You dont have javascript enabled! Please enable it!

ধুতি-লুঙ্গি দ্বন্দ্বসমাস ও দ্বিজাতিতত্ত্ব

গ্রামবাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পােশাক কী ছিল? প্রশ্নটির উত্তর-সন্ধানের আগেই বলে নিই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এর বিপরীতে সংখ্যালঘিষ্ঠ বলতে আমি কোনাে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কথা বােঝাতে চাইছি না। সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সাধারণভাবে যারা সাধারণ মানুষ’ বলে পরিচিত, অর্থনৈতিক বিচারে যারা বিত্তহীন ও নিম্নবিত্ত বা স্বল্পবিত্ত, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ’; এর বিপরীত অবস্থান যাদের তারাই সংখ্যালঘিষ্ঠ।
উত্তরে যদি বলি ন্যাংটি, তা হলে অনেকেই হয়তাে এটিকে ঠাট্টা বলে মনে করবেন। কিন্তু আমি মােটেই ঠাট্টা করছি না। একেবারে আক্ষরিক অর্থে যাকে ন্যাংটি বলে তা হয়তাে সংখ্যাগরিষ্ঠের সকলের পােশাক ছিল না, তবু কোমরে যেটুকু কাপড় জড়িয়ে রেখে কোনাে রকমে লজ্জা-নিবারণের ব্যবস্থা করা হতাে তাকে ন্যাংটিরই একটুখানি শােভন সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। (ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে ন্যাংটি’ শব্দটা তাে ‘লেঙ্গটা’ বা ‘লেঙ্গটি শব্দেরই উচ্চারণভেদ মাত্র। আর ‘লেঙ্গট’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃতি ‘লিঙ্গপট্ট’ থেকে, যার আভিধানিক অর্থ দাঁড়িয়েছে পুরুষের লজ্জাস্থান মাত্র আবৃত করে এমন কৌপীন বিশেষ।)।
সচেতন পরিকল্পনামাফিক তৈরি গান্ধীজীর সংক্ষিপ্ত পরিধেয় তাে ছিল একান্তই শৈল্পিক, তবু সাম্রাজ্যবাদী চার্চিল গান্ধীকে বলতেন ‘আধা-ন্যাংটা ফকির’। সে-বিচারে গ্রামবাংলার মেহনতি কৃষকদের অনকেকেই ‘সিকি ন্যাংটা’র বেশি কিছু বলা যেতাে না নিশ্চয়। ছেলেরা তাে আট/নয় বছর বয়স পর্যন্ত ন্যাংটিও পরতাে না, ন্যাংটাই থাকতাে। দ্রলােকদের রীতিনীতি ‘ছােটলােকদের কাছে সবযুগেই অনুকরণযােগ্য বিবেচিত হয় বলে, গ্রামবাংলার ‘ছােটলােকরা যে পােশাকে-আশাকে ভদ্রলােকদেরই অনুকরণ করবে, তেমনটিই তাে স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিক অনুকরণ-মূলক আচরণ থেকেই সমস্ত বাঙালি জাতির জন্যে সর্বজনমান্য না হলেও বহুজনমান্য একটা পােশাক রূপ পেয়ে যায়। সংখ্যালঘু ভদ্রলােকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটি, ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে, যে-পােশাক পরতাে তার নাম ধুতি। কালের বিবর্তনে এই ধুতিই ‘ইতর-ভদ্র’ সকল বাঙালির স্ট্যান্ডার্ড পােশাক হিসেবে মান্যতা পেয়ে যায়। প্রথমে এই ধুতির সঙ্গে ঊর্ধ্বাঙ্গ আবৃত করার জন্যে ছিল চাদর নামক অপর একটি বস্ত্রখণ্ড, পরে তার সঙ্গে এসে যুক্ত হয় পাঞ্জাবি। অনেক কাল ধরে ধুতি-পাঞ্জাবি-চাদরের কম্বিনেশনই ‘ভদ্র’ বাঙালির পরিচিতিকে ধারণ করে, এবং ‘ইতর’ সাধারণও এই পরিচ্ছদকেই জাতে ওঠার জন্যে মনে করে অপরিহার্য।
ধুতি বােধ হয় ন্যাংটিরই সাম্প্রসারিত রূপ, তাই এখনাে ন্যাংটি হচ্ছে ধুতির একান্ত অনুষঙ্গ। ধুতিটাকে কোমরে পেঁচিয়ে এর বাঁ দিকের যে-অংশটাকে সামনে থেকে পেছনে নিয়ে গুঁজে দেয়া হয়, সেটি আসলে ন্যাংটিরই ভদ্র সংস্করণ হয়ে নাম পেয়েছে কাছা (সংস্কৃত কচ্ছ’ শব্দের তদ্ভব রূপ)। কাছারই বিপরীত কেঁাচা। অর্থাৎ ধুতির ডান দিকের যে-অংশটাকে পাট করে সামনের দিকে ঝুলিয়ে দেয়া হয় তারই নাম কেঁচা। এই কেঁাচাটি তাে শুধু পাট করা কাপড় মাত্র নয়, সমাজে এটি অহংকার ও মর্যাদার প্রতীক। সমাজে, বিশেষ করে ভূসম্পত্তিকেন্দ্রিক সমাজে, ব্যক্তির অহংকার ও মর্যাদা নির্ধারণ হয় মূলত বংশ পরিচয় দিয়ে। এরপর বিত্ত ও বিদ্যার স্থান। এ-সবের অনেক কিছুই ঘাটতি আছে যাদের তারাও যখন অহেতুক অহংকারবশে মর্যাদাসম্পন্ন হতে চায়, তখন আশ্রয় নেয় ওই সমাজ-স্বীকৃত প্রতীকটির। প্রতীকটি দিয়েই আসলটি না-থাকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চায়, প্রতীকের প্রদর্শনী দিয়েই
৬৯
অপরকে বিভ্রান্ত করে নিজে তৃপ্ত হতে চায়। সব সময় যে সবাইকে বিভ্রান্ত করে রাখা যায় তা অবশ্যই নয়। লােকের কাছে প্রতারণটা ধরা পড়ে যায় বলেই তাে ওই ধরনের কপটাচারী পােশাকধারীদের সম্পর্কে প্রবাদ তৈরি হয়েছে—বাইরে কেঁাচার পত্তন, ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন’।
এ-রকম কপটাচারী যারা নয়, তারাও অবিশ্যি তথাকথিত ভদ্র সমাজ-নির্ধারিত প্রতীকগুলােকে মান্য না করে পারে না। আটপৌরে জীবনে যেমন-তেমন করে চালিয়ে দিলেও বিশেষ দিন-ক্ষণে বা বিশেষ স্থানে ওই প্রতীকাশ্রয়ী তাদের হতেই হয়। কিন্তু সঙ্গতিতে কুলােয় না বলে ওই প্রতীকটিকে তারা কখনাে ধরতে পারে না। তখন তারা প্রতীকেরও প্রতীক বানিয়ে তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়, এবং সেটাই তাদের সামাজিক প্রথায় দাঁড়িয়ে যায়।
কথাগুলাে খুবই এ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে গেলাে। বাস্তব দৃষ্টান্ত দিয়ে ব্যাপারটা স্পষ্ট করে নেয়া যাক।
গ্রামের একজন সাধারণ গৃহস্থ কৃষক বা স্বল্পবিত্ত মানুষের চোখেও ধুতি-চাদর-জুতা পরা ‘দ্রলােকরা সম্ভ্রমের উদ্রেক করে। কিন্তু সে নিজে ওই পােশাকটি পরতে পারে না। কেবল যে আর্থিক অসংগতির জন্যেই পারে না, তা নয়। জীবিকার জন্যে তাকে যেভাবে সব সময় জলকাদায় ধূলিমাটিতে গড়াগড়ি দিতে হয় তাতে ওই পােশাকটি পরে বাবু’ সেজে বসে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। অথচ, বাবুর প্রতীক ওই পােশাকটির প্রতি তার ভারি দুর্বলতা। উৎসবের দিনে বা কুটুম বাড়িতে গেলে, এ-পােশাকটি পরে সে বাবু হওয়ার খায়েশ মেটায়। সকলে অবিশ্যি তা-ও পারে না, দারিদ্র্যই সে-ব্যাপারে বাধা। তারা অনেকেই, আমি দেখেছি, খাটো একটা ধুতি পরে, কারাে কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে-আনা একটা পাঞ্জাবি বা শার্ট (তা-ও আবার হয়তাে ভেঁড়া) কাঁধের ওপরে ফেলে (গায়ে দিয়ে নয়) আত্মীয় বাড়ি যায়। এটিতেই তার বাবুত্বের শখ মেটে, এবং এটিকেই আমি বলছি প্রতীকের প্রতীক সৃষ্টি। সারা রাস্তা জলে কাদায় খালি পায়েই হেঁটে যায়, জুতা জোড়া থাকে হাতে। তারপর কুটুম বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে কোনাে পুকুরে বা ডােবায় পা ধুয়ে নিয়ে জুতা জোড়া পায়ে দেয় ও কুটুম বাড়িতে গিয়ে ওঠে। গ্রামাঞ্চলে এমন দৃশ্য, চল্লিশ/পঞ্চাশ বছর আগেও, অনেকেরই নিশ্চয় চোখে পড়েছে।
যাই হােক, বলছিলাম ধুতির কথা। ধুতিই হয়ে উঠেছিল হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান সকল বাঙালির স্বীকৃত পােশাক। কাজী নজরুল ইসলামের মতাে সমন্বয়বাদী কবি যেমন ধুতি পরতেন, তেমনি পরতেন আবুল কালাম শামসুদ্দীনের মতাে মুসলিম স্বাতন্ত্রবাদী লেখকসাংবাদিকও। কোট-প্যান্ট পরা সাহেব বাঙালিও অবশ্যই ছিলেন, তবু বাঙালি মাত্রেরই ধুতির প্রতি স্বাভাবিক অনুরাগ। তাই, রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতার’ অতি-আধুনিক বিলাতফেরত নায়ক অমিত রায় বা অমিট্রেকেও অতি যত্নে ধুতি-পাঞ্জাবি পরতে দেখি। আধুনিক’ বলে যারা পরিচিত হতে চাইতেন তাঁরাও, চল্লিশের দশকেও, কোট-প্যান্টের চেয়ে ধুতি-পাঞ্জাবিকেই বেশি মর্যাদা দিতেন। এরই প্রমাণ পাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রকাশিত কোনাে এক অজ্ঞাতনামা কবির একটি ব্যঙ্গ কবিতাতেও। তখনকার একটি রম্য পত্রিকায় ‘আধুনিক শিরােনামে এই কবিতাটি ছাপা হয়েছিল। একজন যুবককে আধুনিক’ হতে হলে কী কী করতে হবে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে তারই বর্ণনা দিয়ে কবি লিখেছিলেন,
রােগা লিলিকে চেহারাটা হবে,
বুকের পাঁজরা সব দেখা যাবে
দিতে হবে চুলে বিশিষ্ট ছাট,
৭০
বিলিতি সেলুনে ইংলিশ কাট
গোঁফদাড়ি হবে অলওয়েজ সাক্,
পায়েতে নাগরা, নিউকাট বাফ
গােড়ালি অবধি আদ্দি চড়াবে,
ফিফিনে ধুতি ধূলায় ছড়াবে।
পায়ে নাগরা জুতাে, পরনে নিম্নাঙ্গে ধুতি ও ঊর্ধ্বাঙ্গে আদ্দির পাঞ্জাবি—এ-রকম যুবকটির চলন-বলন ও প্রেম করার ধরনধারণ কেমন হবে, সে-সবের ফিরিস্তি দিয়ে কবি কবিতাটি শেষ করেছেন এভাবে-
লিখিলাম যা যা ফলাে করাে ঠিক,
হাতে যদি চাও আ-ধু-নি-ক’।
কিন্তু চল্লিশের দশকের মাঝামাঝিতে এসেই দেখা গেলাে এই আধুনিকতার ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভক্তি ঘটে গেছে। এক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ধুতি বিদায় নিয়ে এসেছে। পায়জামা, পাঞ্জাবির ওপর চেপে বসেছে শেরওয়ানি। এটা অবিশ্যি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত সংখ্যালঘুদের বেলায়। সে-সম্প্রদায়ের গাঁও-গেরামের বাসিন্দা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের পক্ষে পায়জামা মােটেই সহজলভ্য বা সর্বদা ব্যবহার্য হয়ে ওঠেনি। তাদের পােশাক বদলটা আধুনিকতার চর্চার জন্যে নয়, পাকিস্তান-আন্দোলনের সমর্থনে সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্রকে স্পষ্ট করে তােলার জন্যে। তারা তাই ন্যাংটি বা কাছা পরিত্যাগ করে হয়ে গেলাে বিকচ্ছ—ধুতি ছেড়ে ধরলাে লুঙ্গি। বাংলার সমাজ-ব্যাকরণে যুক্ত হলাে একটি নতুন অধ্যায়—ধুতি-লুঙ্গি দ্বন্দ্বসমাস।
ছেচল্লিশ সনের নির্বাচনের সময়ই ব্যাপারটা স্পষ্ট রূপ ধরলাে বলা চলে। আমাদের রামপুর প্রাইমারি ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সােনাফর উদ্দিন সাহেবকে ধুতি পরতেই দেখে এসেছি এতােদিন, কিন্তু হঠাৎ দেখা গেলাে ধুতি ছেড়ে তিনি লুঙ্গি ধরেছেন। এ-রকম আশপাশের সবাই। কোনাে মুসলমানকে ধুতি পরতে দেখলে তাকে নিয়ে রীতিমত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শুরু হয়ে যেতাে।
মুসলিম লীগের নেতারা অবিশ্যি সভা-সমিতিতে লুঙ্গি পরে বক্তৃতা করতেন না, তাদের পােশাক ছিল পায়জামা ও শেরওয়ানিতে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
কংগ্রেসী মুসলমানরা ধুতি ছাড়েননি। আমাদের গায়ে বা তার আশেপাশে ছেচল্লিশ সনে আমি কোনাে কংগ্রেসী মুসলমানকে দেখিনি, কাজেই ধুতি পরে তাঁরা কী ধরনের প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতেন তা আমার জানা ছিল না। অনেক পরে সেটি জেনেছিলাম নাসির সরকারের কাছ থেকে।
নাসির সরকারের মতাে এমন গোঁয়ার গােবিন্দ আমি কমই দেখেছি। ছেচল্লিশে মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের হাতে মার খেয়ে মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েও যিনি কংগ্রেস ছাড়েননি, তিনি যে ব্যঙ্গবিদ্রুপের ভয়ে ধুতি ছেড়ে দেবেন তাতাে হতেই পারে না।
তবে নাসির সরকারদের ধুতি-পরাটা তথাকথিত আধুনিক বা বাবু’ হওয়ার জন্যে ছিল । তারা ফরাশডাঙ্গা বা শান্তিপুরের ফিফিনে ধুতি আর আদ্দির পাঞ্জাবি পরতো না। তাঁদের পরিধেয় ছিল চরকায় কাটা সুতাে দিয়ে বােনা মােটা খদ্দরের খাটো ধুতি, পাঞ্জাবি বা ফতুয়া ও গান্ধী টুপি। এই পরিধেয়টির সঙ্গে যুক্ত ছিল তাঁদের স্বাদেশিকতার চেতনা।
৭১
নাসির সরকার তাে, এমন কি, পাকিস্তানের জন্মের পরও খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি-গান্ধী টুপি পরেই চলাফেরা করতেন। তাঁর মুখেই শুনেছি, ১৯৫৪ সনে একদিন ধুতি পরেই তিনি শেরপুর শহরের রাস্তায় হাঁটছিলেন। তখন একটি সরকারি অফিস ঘর থেকে তাঁরই পরিচিত একজন কেরানি তাঁকে আহ্বান করলেন, “এই যে প্রেসিডেন্ট সাহেব, আসুন আসুন।” (নাসির সরকার এক সময় ইউনিয়ন বাের্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বলেই তাঁকে এই ‘প্রেসিডেন্ট সাহেব’ সম্বােধন।) কেরানির আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি তাে অফিস ঘরে গিয়ে বসলেন, কিন্তু অফিসারটির মুখ গম্ভীর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, “প্রেসিডেন্ট সাহেব, আপনার নাম কি?”
– “নাসির উদ্দিন সরকার।”
–“এ্যা, আপনি মুসলমান! তাে, আপনার লেবাস এ-রকম বিশ্রী কেন?”
নাসির সরকার তার পরনের ধুতিটির এখানে-ওখানে হাত রেখে বিস্মিত হওয়ার ভাণ করে বললেন, “কেন, কী হয়েছে? আমার কি ‘পক্ষী’ দেখা যাচ্ছে?”
(বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যে অনেকটা সুভাষিত করার চেষ্টায় শিশ্নকে ‘পক্ষী’ বলা হয়ে থাকে, একথা পাঠকগণ নিশ্চয়ই জানেন আশা করি।)
এ-রকম আচমকা পাল্টা প্রশ্নে অফিসারটি প্রথমে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। তারপর সামলে নিয়ে রাগ ও দুঃখের সঙ্গে বললেন, “প্রেসিডেন্ট সাহেব, একজন মুরব্বি মানুষ হয়ে এমন অশ্লীল কথা বলেন কী করে?”
-“অশ্লীল কথা বললাম কোথায়? আমরা কাপড় পরি লজ্জা নিবারণের জন্যে। যদি সেই লজ্জা নিবারণ না হয়, শরীরের যে-সব অংশ ঢেকে রাখার কথা যদি সে-সব ঢাকা না থাকে তা হলে কাপড় পরার কোনাে সার্থকতাই থাকে না। তাই আপনি যখন আমার লেবাসটিকে বিশ্রী। বললেন তখন আমি ভাবলাম যে আমার হয়তাে লজ্জাস্থান ঢাকা পড়েনি। সে-কারণেই আপনাকে এ-কথা জিজ্ঞেস করলাম।”
এ-রকম খোচা-দেয়া কথায় অফিসারটির রাগ আরাে বেড়ে যায়। ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করে দেন তিনি।
কিন্তু নাসির সরকারের সঙ্গে যুক্তিতে পাল্লা দেয়া কঠিন। সাম্প্রদায়িক ভাবনায় ওই অফিসারটির মাথা ভরপুর হয়ে আছে বলেই যে তিনি ধুতিকে বিশ্রী পােশাক বলেন, অকাট্য যুক্তি প্রয়ােগ করে নাসির সরকার তা প্রমাণ করে চললেন। এবং সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে সুস্থ ভাবনাচিন্তা করার জন্যে অফিসারটিকে উপদেশ দিয়ে অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
যতাে উপদেশই দিন নাসির সরকারের মতাে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা, সাম্প্রদায়িক মানস প্রতিবন্ধ থেকে উপজাত ধুতি-লুঙ্গির দ্বন্দ্বের অবসান আজো ঘটেনি।
পঁয়তাল্লিশ/ছেচল্লিশ সনের দিকে দেখেছি, পাকিস্তান-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সদ্যজাগ্রত মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা যেমন লুঙ্গি দিয়ে ধুতিকে প্রতিস্থাপিত করছে, হিন্দু রক্ষণশীলতা তেমনি লুঙ্গিকে প্রতিহত করতে চাইছে প্রাণপণে। অথচ পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় থেকেই কাপড়ের দাম এতাে বেড়ে গিয়েছিল যে, সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত কোনাে দ্রলােকের পক্ষেই সারাক্ষণ পরে থাকার জন্যে দশহাত ধুতির সংস্থান করা সম্ভব হচ্ছিল না। তুলনায় লুঙ্গি ছিল অনেক সস্তা। কিন্তু হিন্দু ভদ্রলােক কিছুতেই লুঙ্গি পরবে না। কারণ এতে হিন্দুত্বের অবমাননা হয়! লুঙ্গিতে কাছা থাকে না। আর কাছাই যদি না থাকলাে, তবে তা তাে উলঙ্গ থাকারই
৭২
সামিল! ওই ‘ছােটলােক’ মুসলমানের মতাে ‘দ্রলােক’ হিন্দুরাও যদি কাছাকোচাহীন লুঙ্গি পরতে শুরু করে দেয়, তা হলে আর হিন্দু-স্নেচ্ছের তফাৎ থাকে কোথায়! এই তফাৎ ঘুচে যাওয়া মানে ঘাের কলির সূচনা!
