You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
পাকিস্তান সংকত-ঘটনা ও পরিণতি: এনো ব্রাউন টেলর এর প্রতিবেদন বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন ১১ এপ্রিল, ১৯৭১

পাকিস্তান সংকট: প্রকৃত ঘটনা এবং প্রভাব
এনো ব্রাউন টেলর
বাংলাদেশ (বাঙালী জাতি) অর্গানাইজেশন
এপ্রিল ১১, ১৯৭১
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবার্ট জে, ম্যাক্লস্কি বলেছেন, “বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত ঘটনাবলীর মধ্যে নির্ভরযোগ্য ঘটনাগুলো খুঁজে বের করা এবং তাদের ফলাফল মূল্যায়ন করা অসম্ভব ছিল।”

এটা সত্যি নয়। আমরা হয়তো “প্রকৃত লাশের সংখ্যা” পাচ্ছিনা, তবে ভয়ংকর কিছু “ঘটনার সংগ্রহ” আমাদের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম থেকে অপসারিত ইউরোপীয় এবং আমেরিকারনরা চাক্ষুষ দেখা নির্বিচার হত্যা এবং পাশবিকতার বর্ণনা দিচ্ছেন। সৈন্যরা সংবাদমাধ্যম নিষিদ্ধ করার পর যুদ্ধসাংবাদিকরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন, নতুবা তাদের ঢাকায় থাকতে হত। আল্লাহ, অখন্ডতা এবং জাতীয় ঐক্যের নামে চট্টগ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাঙালীদের কব্জিতে দড়ি বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে সেই অবস্থাতেই মৃত্যুর জন্য ফেলে রেখে গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তাদের নিজেদের কবর খুঁড়তে বাধ্য করে তাদের গুলি করেছে, শহরের সমস্ত বস্তি পুড়িয়ে দিয়েছে… শরণার্থীদের ওপর গঠিত সিনিয়র এডওয়ার্ড কেনেডির উপকমিটির কাছে নির্বিচার হত্যা, ভিন্নমতাবলম্বী নেতা ও ছাত্র খুন এবং প্রতি দিন প্রতি ঘন্টায় মারা যাওয়া ও দূর্দশার শিকার হাজার হাজার সাধারণ মানুষের খবর পৌঁছেছে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে পূর্বাঞ্চল সবসময় পশ্চিম দ্বারা শোষিত হয়ে এসেছে। ভারতীয় অঞ্চল দ্বারা ১১০০ মাইল দূরত্বে অবস্থিত অঞ্চলদুটি ভাষা, সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পূর্ব পাকিস্তান সবসময় উপনিবেশ, কাঁচা পাটের উৎস এবং পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্যের আবদ্ধ বাজার হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। আমেরিকার সাহায্য এবং বৈদেশিক রাজস্বের অধিকাংশই শাসনকর্তা পশ্চিম পাকিস্তানিদের পকেটে চালান হয়ে গেছে। বাঙালীদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের আচরণ ছিল ঘৃণাপূর্ণ এবং উপেক্ষার।
পাশবিকতার দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ভিত্তি নষ্ট করে দেয়া, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হত্যা এবং কারাবাস দেয়ার মাধ্যমে তাদের এই ঘৃণা প্রকাশিত হয়েছিল এবং তা এখন সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে উদ্দীপ্ত করছে। তাদের এই উপেক্ষার জবাব পরিণামে পাওয়া যাবে। শেষপর্যন্ত তা জয়ী হতে পারবে না। পূর্ববাংলা গেরিলা যোদ্ধাদের জন্য এক আদর্শ অঞ্চল এবং প্রথাগত যোদ্ধাদের জন্য নরকস্বরূপ। সেখানে চলাচলের রাস্তা খুবই কম এবং বর্ষাকালে তৃণভূমি ও ধানক্ষেতও খালে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পকারখানার কেন্দ্রগুলোকে উড়িয়েও তাদের খোড়া করে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ খুবই সোজা, সেগুলো প্রতিটিই পশ্চিম পাকিস্তানে। এমনকি তারা ঢাকা বা যশোরের মত শহরকে ধ্বংস করেও পূর্ব পাকিস্তানকে ভেঙে দিতে পারবে না। কারণ, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অঞ্চলই গ্রাম এবং তা ৫৫১২০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে অবস্থিত যা বোমাবাজির মাধ্যমে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। পুরো বিশ্বই পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর ক্ষুব্ধ এবং দেশটি সবার কাছেই ঘৃণার চোখে বিবেচিত। ঢাকা বিমানবন্দর উড়িয়ে দেয়ার ফলে বস্তুত পাকিস্তানি সৈন্যরাই প্রতিকূলতার সাগরে পরিত্যাক্ত হবে।

