শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
কিছুসংখ্যক মার্কিন নাগরিক কর্তৃক পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্যবাহী জাহাজ অবরোধ | রিচার্ড টেইলর, দি প্রগ্রেসিভ | জুলাই, ১৯৭১ |
ঠিক তার কোণায় ছিল বিখ্যাত ফোর্ট ম্যাকহেনরি যেটি, যেহেতু সময় ছিল সন্ধ্যা সাতটার পর, খুব শীঘ্রই “ গোধূলির শেষ ছটায়” স্নান করবে। বিদ্যালয়ের কর্মচারিরা, কিছু কিশোরেরা, একজন ডাক্তার, জেলে যাওয়ার পথে একজন সম্ভাব্য প্রতিরোধকারী, একজন শান্তিকর্মী, একজন কলেজ ছাত্র- আমরা সবাই চেয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানী সামরিক একনায়কতন্ত্রের প্রতি এর সমর্থন বন্ধ করতে।
“তোমরা একটি জাহাজ গতিপথ অবরোধ করে বন্দরের নিয়মকানুন ভঙ্গ করছ” একটি জোরালো অধৈর্য কণ্ঠ ভেসে এল। “ তোমরা সবাই গ্রেপ্তার হবে যদি এখান থেকে সরে না যাও”
টেলিভিশন ক্যামেরা এবং প্রতিবেদকদের দ্বারা পরিপুর্ন একটি বিশাল সাদা ইয়ট গর্জন করে উঠল। একজন টেলিভিশন প্রতিবেদক পেছনে তার ক্যামেরা কর্মীর সাথে জাহাজের ছোট একটি ইনবোর্ড চালিয়ে আসছিল একটি নিকতবর্তী দৃশ্য নেয়ার জন্য। দ্বিতীয় একটি পুলিশের নৌকা এবং দুইজন কোস্টগার্ড আমাদের এবং পদ্মার, যেটি ২০০ গজের মাঝে সরে এসেছিল, মাঝে ত্রিশ ফুটের প্রান্তে ছিল। জাহাজের শিঙা একটি গগনবিদারী বিস্ফোরণ ছাড়ল এবং এটির টাগবোট তাদের নিজেদের তীক্ষ্ণ বাশির শব্দ যোগ করল।
যখন একটি আওয়াজ বলল, “ঠিক আছে, তাদের গ্রেপ্তার কর” আমরা জানতাম আমরা আমাদের লক্ষ্য পুরন করতে পারবনা, কিন্তু আমরা নৌকাগুলোর মাঝে দিয়ে যেতে লাগলাম, বিভিন্ন চিৎকার দিয়ে যেমন, “আমরা আবেদন করছি আপনাদের কাছে কোটি পাকিস্তানির মৃত্যু প্রতিরোধে আমাদের সাহায্য করতে”। দক্ষ কোস্টগার্ডের পথপ্রদর্শন এবং আঁকড়িয়ে ধরা আঁকড়ির সাহায্যে, যাইহোক, শীঘ্রই আমাদের সবাইকে বড় নৌকায় উঠানো হল।
একজন নগর পুলিশ, নম্রভাবে কিন্তু দৃঢ়ভাবে আমাদের প্রহরা দিয়ে নিয়ে চললেন নৌকার অন্যতম একটি কামরায় এবং আমরা দেখলাম পদ্মা, এখন আমাদের উপরে, ৮নং জেটিতে সটান নিল। গরম এবং জনাকীর্ন কামরায়, আমাদের একমাত্র সান্ত্বনাটি আসল একজন তরুন কোস্টগার্ড নাবিকের কাছ থেকে, যিনি ঝুকে ফিসফিস করে বললেন, “ আমাদের এই কাজটি করতে হবে, কিন্তু আমরা শতভাগ তোমাদের সাথে আছি, তোমরা ঠিক জিনিসটি করছ” শীঘ্রই আমরা আমদের পেলাম বাল্টিমোর সিটি জেলে, সংকীর্ন কাঠের সাথে এবং চিন্তা করতে লাগলাম আমরা কিভাবে এই পরিস্থিতিতে নিজেদের জড়ালাম।