এ-রকম যুক্তি আমি, ছেচল্লিশ সনেও, গ্রামীণ হিন্দু সমাজপতিদের মুখে শুনেছি। পরে চিন্তা করে দেখেছি: দ্বিজাতিতত্ত্ব যতাে ভ্রান্তই হােক, এই ভ্রান্তির সৃষ্টি কোনাে এক পক্ষের হাতে হয়নি, হিন্দু ভদ্রলােক আর মুসলমান শরিফ আদমি দুইয়েরই তাতে কমবেশি অবদান আছে। ধুতি-লুঙ্গির দ্বন্দ্বসমাসে সেই দ্বৈত অবদানের উপসর্গই যুক্ত হয়েছে।
তবু কিন্তু গরজ বড়াে বালাই। হিন্দুদের পরিচ্ছদ-নীতির চেয়ে শক্তিধর হয়ে এলাে অভাবের অর্থনীতি। অভাবে স্বভাব নষ্টের নিয়মেই হিন্দুত্বের ব্যত্যয় ঘটিয়ে হিন্দুদের মধ্যে লুঙ্গির প্রচলন শুরু হয়ে গেলাে। তবে সেখানেও মুসলমানের লুঙ্গির সঙ্গে একটা পার্থক্য রাখার চেষ্টা প্রথম প্রথম চালানাে হলাে। যেমন—সেলাইকরা লুঙ্গি নয়, বাজার থেকে লুঙ্গির কাপড় কিনে এনে সেলাই না-করেই সেটিকে কোমরে পেঁচিয়ে রাখা। এতে বােধ হয় মুসলমানের লুঙ্গির সঙ্গে কিছুটা হলেও স্বাতন্ত্র-চিহ্ন বজায় রইলাে। আবার সেই স্বাতন্ত্রকে স্পষ্টতর করার জন্যেই হিন্দুরা পরতাে একরঙা লুঙ্গি, চেক লুঙ্গিকে পরিহার করারই চেষ্টা করতাে। তা ছাড়া হিন্দুরা, অন্তত দ্রতা-অভিমানী হিন্দুরা, জনসমক্ষে লুঙ্গি পরে বের হতাে না। কেবল বেশি দাম দিয়ে কেনা ধুতিটার আয়ু কিছুটা বাড়িয়ে তােলার জন্যেই বাড়ির ভেতর লুঙ্গি পরে থাকতাে।
কিন্তু ছেচল্লিশ সনে নােয়াখালির দাঙ্গার পর ওই ঘর-বাইরের লুকোচুরিও ঘুচে গেলাে, পূর্ববাংলার গ্রামীণ হিন্দুরা তখন প্রাণের ভয়েই চেক লুঙ্গি পরে মুসলমান সেজে বাইরে বেরােতে লাগলাে। এ-রকমটি করতে গিয়ে অনেক হাস্যকর ঘটনাও তারা ঘটালাে। একদিন দেখলাম : রামপুর বাজারের পাশ দিয়ে লুঙ্গি পরা একজন অপরিচিত লােক হেঁটে যাচ্ছে, তার গলায় তুলসীর মালা। বৈষ্ণবদের বৈষ্ণবত্ব তথা হিন্দুত্বের চিহ্ন এই তুলসীর মালা। লােকটি ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি পরে তার নিম্নাঙ্গের হিন্দুত্ব ঘােচালেও ঊর্ধ্বাঙ্গে যে হিন্দুত্বের চিহ্ন একেবারে জ্বলজ্বল করছে, সেদিকে তার খেয়ালই নেই।
যতােই না কেন হিন্দুরা ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি ধরুক, ধুতি আর হিন্দু শব্দ দু’টো অনেকের কাছে। আজো একার্থক হয়েই আছে। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগের মুখপত্রে লেখা। হলাে—‘ঢাকার রাস্তায় ধুতির ভীড়। অর্থাৎ মুসলিম লীগের নেতা তথা পাকিস্তানের কর্তারা যে বলেছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে হিন্দুরা এসে ঢাকায় বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল করছে, সে-কথাটাকে প্রতীকী করার জন্যেই বলা হলাে ধুতির কথা। উনিশ শো সত্তরে যখন এদেশের আকাশ-বাতাস জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখর, তখনাে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের ধারকরা কুৎসিত ইঙ্গিত দিয়ে বলেছে—“জয়বাংলা জয়হিন্দু, লুঙ্গি খুইল্যা ধুতি পিন্‌।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রায় সিকি শতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পরও এই ধুতিলুঙ্গি দ্বন্দ্বসমাসই পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্বকে বাঁচিয়ে রাখছে ও মৃত পাকিস্তানের ভূতকে লালনপালন করে চলছে।
৭৩
ঢাক-ঢােলের বাদ্য, গােহত্যা ও দ্বিজাতিতত্ত্ব
শুধু ধুতি-লুঙ্গি নয়, আরাে নানাভাবে মুসলিম স্বাতন্ত্রকে সচেতনভাবে দৃশ্যমান করে তুলে দ্বিজাতিতত্ত্বকে সত্য করে তােলার চেষ্টা করা হলাে।
আমি বলছি চল্লিশের দশকের শেষ পর্বের—বিশেষ করে পঁয়তাল্লিশ, ছেচল্লিশ ও সাতচল্লিশের গােড়ার দিকের কথা, পাকিস্তানের জন্মের পূর্বক্ষণের কথা। ঠিক এ সময়েই যে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্যবােধ জেগে উঠেছিল, এর আগে কখনাে সে-বােধ ছিল না, তেমন কথা নিশ্চয়ই সত্য নয়। ইতিহাস পরিক্রমা করলে তাে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই আমরা মুসলিম স্বাতন্ত্রের উন্মেষ দেখতে পাই। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬-এ মুসলিম লীগের জন্ম, এর কয়েক বছর পর স্বতন্ত্র নির্বাচন-ব্যবস্থার প্রবর্তন—এ-সবের মধ্য দিয়ে বিশ শতকের প্রথম দশকেই মুসলিম স্বাতন্ত্র তার বাস্তব ভিত্তি পেয়ে যায়। আর ১৯৪০-এ লাহাের প্রস্তাব সেই ভিত্তিকেই মজবুত ও পাকাপােক্ত করে তােলে।
তবে, আমি এখানে ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু তুলে আনতে চাইছি না। আমি বলছি যা ‘দর্শন’ করেছি অর্থাৎ চোখে দেখেছি ও সে-দেখার ভিত্তিতে স্বাতন্ত্রের যে-দর্শনটি উপলব্ধি করেছি—তারই কথা। মাঝে মাঝে কেবল ইতিহাসের পাতা খুলে আমার নিজের দেখাটিকে যাচাই করে নিচ্ছি মাত্র।
একই বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কিছু কিছু শব্দ ব্যবহারে স্বাতন্ত্র বরাবরই ছিল, কিন্তু তার জন্যে হিন্দু-মুসলমানের ভাষা নিশ্চয়ই আলাদা হয়ে যায়নি। যদিও বেশ কিছুকাল আগেই ‘মুসলমানি বাংলা’ বলে একটা ভাষারীতি চালানাের প্রয়াস চলছিল, পাকিস্তান-আন্দোলনের সময় সে-প্রয়াসটাই অতিরিক্ত জোরদার হয়ে উঠলাে। পানি, গােসল, নাস্তা, গােস্ত, আন্ডা—এসব শব্দ বাঙালি মুসলমানরা বহুকাল ধরেই ব্যবহার করে আসছে, কিন্তু এ-সময় এ শব্দগুলাের সচেতন প্রয়ােগ চললাে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রমাণ ও মুসলিম জাতির পরিচয়-চিহ্ন হিসেবে।
এমন কি যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে, সেই বাংলাদেশেও গােস্ত আর আন্ডাকে সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামক একটি ধারণার বেনামিতে চাঙ্গা করে তুলতে চেষ্টা করা হলাে পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্বকেই। দেখা গেলাে : এপ্রয়াসের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন আতাউর রহমান খানের মতাে রাজনীতিকও যিনি এককালে সেকুলার ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী বলে পরিচিত ছিলেন সর্ব মহলে। স্বৈরতন্ত্রী এরশাদের নিয়ােগ করা ঠুটো জগন্নাথ প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনিই ‘গােস্ত দিয়ে মাংসের বিরুদ্ধে জেহাদের সূচনা করেছিলেন। তাঁর এই কাণ্ড দেখে সে সময়ে অনেকেরই মনে পড়েছিল পাকিস্তানের ডিক্টেটর আইয়ুব খানের স্নেহধন্য পূর্ব পাকিস্তানি সেই ছােট লাট সাহেবটির কথা। তিনি নাকি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নিয়ােগের সময় সেপদের প্রার্থীদের প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি আজকে নাস্তা করেছেন ডিম না আন্ডা দিয়ে?
এভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রে, এবং পরবর্তী কালে স্বাধীন বাংলাদেশেও যে ডিম আন্ডা ও মাংসগােস্তের পার্থক্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয়করণের কাজ চলে, তারই প্রবল উন্মেষ-পর্বটি চল্লিশের দশকে প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। মন্দির-মসজিদ নিয়ে যদিও হিন্দু-মুসলমানি কাণ্ড শুরু হয়েছিল এর আগের দশকেই, তবু চল্লিশের দশকেই এ-কাণ্ডটি গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত ছড়িয়ে
৭৪
পড়েছিল। এ-সময়কারই ঘটনা কিশােরগঞ্জ শহরে একটি মসজিদের সামনে পুলিশের গুলিবর্ষণ। বাদ্যভাণ্ড সহকারে মসজিদের সামনে দিয়ে হিন্দুদের দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের মিছিল নিয়ে যাওয়া, মুসলমানের সে-মিছিলের ওপর আক্রমণ, হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ, পুলিশের গুলিবর্ষণ ও পরিণামে বেশ কয়েকজন আদম-সন্তানের প্রাণহানি। এ ঘটনার অভিঘাতেই আমাদের গ্রামাঞ্চলগুলাে চঞ্চল হয়ে উঠলাে, মানুষের মানুষ পরিচয়ের চেয়ে হিন্দু আর মুসলমান পরিচয়টিই রাতারাতি বড়াে হয়ে দেখা দিলাে। মসজিদের সামনে বাদ্যভাণ্ডের কোলাহল তােলার অধিকার হিন্দুত্বের মর্যাদার সঙ্গে যেন অনপনেয় সূত্রে গ্রথিত হয়ে গেলাে। অন্যদিকে, মুসলমান চাইলাে রাজপথের ধারে কিংবা হিন্দু বাড়ির সামনে প্রকাশ্যে গােহত্যা করে মুসলমানত্বের গৌরবকে উচ্চে তুলে ধরতে। মসজিদের সামনে ঢাক-ঢােল বাজানাের কিংবা প্রকাশ্যে গােহত্যার কোনাে ঘটনা আমাদের এলাকায় ঘটেছে বলে শুনিনি, হিন্দুমুসলমানের কোনাে সংঘর্ষও এখানে হয়নি। তবু দেশের নানা জায়গা থেকে উড়ে আসা নানা খবর আমাদের গ্রামের মানুষদের মানসিক শান্তি নষ্ট করে দিলাে, হিন্দু ও মুসলমান একে অন্যের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলাে।
তখনাে, সেই ছেচল্লিশ সনেও, নেত্রকোনা-কিশােরগঞ্জের কতকগুলাে বিশেষ বিশেষ গ্রামকে কেন্দ্র করে হিন্দু তালুকদার-জোতদারদেরই প্রাধান্য। গায়ের সাধারণ হিন্দু-মুসলমান সকলেই তাদের প্রজা। গরিব প্রজাদের অধিকাংশই কৃষিজীবী। কৃষিজীবীদেরও অধিকাংশই ভূমিহীন। কাজেই বাবুকর্তাদের জমি বর্গা নিয়েই তাদের জীবন চালাতে হয়; এবং সে কারণেই, স্বাভাবিকভাবেই, তারা সর্বদা বাবু-কর্তাদের অনুগত। তবু আনুগত্য সত্ত্বেও, শোষণ আর নিগ্রহের আঁতাকলের পেষণ থেকে তাদের কারুরই রেহাই নেই। এ ব্যাপারে হিন্দু আর মুসলমান প্রজার একই অবস্থা, কোনাে রকম পার্থক্য করা যায় না তাদের মধ্যে। অথচ, এখন কিন্তু দেখা গেলাে, একটি পার্থক্য তারা নিজেরাই সৃষ্টি করে নিয়েছে, এবং সেটি করেছে। গােরুকে ঘিরে। হিন্দু প্রজার কাছে যে-গােরু হলাে দেবতা, সেই গােরুই মুসলমান প্রজার আহার্য; হিন্দু প্রজাকে পাপস্খলনের জন্যে খেতে হয় গােরুর মল বা গােবর, তার জন্যে গােহত্যা মহাপাপ; আর মুসলমানের পুণ্যের অংশই আল্লাহর উদ্দেশে গাে-কোরবানি করা ও গােরুর গােস্ত খাওয়া। এ-সব তথ্য সবারই জানা থাকলেও এতােদিন বােধ হয় কেউই এসম্পর্কে সচেতন ছিল না। এবার সবাই যেন রাতারাতি এ-ব্যাপারে সজাগ হয়ে উঠলাে। গােরু-পূজক আর গােরু-খাদক—মনে হলাে, মানুষ যেন এই দু’ভাগে বিভক্ত। বাবুকর্তাদের সকল কৃষিজীবী প্রজাদের বস্তুগত অবস্থা ও অবস্থান এক হলেও এবার গােরু পূজা ও গােরু খাওয়ার ভিত্তিতেই তারা দু’দলে ভাগ হয়ে গেলাে, এক দল অপর দলের শত্রু হয়ে দাড়ালাে। গােরু-পূজকের দল গােরু পূজার সুবাদেই বাবু কর্তাদের সঙ্গে নিজেদের মিল খুঁজে পেলাে, আর গােরু খাদকরা একাত্ম হলাে মিঞা সাহেবদের সঙ্গে। আমি যে-অঞ্চলের কথা বলছি, সেই নেত্রকোনা-কিশােরগঞ্জ তথা তখনকার পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চলে মুসলমান তালুকদারজোতদাররা সংখ্যায়ও বেশি ছিল না, সম্পদেও ছিল অনেক খাটো। অর্থাৎ এখানে বাবুকর্তাদের তুলনায় মিঞা-সাহেবরা ছিলেন নিতান্তই দুর্বল। বাবুকর্তাদের প্রতাপের তাড়নায় তাঁরা বরং অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায়ই ছিলেন। তাই তারা প্রতাপান্বিত হওয়ার সুযােগ খুঁজছিলেন। অনেক দিন ধরে। গাে-পূজক প্রজাদের গােরু ভক্তি ও গাে-খাদকদের গাে-নিধনস্পৃহা থেকে উপজাত বিরােধ সেই সুযােগই নিয়ে এলাে। গােখাদক প্রজারা সংখ্যায় গরিষ্ঠ ছিল বলে তাদের
৭৫
পক্ষে পেয়ে মিঞা-সাহেবদের শক্তি হঠাৎ করেই অনেক গুণ বেড়ে গেলাে। অন্যদিকে, সংখ্যালঘু গাে-পূজক প্রজার সমর্থন বাবুকর্তাদের শক্তিতে তেমন একটা কিছু সংযােজন করলাে না। তবে বাবু বা সাহেবদের শক্তির হ্রাস-বৃদ্ধি যার যে-রকমই হােক না কেন, প্রজাদের দু’দলই হলাে বাবুকর্তা আর মিঞা-সাহেবদের কর্তৃত্বের যুদ্ধে উলুখাগড়া মাত্র। সাম্প্রদায়িক বিরােধের চোরাবালিতে আটকে গিয়ে শ্রেণীসংগ্রাম ধরলাে বিকৃত রূপ।
যদিও তখনাে ব্রিটিশ শাসনই চলছে, তবু সেই প্রশাসনের মধ্যেও বাবুকর্তা আর মিঞাসাহেবরা নিজের নিজের প্রভাব বলয় তৈরি করে নিতে পেরেছেন। সেখান থেকেই নিজের নিজের শক্তির প্রদর্শনীও দেখিয়ে যাচ্ছিলেন। গােরু নিয়েও যে তারা এ রকমই করেছিলেন, তারই একটি মজার ঘটনার কথা শুনেছিলাম। নেত্রকোনার বারহাট্টায় না-কি মুসলমানরা ঠিক করেছিল যে, সে-বছর কী একটা উপলক্ষে তারা প্রকাশ্যে গােরু জবাই করবে কালীমন্দিরের সামনে রাস্তার ধারে। বাবুকর্তারা এটা কিছুতেই হতে দেবেন না। তারা ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যােগাযােগ করলেন। জেলার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা যাতে গােরু জবাই বন্ধ করার জন্যে বারহাট্টা থানায় নির্দেশ পাঠান, এমন ব্যবস্থাও তারা করলেন। ব্যবস্থা-অনুযায়ী একটি অতি সংক্ষিপ্ত তারবার্তা এলাে বারহাট্টা থানায়। তাতে লেখা ‘স্নটারিং প্রােহিবিটেড। থানার ভারপ্রাপ্ত দারােগা বা ওসি ছিলেন মুসলমান। তিনি এই সংক্ষিপ্ত বার্তাটির অর্থ করে নিলেন তাঁর নিজের মন মতাে। স্নটারিং’ বলতে যদি পশু হত্যা বােঝানাে হয়ে থাকে, তা হলে তাে যে কোনাে পশু হত্যা এর ভেতর পড়ে। থানার পাশে কালীমন্দিরটিতে যে রােজ পাঠা বলি দেয়া হয়, তা-ও তাে ওই স্নটারিংই। ব্যস্। দারােগা সাহেব জানিয়ে দিলেন : ওপর থেকে অর্ডার এসেছে যে সব রকম পশু হত্যা বন্ধ করতে হবে, তাই কালী বাড়িতে পাঠা বলি দেয়া চলবে না।
এ-রকম অনেক কৌতুককর ঘটনাই বাবুকর্তা আর মিঞা-সাহেবদের প্রবর্তনায় এখানেওখানে ঘটেছে।
গােরু নিয়ে গােমূর্খতা তাে উনিশ শতকেই শুরু হয়েছিল। সে-শতকে হিন্দু রিভাইভ্যালিজমের প্রথম প্রবক্তা ও আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতীই বােধ হয় এই মূখতার উদ্বোধন ঘটান। ১৮৮২ সালে তিনিই জন্ম দেন ‘গােহত্যা নিবারণী সভা’র। নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে এ সভার সদস্যরা যখন গাে রক্ষার আদর্শ প্রচার করতে থাকে তখন তাতে গাে রক্ষা যে-রকমই হােক না কেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তথা মনুষ্যত্বের আদর্শ রক্ষা যে হয়ে পড়ে সুদূরপরাহত, সে-বিষয়ে কোনােই সন্দেহ করা চলে না। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নামে জাতীয়’ কথাটা খুব জঁক করে জুড়ে দেয়া হলেও বাস্তবে তাতে সাম্প্রদায়িক উপাদানেরই ছিল প্রাধান্য। তাই দেখি: ১৮৮৭ সালে কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে অনায়াসে গােহত্যা বন্ধের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন রাজশাহীর তাহিরপুরের জমিদার শশিশেখর রায়। এর চার বছর পর, ১৮৯১ সালে, নাগপুর অধিবেশনে তাে গাে-রক্ষিণী সভার সদস্যরা কংগ্রেসের প্যান্ডেলেই গাে-রক্ষার জন্যে সভা করার ও চাঁদা তােলার অনুমতি পেয়ে যায়। বাঙালি হিন্দুদেরও একটি অতি উৎসাহী গােষ্ঠী গাে-রক্ষিণী সভা প্রতিষ্ঠার হুজুগে মেতে ওঠে।
গাে-রক্ষা আন্দোলনই, আমার মনে হয় হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়কে দুই জাতিরূপে চিহ্নিত করার সবচেয়ে বেশি সুযােগ এনে দেয়, এবং মুসলিম লিগাররা সেই
৭৬
সুযােগটিরই পূর্ণ মাত্রায় সদ্ব্যবহার করে বিশ শতকের চল্লিশের দশকে। উনিশ শতকের শেষ ভাগে পোতা বীজে বিশ শতকের শুরুতেই ফল ধরতে থাকে।
“উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা চেতনার ধারা” বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ডক্টর ওয়াকিল আহমদ গাে-হত্যা সম্পর্কে লিখেছেন,