আমেরিকার নিরপেক্ষতা এবং নাক না গলানো আচরণের পুরোটাই ধোঁকাবাজি। পাকিস্তানে এর প্রচুর ক্ষমতা রয়েছে (১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এটি শিল্পক্ষেত্রে ৩০০ কোটি এবং প্রতিরক্ষা খাতে ২০০ কোটি ডলার সাহায্য পেয়েছে)। গত অক্টোবরে আমেরিকা ১ কোটি ডলারেরও ওপরে অস্ত্রসস্ত্র বিক্রির জন্য মধ্যস্ততায় এসেছে। এটা খুব দ্রুতই তাদের পাওয়ার কথা। অস্ত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আমেরিকা ১৯৬৫ সালের ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধকে কোণঠাসা করে দিয়েছিল। আমেরিকা যদি এখনই এর সাহায্য বন্ধ করে দেয় এবং একইসাথে বিশ্বব্যাঙ্ক ৩০ জুন পর্যন্ত এর ভিতর ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দেয় তাহলে পাকিস্তান আড়াই মাসের ভিতর দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে (ওয়াশিংটন পোস্ট, এপ্রিল ১১)। সংক্ষেপে, কথার মত কাজেও আমেরিকাকে নিরপেক্ষ হতে হবে।

অথবা তারা তাদের স্বার্থের জন্য পূর্বাবস্থান বজায় রাখতে পারে। তারা এই নির্বিচার হত্যা বন্ধ করতে পারে এবং এর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানকে তাদের চীনের কাছে হারাতে হবেনা। সেটা ১৯৬৫ সালেও হয়নি। চীন শুধুমাত্র পাকিস্তানের পদ্ধতির সাথে তাল মিলাতে না পেরে তাদের সাহায্য করতে পারেনি। পাশাপাশি পাকিস্তানকে তোষামোদ করা ‘পুঁজিবাদী’ শোষকগোষ্ঠী’র পক্ষে থাকা জনপ্রিয় একটি আন্দোলনের বিরোধীতার দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে।

অপরপক্ষে, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ যেভাবেই হোক না কেন, আমেরিকা যদি পরিণামে বিজয়ীর বদলে অদূরদর্শীতার নিদর্শন দেখিয়ে আপাত দৃষ্টিতে বিজয়ী পশ্চিম পাকিস্তানকে সাহায্য করে তবে একে অনেক কিছুই হারাতে হবে। এর ফলে আরেকটি ভিয়েতনামের পরিণতি আমাদের দেখতে হতে পারে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়া আওয়ামীলীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান একজন নিয়ন্ত্রিত পাশ্চাত্যমনা ব্যক্তিত্ব। তাঁর ছয় দফা দাবী পূর্ব পাকিস্তানের শিকার হওয়া রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাকে নতুন রূপ দিতে পারত যেখানে জাতীয় ‘অখন্ডতা এবং ঐক্য’ ধরে রাখাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের প্রথম প্রিয় পন্থা। পূর্ব বাংলাকে এখনও পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক ভেবে সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে; নির্বাচনে বামপন্থী আওয়ামী দল খুব কমই সমর্থন পেয়েছে এবং পশ্চিম বাংলার মাও নকশালরাও আর পূর্বের দিকে এগোয়নি। কিন্তু ব্যর্থতা এবং হতাশা নিয়ন্ত্রিতদের শুধু চরমপন্থীই বানিয়ে দিতে পারে। মুজিবুর রহমানকে কারাবাস দেয়া এবং তাঁর শহীদ হওয়া আরেকটি হো চি মিন ঘটনার জন্ম দিতে পারে।

এই কারণ এবং প্রভাবগুলো জনাব ম্যাক্লস্কি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দ্রুত বিবেচনায় আনতে হবে।
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!