আমাদের মধ্যে অনেকেই ১৯৭১ এর বসন্ত এবং আসন্ন গ্রীষ্ম কাটিয়েছে যুদ্ধনিবৃত্তি মুলক ফিলাডেলফিয়া এলাকায় একটি নতুন সংস্থা গঠনে যার নাম, “ দ্য মুভমেন্ট ফর এ নিউ সোসাইটি (এমএনএস)”। এটি “নিউ আমেরিকান মুভমেন্ট” এর সাথে সাদৃশ্যপুর্ন যা সম্প্রতি এই পৃষ্ঠাগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছে ( জেরেমি রেফকিন, “ দ্য রেড, হোয়াইট, এন্ড ব্লু লেফট, দ্য প্রগ্রেসিভ নভেম্বর, ১৯৭১), কিন্তু একটু বিশদ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাথমিক পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন গঠনে অহিংস প্রত্যক্ষ কার্যক্রমের ভুমিকার উপর।
আমাদের এমএনএস প্রচেষ্টা ছিল “ওভারসিজ ইমপ্যাক্ট গ্রুপ” নামক একটি ছোট অধ্যয়ন –কর্ম দল, যার সদস্যরা অন্যান্য দেশের উপর ইউএস সরকারের নীতি ও বাণিজ্য সম্পর্কের প্রকৃত প্রভাব বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। গ্রীষ্মের মাঝামাঝির দিকে আমরা পত্রিকার প্রতিবেদনে পুর্বপাকিস্তানে গনহত্যা এবং ভারতে বৃহদাকারে শরনার্থীদের যাত্রা সম্পর্কে পড়তে শুরু করলাম। পাকিস্তানের ব্যাপারে প্রায় কিছুই না জেনে, আমরা দেশটি এবং এর উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে অধ্যয়ন শুরু করলাম।
একটি জনপ্রিয় আমেরিকান কলেজ পাঠ্য (লুকাস এবং হোয়াইটবি’র কম্পারেটিভ ইকোনমিক সিস্টেমস হারপার, ১৯৬৯) পাকিস্তানকে বর্ণনা করেছে “বিশ্বের অন্যতম প্রাথমিক পুঁজিবাদী দেশ” এর “গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক তন্ত্র” এর প্রশংসা করেছে এবং উপসংহার টেনেছে যে এর অর্থনৈতিক উন্নয়ন “উল্লেখযোগ্যভাবে সফল”। অন্যান্য প্রতিবেদন, যাইহোক, দেখিয়েছে যে, পাকিস্তান সামরিক একনায়কতন্ত্র দ্বারা শাসিত (জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রধান শাসক) যারা পুর্ব পাকিস্তানকে একটি উপনিবেশ হিসেবে গন্য করে, এবং সেই পুজিবাদি-কেন্দ্রিক উন্নয়ন একটি অঢেল ধনী মালিক শ্রেণী তৈরি করেছে, বেশিরভাগ জনগণকে দারিদ্র্যের মধ্যে রেখে।
সমসাময়িক ঘটনাগুলো অন্তত মনে হচ্ছে এই স্ববিরোধী কিছু বর্ণনাগুলোকে বাতিল করছে। পাকিস্তানী গনতন্ত্রের এই নাটকের সমাপ্তি হল যখন জেনারেল খান, পুর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের জেতা সার্বজনিন নির্বাচনের জবাবে পুর্বে সামরিক নির্যাতনের আদেশ দিলেন। এই জঘন্য নিষ্ঠুর সামরিক কার্যকলাপ কোটি শরনার্থীকে প্রানভয়ে ভারতে পালাতে বাধ্য করল।
ক্রমবর্ধমান গবেষণার সাথে পাকিস্তানী ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। এটি আমাদের দেশ থেকে অনেক দূরে কোন সাধারণ দুঃখজনক ঘটনা ছিল না যেটিতে আমাদের কোন অংশগ্রহণ ছিল না, কিন্তু ছিল এমন একটি ঘটনা যেটির সৃষ্টিতে আমাদের নিজেদের সরকার সাহায্য করছিল।