“গাে রক্ষিণী সভার ফরিদপুর শাখার সম্পাদক যােগেন্দ্র চন্দ্র ঘােষ গাে-হত্যা বন্ধ করার জন্যে কসাই-এর গাে-হত্যা’ শিরােনামে প্রচারপত্র বিলি করে জনমত তৈরি করেন। প্রচারপত্রে হিন্দু জনসাধারণকে হাটে-বাজারে মুসলমান কসাই-এর কাছে গােরু বিক্রয় করতে নিষেধ করা হয়, ঐ সঙ্গে হিন্দু জমিদারদের নিজ নিজ জমিদারীতে গাে-হত্যা বন্ধ করার আবেদন জানানাে হয়। ফরিদপুরের আঞ্জুমানে ইসলাম মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনপত্র প্রেরণ করে। ঐ আবেদনপত্রে বলা হয় যে, গাে-হত্যার প্রশ্নে হিন্দু-মুসলমানের নিত্য সংঘর্ষ বাধে; বিহার ও উত্তর প্রদেশে এ নিয়ে দাঙ্গা হয়ে গেছে; পূর্ববঙ্গে পূর্বে কোনাে বিবাদ ছিল না, কিন্তু যােগেন্দ্রচন্দ্র ঘােষের প্রচারণার ফলে হিন্দুগণ গাে-হত্যা বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। মুসলমানেরা এটি মেনে নিতে পারে না, ফলে শান্তি বিঘ্ন হওয়ার খুবই সম্ভাবনা আছে। জেলা-প্রশাসক যাতে ঐরূপ প্রচারণা বন্ধ করার ব্যবস্থা নেন, ঐ পত্রে তার আবেদন জানানাে হয়েছে।
“গাে-রক্ষিণী সভার পরেই জমিদারদের স্থান। অনেক জমিদার মুসলমান প্রজাদের ঈদ উপলক্ষে গাে-কোরবানি অথবা বিবাহ উপলক্ষে গাে-হত্যা নিষিদ্ধ করে দেন।…হিন্দু প্রজাগণ এ ব্যাপারে জমিদারকে সমর্থন দিত ।…ময়মনসিংহের অম্বারিয়া, মুক্তাগাছা ও সন্তোষের জমিদারগণ কয়েকজন গ্রামবাসীকে গাে-কোরবানির জন্য জরিমানা করেছিলেন।…চাঁদপুরের কতিপয় মুসলমান ঈদ উপলক্ষে গােরু কোরবানি দিলে গােপাল চন্দ্র মজুমদার নামে জনৈক ধনী ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী নালিশ করেন; প্রকাশ্য রাস্তায় গােরু জবাই করেছে এবং বদ্ধজলে মাংস ধৌত করে জল অপবিত্র করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এরূপ অভিযােগ আনা হয়। জেলা হাকিম জগদীশ চন্দ্র সেন সরজমিনে তদন্ত না করে একজনকে একমাস কারাদণ্ড, একজনকে ৫০ টাকা অপরজনকে ১৫ টাকা অর্থদণ্ড করেন।”
হিন্দুদের গােরু নিয়ে এই আদিখ্যেতা একেবারে নতুন নয়, নতুন কেবল এর সাম্প্রদায়িক মতলববাজির প্রকাশটা। কারণ, কোন সুদূর অতীতে বৈদিক যুগে হিন্দুরা পরম আহলাদে গাে মাংস ভক্ষণ করতে বলে কথিত হলেও অন্তত দু’হাজার বছর ধরে হিন্দুদের জন্যে গাে-হত্যা ও গাে-মাংস ভক্ষণ পুরােপুরি নিষিদ্ধ। এ দুটো কাজকে হিন্দুরা এমনই মহাপাপ বলে মনে করে যে, অন্য যে-কোনাে কাজ বা খাদ্যের নিষেধবিধিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তােলার জন্যে বলে, অমুক কাজ করা বা অমুক খাদ্য গ্রহণ করা গাে-হত্যা বা গাে-মাংস ভক্ষণের তুল্য মহাপাপ। যেমন—নবমী তিথিতে লাউ খেতে নেই, এমন একটি নিষেধবিধি অতিরক্ষণশীল হিন্দুরা আজো মেনে চলে। আমার ঠাকুরমাকে জিজ্ঞেস করতাম, নবমীতে লাউ খেলে কী এমন ক্ষতিটা হয় বলাে তাে। ঠাকুরমা দাঁতে জিভ কেটে বলতেন, ‘ছি, ছি, নবমীতে লাউ খাওয়া আর গাে-মাংস খাওয়া তাে একই কথা। অর্থাৎ গােমাংস খাওয়া দূরের কথা, খাওয়ার চিন্তা করাও কোনাে হিন্দুর পক্ষে অসম্ভব।
আমরা জানি: হিন্দুদের কোনাে সুনির্দিষ্ট ক্রীড তাে নেই-ই, এমনকি সারা উপমহাদেশের সকল হিন্দুর জন্যে সর্বমান্য কোনাে আচারও নেই। তা হলে হিন্দুত্বের সাধারণ ভিত্তি কী, কোন
৭৭
লক্ষণ দিয়ে হিন্দুকে চিহ্নিত করা যায়? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে দেখা গেলাে : যে-কোনাে অঞ্চলের যে-কোনাে মতাদর্শের হিন্দুই জন্মান্তরে বিশ্বাস করে, এবং সকল হিন্দুর দৃষ্টিতেই গােহত্যা ও গাে-মাংস ভক্ষণ মহাপাপ।
জন্মান্তরের বিষয়টা নিতান্তই বিশ্বাসের, এর কোনাে বাহ্য প্রকাশ নেই। কিন্তু গাে হত্যার ব্যাপারটি তেমন নয়। এই নিষেধবিধিটি ব্যবহারিক আচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলেই এটিকে খুবই উগ্রতা নিয়ে প্রকাশ করে মৌলবাদী হিন্দু নেতারা। আবার, গাে-হত্যা আর গাে-মাংস ভক্ষণের ব্যাপারে যেহেতু হিন্দুদের বিপরীতে অবস্থান মুসলমানদের, তাই দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা মুসলিম লীগ নেতারা এই ইস্যুটিকে খুবই সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করতে পারে।

মুসলিম স্বাতন্ত্র ও পাকিস্তানের জজবা
মুসলিম স্বাতন্ত্র ও পাকিস্তানের জজবা গােপূজা ও গােহত্যা—এই দুই বিপরীত ধর্মী আচরণ হিন্দু ও মুসলমানকে দুই ভিন্ন জাতি বলে প্রতিপন্ন করার সবচেয়ে বড়াে সুযােগ সৃষ্টি করলেও এই গােমূখতা দূর করার চেষ্টাও কেউ কেউ করেছেন বৈকি। তবে হিন্দু মৌলবাদীদের গােহত্যা-নিবারণী আন্দোলনের কুফল সম্পর্কে হিন্দু সমাজের উদারচেতা মনীষীবৃন্দও যে যথাযথ সচেতনতা দেখাতে পারেননি, এ হচ্ছে এক বেদনাদায়ক সত্য। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যে গােহত্যা-নিবারণ আন্দোলনকে পরােক্ষভাবে সমর্থনই জানিয়েছে, তাও আমরা দেখেছি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের উদ্যোগে যে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট” হয় ১৯২৩ সালে, কেবল তারই একটি ধারায় বলা হয়েছিল : ‘মসজিদের সামনে বাজনা বাজিয়ে মিছিল করা যাবে না। ধর্মের জন্য গােহত্যা-হতে পারবে।’ এতেও গােহত্যা বিরােধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে তেমন কঠোর মনােভাবের প্রকাশ ঘটেনি। কিংবা এ আন্দোলনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যে কতাে প্রতিক্রিয়াশীল ও জাতীয় সংহতি বিরােধী, সে সম্পর্কে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এর প্রণেতারাও যে খুব সচেতন ছিলেন, তা মনে হয় না। তাছাড়া চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর তাে পুরাে বেঙ্গল প্যাক্টেরই অপমৃত্যু ঘটে।
গােহত্যা নিয়ে যখন সমাজে একটা তােলপাড় দেখা দিয়েছিল, তখনই, সেই উনিশ শতকের শেষপাদেই, এ ব্যাপারে একটি উদারনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন সে শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিক মীর মশাররফ হােসেন। তিনি চেয়েছিলেন ; গােহত্যানিবারণের নামে হিন্দু মূর্খতার বিপরীতে গােহত্যার পক্ষে মুসলমানী জেদ যেন উগ্র না হয়ে ওঠে, ওই তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে যেন হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি নষ্ট হয়ে না যায়, গােরু নিয়ে ঝগড়া করে মানুষকে যেন ছােট করে না ফেলা হয়। তাই তিনি মুসলমানদের কাছে গােরু কোরবানি বন্ধ ও গােমাংস ভক্ষণ ত্যাগ করার আবেদন জানিয়েছিলেন। গােমাংস ভক্ষণে ইসলাম ধর্মশাস্ত্রে কোনাে নিষেধাজ্ঞা নেই। একথা অবশ্যই সত্য; কিন্তু গােহত্যা বন্ধ করলে বা গােমাংস ভক্ষণ না করলেও যে মুসলমানি নষ্ট হয়ে যাবে, তেমন কথাও তাে ইসলামি কোনাে ধর্মশাস্ত্রেই লেখা নেই নিশ্চয়। তাই, টাঙ্গাইলের ‘আহমদী পত্রিকায় ১২৯৫ সালে ‘গাে নির্মূল আশঙ্কা’ প্রবন্ধে গােহত্যা বন্ধের প্রস্তাব দিয়ে মীর মশাররফ হােসেন লিখলেন, “এই বঙ্গরাজ্যে হিন্দু মুসলমান উভয় জাতিই প্রধান। পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে, ধর্মে ভিন্ন, কিন্তু মর্মে এবং কর্মে এক—সংসার কার্যে ভাই না বলিয়া আর থাকিতে পারি না। আপদে বিপদে সুখে-দুঃখে, সম্পদে পরস্পরের সাহায্য ভিন্ন উদ্ধার নাই। সুখ নাই, শেষ নাই, রক্ষার উপায় নাই। এমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যাহাদের সঙ্গে, এমন চিরসঙ্গী যাহারা, তাহাদের মনে ব্যথা দিয়া লাভ কি?”
৭৮
‘গােকূল নির্মূল আশঙ্কা’র পর মীর সাহেব লিখেছিলেন এ-রকম আরাে তিনটি প্রবন্ধ ‘গােধন কি সামান্য ধন’, ‘গােমাংস’ এবং ‘গােদুগ্ধ’ । এই চারটি প্রবন্ধ একত্র করে তিনি প্রকাশ করেছিলেন গােজীবন গ্রন্থটি।
কিন্তু মীর সাহেবের উদারনৈতিক প্রয়াসটি পুরােপুরিই ব্যর্থ হয়ে যায়। আহমদীর সম্পাদক আবদুল হামিদ খান ইউসুফজয়ীর মতাে হাতে গােণা দুয়েক জন মুসলমান মীর সাহেবকে সমর্থন জানালেও ধর্মান্ধ ও গোঁড়া মুসলমানরা তাঁকে কাফের’ আখ্যা দেয়, এমনকি তাঁর স্ত্রী হারাম হয়ে গেছে বলেও ফতােয়া জারি করে। তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। শেষ পর্যন্ত মীর সাহেব আপােস করতে বাধ্য হন ও ‘গােজীবন বইটি প্রত্যাহার করে নেন।
মীর মশাররফ হােসেন তাঁর প্রয়াসে ব্যর্থ হলেও তিনি একটি স্মরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে যান নিশ্চয়ই। কিন্তু তার সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে উদারনৈতিক হিন্দুদের কেউই গােরক্ষার নামে বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসননি। শাস্ত্রে নিষিদ্ধ বলে হিন্দুরা গােহত্যা ও গােমাংস ভক্ষণ থেকে বিরত থাকুক, ক্ষতি নেই। কিন্তু যাদের শাস্ত্রে এ বিষয়ে কোনাে নিষেধ বিধি নেই, তাদের অধিকার বাধা দেয়া যে মােটেই ন্যায়সঙ্গত নয়, একথা কি জাতীয়তাবাদী হিন্দুনেতা ও মুক্ত বুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীরা জোরের সঙ্গে বলতে পারতেন না? দুঃখ এই, তারা তা বলেননি।
তবে আমার মনে আছে, তিরিশের দশকের শেষ কিংবা চল্লিশের গােড়ার দিকের কোনাে এক সময়ের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকার একটি পুরনাে সংখ্যা কি করে জানি আমার হাতে এসেছিল। এতে গােহত্যা ও গােমাংস ভক্ষণের সপক্ষে জোরালাে যুক্তি দিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন একজন হিন্দু লেখক। তাঁর নাম—মন্মথনাথ সরকার। প্রবন্ধটি আমি আমার দুয়েক জন গুরুজনকে পড়তে দিয়েছিলাম। তারা তাে এটি পড়ে আমার ওপরই মহাখাপ্পা হয়ে উঠেছিলেন। তীব্র ভৎসনার সঙ্গে আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, আমি যেন এরকম গােখাদক ও কুলাঙ্গার হিন্দুনামধারী লেখকের লেখা কখনাে না পড়ি।
আসলে হিন্দুদের গােহত্যা বিরােধী আন্দোলন কোনাে যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না, অন্ধ ধর্মীয় ভাবাবেগই এর পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল। দেশের গাে-সম্পদ রক্ষার সাধু উদ্দেশ্যই যদি গােহত্যা বিরােধী আন্দোলনকারীদের থাকতাে, তবে তাে তারা ধর্ম নিরপেক্ষ যুক্তি দিয়েই হিন্দু মুসলমান সকলকে নিয়ে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারতাে, ধর্মশাস্ত্রের দোহাই দিতাে না। তাই, এদের আন্দোলনের মধ্যে রক্ষণশীল মুসলিম নেতারা যে মুসলিম বিদ্বেষের গন্ধ পেয়েছিলেন, তাতে তাদের দোষ দেয়া যায় না। গাে-রক্ষিণী সভা আইন করে গােহত্যা বন্ধ করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। এরই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে মীর মশাররফ হােসেনের প্রতিপক্ষ মােহাম্মদ নইমুদ্দীন যা যা বলেছিলেন তার সব কিছুকেই পুরােপুরি অসত্য বলে বাতিল করে দিতে পারি না। ভারতে গােবধ’ নামক একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ আইন দ্বারা গােবধ নিবারণ করতে গভর্ণমেন্টকে উপদেশ দিতেছেন। সরল মনে বন্ধু ভাবে একথা বলিলেও কতকটা ভাল শুনায়, আইন-কানুন ও জোর জবরদস্তির কথা শুনিলে আমাদের মনে বিজাতীয় ঘূণা ও রােষের সঞ্চার হয়। এরূপ কথা শুনিলে আমরা স্পষ্টই অনুভব করিব, ইহা মুসলমানদিগের সহিত বিবাদ বিসম্বাদের কারণই আর কিছু নহে।”
এ-রকম প্রতিক্রিয়া, উনিশ শতকের শেষ থেকেই, নইমুদ্দীনরা গ্রাম-গঞ্জে মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছিলেন। বিশ শতকের চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতারা এই
৭৯
প্রতিক্রিয়ার আগুনেই ক্রমাগত বাতাস দিয়ে চলছিলেন, গ্রামের অল্প শিক্ষিত মুন্সী মৌলবিদের তারা নানানভাবে উস্কিয়ে দিচ্ছিলেন। ইসলাম ধর্মশাস্ত্রে গভীর জ্ঞানের অধিকারী অথচ পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক, এ-রকম আলেম বা মওলানার সংখ্যা ছিল খুবই কম। বিশেষ করে দেওবন্দে শিক্ষিত মওলানারা তাে ছিলেন নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদী, মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের ঘাের বিরােধী। সে কারণেই, গায়ে-গঞ্জে যারা কাঠমােল্লা নামে পরিচিত তাদেরই ওপর মুসলিম লিগারদের নির্ভর করতে হয়েছিল। ওরা সীমাহীন উৎসাহের সঙ্গে ধর্মীয় বিধানের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা হাজির করে সরলপ্রাণ গ্রামীণ মুসলমানদের মনে হিন্দু-বিদ্বেষ জাগিয়ে তােলার ক্ষেত্রে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল সাফল্য অর্জন করে ফেলেছিল।
আমাদের পাশের গ্রামের একটি মুসলমান পরিবারের কেউই গােরুর মাংস খেতাে না। একদিন রামপুর বাজারে একটি মুদি দোকানের আড্ডায় সেই পরিবারের একজন মধ্যবয়স্ক লােক এ কথাটা বলছিলেন। যারা গােরুর মাংস খায় তারা নানা ধরনের চর্মরােগে ভােগে, তাই গােরুর মাংস না খাওয়াই উত্তম,—এ-রকম একটি মতও তিনি প্রকাশ করেছিলেন। আর যায় কোথায় । আর সকলে তাকে একেবারে ছেকে ধরলাে। মুসলমান হয়ে গােরুর মাংস যে খায় না সে তাে মুসলমানই নয়—বেশ কয়েকজন সমস্বরে একথা বলে সেই গােমাংস বিরােধী লােকটির ওপর প্রায় ঝাপিয়ে পড়ে আর কি! একজন মােল্লা কিসিমের লােক এবার ‘ওয়াজনসিহত করার একটি মওকা পেয়ে যান। ওই নালায়েক লােকটি যে মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েও হিন্দুদের মতাে গােরু খাওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলছে, এতেই বােঝা যায় ওর ওপর হিন্দুদের আছর কতাে গভীরভাবে পড়েছে। হিন্দুরা এভাবেই মুসলমানের মধ্যে ঢুকে তাদের ইমান নষ্ট করে চলছে। মুসলমান ভাই সব’ মােল্লা সাহেব গলা উঁচু করে বলতে থাকেন, ‘হিন্দুদের এসব ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে। গােরু হিন্দুর দেবতা হতে পারে, কিন্তু মুসলমানের তা হালাল খাদ্য। কোনাে মুসলমান যদি গােরু খাওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলে, তবে বােঝা যাবে যে সে হালালকে হারাম বলছে। এর মানে তার ইমানের গােড়া আলগা হয়ে গেছে। আমাদের ইমান নষ্ট করছে নাছারা আর মালাউনরা। এদের থেকে তফাতে থাকতে হবে। ভাই মুসলমান, ইমান নিয়ে বাঁচতে হলে মুসলমানদের নিজেদের রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে। কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ সেই রাষ্ট্র পাকিস্তান কায়েমের জন্য আমাদের ডাক দিয়েছেন।
গােরু খাওয়া দিয়ে শুরু হয়ে কথা চলে যায় পাকিস্তানের প্রসঙ্গে। পাকিস্তানের কথা উঠতেই আসে হিন্দুর প্রসঙ্গ। মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অত্যাচারের প্রসঙ্গ। হিন্দুরা মুসলমানের ছোঁয়া খাবার তাে খায়ই না, মুসলমানকে তারা মানুষ বলেই মনে করে না। সে-সবেরই নানা দৃষ্টান্ত আড্ডায় নানা জনে নানা ভাষায় ও ভঙ্গীতে তুলে ধরতে থাকে।
ছেচল্লিশের নির্বাচনের সময়কার হিন্দুদের আড্ডাগুলােতে এক ধরনের কথা শুনেছি, মুসলমানদের আড্ডায় কথাগুলাে হয়েছে অন্য ধরনের। গাঁয়ের মুসলমানদের মুখেও তাদের স্বাতন্ত্রের কথা বেশি বেশি করে উঠে এসেছে। কংগ্রেসীরা যে স্বাধীনতা চাইছে সে স্বাধীনতা যদি তারা পেয়েই যায়, তবে এদেশের মুসলমানরা চিরকালের জন্য হয়ে যাবে তাদের গােলাম। তাই এ-স্বাধীনতা নয়, আমরা চাই মুসলমানের আজাদী, মুসলমানের রাষ্ট্র পাকিস্তান। হিন্দু আর মুসলমান এক নয়, কখনাে এক ছিল না। হিন্দু আর মুসলমানেরও কখনাে এক রাষ্ট্র হতে পারে না। হিন্দুর ভারত আমাদের নয়, আমাদের চাই পাকিস্তান। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।
৮০
মুসলিম স্বাতন্ত্রের বিষয়টি জোরেশােরে উঠে এসেছে পাকিস্তান কায়েমের লক্ষকে সামনে রেখেই—একথা ঠিক। কিন্তু পরে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি : আমাদের নেত্রকোনা অঞ্চলেও, আরাে অনেক আগেই—বিশ শতকের একেবারে গােড়ার দিকেই বেশ কিছু নেতা হিন্দুদের থেকে আলাদা করে মুসলমানের স্বার্থের কথা তুলে ধরেছেন, মুসলমানের জাগরণের জন্য বইপত্র লিখেছেন, সভা-সমিতি করেছেন। এঁদেরই একজন ইব্রাহীম খাঁ।
