শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
শরণার্থী সমস্যার ওপর ডঃ কার্ল ই. টেইলর এর প্রতিবাদ | ডঃ কার্ল ই. টেইলর | জুলাই, ১৯৭১ |
ডঃ উইলিয়াম গ্রিনফের প্রস্তাবে আমি আমার সাম্প্রতিক ভারত সফরের উপর একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিখছি যা আমাদের গবেষণা প্রকল্পের সাথে সম্পর্কযুক্ত।আমি ভারতে জন্মগ্রহণ করেছি এবং জীবনের প্রায় অধিকাংশ সময় সেখানকার বিভিন্ন গ্রামে গবেষণা,শিক্ষাদান সহ সেবামূলক কর্মকান্ডে নিয়োজিত ছিলাম।এই সফরে আমি খুব সহজেই বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ ও সুদূরপ্রসারী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম।
এখন আমরা ‘আমেরিকা বিরোধী’ বিরোধীতার যে তীব্রতা তৈরি করতে পেরেছি তা আমি আগে কখনো দেখি নি।এমনকি উচ্চ কর্মকর্তারাও স্বাভাবিকের চেয়েও সংবেদনশীল আচরণ করছেন যাতে বিদ্যমান বিস্ফোরক পরিস্থিতি আরও তীব্র না হয়।আন্তর্জাতিক ঔদাসীন্য ও ভুল বুঝাবুঝির জন্য জনগণ ও সদের কাছ থেকে প্রাপ্ত বাধা ও অব্যাহত চাপ ভারত সরকার যেভাবে সতর্কতার সঙ্গে সামাল দিচ্ছে তা প্রশংসার দাবীদার।
এটা আমার স্ববিবেচনাপ্রসূত বিচার যে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নীতি বিপদজনক এবং অদূরদর্শী।কারণ আমরা এশিয়ার সংহতিনাশ এবং এখানে আরেকটি দীর্ঘকালীন যুদ্ধের ক্ষত সৃষ্টিতে কাজ করছি।পাকিস্তানকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহয়তা ভারতকে কিছু সামরিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে।এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ সামরিক আক্রমন করলে ভারতকে পাকিস্তান বিভক্তি তরান্বিত করার জন্য আন্তর্জাতিক নিন্দার স্বীকার হতে হত।বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিদ্বেষের পরিচয় পাওয়া যায় তাদের সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর জ্বালাও-পোড়াও এবং হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে।পাকিস্তানের শাসন নীতিই হল উদ্ভূত যে সমস্যার জন্য ভারত সরকার ও এক কোটি হিন্দুদের দোষারোপ করা।যদিও ৯৮ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়া সত্ত্বেও মুসলমান পরিচালিত দল “আওয়ামীলীগ” সরকার গঠন করতে পারে নি।আর যদি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যদি তাদের এই দোষারোপের নীতি প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয় তাহলে তা পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশকে বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করার অন্যতম নিয়ামক হবে।ভারত সরকারও যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিচ্ছে।তারা প্রত্যক্ষ সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রলুদ্ধ নয় বরং বিদ্যমান অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরোক্ষ উপায় অবলম্বন করতে আগ্রহী।জরিপ অনুযায়ী শরনার্থী শিবিরের অধিকাংশই বৃদ্ধ,নারী ও শিশু। দীর্ঘায়িত গেরিলা যুদ্ধ ক্রমশ তার তাৎপর্য হারাচ্ছে।পাকিস্তানের প্রতি চীনের অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রও একসময় অচল সামরিক শাসনব্যবস্থার চেয়ে বরং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন জানাতে পারে।
দিল্লীর বিক্ষুব্ধতা যুক্তরাষ্ট্রের কপটতামূলক অবস্থানের জন্য।তারা স্পষ্ট ভাবেই জিজ্ঞাসা করে কিভাবে আমরা বন্ধ করে দিয়ে আবার অস্ত্রের চালান শুরু করলাম দুই পক্ষকে বোকা বানিয়ে।যখন ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের জন্য ৭ কোটি ডলার অনুদানের ঘোষণা এল এবং পরের দিনই দুইটি যুদ্ধোপকরণ ভর্তি জাহাজ পাঠানোর খবর ছড়িয়ে পড়েছিল; তাদের প্রতিক্রিয়া তখন ছিল “তারা কি মনে করে যে তারা আমাদের কিনে নিতে পারবে?”তারা তখন আমাদের ত্রাণের অপ্রতুলতার একটা সহজ হিসেব দিল।ভারতীয় কর্মকর্তারা হিসেব করেছিল ১^১/৪ মিলিয়ন ডলার প্রতিদিন খরচ হবে শুধু ৬ মিলিয়ন এর বেশি শরণার্থীকে খাওয়াতে।অর্থাৎ পাঁচজনের একটি পরিবারের জন্য প্রতিদিন ১ ডলার করে।যদি এখন বরাদ্দকৃত ২ কোটি এর বদলে পুরো ৭ কোটি ডলার শরণার্থীদের খাবারে খরচ করা হয়, তবুও তা মাত্র দু’মাসের কমেই শেষ হয়ে যাবে।উপরন্তু সেখানকার ভঙ্গুর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা পুনর্নির্মাণের জন্য প্রয়াস দরকার।কিছু কিছু জায়গায় গড় দৈনিক ভাতা ৩ রুপি থেকে ১ রুপিতে নেমে এসেছে।এত সমস্যার সম্মুখীন হওয়াটা একটা বিপর্যয়ের চিহ্ন বহন করে কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে একটা ক্রমশ উদ্দীপনা দানকারী অর্থনৈতিক উন্নতির অগ্রযাত্রাকেও নির্দেশ করে।
সর্বোপরি, পূর্ব পাকিস্তানের ১০ মিলিয়ন হিন্দুর উপর চালানো ভয়ানক গণহত্যা থেকেই অসন্তোষ দানা বেঁধেছে।কতদিন পর্যন্ত সরকার বিপুলসংখ্যক ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া থেকে বিরত রাখতে পারবে তা নিয়ে আসলে সন্দেহ আছে।এটাই বেশি পীড়া দেয় যে এমন একটি বেদনাদায়ক ঘটনা যেটিতে নাৎসিদের ‘ফাইনাল সল্যুশন’ এর চেয়ে বেশী মানুষ জড়িত তাতে বাকী বিশ্বের স্পষ্টত অনুভূতিহীনতা এবং ঔদাসীন্য।আমেরিকানদের বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে এবং যদি সম্ভব হয় সহয়তা করা উচিত।কিন্তু অবশ্যই সামরিক জান্তাকে সাহায্য করে উত্তেজনা বাড়ানো এবং সমস্যা দীর্ঘায়িত করে নয়।