যদিও পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর কিছু অস্ত্রাদি অন্যান্য দেশ থেকে এসেছিল, একটি বড় অংশ এসেছিল ১০০ কোটির বেশী ইউএস সামরিক সহায়তা রুপে- জেট ফাইটার্স, হালকা কামান, সি-১৩০ ট্রান্সপোর্ট প্লেন, বন্দুক, এবং গোলাবারুদ- পাকিস্তানে ১৯৫৫ সাল থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। একটি অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ইন্দ-পাকিস্তান সীমান্ত সংঘর্ষের কারণে ১৯৬৫-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তান উভয় দেশের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল কিন্তু অনেক লক্ষ ডলার ইউএস সামরিক সহায়তা হিসেবে পাঠানো হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার পর।
ইউএস এর অর্থনৈতিক সহায়তাও প্রচুর ছিল, ১৯৫৪ সাল থেকে যা ছিল ৪০ কোটি তাকার বেশী। ইউএস বার্ষিক অর্থনৈতিক সহায়তার (প্রায় ২০০০ কোটি) মোটামুটিভাবে অর্ধেকের মত দেশের বৈদেশিক সহায়তা সরবরাহ করে, সেটি সহ যেটিকে দশ জাতি বিশ্ব ব্যাংক উন্নয়ন সহচর্যের মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জ্ঞাপন করেছিল (মে ৩০,১৯৭১) যে, পাকিস্তানের উন্নয়নের প্রতিটি ধাপে গভীরভাবে পাশে থাকবে এবং দেশের মুদ্রা এবং বাজেট অব্যাহত রাখবে।
পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর নির্যাতন এবং সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে ওয়াশিংটন জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা অব্যাহত ছিল। প্রথমে, রাষ্ট্র বিভাগ এই চালান অব্যাহত রাখার তথ্য অন্ধকারে রাখার চেষ্টা করে,কিন্তু যখন এই অব্যাহত সহায়তার ধারা কংগ্রেস এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পায়, সরকার এই অব্যাহত সহায়তা রাখার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করে এই বলে যে, পাকিস্তানী সরকারের উপর “লিভারেজ” প্রয়োগের জন্য এই সহায়তা। এপ্রিলে রাষ্ট্র বিভাগ স্বীকার করে যে, ইউএস কামান এবং এফ-৮৬ ফাইটার্স পুর্ব পাকিস্তানে ব্যবহার করা হচ্ছিল। এটি পরিষ্কার হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেরিত অস্ত্র বাঙালিদের চুর্ণ করার কাজে সাহায্য করছিল এবং ইউএস সহায়তার ধারা অব্যাহত থাকবে যদিও এটি স্বল্পমাত্রায় থাকবে।
“ লিভারেজ প্রয়োগের জন্য সহায়তা প্রদান” এই তর্কটি গ্রিসের সাথে আমাদের সরকারের সম্পর্কের ব্যাপারে নেয়া নীতির মত শোনাচ্ছিল, এবং আমরা সন্দেহ করছিলাম যে, এটির পাকিস্তানের উপরও সমান প্রভাব থাকবে, বিশেষত জনসমক্ষে নির্বাহী শাখার কেউ অস্বীকার করছিল না কি হচ্ছে সে ব্যাপারে অথবা এর সমালোচনার পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু সাধারণ জনগন এই নীতির বিরোধিতা করার জন্য কি করতে পারে?