না, ইনি টাঙ্গাইলের সেই প্রখ্যাত প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ নন। এর নামের সঙ্গে যুক্ত আছে। ‘মুন্সী’ কথাটি—মুন্সী ইব্রাহীম খাঁ। বর্তমান নেত্রকোনা জেলার মােহনগঞ্জ থানার টেঙ্গাপাড়া গ্রামের অধিবাসী। উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে (১৮৪৮ সালে) তাঁর জন্ম। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময়ই তিনি মুসলিম রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। নেত্রকোনা অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে তিনিই ছিলেন মুসলিম স্বাতন্ত্রের প্রথম প্রচারক। মােহনগঞ্জের মতাে একটি পশ্চাৎপদ জায়গায় বিশ শতকের একেবারে গােড়ার দিকেই ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র ভাটি এলাকার মানুষকে একেবারে অবাক করে দিয়েছিলেন তিনি। সেই পশ্চাৎপদ প্রযুক্তির যুগে গ্রামের মানুষের চোখে ছাপাখানটি ছিল একটি মহা বিস্ময়। তারা এর নাম দিয়েছিল কলঘর’। দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে মানুষ আসতাে এই কলঘরটি দেখতে। এই কলঘর থেকেই মুন্সী ইব্রাহিম খা প্রকাশ করতেন একটি পত্রিকা–‘উদ্দেশ্য মহৎ। মুন্সী সাহেবের সব মহৎ উদ্দেশ্যেরই গন্তব্য ছিল মুসলমান সমাজ। মুসলমানের প্রতিপক্ষ হিসেবে তিনি দেখেছিলেন প্রতিবেশী হিন্দুদের। হিন্দুদের বিরুদ্ধে তিনি রীতিমত জেহাদ ঘােষণা করেছিলেন। এই জেহাদ ঘােষণার মধ্য দিয়ে মুন্সী ইব্রাহিম খাঁ শুধু মুসলিম স্বাতন্ত্রের আদর্শকেই উচ্চে তুলে ধরেননি, হিন্দু বিদ্বেষেরও উগ্র প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।
আমরা জানি : ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ব্যাপক গণ আন্দোলন সংগঠন করেছিল। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথও সে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন, সে সময়ই তিনি রচনা করেন বঙ্গ-প্রশস্তিমূলক অসাধারণ স্বদেশী সংগীতগুলাে। বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলনের সূত্র ধরেই গড়ে ওঠে স্বদেশী আন্দোলন। সে আন্দোলনের কর্মসূচির মধ্যেই ছিল বিদেশী দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহার। সে সময় যারা জাতীয়তাবাদী বলে পরিচিত ছিলেন, এমন অনেক বাঙালি মুসলমান নেতা, যেমন—‘আব্দুর রসুল, আবুল কাসেম, আবদুস সােবহান চৌধুরী, খাজা আতিকুল্লাহ, খান বাহাদুর মুহম্মদ ইউনুস, মুজিবর রহমান, ইসমাইল হােসেন সিরাজী—বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী স্বদেশী আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে পূর্ববাংলার মুসলমানদের একটি বিরাট অংশ ছিলেন বঙ্গভঙ্গের সমর্থক। তাঁরা বঙ্গভঙ্গকে মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূল বলে মনে করেছিলেন। নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ১৯০৬ সালে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠিত হলে তাঁরা এতে যােগ দেন, বঙ্গভঙ্গের সমর্থনে ও স্বদেশী আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানা জায়গায় সভা সমিতি করতে থাকেন। স্বদেশী আন্দোলন ছিল তাদের চোখে হিন্দুদের মতলব উদ্ধারের আন্দোলন। এর বিপরীতে তারা সংগঠন করেন স্বজাতি আন্দোলন। স্বজাতি’ বলতে তাঁরা মুসলমান সম্প্রদায়কেই বুঝিয়েছিলেন। এই স্বজাতি আন্দোলনেরই অন্যতম প্রধান সংগঠক হয়ে দেখা দেন আমাদের মােহনগঞ্জের মুন্সী ইব্রাহিম খাঁ। ১৯০৭ সালে ‘স্বজাতি আন্দোলনের সমর্থনে তিনি প্রকাশ করেন ‘লাল ইস্তেহার’। এই লাল ইস্তেহারটি ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িক বক্তব্যে ভরপুর। মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এতে লেখা হয়েছিল—
৮১
“হে মুসলমানগণ! জাগরিত হও। তহবিল সংগ্রহ কর। জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন কর। পার্যমানে হিন্দুর সঙ্গে পাঠ করিও না। জাতীয় কারবার খােল, হিন্দুর দোকান হইতে কোনাে বস্তু ক্রয় করিও না। শিল্প শিক্ষা কর, হিন্দুর শিল্পজাতি দ্রব্য স্পর্শ করিও না। হিন্দুকে চাকুরি দিও না। হিন্দুর বাড়িতে নিকৃষ্ট চাকুরি করিও না। হিন্দুর কুসংস্কারে আবদ্ধ হইয়া জাতিগত ব্যবসা (গােয়ালা প্রভৃতি ব্যবসা) ছাড়িও না। তােমাদের জ্ঞান নাই, যদি জ্ঞান লাভ করিতে পার তবে একদিনেই হিন্দুকে জাহান্নামে পাঠাইতে পার। দেখ, বঙ্গদেশে তােমাদের সংখ্যা অর্ধেক, তােমরা কৃষক, কৃষিকাজই ধন উৎপত্তির বীজ। হিন্দু ধন কোথায় পাইল, হিন্দুর ধন বিন্দুমাত্রও নাই। হিন্দু কৌশলে তােমাদের ধন নিয়া ধনী হইয়াছে। তােমরা যদি সেই কৌশল শিক্ষা করিতে পার ও জ্ঞান লাভ করিতে পার তবে একদিনেই হিন্দু অন্নাভাবে মরিয়া যাইবে বা মুসলমান হইবে।
“মুসলমান মাত্রেই হিন্দুর বিকৃত স্বদেশী আন্দোলনে যােগদান করিবেন না। হিন্দুরা মুসলমানদিগকে স্বদেশী আন্দোলনে যােগদান করার জন্য সাদরে আহ্বান করিতেছে ও অত্যাচার করিতেছে। তাহা মুসলমানদের মঙ্গলের জন্য নহে। মুসলমানগণ চিরকাল তাহাদের থাকে, ইহাই তাহাদের মূল উদ্দেশ্য। হিন্দু স্বার্থপরতা, মুসলমানদের অজ্ঞানতা’ সর্বনাশের মূল—এই দুই শক্রই মুসলমানকে অবনত করিয়াছে।”
এ-রকম একটি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষযুক্ত ইস্তেহার প্রকাশের জন্য অবিশ্যি মুন্সী ইব্রাহিম খাকে আদালতে অভিযুক্ত হতে হয়েছিল, এবং ইস্তেহারটি প্রত্যাহার করে নেয়ার শর্তে ও এক হাজার টাকার ব্যক্তিগত জামিনের বিনিময়ে তিনি খালাস পেয়েছিলেন।
মুন্সী ইব্রাহিম খাঁ মারা যান ১৯৩৩ সালে। কিন্তু ছেচল্লিশ সালে আমি তাঁর নাম শুনিনি। মােহনগঞ্জ এলাকায়, অর্থাৎ মুন্সী সাহেবের বাড়ির আশে পাশে, এখনাে তার কথা কেউ কেউ স্মরণ করে অবশ্যই। কিছু গবেষণামূলক বই পুস্তক থেকে তার সম্পর্কে নানা তথ্যও জেনে নেয়া যায়। তবু, মানতেই হবে, তাঁর মৃত্যুর বারাে-তেরাে বছরের মধ্যেই সাধারণ মানুষ তার কথা ভুলে যায়। তা না হলে পাকিস্তান আন্দোলনের রমরমার দিনগুলােতে তার নামটি অন্তত শুনতে পেতাম। অথচ, সে সময়, কিংবা এরপরও, কারাে মুখে আমি মুন্সী ইব্রাহিম খার কথা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু গবেষণা গ্রন্থে যেদিন তাঁর লাল ইস্তেহারটি পড়লাম, সেদিনই আমার মনে হয়েছিল যে, ছেচল্লিশ সালে আমাদের গ্রামাঞ্চলের মুসলমানদের মুখে ওই ইস্তেহারটির বক্তব্যই শুনতে পেয়েছি। মনে হয়েছিল : মুসলিম স্বাতন্ত্রের বােধ এ-অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মুন্সী ইব্রাহিম খাই সঞ্চার করে গিয়েছিলেন। ১৯০৭ সালে, লাল ইস্তেহার প্রকাশের সময়, সে-বােধের খুব বেশি বিস্তার হয়তাে ঘটেনি। তবে পাকিস্তান আন্দোলনের অনুকূল পরিবেশে, চল্লিশের দশকে, সে-বােধই লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছিল, শতকরা নিরানব্বই জনেরও বেশি মুসলমান সে বােধেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।
বালক মনেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সংক্রমণ রামপুর প্রাইমারি স্কুলে আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল হােসেন আলী। ক্লাস টু থেকে ফোর–১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ তিন বছর একই স্কুলে আমরা পড়াশােনা করেছি। আমাদের গভীর বন্ধুত্ব অনেকেরই ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হামিদ, রাশিদ, হাশিম উদ্দিন—এরাও ছিল আমার বন্ধু। ওরা যে ছিল মুসলমান, আর প্রাণেশ, গােপাল বা গণেশরা ছিল হিন্দু সে
৮২
সম্পর্কে আমরা সচেতন ছিলাম অবশ্যই। কিন্তু বন্ধুত্বের বিচারে হিন্দু ও মুসলমানের পার্থক্য করতে আমরা শিখিনি। অন্তত ছেচল্লিশ সালের আগে তাে নয়ই। ছেচল্লিশের ইলেকশনের সময় থেকেই অবস্থা পালটে যেতে থাকে।
আমার চৈতন্যে যখন কংগ্রেস, নেতাজী, গান্ধীজী, আজাদ হিন্দ ফৌজ, কুইট ইন্ডিয়া, বন্দেমাতরম, জয়হিন্দ—এ-রকম সব শব্দের উথাল পাথাল ঢেউ, হােসেন আলীর কাছে সে-সব তখন কতকগুলাে অর্থহীন ধ্বনিমাত্র। এ-সবের বিপরীতে যে তার নারায়ে তকবির বা পাকিস্তান জিন্দাবাদ-এর ধ্বনি প্রতিধ্বনি প্রবল হয়ে উঠেছিল, তা-ও নয়। বালক বয়সেই রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠার সুযােগ সে পায়নি। মেহনতি কৃষকের সন্তান হিসেবে সে বরং ছিল জমিসচেতন ও ফসল-সচেতন। কোন জমিতে কী ধরনের ফসল জন্মে, কখন কোন ফসলের জন্য কি ধরনের চাষ দিতে হয়, কোন বাজারে কোন্ ফসলের বীজ কেনাবেচা হয়—এসব খবর ছিল তার নখদর্পণে। ইস্কুলে পড়ার সময়ও সে একই সঙ্গে ছিল ছাত্র ও কৃষক। মেধাবী, মনােযােগী, পরিশ্রমী ও নিয়মনিষ্ঠ হওয়ার ফলে এই দুই ভূমিকাতেই তার ছিল সমান সাফল্য।
প্রায়ই সে আমাদের বাড়িতে যেতাে। আমার মা তাকে খুবই আদর করতেন, তাঁর হাতের চিড়ামুড়ি খেতে হােসেন আলীও খুবই পছন্দ করতাে। ক্লাসের পাঠ্যবিষয় নিয়ে আমাদের দু’জনের মত-বিনিময়ে দু’জনই উপকৃত হতাম। বিশেষ করে, অঙ্কে তাে হােসেন আলীই ছিল আমার শিক্ষক। তার সাহায্য না পেলে, সেই প্রাইমারি স্কুলেও, অঙ্ক পরীক্ষায় পাস নম্বর পাওয়া আমার পক্ষে সহজ হতাে না।
হােসেন আলীর সঙ্গে ক্লাসের পড়ার বাইরের নানা বিষয় নিয়ে আমিই বেশি কথা বলতাম। আমার মুখে রাজনীতির নানা কথা শুনে সে বিস্মিত হতাে খুবই, কিন্তু আগ্রহী হতাে
একটুও। তবে, ক্লাস থ্রি-এ পড়ার সময়ই হােসেন আলীকে ধর্মের ব্যাপারে খুব উৎসাহী হয়ে উঠতে দেখলাম। সে সময়ই রামপুর গ্রামের মুসলমান পল্লীতে ছেলেদের কোরান শরিফ পড়াশােনার ব্যবস্থাটি চালু হয়ে যায়। সকাল বেলায় যে-মৌলবী সাহেবের কাছে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিলে সে কোরান শরিফ পড়তাে, আমার কাছে রােজই সে সেই মৌলবী সাহেবের গল্প করতাে। সে বলতাে, “জানিস, মৌলবী সাহেব খুবই পরহেজগার লােক। ‘পরহেজগার’ শব্দটি আমার কাছে একেবারেই নতুন। হােসেন আলীই আমাকে বুঝিয়ে দেয়, ‘পরহেজগার বুঝলি না? মৌলবী সাহেব পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, কোনােদিন নামাজ কাজা করেন না। ফরজ নামাজ তাে পড়েনই, নফল নামাজও পড়েন, তাহাজ্জদের নামাজও পড়েন। হালাল ছাড়া হারাম খান না কখনাে। খুব ভালাে ওয়াজ করতে পারেন তিনি। এ-রকম লােককেই বলে পরহেজগার।
শুধু পরহেজগার’ নয়, ওয়াক্ত, কাজা, ফরজ, নফল, তাহাজ্জদ, হারাম, হালাল এবং এরকম আরাে অজস্র শব্দের তাৎপর্যও আমি হােসেন আলীর কাছ থেকে শিখে নিতে থাকলাম। এসব শব্দ কেন যে আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করতাে, তা সেদিনও বুঝিনি, আজো আমি কাউকে বােঝাতে পারবাে না। তবে এই শব্দগুলাের তাৎপর্য সন্ধান করতে করতেই ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ সেই ছােট বেলাতেই আমার মধ্যে দানা বেঁধে ওঠে। কলেজে ঢােকার আগেই যে আমি প্রচুর কৌতূহল ও আনন্দের সঙ্গে ইসলাম বিষয়ক অনেক বাংলা বই পড়ে ফেলেছিলাম, সেই কৌতূহল ও আনন্দের গােড়াপত্তন বােধ হয় হােসেন আলীই আমাকে করে দিয়েছিল। তা ছাড়া, আমার ঠাকুরদার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষার মধ্যেই ধর্ম সম্পর্কে কৌতূহলের বীজটি নিহিত ছিল সম্ভবত। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত’ বইটি আমাদের পরিবারে।
৮৩
প্রায় নিত্যপাঠ্য ছিল। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের জীবনী পড়েও আমি ছেলেবেলায় খুবই অনুপ্রাণিত বােধ করতাম। রামকৃষ্ণ অনেক ধরনের ধর্মসাধনা করেছিলেন, ইসলামের সাধনাও করেছিলেন। রামকৃষ্ণের সেই ইসলাম সাধনার বিবরণ পড়েও হয়তাে-বা আমি ইসলাম সম্পর্কে কৌতূহলী ও শ্রদ্ধাবান হয়ে থাকতে পারি।
হােসেন আলীর মুখে আমি অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শুনতাম। শুধু হােসেন আলী নয়, তার মতাে আমার সমবয়সী ও বেশি বয়সী মানুষদের মুখেও ধর্মবিষয়ক অদ্ভুত কথা কম শুনি নি। আমাদের পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে পুরাণের যে-সব দেব-দেবীর কথা জেনেছি, ওদের কাছে শুনলাম ও-সব দেব-দেবীর সঙ্গে না-কি মুসলমানদেরও অনেক সম্পর্ক ছিল। শিবের সঙ্গে আলীর কুস্তি, চণ্ডী দেবীর সঙ্গে হাওয়ার মােলাকাত, গঙ্গা দেবী আর কোন এক মুসলমান। দরবেশকে ঘিরে কি একটা ঘটনা—ওদের কাছে এ-রকম অশ্রুতপূর্ব সব গল্পগাথা শুনে লৌকিক পুরাণের এক ভিন্নতর জগৎ আমার সামনে উন্মোচিত হয়েছিল। এখন বুঝি: তাদের কাছে যা শুনেছি, ওগুলাে ঠিক শাস্ত্রীয় ইসলামের কথা ছিল না, প্রায় সবই ছিল লৌকিক ইসলাম। ওদেরই একজনের মুখে শুনলাম : নবীজির সঙ্গে আল্লাহর নব্বই হাজার বাতচিত হয়েছিল, তার মধ্যে তিরিশ হাজার মাত্র কোরানে আছে, আর ষাট হাজার হলাে বাতেনি। সেগুলাে সবাই জানতে পারে না, এর জন্যে দরকার মারেফতের সাধনা। শরিয়ত আর মারেফতের এ-রকম ভেদের কথা বাউল গানের আসরেও শুনেছি। আমাদের এলাকায় বড়াে বড়াে বাউল গায়ক ছিলেন। সিংহেরগাঁওয়ের জালাল উদ্দিন খাঁ তাে নামকরা বাউল। এ ছাড়া রসিদ উদ্দিন, মিরাজ আলী, মজিদ মিয়া এ-সব বাউলদের গানের পাল্লায় জাহের ও বাতেন, শরিয়ত ও মারেফত, দুনিয়া ও আখেরাতের নানা কথা উঠে আসতাে। এ-সব কথার তাৎপর্য কী বুঝতাম? বুঝতাম না হয়তাে। হয়তাে’ কেন, নিশ্চয়ই বুঝতাম না। তবু বাউলদের পাল্লা ও ‘ধরাট’ শুনতাম। মনােযােগ দিয়েই শুনতাম। শুনতে শুনতে এক ধরনের আবেশ এসে যেতাে। বাউলরা হিন্দুয়ানী বিষয় নিয়েও ‘পাল্লা’ করতেন। তাদের পাল্লা ও ধরাটে হিন্দুয়ানীমুসলমানী, জাহেরি-বাতেনি, শরিয়তি-মারেফতি—সব মিলে মিশে কী জানি কী একটা হয়ে যেতাে! বাউলদের পাল্লা শুনে এসে এখানে-ওখানে নানা জায়গার আডড়ায় শ্রোতারা যখন ওই সব পাল্লার বিষয় নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করতাে, তখন সে-সব মন্তব্যও আমি হা করে শুনতাম। আমার সহপাঠী হােসেন আলীর ইসলাম-ব্যাখ্যার মধ্যেও এসব কথারই প্রতিধ্বনি পেতাম। হােসেন আলীর কাছেই শুনেছিলাম ইসমে আজমের কথা। ইসমে আজম’ যে কী, হােসেন আলী তাে জানতােই না, এবং সে-ই বলতাে : এটি কেউই জানে না। কেউ যদি ইসমে আজম জানে তবে সে পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারে, আগুনে ঝাপ দিলেও তার গা পােড়ে না, হাজারাে মানুষের ভীড়ের মধ্যেও সে অদৃশ্য হয়ে থাকতে পারে।
হােসেন আলীর মুখে এ-ধরনের আজব আজব কথা শুনে আমি অন্য এক জগতে চলে যেতাম। সে-জগৎটি কংগ্রেস-ক্যুনিস্ট বা কুইট ইন্ডিয়া-জনযুদ্ধের জগৎ থেকে অবশ্যই সম্পূর্ণ আলাদা, তবু সে-জগতের কথাও আমাকে কম আনন্দ দিতাে না। প্রায়ই আমাকে ঐ জগৎটি থেকে ঘুরিয়ে আনতাে বলে হােসেন আলীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছিল।
কিন্তু ছেচল্লিশের মাঝামাঝিতেই কেমন যেন তাল কেটে গেলাে। হােসেন আলীরা নানা রকম ঠেশ-দেয়া কথা বলতে শুরু করলাে। হােসেন আলীরা মানে আমারই সহপাঠী বা খেলার
৮৪
সাথী হামিদ, রাশিদ, আজিজ, হাশিম—ওরা। ওদের ঠেশ দেয়া কথার লক্ষ হয়ে উঠলাম আমরা—মানে গােপাল, সুশীল, প্রাণেশ, দীনবন্ধুরা। সবাই মিলে যে আমরা ছিলাম এতােদিন, এখন যেন আর তা থাকছে না, কিংবা থাকতে পারছে না। ওরা বলতে লাগলাে : তােরা হিন্দুরা তাে বুইত্যা’ পূজা করিস। যারা বুইত্যা পূজা করে তারা কাফের।
‘বুইত্যা’ মানে মূর্তি। হিন্দুদের দেব-দেবীর মূর্তিকেই বুইত্যা বলে যে তারা এর প্রতি অবজ্ঞার প্রকাশ ঘটাচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরে খুবই মন খারাপ হয়ে যায়। আমরা তাে বুইত্যা দূরে থাক, দেবদেবীর মূর্তিকে মূর্তিও বলি না, বলি—প্রতিমা। কালীবাড়ির সামনে দিয়ে গেলেই কালীর প্রতিমাটিকে দু’হাত জোড় করে প্রণাম করি। এ নিয়ে ওদের কী ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ!
