে উৎসাহ ও সমর্থন প্রদানে প্রলুব্ধ করেন, সেটা কি আমাদের বিশ্ব পরিবারে জাতিসংঘের একটি দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে প্রকৃত চায়নাকে দেখার প্রত্যাশাকে ভীষনভাবে ব্যাহত করে না?
ভারতের বাংলাদেশকে উদ্ধার করতে যাওয়াকে যুক্তিযুক্ত করার জন্য তিনি বাংলাদেশি জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী শাসনের, যারা বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জাতি গঠন করবে তাদের ভয়াবহ ও ব্যাপক আগ্রাসনের প্রতি মারাত্মকভাবে দেরি করার পর একেবারে শেষে সাড়া দেবেনঃ ভারতের বিরুদ্ধেও আগ্রাসন, ঐতিহাসিকভাবে একটি সাধারন সীমানা লঙ্ঘন বা যুদ্ধের অন্যান্য গ্রহনযোগ্য কারনগুলোর বেশিরভাবের থেকে অনেক বেশি গুরুতর। সর্বোপরি এই ইচ্ছাকৃত গণহত্যার আগ্রাসন সভ্যতা, শালীনতা এবং মানবতা ও বিশ্বাসযোগ্য মানব সম্পর্কের চাদরে একটি ভয়াবহ আক্রমনে পরিনত হয়েছে, বর্বর অবস্থার থেকেও একটি খারাপ অবস্থায় প্রত্যাবর্তন।
হাম্পটি ডাম্পটি(একটি রুপকথার চরিত্র, এখানে ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহৃত) যা কিনা পাকিস্তান- দুইটি ভিন্ন জাতির জন্য অদ্ভুত রাজনৈতিক কৌশল, হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত এবং শুধুমাত্র একই ধর্মের কারনে একত্রীত বলে অনুমিত, একটি সম্পর্ক যা ৭৫০০০০০০ কোটির সংখ্যাগরিষ্ট পূর্ব পাকিস্তানকে বৃটিশ অধীনাধীন থাকা অবস্থার থেকেও নিম্ন ওপনিবেশিক মর্যাদা দিয়েছে, এটা হাম্পটি ডাম্পটিকে আবার জোড়া দিয়েছে- এমনকি পেন্টাগণ ও রাষ্ট্রীয় বিভাগের সাহায্য ছাড়াই।
না, আপনি রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না করে শরনার্থী বা সাহায্যের সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। এটা মূলত কঠিন সত্য যা থেকে প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কত্বকে একটি নতুন নীতির রূপ লাভ করতে হবে।
জ়ে হোমেস স্মিথ
আন্তর্জাতিক ছাত্র সাংস্কৃতিক সংগঠন
কক্ষ নং ৪১১ এস্কেল হল
পশ্চিম ৬০৫, ১১৫নং সড়ক
নিউ ইয়র্ক। নিউ ইয়র্ক ১০০২৫