পত্রপত্রিকা এবং কংগ্রেশনাল দপ্তরের সাথে যোগাযোগ ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে, পাকিস্তানী জাহাজগুলো আমাদের পুর্ব উপকূলে নোঙ্গর করছে, অর্থনৈতিক এবং সামরিক মাল্পত্রের চালান তোলার জন্য।আমরা বুঝেছিলাম, আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ এবং পরিস্থিতির উপর প্রচারনার স্পটলাইট ফেলার একটি উপায় ছিলএই জাহাজগুলোকে অবরোধের প্রচেষ্টা যেহেতু তারা মালপত্র তোলার জন্য নোঙ্গর করেছিল।
এটি জেনে যে কিছু ফিলাডেলফিয়ানস ইতোমধ্যেই পাকিস্তানের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, আমরা ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল নামক একটি স্থানীয় দলে যোগদান করলাম এবং এটির প্রত্যক্ষ কার্যক্রম কমিটি হয়ে গেলাম। আমরা পোতাশ্রয় কার্যকলাপ সম্পর্কে সম্পুর্নরুপে অজ্ঞাত ছিলাম, কিন্তু গ্রন্থাগার গবেষণা এবং টেলিফোন কল গুলো শীঘ্রই আমাদের চালানের তথ্যের প্রধান উৎস গুলো সম্পর্কে একটি ধারণা দিল। কিছু সময় পরে আমাদের একটি পুর্নাঙ্গ “সংবাদ যন্ত্র” প্রস্তুত হল যাতে যুক্ত ছিলেন একজন নান যিনি জাহাজ আগমনের সংবাদ প্রতিবেদনের উপর নজর রাখতেন, সহানুভূতিশীল বন্দরশ্রমিকগন এবং জাহাজ চালকদের সংগঠন এবং যখন প্রয়োজন তখন বন্দরের ঘাটিগুলোতে বাইনোকুলার সহ স্পটারেরা। ( তথ্যসমুহের উভয় সরকারি এবং বেসরকারি উৎসসমূহতে হঠাৎ গোপনীয়তার এই পর্দা নিক্ষেপ আরেকটি কাহিনী, এতটাই বিস্তারিত যে বর্ননা এখানে নিষ্প্রয়োজন)
জুলাই ৮ তারিখে আমরা শুনতে পেলাম যে, পদ্মা মন্ট্রিলে জেট ফাইটার্সের অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ চালানের চেষ্টা করছে। দ্য মন্ট্রিল স্টার (জুন ২৮-৩০) প্রতিবেদনে দেখাল যে, জাহাজে মাল লেনদেনকারীরা দাবি করে যে শুধুমাত্র কোবাল্ট এবং খাদ্যদ্রব্য জাহাজে উঠানো হয়েছে, কিন্তু যখন আন্দোলনকারীরা পরীক্ষণের জন্য জোরাজুরি করল, তখন ৪৬ ক্যারেট সাব্রেজেট এর অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ খুজে পাওয়া গেল। কানাডিয়ান সরকার এই লেনদেনকারীদের অনুমতিপত্র বাতিল করে পদ্মাকে অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ ছাড়াই বাল্টিমোর অভিমুখে যেতে বাধ্য করে। এভাবে, এই প্রকল্প “দ্য পারসুট অফ দ্য পদ্মা” যেটি চালিত করল এক রাত বাল্টিমোর জেলে এবং ত্রিশ দিন মেয়াদি কারাবাস যার মুল অভিযোগ চিল “বিশৃঙ্খল আচরন” এবং “অন্যায়ভাবে স্রোতে ইতস্ততভাবে ভাসমান অবস্থায় বাধন আলগা করা অথবা একটি বস্তু রসিকতাস্বরুপ একটি ক্যানু স্থাপন করে এস ফাইভ পদ্মা গতি রোধ করা”