—“ওই বুইত্যাটার সামনে তােরা হাত জোড় করিস কেন? নিজের হাতে মাটি দিয়ে বুইত্যাটা বানালি, আবার তারই সামনে হাত জোড় করিস! ওই বুইত্যাটার কী ক্ষমতা আছে? এটিকে যদি ভেঙে গুড়াে করে দিই, ও আমাকে কিছু করতে পারবে?’
ওদেরই একজন হয়তাে পাশ থেকে ফোড়ন কাটে—“তাের ভাঙতে হবে কেন? ওরা নিজের হাতেই তাে ওই বুইত্যাগুলােকে পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে দেয়। দেখিস না চন্দ বাড়িতে প্রত্যেক বছর আশ্বিন মাসে অনেকগুলাে বুইত্যা বানিয়ে ধুমধাম করে পূজা করে, তারপর তিন দিন পরে ওগুলােকে ওদেরই পুকুরে নিয়ে ফেলে দেয়। পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে ওই বুইত্যার ভিতরের খ্যাড়গুলাে বেরিয়ে আসে, আর গােরু-ছাগলে সেগুলাে খায়।’
‘ওদের দেবতাকে গােরু-ছাগলে চিবিয়ে খায়। হি হি করে হাসতে হাসতে বলে আরেকজন।
—“আমাদের সঙ্গে ওদের মিলবে না কোনাে কিছুতেই। ওদের দেবতার মূর্তি আছে, আমাদের খােদা নিরাকার। ওদের ভগবানের আছে ভগবতী, ঈশ্বরের ঈশ্বরী। আমাদের আল্লার কোনাে আল্লীর কথা বলতে পারবে কেউ?’ রীতিমত দার্শনিকের মতাে মন্তব্য করে আমারই কোনাে এক সহপাঠী। যার নাম হাশিম বা হামিদ বা আজিজ বা এ-রকমই কিছু।
আর আমার মতাে যারা—যাদের নাম গােপাল বা প্রাণেশ বা দীনবন্ধু কিংবা এ-রকম কিছু—তারা কেবল নিষ্ফল আক্রোশে হাত পা কামড়ায়। হাশিম বা হামিদ বা আজিজদের হাড়-জ্বালানাে কথার কী মােক্ষম জবাব দেয়া যায়, বাড়িতে এসে গুরুজনদের তাই জিজ্ঞেস করে। বয়স্ক গুরুজনরা ধমকে ওঠেন।
–‘ওদের ও-সব অসভ্য কথার আবার জবাব কী? ওই ছােটলােকের বাচ্চাদের সঙ্গে মিশবি না কখনাে। ওরা খায় গােরু, বুদ্ধিও তাে ওদের গােরুর মতােই হবে। আর্যশাস্ত্রের গভীর অর্থ বুঝবার মতাে বুদ্ধি ওরা কোথায় পাবে?’।
বড়াে হয়ে ভেবে দেখেছি: গুরুজনরা এ-ধরনের কথা বলে গুরুতর অন্যায়-আচরণেই আমাদের প্রবৃত্ত করেছেন। মানুষকে ঘৃণা করা যে অন্যায়, সে-বােধটি কি আমাদের সকল গুরুজনই হারিয়ে ফেলেছিলেন? আমাদের যারা কাফের বলে গালিগালাজ করেছে, দেবতা ও পুজো-আচ্চা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছে, তারা এসব করতে শিখেছে কোথায়? তাদেরই গুরুজনের কাছে তাে? আর আমাদের গুরুজনরা প্রতিপক্ষকে ‘ছােট লােকের বাচ্চা’ বলে— এবং নিজেদের আর্য বলে জাহির করে সন্তানদের মনে মিথ্যা অহমিকার বীজ রােপণ করে দিলেন, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে চিরস্থায়িত্ব দানের ব্যবস্থা করলেন।
৮৫
আমাদের যুবক বয়সী দাদা ও কাকা সম্পর্কীয়দের কেউ কেউ আবার সাম্প্রদায়িক প্রতিপক্ষের গালাগালি জবাব দেবার জন্যে আমাদেরও ইতর গালাগালির অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করে তুলতে চাইলেন। নীরু দা বা জীবন দা বা ললিত কাকাদের মতাে যুবকরা মুসলমানদের সম্পর্কে এমন সব বদ কথা আমাদের শিখিয়ে দিতেন যে, ওগুলাে শুনলে মুসলমানরা নিশ্চয়ই গায়ে বিছুটি লাগলে যে-রকম হয় সে-রকম চিড়বিড় করে উঠবে।
বিছুটিকেই নেত্রকোনা-কিশােরগঞ্জে বলে চুত্রা। এই চুত্রা নিয়েই একদিন আজিজ না আর কার মুখে গা-জ্বালানাে কথা শুনতে হলাে।
–তােরা হিন্দুরা তাে হরির পূজা করিস। তুলসী গাছ তােদের এই হরি দেবতার গাছ। এই তুলসী পাতা আমরা সারা শরীরে ঘষতে পারি, আমাদের কিছু হবে না। কিন্তু আমাদের আল্লার গাছের পাতা তােরা গায়ে লাগাতে পারবি? আল্লার গাছ কি জানিস? চুত্রা গাছ। চুত্রা পাতা গায়ে লাগলেই বুঝতে পারবি, তােদের হরি বড়াে না আমাদের আল্লা বড়াে।’
ওরা কয়েকজন আমাদের মুখের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে ছড়া কাটতে থাকে—‘হরির পাতা বড়ি বড়ি/আল্লার পাতা ঢাল্লা ঢাল্লা।
এর পাল্টা কোনাে জুৎসই ছড়া আমরা মনে করতে পারছিলাম না। অথচ এভাবে হার মানাও যায় না। এবার প্রাণেশ একেবারে মরীয়া হয়ে বলতে থাকে, তােদের আল্লাকে তােরা এতাে চিৎকার করে ডাকিস কেন রে? আল্লা কি কালা না-কি! রােজ কানে হাত দিয়ে কানফাটা চিৎকার করে আল্লাকে ডেকে তােদের মােল্লারা কি বলে জানিস? বলে—আল্লা, মরিচ চুরি করবাে না। আল্লা, বেগুন চুরি করবাে না। তােরা তাে চোরের জাত, তাই…’।
এ-রকমভাবেই নানা কুৎসিত কথার পাল্লা চলতে থাকে। নােংরামি আর অশ্লীলতায় কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, তারই প্রতিযােগিতা চলে। সব সময় এ-প্রতিযােগিতা মুখের কথার মধ্যে সীমিত থাকে না, হাতাহাতিও হয়ে যায় কখনাে কখনাে।
কিন্তু যখন খবর আসে বিহারে কলকাতায় নােয়াখালিতে হিন্দু-মুসলমানের বিরােধ আর গালাগালি বা হাতাহাতির স্তরে আটকে নেই, ভয়াবহ মারামারি আর রক্তারক্তির পর্যায়ে উঠে গেছে, তখন আমাদের গালাগালি-হাতাহাতি বন্ধ হয়ে যায়। না, আমাদের এলাকায় ছেচল্লিশ সালে হিন্দু-মুসলমানে মারামারি বা রক্তারক্তি হয়নি। হয়েছে তার চেয়ে অনেক বড়াে ও বেশি কিছু। মানুষ নিহত হয়নি, নিহত হয়েছে মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস। মানুষ মানুষ থাকেনি, হয়ে গেছে হিন্দু কিংবা মুসলমান।
মনুষ্যত্বের গােরস্তান তৈরি করেই এভাবে পাকিস্তানের জন্মলগ্নটিকে এগিয়ে আনা হয়েছে।

কলাপাতার দুই পিঠেতে দুই জাতির খানা’
নােয়াখালির দাঙ্গার খবর যখন আমাদের গায়ে এসে পৌছলাে, তখন আমাদের সে কী উত্তেজনা! কী ভীতি আর ক্রোধ! এখানেও দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে যে কোনাে সময়। হিন্দুদের কথা : নেড়েদের কী বাড়টাই না বেড়েছে।
হিন্দুদের সম্পর্কে মুসলমানদের ঘৃণা যেমন প্রকাশ পায় মালাউন, কাফের, বুৎ পূজারি ইত্যাদি শব্দ দিয়ে, হিন্দুরাও তেমনি মুসলমানদের সম্পর্কে ব্যবহার করে নেড়ে’ শব্দটি।
‘তেতুল নয় মিষ্টি, নেড়ে নয় ইষ্টি’—এ-রকম প্রবাদ পশ্চিমবঙ্গে চালু আছে বলে শুনেছি। পূর্ববঙ্গের নাইড়্যা’ কথাটিরই অভিশ্রুতি হয়ে পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে ‘নেড়ে’। ইতিহাসবিদ বলেন : এক সময় বাংলার নেড়ে বা মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধরাই ব্যাপকহারে ইসলাম গ্রহণ করেছিল বলে মুসলমানরা এই ‘নেড়ে’ আখ্যাটি পেয়ে যায়। কাজেই শব্দটিতে তেমন দূষণীয় বা অবজ্ঞাসূচক কিছু আছে বলে মনে করা যায় না। তবু, ‘নেড়ে’ শব্দটির ব্যবহার ঘৃণা ও অবজ্ঞারই দ্যোতক। আসলে কোনাে শব্দের ব্যুৎপত্তির মধ্যেই সব সময় ঘৃণাবাচকতা বা শ্রদ্ধাবাচকতা থাকে না। একটি শব্দ ঘৃণাবাচক বা শ্রদ্ধাবাচক হয়ে ওঠে শব্দটির ব্যবহারকারীর মনােভাব বা দৃষ্টিভঙ্গীর ফলে। নেড়ে’ শব্দটির বেলাতেও তা-ই হয়েছে। নেত্রকোনা অঞ্চলে হিন্দুদের মধ্যে নাইড়া কথাটির অবজ্ঞাসূচক ব্যবহার থাকলেও, সবচেয়ে বেশি চালু ছিল ‘দারি’ শব্দটি। দারি’ কি দাড়ি’র উচ্চারণ ভেদ? মুসলমানরা দাড়ি রাখে বলেই কি তাদের দারি’ বলা হতাে? হতেও পারে। ছেচল্লিশে নােয়াখালির দাঙ্গার পর সাধারণভাবে হিন্দুরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, ওই নেড়ে বা দারি ব্যাটাদের কিছুতেই বিশ্বাস নেই, এমন কি ওদের পুঁচকে ছোঁড়াদেরও। তাই, আমাদের প্রতি অভিভাবকদের নিষেধ বিধি জারি হয়ে গেলাে : আমরা যেন মুসলমান। ছোঁড়াদের সঙ্গে বেশি ঘষাঘষি না করি, ওদের সঙ্গে গলাগলি করতে না যাই। নােয়াখালিতে ওরা যে কাণ্ড ঘটিয়েছে, এখানেই যে ওরা তা ঘটাবে না—এমন কথা কে বলবে? দুদিন আগে যারা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, তারাই এখন সন্দেহের পাত্র হয়ে গেলাে। কেবল জন্মের কারণে, অর্থাৎ তারা জাতে মুসলমান বলে। তাদের সঙ্গে কথা বলি, কিন্তু আগের সেই উত্তাপ নেই। গল্প করতে করতে আগের মতাে একাত্মও হয়ে যাই না। আবার মতান্তর ঘটিয়ে গালাগালিও করি না। মারামারি যাতে না বেধে বসে, সে-ব্যাপারে তাে খুবই সতর্ক থাকি। সব সময়ই কেবল মনে হয় : নােয়াখালিতে যারা হিন্দু মেরেছে, আর আমার পাশে বসে আছে যে হামিদরশিদ-আজিজ-হােসেন আলীরা, তারা সবাই এক। ওরা যে কোনাে মুহূর্তে আমার পেটে ছুরি বসিয়ে দিতে পারে। আবার ওদের চোখ মুখ ও কথা বলার ভঙ্গি দেখেও মনে হয় যে, ওরাও আমাদের সম্পর্কে ও-রকমই ভাবছে। ওদের অভিভাবকরাও নিশ্চয়ই আমাদের সম্পর্কেও ওরকম ধারণাই ওদের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কলকাতায় যারা মুসলমানদের মেরেছে তারাও হিন্দু, আমরাও হিন্দু। কাজেই আমরা যে কায়দা পেলে এখানেও মুসলমানদের মেরে বসবাে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
ছেচল্লিশ সালের গােড়ায়, নির্বাচনের সময়ও, আমার সহপাঠী গ্রাম্য মুসলিম বালকদের মধ্যে কোনােরূপ রাজনীতি-সচেতনতা দেখিনি। সে-সময়ে আমি যে-রকম অতি উৎসাহী কংগ্রেস সমর্থক হয়ে উঠেছিলাম, জয় হিন্দ বন্দেমাতরম্ মহাত্মা গান্ধী কি জয় নিয়ে মেতেছিলাম, ‘ভােট দিবেন কিসে? কলস মার্কা বাক্সে’ বলে যখন তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলাম—হােসেন আলীরা মােটেই সে-রকম করেনি। তারা কেউ আমার কংগ্রেস সমর্থনের বিপরীতে মুসলিম লীগ সমর্থক হয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ, মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ বা নারায়ে তকবির স্লোগান দিয়ে মুসলিম লীগের মিছিলের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করেনি। আসলে নির্বাচনের সময়েও আমাদের এলাকায় মুসলিম লিগারদের মিছিল টিছিল করার খুব একটা প্রয়ােজনই পড়েনি। কারণ মুসলিম লীগ প্রার্থী আহসান আলীর প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থান ছিল খুবই দুর্বল। অনায়াসেই, বলতে গেলে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই, মুসলিম লীগের জয় হয়ে গিয়েছিল।
মুসলিম লীগের তথা পাকিস্তান পন্থীদের কর্মতৎপরতা শুরু হলাে নির্বাচনের পর। আগস্ট মাসে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’-এর ঘঘাষণা, এবং তারপরই কলকাতার দাঙ্গা বা ‘দ্য গ্রেট
৮৭
ক্যালকাটা কিলিং’ এবং এরও পর নােয়াখালির সেই অশ্রুতপূর্ব অমানবিক ঘটনাবলি । কলকাতার দাঙ্গায় হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানদেরই বেশি সংখ্যায় প্রাণ দিতে হয়েছিল, তাদের ক্ষতির পরিমাণটাও ছিল বিপুল। তবে দাঙ্গার উস্কানিটা দিয়েছিল মুসলিম লীগই। ছেচল্লিশের আগস্ট মাস ছিল মুসলমানদের রমজান মাস। সে-সময় কলকাতার মেয়র মুহম্মদ ওসমান ছিলেন কলকাতা জেলা মুসলিম লীগেরও সেক্রেটারি। তারই স্বাক্ষরিত একটি পুস্তিকায় প্রচার করা হয়েছিল—
“এই রমজান মাসে ইসলাম ও কাফেরদের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য যুদ্ধ আরম্ভ হয়,…এই রমজান মাসেই আমরা মক্কায় জয়লাভ করি এবং পৌত্তলিকদের নিশ্চিহ্ন করিয়া দেই। এই মাসেই ইসলামের বুনিয়াদ স্থাপিত হয়। আল্লার ইচ্ছায় পাকিস্তান লাভের উদ্দেশ্যে জেহাদ আরম্ভ করিবার জন্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগ এই রমজান মাসই ঠিক করিয়াছেন।”
কলকাতার এই জেহাদে কাফের ও পৌত্তলিকরা নিশ্চিহ্ন হয়নি অবশ্যই, তবে মুসলিম লীগ নেতারা যে পবিত্র ইসলামের নাম ব্যবহার করে মানবিক মূল্যবােধকে সাময়িকভাবে হলেও নিশ্চিহ্ন করে দিতে পেরেছিল এ কথা ঠিক। মুসলিম লীগের সমান্তরালেই সনাতন হিন্দুত্বের নামে ছুরি-পিস্তল নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছিল হিন্দু মহাসভা। আর এর ফলে ছেচল্লিশের ১৬ থেকে ১৯ আগস্ট—এই চার দিনে কলকাতায় যা ঘটেছিল তার বর্ণনা দিয়ে ‘দাঙ্গার ইতিহাস প্রণেতা শৈলেশ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—“চারদিনের এই নরমেধ যজ্ঞে কমপক্ষে ৫ হাজার (মতান্তরে ১০ হাজার) নর-নারী-বৃদ্ধ-শিশু নিষ্ঠুরভাবে নিহত, ১৫ হাজারের মতাে আহত, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ভস্মসাৎ অথবা লুণ্ঠিত ও নারীর অমর্যাদার ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তার জন্য হিন্দুদের স্বধর্মীয়দের এবং মুসলমানদেরও মুসলিম অধ্যুষিত পাড়ায় বিপুল সংখ্যায় স্থানান্তরণ করে দেশ বিভাগের ভিত্তি রচনা করা হয়। বলা বাহুল্য চারদিনের এই প্রাথমিক মারণযজ্ঞে হিন্দু ও মুসলমান এক সঙ্গে থাকতে পারে না এবং তাই দেশ বিভাগ অপরিহার্য—এই মানসিকতারও বীজ বপন হয়।”
কলকাতার পর নােয়াখালি। নােয়াখালিতে ‘এক তরফা হিন্দু নিধন ও উৎপীড়ন’-এর অনেক খবর সে-সময়েই আমাদের কানে আসে গুজব আকারে। গুজবের তাে অনেক হাত-পা গজায়, তাই তার ওপর নির্ভর করে সত্য নির্ণয় করা যায় না। তবে বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ইতিহাসকার শৈলেশ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবরণকে অবশ্যই নির্ভরযােগ্য বলতে পারি। তিনি ‘ননায়াখালি অঞ্চলে হিন্দু বিরােধী মানসিকতার ব্যাপক প্রচারের পিছনে বিশেষ একটি স্থানীয় রাজনৈতিক কারণ’-এর উল্লেখ করেছেন। সে-কারণটি হলাে ‘এক শ্রেণীর মুসলমান দ্বারা পিররূপে পূজিত লীগের স্থানীয় নেতা মিঞা গােলাম সারওয়ারের নব দীক্ষিতের উৎসাহে সাম্প্রদায়িকতার প্রচার ও সংগঠন। শৈলেশ বাবু লিখেছেন, “এছাড়া কলকাতার দাঙ্গায় দ্বিতীয় দিন থেকে মার খাওয়া মুসলমানদের দুঃখ দুর্দশার কাহিনীও ইতিমধ্যে ঐ এলাকায় পল্লবিত হয়ে প্রচারিত হয়।…
“১০ই অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে প্রায় পনের দিন একটানা এবং তারপরও গান্ধীজী ও তার সহকর্মীরা ঐ প্রায় ৫০০ বর্গ মাইল এলাকার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে সংখ্যালঘু (শতকরা মাত্র ১২ জন) হিন্দুদের মনে সাহস সঞ্চার না করা পর্যন্ত এক তরফা হিন্দু উৎপীড়ন চলতে থাকে। লীগ সরকার প্রায় এক সপ্তাহ এ খবর প্রকাশিত হতে দেননি। ব্যাপক হত্যা (সঠিক সংখ্যা ঐ অবস্থায় জানা কঠিন।) লুণ্ঠন এবং অগ্নি সংযােগের ঘটনাবলিতে প্রায় ৫০ হাজার