পদ্মার নোঙ্গর প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার আমাদের আত্মবিশ্বাসহীনতার চেয়েও বেশী ছিল আমাদের উল্লাস যা একটি চমৎকার দেশব্যাপী সংবাদমাধ্যম, রেডিও এবং টেলিভিশনে এই অবরোধের প্রচারের মাধ্যমে আমরা অনুভব করেছিলাম। যখন পররাষ্ট্র বিশয়ক মন্ত্রণালয় কমিটি গ্রিস এবং পাকিস্তানে সহায়তা্ বন্ধের ব্যাপারে একটি বিল উত্থাপন করল, একজন কংগ্রেসনাল উৎস এবং একজন সুপরিচিত নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদক আমাদের বললেন যে আমাদের বাল্টিমোর কার্যকলাপ এই নজিরবিহীন উদ্যোগ নিতে কমিটিকে প্রভাবিত করায়একটি প্রধান কারন ছিল।
জেটিশ্রমিকদের সাথে নিকটবর্তী হয়ে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল যখন আমাদের আবেদন সত্ত্বেও বাল্টিমোর সমিতির সিদ্ধান্ত ছিল জাহাজে মালপত্র বোঝাই করা। তাই আমরা একটি দল গঠন করলাম যাতে ছিলেন দুইজন বাঙালি এবং দুই জন আমেরিকান এবং ছুটে গেলাম মিয়ামির ডিলিডো হোটেলে আন্তর্জাতিক জেটিশ্রমিক সমিতির সম্মেলনে। সেখানে আমরা আইএলে এর সদস্যদের আমাদের অবস্থান সম্পর্কে বোঝালাম এবং, উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সাথে সাক্ষাতের এবং সম্মেলন স্থলে একটি ভাষণের পরে, আমরা প্রতিশ্রুতি পেলাম যে, আইএলএ পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যাওয়া কোন সামরিক সরঞ্জামাদি বোঝাই করবে না।
আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন যোগাযোগ, যেটি প্রমাণ হল, ছিলেন, রিচার্ড আস্কেউ, ফিলাডেলফিয়ার আইএলএ লোকাল ১২৯১ এর সভাপতি। তিনি বাঙালিদের প্রতি অবিলম্বে সহমর্মিতা প্রকাশ করলেন এবং তার বিশ্বাস ব্যক্ত করলেন যে একটি ছোট দল সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামকে দাবিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল। একজন কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হিসেবে, তিনি নিপীড়িত লোকদের দুর্দশা বুঝেছিলেন যারা শুধুমাত্র তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ব্যক্ত করার চেষ্টার কারণে নিপীড়িত হয়। যেখানে আন্তর্জাতিক আইএলএ পাকিস্তানের জন্য সামরিক দ্রব্যাদি বোঝাই না করার প্রতিজ্ঞা করেছিল, আস্কেউ নির্দেশ করেছিলেন যে তার স্থানীয় জনগন অর্থনৈতিক সহায়তাও প্রদান নাও করতে পারে, এই বিশ্বাসে যে একনায়কতন্ত্রের জন্য কোন সাহায্য পুর্ব বাংলায় শুধু যন্ত্রনার পরিমাণই বৃদ্ধি করবে।
যখন এই ছোট দল মিয়ামিতে কাজ করছিল, প্রত্যক্ষ কার্যক্রম কমিটির বাকি সদস্যরা অন্যান্য বন্দর নগরীতে দলগুলোকে উদ্বুদ্ধ করছিল সেখানে অবরোধ করার জন্য, এবং পদযাত্রাশুরু করা এবং পাকিস্তানী জাহাজের ফিলাডেলফিয়া এজেন্টদের দপ্তরে পিকেটিং বা বাধা ডান করার জন্যও।
আগস্টের প্রথম দিকে আমরা জানতে পারলাম যে আরেকটি পাকিস্তানী জাহাজ, আল আহমাদি, ফিলাডেলফিয়ার দিকে আগাচ্ছে। আগস্ট ১২ তারিখে আমরা ফিলাডেলফিয়ার ৮০ নং জেটিতে এটির মুখোমুখি হওয়ার জন্য অবরোধ স্থাপন করলাম, কিন্তু এটি ডেলাওয়ার নদির দিকে ঘুরে বাল্টিমোর চলে গেল। আমরা এটিকে সেখানে ধাওয়া করলাম এবং জল ও স্থলে পিকেটিং এর সাথে এটির মুখোমুখি হলাম, তখন জানতে পারলাম এটি ফিলাডেলফিয়ার দিকে এগোচ্ছিল।
আগস্টের ১৭ তারিখে আমরা ডেলাওয়ার নদীতে আল আহমাদির মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমাদের নৌকা সংগ্রহের জন্য ভোর ৪ টায় জেগে উঠলাম, আল আহমাদির সম্ভাব্য পৌঁছানোর সময় ছিল সকাল সাতটা। চারটি ক্যানু এবং একটি ক্যায়াক চালিয়ে ৮০ নং জেটিতে পোঁছানোর জন্য তিন মাইল চালিয়ে গেলাম যেখানে ত্রিশটি পিকেট ঘাটের পাশে বিশালাকৃতির গুদামঘরের সামনে তৈরি করা হয়েছিল। আমরা পাকিস্তানে ইউএস এর অস্ত্র চালানের চিত্র সম্পর্কে বর্ননা করে একটি ত্রিশ ফুট ম্যুরাল নির্মান করেছিলাম এবং শীঘ্রই জেটিশ্রমিক, চালক (যাদের ট্রাক আমাদের পিকেট দ্বারা সমর্থিত ছিল) এবং জাহাজ কোম্পানির কর্মকর্তাদের সাথে, যারা অভিযোগ করছিলান যে আমরা তাদের পুরো কার্যকলাপ বন্ধ করে দিয়েছি এবং তাদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করছি, তাদের সাথে গভীর আলোচনা এবং দরকষাকষিতে লিপ্ত হলাম। আমরা শেষ পর্যন্ত একটি ফটক পিকেট মুক্ত করে ছেড়ে দিতে রাজি হলাম ( যেখানে একটি জাপানি জাহাজ নোঙ্গর করা ছিল)।
এই ক্ষুদ্র অহিংস বহর আলোকিত পানির উপর পাঁচটি অন্ধকারের রৌপ্যমুর্তির মত ছিল, যেগুলো নদীতীরের পাশে অবস্থিত ঘাটের প্রবেশদ্বারের থেকে ২০০ গজ দূরে পানির উপর ভাসছিল। বেশকিছু পুলিশের নৌকা আমাদের উপর কড়া নজর রাখছিল। গুদামঘরটি নদীর দিকে পিকেটারদের দৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল, কিন্তু তারা জানত যে এই মোকাবিলা অনিবার্য ছিল যখন তারা দেখল দুইজন ক্যানুর যাত্রী হঠাৎ তাদের মাথার উপর কার্ডবোর্ড উচিয়ে সংকেত দিল এবং বহির্গামী স্রোতের দিকে ইশারা করল।
কিছু মুহুর্তের মধ্যে আল আহমাদি জাহাজের বিশাল অগ্রভাগ গুদামঘরের প্রান্ত ঘেঁষে অতিক্রম করল, দুটি বিশাল হেচকা ঠেলার সাহায্যে। আমাদের ক্ষুদ্র নৌকাগুলো সরাসরি প্রান্তভাগের দিকে চালিয়ে নেয়া হল, কিন্তু পুলিশ, স্পষ্টত গ্রেপ্তার না করার আদেশের ভিত্তিতে আমাদের পাশাপাশি চলল, তাদের পাকড়াও করল এবং জাহাজের প্রান্তভাগের আড়াআড়ি রাস্তা থেকে সরিয়ে তেনে নিয়ে গেল। যখনই তারা আমাদের ছেড়ে দিল, যাইহোক, আমরা পুনরায় বৈঠা চালিয়ে ফিরে এলাম, টাগবোটের ঢেউ এবং উত্তাল আবহাওয়ার সাথে লড়াই করার মাধ্যমে জাহাজের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য । বিশ মিনিটের একটি ভাল সময়ের মধ্যে এই বহর আক্রমণ করল এবং এই বহরকে পিছনে টানা হল, যখন জেটিশ্রমিক, চালক, আন্দোলনকারীরা, সংবাদপত্রের প্রতিবেদক, টেলিভিশন ক্যামেরাম্যান এবং পাকিস্তানী নাবিকেরা রেলিং এ হেলান দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দেখছিল। শেষ পর্যন্ত আল আহমাদি জেটিতে নোঙ্গর করার জন্য রজ্জু বাধতে সমর্থ হল।