৮৮
নরনারী প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে একটি হিসেবে পাওয়া যায়। ব্যাপক বাস্তুত্যাগের ঘটনাও ঘটে ঐ একতরফা আক্রমণের ফলে। কিন্তু এসব থেকেও শােচনীয় ব্যাপার হলাে বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস বা অপবিত্র করা, বহু ব্যক্তিকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ এবং সর্বোপরি বহু নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করা ও জোর করে দাঙ্গায় সদ্য বিধবা ও তরুণী-বৃদ্ধাকে এক শ্রেণীর মুসলমানের সঙ্গে বিবাহ দেয়া।”
নােয়াখালির পর বিহার। এবং বিহারে নােয়াখালির বিপরীত ঘটনা। অর্থাৎ একতরফা মুসলিম নিধন ও উৎপীড়ন। ইতিহাসকারের ভাষায় ‘বিহারের দাঙ্গায় এক জোর করে ধর্ম পরিবর্তন করা ছাড়া মুসলমানদের ওপর আর সব রকমের অত্যাচার, এমন কি নারীর অসম্মানও করা হয়।’
এ-সবের ফলে, বা এ-সবের মধ্য দিয়ে সারা দেশে মুসলমান সমাজের নিরঙ্কুশ ও সক্রিয় সমর্থন গেয়ে পেলাে মুসলিম লীগ। এবং সে-সমর্থন যে বালক-কিশাের পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ে, তারই প্রমাণ পাওয়া গেলাে আমার সহপাঠী হােসেন আলী-হামিদ-রশিদ-গফুরআজিজদের মধ্যে। দুদিন আগেও যাদের ভেতর রাজনীতি সচেতনতার বাষ্পমাত্রও দেখিনি, এখন রাতারাতি তারাই সকলে নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম লিগার, একেকজন ‘ক্ষুদে কায়েদে আজম। তাদের অবিভাবক শ্রেণীর মানুষদের কাছ থেকেই তারা মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের দীক্ষা পেয়েছিল নিশ্চয়, তবু বয়স্ক অভিভাবকদের সবাই যে পাকিস্তানি জায় একেবারে ভেসে গিয়েছিল তা নয়। আমার বালক বন্ধুরাই বরং তাদের বয়স্ক অভিভাবকদের চেয়ে বেশি মাত্রায় মুসলিম লীগ হয়ে গেলাে। এবং হওয়াই অবিশ্যি স্বাভাবিক। বেশি বয়সী মানুষের চেয়ে কম বয়সীদের উৎসাহ তাে বেশিই থাকবে। আর তাই আমার সহপাঠী মুসলমান বালককিশােররা বিপুল উৎসাহে লেগে গেলাে মুসলিম লীগের দ্বি-জাতিতত্ত্বের দর্শন প্রচারে। তাদের মুখেই যেন এ দর্শন সুনির্দিষ্ট ভাষারূপ পেয়ে যায়। বলা যেতে পারে, তারাই হয়ে ওঠে এ দর্শনের মুখ্য প্রচারক।
চিলুমচি আর দস্তরখানা সকল জাতে চিনে না,
কলাপাতার দুই পিঠেতে দুই জাতির খানা।
এ-রকম একটা ছড়া গাঁয়ে গঞ্জে শুনেছি। হিন্দু মুসলমান যে দুই জাতি, তারই অকাট্য প্রমাণ দেয়ার জন্য বােধ হয় অজ্ঞাতনামা ছাড়াকার এই ছড়াটি রচনা করেছিলেন। মুসলমানরাই চিলুমচি আর দস্তরখানা ব্যবহার করে, হিন্দুরা তাে এগুলাে চেনেই না। সব মুসলমানই কি চেনে? চিলুমচি আর দস্তরখানা তাে আশরাফ ও অর্থবান মুসলমানদের ব্যবহার্য বস্তু, আতরাফ ও অর্থহীন মুসলমানদের কাছে এগুলাে কোনাে অর্থই বহন করে না। কাজেই সাধারণ মুসলমানের পরিচয়-চিহ্ন খোঁজার জন্যই কলাপাতার শরণ নিতে হলাে। মুসলমানরা মাটির শানকিতে ভাত খায়, হিন্দুরা খায় না। হিন্দুরাও অবিশ্যি মাটির শানকিতে ভাত খেতে পারে, তবে একবার মাত্র। একবার ভাত খেয়েই শানকিটি ফেলে দিতে হবে, দ্বিতীয়বার আর তা স্পর্শও করা যাবে না। তাদের মতে, মাটির পাত্রে একবার খাবার খেলেই তা চিরকালের জন্য উচ্ছিষ্ট বা সকড়ি হয়ে যায়। মুসলমানদের সকড়ি বলে কিছুই নেই। কাজেই হিন্দু আর মুসলমানের পার্থক্য দেখাবার জন্য এই মাটির শানকির উদাহরণটি ছড়াকার উল্লেখ করতে পারতেন। কিন্তু শানকিও তাে পয়সা দিয়ে কিনে আনতে হয়, সে পয়সা জোগাড় করা তাে গরিষ্ঠ সংখ্যক মুসলমান বা হিন্দুর পক্ষেই কঠিন। তাই সকলের কাছে একান্ত সহজলভ্য
৮৯
কলাপাতার ব্যবহার গ্রাম-গঞ্জে অত্যন্ত ব্যাপক। এমন কি বড়াে লােকদের বড়াে বড়াে ভােজেও এর ব্যবহার চলে। আবিষ্কৃত হলাে ; এই কলাপাতার ব্যবহারেও হিন্দু ও মুসলমানের স্বাতন্ত্র আছে; হিন্দুরা খায় কলাপাতার উপরের পিঠে, আর মুসলমানরা তার উল্টো পিঠে। ব্যস, এরা যে আলাদা দুই জাতি—এখানেও তার প্রমাণ পাওয়া গেলাে।
এই কলাপাতার দু’পিঠের উল্লেখ করে মুসলমান বালক বন্ধুরা কতােভাবেই না আমাদের বিদ্রুপে জর্জরিত করে তুলতাে।—“তােরা তাে কাউয়ার গু খাস। কলাপাতার উপরের পিঠটায়ই তাে কাউয়ায় হাগে। আমরা খাই নিচের পিঠটায়, সেটা কতাে পরিষ্কার দেখেছিস?”
ধুতি-লুঙ্গি, টিকি-দাড়ি, মালা-তসবিহ আর গােরু পূজা-গােরু খাওয়ার দ্বন্দ্বসমাস তাে আছেই, এরই সঙ্গে কলাপাতার দুই পিঠেতে দুই জাতির খানা’র মতাে একটি মহাতুচ্ছ ব্যাপারকেও উচ্চে তােলা হলাে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রমাণ হিসেবে। মুসলমানের পানি আর হিন্দুর জল, মুসলমানের আণ্ডা আর হিন্দুর ডিম, মুসলমানের গােসল আর হিন্দুর স্নান—এ-সবের মধ্যে যে একেবারে আকাশ-পাতাল ব্যবধান (না, আসমান-জমিন ফারাক), এ মহাসত্যও (!) সে-সময়ই আবিষ্কৃত হয়েছিল। গােরু যেমন হিন্দুর জন্য নিষিদ্ধ খাদ্য, মুসলমানের জন্য শূকরও তেমনি হারাম। কিন্তু বাঙালি হিন্দুরাও শূকর খায় না, তাদের তাে আর শূয়াের খাের’ বলে গালি দেয়া যায় না। তাই তারও একটা বিকল্প খুঁজে বের করা হলাে। হিন্দুরা কাউট্যা ও কাছিম খায়, মুসলমানরা খায় না। শূয়াের খাের’ না হলেও হিন্দুরা কাউট্যা খাের, কাছিম খাের। কাউট্যা-কাছিম খাের তাে শূয়াের খােরের মতােই জঘন্য। তা ছাড়া মুসলমানরা পশুকে জবাই করে, হিন্দুরা দেয় ‘বলি। হিন্দুরা নাকি জলপাত্র রূপে ঘটি বা গাড়ু ব্যবহার করে, আর মুসলমানরা বদনা। আমি কিন্তু অনেক হিন্দু বাড়িতেও বদনা দেখেছি, আমাদেরও একটি ছিল । তবু কবে থেকে যে ঘটি বা গাড়ু হিন্দু এবং বদনা মুসলমান হয়ে গেলাে আমার জানা নেই। তবে, ছেচল্লিশের বেশ আগেই যে হয়েছিল তার প্রমাণ মেলে নজরুলের ব্যঙ্গ কবিতা ‘প্যাক্ট’এ‘বদনা-গাডুতে পুনঃ ঠোকাঠুকি…’
নামের আগে সকল বাঙালিই ‘শ্রী ব্যবহার করতাে—এতে হিন্দু-মুসলমানের কোনাে ভেদ ছিল না। মুসলমানও যে শ্রী’ লিখতাে তার ঐতিহাসিক প্রমাণ তাে রয়ে গেছে ষােড়শ শতাব্দীর ইশা খাঁর বিখ্যাত কামানে, যাতে স্পষ্ট লেখা আছে শ্রী ইছা খা’ নামটি। এখনাে মুসলমান বাড়িতে জমি কেনাবেচার পুরনাে দলিল খুললেই দেখা যাবে : ‘কস্য পত্রমিদং কাৰ্যঞ্চাগে লিখিতং শ্রী সেখ আমজাদ আলী, পিতা শ্রী সেখ রমজান আলী, জাতি মুসলমান, পেশা— গৃহস্থী…। দ্বিজাতিতত্ত্বের উন্মেষের দিনগুলােতেই মুসলমান তার পরিধান থেকে যেমন ধুতি বর্জন করেছিল, তেমনি নাম থেকে করেছিল শ্ৰী বর্জন।
এভাবেই নানা কিছু বর্জন ও ধারণের মধ্য দিয়ে মুসলমান নামক একটি ধর্মীয় কমিউনিটিকে নেশনে রূপ দেয়া হলাে ইংরেজি নেশন শব্দটির বাংলা ভাষান্তর রূপে জাতি’ কথাটির নতুন ব্যবহার দিয়েই—এবং এতাবকাল ধরে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত জাতি’ শব্দটির অন্য সকল ব্যঞ্জনাকে বেমালুম অস্বীকার করেই—জোরের সঙ্গে বলা হলাে যে, মুসলমানরা একটি জাতি। একই দেশমাতা ও ভাষামাতার স্তন্যে লালিত হয়েও, একই ক্ষেতের একই রকম ফসল খেয়েও, একই রকম জীবন-সংগ্রামে লিপ্ত থেকেও হিন্দু আর মুসলমান হয়ে গেলাে আলাদা আলাদা দুটি জাতি। দুই পৃথক জাতির জন্য চাই পৃথক দুটি রাষ্ট্র। দুদিন আগেও, নজরুলের ভাষায়, ‘একই বৃন্তে দু’টি কুসুম’ হয়ে ফুটে থাকলেও এখন তাদের বৃন্তচ্যুত না হলেই চলবে না।
৯০
ধর্মীয় সম্প্রদায়কেই জাতি’ নামে প্রতিষ্ঠা দিয়ে একটি মিথ্যার নিপুণ শিল্প সৃষ্টিতে পূর্ণ। সফলতা লাভ করলাে মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক দলটি। তার এই সফলতার পেছনে সমাজ পরিবেশের আনুকূল্যও অবশ্যই ক্রিয়াশীল ছিল। সাধারণভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদ তথা বর্ণাশ্রমবাদী হিন্দুসমাজের সংকীর্ণতা ও কূপমণ্ডুকতা এখানে একটি বড়াে ভূমিকা পালন করেছে। হিন্দুরা রক্ষণশীলতার দুর্গ তৈরি করে তাতে কচ্ছপের মতাে হাত-পা নিজের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে রয়েছে, বাইরের কাউকে এ-দুর্গে তাে ঢুকতেই দেয়নি, বরং নিজের মানুষদেরও কারণে-অকারণে বাইরে ঠেলে দিয়েছে—এসব অভিযােগ মােটেই মিথ্যা নয়। ব্রাহ্মণ্যবাদের দুর্গ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা হিন্দুরাই যে মূলত এদেশের মুসলমান সমাজ গঠন করেছে, সঙ্গত কারণেই যে সে সমাজটি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ ঘােষণা করবে এবং তা করেছেও এ-কথাও সত্য। সত্য এ-কথাও যে : জমিদার-তালুকদারমহাজনদের মতাে গ্রাম্য শােষকগােষ্ঠী চাকুরে আমলাদের সুবিধাভােগী চক্র—সবই গড়ে উঠেছে হিন্দু সমাজের উপরতলা-থেকে-আসা মানুষদের নিয়েই। তবে এই মুষ্টিমেয় হিন্দুদের প্রতাপান্বিত উপস্থিতিই মুসলমান সমাজের বিপুল সংখ্যক মানুষদের এগিয়ে যাওয়ার পথে যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এ-সত্যকে দেখতে চাইবে না যারা তারা চোখ থাকতেও অন্ধ। যারা অন্ধ নয় তারা স্বীকার করবেই যে, ইংরেজ রাজত্বে বর্ণ হিন্দুদের একটি গােষ্ঠী সকল সামাজিকঅর্থনৈতিক সুবিধা-সুযােগ কবজা করে নিয়েছিল বলেই সুবিধাবঞ্চিত মুসলমানরা নানা বাস্তব ও কল্পিত পার্থক্যগুলােকে একত্র করে হিন্দুদের থেকে নিজেদের পৃথক বলে ভাবতে প্ররােচিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে প্ররােচনা এসেছিল ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতির অনুসারী শাসক ইংরেজদের তরফ থেকেও। এভাবে ভেতরের বাস্তব ও বাস্তবের বিভ্রম এবং বাইরের প্ররােচনা দিয়েই মুসলিম লীগ গড়ে তুলেছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব নামক একান্ত অভিনব ও নির্জলা মিথ্যা তত্ত্বটিকে। মুসলিম লীগ এমন নৈপুণ্যের সঙ্গে এ তত্ত্বটি তৈরি করেছিল যে দেশের প্রায় সকল মুসলমান এর মােহিনী মায়ায় পুরােপুরি মজে গিয়েছিল, একটা চূড়ান্ত মিথ্যাকেই একান্ত সত্য বলে ধরে নিয়েছিল। এ তত্ত্ব এমন বিভ্রম ছড়িয়েছিল যে, আমার কিশাের বন্ধুরাও হঠাৎ করে একেকজন কাঠমােল্লা হয়ে গেলাে।
সম্প্রদায়ই জাতি—এই অপতত্ত্বের ধাক্কায় জাতীয়তাবাদী মুসলমানরা তাে হয়ে পড়লেন প্রায় অচ্ছুৎ। অনেক জাতীয়তাবাদীও মুসলিম লীগের খাতায় নাম লিখিয়ে ঘাের সাম্প্রদায়িকতাবাদীতে পরিণত হলেন। আবার যে শেরে বাংলা ফজলুল হকের নাম প্রচারিত হয়েছিল লাহাের প্রস্তাব বা পাকিস্তান প্রস্তাবের প্রস্তাবক রূপে, তিনিই এ-সময়ে চিহ্নিত হয়ে গেছেন প্রস্তাবিত পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে। আর সে-সময়, পাকিস্তানের শত্রু মানে মুসলমানের শত্রু। কাজেই মুসলমান এমন শত্রুকে সহ্য করবে কেন? নেত্রকোনা শহরে মিটিং করতে এসে চরম অপমানিত ও লাঞ্ছিত হলেন শেরে বাংলা। আর, কী আশ্চর্য, মুসলিম লীগ তাকে অপমান ও লাঞ্ছিত করতে পারলাে মুসলমান কৃষক-প্রজাদের হাত দিয়েই। অথচ, দু’দিন আগেও এই শেরে বাংলাই ছিলেন কৃষক-প্রজাদের নয়নমণি।
জাতীয়তাবাদী কিংবা কৃষকপ্রজাপন্থী মুসলমানদের চেয়ে করুণ অবস্থা হলাে আন্তর্জাতিকতাবাদী ও সাম্যবাদী মুসলমানদের। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের রাহু এসে গ্রাস করলাে লেনিনের দ্বিজাতিতত্ত্বের সূর্যকে। লেনিনের দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রত্যেক জাতির ভেতর দেখে দু’টি করে জাতি—শােষক ও শােষিত। আর জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বে মুসলমান আর হিন্দু—এই দু’টি মাত্র জাতি। হিন্দু মানেই শোষক, মুসলমানের মধ্যে শােষকের কোনাে অস্তিত্বই নেই। হিন্দুদের
৯১
আধিপত্য-মুক্ত হয়ে মুসলমানের পাকিস্তান কায়েম হলে শােষক-শােষিত বলে কিছুই থাকবে না। এ-রকম একটি জঘন্য প্রতারণার মাদক দিয়ে গােটা দেশের একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নেশাগ্রস্ত করে মুসলিম লীগ পাকিস্তান নামক একটি পিশাচের জন্মকে সম্ভব করে তুললাে। সেই পিশাচের গানের ধ্রুবপদ—কলাপাতার দুই পিঠেতে দুই জাতির খানা’।

হিন্দুর জাতপাত ও হিন্দু মহাসভার ‘প্রগতিশীল’ ভূমিকা
নােয়াখালির দাঙ্গার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশেই একটা দাঙ্গা দাঙ্গা ভাবের সংক্রমণ ঘটে যায়। দাঙ্গা বাধানাের জন্যে না হলেও সম্ভাব্য দাঙ্গা প্রতিরােধের প্রস্তুতির জন্যে জোট বাঁধতে থাকে সবাই। শুধু জোট বাঁধলে তাে হবে না, অস্ত্রও জোগাড় করতে হবে। তখন তাে অন্তত গ্রামাঞ্চলে, এখনকার মতাে বােমা-বন্দুকের ছড়াছড়ি ছিল না। দা, বটি, ছুরি, চাকু–গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার্য এসব অস্ত্রই তখন মারণাস্ত্র রূপেও ব্যবহৃত হতাে। মাছমারার কোচও মানুষ মারার কাজে লাগতাে কখনাে কখনাে। তবে সনাতনী লাঠিই ছিল সবচেয়ে বড় অস্ত্র, লাঠিয়ালই ছিল বড় যােদ্ধা। ছেচল্লিশেও দেখলাম বাঁশ কেটে প্রচুর লাঠি তৈরি হচ্ছে, দক্ষ লাঠিয়ালদের খাতির বেড়ে যাচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জে আরেকটি অস্ত্র তৈরিরও ধুম পড়ে গিয়েছিল সেসময়। সেটির নাম হলঙ্গা। সুপারি গাছ ফালা ফালা করে কেটে লম্বা লাঠি বানিয়ে সেই লাঠির আগাটা বর্শার মতাে সুঁচালাে করে নিলেই তৈরি হয়ে যায় হলঙ্গা।
কিন্তু লাঠিই হােক আর হলঙ্গাই হােক সেটি চালাবার জন্যে তাে মানুষ লাগবে। হিন্দু ‘ভদ্রলােকের পাড়ায় সে-মানুষ কই? ভদ্রলােক মানেই হলাে পরগাছা পরশ্রমজীবী। পরিশ্রমজীবীদের শ্রমের ওপরই তাদের জীবন ও জীবিকার নির্ভর। লাঙ্গল বা হাতুড়ি চালিয়ে তারা যেমন উৎপাদন করতে জানে না, তেমনি দুশমনকে হঠানাের জন্যে লাঠি বা হলঙ্গা চালানাের ক্ষমতাও তাদের নেই। তারা কেবল জানে কলমের খোঁচা দিয়ে শ্রমজীবীদের শ্রমের ফল অপহরণ করতে। কাজেই ভদ্রলােকেরা জোট বাধলেই-বা কী, অস্ত্র জোগাড় করলেই-বা কী?