জেটিশ্রমিকদের হাতে ছিল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত; আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম এটি দেখার জন্য যে তারা মাল বোঝাই করবে কি করবে না। এই পর্যন্ত কেউ পিকেট এর রেখা অতিক্রম করেনি, এবং পরবর্তী কর্মীদলের ফটক অতিক্রমের নির্ধারিত সময় ছিল দুপুর একটা। ১২:৩০ এর দিকে তারা আসতে শুরু করল এবং এ পিকেটিং আরও তীব্রতর হল। ১২:৪৫ এ রিচার্ড আস্কেউ গুদামঘরের ফটকের সামনে বর্ধিষ্ণু জনতার মাঝে একটি বিশাল কালো গাড়ি চালিয়ে এলেন। তিনি ধীরে গাড়ি থেকে নামলেন এবং অতিসত্বর মাইক্রোফোন এবং প্রতিবেদকদের প্রশ্নের মাঝে বেষ্টিত হলেন।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বলার জন্য, তিনি বললেন, “ আমি এখানে জনতাকে বলতে এসেছি কি করতে হবে। আমার মনে হয় তারা ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কি করতে হবে। আই এখানে আমার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করতে এসেছি। এই কোম্পানিকে এই ঘাটে জাহাজ স্থাপনের জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত। পশ্চিম পাকিস্তান পুর্ব পাকিস্তানে গনহত্যা চালাচ্ছে। যদি আমরা এই জাহাজে মাল বোঝাই করি, এটি এমন হবে যে আমরা গনহত্যা সংঘটনে সাহায্য করছি”।
একজন প্রতিবেদক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন যেটি সকাল থেকে সকল আন্দোলনকারীর দিকে নির্দেশ কড়া হয়েছেঃ “ জনাব আস্কেউ আপনার লোকেরা মাল বোঝাই করতে না দিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতি করছে না?”
…… “ এই কর্মকান্ডগুলো জনগনের কাছে পাকিস্তানে ইউএস এর ভূমিকা সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করেছে। তারা একটি উদাহরন ও স্থাপন করেছে যে কিভাবে সাধারণ জনগন একটি অসহায়তার অনুভুতির গণ্ডি অতিক্রম করে তাৎপর্যপুর্ন কার্যক্রমে সেটিকে রুপান্তর করতে পারে……”
বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছাড়াই তিনি জবাব দিলেন, “ যদি আমার মনে হত যে অর্থ আমি উপার্জন করছি সেটিতে অন্যের রক্ত মেশানো আছে, তাহলে আমি এই অর্থ আমার কাছে মূল্যহীন হয়ে যেত,” এবং তিনি তার গাড়ির দিকে ফিরে সেটি চালিয়ে চলে গেলেন।
একজন জেটিশ্রমিকও সীমারেখা পার করে নি, তখনও অথবা পরবর্তী ২৮ ঘন্টার মধ্যে, যে সময় একটি লাগাতার দিবারাত্রি আন্দোলনের আয়োজন করা হয়েছিল।অল্প কিছু জেটিশ্রমিক জাহাজ কোম্পানির কর্মীদের কাজ করার জন্য বারবার আহবান করছিল, এবং পরবর্তী সময়ে কোন শ্রমিক না থাকায় আল আহমাদি জেটিতে হাজার টনের উপর পন্য রেখে চলে যায়।