লাঠি কিংবা হলঙ্গা যারা চালাতে পারে আর্যশাস্ত্রে তাদের নাম দেয়া হয়েছে। নগরান্তবাসী। যারা শূদ্র যারা অন্ত্যজ, নগরে তথা ভদ্রলােকের পাড়ায় বাস করার অধিকার তাদের নেই, তারা বাস করবে নগরের উপান্তে। ভদ্রলােকেরা যাতে তাদের ছোয়া বাঁচিয়ে চলতে পারে সেজন্যেই এ-ব্যবস্থা।
অবিশ্যি ভদ্রলােকরা যখন বিপদে পড়ে তখন কিন্তু এই নগরান্ত বাসীদের কাছেই তাদের ছুটে যেতে হয়। তখন বাপু-বাছা বলে ওদের মন ভেজানাের কাজে লেগে যেতে তাদের দেমাকে একটুও বাধে না। ছেচল্লিশেও তাই দ্রলােকরা মানের গােড়ায় ছাই ঢেলে দিয়ে ছােটলােকদের দুয়ারে গিয়ে ধর্না দিলাে। কিন্তু ততােদিনে ওই ছােটলােকরাও যথেষ্ট সেয়ানা হয়ে উঠেছে, নিজেদের মান-সম্মানের ব্যাপারে বেশ সজাগ হয়ে গেছে। তারা আর এখন ভদ্রলােকদের বাপু-বাছা শুনেই গলে যাবার পাত্র হয়ে নেই। তারা এখন প্রাপ্য মর্যাদা কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নিতে চায়।
এখানে হিন্দু সমাজের ভদ্রলােকের তৈরি সামাজিক স্তর বিন্যাসটি সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেয়া দরকার বলে মনে করি। কারণ, এখন আর সেই বিন্যাসটি কোথাও অবিকৃতভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাকিস্তানের জন্ম ও মৃত্যুর অভিঘাতে এ দেশের হিন্দুসমাজে অনেক রূপান্তর
৯২
ঘটে গেছে। কাজেই এখনকার হিন্দুদের দেখে সাতচল্লিশ সালের আগেকার হিন্দু সমাজ সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন।
সকলেই হিন্দু সমাজের বর্ণাশ্রম অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র—এই চার বর্ণের বিন্যাসের কথা জানেন। ব্রাহ্মণ সবার উপরে, শূদ্র সবার নিচে। শূদ্রদেরও নিচে আছে। অন্ত্যজরা। শূদ্ররা অন্য তিন বর্ণের অস্পৃশ্য, আর অন্ত্যজরা শূদ্রদেরও অস্পৃশ্য।
কিন্তু চার বর্ণ আর অন্ত্যজের বিন্যাসও বহু আগেই কেতাবী ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে, অন্তত বাংলায় তাে বটেই। বাংলায় চার বর্ণ নেই, এখানকার স্মৃতিশাস্ত্র বা ধর্মীয় আচারের বিধানে আছে মাত্র দু’টি বর্ণ-ব্রাহ্মণ আর শূদ্র। ব্রাহ্মণ ছাড়া আর সবাই শূদ্র। তবে বাংলার ব্রাহ্মণরা শূদ্রদের মধ্যেও বিভাজন তৈরি করে নিয়েছে। বলা হয় : বাংলার হিন্দুদের আছে ছত্রিশ জাত। ছত্রিশ জাত হচ্ছে একটা কথার কথা মাত্র। আসলে হিন্দুদের জাতের সংখ্যা যে কতাে তার সঠিক সংখ্যা বােধ হয় কারাে জানা নেই।
তবে ব্রাহ্মণরা বঙ্গীয় স্মৃতিশাস্ত্রে শূদ্রদের প্রধান দুটো ভাগে ভাগ করে নিয়েছে—সৎ শূদ্র আর অসৎ শূদ্র। কায়স্থ আর বৈদ্যরা পড়ে সৎ শূদ্রের দলে। (অবিশ্যি কায়স্থরা এক সময় শূদ্র’ বলে অভিহিত হতে অস্বীকার করে এবং ক্ষয়িত্ৰত্ব দাবি করে বসে। বৈদ্যরা তাে ব্রাহ্মণদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নিজেদেরকে ব্রাহ্মণদের সমপর্যায়ের বলে ঘােষণা দেয়। তবে সে হচ্ছে ভিন্ন প্রসঙ্গের আলােচ্য বিষয়)। সৎ শূদ্রদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের ব্যবহার কিছুটা মর্যাদাপূর্ণ, ব্রাহ্মণরা এদের হাতে জল খায়, এদের বাড়ির পূজা পার্বণে পৌরােহিত্য করে শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণরা। এই সৎ শূদ্রদের দলে আরাে আছে নবশাক’ বা নবশায়ক’রা। সপোপ (গােয়ালা), মালাকার, তেলী, তাঁতী, মােদক (ময়রা), বারুই (পানচাষী), কুমার, কামার, নাপিত—এই নয়টি বৃত্তিবাচক জাতকেই বলে নবশাক বা নবশায়ক।
ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ ও নবশাক ছাড়া অন্য সব জাতই জল-অনাচরণীয়। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও সৎ শূদ্রদের দৃষ্টিতে অন্যসব জাতের লােকই অস্পৃশ্য, তাদের ছোঁয়া জল পর্যন্ত নিষিদ্ধ, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণরা তাদের বাড়িতে পূজা পার্বণে পৌরােহিত্য করেন না, করলে পতিত বলে গণ্য হন। এই জল অনাচরণীয় ‘ছােটজাতে’র লােকেরাই সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারাই সামাজিক শ্রমের উৎপাদক, তারাই শ্রমজীবী। এই জল-অনাচরণীয় ‘ছােটজাতে’র লােকেরা আবার অনেক জাতে বিভক্ত। যেমন—নমশূদ্র, ধােপা, উঁই মালী, কৈবর্ত, পাটনী, সূত্রধর ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের বাড়িতে পূজা-পার্বণে পৌরােহিত্য করেন অনভিজাত ও পতিত ‘বর্ণ ব্রাহ্মণরা। আর শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ বা বর্ণ ব্রাহ্মণ কেউই যাদের পৌরােহিত্য করেন না, সবাই যাদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে, অথচ ‘হিন্দু নামেই যাদের পরিচয় সেই হাড়ি ডােম মেথর ধাঙ্গড়রা হচ্ছে অন্ত্যজ ।
হ্যা, এখানে ব্রাহ্মণদের অভ্যন্তরীণ বিভাজনটির কথাও বলে নেয়া প্রয়ােজন। ব্রাহ্মণদের মধ্যেও আছে অনেক স্তরভেদ, তাদের নিজেদের ভেতরেই আছে অভিজাত-অনভিজাতের ব্যবধান। শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ ও বর্ণ ব্রাহ্মণ—প্রথমত এরকম মােটা দু’ভাগে বাঙালি ব্রাহ্মণ সমাজ বিভক্ত। শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণদেরও অন্তত তিনটি উপ-বিভাগ—রাঢ়ী, বারেন্দ্র, বৈদিক। ব্রাহ্মণগােষ্ঠিতে এরাই অভিজাত। অভিজাতদের আভিজাত্যেরও আবার রকমফের আছে। কেউ কুলীন, কেউ অ-কুলীন। কুলীনদেরও কেউ ‘নৈকষ্যকুলীন’ বা খাঁটি কুলীন, কারাে বা কুলীনত্বে ভেজাল মিশে গিয়ে হয়ে পড়েছে ‘ভঙ্গ কুলীন।
৯৩
আর বর্ণ ব্রাহ্মণরা শুধু অনভিজাতই নয়, শ্ৰোত্রিয় ব্রাহ্মণরা তাদের হাতের জলও স্পর্শ করে না। এমনকি অব্রাহ্মণ সৎ শূদ্রদের কাছেও বর্ণ ব্রাহ্মণরা অস্পৃশ্য। এই বর্ণ ব্রাহ্মণদেরও আবার অনেক বিভাগ। জল-অনাচরণীয় যেসব ‘ছােট জাতের ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ড তারা পরিচালনা করে, সেসব জাতের নামেই এদের পরিচয়। যেমন—ধােপার ব্রাহ্মণ, নমশূদ্রের ব্রাহ্মণ, কৈবর্তের ব্রাহ্মণ ইত্যাদি। বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ বর্ণের লােক হয়েও হিন্দু সমাজের প্রায় উপান্তে এদের অবস্থান। তথাকথিত উঁচু জাতের লােকেরা সুযােগ পেলেই বৃত্তিজীবী নানা জাতের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুরােহিত বর্ণ ব্রাহ্মণদের নিয়েও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে ছাড়ে না। এমনকি, খুবই দুঃখজনক, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতাে দিপাল সাহিত্যিকও মুচিরাম গুড়ের জীবন চরিত’ নামক উন্নতমানের স্যাটোয়ার গ্রন্থটিতে কৈবর্তের ব্রাহ্মণদের ওপর অহেতুক কটাক্ষ বর্ষণ করে নিতান্ত নীচতার পরিচয় দিয়েছেন।
খুবই মােটা দাগে আমি হিন্দুদের জাতপাতের কিছু পরিচয় তুলে ধরলাম। কিন্তু এ-পরিচয় খুবই সংক্ষিপ্ত ও খণ্ডিত। হিন্দু সমাজের জাতপাতের ব্যবস্থাটা এতাে জটিল যে, এ-সমাজের বাইরের কোনাে লােক এটির স্বরূপ বুঝতে চাইলে অল্পতেই তার মাথা ধরে যাবে। হিন্দু সমাজের ভেতরের মানুষদেরও সবাই যে এর খুঁটিনাটি ব্যাপারটা সহজে বুঝে উঠতে পারে, তা-ও নয়।
সমাজটির পরতে পরতে আছে ঘৃণা,, পারস্পরিক ঘৃণা। আর এই ঘৃণার দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রকাশ ঘটে খাওয়া আর ছোঁয়ার মধ্যে। খাওয়া আর ছোঁয়াতেই হিন্দুর জাত যায়। যায় না বলে অবিশ্যি ‘যেতাে’ বলাটাই সঠিক। এখন আর হিন্দুর জাত যায় না। কেউ ইচ্ছে করলেই কারাে জাত মারতে পারে না। কিন্তু পাকিস্তানের জন্মের কিছুদিন আগেও অবস্থাটা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। তখন ভাতের হাঁড়ি আর হুঁকোর জলের মধ্যেই ছিল হিন্দুর জাতের আশ্রয়। নজরুলের জাতের নামে বজ্জাতি’ কবিতাটি তাে আর খুব বেশিদিন আগের লেখা নয়।
শুধু বড় জাতের লােকেরাই যে জাতের নাম বজ্জাতি করে তা নয়। এ বজ্জাতি টুইয়ে চুইয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ছােট জাতের মধ্যেও। ব্রাহ্মণ সুরেন্দ্র চক্রবর্তী বা কায়স্থ নগেন্দ্র দত্তের কাছে মহিম নমশূদ্র বা শরৎ ধােপা একই রকম অস্পৃশ্য। অর্থাৎ নমশূদ্র কিংবা ধােপা উভয়কেই ব্রাহ্মণ কায়স্থরা একই রকম ঘৃণা করে। কিন্তু শরৎ ধােপা মনে করে যে সে মহিম নমশূদ্রের চেয়ে বড়। মহিমের হাতে জল খেলে তার জাত যাবে। এরকমই জাতের মহিমা!
কিন্তু এ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন কুঠুরিতে যাদের বসবাস, এক কুঠুরির বাসিন্দারা অন্য কুঠুরির মানুষদের থেকে যেখানে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে থাকতে চায়, এমন কি একই কুঠুরির ভেতরও ছােট ছােট বেড়া তুলে দেয়, সেই সব পরস্পর-বিচ্ছিন্ন মানুষদের নিয়ে একটি অভিন্ন হিন্দু সম্প্রদায় বা সমাজ কী করে তৈরি হয়?
প্রশ্নটির উত্তর নিশ্চয়ই আছে, তবে এক কথায় কোনাে উত্তর নেই। এককথায় কেন, বহু কথায়ও সে উত্তর আমি এখানে দিতে চেষ্টা করবাে না। ছেচল্লিশ সালে, আমার মাত্র এগারাে বছর বয়সে, আমি উপলব্ধি করেছি : অন্তত সে-সময়ে নােয়াখালির দাঙ্গাই মুসলমানদের বিপরীতে ব্রাহ্মণ-কায়স্থের মতাে ভদ্রলােক’ থেকে ধােপা-নমশূদ্রের মতাে ছােট লােক’ কিংবা হাড়ি-ডােমের মতাে অন্ত্যজ পর্যন্ত সকলকে ‘হিন্দু নামক একটি বােধে একত্র করে দিয়েছিল।
কংগ্রেসীরা যদিও দেশের সকল মানুষকে এক জাতি বলেই প্রচার করতাে, তবু মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবল প্রতিষ্ঠার মুখে কংগ্রেসীদের একজাতিতত্ত্ব নিতান্ত একটা তাত্ত্বিক
৯৪
ধারণা মাত্র হয়ে গেলাে। আর এ সময়েই মুসলিম লীগের পাশাপাশি হিন্দু মহাসভারও প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে যায় অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।
নামেই প্রকাশ, মুসলিম লীগের মতাে হিন্দু মহাসভাও একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন। মুসলিম লীগের জন্ম ১৯০৬ সালে। কয়েক বছরের মধ্যেই, ১৯০৯ সালে, আত্মপ্রকাশ করে হিন্দু মহাসভা। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে হিন্দু মহাসভা কোনােদিনই তেমন প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারেনি। ঘাের সাম্প্রদায়িক হিন্দুটিও রাজনৈতিক দিক দিয়ে ছিল কংগ্রেসের সমর্থক। কারণ কংগ্রেসের একজাতিতত্ত্ব তাে অবিভক্ত ভারতের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দুর কোনাে ক্ষতি করে না। সাম্প্রদায়িক মনােভাবাপন্ন হিন্দুটিও বরং কংগ্রেসী একজাতিতত্ত্বকে তার স্বার্থের অনুকূল বলে মনে করে। তাই সে কংগ্রেসকে ভােট দেয়, কংগ্রেসী শ্লোগানে গলা মেলায়। কিন্তু মুসলিম লীগের নানা সাম্প্রদায়িক দাবির বিরুদ্ধে হিন্দু মহাসভা যখন হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলে ধরে, তখন অনেক কংগ্রেসী হিন্দুকেও দেখেছি হিন্দু মহাসভার সমর্থক ব’নে যেতে। অর্থাৎ হিন্দু মহাসভা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা না পেলেও অসুস্থ রাজনীতির আবহাওয়ায় সামাজিক প্রতিপত্তিতে একেবারে পিছনে পড়ে থাকে না।
ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় এদের প্রতিপত্তি বেড়ে যাওয়ার একটা বিশেষ কারণ আছে। মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ কর্মসূচির প্রত্যক্ষ ফলই ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দাঙ্গায় মুসলিম হুমকি মােকাবেলার জন্যেই প্রয়ােজন হিন্দু ঐক্য—হিন্দু মহাসভা তার এই বক্তব্যটিকে জনপ্রিয় (আসলে হিন্দুপ্রিয়) করার জন্যে এ সময় মাঠে নামে। হিন্দু ঐক্যের ব্যবস্থা করতে হলে তাে হিন্দুত্বের সংস্কার করতে হবে। আর হিন্দুত্বের সংস্কারের জন্যে অস্পৃশ্যতা দূর করাটাই হচ্ছে প্রথম করণীয়। শূদ্র কিংবা অন্ত্যজদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে, তাদের হাতে জল খেলে তােমাদের জাত যাবে, তাদের ছায়া মাড়ালে তােমাদের স্নান করে পবিত্র হতে হবে, দেবতার মন্দিরেও তাদের ঢুকতে দেবে না, আবার ঠ্যালায় পড়লে তাদেরই বাপু-বাছা বলে ডেকে আনবে, তাদের হাতে লাঠি-হলঙ্গা তুলে দিয়ে বলবে মুসলমানদের মারের হাত থেকে আমাদের বাঁচাও। কারণ আমরাও হিন্দু তােমরাও হিন্দু, হিন্দুর বিপদে হিন্দুকেই তাে পাশে দাঁড়াতে হবে’—এ রকমটি আর এখন চলছে না। হিন্দু মহাসভার নেতারা এ কথাটাই নানাস্থানে সভা করে হিন্দুদের বােঝাতে থাকে। আমাদের গ্রামেও এরকম কয়েকটি সভা হয়েছিল।
এ-সব সভা আমাকে খুবই উদ্দীপ্ত করেছিল। শাস্ত্রের নামে এতােদিন ধরে যা বলা হয়েছে, সেসবের মধ্যে যে রয়ে গেছে প্রচুর ফাক ও ফাঁকি—এ কথাটাই হিন্দু মহাসভার বক্তৃতা শুনে আমি বুঝে নিয়েছিলাম। হিন্দুর শাস্ত্র যে মানুষে মানুষে কতাে ব্যবধান তৈরি করে রেখেছে, সেই শাস্ত্রের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে না এলে যে সত্যিকারের মানুষই হওয়া যাবে না, হিন্দু মহাসভার ‘অস্পৃশ্যতা বর্জনের আহবান আমাকে তাই জানিয়ে দিয়েছিল। এদিক দিয়ে, আমি বলবাে, চরম প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন হিন্দু মহাসভা তার অজ্ঞাতসারেই হয়তাে-বা একটি অত্যন্ত প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে ফেলেছিল। উনিশ শতক থেকে হিন্দু মনীষীরা সমাজসংস্কারের যেসব ভাবনা প্রচার করেছেন ও বাস্তব কর্মকাণ্ডের অনুশীলন করেছেন, সেগুলাে শহর-নগরের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রাম-গঞ্জের বিপুল সংখ্যক সাধারণ হিন্দুর মধ্যে তেমন কোনাে প্রভাবই ফেলতে পারেনি। ছেচল্লিশ সনে হিন্দু মহাসভা আর যা-ই করুক আর না করুক, হিন্দু ঐক্যের ধুয়া তুলে হিন্দু সমাজের সবচেয়ে বড় পাপ অস্পৃশ্যতা দূর করার
৯৫
একটা কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। গান্ধীজী যদিও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে লড়ে এসেছেন, বিহারের ভূমিকম্পকে পর্যন্ত বর্ণহিন্দুদের অস্পৃশ্যতার পাপের পরিণাম বলে ব্যাখ্যা করেছেন, তবু তিনি এই পাপ দূর করার জন্যে তেমন কিছুই করতে পারেননি। এক্ষেত্রে হিন্দু মহাসভার উদ্যোগটিকে অনেক সফলই বলতে হবে। তারা গ্রামে গ্রামে অস্পৃশ্যতা নিবারণের জন্যে সর্বজনীন পূজার অনুষ্ঠান করলাে। সর্বজনীন পূজা মানে ব্রাহ্মণ-শূদ্র নির্বিশেষে সকল হিন্দু একত্র হয়ে একই মন্দিরে পূজা করবে, সব জাতের মানুষ সেই মন্দিরে প্রবেশ করবে, শূদ্র প্রসাদ বিতরণ করবে এবং ব্রাহ্মণ-কায়স্থরাও সেই প্রসাদ গ্রহণ করবে। এভাবে সকল জাতের মানুষের একত্র মিলন ও পানভােজনের ব্যবস্থা করে গ্রামীণ হিন্দু সমাজে একটা ঐক্যবােধ আনার চেষ্টা করলাে হিন্দুমহাসভা।

হিন্দু সমাজের ছাত্মার্গ ও মুসলিম স্বাতন্ত্রের অকূল অতল কালাপানি
হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্যতা দূর করার ক্ষেত্রে চল্লিশের দশকে হিন্দু মহাসভা যে ভূমিকা পালন করেছিল তাকে আমি বলছি প্রগতিশীল। এবং হিন্দু মহাসভার প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র সম্পর্কে পুরাে সচেতন থেকেই এ কথা বলছি। আসলে কোনাে ব্যক্তিমানুষ বা কোনাে গােষ্ঠী কিংবা কোনাে সংগঠন সব সময় স্বেচ্ছায় বা সচেতনভাবে প্রতিক্রিয়াশীল বা প্রগতিশীল অবস্থানে থাকতে পারে না। পরিপার্শ্বের ইচ্ছানিরপেক্ষ বাস্তবতাই অনেক সময় প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি বা গােষ্ঠীকে দিয়েও এমন অনেক কাজ করিয়ে নেয় যা পরিণামে প্রগতিশীল বলে প্রমাণিত হয়ে যায়। আবার এর উল্টোটাও হয়। অর্থাৎ প্রগতিশীলদের অনেক কার্যকলাপও অনেক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীলদেরই সাহায্য করে।
যাই হােক, আমি এখানে প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব কথা নিয়ে অধিক বাগ্‌বিস্তার করতে চাই না। ছেচল্লিশ সালে হিন্দু মহাসভার অস্পৃশ্যতা বর্জনের কর্মসূচি যে গ্রামাঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপক আলােড়নের সৃষ্টি করেছিল সে কথাটাই কেবল স্মরণ করছি। একেবারে এই প্রথম যে গ্রামবাংলার হিন্দুরা প্রচলিত শাস্ত্রীয় সংস্কার বা কুসংস্কার-বিরােধী আন্দোলনের সংস্পর্শে এলাে, তা অবশ্যই নয়। গ্রামীণ সমাজেও নানা লৌকিক ধর্মান্দোলন ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র বিধানকে এর আগেও নানা সময়ে নানাভাবে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে এবং এ সবের ফলে সেই নিস্তরঙ্গ সমাজেও তরঙ্গ উঠেছে, সে তরঙ্গ কখনাে কখনাে কূল ছাপিয়েও গিয়েছে। এ রকম কূল প্লাবিত করা সামাজিক আলােড়ন-আন্দোলনের স্মৃতি আমিও কিছু কিছু বহন করে চলছি। পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শন প্রসঙ্গে যে সব স্মৃতির রােমন্থনও আমাকে করতে হবে বৈকি। তবে ছেচল্লিশে হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে অস্পৃশ্যতা বর্জনের আন্দোলনটা যেমন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনটি এর আগে কখনাে হয়নি।
আনুষ্ঠানিকভাবে অস্পৃশ্যতা বর্জনের জন্যে সে সময় গ্রামে গ্রামে যে সব সর্বজনীন কালীপূজা কিংবা মঙ্গলচণ্ডী পূজা হচ্ছিল, সেগুলাের খবর খুবই ঘটা করে ছাপা হতাে অর্ধসাপ্তাহিক আনন্দবাজার পত্রিকায়। পত্রিকায় ওই সব খবর পড়ে কবিরাজ জগদীশ চন্দ্র নাগের ‘কুলনন্দআয়ুর্বেদ ভবন’-এ গ্রামীণ পাঠকদের মধ্যে তর্কবিতর্কের ঝড় উঠতাে। অস্পৃশ্যতা বর্জনের পক্ষ সমর্থন করে যদি একজনে এক কথা বলতাে তাে এর বিরুদ্ধে পাঁচ জনে বলতাে পাঁচ দ্বিগুণে দশ কথা। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার হুমকির মুখেও গ্রামীণ
৯৬
হিন্দুরা জাতপাতের গণ্ডি ভাঙতে রাজি হচ্ছিল না। সেই ১৯৪৬ সালেও অস্পৃশ্যতার পক্ষে প্রবীণ ব্যক্তিদের মুখে এমন যুক্তি শুনেছি যাকে যুক্তি বলে মেনে নেয়া একালের যে কোনাে অর্বাচীন ব্যক্তির পক্ষেও অসম্ভব।
আসলে সে সময়েও হিন্দুত্ব আর অস্পৃশ্যতা ছিল সমার্থক। আচার-সর্বস্ব হিন্দুত্বের প্রধানতম আচারই ছিল খাওয়া আর ছোঁয়া সম্পর্কীয়। কোন জাতের লােকের ছোঁয়া জল খাওয়া যাবে না, কোন জাতের ছোঁয়া জল খাওয়া যাবে কিন্তু ভাত খাওয়া যাবে না, কোন জাতের লােকের ছায়া মাড়ালেও স্নান করে পবিত্র হতে হবে—এ সবই ছিল হিন্দু সমাজের মূল বিবেচ্য বিধিবিধান। এ সব বিধিবিধান শুধু কঠোরই ছিল না, অনেক ক্ষেত্রে ছিল অমানবিকও। উনিশ শতকে রামমােহন থেকে বিবেকানন্দ পর্যন্ত সকল মনীষী এই সব অমানবিক বিধিবিধানের ওপরই আঘাত হেনেছিলেন এবং তাতে নাগরিক হিন্দুসমাজে একটি রেনেসাঁসের মতাে ঘটনাও ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু সে রেনেসাসটা যে ছিল খুবই খণ্ডিত, তারই প্রমাণ বহন করে আসছিল চল্লিশের দশক পর্যন্ত গ্রামবাংলার সমাজ। গ্রাম বাংলার হিন্দুরা তখনাে বাস করতাে জাতপাতের পাচিলঘেরা অচলায়তনের ভেতর। ঠিক এ সময়েই যখন হিন্দু মহাসভা সব জাতের হিন্দুকে এক সঙ্গে পানভােজন করার আহবান জানালাে, শুধু আহবান নয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে সে আহবানের বাস্তব রূপ দিতেও লেগে গেলাে—তখন বর্ণ হিন্দুদের অনেকের পক্ষেই তা মেনে নেয়া খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাদের ভাষায় এটি হলাে ‘ম্লেচ্ছাচার’। সনাতনী হিন্দু দৃষ্টিতে ব্রাহ্মণ্য আচার-পরায়ণ হিন্দু ছাড়া আর সবাই ম্লেচ্ছ। যারা জাতপাত মানে না, পান ভােজনে ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার করে না, তারা সবাই ম্লেচ্ছ। খ্রিষ্টান কিংবা মুসলমানরা এ কারণেই স্লেচ্ছ। আর এখন কিনা জাতপাতের সব দেয়াল ভেঙে দিয়ে হিন্দুকেও ম্লেচ্ছ বানিয়ে ফেলবার ব্যবস্থা। করা হচ্ছে। কলি, ঘাের কলি! হ্যা, শাস্ত্রেই তাে আছে : কলির শেষে ঘাের অধর্মে যখন পৃথিবী ছেয়ে যাবে তখন ব্রাহ্মণ-শূদ্রে কোনাে ভেদ থাকবে না, ম্লেচ্ছাচারের পাপের ভারে পৃথিবীতে প্রলয় নেমে আসবে! বােঝা যাচ্ছে, প্রলয় খুব বেশি দূরে নেই আর!
ছেচল্লিশের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেও এ রকম কথা আমি আমাদের গাঁয়ের প্রবীণ হিন্দুদের মুখে শুনেছি। দেশের বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিকভাবে (অর্থাৎ কালী পূজা মঙ্গলচণ্ডী পূজা কিংবা এ রকম অন্য কোনাে পূজার অনুষ্ঠান করে) অস্পৃশ্যতা বর্জনের খবর আনন্দবাজারে পড়তে পড়তে তারা ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। উত্তেজনার বশে কতাে অযৌক্তিক ও অসঙ্গত কথাই-না তারা বলে যেতেন।
তাদের কথার প্রতিবাদ করতাে গ্রামের হিন্দু যুবকরা। ওই ছাত্মার্গের ব্যাপারটা যে নিতান্তই কুসংস্কার এবং এই কুসংস্কারই যে হিন্দুর সর্বনাশের মূল কারণ, কুসংস্কার আর হিংসাই যে হিন্দুকে হাজারাে ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে, আর তারই ফলে যে নােয়াখালিতে হিন্দুরা মুসলমানের হাতে পড়ে পড়ে মার খেয়েছে—এ সব কথাই প্রবীণ হিন্দুদের মুখের ওপর তীব্র ঝঝের সঙ্গে বলতেন আমার জ্ঞাতিভাই হীরেন্দ্র দা। নির্বাচনের সময় হীরেন্দ্র দা ছিলেন কট্টর কংগ্রেসপন্থী। আর এখন দেখলাম তিনি হিন্দু মহাসভার প্রবল অনুরাগী। হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই’—এ রকম কথা এখন আর তার মুখে শােনা যায় না। তার বদলে জাতপাতের ভেদ দূর করে সব হিন্দুকে এক হয়ে মুসলমানদের রুখতে হবে’–এ ধরনের কথাই তিনি পাগলের মতাে দিনরাত বলে যাচ্ছেন। আর মহাউৎসাহে এ গাঁয়ে ও গাঁয়ে সর্বজনীন মঙ্গলচণ্ডী পূজার ব্যবস্থা করে অস্পৃশ্যতা বর্জনের অনুষ্ঠান করছেন।
৯৭
কিন্তু অস্পৃশ্যতা বর্জনের হৈ হৈ প্রচার যতােটা হয়েছে, আসল কাজ ততােটা হয়নি। কারণ স্মরণাতীত কালের সংস্কার রাতারাতি বর্জন করা যায় না, অন্তত সবাই তাে তা পারেই না। তাই অস্পৃশ্যতা বর্জন নিয়েও দেখা গেলাে অনেক লুকোচুরির খেলা, অনেক কপটতা, অনেক আত্মপ্রতারণা।
রামপুরের কালীবাড়িতে যেদিন ঘটা করে সর্বজনীন মঙ্গলচণ্ডী পূজা করা হচ্ছিল, সেদিন সকাল থেকেই আমার ঠাকুরমা আমাকে বাড়িতে আটকে রাখতে চাইছিলেন। কারণ, এই পূজার ব্যাপারে আমার উৎসাহের আতিশয্য দেখে তিনি খুবই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর অতি আদরের নাতিটি কালীবাড়িতে গিয়ে নমশূদ্র আর ধােপাদের হাতের জল খেয়ে জাত খােয়াবে, এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু আমি তখন প্রচণ্ড বিদ্রোহী। ঠাকুরমার সব বাধা ঠেলে পূজার দিনে কালীবাড়িতে উপস্থিত হয়ে মহা ফুর্তি করলাম, পূজা শেষে লােকনাথ নমদাসের পরিবেশন করা প্রসাদ খেলাম মহা আনন্দে এবং সারা গ্রাম জুড়ে আমার এই বীরত্বের কাহিনী প্রচার করতে লাগলাম উচ্চকণ্ঠে। ঠাকুরমা যেন মরমে মরে গেলেন। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনুনয় বিনয় করে বলতে লাগলেন, “দেখ, পূজার প্রসাদ খেয়ে যখন এসেছিসই, তখন করবার তাে আর কিছুই নেই। যা হবার হয়ে গেছে। কিন্তু এখন সকলের কাছে এ কথা বলে বেড়াচ্ছিস কেন? জাত খােয়ানাের কথা কি মানুষকে জানাতে হয় কখনাে?…সােনা ভাই আমার, কাউকে ওই প্রসাদ খাওয়ার কথাটা বলিস না, কেউ জিজ্ঞেস করলে সােজা অস্বীকার করবি।
আমার প্রতি ঠাকুরমার এ রকম উপদেশের পেছনের যুক্তিটাও গ্রাম সমাজ থেকেই নেয়া। একটি প্রবাদ আছে—“খাইলে জাত যায় না, কইলে জাত যায়। অর্থাৎ জল অনাচরণীয় জাতের কোনাে মানুষের হাতের ছোঁয়া খাবার কেউ খেয়ে ফেললেই যে তার জাত চলে যাবে, তা নয়। সেই খাদক নিজে যদি তা অন্যের কাছে প্রকাশ করে দেয়, তাহলেই তার জাত যাবে; গােপন করে রাখতে পারে যদি, তবে তার জাত খােয়া যাবার কোনাে সম্ভাবনা নেই। হিন্দুর জাত বিচারের মধ্যে এমন একটা ভাবের ঘরে চুরি’র ব্যাপার সব সময়ই ছিল।
সেই ভাবের ঘরে চুরি করতে দ্বিধা করলেন না অস্পৃশ্যতা-বর্জন আন্দোলনের অনেক নেতাও। হিন্দু মহাসভা মার্কা হিন্দু ঐক্যের বক্তৃতা তারা দিয়েছেন, সর্বজনীন পূজা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ-আয়ােজনে উৎসাহও দেখিয়েছেন, কিন্তু পূজা শেষে প্রসাদ গ্রহণের সময় অনেকেই সটকে পড়েছেন। কেউ বৈষয়িক কাজের অজুহাত দেখিয়েছেন, কেউ ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কথা বলে লেপের তলায় আশ্রয় নিয়েছেন। কোনাে কোনাে জায়গায় সর্বজনীন পূজায় পুরােহিত সংকটও দেখা দিয়েছে। মােটা দক্ষিণার বিনিময়ে কোনাে গরিব ব্রাহ্মণ হয়তাে পৌরােহিত্য করতে রাজি হয়েছেন, কিন্তু নমশূদ্রের তােলা ফুল দিয়ে পূজা করতে অস্বীকার করেছেন। কোনাে পুরােহিত শর্ত দিয়েছেন যে, যতােক্ষণ তিনি পূজা করবেন ততােক্ষণ কোনাে অসৎ শূদ্র মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে না, পূজা শেষ করে তিনি চলে গেলে ওরা মন্দিরে ঢুকুক তাতে তিনি আপত্তি করবেন না।
তবু এ সবের পরও, হিন্দু মহাসভার এই উদ্যোগ গ্রামের হিন্দুদের জাতপাত সম্পৰ্কীয় চিন্তায় যে একটা র্যাডিকেল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল, সে কথা অস্বীকার করা যাবে না। এ কারণেই এ সময়কার হিন্দু মহাসভার ভূমিকাকে প্রগতিশীল বলে মনে হয়েছে আমার।
কিন্তু এ প্রগতিশীলতা তাে হিন্দুত্বের গণ্ডি অতিক্রম করে যায়নি, যেতে পারে না। হিন্দু মহাসভার পক্ষে সে গণ্ডি অতিক্রম করা অসম্ভবই ছিল। মুসলমানদের যে হিন্দুরা অস্পৃশ্য করে
৯৮
রেখেছে যুগ যুগ ধরে, সে অস্পৃশ্যতা বর্জনের কার্যকর উদ্যোগ কেউই গ্রহণ করলাে না। সর্বজনীন পূজায় হিন্দু মহাসভা যে ঐক্যের প্রদর্শনী করলাে তা বরং মুসলমানদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জই তুলে ধরলাে। সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্যবােধ আরাে তীব্র ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলাে।
মুসলমানদের অস্পৃশ্য করে রেখে যে হিন্দু মুসলমানের জাতীয় ঐক্য বা এক জাতিত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায় না, এই সহজ কথাটি কোনাে রাজনৈতিক নেতাই তেমন করে বুঝতে পারেননি বা বুঝতে চাননি। কিংবা বুঝলেও বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়ােজন বলে মনে করেননি।
এর সঠিক গুরুত্ব যিনি বুঝেছিলেন তিনি রাজনৈতিক নেতা নন, তিনি কবি। কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ। মুসলিম স্বাতন্ত্র উগ্র হয়ে ওঠার অনেক আগেই, ১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছিলেন—
‘হিন্দু মুসলমানের পার্থক্যকে আমাদের সমাজে আমরা এতই কুশ্রীভাবে বেআব্রু করিয়া রাখিয়াছি যে, কিছুকাল পূর্বে স্বদেশী অভিযানের দিনে একজন হিন্দু স্বদেশী প্রচারক এক গ্লাস জল খাইবেন বলিয়া তাঁহার মুসলমান সহযােগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছুমাত্র সংকোচ বােধ করেন নাই। কাজের ক্ষেত্রে প্রতিযােগিতার বশে মানুষ মানুষকে ঠেলিয়া রাখে, অপমানও করে—তাহাতে বিশেষ ক্ষতি হয় না।…আমরা বিদ্যালয়ে ও আপিসে প্রতিযােগিতার ভিড়ে মুসলমানকে জোরের সঙ্গে ঠেলা দিয়াছি, সেটা সম্পূর্ণ প্রীতিকর নহে তাহা মানি তবু সেখানকার ঠেলাঠেলিটা গায়ে লাগিতে পারে, হৃদয়ে লাগে না। কিন্তু সমাজের অপমানটা গায়ে লাগে না, হৃদয়ে লাগে। কারণ, সমাজের উদ্দেশ্যই এই যে, পরস্পরের পার্থক্যের ওপর সুশােভন সামঞ্জস্যের আস্তরণ বিছাইয়া দেওয়া।
জমিদার রবীন্দ্রনাথের কাছারিতে মুসলমান প্রজার প্রতি যে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হতাে, কবি রবীন্দ্রনাথ তা সহ্য করতে পারেননি। এ রকম একটি ঘটনার বিন্দুতে তিনি দেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সিন্ধু দর্শনে করতে পেরেছিলেন। তাই, একাধিক লেখায় অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে সেই ঘটনাটির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপনের এক যুগ আগেই তিনি লিখেছিলেন—
“আমি যখন আমার জমিদারী সেরেস্তায় প্রথম প্রবেশ করলেম তখন একদিন দেখি, আমার নায়েব তার বৈঠকখানার এক জায়গায় জাজিম খানিকটা তুলে রেখে দিয়েছেন। যখন জিজ্ঞেস করলেম এ কেন তখন জবাব পেলেম—যে সব সম্মানী মুসলমান প্রজা বৈঠকখানায় প্রবেশের অধিকার পায় তাদের জন্যে এই ব্যবস্থা। এক তক্তপােশে বসাতেও হবে, অথচ বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা পৃথক। এ প্রথা তাে অনেক দিন ধরে চলে এসেছে; অনেকদিন মুসলমান মেনে এসেছে, হিন্দুও মেনে এসেছে। জাজিম ভােলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম পাতা আসনে অন্যে বসেছে। তারপর ওদের একদিন ডেকে বলেছি, আমরা ভাই, তােমাকে আমার সঙ্গে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, কারাবাস ও মৃত্যুর পথে চলতে হবে। তখন হঠাৎ দেখি অপরপক্ষ লাল টকটকে নতুন ফেজ মাথায় দিয়ে বলে, আমরা পৃথক। আমরা বিস্মিত হয়ে বলি, রাষ্ট্র ব্যাপারে পরস্পর পাশে এসে দাঁড়াবার বাধাটা কোথায়? বাধা ঐ জাজিম তােলা আসনে বহুদিনের মস্ত ফাঁকটার মধ্যে। ওটা ছােট নয়। ওখানে অকূল অতল কালাপানি। বক্তৃতা মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিলেই পার হওয়া যায় না।”

Reference: পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন – যতীন সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!