স্পষ্টত, এই কার্যক্রম ফিলাডেলফিয়া বন্দরকে পাকিস্তানী জাহাজগুলোর জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল, যেটির জন্য পরবর্তীতে, ডিরেক্ট অ্যাকশন কমিটি একজন প্রস্তুতকারক এবং একজন উকিলের কাছ থেকে ফোন পেয়েছিল , এই কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য যাতে তারা পাকিস্তানে চালান পাঠাতে পারে। বোস্টনে আরও একটি দল একটি অহিংস বহরের আয়োজন করেছিল এবং এই পোতাশ্রয় ব্যবহার থেকে একটি নির্ধারিত জাহাজকে নিরুৎসাহিত করেছিল।
অক্টোবরে আমরা নর্দমার নালীর আটটি প্রতিরুপ তৈরি করেছিলাম ( ইনডিয়াতে বাংলাদেশী শরনার্থীদের ঘর হিসেবে যেটি ব্যবহৃত হয় তার সমরুপ) এবং সেগুলোকে লাফায়েট পার্কে স্থাপন করেছিলাম, যেটি ছিল হোয়াইট হাউসের আড়াআড়ি পার্শ্বে অবস্থিত। ডিরেক্ট অ্যাকশন কমিটির একটি দল সেগুলোতে এক সপ্তাহের বেশী বাস করেছিল, উপবাস করে অথবা বাঙালি প্রবাসীদের দেয়া সামান্য খাবার গ্রহণ করে, শরনার্থীদের দুঃখ দুর্দশা উপস্থাপনের জন্য। এই পর্ব থেকে আমরা পাকিস্তান দুতাবাসে একটি পদযাত্রার আয়োজন করেছিলাম, ক্যাপিটাল হিল এ একটি তদবির কার্যক্রমের দিন, জাতিসংঘে বাংলাদেশী প্রতিনিধিদের দ্বারা আয়োজিত একটি আন্তঃধর্মীয় সেবা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য একটি শরনার্থী আহার।
কার্যকর গণমাধ্যম প্রচারের কারণে, এই কর্মকান্ডগুলো জনগনের কাছে পাকিস্তানে ইউএস এর ভূমিকা সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করেছে। তারা একটি উদাহরন ও স্থাপন করেছে যে কিভাবে সাধারণ জনগন একটি অসহায়তার অনুভুতির গণ্ডি অতিক্রম করে তাৎপর্যপুর্ন কার্যক্রমে সেটিকে রুপান্তর করতে পারে.
ইন্ডিয়াতে আমাদের সূত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে,এই রকম কার্যক্রম ইন্ডিয়ান গণমাধ্যমে ফলাওভাবে বর্ননা করা হএই কর্মকান্ডগুলো জনগনের কাছে পাকিস্তানে ইউএস এর ভূমিকা সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করেছে। তারা একটি উদাহরন ও স্থাপন করেছে যে কিভাবে সাধারণ জনগন একটি অসহায়তার অনুভুতির গণ্ডি অতিক্রম করে তাৎপর্যপুর্ন কার্যক্রমে সেটিকে রুপান্তর করতে পারে.য়েছে এবং ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে নিদর্শন হিসেবে যে, যদিও ইউএস সরকার সহানুভূতিহীন ছিল, কিছু আমেরিকান জনগন গনহত্যার সমর্থনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য পদক্ষেপ নিতে তৈরি ছিল। জাতিসংঘে ইন্ডিয়ান এবং ইউএস প্রতিনিধিগণ এখন কথা বলার অবস্থায় না থাকলেও জেটি ৮০ এর মুহুর্ত মনে করতে পারেন যখন জেটিশ্রমিক এবং আন্দোলনকারীরা একত্রিত হয়েছিল এবং পৃথিবীর অপর প্রান্তে হতে থাকা স্বৈরশাসন এবং গনহত্যার জন্য তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল।